পাতা বাহার পর্ব ৩০
বেলা শেখ
হৈ চৈ হুল্লোড় মুখর পরিবেশ এখন শান্ত পরিবেশে বদলে গেছে। গাছে গাছে বিদ্যমান নিশাচর ভবঘুরে বিহঙ্গের দল যেন জানে প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মা বাবুই তার বাচ্চাগুলো নিয়ে সংশয়ে জেগে আছে। তবে বাচ্চার দল নিশ্চিত মনে মায়ের ডানার ছায়ায় মুড়ে।
আভারি নিজ ঘরে নিজ বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। ঘুমিয়ে আছে বলতে শুধু নেত্রযুগল বন্ধ করে ঘুমের অভিনয় করার প্রয়াসে। বন্ধ নেত্রযুগল পিট পিট করা তার মোক্ষম প্রমাণ। মিনু তার পায়ের কাছে বসে পা গুলো টিপে দিচ্ছে আস্তে আস্তে। মাঝে মাঝে ডাকছেও। কিন্তু আভারি মটকা মেরে শুয়ে দাঁত কটমট করছে জবাব দিচ্ছে না। মিনু বেশ কয়েকবার ডাক দিয়েও সারা না পেয়ে বিরক্ত হয়। পা টিপা বন্ধ করে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে বসে বলে,
-” আপনে কিন্তু এবার বাড়াবাড়ি কইরতেছেন! ভোর বাবার মতো জেদ ধইরে বসে আছেন। আরে বাবা অরুণ স্যারের বন্ধুরা মজা করে আমার আপনের লগে। আপনি বুঝেন না খালি চ্যাতেন!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এবার কাজ হয়। আভারি উঠে বসে, পা দুটো টেনে নেয় নিজের কাছে। দাঁত কপাটি কটমট করে বলে,
-” আমি তো বাড়াবাড়িই করি! ওই পোলারা কমকম করে। আমি ফুল দিলাম, ‘বুইড়া কালে এইসব খোঁপায় দিলে লোকে কি কইবে’ আর ওই ছোকরা গুলো দিলো তহন বুইড়া ছিলে না? কুড়ি বছরের ছুরি ছিলা? আবার খোঁপায় গুঁইজে দিল! সে কি লজ্জা ! বাহ্ কি রোমান্টিক দিশশো!”
মিনু মুখ টিপে হাসে। এই লোক তো ভোরের থেকেও বেশি ছেলেমানুষী করে। সে হাই তুলে বলে,
-” আপনের জ্বলে?”
আভারি যেন জ্বলন্ত চোখে চায়। মিনু তার চাহনিকে থোরাই ভয় করে। সে বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়ে। আভারিকেও টেনে শুয়ে দেয়। স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে বলে,
-” আপনে একটা পাগল!”
আভারির অভিমান অভিযোগ গলে পড়ে যায়। মুখশ্রী জুড়ে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
-” তুমি পাগলের বউ পাগলি! বুঝলে?”
‘হুম’ বলে মিনু হাসে। হাসতে হাসতেই খেয়ালে ডুবে অন্যমনস্ক হয়ে যায়।
-” স্যারের নতুন বউ পাতা মাইয়াটা ভালোই, তাই না? ভোর বাবারে কত্তো আদর করে। ভোর বাবার এহন এই মিনু খালার দরকার পইড়বে না, তাই না?”
আভারির হাসিমুখেও বিষাদ নামে। ছোট্ট ছেলেটা তাদের নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানের অনুভূতি কিছুটা হলেও অনুভব করিয়েছে। ছোট্ট ভোর স্কুলে যাওয়া শুরু করার পর অরুণের সাথে অফিসে যেতো না। স্কুল থেকে ফিরে তাদের সাথেই থাকতো বেশিরভাগ সময়। ছোট খাট আবদারের ঝুলি নিয়ে আসতো মিনুর কাছে। ‘মিনু খালা নুডুলস বানিয়ে দাও!’ নুডুলস খাইয়ে দাও’ ভারি কাক্কুকে বলে চুপিচুপি আইসক্রিম আনিয়ে দাও? আমার সাথে ক্রিকেট, ফুটবল খেলো!’ রাজকন্যার গল্প শুনাও? মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দাও? আরো কতশত আবদার। নতুন আম্মু আসায় আর কি সেসব আবদার নিয়ে আসবে তাদের দুয়ারে? কি জানি! সে মিনুকে জড়িয়ে বলে,
-” ভোর বাবার আম্মু, আম্মুর জায়গায়। মিনু খালা, মিনু খালার জায়গায়। কেন দরকার পইড়বে না তোমারে? দেইখো সকাল হলেই ছুটে এসে বলবে ‘মিনু খালা আমাকে আলুর পরোটা বানিয়ে দাও সবার আগে। শুধু আমাকেই দিবে অন্য কাউকে দিলে তোমার সাথে কথা নেই বুঝলে!”
মিনু হেসে ওঠে আভারির বলার ভঙ্গিমা দেখে। আভারি তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।
-” ঘুমাও মিনু!”
মিনু আভারির বুকে মাথা রেখে শান্ত মলিন কণ্ঠে সুধায়,
-” আল্লাহ আমার ঘরে কেন ওমন একটা রাজপুত্তুর দিলো না বলেনতো?”
অরুণ সরকার বিছানায় শুয়ে আছে চিৎ হয়ে। আর ভোর নরম বিছানা ছেড়ে শক্ত বিছানায় বালিশ বিহীন শুয়ে আছে। সেই শক্ত বিছানা তার বাবা আর বালিশ বাবার বুক।এর থেকে শান্তিময় আরামদায়ক বিছানা বালিশ কখনো হয়? ভোরের নয়ন জোড়া নিদ্রায় আচ্ছন্ন থাকলেও অরুণের চোখে ঘুমের রেশ মাত্র নেই। সে তো থমথমে মুখে ঘূর্ণায়মান তার ঘরের ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে ব্যস্ত। আর ঘুর্ণিঝড়ের নাম পাতাবাহার! এক পাতাবাহার থমথমে মুখে কাপড়চোপড়ে এলোমেলো ঘর গোছাচ্ছেন। আরেক পাতাবাহার চার হাতপায়ে তার সখির পিছু পিছু ঘুরে সাহায্য করার চেষ্টায়। কিন্তু সখি তাহার সাহায্য নিচ্ছেন না বরং দূরছাই বকাবকি করে সরিয়ে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে এক পাতাবাহার লেজ নাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে মিও মিও করে সখির নামে নালিশ জানিয়ে তার পা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল। অরুণ হামি তুলে পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” ঘুম পাচ্ছে আমার।”
-” মানা করেছে কে!”
ত্যাড়া তীক্ষ্ণ জবাব যেন ঠোঁটের আগায় ছিল। বলার সাথে সাথে উত্তর। অরুণ গলা খাঁকারি দিয়ে থমথমে গলায় বলে,
-” লাইট জ্বললে ঘুম আসে না আমার।”
পাতা শব্দ করে আলমারি লাগায়, যার দ্বারা বোঝাই যাচ্ছে মহারানী রেগে বোম! অরুণ পাতার আপাদমস্তক দেখে। এইটুকুনি মেয়ে সালোয়ার টপসে আরো কমবয়সী লাগছে।ফু দিলেই উড়ে যাবে সে অরুণ সরকারের সামনে রাগ দেখায়। এক চটকানা পড়লে রাগ বাপ বাপ করে পালাবে। পাতা আলমারি বন্ধ করে ওয়াশ রুম থেকে ঘুরে আসে। তারপর বিছানা থেকে একটা বালিশ ও কম্ফোর্ট টা টেনে নিয়ে সোফায় বসে। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। ধমকের সুরে বলে,
-” কি হয়েছে? আবার কোন নাটক শুরু করলে?
পাতা নীরব রিসেপশন শেষ হওয়ার পর থেকেই। সেই নীরবতা ভেঙ্গে এবার শান্ত ভঙ্গিতে বলে,
-” কিছুই হয় নি। ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম!”
অরুণ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলে,
-” বাপের বাড়ি যেতে পারোনি বলে জেদ দেখাচ্ছো? চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ো!”
পাতা যায় না বিছানায়। জেদ করে বসেই থাকে। চোখের কোটরে নোনাজলের আভাস দেখা দিচ্ছে। পাতা ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে বাঁধা দেয়।
-” আমি তো স্যরি বলেছিলাম আপুর হয়ে। আমি আপুকে সেভাবে বলি নি! আপু জিজ্ঞেস করেছির আমি শুধু মাথা নেড়েছিলাম! আমার মাথায় ওতশত খেয়াল আসে নি।”
অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে চায়।
-” যা হওয়ার হয়েছে। বাদ দাও! ঘুমিয়ে পড়। রাত অনেক হলো!”
-” রিসিপশনের পর ওবাড়ি যাওয়া একটা কনভেনশন ছিল। আপনাকে কত অনুরোধ করলাম ক্ষমাও চাইলাম। আপনি গেলেন না। আব্বু আম্মু বাকি সবাই কি ভাবলো? আপুর কথায় খারাপ লেগেছে মানলাম কিন্তু বাকি সবাই? ওদের সম্মানের খাতিরেও যেতে পারতেন। কিন্তু না আপনি তো নাক উঁচু দাম্ভিকতায় ভরপুর ম্যানারল্যাস লোক।”
রাগি সুরে ঠেকে ঠেকে বলে পাতা। কান্নায় গলা জড়িয়ে আসতে চাইছে। অরুণ চোখ বুজে বলে,
-” জানোই তো আমি এমন। তারপরও.”
-” হ্যাঁ জানি তো! বিশিষ্ট ব্যবসায়ী স্বনামধন্য ব্যাক্তি আপনি। আপনার মতো ধন্যমান্য লোক কি আর মধ্যবিত্তের ঘরে রাত কাটাবেন? ক্যাটাগরি মেইনটেইন করে চলতে হবে না?”
পাতার উপহাসের গলা। অরুণের চোয়াল শক্ত হলেও নম্র গলায় বলে,
-” বেশি বোঝো তুমি।এখন মাথা গরম আছে তোমার। ঘুমিয়ে পড়ো এখানে এসে। পড়ে কথা হবে!”
পাতা শোনে না তার কথা। বালিশ ফিক্কে সোফার কিনারায় রেখে শুয়ে পড়ে। কম্ফোর্ট দিয়ে নিজেকে মুড়িয়ে নেয়। তার সখি পাতাবাহার বিছানার কিনারায় এসে মিও মিও করে বকছে নাকি এখানে আসতে বলছে কে জানে! অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লাইট ওফ করে দেয়। হঠাৎ মাথায় কিছু আসে। সে গলা খাঁকারি দিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” মিসেস পাতাবাহার? গুড নাইট। হ্যাভ আ সুইট ড্রিম। বাট সাবধানে হ্যাঁ? আমার বেলকনিতে তিনটা ভূতের বাচ্চা আছে, একদম আপনার মতোই কিউট দেখতে। এমনিতে ভদ্র বাচ্চা তবে মাঝেমধ্যে একটু আকটু দুষ্টুমি করে।”
বলে ছেলেকে বুকে নিয়েই পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে। পাতা চোখ বড় বড় করে উঠে বসে। ভূত!! সত্যি আছে নাকি? থাকুক না থাকুক সে তো শেষ! পাতা ঢোক গিলে বলে,
-” নাক উঁচু ম্যানারলেস বাজে লোক একটা। মিথ্যে বলে আমার দূর্বলতায় আঘাত হানেন? আপনি একটা যা তা! আমি ভোরকে সব বলে দেব!”
অরুণ চুপচাপ শুয়ে থাকে। বড়শিতে ফাঁদ পেতে জলে ফেলেছে এখন মাছের রানি ফাঁদে পা দিল বলে। ‘শালার জামাই! তোর বউ তোর মাথায় উঠে সালসা ড্যান্স করবে, দেখে নিস।’ পাতা আড়চোখে বেলকনির দিকে চায়। লাইট জ্বলছে. ভূত টুত কিছু দেখা যাচ্ছে না তবুও পাতার মনে হচ্ছে এখনি বড় বড় চোখ করে হি হি করে হেসে ভেটকাবে। ওই তো দিলো বলে? পাতা ব্যাগপত্র সমেত নিজ স্টেশনে হাজির হয়। ধপাস করে বিছানায় বসে। অরুণ এবার হেসে ওঠে খুব ধীর আওয়াজে। তার ক্ষীণ কণ্ঠের হাসি পাতার কানে আসা মোটেও উচিত ছিল না। হাসির আওয়াজে পাতা সর্বাঙ্গ যেন রাগে গড়াগড়ি খায়। ওপাশ ফিরে শুয়ে থাকা অরুণের উপর হামলে পড়ে। বাহুতে কিল বসিয়ে দেয় গোটা তিনেক।
-” শালার জামাই! খুব হাসি পাচ্ছে। দাঁত গুলো খুলে নিয়ে ভূতের মায়েদের কাছে দিয়ে আসবো!”
অরুণের উপর হামলে পড়ার দরূণ বিড়াল শাবকটি লাফিয়ে উঠে পাতার সামনে হাজির হয়ে মিও মিও বলে চেঁচাতে লাগলো। পাতা তাকেও হাত দিয়ে সরিয়ে দেয় ঝটকা মেরে, এসেছে কর্তার রক্ষা কর্তী। বিড়ালটা আবার তেড়ে আসে। অরুণ হতবাক। এই মেয়ে তাকে মারছে? অরুণ সরকারকে! এ আদৌ ঘটছে নাকি তার ভ্রম মাত্র! এইটুকুনই মেয়ে গায়ে নেই দেড় কেজি মাংস, সে কিনা তাকে মারে। তার বন্ধুরা জানলে রাসেলের কাছে থাকা সরকারী বস্তুটা নিজের মাথায় ঠুকে গুড বায় জিন্দেগি বলে পটল তুলতো। সে পাশ ফিরে পাতার দিকে চায়। আবছা আলোয় চোখাচোখি হতেই পাতার হাত থেমে যায়। অরুণ ধমকে বলে,
-” এক থাপ্পড়ে চাপার সবকটি দাঁত খুলে ফেলবো বেয়াদব। হাত বেশি লম্বা হয়েছে?চুপচাপ ঘুমাও?”
ধমকে বিড়ালছানার মিও মিও বন্ধ হয়। লেজ নাড়িয়ে দৌড়ে ভোরের হাঁটুর ভাঁজ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। আর পাতা চুপচাপ কম্ফোর্ট মুড়িয়ে শুয়ে পড়ে। লোকটার ধমকে তার ছোট্ট হৃদয়খানি এখনো কম্পমান অবস্থায়। নাক ভরে ওঠে, চোখের পানি বাঁধনছাড়া হয়ে পড়ে। ভূত, অন্ধকারে ভয় তার কিশোরী বয়স থেকে। ভয়ের শুরু হয় এক বাদলা নির্জন রাতে। সেদিন দুপুরেই বাবা মা সহ সকলে ফুপুর বাড়িতে বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছিল। পাতাও যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছিল কিন্তু যাওয়া হয় নি। বাবা বলেছিল,
-” মা একলা বাড়িতে থাইকবো নাকি?পাতা থাইক বাড়িতে। আর তাছাড়াও ওখানে ওরে নিয়ে গেলে নানান জন নানা কথা কইবো! পালক বাচ্চা হাবিজাবি ওর কানে গেলে ওই কষ্ট পাইবো! তার চেয়ে ভালো এখানেই থাক!”
পাতার আর যাওয়া হয় না। একলা বাড়িতে দাদি আর সে অবস্থান করে। সন্ধ্যার পরেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। পাতা নিজের ঘরেই বসেছিল, শুনশান নীরবতায় ভয় লাগতে শুরু করে। সে দৌড়ে দাদির ঘরে গিয়ে তার পাশে শুয়ে পড়ে। আকলিমা বেগম বুঝতে পেরে পিঠে এক ঘা বসিয়ে পান খাওয়া টকটকে ঠোঁট নাড়িয়ে বলে,
-” দূর হো ছেমড়ি! যা আমার ঘর থাইকা। তোরে দেখলেই আমার গা জ্বলে। আমার পোলার অন্ন ধ্বংস করে ফুর্তি করস!”
পাতা আর থাকে না। ভয় মনেই নিজের ঘরে আসে। দরজা শক্ত করে লাগিয়ে মোমবাতি খুঁজে বের করে। দেয়াশলাই খুঁজতে নিলেই কারেন্ট চলে যায়। পাতা হাতরিয়ে হাতরিয়ে খোঁজার প্রচেষ্টায়। কিন্তু পায় না। এদিকে কালো ঘনঘটা অন্ধকার। বৃষ্টির এলোমেলো শব্দ পাতার কানে কেমন যেন ভয়ংকর শোনায়। পাতা গলা উঁচিয়ে দাদিকে ডাকে অনেকবার, সারা পায় না। পাতা অন্ধকার হাতরে বিছানায় শুয়ে চাদর টেনে ঢেকে নেয় আপাদমস্তক। চিল্লিয়ে ‘দাদি দাদি’ ডাকতে থাকে। কিন্তু কেউ আসে না। পাতা ভয়ে কেঁদে দেয় শব্দ করে। ফোঁপাতে ফোঁপাতে কিছু আওয়াজ কানে আসতেই শরীর যেন হিম হয়ে ওঠে। কেমন বিদঘুটে হাসির আওয়াজ! পাতা
ভয়ে কেঁদে কেঁদে বলে,
-” দাদি তুমি হাসছো? দেখ আমি ভয় পাচ্ছি অনেক! দাদি কথা বলছো না কেন?”
হাসি থেমে যায় হঠাৎ করে। কিছু পল নীরবতা ভেঙে আবার ক্রন্দনরত সুর ভেসে আসে, সাথে ঠক ঠক ভুতুড়ে আওয়াজ । পাতা চিল্লিয়ে কাঁদে। দাদি আসে না। কাঁদতে কাঁদতে পাতার গলার স্বর ভেঙে আসে তবুও চিল্লাতে থাকে। প্রকৃতি যেন সেদিন ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছিল। ঝড়ো বাতাসে শম শম আওয়াজ, গাছের ডালের মট মট করে ভেঙ্গে পড়ার শব্দ! সব পাতার কাছে ভূতুড়ে কারবার মনে হয়। সে দাদি দাদি বলে কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়ে জানে না। সকাল ভোরে বিদঘুটে গন্ধ নাকে আসলে ঘুম ভাঙ্গে। পাতার মস্তিষ্ক সচল হয় রাতের ভয় ঘিরে ধরে। কিন্তু সব সূর্যের আলোয় আলোকিত দেখায় তনুমন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বিছানা ছাড়ার সময় ভেজা অনুভব করে, বুঝতে অসুবিধা হয় না বিদঘুটে ঝাঁঝালো গন্ধটা কিসের! পাতা ঠোঁট উল্টিয়ে কেঁদে ওঠে মৃদু স্বরে। তারপর চুপ হয়ে যায়। তারপর টানা নয়দিন সে জ্বরে ভুগে ছিল।
-” আবার কি শুরু করলে? কাঁদছো কেন?”
অরুণের বিরক্তিকর স্বর কানে বাজতেই পাতার ভাবনাচ্ছেদ হয়। দুহাতে চোখ ডলে বলে,
-” শখে কাঁদছি! আপনি কাঁদবেন? আসুন গলা জড়িয়ে কাঁদি দুজন মিলে!”
-” ফাজলামি হচ্ছে আমার সাথে?”
-” আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা!”
এই মেয়ে নাকি শান্ত শিষ্ঠ নরম! প্রত্যেকটা কথার জবাব দিতে হবে, তাও ত্যাড়াবাঁকা! একদম ঝগরুটে। অরুণ ছেলেকে ছাড়িয়ে উঠে পড়ে। পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ছিঁচকাদুনে মেয়ের আমার ঘরে জায়গা নেই! বাইরে গিয়ে কাঁদো, যাও?”
পাতা সরাসরি অরুণের দিকে চায়। তাকে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে লোকটা? পাতা মনে মনে কষ্ট পায়, ইচ্ছে করে বেড়িয়ে যেতে। কিন্তু যাবে কোথায় এই রাত্রি বেলায়! সে নাক ডলে বলে,
-” যাবো না। মনে রাখবেন ঘরটা আপনার একার না, আমারো। এখন আপনার সমস্যা হলে আপনি যেতে পারেন।”
অরুণ চোখ উল্টিয়ে মুচকি হাসে। এই মেয়েটাও না! সে রিমোট হাতরিয়ে খুঁজে লাইট জ্বালিয়ে দেয়। বিছানা থেকে নেমে ড্রেসিন টেবিলের সামনে যায়। পাতা বিছানায় হাত ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়। লোকটা কি তাকে জোড় করে বের করে দেবে? অরুণ টিস্যু বক্স এনে কিছু টিস্যু বের করে পাতার নাকে চেপে ধরে। পরিষ্কার করে ব্যবহারকৃত টিস্যু বিণে ঢিল ছুড়ে। আবার টিস্যু বের করে ভালোভাবে মুছে দেয় চোখ, গাল, নাক ।
-” ছেলেও ছিঁচকাদুনে ছেলের আম্মুও ছিঁচকাদুনে! মনে হচ্ছে বাকি সারাটা জীবন ছেলের ও তার আম্মুর নাক মুছতে মুছতেই কেটে যাবে!”
পাতা হা করে চেয়ে আছে অরুণের দিকে। ব্যপারটা ভালো লাগে বেশ। কান্না সে ভূলে গেছে। এরকম যত্ন করলে কান্না করা যায়? যায়, সুখের কান্না। পাতার কাছে সর্দি খুবই বাজে একটা জিনিস; নিজের সর্দি তার নিজের কাছেই ঘৃণা লাগে। অথচ লোকটা!!! পাতার অন্তঃপুরে অসংখ্য ভালোলাগার প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে এলোমেলো কিন্তু সব গুলো বেরঙিন, কেন? অরুণ ততক্ষণে লাইট ওফ করে বালিশে মাথা রেখেছে। পাতাকে স্টেচু হয়ে আধশোয়া অবস্থায় দেখে টেনে শুইয়ে দিয়ে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। তৃতীয় বারের মতো নববধূয়ার ললাটে অধর স্পর্শ করে বলে,
-” সব রাগ অভিমান ছুড়ে ফেলো হুম? আর মনে রেখ স্বামী স্ত্রী একে অপরের পোষাক স্বরূপ। আমার দিকে কাঁদা ছুঁড়লে সেটা তোমার গায়েও লাগবে তেমনি তোমার দিকে ছুঁড়লেও আমার গায়ে লাগবে। তাই ভেবেচিন্তে কদম ফেলবে। আমাদের মধ্যে ঝগড়া, কলহ, মান অভিমান, রাগ, ভালোবাসা যাই থাক সেগুলো শুধু আমাদের একান্তের। সেগুলো কেন অন্যের কানে যাবে? ভোরের আমাদের সাথে থাকা না থাকা সেটাও আমাদের একান্তের ব্যাপার অন্যরা কেন নাক গলাবে? একটু রেগে ছিলাম প্রথমে। এখন নেই তো। তুমিও রেগে থেকো না। ঘুমাও!”
পাতার অন্তঃপুরে ডানা মেলে উড়তে থাকা বেরঙ প্রজাপতি গুলোর মধ্যে রামধনুর রঙে রঙিন হয়। মনের খুশিতে উড়ে আনন্দ প্রকাশ করতে থাকে। পাতা অরুণের কটি সংযোগে হাত গলিয়ে দিয়ে উন্মুক্ত পিঠ আকরে ধরে। বুকে মাথা গুঁজে পরম আরামে চোখ বুজে। তীব্র পুরুষালী গন্ধ নাকে টেনে নেয়, হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত হয়। পঁচিশ বছরের জীবনে কারো উপরে মান অভিমান করে ছিল কি? এতো এতো নাটকীয়তা ঘেরা জীবনে সকলের নিষ্ঠুর কঠোর অবদান পাতা খুব অল্প সংখ্যক মানব মানবীর উপরেই মান অভিমান করেছে তবে কখনো মুখ ফুটিয়ে বলে নি আর না কোনো প্রকার আচরণে বুঝিয়েছে যে, সে অভিমান করেছে তার উপর। অথচ এই লোকটার উপর সে অভিমান করেছিল, ঝগরা করে সেটা বুঝিয়েও দিয়েছে। আর লোকটা তার অভিমান ভেঙেছে। পাতা পণ করে সে ভবিষ্যতে আরো অনেক অভিমান করবে! মিছিমিছি তো কখনো সত্যি। পাতার অধরকোণে হাসি ফুটে উঠল। তার লজ্জা পাচ্ছে না এমন না! তার লজ্জাও লাগছে বেশ, তবে তার থেকে বেশি ভালো লাগছে। আর লজ্জা লাগলেও বা কি? লোকটা তো তারই একান্ত ব্যক্তি! তাহলে লজ্জাকে একটু সাইডে রেখে ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিলে কি সে জামাই পাগলি বনে গেছে নাকি??
অরুণ পাতার চুপ করে যাওয়া দেখে চোখে হাসে। মেয়েটাও তার কলিজার মতোই আদর, ভালোবাসার কাঙালীনি! একটু আদর করে বুকে টেনে নিয়েছে ব্যস, রাগ গোস্বা গায়েব মুড অন। অরুণ পাতার চুলের রেবন খুলে দেয়। চুলের মাঝে হাত গলিয়ে বুলিয়ে দিতে থাকে। পাতা এক পা অরুণের উপর তুলে দিয়ে বিড়ালছানার মতো বুকটায় আরেকটু সেঁটে যায়। অরুণের ভ্রু কুটিতে ভাঁজ পড়ে। তন্মধ্যে আরেকটি ছোট্ট হাত পেছন থেকে তার পেটে জড়িয়ে, ছোট পা তুলে দেয়। অরুণ একহাত বাড়িয়ে ছেলেকেও কাছে টেনে কম্ফোর্ট দিয়ে ঢেকে দেয়। বিড়ালছানা পাতার ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগ নিয়ে পাতার পাশে ঘেঁষে মিও মিও করে গা এলিয়ে দেয়। অরুণ চোখে মুখে হাসে; তার ছোট্ট সংসার!
মাঝরাতে শীতের দরূণ পাতার ঘুম ছুটে যায়। বেশ ঠান্ডা লাগছে তার। সে পিট পিট চোখ খুলে। গায়ে কম্ফোর্ট নেই! কোথায় গেল? ম্যানারল্যাস লোকটার বুকটা থেকেও উষ্ণতা আসছে না! কোথায় গেল?পাতার মস্তিষ্ক সচল হয় পুরোপুরি। তার ডান হাতের উপর একটা পা তুলে দিয়ে হা করে নিদ্রায় মশগুল বিড়ালশাবক। পাতা নাক মুখ বিবৃতি করে সেই পা ছাড়িয়ে নেয়। পাশ ফিরতেই দেখতে পায় বাবা ছেলে একেঅপরকে জড়িয়ে শান্তির ঘুমে। কম্ফোর্টা গায়ে জড়িয়ে। পাতার মুখটা মলিন হয়ে আসে। বুকটাতে তো সে ছিল! ভোরকে কখন জড়িয়ে নিল? সে ঘুমিয়ে পড়তেই হয়তো লোকটা তাকে সরিয়ে ভোরকে নিয়েছে। পাতার মনটা খানিক বিষিয়ে ওঠে যেন!
লোকটাকে সবসময় ভোরের সাথে ভাগ করে নিতে হবে। ভাগ করে কি? লোকটা তো সরাসরি বলেই দিয়েছে পার্থিব জীবনে সবার আগে ভোর! বাকি সবাই পড়ে। সবার ভিড়ে পাতা কি আছে? আছে হয়তোবা কোনো কোণে। পাতা তার দ্রোহী ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণে আনে। এসব ভাবনা মাথায় আনলে ভোরের প্রতি তার মনটা বিষিয়ে উঠবে হয়তোবা। আর পাতা এটা কখনো চায় না।
পাতা বাহার পর্ব ২৯
সেদিন রাতে গাড়ির ভেতরে ভোরের আম্মু ডাকার মর্যাদা রাখবে সে। মায়ের আদর ভালোবাসার কাঙাল ছোট্ট ভোরকে সে সাধ্যমত আদর ভালোবাসায় ভরিয়ে তুলবে ইনশাআল্লাহ। আর স্বামী নামক লোকটাকে আগলে সারাটা জীবন যেন কাটিয়ে দিতে পারে সাধ্যমতো সেই চেষ্টাতেও ত্রুটি রাখবে না ইনশাআল্লাহ। পাতা নিজেকে খুব ভালো ভাবে চেনে। সে লোকটার উপর ক্ষণে ক্ষণেই দূর্বল হচ্ছে। সেই দূর্বলতা কোথায় গিয়ে পড়ে দেখা যাক!