পাতা বাহার পর্ব ৩০(২)
বেলা শেখ
মেঘলা আকাশ। হালকা বাতাসে পরিবেশ শীতলতম। লাবনী আক্তার টি টেবিলে চায়ের ট্রে রেখে স্বামী, ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” বাড়িটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, তাই না? কেমন গুমোট ভাব এসে গেছে। লতাটাও ছেলে মেয়ে নিয়ে চলে গেল! পাতা তো তার সংসারে!”
আতিকুর ইসলাম সায় জানালো।
-” ঠিক বলেছো!
-” পাতাটার কথা মনে পড়ছে বেশ! বিদায়ের ছয়দিন হয়ে গেছে! মনে হচ্ছে কতদিন হলো দেখি না! বুকটাও ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাড়িতে থাকলে পিছু পিছু ঘুরঘুর করতো! কিন্তু কিছু বলতো না। কতো বকতাম তবুও আম্মু আম্মু বলে মিনমিন করতো! তবে আপনি বাসায় এলে ও ঘর থেকেই বের হতো না তেমন!”
আতিকুর ইসলাম স্ত্রীর দিকে চায়। তারও কিছুটা মনে পড়ছে মেয়েটার কথা। কেমন আছে সে?
লুবমান চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
-” রত্ন কাছে থাকতে তো কদর করো নি তাহলে এখন দূরে পাঠিয়ে কেন আফসোস করছো? যতদিন তোমাদের কাছে ছিল দূরছাই না করলেও বুকেও টেনে নাও নি ভালোভাবে! লতার মতো পাতারও যদি যত্ন নিতে!!”
লাবনী আক্তারের মুখ মলিনতায় ছেয়ে যায়! ছেলের পাশে বসে যায়। অনুতাপে পোড়া মাতৃমন ছল ছল করে ওঠে।
-” ঠিক বলেছিস লুব! ভুল গুলো তো আমাদেরই! ভালো পাতাকেও বাসি! মেয়েকে ভালোবাসবো না? তবে হ্যা দূরে ছিল পনেরো ষোলোটা বছর! হয়তো জড়তার কারণেই ভালোভাবে বুকে নিতে পারি নি সেভাবে! সেই জড়তা বোধকরি কেটে যাচ্ছে! মেয়েটা..”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বলেই কেঁদে ওঠেন তিনি। আতিকুর ইসলামের কঠোর মনটাও মলিন হয়ে যায় অনুতাপের রেষে! ইশ মেয়েটার সাথে যদি একটু পিতৃসুলভ আচরণ করতো!! লুবমান মা’ কে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-” আম্মু? কেঁদো না তো! কাঁদলে সব ঠিক হবে? আর এই কান্নার কোনো ওয়ে আছে? যা হয়েছে হয়েছে! এখন ভবিষ্যতে পাতুটাকে একটু বেশিমাত্রায় ভালোবেসে পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করো! আর আব্বুকেও একটু বোলো! পাতা তারই রক্ত। ভালোবাসে সেটা দেখালে জাত চলে যাবে না! আর যদি না বাসে তাহলে একটু অভিনয়ই করলো না হয়!”
দুপুর গড়িয়ে বিকেল বেলা। সরকারবাড়ির প্রায় সকলেই বাগানের পাশে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের উৎসাহ প্রদান করছে। ভোর ও আনিকার জন্য সাইকেল এনেছে আরিয়ান। তারা দুজনেই সাইকেল চালানো শিখছে। সাথে সাইকেল নিয়ে যোগ দিয়েছে আদুরি, আরিয়ান ও রুবি। ওরা তিনজনও সাইকেল চালাচ্ছে। আনিকার ছোট্ট সাইকেলে চার চাকা হওয়ার দরুণ সে প্যাডেল ঘুরিয়ে অল্প অল্প করে এগিয়ে যেতে পারছে। কিন্তু ভোর পারছে না। তার সাইকেলে তিন চাকা! মানে বাম পাশে এক্সট্রা ছোট চাকা আছে যেটা ইউজ করাও যায় আবার তুলে রাখাও যায়। ভোর ভয়ে ভয়ে সাইকেলে বসে চালানোর চেষ্টা করছে। মিনু ও পাতা তাকে সাহায্য করছে । ভোর সাইকেলে প্যাডেল ঘুরিয়ে একটু যাওয়ার পর পাতা ও মিনু ছেড়ে দেয়! ভোর চোখ বড় বড় করে সাইকেল ছেড়ে দিয়ে বলল,
-” আব্বু গো! ও মিনু খালা ! ও আম্মু! পড়ে গেলাম! ধরো আমাকে! এই?”
পাতা, মিনু গিয়ে ধরে সাইকেল ও ভোরকে। আভারিসহ উপস্থিত সকলে হেসে উঠলো জোড়ে। ভোর গাল ফুলিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” ভারি কাক্কু তুমি হাসছো? তোমার সাথে কথা নেই বলে দিলাম!”
আভারি হাসি থামিয়ে কান ধরে স্যরি বলে। ভোর মুখ ফিরিয়ে নেয়। তন্মধ্যে আরিয়ান আসে সাইকেল নিয়ে। ভোরকে বলে,
-” ভোর? এভাবে সাইকেল চালানো শিখতে পারবে তুমি? কখনো না! আরে তোমার ট্রেইনার দুটোই সাইকেল চালাতে পারে না তোমাকে কি শেখাবে!”
ভোর চাচ্চুর কথা শুনে মুখ গোমড়া করে পাতা ও মিনুর দিকে চায়। মিনু সায় জানিয়ে বলল,
-” ছোট স্যার ঠিক কইছে ভোর বাবা! তুমি বরং তার কাছেই শিইখে নাও?”
ভোর খুশি হয়ে কিছু বলবে এর আগে আনিকা উপস্থিত হয় সাইকেল নিয়ে।
-” আব্বু তুমি এই পঁচা ভোরকে একটুও শিখাবে না! ওর আব্বুর কাছে থেকেই শিখুক না! তুমি শুধু আমাকে শিখাবে। সকালে বড় চাচিমনি একটু আদর করলো বলে আমার গালে চিমটি কেটেছে! ব্যাথাও পেয়েছি!”
কাঁদো কাঁদো গলায় বলল আনিকা। ভোর কাঁচুমাচু করে চায়। সত্যিই সে চিমটি জোরে কেটেছিল। এখন তো চাচ্চু তাকে শেখাবে না!
আরিয়ান আনিকার গালে হাত বুলিয়ে ভোরকে বলে,
-” সত্যিই ভোর? ও তো তোমার ছোট বোন হয়! বোনকে কেও মারে?”
ভোর মাথা নাড়ে! মারে না। আরিয়ান তার মাথার চুল এলোমেলো করে বলে,
-” ভোর আর মারবে না মামনি!”
-” নাহ্। ও আবার মারবে। আমি জানি তো। ভোর পঁচা দুষ্টু ছেলে!”
পাতা এতক্ষণ নীরব দর্শক হয়ে থাকলেও এবার ভোরকে বলে,
-” ভোর সোনা স্যরি বলো আনিকাকে? আর এসব কি শুনছি আমি? আমি তো জানতাম ভোর গুড বয়! গুড বয়েস’ কখনো ঝগড়া মারামারি করে? সে স্যরি ট্যু হার?”
ভোর গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে চেয়ে স্যরি বলে আনিকাকে। আনিকাও অন্যদিকে চেয়ে ভেংচি কাটলো। আরিয়ান পাতার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
-” ভোর! গুড বয়েস, গার্লস কখনো ঝগড়া করে না। ঝগড়াতো করে কিছু কুটনি কুচুটি মহিলা! শুনেছি তাদের চুল ছোট ছোট হয়! হাইটেও ছোট হয়! এইরকম বড় বড় করে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে! বুঝলে?”
পাতা মাথায় ওড়না টানে। সদ্য রসগোল্লার মতো চক্ষু যুগল স্বাভাবিক করে। ভোর পাতার দিকে একবার চেয়ে আরিয়ানকে জিজ্ঞেস করল,
-” সত্যিই?”
পাতা বিরোধীতা করে বলে,
-” একদম না ভোর! উনি বোকা বানাচ্ছে!”
-” এই মেয়ে বোকা বানাচ্ছি না সত্যিটা দেখাচ্ছি! ভোর ঝগরুটে মানুষ এভাবেই ঝগড়া করে!”
পাতা বিরক্তিকর শ্বাস ফেলে একবার পিছনে মুড়ে নিজ শাশুড়ি ও রুবির মায়ের দিকে চায়। তাদের অবস্থান দূরে হওয়ায় আঙ্গুল তাক করে বলে,
-” এই মেয়ে কাকে বলছেন? বড় ভাবী হই আপনার! সম্মান দিয়ে কথা বলবেন!”
-” ওরে আমার বড় ভাবী! এই আভারি ভাই? গেটের সামনের দোকান থেকে এক প্যাকেট সম্মান কিনে আনো তো!”
পাতা কটমট করে চায়। কিছু বলবে কিন্তু বলা হয় না। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হয় হুট করে। আরিয়ান তড়িঘড়ি করে মেয়েকে নিয়ে চলে যায় বাড়ির ভিতরে। ভোর পাতার হাত ধরে। মিনু টানে যায় না। অগত্যা মিনু সাইকেল নিয়ে ভিতরে যায়। সবাই চলে গেছে কিন্তু রয়ে যায় ভোর,পাতা, আদুরি ও রুবি! ওপাশ থেকে মিনু গলা উঁচিয়ে ডাকছে সবাইকে। কিন্তু তাদের ধ্যান নেই! বৃষ্টির বড় বড় ফোটা তাদের ভিজিয়ে দেয় মুহূর্তেই! ভোর নেচে ওঠে পাতার হাত ঝাঁকিয়ে। পাতাসহ আদুরি, রুবি হাসে। মেতে ওঠে সবাই বৃষ্টি বিলাসে!
মিনুর উঁচু গলা শুনে অরুণ সরকার ল্যাপটপ সাইডে রেখে উঠে বেলকনিতে যায়। তার পিছনে পাতাবাহার। লেজ নাড়িয়ে সেও চলল তার সাথে। অরুণ বেলকনিতে গিয়ে আশেপাশে তাকায়! বৃষ্টির মধ্যে আবছায়ায় দৃশ্যমান হয় বৃষ্টিবিলাসে আচ্ছন্ন রমনীদের। সাথে তার ভোর! পাশেই মিনু ডাকতে ডাকতে আসছে ছাতা হাতে। অরুণ গলা উঁচিয়ে ভোরকে ডাকে কয়েকবার। আনন্দে মাতোয়ারা ভোর শুনতে পায় না। কেউই শুনতে পায় না বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে। পাতাও না! তবে কেমন একটা অনুভুতি হওয়ায় সে আশেপাশে চায়। ঘার উঁচু করতেই বেলকনিতে অরুণকে দেখতে পায়। কিছু বলছে তাদের দিকে তাকিয়েই! চোখও রাঙালো। পাতা ইশারা করে বোঝায় শোনা যায় না! অরুণ হতাশ হয়ে বেলকনি ত্যাগ করে।
মিনুকে ছাতা হাতে দেখে ভোর বলে,
-” মিনু খালা একটু ভিজি প্লীজ? ও মিনু খালা প্লীজ?”
মিনু সাথে সাথে সাবধানী গীত গায়।
-” একদম না! সবসময় নাকে সর্দি নিইয়ে ঘোরেন! আবার বৃষ্টিতে ভেজা হইতেছে? এখুনি ওঠো ভোর বাবা! বড় স্যার খবর পাইলে তোমার খবর হইয়ে যাইবে! ওঠো?”
ভোর গিয়ে আদুরির পিছনে লুকিয়ে পরে। পাতার টনক নড়ে। সত্যি কথাই তো বলেছে মিনু আপা! তার তো এ কথা মাথায়’ই আসে নি। মিনু পাতার দিকে চেয়ে বলে,
-” বড় ম্যাডাম আপনে একটু বলেন ভোর বাবারে! স্যার জানলে রাইগে যাবে বাচ্চাটার উপর!”
-” তুমি চিন্তা কোরো না আপা! আমি নিয়ে যাচ্ছি!”
আদুরি ভোরের হাত ধরে পালিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” বড় ভাইয়ার একটু বাড়াবাড়ি! এইটুকু বৃষ্টিতে ভিজলে কিচ্ছু হবে না বড় ভাবী। গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিলেই হবে!”
পাতা ভোরকে ডাকে। ভোর আসে না।
-” ভোর সোনা? আসো? অনেক ভিজেছি তো! আমি কিন্তু রাগ করবো তোমার সাথে। কথাও বলবো না, আদর তো দূরে থাক!”
এবার কাজ হয়। ভোর থেমে যায়। আদুরির দিকে অসহায় চোখে চেয়ে পাতার কাছে ফিরে আসে। পাতা খুশি হয়। ভোরকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভিতরে যেতে যেতে আদুরি ও রুবির উদ্দেশ্যে বলল,
-” তোমরাও জলদি ওঠো! মেঘের ডাক শোনা যাচ্ছে। ভয় পেয়ে যাবে!”
পাতা গোমড়া মুখো ভোরকে কোলে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করে দেখে আনিকা কাঁদছে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য, আরিয়ান তাকে সামলাচ্ছেন। আসমা বেগম বকছে তাদের সবাইকে, তার নাম উল্লেখ করে নি যদিও! তাকে আসতে দেখে কেমন করে যেন চায়। পাতা মাথা নিচু করে নেয়। সিঁড়ির কাছে আসতেই অরুণের সামনাসামনি হয়! গম্ভীর মুখে এগিয়ে এসে ভোরকে কোলে তুলে নিয়ে তোয়ালে এগিয়ে দেয়। পাতা কাঁচুমাচু মুখে সেটা নিয়ে নিজেকে আবৃত করে রুমের দিকে পা বাড়ায়। অরুণ তার পিছু পিছু যায়।
ঘরে প্রবেশ করতেই কোথা থেকে বিড়াল ছানাটি ছুটে এসে সামনে দাঁড়ায়। মিও মিও করে লেজ নাড়লো। যেন বকছে! পাতা ছোট ছোট করে চায়। অরুণ ছেলেকে নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করে। পাতা তার অনুসারী। অরুণ ছেলেকে গোসল করিয়ে দেয় হালকা গরম পানিতে। ভোরকে তোয়ালে পেঁচিয়ে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” পাঁচ মিনিটের ভিতর এই গরম পানিতে গোসল করে বেরোবে! যাস্ট ফাইভ মিনিটস! ফাস্ট !”
বলেই বেড়িয়ে যায়। ভোরকে বিছানায় দাঁড় করিয়ে আলমারি খুলে শাড়ি সহ প্রয়োজনীয় কাপড় নিয়ে ওয়াশ রুমে রেখে আসে। ভোরকে প্যান্ট শার্ট পরিয়ে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে দিতে থাকে। ভোর অরুণের শার্টের বোতাম খোঁচাতে খোঁচাতে মিষ্টি করে আবদার করে,
-” আব্বু তুমি আমায় সাইকেল চালানো শিখাবে না? ও আব্বু?”
-” যে আমার কথা শুনে না আমি কেন তার কথা শুনবো?”
ভোর অসহায় গলায় বলল,
-” ও আব্বু? তুমি না আমার সোনা আব্বু! কলিজা আব্বু! আমি তো তোমার সব কথাই শুনি!
অরুণ ছেলের দিকে শান্ত চোখে চায়!
-” আমি কারো কলিজার আব্বু টাব্বু না। তুমি আমার একটা কথাও শোনো না!”
-” ও আব্বু? টাব্বু কি? আর আমি তোমার সব কথাই শুনি! তুমিই আমার একটা কথাও শুনো না!”
গাল ফুলিয়ে বলে ভোর! অরুণ কিছু বলে না। চুপ থাকে।
একটু পরেই তড়িঘড়ি করে পাতা বেরিয়ে আসে। এলোমেলো ভাবে শাড়ি পড়েছে। চুল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে! যার দরুন ব্লাউজের অনেকাংশই ভিজে।
-” পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেছে কি?”
ভোর মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়। পাতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে। অরুণের থমথমে মুখশ্রী দেখে ভোরকে ইশারা করে আবহাওয়া কেমন? ছোট্ট ভোর তার ইশারা বুঝতে অক্ষম।
অরুণ পাতাকে পর্যবেক্ষণ করে বলল,
-” পাতাবাহার এখানে বসো ফাস্ট!”
পাতা অরুণের ইশারাকৃত জায়গায় বসে বাধ্য মেয়ের মতো। অরুণ পাতার সম্মুখীন দাঁড়িয়ে তোয়ালে দিয়ে পাতার চুল মুছতে শুরু করে যত্ন সহকারে। পাতা থমকে যায়! অনুভূতিহীন চেয়ে রয় শূন্যে। আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠে নেত্রযুগল! জমতে শুরু করে নোনা জল! পাতা সেগুলো লুকিয়ে নেয় কৌশলে। কিন্তু !!অধরকোণে দখল নেয়া মিষ্টি হাসি সম্মুখে। লোকটা তার যত্ন নিচ্ছে! অবশ্য আরো অনেক ছোট খাটো যত্নের সম্মুখীন সে হয়েছে। লোকটা তাকে ছোট বাচ্চার মতোই ট্রিট করে যেন সেও ভোরের মতো কোনো বাচ্চা! পাতা ভোরের দিকে চায়। ভোরও তার দিকে তাকিয়ে। পাতা অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-” ছেলেটাকে বকেছেন আপনি? ওর কোনো দোষ নেই। ও তো আবদারও করে নি! ভোর বকেছে তোমায়?”
ভোর মাথা নাড়ে। বকেছে! অরুণ ভোরের দিকে চায়। ভোর পাতার গলা জড়িয়ে পিঠে মুখ লুকায়। অরুণ তোয়ালে দিয়ে পাতার চুল মুড়ে দেয়।
-“ভোরের বাবা! বকেছেন কেন ভোরকে? মুখটা শুকিয়ে গেছে ছেলেটার! বকা ছাড়া আর কিছু পারেন আপনি?”
পাতার কথায় অরুণ বুকে হাত গুঁজে খানিকটা ঝুঁকলো।
-” পারি তো! অনেক কঠোর পানিশমেন্ট দিতে পারি! দেখতে চাও মিসেস পাতাবাহার?”
পাতা অরুণের কপালে হাত রেখে সরিয়ে দিয়ে বলে,
-” ভয় দেখাচ্ছেন? কিন্তু আপনাকে বলে রাখি এই পাতা আপনাদের মতো ম্যানারল্যাস লোকদের ভয় করে না। বরং ভয় দেখায়!”
অরুণ ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
-” তা পাবে কেন? তুমি তো ব্রেভ ওমেন! শুধু রাতের অন্ধকারে ভুত টুতকে একটু ভয় পাও! জানি আমি! আর ভয় পাও না আমায়? দেখাবে? ভয়?”
পাতা গম্ভীর মুখে চায়। কিছু বলে না। অরুণ মুচকি হেসে পাতার গাল টিপে দিয়ে সোফায় ল্যাপটপ নিয়ে বসে। ভোর উঁকি দিয়ে দেখে বাবাকে। তখনই ঘরে প্রবেশ করে ছোট্ট আনিকা। পরণের ফ্রক মাথায় দুটো ঝুটি! পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” চাচিমনি দাদি ডাকে তোমাকে! এখুনি যেতে বলল!”
পাতার পিছনে ভোরকে দেখে পাতার কাছে আর যায় না। ফিরতি পথ ধরে বলে,
-” ফাস্ট ফাস্ট এসো কিন্তু?”
পাতা বিছানা থেকে নেমে মাথার তোয়ালে খুলে চুলে চিরুনি করে। ভোরকে বগলদাবা করে ঘর থেকে বেরোতে নিলে অরুণ পিছু ডাকে।
-” পাতাবাহার! শাড়ি ঠিকঠাক করে যাও!”
পাতা জিভে কামড়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টেনে বলে,
-” এখন ঠিক আছে?”
ভোর সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে জবাব দেয়,
-” একদম আম্মু!”
অরুণ ল্যাপটপ থেকে মাথা তুলে পাতার আপাদমস্তক পরখ করে পাতাকে তার সামনে আসতে বলে। পাতা ভ্রু কুঁচকে তার সামনে দাঁড়ায়। অরুণ হাত বাড়িয়ে পাতার পেটের কাছটার আঁচল ঠিক করে ঢেকে দিয়ে বলে,
-” ছোটমা আর ওই আন্টি যতই ত্যাড়া বাঁকা কথা বলুক মন খারাপ করবে না। সকলের সাথে ভদ্র ভাবে কথা বলবে। আরিয়ান ভাইয়ের মতো তোমার। তাকে সম্মান দিবে, ঝগড়া মোটেও করবে না। যাও?”
পাতা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নেড়ে ভোরকে নিয়ে চলে যায়। অরুণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে অপলক।
পাতা ভোরের এক হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে নামে। নজর ড্রয়িং রুমে। আদুরি বাদে সবাই উপস্থিত। আরিয়ান ও রুবি ছেলে নিয়ে বসে আছে। রুবির মা সুরুভি বেগম নাতিকে কোলে নিয়ে বসে। আসমা বেগম সোফায় বসে চশমা চোখে একটা বই পড়ছেন। আভারি দাঁড়িয়ে আছে পাশে। মিনু সবাইকে চা-টোস্ট দিলো! ভোর পাতার হাত ছেড়ে দৌড়ে গিয়ে মিনুর হাত ধরেই আবদার করে,
-” ও মিনু খালা! আমায় নুডুলস বানিয়ে দাও না?”
মিনু প্রাণখোলা হাসে।
-” আমি এখনি দিতেছি ভোর বাবা!”
ভোর মিষ্টি হাসে। পাতা এগিয়ে এসে আসমা বেগমের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
-” মা ডেকেছিলেন?”
সবাই পাতার দিকে চায়। আসমা বেগমও বই থেকে মুখ তুলে পাতার দিকে চায়। বই টি বন্ধ করে পাশে রেখে বলে,
-” হুম! না ডাকলে তোমায় পাওয়া যায়? আমাকে দেখলেই এমনভাব ধরো যেন আমি বাঘ না ভাল্লুক! কেটে পরেই নিস্তার পাও! সৎ শাশুড়ি তাই গ্রাহ্য করো না।”
-” মা কি সব বলছেন!”
অসহায় গলা পাতার। এই শাশুড়ি মা’ কে তার ভয় লাগে। কেমন যেন গম্ভীর মহিলাটি! অরুণ সরকারের থেকেও গম্ভীর গলায় কথা বলে তার সাথে। এটা করবে না!ওটা করবে না! ওরকম করছো কেন? ওভাবে হাঁটে কেও? মনে হয় তার সব কাজেই শাশুড়ি মায়ের এলার্জি। সবকিছুতেই দোষ ত্রুটি খুঁজে বের করবে আর শাসন করবে। অথচ রুবির সাথে তার ভিন্ন আচরণ। পাতার মন খারাপ হয়। তাই পারত পক্ষে শাশুড়ি মায়ের থেকে গা ঢাকা দিয়েই থাকে।
আসমা বেগম তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
-” কি সব বলছি আমি? তোমার আচরণে তো সেটাই মনে হয়! থাক বাদ দাও! আমার পাশে বসো? চা নাও?”
পাতা তার পাশে বসে চুপটি করে। চা নেয়, চায়ে চুমুক বসাতেই জিভ পুড়িয়ে হালকা স্বরে আর্তনাদ করে উঠলো। চা গরম ছিল খুব! ভোর এগিয়ে এসে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,
-” আম্মু কি হলো?”
আরিয়ান ও আনিকা ফিক করে হেসে উঠে।
-” মা! তোমার বড় বউমা দেখি চা’ ও খেতে যানে না!”
সবার মুখেই চাপা হাসি! পাতা মুখশ্রী কাঁদো কাঁদো হয়ে এলো। আসমা বেগম গম্ভীর গলায় ঝাড়ি দিয়ে বলে,
-” ছোট বাচ্চা তুমি? চা গরম কিনা পরখ করে খাবে না? শুধু হাতে পায়েই বড় হয়েছো দেখছি!”
পাতা মাথা নিচু করে নেয়। ভোর পাতার কোলে বসে কোমল গলায় সুধায়,
-” ও আম্মু! জ্বলছে?”
পাতা মাথা নেড়ে না বোঝায়। সুরুভি বেগম আসমা বেগমের দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
-” থাক আপা আর বকিয়েন না! আপনার বউমা চা খেতে পারে না ! অভ্যাস নেই হয়তোবা!”
আসমা বেগম বাদে সবার মুখেই চাপা হাসি বিদ্যমান। মিনু আভারিও বাদ যায় নি! পাতার চোখ ভরে উঠতে চায়! আশ্চর্য কথায় কথায় কান্না আসে কেন? আগে তো কখনো আসতো না! পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আগমন ঘটে আদুরির! এসেই কথার ফুলঝুড়ি শুরু করে দেয়। হাসি তামাশায় মেতে ওঠে ড্রয়িং রুম। তবে চুপচাপ ভোর ও পাতা। পাতার মন খারাপ আর তার মুখশ্রীর আঁধার বুঝতে পেরে ভোরের মুখশ্রীতেও আঁধার নামতে চায়! দাদি আম্মুকে বকলো!সবাই মজা উড়ালো!
আড্ডার মাঝেই আদুরি মিনুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” মিনু আপা? এরকম বৃষ্টির মৌসুমে মন সব সময় খাই খাই করে! কিছু বানিয়ে দাও না? বিরিয়ানি রান্না করতে পারো!”
-” আচ্ছা ম্যাডাম!”
-” উফ মিনু আপা! ম্যাডাম ম্যাডাম না বললে হয় না?”
মিনু হাসে। যার অর্থ ‘হয় না’। সুরুভি বেগম নাতির গালে চুমু দিয়ে পাতার দিকে একনজর দেখে আদুরিকে বলে,
-” আদুরি! মিনুর হাতের রান্না তো সবসময়ই খাও! আজ ভিন্ন হাতের রান্না খেলে কেমন হয় ?”
সবাই অবুঝ চোখে চায়! সুরুভি বেগম রান্না করবে কি? সুরুভি বেগম হেসে পাতাকে ইশারা করে বললো,
-” তোমার বড় ভাবীর হাতের রান্না চেখে দেখতে হবে না? তার হাতের গুনাগুণও জানা যাবে সাথে তোমার আবদারও পূরণ হবে!”
পাতার মুখ ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যায়। সে আর রান্না দু মেরুর বাসিন্দা। সে রান্নার র’টাও জানে না। শুধু ঠিকঠাক চা বানাতে পারে এই যা!
আদুরি খুশি হয়ে বলে,
-” ঠিক বলেছেন আন্টি! এতো খুশি ডাবল হয়ে যাবে। বড় ভাবী তুমি কি বলো?”
পাতা আমতা আমতা করে! কি বলবে? সুরুভি বেগম ও রুবি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাতার দিকে চেয়ে। আরিয়ান হেঁয়ালি করে বলে,
-” আদু খুশি ডাবল হবে নাকি মাইনাস তা তোর বড় ভাবীর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে!”
আসমা বেগম পাতাকে পর্যবেক্ষণ করে সন্দেহ গলায় জিজ্ঞেস করে,
-” রান্না বান্না পারো তুমি?”
পাতা মাথা নিচু করে নেয়। ঢোক গিলে মাথা নেড়ে বলল,
-” না!”
আসমা বেগম হতাশ ভঙ্গিতে চায়। সুরুভি বেগমের অধরে খেলা করে শয়তানী হাসি।
-” আপা এতো দেখছি আলালের ঘরের দুলালী! রান্না পারে না। মেয়ে মানুষ হয়ে রান্না পারে না এটা তো লজ্জার বিষয়। আমার রুবিকে রাজকন্যার মতো বড় করেছি তবে রান্না বান্না শেখানো বাদ রাখি নি! রান্না করতে পারা সেকেলে কিছু না। বউমা রান্না জানো না স্বামীকে রেঁধে খাওয়াবে কি?”
লজ্জায় পাতার মাথা কাটা যাবার উপক্রম। সত্যিই তো কথাগুলো! কেন রান্না শিখলো না! বাড়িতে বড় বোন থাকলে ছোট বোনের রান্না শেখা হয়? আর ও বাড়ি প্রিয় ও ফয়সালকে সামলানোর দরুণ রান্নার বোঝা তার কাঁধে চাপে নি!
ইতিমধ্যে সবার নজরে আসে অরুণ! পকেটে হাত গুটিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়। সোফায় জায়গা থাকায় পাতার পাশেই বসে পড়লো। পাতা আড়চোখে একবার দেখে শাশুড়ি মায়ের দিকে চেপে বসলো।
অরুণ সকলের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-” আমি আসাতে সবাই চুপটি করে গেলে কেন?”
আদুরি হেসে ভাইকে বলে,
-” বড় ভাবীর হাতের বিরিয়ানী খেতে চাইলাম! কিন্তু সে ছ্যাঁকা দিলো তো! রান্নাই করতে পারে না সে!”
-” ওহ্। এখন সবাই সব কাজে পারদর্শী হবে এরকম তো কথা নেই, তাই না? কথা হলো আমাকে দেখে সবাই চুপ করে গেল কেন?”
সুরুভি বেগম বলে,
-” অরুণ বাবা কটুক্তি করি নি তোমার বউকে! আজকালকার মেয়েরা রান্না জানাকে সেকেলে মনে করে। তাই রান্না শেখে না। আরে বাবা রান্না না জানলে ভালোমন্দ রেঁধে বেড়ে স্বামীর মন জয় করবে কিভাবে? তাই তোমার বউকে বলছিলাম!”
অরুণ পাতার দিকে একপলক তাকায়। একটু আগের সব কথাই সে শুনেছে। সুরুভি বেগমের কথার প্রেক্ষিতে বলে,
-” এখন রান্না পারে না এতে তো কিছু করার নেই তাই না? আর এমনিতেই আমি তো আমার বউকে মাস্টার শেপ বানাবো না। আর আদু কিসের বিরিয়ানী খাবি বল?”
-” মাটন বিরিয়ানি! তুমি রাঁধবে ভাই?”
অরুণ সোফা থেকে উঠে বলে,
-” হুম! মিনু আপা আজ আপনার কিচেনের দখল আমি নিলাম!আর কারো কোনো আবদার? বলে ফেলো?”
আনিকা হাত তুলে বলে,
-” চাচ্চু নুডুলস খাবো আমি!”
অরুণ সায় জানালো। পাতা অবাক লেচনে অরুণের দিকে চেয়ে। এই লোক রান্না করতে পারে? আসমা বেগম বরাবরের মতো গম্ভীর মুখেই। আরিয়ান ও রুবি চুপচাপ বসে। সুরুভি বেগমও খানিকটা অবাক হয়।
-” তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে রান্না করবে? রান্না করতে পারো?”
অরুণ মুচকি হেসে বলে,
-” না পারার কি আছে? আর কোথায় লেখা আছে পুরুষ মানুষের রান্না করতে নেই? বড় বড় রেস্টুরেন্টের শেফ, বিয়ে অনুষ্ঠানে বাবুর্চি,বিভিন্ন ক্যান্টিনেও কিন্তু ছেলেরাই রান্না করে। তো বাড়িতে করলে সমস্যাটা কি? আদু তার ভাবীর কাছে বিরিয়ানীর আবদার করেছে! তার ভাবী না পারুক ভাই তো পারে। আমিই পূরণ করলাম। আশা করি এতে আর পাতাকে কথা শুনতে হবে না।”
বলেই পাতাকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-” এই আলালের ঘরের দুলালী? কিচেনে চলো! রান্না না পারো হেল্প তো করবে?”
বলে রান্নাঘরে চলে যায় অরুণ! ভোর খুশি হয়ে পাতাকে টেনে নিয়ে যায় কিচেনের দিকে।
ওরা চলে যেতেই রুবি উঠে দাঁড়িয়ে শাশুড়ি ও স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” মা, আরিয়ান? অরুণ ভাইয়া কেমন করে কথা বললো? মা বড় ভাবীকে কি এমনটা বলল যে এভাবে কথা বলতে হবে? ওনাকে কি অপমান করেছে আমার মা? মা আপনিই বলুন মার কথাগুলো কি বাজে টোনে ছিল?”
আসমা বেগম রুবির দিকে চায় শান্ত ভাবে। কি বলবে? আরিয়ান আনিকাকে সোফায় বসিয়ে রুবির কাঁধে হাত রেখে বলে,
-” ভাইও ওমন টোনে কথা বলে নি রুবি! হেসেই বলেছে! তুমি কথা বাড়াচ্ছো..
আর বলতে পারে না। রুবি কাঁধ থেকে আরিয়ানের হাত ঝটকায় সরিয়ে বলল,
-” আমারও কান আছে আরিয়ান! ঠিকই বলেছো, কথা বাড়িয়েছি! আম্মু? তোমাকেও বলিহারি বাইরের মানুষের ব্যাপারে তোমার কেন কথা বলতে হবে? অপমান হতে ভালো লাগলো?”
সুরুভি বেগম গোমড়া মুখে বসে থাকে। আসমা বেগম উঠে এসে রুবির মাথায় হাত রেখে বলে,
-” শান্ত হও! সুরুভি আপা? অরুণের কথায় কষ্ট পেলে অরুণের হয়ে আমি ক্ষমা চাইছি! যদিও ছেলেটা ওভাবে বলে নি আপনাকে তবুও ক্ষমা চাইছি! মনে কিছু নেবেন না।”
কিচেনে ঢুকেই অরুণ ফ্রিজ খুলে গরু ও মুরগির মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখে। চারটা ডিম বের করে। চুলায় গরম পানি বসায়। এরপর পেঁয়াজ ছিলে কুঁচি কুঁচি করে মরিচ কাটতে থাকে। ভোর কেবিনেটের উপর বসে পেঁয়াজ ছিলে বাবাকে সাহায্য করছে। পাতা হা করে চেয়ে আছে বাবা ছেলের দিকে। সাদা শার্ট ও কালো ট্রাওজারে অরুণ সরকার কিচেনে রান্না করতে ব্যস্ত। এটা তার ধারনার বাইরে ছিল। অরুণ গরম পানিতে কতকগুলো ম্যাগি নুডুলসের প্যাকেট ছিঁড়ে ছেড়ে দিল। ভোর কিছু টমেটো ধুয়ে দিলে অরুণ সেগুলোও কেটে নেয়। নুডুলস ছেঁকে চুলায় কড়াই বসিয়ে পেঁয়াজ, মরিচ, ও টমেটো কুচি ছেড়ে দেয়। অল্প সময়ের মধ্যেই নুডুলস রান্না শেষ হলে অরুণ চুলায় আবার গরম পানি বসিয়ে দেয়। অরুণ এক বাটি নুডুলস রেখে বাকি টুকু মিনুকে ডেকে সবাইকেই দিতে বলে। মিনু ও আভারির জন্যও এক বাটি দেয়। মিনু মুচকি হেসে নিয়ে যায়। অরুণ একটা কাঁটা চামিচ বাটিতে দিয়ে বলে,
-” দুজন খেয়ে নাও!”
পাতা চামিচে নুডুলস তুলে ফু দিয়ে ভোরের মুখে দেয়! ভোর মজা করে চিবোতে থাকে। পাতা আবার চামিচে তুলে একটু উঁচু হয়ে অরুণের মুখের সামনে ধরল। অরুণ ভ্রু কুঁচকে চায়। পাতা ইশারায় খেতে বলে। অরুণ ভ্রু যুগল শিথিল হয়। মুখশ্রী একটু প্রফুল্লচন্দ্র হলো কি? মুখে পুরে নেয়। পাতা মুচকি হেসে নিজেও মুখে নেয়। একদম পাক্কা হাতের রান্না।
-” ইশ! অসাধারণ! একদম পার্ফেক্ট! আপনার রান্নার হাত নিপুণ! ”
পাতার প্রশংসায় অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” হয়েছে! পাম দিতে হবে না।”
পাতা হেসে বলে,
-” পাম দিচ্ছি না! সত্যি বলছি! কোথা থেকে শিখেছেন?”
অরুণ মুচকি হেসে পেঁয়াজ কুচি করতে করতে বলল,
-” শিখেছি কখনো ইউটিউব থেকে তো কখনো মেসের বুয়ার থেকে।”
-” আপনি ম্যাচে থাকতেন?”
অবাক স্বরে সুধায় পাতা। অরুণ মাথা নাড়িয়ে সায় জানায়। বাবার মৃত্যুর আগে সে মেসেই থাকতো বন্ধুদের সাথে। সপ্তাহ, মাস অন্তর অন্তর বাড়িও আসতো। তার ম্যাসে থাকার কারণও ছিল। অরুণ আর আরিয়ানের মধ্যকার সম্পর্ক এখন মিষ্ট হলেও অতিতে খুবই তিক্ত স্বাদের ছিল। দুজনের মাঝে একটুও পড়তো না। যেন তারা সাপ বেজি যুগল। একে অপরকে দেখতেই পারতো না। আসমা বেগমের বিয়ের দু বছর পরই আরিয়ানের জন্ম হয়। অরুণের আট বছরের ছোট আরিয়ান।অরুণের ভাগের আদর ভালোবাসা কমতে শুরু করে আসমা বেগমের কাছ থেকে। এরজন্য অরুণ আরিয়ানকেই দায়ী মনে করে। আরিয়ানকে আদর করে কোলে নেয়া তো দূর, কাছেই ঘেঁষতে দিতো না অরুণ। দুজন বড় হতে থাকে, তাদের মধ্যকার রেষারেষিও বাড়তে থাকে।অরুণ সতেরো কি আঠারো বছরের ছিল আরিয়ান নয়/ দশ! দুজনের ঝগড়ার মাঝে আরিয়ান অরুণকে ‘কুত্তার বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছিল। অরুণ রেগে গিয়ে প্রথমবারের মতো আরিয়ানকে অনেক মেরেছিল। ছোট আরিয়ান কেঁদে ওঠে তবুও ছাড়ে নি।পড়ে আর কি?
আসমা বেগম এসে অরুণের থেকে ছাড়িয়ে নেয় আরিয়ানকে। ধমক দেয় অরুণকে। রাতে অনিক সরকার এলে নালিশ জানায় অরুণের নামে। আসমা বেগম জখমি ছেলেকে দেখিয়ে কেঁদে কেটে বিচার চায় অনিকের কাছে। গুন্ডা মাস্তান, বদমাইশ, বেয়াদব যা তা বলে গালি দেয় অরুণকে। অরুণ দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে সব শোনে। একটু পরেই তার ডাক আসে। অনিক সরকার অরুণকে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে? অরুণ জবাব না দিয়ে মনব্রত পালণ করে । ফলাফল অনেক বকা ও একটা ডাবাং মার্কা চড় পড়ে। এর একমাস হওয়ার পর অরুণ জেদ করে মেসে উঠবে। অনিক সরকার জেদ ধরল পাঠাবেন না মেসে। দুই জেদি মানব জেদে অনড়। শেষমেষ অরুণ আসমা বেগমের কাছে সাহায্য চায়। আসমা বেগম অনিক সরকারকে বুঝায়। তারপর অরুণ মেসে। আরিয়ানের সাথে তার সম্পর্ক ঠিক হয় অনিক সরকারের পরলোক গমনের পর! কিভাবে হয় উপর ওয়ালাই জানে।
বাটির সবটুকু নুডুলস তিনজনের ভাগাভাগিতে শেষ হয়। পাতা ভোরকে পানি খাইয়ে অরুণকেও দেয়। নিজে পান করে গ্লাস রেখে এসে দেখে বাবা ছেলের চোখে জল। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। পরে খেয়াল হয় নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা পেঁয়াজ কাটছে, ভোর তার পাশেই বসে। পাতা হেসে বলে,
-” আপনারা কাঁদছেন? থাক কাঁদবেন না। আমি এসে গেছি ভয় নেই।”
অরুণ পাশে তাকিয়ে নাক টানে। পকেট হাতরিয়ে রুমাল খোঁজে পায় না। তাই হাতের ইশারায় পাতাকে কাছে আসতে বলে। পাতা কাছে এলেই তার বাড়তি আঁচল টেনে চোখ মুখ ও নাকের পানি মুছে বলে,
-” পাতাবাহার তুমি এক নম্বরের কাজ চোর! হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দেবে তা না! ভোরকে দেখেও তো শিখতে পারো?”
পাতা বাহার পর্ব ৩০
পাতার মন টা ‘তা তা থৈ থৈ করে নাচলেও অভিনয় সরূপ গোমড়া মুখে ভোরের চোখ মুখটাও মুছে দিয়ে বলে,
-” কি করতে হবে বলুন আমি করে দিচ্ছি!”
-” থাক আমিই করছি! আপনি কাজ করতে গিয়ে অকাজ না করে বসেন!”
বলেই মাংস ধুয়ে নিয়ে তাতে ময় মসল্লা দিতে থাকে। আর পাতা চুপ নেই কাজে অষ্টরম্ভা হলেও তর্কে সে নোবেলজয়ী! ভোরও চুপ করে নেই! কখনো সে আম্মুর পক্ষে তো কখনো রদবদল করে অরুণের পক্ষে। তাদের মিষ্টি খুনসুটিতে মুখরিত রান্নাঘর।