পাতা বাহার পর্ব ৪৬

পাতা বাহার পর্ব ৪৬
বেলা শেখ 

সময়টা বিকেল বেলা। হেমন্তের রৌদ্রজ্জ্বল দিন। সাথে গা ঠান্ডা করা শীতল পবনের দোলা‌। না গরম না শীত এক মনোরম পরিবেশ বিরাজ করছে। সরকার বাড়ির আঙিনায় হরেক রকম অতিথি পাখির আগমন যাত্রা শুরু হয়ে গেছে। তাদের কলতানে পরিবেশ যেন মুখরিত হয়ে আছে।এমন পরিবেশে পাতা কোমড়ে আঁচল গুঁজে মাথায় স্পোর্টস ক্যাপ পড়ে ক্রিজে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে ক্রিকেট খেলার খ টাও জানে না অথচ ভোরের জেদে সে এখন ব্যাটিং করতে এসেছে। আর ছোট ভোর জার্সি,প্যান্ট ও ক্যাপ পড়ে বল হাতে সামনে বল করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আনিকা ফিল্ডিং করছে।আভারি স্ট্যাম্পের পেছনে দাঁড়িয়ে। অদূরে আসমা বেগম ও আরিয়ান রূপকে নিয়ে বসে আছে। ভোর পাতার দিকে তাকায়। মুচকি হেসে থাম্বস আপ দেখায়! পাতাও প্রতিত্তরে মুচকি হেসে প্রস্তুত হয়। ভোর বল ঘুরিয়ে বল করে। পাতা কি করবে ভেবে পায় না। চোখ বন্ধ করে ব্যাট চালালো। বল ব্যাটে স্পর্শ না করে সোজা স্টাম্পে আক্রমণ করে। অন্যসময় হলে ভোর বোল্ড করার খুশিতে নেচে দিতো কিন্তু এবার গম্ভীর মুখে পাতার কাছে যায়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” আম্মু এভাবে না! ব্যাট দাও আমি দেখিয়ে দিচ্ছি!”
পাতা ব্যাট দেয়। ভোর খুব সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে দেয়‌। পাতা হা করে শোনে। কে বলবে এই ছেলে পিচ্চি! এতো ওর বাপেরও বাপ! ভোর ভালো ভাবে বুঝিয়ে আবার বল করে। এবার একটু ধীর গতিতে করে। পাতা ব্যাট দ্বারা বলে আঘাত করতে সক্ষম হয়। একেবারে আরিয়ানের পায়ের কাছে গিয়ে পড়ে। ছোট রূপ বাবার কোল থেকে নেমে বল হাতে তুলে খুশিতে আ’মা আ’মা বলে উল্লাস প্রকাশ করে।দূর থেকে ভোর শুনতে পায় না তবে ঠাহর করতে পারে রূপ কি বলছে। সে গাল ফুলিয়ে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে থাকে। বল আনতে যায় না। আনিকাকে হুকুম তামিল করলো,
-” আনি যা বল নিয়ে আয়? ফাস্ট ফাস্ট!”

আনি যাবে তার আগে আরিয়ান বল নিয়ে আসে। রূপ তার দাদির কোলে বসে আ আ বলে চেঁচাতে থাকে। আরিয়ান এসে ভোরের মাথার ক্যাপটা খুলে নিজের মাথায় লাগিয়ে বলে,
-” এই আম পাতা জোড়া জোড়া?”
পাতা চোখ বড়বড় করে চায়। এই লোক তাকে যদি এক ফোঁটা সম্মান দিতো! সবসময় তাঁর সাথে ঝগড়া করার জন্য মুখিয়ে থাকে। আরে শালার দেবর! বয়সে ছোট হতে পারে কিন্তু সম্পর্কে তো বড় সেই হিসেবে একটু সম্মান দিলে কি তাঁর ইগো পুকুরে ডুবে যাবে? সে ব্যাট উঁচিয়ে শাসনের সুরে বলে,

-” গিভ মি সাম রেসপেক্ট! আমি আপনার বড় ভাইয়ের স্ত্রী। আপনার বড় ভাবী লাগি!”
আরিয়ান পাতার আপাদমস্তক দেখে হেসে দেয়। ভোর কোমড়ে হাত রেখে বাবার মতো রাশভারী গলায় বলে,
-” চাচ্চু? আমার আম্মুর নাম পাতা! ওরকম বলে একদম ডাকবে না বলেদিলাম!”
আরিয়ান তাঁর চুল এলোমেলো করে দিয়ে বল শূন্যে ছুঁড়ে ক্যাচ করে।
-” টি টোয়েন্টি ম্যাচ হয়ে যাক? তোমরা সবাই এক টিম আমি একা! যদি তোমরা জিততে পারো পার্কে নিয়ে যাবো ঘুরতে সাথে রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া!”
ভোর কপালে ভাঁজ ফেলে কতক্ষণ ভাবে। চাচ্চু একা! আর তাঁরা কত গুলো! সে ,আনি, আম্মু ও ভারি কাক্কু! চারজন। চাচ্চুকে হারানো একদম ইজি হবে।

-” আগে বলো তুমি জিতলে আমাদের কি করতে হবে?”
আরিয়ান ভোরের মাথায় টোকা দিয়ে বলে,
-” কিছু না। তখন আমি একাই ঘুরতে যাবো! ডিল ফাইনাল?”
আরিয়ানের বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত মেলায় ভোর! পাতা ব্যাট রেখে বলে,
-” তাহলে তোমরা খেলো! আমি যাই!”
ভোর চোখ বড়বড় করে পাতার হাত টেনে ধরে বলে,
-” না যাবে না। তুমিও আমাদের দলে খেলবে! নইলে কিন্তু ভোর রাগ করবে!”
-” আমি খেলতে পারি না রে বাবা!”
-” আমি আছি না?”

পাতা মুচকি হাসলো। কি মিষ্টি করে বলল ‘আমি আছি না?’ এ ছেলে পুরোই অরুণ সরকারের কার্বন কপি! অরুণ সরকার নাক উঁচু ম্যানারলেস গাম্ভীর্যে ভরপুর লোক! আর ভোর মিষ্টি চঞ্চলতায় ভরপুর এক আদুরে বাচ্চা। তবে মাঝে মাঝে ছোট ভোর বাবার মতো গম্ভীর আচরণ করে।
-” তোমরা খেলো! আমি তোমাদের চিয়ার্স করবো!”
বলতে দেড়ি ভোরের ফুলো গাল ফুলতে দেড়ি হয় নি। আরিয়ান ব্যাট তুলে পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-‘ এই তেজপাতা? তেজ ফুরিয়ে গেলো নাকি? ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছো?”
পাতা দাঁতে দাঁত পিষে। বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

-” বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু?”
আরিয়ান এক ভ্রু উঁচিয়ে চায়। পাতা কটমট করে বলে,
-” ওকে ফাইন ভোর খেলবো আমি!”
ভোর ইয়ে বলে পাতাকে জড়িয়ে ধরে। আরিয়ান সব রুলস বলে দেয়। টস জিতে ব্যাট করতে নামে ভোরের দল! প্রথমে ভোর ও আভারি নামে। আভারি প্রথম তিন ওভার খেলেই আউট! ঝুলিতে মাত্র পনেরো রান। এরপর আনিকা নামে। ব্যাট হাতে বাবাকে বলে,
-” আব্বু? আস্তে বল করবে কিন্তু? আর মোটেও ক্যাচ করবে না! তুমি না আমার সোনা আব্বু?”
আরিয়ান মেয়ের কথা শুনে গমগমে গলায় বলে,

-” এখন আমি কারো আব্বু নই! আমি তোমাদের বিরোধী দল! তাই পাম দেয়া‌ বন্ধ করো মামুনি!”
আনিকা ভেংচি কাটলো। আরিয়ান হেসে আস্তে বল করে। আনিকা শূন্যে বল মারে। বল গিয়ে বাউন্ডারির বাইরে! ছক্কা বলে ভোর ব্যাট উপরে তুলে ইয়ে ইয়ে সুরে নাচতে থাকে। পাতা তার নাচ দেখে হাসতে হাসতে শেষ। আভারি বল এনে দিলে আরিয়ান আবার বল করে এবার একটু গতিতে। আনিকা ব্যাট দিয়ে জোড়ে আঘাত করে বল উঁচুতে উঠে যায়। আরিয়ান দাঁত কেলিয়ে হাত পাতে ক্যাচ করার জন্য। আনিকা কাঁদো কাঁদো চোখে ভোরের দিকে চায়। ভোর জিভে কামড় বসিয়ে আরিয়ানকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বল নিচে পড়ে। ক্যাচ মিস! আনিকা নাচতে থাকে আর চিল্লিয়ে বলে,

-” থ্যাংক ইয়ু ভোর!”
আরিয়ান ছোট ছোট করে ভোরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ইটস চিটিং!”
-” চাচ্চু চিটিং কিভাবে করে? আমি তো তোমাকে বাঁচিয়ে দিলাম। বলটা তোমার মাথার উপর পড়লে ইয়া বড় আলু গজাতো!”
কিউট কিউট ফেস বানিয়ে বলে ভোর। পাতা বাহবা দেয়! এই না হলে ভোর সরকার! আরিয়ান তাঁর গাল টেনে আবার বল করে। বেশ রান করে তাঁরা।মোট চল্লিশ! ভোর পঁচিশ। আনিকা দশ! আভারি পাঁচ করেছিল! এরমধ্যে আনিকা বোল্ড হয়ে যায়। সে ব্যাট ফিক্কে দিয়ে বলে,
-” আব্বু তুমি একটুও ভালো না। তোমার সাথে আড়ি!”

আরিয়ান হাসে। আনিকা রেগে মেগে আগুন হয়ে চলে যায়! পাতা বুকে ফুঁ দিয়ে ভালোভাবে কোমড়ে আঁচল গুঁজে ক্যাপ মাথায় ক্রিজে যায়। ব্যাট তুলে দোয়া দরুদ পাঠ করে। ভোর এগিয়ে এসে তাকে বাহবা দেয়। কিভাবে কি করতে হবে বলে বিপরীত ব্যাট হাতে দাঁড়ায়। আরিয়ান শয়তানী হাসে। পাতা ভেংচি কাটলো। বল আসার সাথে সাথে ভোরের সব থিওরি ভুলে চোখ বুজে আন্দাজে ব্যাট করে। বল দূরে যায় না। ভোর চিল্লিয়ে দৌড়াতে বলে! দৌড়ে একরান নেয় দুজনে। এবার ভোর ব্যাট করে। একটা ছক্কা হাঁকিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ী হাসি দেয়। পাতা সিটি বাজায়। ভোর মুচকি হাসলো। আরিয়ান আবার বল করে ভোর এবার সিঙ্গেল নিয়ে এপাশে আশে। এবার পাতার পালা সে আবার দোয়া দরুদ পাঠ করতে থাকে। ইয়া আল্লাহ বাচ্চাটার সামনে মানসম্মান রেখো! ঝগরুটে পেঁচা মুখো দেবরের মুখে ঝামা ঘষিয়ে দিও! বল এলে পাতা আবার ভোরের শেখানো থিওরি ভুলে চোখ বুজে ব্যাট তোলে। কথায় আছে না ‘ঢিলে বক মরে ফকিরের কেরামতি বাড়ে’! এখানে খাপে খাপ মিলে যায়। বল একেবারে বাউন্ডারির বাইরে। ভোর ছক্কা বলে উল্লাস করে। পাতা মুচকি হেসে আরিয়ানের দিকে চায়। আভারি বল কুড়িয়ে আনে। আরিয়ান আবার বল ছুঁড়ে। তবে এবার আর কেরামতি হয় না‌ স্ট্যাম উড়িয়ে বোল্ড হয় পাতা! ব্যস খেলা শেষ! পাতা গোমড়া মুখ বানিয়ে ভোরের দিকে চায়। ভোর হেসে বলে,

-” ইটস ওকে আম্মু! অনেক ভালো খেলেছো তুমি!”
পাতা মুচকি হেসে এগিয়ে আসে। কোমড়ে গোঁজা আঁচল ঘামে ভেজা মুখটা মুছিয়ে দেয়। ইশ্ ঘেমে নেয়ে একাকার বাচ্চাটা। সবাই পাঁচ মিনিট ব্রেক নিয়ে আবার ক্রিজে নামে। আরিয়ান ব্যাট করে ভোর বল হাতে তাঁর জাদু দেখায়। ছেলেটা ছোট হলে কি হবে? কি সুন্দর বল করছে!! একেবারে প্রসংসনীয়। আরিয়ান তো তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভাইয়ের সাথে কথা বলে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করবে! এ ছেলে বড় হয়ে ভালো একজন বলার হতে পারে! মুস্তাফিজ, তাসকিনের মতো। আরিয়ান চার ছয় হেঁকে সাত ওভারেই পঁয়তাল্লিশ বানিয়ে ফেলেছে। দুই বার শূন্যে উঠেছিল। ক্যাচ করা যেতো কিন্তু পাতার হাত থেকে ছুটে যায়। পঞ্চান্নতে টার্গেট! আর মাত্র দশ রান করতে হবে আরিয়ানকে। আরিয়ান এটা ওটা বলে ভোর ও আনিকাকে লেগপুল করছে। আনিকা বাবার সাথে গলা মিলিয়ে ঝগড়া করছে। পাতাও দুই একটার জবাব দিচ্ছে। তবে ভোর চুপচাপ বল করায় মনোযোগী। সে হার কিছুতেই মানবে না। শেষ অবধি লড়াই করবে। ভোর গম্ভীর মুখে হাত ঘুরিয়ে বল করে। আরিয়ান বলে আঘাত করে; বল এবার উঁচুতে উঠে। পাতা চোখ বড় বড় তাকিয়ে থাকে! তার দিকে প্রবল বেগে ছুটে আসছে ঘূর্ণায়মান ছোট বল! পাতা ফট করে কোমড়ে গোঁজা বাড়তি লম্বা আঁচল খুলে পেতে ধরে। বলটা খপ করে তার পেতে রাখা আঁচলে পড়ে। উল্লাসে পাতা মাতোয়ারা। হেসে বলটা হাতে নিয়ে বলে,

-” আরিয়ান ভাই? আউট! আমরা জিতে গেছি!”
আরিয়ান ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। এদিকে ভোর আনিকা ছুটে এসে পাতাকে ধরে। ইয়ে ইয়ে বলে চিল্লিয়ে বিজয়ের উল্লাসে ফেটে পড়ে। আসমা বেগম রূপকে নিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে। আরিয়ান চিল্লিয়ে বলে,
-” এটা চিটিং! আউট যাই নি আমি!”
ভোর হেসে বলে,
-” চাচ্চু? তুমি তো হেরে গেছো! এখন বাহানা দিয়ে লাভ নেই!”
-” চিটিংবাজ! তোমাদের দলে চিটারে ভরপুর!”
পাতা হেসে বলে,
-” হেরে গেছেন আরিয়ান ভাই! এখন শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে হবে না!”

ফোন হাতে দাড়িয়ে আছে অরুণ সরকার। মুখের আদল অতিব গম্ভীর। কপালের শিরা ফুলে উঠেছে। ফর্সা হাতের নীলচে রগ ফুলে স্পষ্টত হয়ে আছে। ফোনের অপাশের ব্যক্তির কথা শুনে রাগে ফেটে পড়ে অরুণ! পাশের টবে লাথি দেয় সজোরে। হিসহিসিয়ে দাঁত কপাটি পিষ্ট করে রাশভারী গলায় বলে,
-” ঘটনার সাতদিন পেরিয়ে গেছে। ওই
শু*য়োরের বাচ্চারা এখনো মুক্ত বাতাসে আর তুই আমাকে শান্ত হতে বলছিস? **** জা*নোয়ার গুলো কোন **** ঘাপটি মেরে আছে তোর টিম এখনো বের করতে পারলো না! এতোটা নিকম্মা টিম আদৌ হয়!”
রাসেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

-” ভাই ওরা যথেষ্ট চেষ্টা করছে। ওই আকাশকে আমরা যতটা হালকা ভাবছি সে ততটা নয়। শালা ****! তবে কতদিন লুকিয়ে থাকবে? তুই টেনশন করিস না। বাড়িতে সিকিউরিটি রেখে দেয়া হয়েছে। আর ভাবী আর ভোরের জন্যও স্পেশাল গার্ড রাখা হয়েছে। তোদের ওই দাড়োয়ানকে কি বের করে দিয়েছিস?”
-” হুম। কিছু টাকা দিয়ে বিদায় করে দিয়েছি। ভাই যেখানে আমার ছেলের কথা ওঠে আমি খুবই নির্দয়! আর তুই একটু ভালোভাবে খোঁজখবর নে! আমিও আমার লোক লাগিয়ে দিচ্ছি! জানোয়ারদের পিঠের চামড়া তুলে লবণ না দেয়া পর্যন্ত আমি অরুণ সরকার শান্তিতে ঘুমাতে পারবো না। রাখছি!”
বলেই ফোন কেটে দেয়। ফোনটা সজোরে আছাড় মারতে নিয়েও মারে না। সুজনকে কল করে ভিতরে আসতে বলে। মিনিটের ব্যবধানে সুজনের আগমন ঘটে। অরুণ লম্বা শ্বাস টেনে সুজনকে বলে,

-“আমার লোক লাগিয়ে দাও! ওই শুয়া পোকার বংশধর, আবাল সবকটার পুরো হিস্ট্রি জিওগ্রাফি চাই!”
সুজন সায় জানিয়ে বলে,
-” ওকে বস!”
চলে যাবে হঠাৎ সে থেমে বলে,
-” স্যার আজকে একটু পর মিটিং আছে। এই অফিসের পাশের রেস্টুরেন্টে! খসরু নোমানের সাথে!”
অরুণ তার কেবিনে বসে কালো ফ্রেমের চশমা লাগায়। ল্যাপটপ ওপেন করে বলে,
-” আই নো! তুমি সঙ্গে যাচ্ছো। সব কালেকশন গুছিয়ে নাও। ফাস্ট!”
সুজন মাথা নাড়ল। তবে রুম থেকে বেড়োয় না। অরুণ ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে বলে,
-” কিছু বলবে?”

সুজন খানিক জড়তার সাথে বলে,
-” রুবি ম্যাম কিছু ডিজাইন করেছে। ইউনিক এন্ড গর্জিয়াস। সো তিনি চাচ্ছেন আজকের মিটিং এ এই ডিজাইন শো করাবেন।”
অরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে চশমা খুলে ভাবুক সুরে বলে,
-” উম! আমি রুবির সাথে কথা বলে নেব! মি. নোমান সুবিধার লোক নয়।”
‘হুম’ বলে সুজন বেড়িয়ে যায়। অরুণ ল্যাপটপে কিছু ই-মেইল সেন্ড করে উঠে দাঁড়ালো। কেবিন থেকে বেড়িয়ে রুবির কেবিনে গিয়ে নক করে। অনুমতি পেয়ে অরুণ ভিতরে প্রবেশ করে। রুবি তাকে দেখে মুচকি হেসে বলে,
-” আমি মাত্রই আপনার কাছে যাচ্ছিলাম ভাইয়া!আজকের মিটিংএ আমিও যেতে চাইছি।এই ডিজাইন গুলো একবার দেখুন? আশাকরি মি. নোমানের পছন্দ হবে!”
অরুণ ডিজাইন গুলো হাতে নেয়। বেশ গর্জিয়াস লুক। অরুণ সবগুলো দেখে বলে,
-” ইম্প্রেসিভ! বাট তুমি মিটিং এ যাচ্ছো না। ডিজাইন গুলো আমিই নিয়ে যাচ্ছি। ওগুলোর সাথে এগুলো এড করে দেবো।”
রুবির হাস্যোজ্জ্বল মুখে আঁধার নামতে শুরু করে। সে জিজ্ঞেস করে,

-” আমি গেলে কোনো প্রবলেম ভাইয়া?”
-” কিছুটা! নেক্সট ক্লায়েন্টের মিটিংএ যেও!”
রুবি ভদ্র সুলভ হাসে। তবে সে কিছুটা নারাজ হয়। সে খুব এক্সাইটেড ছিলো। নিজ উদ্যোগে কিছু ডিজাইনও করেছে। অরুণ ভাইয়া তাকে মানা করবে এটা তার ভাবনার বাইরে ছিলো!
অরুণ ডিজাইন গুলো নিয়ে বেড়িয়ে আসে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ল্যাপটপ সমেত সুজনকে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়। রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসে মি নোমানকে কল লাগায়। তাঁরা জানায় ওন দা ওয়ে। মিনিট খানেক পর তাঁরা আসে। অরুণ খাবার অর্ডার করে কালো ফ্রেমের চশমা পড়ে তাদের সব কালেকশন দেখায়! ডিজাইনে বর্ননা দিয়ে তারা কিছু ডিজাইন সিলেক্ট করে সাথে সব ডিজাইন ইমেইলে পাঠাতে বলে। খাবার সেরে সবাই আরো কিছু প্রয়োজনীয় কথা বার্তা বলে। কাজের আলাপন শেষ হলে ক্লায়েন্ট বিদায় নেয়। অরুণ চশমা খুলে টেবিলে রাখে। সুজনকে বলে ঠান্ডা আইসক্রিমের অর্ডার করতে বলে। আইসক্রিম খেয়ে মাথা ঠান্ডা করা যাক! সুজন আইসক্রিম অর্ডার করতে উঠে যায়। অরুণ টেবিলে মাথা রেখে ঝুঁকে আসে। মাথাটা প্রচন্ড ধরেছে। মনে হচ্ছে ব্যাথায় রগ টগ ছিঁড়ে যাচ্ছে ‌।

-” অরুণ সরকার?”
মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে অরুণ বিরক্ত হয় বেশ! মাথা তুলে সম্মুখে চায়। মেয়েটি মুচকি হেসে সামনে ফাঁকা জায়গায় বসে।পার্স টা টেবিলে রেখে বলে,
-” চিনতে পারলেন না? আমি শ্রাবনী আহসান!”
অরুণ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
-” জি চিনতে পেরেছি।”
মেয়েটি হেসে উঠলো।
-” আপনার উপর কিন্তু আমি অনেক রেগে আছি! কন্টাক্ট করারও চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারি নি! আব্বু দেয় নি আপনার নম্বর!”
অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। মেয়েটি আবার হেসে বলে,

-” আপনাদের তরফ থেকে যখন প্রস্তাব পাঠানো হয় আমি মোটেও রাজি ছিলাম না। আটত্রিশ বছরের বুড়ো সাথে ছেলে! কিন্তু আপনাকে দেখার পর আমার ধারনা পাল্টে যায়। আমি স্ট্রেট কথা বলতে পছন্দ করি। আপনাকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু আব্বু বলল আপনারা মানা করে দিয়েছেন। আমি অনেক রেগে গিয়েছিলাম। আব্বুর কাছ থেকে আপনার কন্টাক্ট নম্বর চেয়েছি বেশকয়েকবার সে দেয় নি। আপনার সাথে যোগাযোগও হয় নি। আপনি কি সেদিন আমার কথায় কিছু মনে করেছিলেন?”

অরুণ স্বভাব সুলভ গম্ভীর। তার মোটেও ভালো লাগছে না এই বকবক। তাই সে জবাব দিলো না। শ্রাবনী অরুণের দিকে তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে।লোকটা আগের থেকে হ্যান্ডসাম হয়েছে। বলিষ্ঠ আকর্ষণীয় বডি! কালো স্যুড বুটে বেশ লাগছে। গাম্ভীর্যে ভরপুর ব্যক্তিত্বে ভরাট এক সুপুরুষ! সে রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করেই দেখেছিল। কিন্তু তাঁর সাথে আরো কিছু লোক থাকায় অপেক্ষা করছিল। যেই তাঁরা চলে যায় সুযোগ হাতছাড়া করে নি। তবে লোকটাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে ইতস্তত বোধ করে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
-” আপনার বাচ্চাটা কেমন আছে?”
-” আলহামদুলিল্লাহ!”

ছোট জবাব অরুণের। শ্রাবনী কথা বলার বাহানা খুঁজেছে কিন্তু লোকটা তো মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে। এই লোক এমন কেন? ভদ্রতার খাতিরেও তো টুকটাক কথা বলা যায়। হঠাৎ সে খেয়াল করে তার সামনে অর্থাৎ অরুণ সরকারের পেছনের দিকে এক টেবিল পরে বসা এক মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার চাহনিতে কিছু একটা আছে। কেমন করে তাকিয়ে আছে যেন তাকে ভস্ম করে দেবে। সে যে তাকিয়ে আছে মেয়েটা তবুও নজর সরায় নি। কেমন কটমট করে তাকিয়ে আছে। শ্রবনী ভালো করে খেয়াল করে কম বয়সী মেয়ে। তাঁর সাথে তিনটা বাচ্চা ও একটা লোক বসে। লোকটার মুখ দেখতে পাচ্ছে না সে। তবে আন্দাজ করে মেয়েটার হাসবেন্ড হবে। কিন্তু কথা হলো ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সে মেয়েটার দিকে দৃষ্টি রেখে অরুণের উদ্দেশ্যে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” আপনার পেছনের এক টেবিল পড়ে একটা মেয়ে বসে আছে ‌। ছোট মেয়ে বিশ বাইশ বছর হবে! সাথে তিনটা বাচ্চা আর হাসবেন্ড। কিন্তু মেয়েটা আমার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে যেন! মনে হচ্ছে আমি তার হাসবেন্ডের সাথে ডেটে এসে ধরা পড়েছি!”
বলেই আবার হাসে। অরুণের বিরক্তের সীমা আকাশ ছোঁয়। তবুও কৌতুহল মেটাতে পেছনে তাকায়। মেয়েটার সাথে চোখাচোখি হয় অরুণের! সে সামনে ফিরে স্বাভাবিক ভাবেই। তখনই সুজনের আগমন ঘটে। হাতে তাঁর আইসক্রিমের বাটি! সুজন শ্রাবনীকে দেখে কৌতূহলী মনে অরুণের দিকে চায়। অরুণ তার হাত থেকে আইসক্রিমের বাটি নিয়ে বলে,

-” তুমি এখন যেতে পারো! আর হ্যাঁ আমি আর অফিসে যাচ্ছি না। রুবিকে বলবে এখানে আসতে! এখুনি!”
-” ওকে বস!”
বলেই সুজন সুরসুর করে চলে যায়।শ্রাবনী খুশি হয় ঢের। সে ভাবে তার সাথে আলাপ করার জন্য অফিসে যাবে না। সে মুচকি হেসে বলে,
-” কেমন চলছে লাইফ? বিয়ে টিয়ে করেছেন নাকি?”
-” কাম?”

বলেই অরুণ উঠে দাঁড়ায়। শ্রাবনী আগা মাথা কিছুই বুঝল না তবে সেও অরুণের পিছু গেল! অরুণ সরকার সেই টেবিলের সামনে যায়।একটা বাচ্চা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বাচ্চা ছেলে ঘার ঘুরিয়ে তাকায়। আ আ বুলি আওড়াতে থাকে। টেবিলে সবাই তার দিকে তাকায়‌। ভোর মাথা তুলে বাবাকে দেখেই খুশিতে লাফিয়ে উঠে। অরুণ আইসক্রিমে বাটি টেবিলে রেখে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নেয়। আরিয়ানের পাশে বসে ছেলের আদুরে মুখটায় চুমুতে ভরিয়ে দেয়। ভোর বাবার গলা জড়িয়ে গালে সশব্দে চুমু দিয়ে আগ্রহ সমেত বলে,
-” ও আব্বু জানো কি হয়েছে?”
অরুণ মাথা নাড়ে সে জানে না। ভোর মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে,

-” আজ আমরা টি‌ টোয়েন্টি খেলেছি! আমি আম্মু, আনি, ভারি কাক্কু এক টিম! আর চাচ্চু একাই এক টিমে। আমরা সবাই মিলে চাচ্চুকে হারিয়ে দিয়েছি। আমরা ম্যাচটা জিতে গেছি!”
অরুণ ছেলের অধরকোণে চুমু দিয়ে বলে,
-” সত্যিই? কনগ্রেটস আব্বু!”
ভোর খুশিতে বাকবাকুম! আরিয়ান ছোট ছোট করে তাকিয়ে হেসে বলে,
-” চিটিং করলে জেতাই যায়!”
ভোর সাথে সাথে তীব্র প্রতিবাদ জানায়।
-” মোটেও চিটিং করি নি আমরা! তুমি হেরে গিয়ে এখন বাহানা বানাচ্ছো!”
-” তাই?”

ভোর মাথা উপর নিচ করে সায় জানালো।
শ্রাবনী এখনো দাঁড়িয়ে আছে। এটাই তাহলে লোকটার ছেলে। বেশ আদুরে; আর কি সুন্দর পাকা পাকা কথা! পুরাই রসগোল্লা টাইপ! কিন্তু বাকিরা কারা?
অরুণ পাতার দিকে চায়। মেয়েটার মুখটা থমথমে। কারণটাও বুঝতে বাকি রইলো না! হায়রে মেয়ে মানুষ! সন্দেহ এদের রগে রগে রক্ত কনিকার মতো ঘুরে বেড়ায়। সে ঘার ঘুরিয়ে শ্বাবনীকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” এখানে বসুন!”
শ্রাবনী যেন খুশি হলো খুব। পাতার পাশে বসে অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” এনারা?”

আরিয়ান অবাক চোখে অরুণের দিকে তাকিয়ে। শ্রাবনীকে দেখে তার চিনতে অসুবিধা হয় নি। কিন্তু এই মেয়েটা ভাইয়ের সাথে? সে এবার পাতা দিকে চায়। মেয়েটার মুখের আদলও সন্দেহভাজন!
অরুণ শ্রবনীর কথার প্রেক্ষিতে আরিয়ানকে দেখিয়ে বলে,
-” এটা আমার ভাই! এগুলো বাচ্চা কাচ্চা! আর আপনার পাশের জন আমার ওয়াইফ!”

পাতা যেন এবার আটকে রাখা শ্বাস টেনে নিলো! তবুও মুখের আদল পরিবর্তন হয় নি। তাঁরা রেস্টুরেন্টে এসেছে বেশ কিছু সময় হলো। পার্ক থেকে ঘুরে তারপর আরিয়ান ভাই এখানে নিয়ে আসে। খাওয়ার মাঝেই পাতা খেয়াল করে তাদের সামনে এক টেবিল পড়ে একটা লোক বসে।যদিও ব্যাক সাইড দেখেছে তবুও পাতার চিনতে অসুবিধা হয় নি লোকটা তাঁর নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক। কিন্তু লোকটার সাথে একটা মেয়েকে দেখে পাতার মাথা হ্যাং হয়ে যাবার উপক্রম। ভালো করে দেখে পাতার স্মরণে আসে এই মেয়েটাকে সে এর আগেও দেখেছে। কিন্তু কখন কোথায় মনে পড়ে না। কিন্তু সেটা কথা না! কথা হলো তার জামাইকে কেন অন্য মেয়ের সাথে দেখা যাবে?
শ্রাবনী অবাক লেচনে পাশে তাকায়। পাতাকে দেখে অরুণের দিকে চায়। লোকটা বিয়ে করে নিয়েছে? অরুণ যেন তাঁর না বলা প্রশ্ন বুঝতে পারলো তাই ছোট করে জবাব দিলো,

-” চার পাঁচ মাস হবে বিয়ের!”
শ্রাবনী ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে পাতার সাথে পরিচিত হয়। আরিয়ানের সাথে টুকটাক কথা বলে। হাত বাড়িয়ে আনিকা ও ভোরের গাল টিপে দিয়ে বাহানা দিয়ে কেটে পড়ে। সে চলে গেলেই অরুণ ছেলেকে নিয়ে উঠে এসে পাতার পাশে বসে। আরিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ে,
-” এখানে কি সমস্যা হচ্ছিল?”
-” ঘামের উদ্ভট গন্ধ বেড়োচ্ছিলো গোসল করিস নি?”
আরিয়ান নিজেকে শুকে। কই কোনো গন্ধ টন্ধ নেই তো! সে গোসলও করেছে আবার বেরোনোর আগে পারফিউমও লাগিয়েছে তাহলে? সে ভাইয়ের দিকে তাকায়। অরুণের মুখাবয়ব সিরিয়াস থাকলেও আরিয়ানের বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে কটমট করে বলে,

-” গোলাপের সুবাসে অভ্যস্থ ভাই আমার! শিমুলের ফুলে গন্ধ খুঁজে পায়! ভালো বেশ ভালো!”
পাতা খানিকটা ইতস্তত বোধ করে। কি শুরু করলো দুই ভাই! সে অরুণের দিকে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” মহিলাটি কে ছিলো? হুম?”
অরুণ আইসক্রিমের বাটির ঢাকনা খুলে দেয়‌। এক চামচ তুলে ছেলের মুখে দেয়। পরপর সামনে বসা আনিকার মুখে দিলো। ছোট রূপ আরিয়ানের কোল থেকে টেবিল চাপড়াতে আ আ করে। সেও খাবে। অরুণ অল্প করে তার মুখেও দেয়। রূপ মুখে নিয়ে ফোকলা দাঁতে হাসি উপহার দেয়! আরিয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিলে সে নেয় না। তাঁর মতে আইসক্রিম বাচ্চারা খায়! অরুণ নিজের মুখে নেয়। পাশে বসা পাতার মুখটা এইটুকু হয়ে যায়। একে তো তাঁর কথার উত্তর দিলো না ;তাঁর উপর সবাইকে আইসক্রিম খাওয়ালো অথচ তার কথা মনে নেই। পাতা চুপচাপ কাচ্চি বিরিয়ানী খাওয়ায় মনোনিবেশ করে।অরুণ আড়চোখে একবার পাতার ফুলো গাল দেখে, তবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে না। এখন কি ছোট ভাইয়ের সামনে বউকে আইসক্রিম মুখে তুলে খাইয়ে দিবে? কি ভাববে আরিয়ান? কচি বউ পেয়ে আহ্লাদ করছে।
আরিয়ানও চামচ ভর্তি বিরিয়ানী মুখে তুলে বলে,

-” ওই মেয়েটা এখানে কেন? আর তুই বা এখানে কেন?”
পাতার কানটা সজাগ হয়। প্রথমবার আরিয়ানের কথাটা তার ভালো লেগেছে। অরুণ ছেলের মুখে আইসক্রিম দিয়ে বলে,
-” ডেট করতে এসেছিলাম!”
আরিয়ানের কপালে ভাঁজ পড়ে। ভাইয়ের মিথ্যে তাঁর বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে পাতার দিকে চায়। বোকা মেয়েটা থম মেরে আছে যেন এখনই স্ট্রোক করবে! তার হাসি পায় বেশ।
পাতা সত্যিই ঝটকা খায়! কি বললো লোকটা? মজায় বলেছে নাকি সিরিয়াস? কিন্তু তাঁর কথা হলো বলবে কেন? তাঁর চোয়াল শক্ত হয়। তবে কিছু না বলে গপাগপ বিরিয়ানী মুখে পুরে। আরিয়ান তাঁর কান্ড দেখে হাসতে হাসতে বলে,

-” দেখ তোর আম পাতা জোড়া জোড়া! হিংসেয় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।”
পাতা কটমট করে তাকালো তার দিকে। শালার দেবর! একে তো পদ্মা সেতুর উপর থেকে টুপ করে ফেলে দেয়া উচিত!
অরুণ পাতার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,
-” এখানে একটা মিটিংএ এসেছিলাম। মিটিং শেষ হতেই মেয়েটার আগমন!”
-” আর মেয়েটা হচ্ছে ভাইয়ের না হওয়া ফিয়ন্সে! মানে ভাইয়ের সাথে তাঁর বিয়ের কথা উঠেছিল। ভাই মানা করার পর কথাবার্তা আর এগোয় না!”

আরিয়ান কনফেস করে ব্যাপারটা। পাতার খেয়াল হয় লোকটার সাথেই এক রেস্টুরেন্টে দেখেছিল মহিলাকে। পাতা আবার নিজের খাওয়ার মনোনিবেশ করে। ভোরের মুখেও চামচে করে বিরিয়ানী তুলে দেয়। ভোর বাবার কোলে বসে একবার আইসক্রিম খাচ্ছে তো একবার বিরিয়ানী মুখে পুরছে। অন্যসময় হলে অরুণ বাঁধা দিতো এখন বাঁধা দিতে মন চাইলো না। আরিয়ান ভাইয়ের জন্য বিরিয়ানী অর্ডার দিতে চাইলে অরুণ মানা করে। মাত্রই চাইনিজ খেয়েছে সে। এরই মাঝে রুবির আগমন ঘটে। সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেড়িয়ে আসে। সবাই সিদ্ধান্ত নেয় পার্কে যাবে। ভোর আনিকা তো সেই খুশি! পারে না গাড়িতেই নেচে ওঠে। সন্ধ্যার দিকে হলেও পার্ক খোলা থাকে। বিশেষ করে এই সময়টা যেন আরো জমে ওঠে। সবাই মিলে একটা শিশু পার্কে যায়।অরুণ ভিড় ঠেলে টিকিট কেটে নেয়। পার্কে প্রবেশ করে ভোর আনিকা সামনে সামনে হাঁটতে থাকে। তাঁরা দুজন ঘোর আলাপের মাঝে ডুবে। কে কোন রাইডে উঠবে! ভুতের ঘরে যাবে। ঘোড়ার উঠবে! আরো কতশত প্ল্যান তাদের! ভোর মাঝেমধ্যে বাবাকে জিজ্ঞেস করছে,

-” আব্বু আমি কিন্তু সব রাইডে চড়বো। তুমি কিন্তু একদম মানা করতে পারবে না!”
অরুণ চুপচাপ হ্যাঁও বলে না; আবার নাও করে না। সে পকেটে হাত গুটিয়ে ছেলের পেছনে হাঁটছে। তাদের পিছনে আরিয়ান রূপকে কোলে নিয়ে হাঁটছে আর রুবি তাঁর বাহু আঁকড়ে ধরে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। মাঝে মাঝে দু একটা প্রেম বাক্য পাঠ করছে দুই কপোতী! পাতা সবার পেছনে অবস্থান করছে। সে আস্তে ধীরে হাঁটছে আপনমনে। শাড়ি পড়ে সবার সাথে হাঁটতে বেশ বেগ পোহাতে হচ্ছে। সে লোকটার উপর ভয়ঙ্করভাবে রেগে আছে। লোকটা কেমন যেন তাকে গ্রাহ্যই করছে না! এমন কেন করছে? সকালেও তো ঠিক ছিল তাহলে? পাতার চোখ জোড়া ভিজে ওঠে। আরিয়ান ভাই আর রুবি আপু কি সুন্দর করে হেঁটে যাচ্ছে। আর লোকটা তাকে ফেলেই আগে আগে যাচ্ছে। রসকষহীন আনরোমান্টিক লোক কোথাকার! তাঁর যে একটা আদুরে বউ আছে সেই সেটা ভুলেই বসেছে!

ভোর আনিকা পুরো পার্ক ঘেটে দেখেছে। ট্রেন, বোর্ড, নাগরদোলা সব কিছুতেই ওঠা শেষ। শুধু ভুতের ঘরে যাওয়া হয় নি। সেটা আপাদত বন্ধ আজ। এখন দুজন দোলনায় বসে দোল খেতে ব্যস্ত। পাতা তাদের ধাক্কা দিচ্ছে। আরিয়ান রুবি একটু দূরে দাঁড়িয়ে। ছবি উঠতে ব্যস্ত তাঁরা সাথে রূপও আছে। আর অরুণ সরকার? সে সামনে ব্রেঞ্চে চুপচাপ বসে। পাতা ব্যাপারটা খেয়াল করেছে। লোকটা কেমন যেন অস্বাভাবিক রকম চুপ হয়ে আছে। লোকটা গম্ভীর চুপচাপ কিন্তু ছেলের সামনে সে অন্য অরুণ সরকার। এর আগেও তাঁরা এসেছিল পার্কে! সে, ভোর ও লোকটা। তখন তো নাক উঁচু লোকটা হাসিখুশিই ছিলো। অথচ আজ কেমন যেন; লোকটা তাদের সাথে থেকেও নেই! আনমনা! এমনকি ভোরের সাথেও! অন্যসময় হলে ভোরের উপর শতখানি নিষেধাজ্ঞা জারি করতো। ভোর ওটা করবে না! এটা করবে না। ব্যাথা পাবে। আমার কাছে থাকো! কিন্তু আজ সে ভোরকে কোনো কিছুতেই নিষেধ করে নি‌। ভোর নিজের মতো লাফালাফি ছোটাছুটি করেছে যেন মুক্ত বিহঙ্গ। আর অরুণ সরকার পুরোটা সময় চুপ ছিলো।

-” ও আম্মু? তুমিও চড়ো না দোলনায়? আমি ধাক্কা দিবো!”
ভোরের কথায় পাতার ধ্যান ভঙ্গ হয়। অরুণের উপর থেকে নজর সরিয়ে ভোরকে বলে,
-” না সোনা তুমিই দোল খাও! আমি একটু আসি! আস্তে আস্তে কিন্তু? ব্যাথা পাবে!”
ভোর মাথা নেড়ে সায় জানালো। পাতা শাড়ির কুচি ধরে‌ এগিয়ে যায়। অরুণের পাশে বসে। অরুণ তাঁর দিকে একবার তাকিয়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়। পাতা ভ্রু কুটিতে ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে,
-” কি হয়েছে আপনার? কেমন চুপচাপ আছেন! কিছু হয়েছে?”
অরুণ পাতার মাথার স্কার্ফটা পিন ঠিক করে দেয়। কাঁধে হাত রেখে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,

-” কিছু হয় নি! আই’ম ফাইন। শুধু টায়ার্ড লাগছে একটু আকটু!”
পাতার বিশ্বাস হয় না। তবে কথার প্রেক্ষিতে কিছু বলে না। বললে দেখা যাবে লোকটা রেগে বোম হয়ে আছে। সে হাত বাড়িয়ে অরুণের কপালে রাখে। নাহ্ জ্বর তো নেই! অরুণ মুচকি হেসে পাতার হাত মুঠোয় ভরে আলতো করে চুমু দেয়। হাতটা মুঠোয় বন্দি রেখে শান্ত গলায় বলে,
-“হেডেক হচ্ছে। যন্ত্রণায় মাথা মনে হয় ছিঁড়ে যাচ্ছে!”
পাতা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। লোকটার মাথা ব্যাথা! কষ্ট হচ্ছে নিশ্চয়ই! লোকটা কখনো বলে না তাঁর খারাপ লাগছে বা কোনো অসুবিধা হচ্ছে। সবসময় নিজের ভিতর কথা চেপে রাখবে।পাতা উঠে দাঁড়ালো। অরুণের পরিপাটি চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে শাসনের সুরে বলে,

-” এই জন্যই চুপচাপ বসে ছিলেন! বললে বাড়ি চলে যেতাম! ইশ্! ওষুধ খেয়েছিলেন?”
অরুণের ভালো‌ লাগে মিষ্টি শাসন। সে বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ে খায় নি। পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে চলে যায়! আরিয়ানকে ডেকে বলে,
-” আপনারা কি আরো কিছুক্ষণ থাকবেন?”
আরিয়ান জিজ্ঞেস করে,
-” কেন কোনো সমস্যা? বাড়ি যাবে? মাত্র তো সারে আটটা বাজছে!”
-” তাহলে আপনারা থাকুন আমরা চলে যাচ্ছি! ভালো লাগছে না আর!”
পাতার কথায় রুবি ভেবে বলে,
-” একসাথেই যাই! চলো? অনেক হয়েছে। ছেলেটার ঘুমোনোর সময় হয়ে গেল!”
আরিয়ান আর দ্বিরুক্ত করে না।

রাত এগারোটার কাছাকাছি। পাতা তড়িঘড়ি করে ঘরে আসে। রুম জুড়ে অন্ধকার! ড্রিম লাইটও জ্বালানো হয়নি! পাতা লাইট জ্বালানোর জন্য দেয়াল হাতরে সুইচের খোঁজ চালায়! পেয়েও যায় এরমধ্যে গমগমে আওয়াজ ভেসে আসে,
-” পাতাবাহার? লাইট জ্বালিও না!”
-” অন্ধকার তো! ড্রিম লাইট জ্বালিয়ে দিন?”
-” আলো অসহ্য লাগছে! বন্ধই থাক!”
পাতা আর কিছু বলে না। অন্ধকারে পা টিপে টিপে বিছানায় গিয়ে বসে‌।শাড়ি চেঞ্জ না করেই গা এলিয়ে দেয়! কম্ফোর্টের ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারে লোকটা মাঝখানে শুয়ে আছে। পাতা কাত হয়ে একটা হাত অরুণের কপালে রেখে টিপে দিতে থাকে।
-” কমে নি তাই না? খুব খারাপ লাগছে? মাথায় পানি দিবেন?”

অরুণ বুজে রাখা চোখ খুলে নেয়। অধরকোণে মিষ্টি হাসির রেখা। যেই মিষ্টি হাসি সচরাচর দেখা যায় না। অরুণ লম্বা শ্বাস টানে! মাথা ব্যাথা থাকলেও সেটা এখন তাকে মোটেই কাবু করতে পারছে না। করবে কিভাবে? ছেলে, ছেলের আম্মু যেন উঠে পড়ে লেগেছিলো! ভোর তো বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে কত চুমু দিয়েছে! বিড়বিড় করে সুরা পাঠ করে পঁচিশ বার ফু দিয়েছে। আরো বিড়বিড়িয়ে বলছিলো ‘আল্লাহ আমার আব্বুর মাথা ব্যাথা ঠিক করে দাও’। অরুণের কাছে ছেলের এসব আদুরেপনা বেশ পরিচিত। কিন্তু আজ পাতাবাহারের কান্ডকারখানায় সে হেসেছে! পারে না পাগলী মেয়েটা তাঁর মাথা ব্যাথাকে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বের করে দিতে! তার সেসব কান্ডের কথা বলার মতো নয়। অরুণ কপাল থেকে পাতার হাতটা সরিয়ে দিয়ে অন্ধকারেই পাতার বুকে মুখ গুঁজে বলে,

-” একটুও কমে নি! খুউব খারাপ লাগছে!”
পাতার চিন্তার মাত্রা বেড়িয়ে যায় তরতরিয়ে। বুকটা কাঁপছে অনবরত। সে অরুণের ঘন সাদাকালো মিশেলের চুলের মাঝে হাত চালিয়ে বলে,
-” ওষুধ খেয়েও কমে গেলো না কেন? ডাক্তারের কাছে একবার কল করুণ তো?”
অরুণ পাতাকে আরেকটু নিবিড়ভাবে জড়িয়ে বিড়বিড় করে বলে,
-” ডাক্তারে কিছুই হবে না। তবে আমার আদুরে পাগলী বউটা একটু আদর করলেই কমে যাবে! একশ দেড়শতাধিক চুমু দিলে একটু কমতে পারে!”
পাতা হাসে। সে কি কোনো সতেরো আঠারো বয়সী নিব্বি প্রেমিকা নাকি? যে এসব রোমান্টিক কথাবার্তায় আবেগে আপ্লুত হয়ে যাবে! পাতা অরুণের মাথার চুল টেনে ধরে বলে,

-” তাহলে থাক..”
আর বলতে পারে না। ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে যায়।
-” নাক উঁচু ম্যানারলেস অসভ্য বর্বর লোক কোথাকার!”
অরুণ আবার দাঁত বসিয়ে বিড়বিড় করে কিছু বলে। পাতা অরুণকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে বলে,
-” কি হচ্ছে টাকি ভোরের বাবা? ছাড়ুন?”
অরুণ ছেড়ে দেয় সাথে সাথেই। অপাশ ফিরে ভোরকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। সবকিছু পাতার মাথার উপর দিয়ে যায়। কিছু পল চুপচাপ ওভাবেই শুয়ে থাকে। লোকটা কি রেগে গেলো? পাতার মনটা খারাপ হয়ে যায় নিমিষেই। সে অরুণের বালিশে মাথা রেখে এক হাত পেটে রাখে। অরুণ প্রতিক্রিয়াহীন। না সরিয়ে দেয় না আকরে ধরে। পাতার হাতটা ধীরে ধীরে উপরের দিকে উঠে। উন্মুক্ত পিঠে অধর ছুঁয়ে যায়। এতেও যেন কাজ হয় না। পাতার কপালে ভাঁজ পড়ে। সে উঠে বসে অরুণের বাহু ধরে ঝাঁকিয়ে বলে,

-” এই ভোরের বাবা?”
অরুণ চোখ মুখ খিচে নিয়ে শুয়ে থাকে। এতো আদুরে ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকা যায়? পাতা আবার ডাকে,
-” এই?”
না আর থাকা গেলো না। সে ঝটকায় পাতার হাত ছাড়িয়ে ধমকে বলে,
-” শান্তিতে ঘুমাতে দিবে না? এমনিই মাথা ব্যাথায় ভালো লাগছে না। অসহ্যনীয় হয়ে উঠেছে।”
পাতা বসে থাকে ওভাবেই। এভাবে ধমক দিতে পারলো? সে লোকটাকে শান্তিতে ঘুমাতে দিচ্ছেনা?সে অসহ্যনীয় হয়ে উঠেছে?পাতা আবছা অন্ধকারে অরুণের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখের উপর হাত রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে লোকটা। তার ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ পাতার কানে বাজছে। পাতা তাকিয়ে থাকে শুধু। নড়ে না চড়েও না; চুপচাপ ওভাবে বসে থাকে।
অরুণ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে নেয়। অন্ধকারে পাতার অবয়ব বুঝতে পারে। নাক টানার শব্দও ভেসে আসে। অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে; এদের কি করবে সে? অরুণ হাত বাড়িয়ে দেয়। আবছা আলোয় পাতার কাঁধ থেকে আঁচল নামিয়ে বলে,

-” পাতাবাহার কাম?”
বলতে দেড়ি পাতার আসতে দেড়ি হয় না। একপ্রকার ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ব্যাক্তিগত মালিকানায়! দু গালে হাত রেখে মুখোমুখি হয়। কপালে ছোট বেশ কয়েকটি চুমু দেয়! সুযোগ বুঝে গালে থুতনি জুড়ে চুমুর বর্ষন হয়! প্রথমবারের মতো বোচা নাকটায় আলতোভাবে কামড় দিয়ে কাঁধে মুখ লুকিয়ে নেয়! অরুণ শব্দ করে হেসে উঠে। দু হাতে জড়িয়ে ধরে ধীমে গলায় বলে,
-” মাত্র সাতাশ! এখনো একশত তেইশটা বাকি আছে!”
পাতার কান দিয়ে যেন গরম ধোঁয়া বের হবে! সে বিড়বিড় করে,
-” শালার অসভ্য জামাই!”
অরুণের কর্ণ গহ্বরে বাক্যটা পৌঁছানো মাত্র তার মুখের আদল পরিবর্তন হয়। পাতাকে বুকের নিচে ফেলে বলে,
-” বন্ধু নই তোমার! আই’ম ইয়ুর হাসবেন্ড! শালা কেমন ভাষা? হুম?”
স্পষ্ট ধমকের সুর! পাতা কাঁচুমাচু মুখে তাকায়। এখন মুখ ফসকে বেড়িয়ে এলো সে কি করবে? সে মিনমিনে গলায় বলে,
-” স্লিপ অফ টাঙ! আর হবে না। এই বালিশ ছুঁয়ে বলছি!”

অরুণ কপালে ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে। পাতা নজর সরিয়ে নেয়। লোকটার চোখের গভীরে তাকানোর সাহস এই মুহূর্তে তার নেই! অরুণ পাতার কপালে চুমু দিয়ে তার নিজ কার্যে অগ্রসর হতে থাকে। মিষ্টি মধুর আলিঙ্গনে ধীরে ধীরে ভাসিয়ে নেয় পাতাকে। পাতা একবার বাধা দেয়! অরুণ চোখ রাঙায়! আবছা আলোয় গরম চোখের চাহনি দেখে পাতা আর কিছুই বলতে পারে না। সময় যতো পেরিয়ে যায়‌ রাত ততটাই অন্ধকারে ধাবিত হয়। সাথে নিশীথ গভীরে ডুব দেয়। অন্ধকার ঘরে দম্পতি প্রণয়ের জোয়ারে ভাসমান। চাপা ঘন নিঃশ্বাস পুরো ঘর জুড়ে। হঠাৎ ক্ষীণ সুরে ‘আব্বু’ ডাক ভেসে আসে। অরুণের কান সজাগ হয়। অন্ধকারে পাশ হাতরে নিজের খুলে রাখা শার্ট খুঁজে পাতার গায়ে গলিয়ে দুটো বোতাম লাগিয়ে সরে আসে। হৃদস্পন্দন তার অস্বাভাবিক। ছেলের কাছে গিয়ে আদুরে গলায় বলে,

-” ঘুম ভেঙ্গে গেছে কলিজার? বাজে স্বপ্ন দেখছো?”
ভোর বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুম জড়ানো ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলে,
-” হুম! খুবই বাজে স্বপ্নটা! দেখি তোমার মাথা ব্যাথা বড় হয়ে দুটো সিং গজিয়েছে! একদম ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছে!”
অরুণ তার কপালে চুমু দেয়। ভোর বলে,
-” তোমার মাথাব্যথা কমেছে আব্বু? লাইট জ্বালাও না?”
অরুণ লাইট জ্বালিয়ে দেয়। ভোর বাবার কপালে চুমু দিয়ে বলে,
-” কমেছে?”
-” হুম! তুমি আল্লাহকে বলেছো! তিনি সারিয়ে দিয়েছেন!”
ভোর খুশি হয়ে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। অরুণ আড়চোখে পাতার দিকে চায়।পাতা কম্ফোর্ট সরিয়ে উঠে বসে। ভোর তাকে দেখে বলে,

-” আম্মু আব্বুর মাথা ব্যাথা ভেনিশ হয়ে গেছে!”
পাতা তাঁর মাথার এলোমেলো চুল ঠিক করে বলে,
-” ভোর এতো দোয়া‌ করেছে হবে না? আচ্ছা ভোর সিং গজানো বাবাকে কেমন দেখলে?”
ভোর দাঁত বের করে হেসে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অরুণের থুতনি ধরে এদিকে ওদিকে করে বলে,
-” আম্মু একদম ভ্যাম্পায়ারের মতো লাগছিল! মাথায় দুটো সিং! বড় বড় দুটো রাক্ষুসে দাঁত! চোখ দুটো লাল টুকটুকে ছিলো!”
পাতা পিটপিট করে তাকালো।
-” একটা ছবি তুলে রাখতে। আমিও দেখতাম!”
ভোর ভাবনায় পড়ে।
-” স্বপ্নে ছবি তোলা যায় আম্মু?”
পাতা হেসে দেয় খিলখিলিয়ে। অরুণ ছেলেকে শুয়ে দেয়। পাতার হাসি থামে না। তার হাসি দেখে ভোর বলে,
-” আম্মু হাসছো কেন?”
পাতা কিছু বলে না শুধু হাসতেই থাকে যেন হাসির প্রতিযোগিতায় নেমেছে। অরুণ বিরক্তের সাথে তাকায় পাতা তবুও থামে না। ভোর আম্মুর হাসি দেখে হাসতে নিবে অরুণ শক্ত গলায় বলে ,

পাতা বাহার পর্ব ৪৫

-” ঘুমাও?”
ভোর বাবার পেটের উপর এক পা তুলে বুকে মুখ লুকিয়ে চোখ বুজে নেয়। পাতা হাসি থামিয়ে পিটপিট করে চায়। অরুণও তাকায় তার দিকে। পাতা ঠোঁট ভেঙে আবার হেসে দেয়। লোকটার উপর তাঁর করুণা হচ্ছে, আহারে!
-” বেয়াদব রাত দুপুরে পেত্নি ভর করেছে? ঘুমাও?”
অরুণে ধমকে পাতা ধপাশ করে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে। তবে তার হাসি মোটেও বন্ধ হয়ে যায় নি‌! অরুণ হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বুজে নেয়।

পাতা বাহার পর্ব ৪৭