পাতা বাহার পর্ব ৩৮(২)
বেলা শেখ
ঝলমলে ভোর বেলা! পূর্ব দীগন্তে অরুণ উঁকি দিচ্ছে। তার লালিমায় ছেয়ে আছে দীগন্তের বুক। কালো মেঘ হীন পরিষ্কার আকাশে সাদা মেঘমল্লার দল বেঁধে উড়ে বেড়াচ্ছে। এ যেন শরতের আহ্বান জানিয়ে দিচ্ছে। যদিও বর্ষাকাল চলছে ঋতুচক্রে। হালকা শিশিরে গাছের পাতা ঘাস ভিজে আছে অল্প। মুক্ত বিহঙ্গের দল নীড় থেকে বেরিয়ে এসেছে। দলবেঁধে উড়ছে এলোমেলো। কখনো বাগানে তো কখনো ছাদের পেয়ারা গাছটাতে। তাদের কলতানে মুখরিত হয়ে উঠেছে পরিবেশ। অরুণ সরকারের বেলকনিতে কয়েকটি চড়ুই পাখির আগমন ঘটেছে। তারাই হইহুল্লোড় করছে। চি চি শব্দ পুরো রুম জুড়ে ধ্বনিত হচ্ছে।
অরুণ বেলকনিতে এসে দেখে চড়ুই পাখি গুলো টবে দেয়া পানিতে নেমে ঠোকাঠুকি করছে একে অপরের সাথে। অরুণ তাদের তাড়িয়ে দেয় না। ফিগ প্লান্টের চারার গোড়ায় পানি ঢেলে দেয়। এতে টব ভরে যায়। অরুণ সরে আসলে কিছু পাখি সেখানে গিয়ে পানি পান করছে নাকি আনন্দ করছে ঠাহর করতে পারল না। তাদের আনন্দ বোধহয় একজনের সহ্য হলো না। পাতাবাহার শিকারির মতো শব্দহীন পা ফেলে একটু একটু করে এগিয়ে খপ করে লাফ দিল পাখিগুলো ধরার উদ্দেশ্যে! কিন্তু পাখিগুলো বুঝতে পেরে কেটে পরে। বিড়াল শাবকটি টপ সমেত পড়ে যায়! টপ ভাঙে নি শুধু উল্টে গেছে।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
অরুণ বুকে হাত গুঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালে বিড়াল শাবক নিজেকে নিরপরাধ প্রমাণ করার জন্য সাফাই গায় কিউট ভঙ্গিতে মিঁয়াও মিঁয়াও! অরুণ চুপচাপ রুমে প্রবেশ করে; পাতাবাহার লেজ নাড়িয়ে তাঁর পিছু পিছু। তাদের বাড়ির আঙিনায় বসবাস করা সব পাখি উঠলেও তার ঘরে বাস করা দুটো পাখি এখনো গভীর নিদ্রায়। অরুণ সোফায় বসে থাকে। একা একা ভালো লাগছে না। সে চাইছে পাখি দুটো উঠুক আর তার কানের কাছে কিচিরমিচির করুক। অরুণ উঠে বিছানায় বসে। ভোর এপাশে শুয়ে আছে। অন্যপাশে পাতা গুটিসুটি মেরে কম্ফোর্টে আপাদমস্তক ঢেকে শুয়ে আছে। অরুণ ছেলেকে টেনে এনে বুকে জড়িয়ে ডাকে। ভোর পিটপিট করে চায়। ঘুম জড়ানো ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,
-” আব্বু ভোর ঘুম'”
-” অনেক হয়েছে ঘুম এখন উঠো কলিজা!”
ভোর দু হাত তুলে হামি দেয়। বাবার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর তার কাঁধে মুখ গুঁজে পুনরায় ঘুমের প্রস্তুতি দিবে অরুণ তা হতে দেয় না।
-” একদম ঘুমাবে না। অনেক বেলা হয়ে গেছে। একটু পরেই আমি অফিসে যাবো! তোমার আম্মুকে ডাকো?”
গম্ভীর গলা শুনে ভোরের ঘুম গায়েব হয়ে যায়। ঠোঁট উল্টে বাবাকে ছেড়ে বিছানায় বসে। কম্ফোর্ট টেনে আম্মুকে ডাকে। কোনো প্রতিক্রিয়া না পেয়ে বাবার দিকে চায়!
-” কম্ফোর্ট সরিয়ে টেনে তোলো!”
বাবার কথায় ভোর গাল ফুলিয়ে কম্ফোর্ট সরিয়ে দেয়। বাহু ধরে টেনে চিৎ করে শুইয়ে দেয় আর ডাকে,
-” আম্মু? ও আম্মু? গুড মর্নিং হয়ে গেছে ওঠো না! আম্মু?”
পাতা আড়মোড়া ভেঙে পিটপিট করে এপাশে ফিরে । ভোরকে দেখে মুচকি হেসে গুড মর্নিং বলে। ভোর হাসে না। উদ্বিগ্ন হয়ে পাতার গালে হাত রেখে বলল,
-” আম্মু তোমার গালে কি হয়েছে? ফুলে গেছে?”
ব্যাথায় পাতার মুখ কুঁচকে যায়। ভোরের হাত সরিয়ে গালে হাত রাখে। অনুভব করতে পারে তার গাল সহ মুখশ্রী ফুলে কলা গাছ বনে গেছে। সব ওই নাক উঁচু ম্যানারলেস রাক্ষস লোকটার জন্য। অরুণ পাশেই ছিল ছেলের কথা শুনে এগিয়ে এসে পাতার কাছে বসে। থুতনি ধরে এপাশ ওপাশ করে। পুরো মুখশ্রীই ফুলে গেছে তবে ডান গালটা বেশি ফুলে গেছে। আর কামড়ের জায়গায় কালসিটে দাগ পড়েছে। বোঝাই যাচ্ছে কালকের কামড়ে কতটা প্রভাব ফেলেছে। অরুণ পাতার কপালে গলায় হাত রাখে! গা গরম, জ্বর এসেছে; তবে বেশি না। পাতা পিটপিট করে অরুণের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করে। এরপর উঠে বসে। ভোর দুঃখি গলায় বলে,
-” আম্মু ব্যাথা পেলে কিভাবে? গালে কি হয়েছে?”
পাতা রাগি রাগি চোখে অরুণের দিকে চেয়ে ঘুম জড়ানো মোটা ভাঙ্গা গলায় হিসহিসিয়ে বলে,
-” ডাকাত হামলা করেছিল! মানুষ খেকো রাক্ষস ডাকাত!”
ভোরের মুখশ্রী জুড়ে ভয়ের আবির্ভাব ঘটে। ডাকাত! রাক্ষস! মানুষ খায়! সে পাতাকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। পাতা খানিকটা হাসে। ফুলো লাল মুখশ্রীতে তার হাসি মিষ্টি লাগছে। অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে চেয়ে; নজর পাতার গালে নিবদ্ধ। ইশ্ গালটার সাথে মুখটার কি হাল হয়েছে। তবে মন্দ লাগছে না। রাগি রাগি চাহনি, ফুলো ফুলো গাল! তবে গালের লাল লাল কালসিটে দাগ দেখে খানিকটা মায়া হয়। সে হাত বাড়িয়ে গালে রাখে। পাতা ঝটকায় সরিয়ে দিলো। অরুণ মুচকি হেসে বললো,
-” আমাদের বাগানে পেঁপে গাছ আছে বেশ কয়েকটা। সেখানে পেঁপে ধরেছে বড় বড় ফুলো ফুলো! একদম তোমার গালের মতো পাতাবাহার!”
পাতা কটমট করে তাকালো। মজা উড়াচ্ছে লোকটা? তার কষ্ট হচ্ছে। ব্যাথায় কথা বলতে পারছে না ভালোকরে। আর লোকটা হাসছে। পাতা কিছু বলে না। তবে ভোর চুপ থাকে না। পাতাকে ছেড়ে অরুণের সামনে দাঁড়িয়ে মাথার চুল টেনে ধরে শক্ত করে।
-” আম্মু ব্যাথা পাচ্ছে আর তুমি হাসছো? মজা করছো? তুমি পঁচা!”
-” আরে বাবা! আচ্ছা হাসবো না মজাও করবো না। ছাড়ো ভোর?”
অরুণের কথায় ভোর ছাড়ে না বরং আরো শক্ত করে ধরে। পাতার গোমড়া মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বিছানা থেকে নেমে ওয়াশ রুমে চলে গেল। অরুণ ছেলেকে কোলে নিয়ে তার পিছনে গেল। পাতা পিছনে মুড়ে প্রশ্নাত্মক চোখে চায়।
-” ব্রাশ করিয়ে ফ্রেশ করিয়ে দিবো ছেলেকে!”
পাতা অরুণের কোল থেকে ভোরকে নামায়! হাত ধরে নিয়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে ধরাম করে দরজা বন্ধ করে। অরুণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। নিচে গিয়ে সরাসরি কিচেনে প্রবেশ করলো নক করে। কিচেনে আভারি ও মিনু! মিনু রুটি বেলছে আভারি চুলায় বসানো কড়াইয়ে ভাজি নাড়ছে। অরুণকে দেখে মিনু বলল,
-” কিছু লাইগবে স্যার? চা দিবো?”
অরুণ খানিক হেসে আটার বৈয়াম নিলো।
-” না! আমি করে নিচ্ছি। মিনু আপা আর কয়েকটা দিন কিচেন সামলান এরপর আপনার কিচেনে আসা বন্ধ!”
-” মানে স্যার বুঝলাম না?”
-” ডাক্তার আপনাকে পুরোপুরি রেস্টে থাকতে বলেছে না? সব কাজ বন্ধ। নতুন লোক আসবে। সেই রান্নার কাজ করবে। আপনার লং টাইম ছুটি!”
মিনু অবাক সুরে বলে,
-” স্যার আমি রান্না বান্না করতে পারবো! সমস্যা..”
-” কোনো কথা না। আপনার সাবধানে থাকতে হবে। কোনো কাজ না শুধু রেস্টে থাকবেন। আপনার ভাগের কাজ আভারি ভাইকে দিয়ে করিয়ে নিবো!”
মিনু আর কথা বলার পথ খুঁজে পায় না। আভারি কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে অরুণের দিকে চায়। ডাক্তার আপা বলেছে যে খুব সাবধানে থাকতে হবে; প্রপার যত্ন নিতে হবে। ভারি কাজ তো দূর অতি দরকার ব্যাতিত কোন কাজ যেন না করে। বাচ্চা মিসক্যারেজ হতে পারে। খুবই নাজুক অবস্থায় আছে।
অরুণ আর কিছু বলে না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। নরম করে পরোটা বানিয়ে অমলেট ভেজে নেয়। সাথে দুটো গ্লাসে গরম দুধ ঢেলে নিল। একটা ট্রেতে সব গুছিয়ে জগ ভরে পানি নিল। ফ্রিজ থেকে কিছু বরফের টুকরো ছোট বাটিতে নিয়ে ট্রেটে রেখে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়!
পাতা ভোরকে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নেয়। পড়নের জামাকাপড় চেঞ্জ করে শাড়ি পড়ে বিছানায় বসে থাকে। ভোর এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। ডাকাত কোথা থেকে এলো? তাকে বা আব্বুকে কেন ডাকলো না আম্মু? ডাকাতটা কি রাক্ষস ছিল? বড় বড় দাঁত ছিলো ভ্যাম্পায়ার দের মতো? আম্মু ভয় পেয়েছে কি না! পাতা কি উত্তর দিবে ভেবে পায় না। আরে এ রাক্ষস ডাকাত সেই রাক্ষস ডাকাত না। এতো মানুষ রুপি ভদ্র ভেসে ঘুরে বেড়ানো ভোরের কলিজার আব্বু! যে কিনা তার ওই কিউট পরিপাটি দাঁত বসিয়ে তার নরম গালটার তেরোটা বাজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেটা তো বলা যায় না। তাই ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এতেও ছেলেটা চুপ করে নেই এটা ওটা বলেই যাচ্ছে। পাতা শুধু হু হা করছে। গালে ব্যাথা বেড়ে যাচ্ছে সাথে চোখ ও মাথা ব্যথা করছে। জ্বর জ্বর লাগছে। চোখ ভরে উঠছে বারংবার। এরই মধ্যে অরুণ সরকারের আগমন ঘটে রুমে। পাতা মাথা উঁচু করে তাকালো। লোকটার হাতে খাবারের ট্রে! অরুণ ট্রে টি টেবিলের উপর রেখে পাতার দিকে চায়। ভিজে ওঠা চোখের পানি নজর এড়ায়নি। অরুণ বরফের টুকরো গুলো একটা মসলিন সুতি কাপড়ে পেঁচিয়ে পাতার সামনে দাঁড়ায়। থুতনি ধরে মাথা উঁচু করে গালে বরফ ছোঁয়ায়। পাতা চোখ মুখ কুঁচকে নেয় ব্যাথায়। ভোর এগিয়ে এসে পাতার পাশে বিছানায় দাঁড়িয়ে গালে ফুঁ দিয়ে আদুরে গলায় বলে,
-” আম্মু? ব্যাথা করছে? বরফ দিলে একদম ঠিক হয়ে যাবে দেখে নিও!”
অরুণ মুচকি হাসলো।
-” এটুকুতেই এই অবস্থা পাতাবাহার? ভবিষ্যত তো পড়েই আছে!”
কি সব ছিঃ মার্কা কথাবার্তা! পাতার ইচ্ছে হয় লোকটার দাড়িযুক্ত গালে কামড়ে শোধ বোধ করতে। শালার জামাই! শুনেছে জামাই মানুষ বউকে আদর করে সোহাগে ভরিয়ে রাখে। কই তার জামাই তো আদর সোহাগ করে না। করে না তেমন না! একটু একটু যত্ন করে আদরও করে মাঝেমধ্যে তবে আদরের সাথে কামড় ফ্রি! তার ভাবনার মাঝেই অরুণ পাতার হাতে বরফে মোড়ানো কাপড় দিয়ে বলে,
-” গালে ঘঁষে দাও!”
পাতা বাধ্য মেয়ের মতো গালে বরফ ঘষতে থাকে। অরুণ হাত ধুয়ে রুটির প্লেটটা হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর গলায় আদেশের সুরে বলে,
-” ভোর! চুপচাপ বিনা বাক্যব্যয়ে সবটুকু খাবার শেষ করবে দুজনেই! কোন কথা যেন না হয়! ”
ভোরের মুখে খাবার দেয়। ভোর খাবার চিবিয়ে উজ্জ্বল মুখে সুধায়,
-” তুমি বনিয়েছো?”
অরুণ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো। পাতা ফ্যালফ্যাল করে চায়। লোকটা নিজে রান্না করে এনেছে? এইরকম জামাই ই তো সব মেয়েরা চায়; যে রান্না করে নিজ হাতে খাওয়াবে। পাতার মন পুলকিত হয় তবে সেটা প্রকাশ করে না। গোমড়া মুখেই অরুণের হাতের খাবার খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। হঠাৎ মনের ভিতর শয়তানী শখ জাগে। অরুণ মুখে খাবার দিলে পাতা তার আঙ্গুলসহ মুখে পুরে কামড় বসায়। জোরে না তেমন, আস্তেই দেয়। সে আবার দয়ালু কি না! ব্যাথা তো তার জামাইটাই পাবে। অরুণ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। স্বাভাবিকভাবেই ন্যায় ব্যাপারটা। পাতা তার দিকে ছোট ছোট চোখে চায়। অরুণ মুচকি হেসে তার মুখে আবার খাবার দিয়ে বলে,
-” পাতাবাহার তোমার ওইটুকুনি দাঁত আমার কিছুই করতে পারবে না!”
ভোর বাবার কথা বুঝতে না পেরে বলে,
-” আব্বু কি হয়েছে?”
পাতার গলায় খাবার আটকে যায়। অরুণ প্লেট রেখে পানির গ্লাস এগিয়ে দেয়। পাতা পানি পান করে। অরুণ তার মাথায় আলতো চর দিয়ে বুলিয়ে দিতে থাকল। পাতা স্বাভাবিক হয়।
-” ঠিক আছি আমি!”
অরুণ আবার প্লেট হাতে নিলে পাতা মুখ কুঁচকে বলে,
-” আমি আর খাবো না। পেট ভরে গেছে আমার!”
অরুণ চোখ রাঙিয়ে মুখের সামনে খাবার ধরে।পাতা মুখে না নিয়ে আঙ্গুল উঁচিয়ে বলে,
-” একদম চোখ রাঙাবেন না! একটু কিছু হলেই চোখ গরম করে তাকাবে। আর খাবো না আমি।”
অরুণ শান্ত দৃষ্টিতে পাতার দিকে তাকায়। পাতা মুখ ঘুরিয়ে নেয়। চোখে অল্প নোনা জলের আভাস! অরুণ আর জোর করে না। ছেলের মুখে খাবার দেয়। ভোর মুখে পুরে বলে,
-‘ আব্বু আমিও আর খাবো না। আমার পেটও ভরে গেছে। সত্যিই বলছি!”
-” ঠিকাছে।”
বলে অরুণ সোফায় বসে বাকি খাবার শেষ করে। পাতা বসে থাকে না। তার মাথা ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। বমি বমি ফিল হচ্ছে। পাতা কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে শুয়ে পড়ে। ভোর পাতার গালে চুমু দিয়ে বাবার ফোনটা নিয়ে সোফায় বসে গেম খেলতে থাকে। বেলকনি থেকে পাতাবাহার দৌড়ে এসে অরুণের পায়ের কাছে বসে মিয়াও মিয়াও করতে থাকে। এতক্ষণ সে বেলকনিতেই ছিল! ছোট ছোট পাখিকে ধরবে বলে ঘাপটি মেরে বসেছিল। কিন্তু বজ্জাত পাখি গুলো ধরাই দিল না। কাছে যাওয়ার আগেই ফুরুৎ!
অরুণ অল্প রুটি ডিম বিড়াল ছানার সামনে দেয়। সে কৃতজ্ঞতা সরূপ মিয়াও বলে চাটতে লাগলো। অরুণ খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে নেয়। তার ব্যাক্তিগত ওষুধের বাক্স পেইন কিলার ও জ্বরের ওষুধ বের করে। এক গ্লাস দুধ ভোরকে খাইয়ে দিল। অপর গ্লাস দুধ, ওষুধ সমেত নিয়ে বিছানায় বসে। নরম সুরে পাতাকে ডেকে বলে,
-” দুধটুকু দিয়ে ওষুধ খেয়ে নাও। জ্বর ব্যাথা দুটোই কমে যাবে!”
পাতা বেরোয় না কম্ফোর্টের ভিতর থেকে। জিদ ধরে শুয়ে থাকে। ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়ে এখন দরদ দেখাচ্ছে। অরুণ এক হাতে কম্ফোর্ট সরিয়ে দিয়ে ধমকের সুরে বলে,
-” ভালোভাবে বললে কথা কানে ঢোকে না, না?”
পাতার চোখ ভরে ওঠে। ধমকাচ্ছে তাকে! সে চুপচাপ উঠে বসে হাত পাতে ওষুধের জন্য। অরুণ হাতে দেয় না হা করতে বলে! পাতা ফোঁস ফোঁস করে তাকিয়ে হা করে। অরুণ ওষুধ দিয়ে দুধের গ্লাস মুখে দেয়।
-” সব টুকু শেষ করবে!”
পাতা শেষ করে মুখ মুছে পুনরায় বিছানায় শুয়ে পড়লো। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ট্রে নিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে। পাতা উঁকি দিয়ে দেখে সবটা। খানিকটা হেসে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” তোমার বাবা কি আজ অফিসে যাবেন?”
ভোর মোবাইল থেকে মুখ তুলে মুচকি হেসে জবাব দিল,
-” বলল তো যাবে!”
আর কিছু বলে না পাতা। মন টা আবার খারাপ হয়ে যায়। লোকটা অফিসে যাবে। বাড়িতে একা একা ভালো লাগবে না তার! ভোর তো খেলা ধুলা নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। এই ট্যাটু ওয়ালা গাল নিয়ে ঘর থেকেই তো বের হতে পারবে না। শাশুড়ি সহ বাকি সবাই কি ভাববে?
তার ভাবনার মাঝেই অরুণের আগমন ঘটে। আলমারি থেকে স্যুট বের করে নিয়ে ওয়াশ রুম যায়! শুয়ে থাকতে ভালো না লাগায় পাতা বিছানা থেকে নেমে বারান্দায় যায়। অরুণ ওয়াশরুম থেকে এসেই বিছানায় তাকায়। পাতাকে না দেখে কপালে ভাঁজ পড়ে। ভোরের দিকে তাকাতেই ভোর ইশারায় বেলকনি দেখিয়ে বলে,
-” আম্মু ওখানে!”
ওহ্ বলে অরুণ ড্রেসিন টেবিলের সামনে যায়। চুল পরিপাটি করে পারফিউম লাগায়। টাই বাঁধার পর সাদা শার্টের উপর কালো কটি পড়ে নেয়। গলা উঁচিয়ে ডাকে,
-” পাতাবাহার?”
পাতা এগিয়ে আসে। প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকায় অরুণের দিকে। অরুণ ভোরকে বলে,
-” আব্বু ফোনটা দাও?”
ভোর ফোন দিয়ে বলল,
-” আব্বু আম্মু অসুস্থ তুমি আজ অফিস থেকে ছুটি নাও না?”
অরুণ ফোন পকেটে পুরে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়। গালে মুখে চুমু দিয়ে বলে,
-” ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে আব্বু! জলদি আসার চেষ্টা করবো! তুমি নিজের খেয়াল রাখবে সাথে তোমার আম্মুরও!”
ভোর মাথা নেড়ে সায় জানালো। বাবার কপালে গালে চুমু দিয়ে আবদার করে,
-” আসার সময় আমার জন্য নতুন ব্যাট বল নিয়ে আসবে কিন্তু?”
-” ওকে কলিজা। পাতাবাহার সাবধানে থাকবে। ঘরে বসেই রেস্ট নাও! ফোন কাছেই রেখো আমি ফোন করবো! হুম?”
অরুণের কথায় বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ল পাতা। অরুণ ছেলেকে নামিয়ে দিয়ে হাত ঘড়ি বাঁধতে বাঁধতে ব্যস্ততার সুরে বলল,
-” কলিজা? স্টাডি রুমে আমার ল্যাপটপ আছে একটু এনে দিবে প্লিজ?”
-” এখুনি আনছি!”
মুচকি হেসে বলে ভোর দৌড়ে বেড়িয়ে আসে ঘর থেকে। স্টাডি রুমের দরজা ধরাম করে খুলে ল্যাপটপ খোঁজে, কিন্তু পায় না। পুরো ঘরের আনাচ কানাচে খুঁজে হয়রান সে। তার স্কুল ব্যাগ অবধি বাদ রাখে না। কিন্তু ল্যাপটপ কোথাও নেই। ভোর চিন্তিত ভঙ্গিতে বেড়িয়ে আসে। রুমে ঢুকে বলে,
-” আব্বু পেলাম না ল্যাপটপ!”
অরুণ পাতাকে ছেঁড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ঘুরে ছেলের দিকে ফিরে হেসে বলে,
-” স্যরি আব্বু! ল্যাপটপ এখানেই আছে। ওই ব্যাগে খেয়াল ছিল না!”
ভোর গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে। অরুণ ছেলেকে কোলে তুলে বিছানায় দাঁড় করিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” সাবধানে থাকবে। তোমার আম্মুর সাথে সাথেই থাকবে। কোন প্রবলেম হলে কল করবে আমায়!”
ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে। অরুণ হেসে ছেলের ঠোঁটে চুমু খায়। ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে ব্লেজার হাতে নিয়ে পাতার গালে হাত রেখে কপালে ও গালে ছোট চুমু দেয়।
-” আসছি পাতাবাহার!”
বলে দাঁড়ালো না। হনহনিয়ে চলে যায়। পাতা আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো। শরীরটা কেমন দুলছে। বুকটা কেঁপে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। এ কেমন মরণ যন্ত্রণা! সে ভোরের দিকে একপল তাকিয়ে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়ে। আপাদমস্তক কম্ফোর্টে ঢেকে নিয়ে বালিশে মুখ লুকায়। ভোর উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-” আম্মু কি হয়েছে?”
-” ইটেরর ভাটায় কয়লা দিয়া আগুন
জ্বালাইছে(২)
দেওয়ানা বানাইছে
কি জাদু করিয়া বন্দে মায়া লাগাইছে!”
সুর দিয়ে বলে পাতা। ভোরের কপালে চিন্তার রেখা। আম্মু গান গাইছে কেন? সে গলা উঁচিয়ে আব্বু বলে ডাক দেয়। পাতা উঠে বসে চোখ বড় বড় করে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” কিছু হয় নি আমার! আই এম ফাইন!”
-” সত্যিই?”
পাতা দাঁত বের করে হেসে ভোরকে টেনে শুইয়ে দেয়। নিজেও শুইয়ে পড়ে পাশে। মুচকি মুচকি হেসে ভোরকে বলে,
-” ভোর তোমার আব্বু এতো ভালো কেন?”
-” কি জানি!”
ঠোঁট উল্টিয়ে বলে ভোর! পাতা হাসে। তার খুব হাসি পাচ্ছে। এতোগুলো ভালো লাগছে। মন প্রসুণে পায়রা ডাকছে বাকবাকুম! মনে হচ্ছে সে মেঘের মতো করে আকাশে ভাসছে।
সরকার জুয়েলারি ফ্যাশন হাউসে প্রবেশ করে রাসেল, শুভ, জীবন, দীপ্ত, ফয়সাল। অফিসের প্রায় সকলেই চেনে তাদের। বসের বন্ধু হওয়ার সুবাদে প্রায়ই আসে তারা। এসেই হইহুল্লোড় বাজিয়ে ফেলে। যেন সব কটা তরুণ ছেলেপেলে। মারামারি, দৌড়াদৌড়ি, কাড়াকাড়ি সব চলে। তাদের বসও বন্ধু পেলে মাতিয়ে আড্ডা দেয়। গম্ভীর মুখে থাকা অরুণ সরকারকে হাসতে দেখা যায়। বন্ধু এমনি একটা জিনিস যারা সিরিয়াস মুহূর্তেও সিরিয়াস থাকতে দিবে না। ইমোশনাল কথাবার্তাকে গুলি মেরে ফানি আলাপে কনভার্ট করবে। শত ফ্রাস্ট্রেশনের মাঝে থেকেও বন্ধুদের সাথে প্রাণখোলা হাসি আটকানো দায় হয়ে পড়ে। দুঃখের কথা বললে স্বান্তনা না দিয়ে পঁচাবে; কখনো সিরিয়াসলি নিবে না।হেসেই উড়িয়ে দিবে। অথচ বিপদে পড়লে তারাই আগে ঝাঁপিয়ে পড়বে। বুকে জড়িয়ে সাহস দিবে না বরং পিঠ চাপড়ে বলবে এতেই কুপোকাত? আমরা আছি না? বসের বন্ধুদের আসতে দেখে সুজন এগিয়ে আসে। হাসিমুখে বলে,
-” ভালো আছেন সবাই?”
রাসেল গম্ভীর মুখে পকেটে হাত ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলে,
-” সালাম কালাম দিতে জানো না?”
সুজন ঝটপট সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে ভালো আছে কিনা! শুভ মুচকি হেসে বলল,
-” আর ভালো থাকা! ষাঁড়টা কোথায়?”
সুজনের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে ষাঁড় বলতে এরা কাকে বুঝিয়েছে! বসের বন্ধুরা বসকে ষাঁড় বলেই ডাকে মাঝে মাঝে।
-” স্যার একটু গ্রাউন্ড ফ্লোরে আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি। আপনারা কেবিনে গিয়ে বসুন!”
সবাই অরুণের কেবিনের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়। জীবন হঠাৎ থেমে সুজনের উদ্দেশ্যে বলে,
-” ওয়েটার থুরি ম্যানেজার! ছয় প্লেট ফ্রাইড রাইস, ব্রিফ কাবাব! সাথে চাটনি যেকোনো একটা হলেই হবে! ফাস্ট ফাস্ট হ্যাঁ?”
সুজন মাথা নাড়ায়। জীবন হেসে হাঁটা দেয়। শুভ ধমকের সুরে বলে,
-” শালা তোরা ভালো হলি না। এটা রেস্টুরেন্ট লাগে? তোর বাপের?”
-” দেখ বাপ তুলে কথা বলবি না অশুভ! লাঞ্চের টাইম। পেটে ইঁদুর লুঙ্গি ডান্স করছে। না খেয়ে যাবো না।”
সবাই হেসে উঠল জীবনর কথায়। শুভ জীবনের পিঠে চাপড় মেরে বলল,
-” শালা খাই খাই কম্পানি!”
জীবন টিপ্পনী শুনেও দাঁত কেলায়!
অরুণ কেবিনে প্রবেশ করে বেশ সময় পড়ে। ঢুকেই অবাক এটা তার কেবিন নাকি কোনো খাবার হোটেল! খাবারের গন্ধে পুরো রুম জুড়ে মো মো করছে। তার অতি ভদ্র লোক বন্ধুরা খাচ্ছে অতি আনন্দে। যেন কত দিনের অভুক্ত। সে যে এসে দাঁড়িয়েছে সেটা খেয়ালই করে নি। সে দরজা বন্ধ খরে গলা খাঁকারি দিলো। সবাই অরুণের দিকে তাকিয়ে হাসে। রাসেল খাবার গলাধঃকরণ করে বলে,
-” শালা কখন থেকে বসে আছি তোর খবর নেই! এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে আসতে হবে নাকি!”
অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফয়সালকে ঠেলে তার পাশে বসে বলে,
-” নিলে ভালো হয়। তা কি মনে করে উদয় হলি?”
দীপ্ত অরুণের দিকে একটা প্লেট বাড়িয়ে দিয়ে ইশারায় খেতে বলে। অরুণ প্লেট নেয়। চামচ থাকায় হাত ধুতে হয় না। মুখে পুরে খাবার। শুভ বলে,
-” তুই তো খোঁজ খবর নিবি না তাই ভাবলাম আমরাই একটু দেখা করে আসি! বেঁচে আছিস নাকি টপকে গেছিস!”
ফয়সাল মুখে খাবার তুলে অরুণের দিকে আড়চোখে চেয়ে বলে,
-” কি যে বলিস না শুভ! আমাদের অরু এক সুন্দরী রমণী বিয়ে করে এতো জলদি টপকে যাবে? এখন তো তার মধুমাস চলে! নতুন বউ নিয়ে মজে আছে তাই বন্ধুদের ভুলে গেছে!”
রাসেল টিপ্পনী কেটে ফিসফিস করে বলে,
-” তা কেমন চলছে মধুমাস? মধু সংগ্রহ টংগ্রহ করেছিস? এক্সপেরিয়েন্স বল শালা!”
দীপ্তও রাসেলের মতো করে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” সংগ্রহ করা বাদ রাখবে? অরুণ সরকার? আমি জীবনেও বিশ্বাস করি না! শালা তো মনে হয় রাতভর মধু..”
আর বলতে পারে না। অরুণ তার মুখে চাটনি পুরে দেয়। কটমট করে বলে,
-” শালারা এসব কি শুরু করেছিস? মুখে লাগাম টান! বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু!”
-” আচ্ছা টানলাম এখন বল কেমন চলছে মধুমাস মানে বিবাহিত পরবর্তী জীবন?”
ফয়সালের কথায় অরুণ ছোট জবাব দিল,
-” আলহামদুলিল্লাহ ভালো! এখন টপিক চেঞ্জ কর!”
শুভ শান্ত চোখে অরুনের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” পাতাকে কেমন পর্যবেক্ষণ করলি? ভোরের যত্ন নেয় ? আগলে রাখে?”
এবার অরুণের ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো।
-” যথেষ্ট পরিমাণে!”
শুভও হাসে। জীবন টিপ্পনী কেটে বলে,
-” দেখছিস অরু ব্লাস করছে! এই ভালোটালো বেসে ফেলিস নি তো আবার?”
-” সুন্দর কিউট আদরের বউ আমার! ভালোবাসবো না?”
‘ওহ হোওও’ ধ্বনিতে সবাই চিল্লিয়ে ওঠে সমস্বরে। অরুণ কানে হাত দেয়। ফয়সাল কানে থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে কিছু বলে ফিসফিসিয়ে। অরুণ খাওয়া বাদ রেখে তার পিঠে গোটাকয়েক আদর বসিয়ে দেয়। ফয়সাল পিঠ বাঁকিয়ে বলে,
-” বদ দোয়া দিলাম! তোর আদরের বউ তোরে নাকানিচোবানি খাওয়াবে!”
অরুণ হাসে তবে কিছু বলে না। বন্ধুদের মাঝে খুনসুটি বাড়তে থাকে যত সময় অতিবাহিত হয়। অরুণ সরকারের কেবিন যেন আজ কর্মস্থল থেকে আড্ডাস্থলে রূপান্তরিত হয়েছে। সময়ের পর সময় গড়িয়ে যায় তাদের আড্ডা শেষ হয় না। চলতেই থাকে। বন্ধুরা সবাই মেতে ওঠে পুরনো স্মৃতি চারণে। হয়ে ওঠে সেই কিশোর বয়সের অরুণ, শুভ, দীপ্ত, ফয়সাল,রাসেল, জীবন। আবার সদ্য আঠারোয় পা দেয় তো কখনো ত্রিশের তাগড়া পুরুষ। আড্ডার এক পর্যায়ে রাসেল বলে,
-” অরুণ আমাদের ব্যাচের সবাই একটা পার্টি অর্গানাইজড করেছে!তোকেও ইমেইল পাঠানো হয়েছে চেক করেছিস কি?”
-” না ইয়ার। ব্যস্ত ছিলাম খুব। রি ইউনিয়ন? তাহলে তো ভালোই হয়!”
অরুণের কথায় জীবন হেসে বলে,
-” সেটা তো দু বছর আগে হলোই! কাপল পার্টি হবে! যে যার স্পাউস নিয়ে যাবে। কোনো বাচ্চা কাচ্চা না। যাস্ট হি এন্ড সি! তুই তো আর সিঙ্গেল নস সুন্দরী কিউট আদরের বউ আছে!”
অরুণ হেসে তার মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
-” উম বাচ্চা এলাও না! তাহলে যাওয়া হবে না। তোরা সবাই যাবি?”
শুভ বিরক্ত হয়ে বলে,
-” অরু তোর নাটক বাদ দে! সারাজীবনের জন্য যাচ্ছিস না। মাত্র এক বেলা। ভোর বাড়িতেই থাকতে পারবে। আমরা সবাই যাবো তুই ও যাচ্ছিস!”
অরুণ হামি তুলে বলে,
-” সে দেখা যাবে! কবে হবে পার্টি?”
-” পরশু সন্ধ্যা থেকে। ইমেইল চেক করিস সব ডিটেইলস পেয়ে যাবি!”
-” ওকে! তোরা কি এখানেই থাকবি? আমার আজ জলদি ফিরতে হবে! মেয়েটা অসুস্থ!”
জীবন কপালে ভাঁজ ফেলে সুধায়,
-” তোর আবার মেয়ে কবে হলো?”
ফয়সাল হেসে চোখ টিপে বলল,
-” আরে এই মেয়ে সেই মেয়ে না। এতো ওর আদরের বউ!”
-” ফাজিলের দল!”
বলে অরুণ সরকার উঠে আসে। এদের সাথে থাকলে সময় কখন চলে যাবে বোঝাই যায় না। সে সুজনের কাছে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বন্ধুদের সমেত অফিস থেকে বেড়িয়ে আসে। গন্তব্যস্থল পাতাবাহার ও কলিজা! যাওয়ার আগে ছেলের জন্য ব্যাটবল কিনে নেয় শপিং মল থেকে। বেড়িয়ে আসার সময় শাড়ির দোকানের দিকে নজর পড়লো। একটা সুন্দর সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস কালো শাড়ি। ভালোই লাগছে। আর কিছু না ভেবে প্যাক করে নেয়।
সারাবেলা শুয়ে বসেই কেটেছে পাতার। ঘর থেকে বেরই হয় নি। ভোর, আনিকা ও রূপের সাথে ঘরে ও বেলকনিতে সময় পার করেছে। কখনো বাচ্চাদের সাথে লুডু খেলেছে তো কখনো কার্টুন দেখেছে; বন্দুক নিয়ে চোর পুলিশ খেলেছে। সবমিলিয়ে সুন্দর একটা সময় কেটেছে তার। এমনিতেই তার মনটা আজ অনেক অনেক ভালো,ফুরফুরে, সতেজ। তার মন কাননে অসংখ্য ফুল ফুটেছে। অসংখ্য রঙ বেরঙের প্রজাপতি তাদের ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে। তার সাদাকালো আকাশে এখন রামধনুর খোঁজ পাওয়া যায়। মনটা অকারণেই নেচে গেয়ে বেড়াচ্ছে। অধরকোন থেকে হাসি যেন সরছেই না। এমনকি সে এখনো হাসছে। তাও একা একা। সে এখন একটা সিক্রেট রুমে বসে আছে। যার খোঁজ ভোর আজকে তাকে দিয়েছে। সে প্রায় মাস হবে এ বাড়িতে থাকছে। তাঁদেরই ঘর থেকে আরেকটা সিক্রেট রুমে যাওয়া যায় সে জানতোই না।
এ ঘরের বেলকনির দেয়ালে একটা দরজা আছে। যেটা সে কখনো খেয়ালই করে নি। সেই দরজা খুললেই এই সিক্রেট ঘর। অবশ্য স্টাডি রুম থেকেও আসা যায় এখানে। সে আজ প্রথম বার প্রবেশ করে ভোরের সাথে। ঘরটা তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ছোট একটা রুম। রুমের ফ্লোরে শুধু ম্যাট্রেস বিছানো বিছানা আর বেশ কিছু টব। একপাশের দেয়াল পুরোই গ্লাস লাগানো। সেখানে পর্দা ঝুলছে। যদিও পর্দা পাতা একপাশে সরিয়ে রেখেছে। বাবু হয়ে বসে প্রকৃতি বিলাস করছে। বাইরের সবুজ গাছ গাছালির মেলা এখান থেকেই দৃশ্যমান। পাতা হা করে সেগুলো দেখতে ব্যস্ত। এরইমধ্যে এ ঘরের দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করে ভিতরে। পাতা ভাবে ভোর হয়তোবা। হুজুর পড়ানো শেষ করে দিয়েছে বোধহয়। কিন্তু দরজার দিকে তাকিয়ে সে অবাক হয় বেশ। এ কখন এলো? অরুণ সরকার ভিতরে প্রবেশ করে। পাতার পাশ ঘেঁষে পা ছড়িয়ে বসে। সে এসেছে কিছু সময় হলো। এসে পাতাকে পায় না। স্টাডি রুমে উঁকি দিয়ে দেখে ছেলে পড়ছে তাই ডিস্টার্ব না করে ঘরে আসে। ফ্রেশ হয়ে চেঞ্জ করে। পাতাকে খুঁজে না পেয়ে হঠাৎ এই রুমের খেয়াল আসে। বেলকনির দরজা খুলতেই দেখতে পায় মহারানী এখানে বসে।
-” আজ এতো জলদি এলেন?”
-” একমাত্র ছোট বউটি জ্বরে ভুগছে! তার চিন্তায় অফিসে মনোযোগ বসছিল না তাই চলে এলাম!”
অরুণের কথায় পাতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। অরুণের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে হাসতে হাসতেই বলে,
-” হয়েছে পাম দিতে হবে না। এমনিতেই গাল মুখ ফুলে আছে। এখন ফেটে না যায়!”
অরুণ মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে পাতার কপালে রেখে তাপ পরখ করে। না স্বাভাবিকই আছে। মুখের ফুলোভাবটাও কমে গেছে। বরফ ঘষাঘষিতে গালের কালসিটে দাগেরও ক্ষীণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। অরুণ স্বস্তির শ্বাস ফেলে বলে,
-” জ্বর কি এসেছিল আবার? দুপুরে ওষুধ খেয়েছিলে?”
-” আর আসে নি জ্বর! ওই ওষুধেই জ্বর ব্যাথা ভ্যানিশ।”
-” কোন ওষুধে?”
ভ্রু নাড়িয়ে বলল অরুণ। স্পষ্টতই ফাজলামির সুর! অস্বস্তি ভর করে। কপোলজোড়া লালিমায় ছেয়ে যায়। কান গরম হয়ে আসে। চোখের তারায় ভেসে ওঠে সকালের সেই মিষ্টি মুহূর্ত। বুকটার ধুকপুক বেড়ে যায়। অরুণের বাহু থেকে মাথা সরিয়ে সোজা হয়ে বসে। এদিকে ওদিকে তাকিয়ে নজর লুকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
-” ভোরের পড়া শেষ হয় নি এখনো?”
অরুণ হাসে শব্দ করে। পাতা বিরক্তের সহিত চায়। লোকটাকে উচ্চস্বরে হাসলে একটুও ভালো লাগে না। খুবই বাজে লাগে। ভিলেন ভিলেন ফিল আসে। কিন্তু মুচকি হাসলে সুন্দর লাগে বেশ। নাইস এন্ড অ্যাট্রাকটিভ!
-” ষাঁড়ের মতো হাসছেন কেন? আশ্চর্য!”
অরুণ হাসি থামিয়ে ছোট ছোট করে তাকালো। মুখের আদল চেঞ্জ করে গম্ভীর গলায় বলে,
-” তোমার সাহস তো কম না? ভেবেচিন্তে কথা বলবে পাতাবাহার। আমি তোমার বড় মজা করেও বেয়াদবি কথাবার্তা বলবে না।আর ষাঁড়কে কখনো হাসতে দেখেছো?”
পাতার হাসিখুশি মুখ খানি চুপসে যায়। লোকটা একেবারে নিরস! হাসি মজা বোঝে না। পাতা ছোট্ট করে স্যরি বলে। অরুণ হাত বাড়িয়ে তার গালে হাত বুলিয়ে বলে,
-” ব্যাথা করছে এখনো?”
পাতার চুপসে যাওয়া মুখ স্বাভাবিক হয়। মাথা নেড়ে না বোঝায়। একটা কুশন এনে অরুণের কোলে রাখে। তারপর সেখানে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে সাথে অরুণের একটা হাত টেনে মাথায় রাখে যার অর্থ হাত বুলিয়ে দিন! অরুণ মুচকি হাসে। চুলের রেবন খুলে দিয়ে চুলের মাঝে হাত গলিয়ে দেয়। পরপর ঝুঁকে ললাটে চুম্বন বসায়। পাতার কোনো প্রকার অস্বস্তি হয় না। বরং ভালোলাগে বেশ সাথে একটু লজ্জাও পায়।
-” কেমন কাটলো সারাদিন?”
পাতা চোখ উঠিয়ে অরুণের চোখে চোখ রাখে। সম্মোহনী চোখের মায়ায় যেন সম্মোহিত হয়ে পড়ে। মিষ্টি হেসে জবাব দেয়,
-” আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো কেটেছে। আপনার?”
অরুণ মুচকি হেসে বলে,
-” ভালো!”
-” আপনার অফিসের ঝামেলা মিটেছে?”
-” হুম!”
-” কি নিয়ে প্রবলেম হয়েছিল?”
-” সেটা তোমাকে জানতে হবে না। জেনে কি করবে?”
-” বলবেন না সরাসরি বললেই হয়!”
অরুণ শান্ত চোখে চায়। কিছু বলে না। পাতাও চুপ করে থাকে। তবে তার চোখের আকার বড় হয় নিমিষেই। লজ্জা ভিড় করে সর্বাঙ্গে। গুটিয়ে যায়। সরানোর চেষ্টা করে তার উদরে অবস্থিত বলিষ্ঠ হাত। অরুণ সরায় না ; আরেকটু গভীরে নিয়ে যায় হাত।
-“আমি নিরপরাধ! তোমার কিউট টাম্মি আবার উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছিল আমায়!”
পাতার মুখ থেকে ভয়ংকর গালি বের হতে চায়। কিন্তু আটকে নেয়। হাত সরানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। উঠতেও পারছে না; লোকটা চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে আটকে রেখেছে। সে মিনমিনে গলায় বলে,
-” প্লিজ ছাড়ুন না?”
অরুণ ঝুঁকে আসে। পাতার নাকে নাক ঘঁষে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” ইটস ট্যু মাচ সফট!! ছাড়তেই ইচ্ছে করছে না!”
পাতা চোখ বুজে নেয়। কি অশ্লীল কথাবার্তা!! অসভ্য লোক! মুখের কোনো ব্রেক নেই। পাতা অরুণের হাতের লোম ধরে টান দেয়। ব্যাথা লাগে বেশ! অরুণ হাত সরিয়ে নেয় মুহূর্তেই! পাতা ছাড়া পেতেই লাফ দিয়ে ওঠে। দৌড়ে দরজার দিকে যেতে বলে,
-” নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য লোক কোথাকার!”
অরুণের কানে যায়। সে হেসে বলে,
-” এক মাঘে শীত যায় না কিন্তু!”
পাতা রুমে চলে আসে অরুণের গুষ্টি তুষ্টি করতে করতে। এসে দেখে ছোট ভোর টুপি মাথায় কিছু বলতে বলতে আসছে। তাকে দেখে মিষ্টি হেসে বলে,
-” •রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা• আম্মু আমি নতুন দোয়া শিখেছি! এর অর্থ হলো
°হে আমার প্রতিপালক, তাদের উভয়ের (বাবা-মা) প্রতি রহম করুন! যেমনটি তারা আমাকে শৈশব কালে লালন পালন করেছেন°”
বলেই মিষ্টি করে হাসলো। পাতা তাকে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে গালে চুমু খায়।
-” বাবাটা দেখছি অনেক বড় হয়ে গেছে। বাবা মায়ের জন্য দোয়া করা শিখেছে!”
-” থ্যাংক ইয়ু আম্মু!”
পাতা তার গাল টিপে দেয়। এরমধ্যে অরুণ বেড়িয়ে আসে। বাবাকে দেখে ভোর লাফিয়ে উঠলো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলে,
পাতা বাহার পর্ব ৩৮
-” আব্বু তুমি কখন এসেছো? আমাকে ডাকো নি কেন?”
অরুণ এগিয়ে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দেয়। নরম গলায় সুধায়,
-” আমার কলিজা কি দোয়া শিখেছে বলো দেখি আব্বু?”
ভোর টকটকে ঠোঁট দুটো নেড়ে পুরো দোয়া অর্থ সহকারে বলে। অরুণ ছেলের প্রশংসায় মাশাআল্লাহ আওড়াতে থাকে। ছেলের গালে মুখে চুমুতে ভরিয়ে দেয়। ভোর আদর পেয়ে হেসে কুটিকুটি। আদর খেতে তার খুব ভালো লাগে।