পাতা বাহার পর্ব ৩৭
বেলা শেখ
তিমিরে আচ্ছন্ন রজনী এখনো গভীরে ডুব দেয় নি। আকাশ মেঘলা না হলেও চাঁদের ছিটেফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। দু এক গোছা তারকারাজি ক্ষণে ক্ষণে পিট পিট করছে। ধরনীর বুকে গম্ভীর গুমট ভাব! পবনের দেখা মেলা ভার! গাছের পাতার নড়চড় দেখা যাচ্ছে না। বাদুরের দল ডানা ঝাপটায়! কুকুরের দল ঘেউ ঘেউ করছে এক নাগাড়ে! বিরক্তিকর সেই সুর!রাতের শুনশান নীরবতায় ঝিঁঝিঁ পোকার বিরতিহীন সুর! দেয়াল ঘড়ির টিক টিক টিক শব্দ! পাতা বিছানায় শুয়ে উশখুশ করছে। ঘুম আসছে না তার! যার ফলে ক্ষীণ থেকে ক্ষীণ শব্দও বিরক্ত লাগছে পাতার কাছে। পাতা চোখ বুজে শুয়ে থাকে। ঘুম ধরা দেয় না! চোখ মেলে রাখলেও অন্ধকারে গা ছমছম করে ওঠে। তার উপর মাথার কাছটার জানালাটা খোলা! ছোট বিছানা পাতার!
একজন ভালোভাবে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোতে পারে। দুজনেও সমস্যা হয় না; মানিয়ে নেয়া যায়। সেই বিছানায় আজ তিনজন ঘুমিয়ে।অনেকটা চাপাচাপি করে শুয়েছে তিনজন। সে ভোর দুই পাশে মাঝখানে অরুণ সরকার। লুব ভাই অবশ্য বলেছিল ভোরকে তার সাথে রাখবে। সে, ভোর আর লাবিব থাকবে। লোকটা গম্ভীর মুখে তৎক্ষণাৎ মানা করে দেয়; সাথে পাতার দিকে চায় শান্ত দৃষ্টিতে। লোকটা হয়তো ভেবেছিল পাতাই অন্যত্র রাখার জন্য পাঁয়তারা করছে। কিন্তু এমনটা মোটেই না!চাপাচাপিতে পাতার ঘুমের অসুবিধে হচ্ছে না। তার উশখুশ অস্থিরতার কারণ ভ্যাপসা গরম; তার সাথে কারেন্ট মামা ভ্যাকেশনে গেছে! এই কয়েকদিন এসিতে থেকেই বড়লোকি ভাব এসে গেছে পাতু? চার্জার ফ্যান ঘুরছে এতেও গরম লাগছে? এখন লাগলে কি করার! পাতা পাশ ফিরে কাত হয়ে শোয়।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
লোকটা নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে! চিৎ হয়ে এক হাত পেটের উপর রেখে। অপর হাতের উপর ভোর মাথা রেখে ঘুমিয়ে। তার কি গরম লাগছে না? লাগবে না? সে তো কয়েকদিন এসি যুক্ত কামরায় থেকে এই সামান্য গরম সহ্য করতে পারছে না। আর লোকটা তো এসি ঘরেই সারাজীবন কাটিয়েছে। ঘনঘটা অন্ধকারের মধ্যে জানালা দিয়ে আগত ক্ষীণ আবছা আলোয় পাতা হাত বাড়িয়ে অরুণের বলিষ্ঠ হাতের উপর রাখে। ভালো লাগে পাতার। মন বলে ঘুম আসবে। অরুণের হাতের উপর থেকে হাত সরিয়ে কোমড়ের একপাশে রেখে জড়িয়ে ধরে; সাথে একটা পাও তুলে দেয়। যেন এটা অরুণ সরকার নয় ; পাতার ব্যাক্তিগত কোলবালিশ। কিন্তু ব্যাক্তিগত কোলবালিশ জড়িয়েও পাতার ঘুম ধরা দিল না। লোকটা ঘেমে একাকার। পাতা অরুণের উন্মুক্ত বুকে, গলায় হাত রাখল।
ঘেমে চিপচিপে হয়ে আছে লোকটা! পাতা উঠে বসে। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ভোরকে দেখে। ছেলেটা টি শার্ট গায়ে জড়িয়েই ঘুমে আচ্ছন্ন। ঘেমে গায়ের সাথে লেপ্টে আছে। মুখশ্রীতেও বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে আছে। পাতা ঘরময় হাত পাখা খোঁজ করে পায় না। দরকারের সময় কোনো জিনিস হাতের নাগালে পাওয়া যায় না। অথচ সবসময় সেইটা চোখের সামনেই থাকে। পাতা তার ড্রয়িং খাতা বের করে সেটা দিয়েই বাতাস করে বাবা-ছেলেকে। বেশি সময় করতে হয় না। মিনিট পাঁচেক পরেই কারেন্ট চলে আসে। পাতা স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। লাইট জ্বালিয়ে বিছানার হাঁটু ভাঁজ করে সেথায় থুতনি ঠেকিয়ে বসে রইল! নজর ঘুমন্ত অরুণ! কখনো কখনো ভোর! ঘুম আসছে না; এখন সময় পার করার এর থেকে ভালো পন্থা হতেই পারে না।
পাতা তার দিকে তাকিয়ে থাকে আর মুচকি মুচকি হেসে সুখে আচ্ছাদিত কল্পনার রাজ্যে ঘোড়া ফেরা করে। লোকটা ঘুমের ঘোরেও মুখের আদল গম্ভীর বানিয়ে রেখেছে। নাকটা সিঁকায় তুলে রেখেছে। পাতা দাঁত বের করে হাসে। ‘নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক’ বিড়বিড়িয়ে হাত টান করে অরুণের নাকটা টেনে দেয়। সাদাসিধে মনটা লোভী হয়। দাঁড়ি যুক্ত গালে হাত বুলিয়ে টিপে দেয়। লোকটা সবসময় তার নাক, গাল টেনে দেয় আজ সে দিলো! পাতা হামি তোলে; চোখে ঘুমের আবির্ভাব ঘটে। অরুণের দিকে ঝুঁকে প্রথমবারের মতো তার নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটার ললাটে মিষ্টি ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। দিয়ে সরে আসবে অরুণ চোখ খোলে! পাতা থতমত খেয়ে যায়! তড়িঘড়ি করে সরে আসে। বুকটা ধরফর করছে অনবরত! কথা জড়িয়ে আসে তবুও আমতা আমতা করে বলে,
-” ওই ওই মশা পড়েছিলো!”
বলেই মনে মনে নিজের গালে একটা থাপ্পড় লাগায়। এটা কোনো এক্সকিউজেস হলো? এখন লোকটা যদি জিজ্ঞেস করে চুমু দিয়ে মশাকে তাড়াচ্ছিলে? কিন্তু অরুণ কোনো প্রকার প্রশ্ন করে না। পাতা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক বাবা লোকটা ঘুমের ঘোরে হয়তো; খেয়ালই করে নি! সে বিছানা থেকে নেমে লাইটের সুইচ অফ করে এসে বালিশে মাথা রাখে। অন্ধকারেই পাশে তাকায়! কিন্তু কিছু দেখার সুযোগ পায় না। তড়িৎ বেগে অরুণ সরকার একপ্রকার হামলে পড়ে। পাতার গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে চুমুর বর্ষণ শুরু করে। পড়নের টপসের ভিতর হাত গলিয়ে উদরে রাখে। সদ্য নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত পাতা শিউরে ওঠার সময় পায় না। মস্তিষ্ক কেমন অচল হয়ে যায়। ভয়ে উত্তেজনায় হাত পা শিথিল হয়ে আসে।
হৃদস্পন্দন বেড়ে যায় অস্বাভাবিক গতিতে। পাতা ঢোক গিলে। এ কেমন অসহ্যনীয় ভালোলাগার রেশ! অরুণ থেমে নেই। অগাধ উত্তেজনায় ঠাসা অরুণ সরকার বেপরোয়া বেগে হিংস্র গতিতে নিজের আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। হাতের নরম ছোঁয়া গভীরে ডুব দেয় সাথে কঠোরতার রেশ! পাতা ছটফটিয়ে উঠে। বলিষ্ঠ দেহটাকে সরাতে চায়; ব্যর্থ হয়! বরং বলিষ্ঠ দেহটা পিষে ফেলতে চায় ছোট নরম তনু! হাতটা যেন খেই হারিয়ে ফেলে। পাতা নিজ নরম হাতে বাঁধা দিলে, তার হাত জোড় দখল হয়ে যায়। পাতার ছটফটানি বেড়ে যায়, সাথে অরুণের বিস্তার! কিন্তু কপোত যুগল খেয়ালহারা! বিছানার কিনারায় অবস্থান তাদের; সেটা বেমালুম ভুলে বসে। ফলাফল স্বরূপ ধপাস কোরে পড়ে ফ্লোরে গড়াগড়ি খায়! পাতা অতি মৃদুস্বরে চেঁচায়! কোমড়টা তার আজ গেলো! অরুণও বেশ ব্যাথা পায় কনুই জোড়ায়! তবে আমলে নেয় না। উঠে ফ্লোরে বসে নরম গলায় পাতাকে সুধায়,
-” আর ইয়ু ওকে?”
পাতা অরুণের দিকে চায়। লোকটা হাঁপাচ্ছে নিঃশ্বাসে গতি অস্বাভাবিক! শালার জামাই! অসভ্য! অরুণ আবার একই প্রশ্ন করে। পাতা ছলছল চোখে না বোধক মাথা নাড়ে। অরুণ খানিকটা উদ্বেগ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করে,
-” ব্যাথা পেয়েছো? কোথায় লেগেছে?”
পাতা কটমট করে চায়। শালার জামাই! লোকটার জন্যই তো সব হলো! অসভ্য লোক! অরুণ পাতাকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। পাতা চুপটি করে এপাশ ফিরে কাত হয়ে শোয়! কিছুপল আগের মুহূর্ত চোখের পাতায় ভাসছে যেন! পাতা ঢোক গিলে। লজ্জায় কান গরম হয়ে আসে। তার লজ্জাকে বাড়িয়ে দিতে অরুণ তাকে কাছে টেনে নেয়। পেছন থেকে জড়িয়ে কাঁধে মুখ গুঁজে ধীমে সুরে গম্ভীর গলায় বলে,
-” ইফ দিছ ওয়াজ আওয়ার বেডরুম ইনস্টেড ওফ ইয়োর ফাদার’স হাউজ, ইয়ু উড বি ফিনিশড ট্যু ডে পাতাবাহার!”
-” অসুখ শরীর নিয়ে তোমার কাজ কইরতে হইবে না! ওঠো? ওখানে বইসে থাকো! আমি করছি তুমি শুধু দেখতে থাইকবে! ভূল হইলে সুধরে দিবে!”
-” আমি পারবো আপনি যান তো!”
বলে পেঁয়াজ কুচি করতে থাকে মিনু। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে ঝাঁঝে। তবুও থামে না। আভারি বিরক্ত হয়।
-” তুমি আমার কথা শুইনবে না, না? ওঠো বলছি? ওঠো?”
ধমকে বলে আভারি! মিনু খানিকটা ভয় পেলেও আমলে নেয় না। সকাল আটটা বাজতে চললো এখনি রান্না হয় নি। সবাই ঘুম থেকে উঠেই তো চা নাস্তার জন্য চিল্লাচিল্লি শুরু করে দেবে। আভারি মিনুর বাহু ধরে টেনে সরিয়ে দেয়। মিনু চাপা স্বরে বিরক্ত হয়ে বলল,
-” কি কইরছেন টা কি! বিরক্ত করবেন না তো! সবাই উঠলো বলে! রান্না না কইরলে কি খাইবে সবাই?”
আভারিও তেজের সাথে বলল,
-” সেই ব্যবস্থা আমি কইরতেছি! তুমি চুপচাপ বইসে থাকো মিনু। রান্না আমি কইরতেছি! রান্না বান্না আমিও পারি!”
মিনু মিনমিন করে কিছু বলতে চায় আভারির ধমকে বলে,
-“খবরদার কথা না শুনলে!”
অগত্যা মিনু চুপ বনে যায়। কাল রাত থেকে শরীরটা বেশ খারাপ। জ্বর ঠান্ডা সাথে মাথা ব্যাথা!রাতে বেশকয়েকবার বমি করে ভাসিয়েছে। লোকটা নিজেই পরিষ্কার করেছে। মাথায় পানি ঢেলেছে। বলা চলে নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে। আভারি ছুরি হাতে নিয়ে পেঁয়াজ কুচি করতে থাকে খানিকটা অপরিপক্ক হাতে। এরইমধ্যে কিচেনে আসমা বেগমের আগমন ঘটে। মিনুকে ছলছল মুখে বসে থাকতে দেখে সাথে আভারিকে কাজ করতে দেখে গম্ভীর মুখে আভারির উদ্দেশ্যে বলে,
-” কি হয়েছে? চিল্লাচিল্লি করছিলে কেন মেয়েটার উপর? হুম?”
আভারি মাথা নিচু করে জবাব দেয়,
-” ম্যাডাম! অসুখে পইড়েছে! কাল রাত থেকে অনেক জ্বর! বারবার বমি কইরে শরীর দূর্বল! পাক পাইরতেছে। কহন চোখ উল্টাইয়ে পইড়ে যায়! এই অবস্থায় রান্না কইরতে আইছে। মানা করছি তাও শোনে নাই! তয় ধমক দিছি!”
আসমা বেগম এগিয়ে গিয়ে মিনুর কপালে হাত রাখে। বেশ গরম! জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে মনে হয়! এই অবস্থায় রান্না করতে এসেছে মেয়েটা!
-” জ্বর বাঁধালে কিভাবে?”
মিনুকে কিছু বলতে না দিয়ে আভারি বলে,
-” বাইধবে না? ঠিক মতো খাইবে না। নিজের যত্ন নিইবে না! চেহারার কি হাল হইছে! শরীরের এক পত্তন মাংস নাই!”
সত্যিই মিনুর চেহারার উজ্জলতা নষ্ট হয়েছে! শুকিয়েও গেছে বেশ! আসমা বেগম মিনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো! মিনুর কপোল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বাবা মা গত হয়েছে বিয়ের কয়েকবছরের মাথায়! একটা বড় ভাই আছে সে সংসার নিয়েই ব্যস্ত। বছর অন্তর একবার ফোন করে খোঁজ খবর নেয় এই যা। এতেই মিনু খুশি। আজ আসমা বেগমের মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়াতে কেন যেন বাবা মায়ের কথা মনে পড়লো! আসমা বেগম আভারিকে বললেন,
-” ওকে ঘরে নিয়ে যাও! রেস্ট করুক! আরেকটু পরে ডাক্তার দেখিয়ে আনবে। আমি ড্রাইভারকে বলে দেব নিয়ে যাবে। আর যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করে যাবে অবশ্যই!”
আভারি মাথা নেড়ে সায় জানালো। চুলায় চড়ানো চায়ের কেতলি নামিয়ে অফ করে দিলো। মিনুর হাত ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। আসমা বেগম বললেন,
-” ওর কাছেই থেকো! গা টা তোয়ালে ভিজিয়ে মুছে দিয়ো! গায়ে অনেক জ্বর! আর রান্নার চিন্তা করতে হবে না। আমি করছি!”
আভারি অবাক সুরে বলে,
-” না ম্যাডাম! আমি রান্না করতে পারি..”
-” যেটা বলছি সেটা করো যাও! রান্না আমিও করতে পারি!”
ধমকের সুরে বলল আসমা বেগম। তবে ধমকে আভারি বা মিনু কারো মন খারাপ হয় না। বরং মনটা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়।
আসমা বেগম কোমড়ে আঁচল বেঁধে দক্ষ হাতে সকালের নাস্তা বানায়। রান্না শেষ করে নিজেই ডাইনিং টেবিলে পরিবেশন করে। শুক্রবার হওয়ার দরুণ সকলেই দেড়িতে ঘুম থেকে উঠে। তিনি চায়ের কেতলি পুনরায় চুলায় দিয়ে চুলার আঁচ কমিয়ে আদুরিকে ডাকতে যান। মেয়েটাকে এখন না ডাকলে এগারোটা বারোটার আগে উঠবেই না!
রুবি ছেলেকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে আছে। ছেলেটা মাতৃদুগ্ধপান করতে ব্যস্ত। রুবি ঘুমে ঢুলুঢুলু করছে। যদিও ঘড়িতে নয়টা বেজে সাতাশ! তবুও আজকের ঘুম যেন অপূর্ণই রয়ে গেলো! ওদিকে আরিয়ান কম্ফোর্ট জড়িয়ে আরামে নিদ্রা বিলাসে ব্যস্ত। মেয়েটা আদুরির সাথে ঘুমিয়েছে গতরাতে। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার তার পতি মহাশয় করেছে। রুবি পাশ থেকে বালিশ নিয়ে আরিয়ানের দিকে ছুঁড়ে মারে। আরিয়ান নড়েচড়ে ওঠে। ঘার ঘুরিয়ে চোখ খুলে পিটপিট করে তাকালো। রুবিকে দেখে মুচকি হেসে বলল,
-” জর্জ সাহেবান কিছু বলবেন?”
সদ্য ঘুম ভাঙ্গার দরুণ ভাঙা ভাঙা গলার আওয়াজ। রুবি চোখ পাকিয়ে বলল,
-” উকিল সাহেব কৃপা করে উঠুন? সূর্যিমামা আপনার প্রতিক্ষায়!”
আরিয়ান ওপাশ ঘুরে চোখ বুজে বলল,
-” আজ ফ্রাইডে! সারাদিন ঘুমোলেও প্রবলেম নেই!”
-” অরুণ ভাইয়া কবে ফিরবে শশুর বাড়ি থেকে?”
রুবির প্রশ্নে আরিয়ান পুনারায় এপাশ ফিরে।
-” প্রথম প্রথম শশুর বাড়ি গেলো! দুই এক দিন থাকবে না? তোমার এতো জলদি কিসের?”
রুবি মুচকি হেসে ছেলেকে দাঁড় করিয়ে জবাব দিল,
-” আজ ছুটির দিন। কাল শনিবার অফিস তো খোলাই থাকে! আমার রিজাইন লেটারও পাশ হয়ে গেছে। ভাবছি কাল থেকেই জয়েন করবো অফিস!”
আরিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ে।
-” দুই এক মাস সময় নাও! ছেলেটাকে আরেকটু সময় দাও! তারপর শুরু করো! এতো তাড়া কিসের?”
রুপ মায়ের কোল থেকে নেমে বাবার কাছে যায়। বাবার বুকের উপর উঠে বসে। উ উ শব্দ করে ঘোড়া চালানোর মতো ভঙ্গিমা করে। আরিয়ান ছেলেকে বুকে নিয়ে চুমু খায়।
রুবি মুচকি হেসে জবাব দেয়,
-” একচুয়ালি আই এম ঠ্যু মাচ এক্সাইটেড! আমাদের অফিস! সব কিছুতে আমাদের হুকুম! আহা! অন্যের অধিনে কাজ করে অতিষ্ট হয়ে গেছি!”
আরিয়ান ছেলেকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো বিছানা থেকে। সিরিয়াস গলায় বলল,
-” ভালো! বাট একটা কথা মাথায় রাখবে রুবি! অফিসটা ভাইয়ের! বাবা মারা যাওয়ার পর অফিস ডুবতে বসেছিল! ব্যবসায় লস! অফিসের পুরোনো ম্যানেজারের ধোঁকাবাজি! ঋণে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল! সব মিলিয়ে নিলামে ওঠার মতো অবস্থা! ভাই সেখান থেকে একলাই টেনে এনেছে এতদূর! তুমি অফিসে যাবে ভালো! বাকি স্টাফদের মতোই সৎ মনে কাজ করবে! কোন প্রকার এক্সট্রা সুবিধা গ্রহণ করবে না! আর তুমি ভাইয়ের অধিনে কাজ করবে এটা খেয়াল রাখবে। ভাই অনেক এক্সপেরিয়েন্সড! তুমি বুদ্ধিমতী,আই থিংক আমার কথা বুঝতে পারছো।”
রুবির মুখশ্রীতে গাম্ভীর্য ভর করে।
-” তুমি কি বোঝাতে চাইছো? ক্লিয়ারলি বলো?”
আরিয়ান হাসে। ছেলেকে রুবির কাছে দিয়ে বলে,
-” তুমি যেটা বুঝেছো!”
বলে মুচকি হেসে ওয়াশ রুমে চলে যায়। রুবি সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। মানছে অরুণ ভাইয়া ক্ষতিগ্রস্ত অফিসটাকে পুনরায় দাঁড় করিয়েছে। তার কৃতিত্ব অনেক। তার মানে এটা নয় যে অফিসটাই তার! সেখানে আরিয়ান, আদুরিরও অধিকার আছে।
আসমা বেগম আনিকাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসেন! তখনই কল আসে। তিনি আনিকাকে রেখে একটু দূরত্বে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকে। আনিকা এদিকে ওদিকে ঘার ফিরিয়ে ভোরকে খোঁজে! আজ ফ্রাইডে! মানে সারাদিন ছুটি খেলাধুলা। সে ডিসাইড করে ভোরের সাথে সারাদিন কি কি খেলবে। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল হয় যে ভোরতো নেই! তার নানুর বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তাহলে সে কার সাথে খেলবে? তার ভাবনার মাঝেই রুবি চলে আসে রূপকে নিয়ে। আনিকাকে গোমড়া মুখে বসে থাকতে দেখে বলল,
-” মামনি মন খারাপ করে বসে আছো কেন? কি হয়েছে?”
আনিকা গালে হাত দিয়ে গোমড়া মুখে বলে,
-” আজ ফ্রাইডে! ভোর নেই আমি কার সাথে খেলবো? আনি মিসড ভোর!”
রুবি মুচকি হাসে। দুটোর মধ্যে একটুও পড়ে না। কিন্তু একে অপরের থেকে দূরে গেলেই বলবে ‘আনি মিসড ভোর’ ‘ভোর মিসড আনি’ রুবি রূপকে বসিয়ে দিয়ে আনিকার সামনে বসে বলল,
-” ভোর নেই তো কি হয়েছে? রূপ আছে না তার বোনের সাথে খেলার জন্য!”
-” ও পঁচা আর ছোট ওর সাথে আমি কিভাবে খেলবো!”
-” তাহলে কি করা যায়? উম এক কাজ করি আমরা সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাই? আমি, তুমি, রূপ, তোমার আব্বু?”
আনিকা খুশির চোটে লাফ দিয়ে উঠলো।
-” সত্যিই! তাহলে তো অনেক মজা হবে! আচ্ছা দাদিকে নেব না কেন?”
রুবি মেয়ের হাসিমাখা মুখশ্রী আঁজলে তুলে চুমু খায়!
-” দাদিকেও নেবো!”
-” কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি?”
বাবার আওয়াজ শুনে আনিকা সামনে তাকায়। বাবাকে দেখেই দৌড়ে কোলে উঠে। আরিয়ান মেয়ের মুখশ্রী আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। সোফায় বসে মেয়েকে কোলে নিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল,
-” ক্ষিধে লেগেছে কেউ কিছু খেতে দাও না? চা টাও দিতে পারো!”
আসমা বেগম ফোন রেখে আরিয়ানের সম্মুখের সিঙ্গেল সোফায় এসে বসে।
-” ডায়নিং টেবিলে সব খাবার আছে শুধু সার্ভ করে খাবি! যাহ্!”
আরিয়ান আশেপাশে তাকিয়ে বলল,
-” মিনু আপা কই? আভারি ভাই কেও দেখছি না!”
-” মিনুর শরীর ভালো নেই! রাত থেকেই জ্বর! জ্বরের শরীর নিয়েই রান্না করতে এসেছিলো! আভারি তাকে বারণ করে নিজেই রাঁধতে বসেছিলো!”
-” বাহ্! আজ আভারি ভাইয়ের রান্না খাবো?”
রুবির কথায় আসমা বেগম গম্ভীর মুখে বলল,
-” আমি রান্না করেছি! আভারি মিনুর কাছে।”
আরিয়ান বলে,
-” বেশি খারাপ? ডাক্তার ডাকবো?”
-” অনেক জ্বর! আমি বলেছি একটু পর হাসপাতালে নিয়ে যেতে! ড্রাইভারকেও বলেছি ফোন করে!”
আসমা বেগমের কথায় আরিয়ান খানিকটা সন্তুষ্ট হয়। রুবি সোফায় বসে চিন্তিত সুরে বলল,
-” মা আমাকে ডাকতে পারতেন আমি রান্না করে দিতাম! লাঞ্চে আমি রেঁধে খাওয়াবো!”
আসমা বেগম খানিকটা হেসে বললো,
-” সেটার মনে হয় দরকার পড়বে না। অরুণের শশুর বাড়ি থেকে দাওয়াত এসেছে। এখনি যেতে বলেছে। আমি বলেছি রারোটার দিকে যাবো!তোমরাও সাথে যাচ্ছো!”
আনিকা খুশিতে চিল্লিয়ে ওঠে ‘ইয়ে’ বলে!
রান্না ঘরে ব্যস্ত সময় পার করছেন লাবনী আক্তার। সকাল ভোর থেকেই তিনি রান্নাঘরে! বাড়িতে দুটো মেয়ের জামাই তাদের সকালের নাস্তার জন্য বিভিন্ন ধরনের পিঠা পুলির মেলা বসেছে। বর্ষা কাল হওয়ায় তালের বরা, তালের পিঠা, ঝাল পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, কুসুলি, পাটিসাপ্টা বানিয়েছে! এছাড়াও নাস্তার জন্য আলুর পরোটার সাথে দেশি মোরগের কষা মাংস! সব রান্নাই শেষ শুধু লতার মেয়ে রুম্পার জন্য সুজি ছড়িয়েছে। এরমধ্যে লতা মেয়েকে নিয়ে আসে। লাবনী আক্তার লতাকে বলল,
-” ওরা এসেছে?”
-” রাতুল, লাবিব আর লুব এসেছে! অরুণ ভাইয়া কাওছারকে নিয়ে কোথাও গেছে।ওদের বলে যায় নি! বলেছে আসছে আধা ঘন্টার মধ্যে!”
-” কোথায় গেল!! আচ্ছা সেসব বাদ দে! শোন কাল রাতে অরুণ কতগুলো সদাই আনলো আবার পাতাও এনেছে মিষ্টি, ফলফলাদি কতসব! বাচ্চাগুলোকে সদাই দিস মনে করে! আর এক কাজ কর এক প্যাকেট মিষ্টি বের করে রাখ! প্রতিবেশিদের দিতে হবে না? প্রথমবার জামাই বাড়িতে আসলো!”
-” আচ্ছা!”
-” আর শোন পাতাকে ডেকে দে! দশটা বাজতে চলল মহারানি এখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে! এর সোধবুদ্ধি কবে হবে! আল্লাহ জানে!”
লতা মেয়েকে রাতুলের কাছে দেয়। সকাল ভোরেই রাতুল, অরুণ, কাওছার, লুবমান, লাবিব ও ছোট্ট ভোর হাঁটতে বের হয়েছিল! উদ্যোক্তা অবশ্য অরুণ! নয়তো তার অলসের ঢেঁকি স্বামী যায় হাঁটতে! হাঁটতে বের হয়েছে ভোরেই এখন দশটা বাজে ! এসেছে তবে কয়েকজন। আর গুলোর খবর নেই! এরা সকালের নাস্তা কখন করবে! লতা ভাবতে ভাবতে পাতার ঘরে প্রবেশ করে। পাতা উপুড় হয়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে। লতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে! এই মেয়েটির ঘুমানোর অভ্যাস বিয়ের পর মোটেই চেঞ্জ হয় নি। লতা পাতাকে ডাকে পিঠ ঠেলে। পাতা হুম হা বলে আবার ঘুমে তলিয়ে যায়! লতা টানে পাতা বিরক্ত হয়ে চোখ পিটপিট করে হাত ছাড়িয়ে আবার শুয়ে পড়ল। লতা কটমট করে বলল,
-” পাতু উঠ বলছি? দশটা বাজে! তার উপর তোর জামাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না! সকালে হাঁটতে বেরিয়েছে এখনো আসেনি!”
ওষুধে কাজ হয়! পাতা উঠে বসে বিছানায় অরুণ ও ভোরকে খোঁজে! না পেয়ে লতার দিকে চায় বড় বড় করে,
-” আপু! কি বলছো এসব! দেখো এরকম ফালতু মজা করবে না!”
লতা পাতার মাথায় গাট্টা মেরে বলল,
-” আমি জানতাম তুই জামাই পাগল হবি! তবে এতোটা আর এতো জলদি ভাবি নি!”
পাতা মুচকি হাসলো । দু হাত উঁচুতে তুলে হাই তোলে। লোকটা কোথায় গেল? তাকে ডাকবে না? লতা বোনের দিকে চায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে! টপসের উপরের দুটো বোতামই খোলা! হা হয়ে আছে! গলা সহ বেশ কিছু অংশ দৃশ্যমান। সাথে গলায় লাল, নীল ছোপ ছোপ জখম! অভিজ্ঞ লতার বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে পাতা টপসের গলাটা আরেকটু নামিয়ে এনে বলল,
-” আরেকটু সময় নিতে পারতি! এতো জলদি কিসের ছিলো? সারাজীবনের ব্যাপার। বোঝাপড়াটা আগে ভালো করে বুঝে নিতি!”
পাতা সরে যায়। বুঝতে বাকি থাকে না আপু কিসের কথা বলছে। লজ্জায় গাল গরম হয়ে যায়। টপসের বোতাম আটকানোর চেষ্টা করে কিন্তু বোতাম খুঁজে পায় না ছিঁড়ে গেছে বোধহয়। পাতা মনে মনে অরুণকে ভয়ংকর একটা গালি দিলো। শালার জামাই! পাশ থেকে ওড়না নিয়ে গলায় জড়িয়ে নিলো। লতা পাতার অস্বস্তি ও লজ্জা দেখে মুচকি হাসলো। পাতার খোলা চুল এলোমেলো করে বলল,
-” হয়েছে আর লজ্জা পেতে হবে না। আমিই তো! তবে আর কিছুদিন..”
-” আপু কি সব বলো না। আমি ওয়াশ রুমে যাচ্ছি! ইটস এন ইমার্জেন্সি!”
বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সাথে অরুণের গুষ্টির তুষ্টি করে। ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য লোকটার জন্য আপুর সামনে কি লজ্জাটাই না পেল! ধ্যাত!
পাতার পলায়ন দেখে লতা মুচকি হাসলো। পাগলিটা বেশ লজ্জা পেয়েছে।
একটা অটো এসে থামে আতিকুর ইসলামের বাড়ির সামনে। অটো থেকে নেমে আসে ভোর! হাতে অনেক গুলো হিলিয়াম গ্যাসে ভরপুর খেলনা বেলুন! যেগুলো মাছ,মটু,পাতালু, ঘোড়া, বিমান সহ বিভিন্ন শেপের! ভোর হাসিমুখে সেগুলো দেখছে আর হাঁটছে, বাড়ির ভিতরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। সে এই বেলুন গুলো মা ও লাবিবকে দেখাবে!
এরপর অটো গাড়ি থেকে নামে অরুণ ও কাওছার। চালকও নেমে গাড়িতে অবস্থানরত বাজারের ব্যাগ গুলো ভিতরে রেখে আসে একে একে। অরুণ তার ভারা মিটিয়ে কাওছারের সাথে ভিতরে প্রবেশ করে।
ভোর সব বেলুন গুলো অনেক কষ্টে ভিতরে নিয়ে গিয়ে গলা উঁচিয়ে ‘আম্মু, লাব্বু ভাইয়া’; ডাকলো বেশ কয়েকবার! লাবিব পাতা সহ সবাই ড্রয়িং রুমে আসে। ভোর বেলুন গুলো দেখিয়ে বলল,
-” দেখো কতোগুলো বেলুন! মটু, পাতলু, মাছ, বিমান!”
লাবিব গিয়ে ভোরের পাশে দাঁড়িয়ে দেখে সব! অরুণ গিয়ে সোফায় বসে! গরমে সে ঘেমে নেয়ে একাকার! জলপাই রঙের টি শার্ট গায়ে লেপ্টে আছে। পাতা গিয়ে ফ্যান ছাড়ে ফুল স্পীডে! তারপর পানি আনতে যাবে তার আগে অরুণের গলার আওয়াজ ভেসে আসে।
-” আম্মা! লেবুর শরবত আনবেন দুই গ্লাস! চিনি ছাড়া শুধু লবন দিয়ে!”
কথাটা যে লাবনী আক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলেছে অরুণ সরকার সেটা কারোরই বুঝতে বাকি নেই! রাতুল মিটমিট করে হাসে। পাতা অবাক হয়ে অরুণের দিকে চেয়ে। লাবনী আক্তারও অবাক হয় বেশ! কাল রাতে আন্টি বলল আজ আম্মা ডাকলো! তবে তিনি অবাকতাকে ঠেলে কিচেনে যায় সায় জানিয়ে। অরুণকে অস্বস্তিতে ফেলে না। এমনকি রাতুল, লুব ও কাওছারও কিছু বলে না। বলেছে এই অনেক! আতিকুর ইসলাম সবসময়য়ের মতো গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে তার ও বাকি সকলের নজর দরজায়! ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে বাজার দেখে সবার চোখ কপালে । বড় বড় চারটা রুই ও কাতল মাছ! পাশে আরো তিনটা বাজারের ব্যাগ! লতা গিয়ে ব্যাগের ভেতর থেকে আস্তে ধীরে সব বের করে!এক থলেতে পান সুপারি, মিষ্টি, সন্দেশ, পানতোয়া, জিলেপি ও দই! আরেক থলেতে গরু ও খাসির মাংসের পলি; বড় দুটো ব্রয়লার, একটা লেয়ার মুরগি ড্রেসিং করে এনেছে! তৃতীয় ব্যাগে শসা, টমেটো, লেবু, মশলাপাতি ও কিছু শাক সবজি! লতা সব দেখে আতিকুর ইসলামের উদ্দেশ্যে বলে,
-” আব্বু তোমার ছোট মেয়ের জামাই বাজার করে এনেছে! হয়তো ভেবেছে তুমি বিত্তশালী অতিথি আপ্যায়ন করতে সক্ষম হবে না!”
অরুণের মুখাবয়ব কঠিন হয়! রাতুল স্ত্রীর দিকে চোখ রাঙিয়ে চায়। মেয়েটা বেশি বলে! আতিকুর ইসলাম নরম গলায় অরুণকে বলল,
-” বাবা এসব..”
-” আমাদের ওখানে একটা রিচ্যুয়াল আছে!বিয়ের পর প্রথমবার শশুর বাড়ি এলে জামাই বাজার করে! আপনাদের এখানে হয়তো এই নিয়ম নেই; জানলে আমি করতাম না বাজার, যেচে অপমানিত হওয়ার জন্য!”
আতিকুর ইসলামকে থামিয়ে ভদ্র কন্ঠে বলল অরুণ! আতিকুর ইসলাম আর কিছু বলেন না। রাতুল লতার দিক কটমট করে চেয়ে অরুণের পাশে বসে বলল,
-” ভাই মজা করে বলেছে লতা!”
-” তাহলে ধরে নিবে আমিও মজা করেই বললাম!”
কাটকাট জবাব! রাতুল অপ্রসন্ন করুণ চোখে পাতার দিকে চায়! যার অর্থ এই যে তোমার ক্ষ্যাপা ষাঁড় তুমিই সামলাও! পাতা খানিকটা হেসে বলল,
-” কি নিয়ে পড়লে সবাই বাদ দাও তো এসব! বেলা কত হলো! সকালের খাবার খেয়ে নাও”
এরইমধ্যে লাবনী আক্তার শরবত নিয়ে আসে চার গ্লাস! অরুণ একগ্লাস নিয়ে অর্ধেকটা খেয়ে ভোরকে দিলো! ভোর বাবার কোলে বসে এক চুমুক খেয়ে মুখ কুঁচকে বলল,
-” উম্ টক! খাবো না!”
লাবনী আক্তার আরেকটা গ্লাস ভোরকে দিয়ে বলল,
-” এটা খাও! এতে চিনি আছে!”
ভোর মুচকি হেসে ঢকঢক করে সবটুকু খেয়ে বলল,
-” থ্যাংক ইয়ু নানু!”
লাবনী আক্তার মুচকি হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো! ভোর ক্লোজ আপ হাসি দেয় প্রতিত্তরে। ভোর আঙুলের ক্যাড় গননা করে বাবাকে জিজ্ঞেস করে,
-” আব্বু আমি যদি আরো এতগুলো বেলুন কিনি তাহলে কি ওগুলো আমাকে আকাশে নিয়ে যেতে পারবে?”
-” হুম”
অরুণ প্রতিত্তরে ছোট্ট জবাব দেয় ।
ভোর হাসিমুখে আবার সুধায়,
-” তাহলে আরো এতো এতো বেলুন কিনলে আমাদের বাড়িও উড়িয়ে নিয়ে যাবে ওগির বাড়ির মতো? তাহলে ভালো হবে তাই না? আমাদের বাড়ি আকাশে হবে! নিচের দিকে তাকিয়ে আমরা সবাইকে দেখবো! বড় বড় বিমান আমাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাবে!”
অরুণের গোমড়া মুখে হাসির ঝিলিক দেখা দেয়। ছেলের গালে মুখে চুমু দিয়ে বলল,
-” আমার কলিজা এতো কথা জানে!”
-” আমি সব জানি!”
বলে অরুণের কোল থেকে নেমে হাসে খিলখিলিয়ে। অরুণের অধরকোনায়ও মুচকি হাসি। পাতা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল। লাবনী আক্তার মেয়ের কাছে গিয়ে ধীমে সুরে বলল,
-” এভাবে বলা মোটেও উচিত হয় নি লতা! রাতুলকে যদি এভাবে পাতা বলতো?”
লতাও বুঝতে পারে এভাবে বলা ঠিক হয় নি। সে একবার স্যরি বলে নেবে সিদ্ধান্ত নেয়। সে মেয়েকে কোলে নিয়ে অরুণের সামনে যায়! রুম্পাকে অরুণের কোলে বসিয়ে দিয়ে বলল,
-” স্যরি বললাম কিন্তু! জামাই মানুষের এতো নাখরা থাকতে নেই! সম্পর্কে আপনার বড় হলেও বয়সে আপনার ছোট। একটু আকটু মজা করার হক আমাদেরও আছে! সেই হক থেকে বঞ্চিত করবেন নাকি?”
অরুণ প্রথমে খানিকটা হকচকিয়ে গেলেও লতার কথায় হেসে উঠলো। রুম্পাকে কোলে নিয়ে আদর করে বলল,
-” একদম না! বউয়ের বড় বোন তুমি।”
লতাও হেসে উঠলো! পাতা আবারো স্বস্তির শ্বাস ছাড়ে।
মধ্যাহ্নের সময়! অরুণ সরকার সবেই গোসল সেরে পাতার ঘরে বসে আছে। আজ শুক্রবার জুম্মার নামাজ আদায় করতে যাবে একটু পর! আযান হয় নি এখনো তাই অপেক্ষা। ছোট ভোর প্যান্ট শার্ট ও মাথায় টুপি পড়ে বসে আছে বাবার সাথে; বাবার সাথে সেও গোসল করেছে। আযান হলেই বাবা নানা ও সকলের সাথে নতুন মসজিদে যাবে। সে চুপচাপ মোটেও বসে নেই! এটা ওটা প্রশ্ন করে চলেছে অরুণকে।
-” আব্বু ফ্রাইডে তে মসজিদে নামাজ পড়লে জিলিপি দেয়! বাকি দিন দেয় না কেন?”
-” ফ্রাইডে জুম্মার দিন! এটি প্রত্যেক মুসলমানের জন্য সাপ্তাহিক ঈদের দিন। তাই!”
ভোর বিজ্ঞদের মতো মাথা নাড়ল। আবার চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল,
-” আচ্ছা আব্বু এই জিলিপি কি আল্লাহ তায়ালা দেয় ইমাম সাহেবের কাছে? তাহলে তুমি একটু আল্লাহকে বলে দিও আমি জিলিপি নিব না। আমাকে যেন চারটা কোন আইসক্রিম দেয়!”
অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে চায়। ভোরও বাবার দিকে তাকিয়ে; একটু পর পর কিউট ভঙ্গিতে চোখের পলক ফেলছে। অরুণের ঠোঁটে হাসি ফুটতে চায়; হাসি লুকিয়ে হাত বাড়িয়ে ছেলের মাথার টুপি টেনে ঠিক করে পড়িয়ে বলে,
-” তুমিই বলিও মোনাজাতে!”
ভোর মাথা নাড়ল। তখন খেয়াল করে বাবার হাতে কিছু হয়েছে। সে বাবার হাত ধরে উল্টিয়ে দেখে। ছিলে গেছে দুই জায়গায়। ভোরের মুখ খানি মলিন হয়ে যায়। উদ্বিগ্ন ভরা মায়াময় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
-” আব্বু? এখানে লাগলো কিভাবে? কিভাবে ব্যাথা পেয়েছো? কখন লাগলো? আমাকে বলো নি কেন?”
অরুণ ছেলেকে বুকে টেনে নিল! শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ঝুঁকে গালে মুখে চুমু দিয়ে। ফুলিয়ে রাখা ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,
-” একটু লেগেছে তো! ওতে কিছুই হয় না কলিজা!”
-” বেশি ব্যাথা করছে আব্বু?”
-” তুমি একটু আদর করে দাও! সব ব্যাথা হাওয়া হয়ে যাবে!”
হেসে বলে অরুণ! ভোর বাবার বুক থেকে মাথা তুলে গালে মুখে ছোট ছোট চুমু দেয়। আঘাত প্রাপ্ত হাতে কয়েকটি চুমু দিয়ে বিড়বিড় করে সুরা ফাতিহা বলে ফুঁ দিল।
দরজায় দাঁড়িয়ে আছে পাতা! বাবা ছেলের আবেগীয় মিষ্টি মুহূর্তের সাক্ষী সে। দুজনের মিষ্টি মধুর আলাপনে বাঁধা দিতে মোটেও ইচ্ছে করছিল না। আল্লাহ তায়ালা এদের বাবা ছেলেকে কোথাকার মাটি দিয়ে বানিয়েছে? সেই মাটি কি মিষ্টি ছিল নাকি? না হলে এরা বাবা ছেলে এতো মিষ্টি কেন? পুরাই রসগোল্লার হাঁড়ি! তার তো ইচ্ছে করছে টুপ করে গিয়ে গিলে ফেলতে! নিজের ভাবনায় পাতা নিজেই হাসে। সে সত্যিই পাগল হয়ে যাচ্ছে! সে শব্দহীন দরজা চাপিয়ে ধীর পায়ে গিয়ে বাবা ছেলের সম্মুখীন হয়ে দাঁড়ালো! ভোর পাতাকে দেখে বাবার হাত দেখিয়ে বলল,
-” আম্মু দেখ না আব্বু ব্যাথা পেয়েছে! হাত ছিলে গেছে কতখানি!”
পাতা দেখে বেশি না , এই এইটুকু ছিলেছে! তার জন্যই ছেলের এতো উদ্বিগ্নতা! নিঃসন্দেহে অরুণ সরকার একজন সার্থক বাবা। পাতা হেসে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা মলম বের করে বলল,
-” এই যে ওষুধ! এটা দিলে ঠিক হয়ে যাবে! তাই টেনশন নট!”
অরুণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পাতার দিকে চায়। তার চাহনি দেখে পাতা থতমত খেয়ে যায়। আঁচল ঠিক করে। গতরাতের ঘটনা রিপিট টেলিকাস্টের মতো চোখ সম্মুখে ভাসে! কপোল জোড়ায় রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে। হাত পা সর্ব শরীরে অস্বস্তি নামক পাখি বাসা বাঁধতে শুরু করে! অরুণ সেটা লক্ষ্য করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে। হাত বাড়িয়ে ইশারা করে মলম লাগিয়ে দিতে! পাতা অস্বস্তি পিছনে ঠেলে অরুণের সম্মুখীন হয়ে বিছানায় পা তুলে বাবু হয়ে বসল। অরুণের হাত টেনে কোলের উপর রাখে; মলম ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুলের ডগায় নিয়ে ধীরে ধীরে লাগিয়ে দিল! সাথে যত্ন সহকারে ফুঁ দিতে ভূলে নি! ভোর বাবার কাছ থেকে সরে আম্মুর পাশে বসে বলল,
-” আব্বু তুমি কিন্তু বললে না কিভাবে ব্যাথা পেলে? তুমি কি দুষ্টুমি করেছিলে?”
তার প্রশ্ন শুনে পাতা গোল গোল করে অরুণের দিকে চায়! অধর জোড়া চেপে হাসি আটকানোর বৃথা প্রচেষ্টায়! অরুণ তাকে চোখ রাঙিয়ে ভোরকে বলল,
-“সেটা তোমার জানতে হবে না!”
-” অবশ্যই জানতে হবে! বলো তুমি? যদি দুষ্টুমি করে থাকো তাও বলো! আমি বকবো না তোমাকে!”
জেদি কন্ঠস্বর! একদম বড়দের মতো করে বলল। যেন সেই অরুণ সরকারের বাবা। আর অরুণ তার ছোট ছেলেটি! পাতা ভোরের দিকে একবার তাকিয়ে অরুণের চোখে চোখ রাখলো! শালার জামাই! এখন জবাব দে? কি দুষ্টুমি করেছেন! আব আয়া না উট পাহাড় কা নিচে। তার হাসি বাঁধ ভেঙে ছড়িয়ে পড়তে চায়। অনেক কষ্টে আটকিয়ে রেখেছে। অরুণ নির্বিকার ভাবে বসে। মুখের অবায়ব ঠাহর করা যাচ্ছে না। পাতা আর নিজের হাসিকে বেঁধে রাখতে পারে না। বাঁধন ছেড়ে দেওয়া মুক্তিলোভি বিহঙ্গের মতোন ডানা ঝাপটিয়ে বেরিয়ে আসে। ডানা মেলে মুক্ত আকাশে মুক্তির আনন্দে উড়তে থাকে এলোমেলো! পাতার হাসি দেখে ভোর পিটপিট করে চায়। আম্মু ওভাবে হাসছে কেন? সে আব্বুর দিকে চায়। অরুণ মুখশ্রীতে এবার খানিকটা রাগ মিশে আছে। তবে সেটা কৃত্রিম নাকি প্রাকৃতিক ঠাহর করা মুশকিল! পাতাকে চোখে শাসায়। পাতা থামে না। হাসতে হাসতে তার চোখের কোনায় পানি জমে গেছে। বিছানায় একপ্রকার গড়াগড়ি খাওয়ার উপক্রম। ভোর জিজ্ঞেস করলো,
-” আম্মু এভাবে হাসছো কেন? আমাকেও বলো? আমিও হাসবো তোমার মতো করে!”
পাতা হাসতে হাসতেই বলল,
-” এক রাজ্যে এক ডাকাত ছিল! সে রাত্রে ডাকাতি করতে গিয়ে বিছানা থেকে পড়ে গেল। ধপাস!”
বলেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো! ভোর কিছু বুঝলো না তবে সে পাতার প্রাণখোলা হাসি দেখে নিজেও হাসতে লাগলো খিলখিলিয়ে! অরুণের চোখে মুখে এবার কৃত্রিম রাগের প্রতিচ্ছবিও নেই! প্রিয়জনের হাসির মনোমুগ্ধকর কলতানে চোখ, কান ,তনু মন শীতলতায় ছেয়ে যায়! তবুও কৃত্রিম ধমকের সুরে বলল,
-” কি হচ্ছে টাকি পাগলের মতো হাসছো কেন?”
পাতা ও ভোরের হাসি থেমে যায় ধমকে! দুজনে পিটপিট করে চায়। পাতা কাঁচুমাচু মুখে চায়। এ বিষয়ে তার লজ্জা পেয়ে অন্য মেয়েদের মতো বিছানার নিচে লুকিয়ে থাকার কথা থাকলেও সে আহম্মকের মতো হাসছে! পাতু তুই জীবনে ভালো হলি না। এখন তারই বা কি দোষ! তার হাসি পাচ্ছে আর সে কন্ট্রোল করতে পারছে না!
অরুণ চোখ রাঙিয়ে বলল,
পাতা বাহার পর্ব ৩৬
-” ভূতে ভর করেছে? এভাবে কেউ হাসে? এক থাপ্পড়ে কানে তালা ঝুলিয়ে দিবো!”
পাতা সটান হয়ে বসে। গাল ফুলিয়ে মন খারাপের রেশ ফুটিয়ে তুলতে চায় মুখশ্রী জুড়ে; কিন্তু ব্যার্থ হয়! হাসি যেন আবার বেড়িয়ে আসে। লোকটার ধমকেও যেন কেমন রসকস নেই! সে আবার হেসে উঠলো সাথে ভোর সঙ্গী! অরুণ হতাশ! এই মেয়ে ছোট ভোরের কোনো অংশে কম না। বিচ্ছু!