পাতা বাহার পর্ব ৪৯

পাতা বাহার পর্ব ৪৯
বেলা শেখ 

শীতের কুয়াশামাখা ভোর বেলা। মেইন শহরের ভিতরে হওয়ায় পাখির আনাগোনা শোনা যায় না খুব একটা। ঘনঘটা কুয়াশার আবরণও চোখে পড়ে না। এতো ব্যস্তবহুল রাস্তা, বড় বড় দালান কোঠার ভিড়ে শীতের সকাল উপভোগ করা খুব দুষ্কর!

অরুণ সরকার কিচেনে রুটি বেলছে। গত আড়াই মাসের পঞ্জিকায় নিত্যদিনের মতো মর্নিং ওয়াক শেষে বাড়ি ফেরার পর এটাই তার রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সকালের রান্না করে দুপুরের খাবারও রেডি করে রেখে যেতে হয়। রাতে ফিরে আবার রান্না! অরুণ স্বাচ্ছন্দ্য চিত্তে সব রান্না করে। করবে না কেন? তার রাজ্যের রানিসাহেবান, রাজপুত্রের জন্য রান্না করতে তার বেশ লাগে। তবে মাঝেমধ্যে ব্যস্ততা বেড়ে গেলে একটু কষ্টসাধ্য ব্যাপার হলেও কিচ্ছু করার নেই। একটা রাঁধুনী রেখেছিলো! অল্পবয়সী মেয়ে! রান্না বান্না, ঘরদোর পোছাসহ টুকটাক কাজের জন্য। কিন্তু তাঁর মহারানী ভাগিয়ে দিয়েছে! কেন? জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না। তবে অরুণ কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই কিছু বলে নি। অরুণ গোল রুটি তাওয়ায় সেঁকতে দেয়। একটা কোমলমতি হাত তাওয়ার রুটি উল্টে দিতে উদ্যত হয়। অরুণ তার নরম হাতে বেলুনি দিয়ে আস্তে করে আঘাত করে নিজেই রুটি উল্টো করে দেয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে হাত গুটিয়ে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। পূর্ব দৃষ্টি মেলে অরুণ সরকারের রুটি বানানো দেখে। কি সুন্দর গোল গোল করে বানাচ্ছে! দেখে পাতার নিজেরই লজ্জা করে। সে কেন পারে না? পারবে কিভাবে! তার রান্না করা একেবারে নিষিদ্ধ। যদিও নিষিদ্ধ হবার পেছনে এক অতি যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে বটে। এ বাড়িতে আসার পাঁচ ছয়দিনের মাথায় একবার ভোরের আবদারে নুডুলস রান্না করার সময় গরম পানি পায়ে ফেলে লঙ্কা কাণ্ড বেঁধে ফেলেছিলো। ফুটন্ত গরম পানি পরার সাথে সাথেই যেন চামড়া পুড়ে যা তা অবস্থা হয়েছিল! ছোট ভোর সেদিন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছে। পাতা ব্যাথায় ছটফট করছিলো; ভোর ভেঙ্গে না পড়ে তাকে সান্ত্বনা দেয়। পাতার পায়ে ফ্রিজের ঠান্ডা পানি ঢেলেছিলো! সাথে বরফ কুচি ডলে দিয়েছিলো। তবে পাতার ফোন থেকে বাবার নম্বরে কল করেই ভোর কেঁদে গঙ্গা যমুনা ভাসিয়ে ছিলো। আধাঘণ্টার ব্যবধানে লোকটা ডাক্তার সমেত হাজির হয়েছিলো। বকে বকে পাতার কান ঝালাপালা করে তার রান্না করা ব্যান করে দিয়েছে । ভাবতেই পাতার অধরকোনে হাসির ঝিলিক দেখা যায়।
অরুণ আড়চোখে লক্ষ্য করে নরম সুরে বলে,

-” হাসছো কেন?”
পাতার হাসি গায়েব হয়ে যায়। মাথা নেড়ে বোঝায় এমনিতেই। অরুণ ছোট ছোট করে তাকালো। মেয়েটার মাঝে মাঝে কেমন অদ্ভুত বিহেব করে। কখনো তার মুখশ্রী জুড়ে শীতকালীন মিষ্টি রৌদ্রের আনাগোনা তো কখনো ঠান্ডা কুয়াশার আবির্ভাব। আবার এই শীতের সিজনে কালো মেঘের উঁকিঝুঁকি! অরুণ রুটি সেঁকে ঝুড়িতে রেখে পাতার গালে অধর ছুঁয়ে আবার নিজ কাজে মনোনিবেশ করে বলে,
-” পাতাবাহার? রুটি বানানো শিখতে চাও?”
পাতা সন্দেহ চোখে তাকায়। অরুণ মুচকি হাসলো। পাতাকে দু হাতের মাঝে আটকে দুহাতে বেলুনি ধরিয়ে দিয়ে কাঁধে থুতনি রেখে বলে,
-” লেটস স্টার্ট!”

পাতা খানিক ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে রুটি বেলতে থাকে। অরুণ তাকে দেখিয়ে দেয় কিভাবে কি করতে হবে। পাতা মুহুর্তের মাঝেই একটা অর্ধ গোলাকার রুটি বানিয়ে ফেলে। তার মুখশ্রীতে রুটি বানাতে সফলকাম হওয়ার আনন্দে উপচে পড়ছে। অরুণ পেছনে থেকে পাতাকে জড়িয়ে গালে চুমু দেয় সশব্দে। পাতা একটু লজ্জা পেলেও লজ্জাকে পাশে রেখে আরেকটা গোলা নেয় রুটি বানানোর জন্য। পাতা অরুণের সহায়তা ছাড়াই রুটি বেলতে থাকে। অরুণ পাতার ঘারে থুতনিতে অধর বুলাতে থাকে। মাঝে মাঝে ছোট তবে গভীর চুমু দেয়। পাতা কেঁপে ওঠে; পাতার ভালো লাগে তবুও কনুই দিয়ে অরুণের পেটে শক্তপোক্ত গুঁতো মেরে বাঁধা দেয়। অরুণ কাঁধে দাঁত বসিয়ে একহাত আঁচল গলিয়ে উন্মুক্ত পেটে রাখে। পাতার মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন বৃদ্ধি পায়। রগে রগে ছড়িয়ে পড়ে ভয় নামক উত্তেজনা। রুটি বেলতে থাকা হস্তদ্বয় থেমে শক্ত হয়ে আসে। শীতের ঠান্ডা ঠান্ডা আমেজেও পাতা ঘামতে শুরু করে। অরুণ পাতার ঘারে গরম শ্বাস ছেড়ে বলে,

-” কি হয়েছে পাতাবাহার? কিছুদিন হলো খেয়াল করছি আনমোনা হয়ে থাকো। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে থাকো। কাছে আসলেই কেমন অসাড় হয়ে যাও! আমার সাথে ঝগরাও কর না ঠিকমতো!”
পাতা মন কুঠির ভয় নাম উত্তেজনায় কিলবিল করে। লোকটা যদি বুঝে যায়! জেনে যায় সব কিছু? পাতাকে দূরে সরিয়ে দেয়? কিভাবে বাঁচবে পাতা? মরে যাবে তো! পাতার দম বন্ধ বন্ধ লাগে। কান্না পায়।অরুণের বাঁধন থেকে ছাড়া পাওয়ার প্রয়াসে ছটফট করে। অরুণ ময়দা মাখানো হাতটা পাতার পেটে রেখে দু হাতেই বেঁধে নেয়। গালে আদুরে চুমু দিয়ে বলে,

-” বলবে না আমায়? তোমার আদুরে মুখটাতে ভয় প্রস্ফুটিত হয়ে গেছে। কোন সমস্যা? নির্দ্বিধায় বলতে পারো পাতাবাহার!”
পাতা ঢোক গিলে। ভয়ে হাত পা শিথিল হয়ে আসে। শরীরের কম্পন বেড়ে যায়। তবুও অরুণের হাত সরিয়ে দিতে দিতে নিজেকে সামলে স্বাভাবিক গলায় বলে,
-” কোথায় ভয় ফুটে উঠেছে? আপনার চোখে সমস্যা দেখা দিয়েছে। ঘরে টেবিলে চশমা আছে পড়ে নেবেন! কিছুই হয় নি।”
পাতাকে ছেড়ে দেয় অরুণ। ফ্রিজ খুলে ডিম বের করে ধুয়ে নেয়! পাতা রুটি বানানো সম্পূর্ণ করে বলে,
-” সত্যিই কিছু হয় নি। সমস্যা হলে বলি তো আপনাকে!”

‘হুম’ বলে অরুণ রান্না করায় মগ্ন হয়ে পড়ে। পাতার মুখের আদল মলিন; চোখ জোড়া পানিতে টলমল। অরুণ খেয়াল করে তবে কিছু বলে না। পাতা একবার ভাবে চলে যাবে কিচেন থেকে; কি মনে করে যায় না। অরুণের পাশেই দাঁড়িয়ে চুপচাপ সব অবলোকন করে। টুকটাক কথা বলে। অরুণ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দেয়। এর মাঝেই আগমন ঘটে পাতাবাহারের। কিচেনে অরুণের সাথে পাতাকে দেখে একপ্রকার ছুটে আসে। কেবিনেটের উপর উঠে পাতার দিকে তাকিয়ে মিও মিও করে! অবুঝ প্রাণী হয়তোবা জেলাসিতে ভুগছে। পাতা তাকে চোখ রাঙিয়ে অরুণের বাহু জড়িয়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। বিড়ালটি ছোট ছোট চোখে তাকিয়ে বসে পড়ে; তার ঝলমলে চোখের তারায় অরুণ পাতার স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
অরুণ দু’জনের কান্ডে হতাশ! ভেবেছিল দুই সখির গলায় গলায় ভাব হবে। অথচ একে অন্যকে দেখতেই পারে না। মনে হয় দুই সতিন! সে হতাশ গলায় ডাকে,

-” পাতাবাহার?”
অরুণের দুই পাতাবাহারই তার ডাকে সাড়া দেয় শতভাগ। অরুণ মুচকি হাসলো। পাতা যেন সুযোগ পায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার! সে অরুণের বাহুতে চিমটি কেটে বলে,
-” শুনুন ভোরের বাবা! দ্বিঘাত ত্রিঘাত সমীকরণে যেমন × এর মান হয় এটা; অথবা ওটা নির্বাচন করতে হয়! তেমনি আপনি হয় আমাকে পাতাবাহার ডাকবেন নয়তো আপনার ওই ছা’পোষা বিড়ালকে ! ওকে ডাকলে আমাকে ডাকবেন না। আমাকে ডাকলে ওকে না! কথা ক্লিয়ার?”
অরুণ ঠোঁট চেপে হেসে পাতার বাঁধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,

-” একদম ক্লিয়ার নয়। তোমাকে যেমন ভালোবেসে ডাকি ওকেও ডাকি! একটা অবুঝ বিড়ালকে কেউ হিংসে করে? হুম?”
পাতা স্বস্তিবোধ করে। লোকটা রেগে নেই তাহলে। সে বাহানা দিয়ে কেটে পড়ার উদ্দেশ্যে বলে,
-” আমি ভোরের কাছে যাচ্ছি।ওর রিভিশন কতদূর দেখি গিয়ে!”
অরুণ পাতাকে আটকিয়ে কাঁধ জড়িয়ে নিজের সাথে চেপে ধরে বলে,
-” আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকো ভোরের আম্মু!
পাতা উশখুশ করে বলে,
-” শুধু দেখে আসি..”
-” বলছিতো এখানে থাকো!”
শক্ত গলায় বলে অরুণ! পাতার যাওয়া হয় না। সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অরুণ কিছুপল চুপ থেকে এক হাতে পাতাকে আটকে রেখে অপর হাতে কাজ করে! শান্ত গম্ভীর গলায় বলে,
-” কি হয়েছে পাতাবাহার?”

পাতার বুকটা কেঁপে ওঠে। নোনাজল ভিড় জমায়। একবার ভাবে বলে দেবে। এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না। প্রতিটা মুহুর্তই দমবন্ধ লাগে তাঁর। অরুণ সময় দেয়! পিঠে হাত বুলিয়ে পাতাকে ভরসা দেয়। মাথায় চুমু দেয়। পাতা প্রস্তুতি নেয় সব বলার। জুবান ছিঁড়ে কথা বেড়োবে হঠাৎ নিজেকে থামিয়ে দেয় পাতা। কি করতে যাচ্ছিলো সে? এখন যতোই আদুরে গলায় বলুক; আদর যত্ন করে মনের খবর নিক! যখন সত্যিটা জানতে পারবে ঘার ধাক্কা দিয়ে পাতাকে দূরে ঠেলে দিতে একবার ভাববে না। সে জানে ছেলের ভালো থাকা অরুণ সরকারের কাছে সবার আগে। বাকি সবাই জাহান্নামে গেলেও লোকটা ফিরে তাকাবে না। ছেলের জন্য হয়তো আগত অতিথিকে সে দুনিয়ার আলো দেখতে দিবে তো? পাতা নিজেকে ধাতস্থ করে চুপচাপ থাকে।
অরুণ বেশ সময় দেয়। পাতাকে চুপ থাকতে দেখে বুঝতে বাকি থাকে না ব্যাপারটা গুরুতর; মেয়েটা তাকে ভয় পাচ্ছে! অরুণ পাতার কপালে চুমু দিয়ে বলে,

-” ইটস ওকে বলতে হবে না। হয়তো আমার উপর ভরসা নেই।”
পাতা অরুণের পিঠে হাত গলিয়ে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে। অরুণ তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। সে জানে সাথে বিশ্বাস করে, মেয়েটা তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। মাঝে মাঝে অবাক হয়; মেয়েটা এতটা ভালোবাসে কেন তাকে? এরকম পাগলের মতো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতা তাঁর আদৌ আছে? সে পাতাকে ভালোবাসে! কিন্তু পাতার মতো না।

যেদিন রাস্তায় পাতাকে এক ট্রাফিক পুলিশ রাস্তা পার হতে সাহায্য করে। অরুণ হিংসাত্মক চোখে চেয়ে দেখেছিলো পুরোটা। ছেলের এক্সামের সময় মেল কলিগের সাথে হাসিমুখের কথাবার্তাও ভালো লাগে নি। কিন্তু সে এই হিংসার যথাযথ ব্যাখ্যা বের করতে পারে নি। ক্ষণিকের আকর্ষণ ছিলো হয়তোবা।যেদিন তার সাথে জুড়ে মেয়েটার নামে কুৎসা রটানো হয়। সে খুবই রেগে গিয়েছিল! সুজনকে দিয়ে মেয়েটার এ টু জেড ডিটেইলস জেনে নেয়। এতো আরেক হতভাগী! অরুণের বুকে স্নেহ জমেছিল ঢের! ঠিক সেদিনই মেয়েটার ফোন পেয়ে ছুটে গিয়েছিলো।

সেই ভরা শালিশে মেয়েটার ক্রন্দনরত মুখটা দেখে মায়া লেগেছিল বেশ! মেয়েটার করুণ মায়াময় মুখ দেখে তাঁর মায়ায় ভরা ছেলেটার মুখ ভাসছিলো চোখের তারায়! ছেলের ‘মিস পাতার মতো আম্মু চাই! পাতা মিস আম্মু হলে অনেক ভালো হবে!’ কথাগুলো কানে বাজছিলো। অরুণ ভেবেচিন্তে কথা পাড়ে আতিকুর ইসলামের কাছে।সে আশাবাদী ছিল আতিকুর ইসলাম মানা করবেন না। কেননা এর আগে এক ডিভোর্সী ছেলের সাথেই মেয়ের বিয়ের কথা এগোচ্ছিলেন। কিন্তু মাঝখানে লতা অস্বীকার করে।

অরুণ তাদের সিদ্ধান্তকে সম্মান জানিয়ে ফিরতি পথে পা বাড়িয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা যখন তাকে ডাকলো সে একবুক আশা নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো। নিরাশ হয় নি। মেয়েটি স্বীকারোক্তি দিতেই অরুণ আর দেড়ি করে নি। যদি আবার সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলে! তবে অরুণের ভয় হতো মেয়েটা ভালো মনের; তবে আবেগী মন। তাঁর কলিজাকে ভালোবাসবে তো? মা হয়ে উঠতে পারবে তো? সে অনেক ভাবে মেয়েটাকে পরখ করেছে। মেয়েটা সবসময় ফুল মার্কস নিয়ে উত্তির্ণ হয়েছে। কথাটা স্বার্থপর হলেও এটাই সত্য যে, পাতা ভোরকে মন থেকে ভালোবেসে আপন করে নিয়েছে;ভোরের মা হয়ে উঠেছে। তবেই সে অরুণ সরকার ভালোবাসতে শুরু করেছিলো। এখন মেয়েটা তার হৃদয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ রূপে অধিপত্য বিস্তার করে অরুণ সরকারের মন প্রসূণের আঙ্গিনায়। অরুণ সব ভাবনা দূরে ঠেলে কন্ঠে মাধুর্য ঢেলে বলে,

-” ভোরের আম্মু ভোরকে অনেক আদর করেন! মাঝে মধ্যে ভোরের বাবাকেও আদর করতে পারেন! ভোরের বাবা মাইন্ড করবে না। বরং খুশি হয়ে ট্রিপল আদর ফিরিয়ে দেবে!”
পাতা অরুণের বুক থেকে মাথা তুলে শান্ত চোখে তাকায়। তবে ছাড়ে না। নাক টেনে পায়ের আঙ্গুলে ভর দিয়ে উঁচু হয়। অরুণ সাহায্য করে তাঁর রানি সাহেবান কে! কোমড় বেষ্টন করে বুকের উপর তোলে। পাতা লজ্জা পায় না মোটেও; তবে অরুণের চোখে চোখ রাখে না। যেন চোখের ভাষা পড়ে নেবে অরুণ! কুচকুচে কালো দাঁড়িতে ঢাকা কপোল জোড়া আঁজলায় করে আদরে আদরে ভরিয়ে দিল। বিড় বিড় করে অস্ফুট স্বরে বলে ‘অরুণ বিনা মরে যাবে পাতা!’ অরুণ সরকারের শক্ত পোক্ত বলিষ্ঠ শরীর যেন কেঁপে ওঠে সেই ক্ষুর ধারালো গভীর বাক্যে। বুকের বা পাশে আঘাত হানে তীব্র গতিতে।শক্ত বাঁধন আগলা হয়ে আসে। পাতা গভীরে ডুব দেয়। অরুণের আগলা বাঁধন ধীরে ধীরে মজবুত হয় ইস্পাতের মতো!

দুপুর গড়িয়ে দুটোর ঘরে যেতেই ঘন্টা বেজে ওঠে।এক্সামের সময় শেষ হয়ে গেছে। বাচ্চারা পেপার শীট জমা দিয়ে বের হয়। ভোর এক্সাম হল থেকে বেরিয়ে গুটি গুটি পায়ে অফিস রুমের দিকে যায়। বারান্দা খোলা থাকায় সেখান দিয়ে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে আম্মু আছে কি না!
সৈয়দ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বেরিয়ে আসে রুম থেকে। ভোরের পিছনে দাঁড়ায় ভোর তাঁকে দেখেনি! সে তো উঁকি ঝুঁকি দিতেই ব্যস্ত। সৈয়দ গলা খাঁকারি দিতেই ভোর চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
-” আসসালামুয়ালাইকুম স্যার! কেমন আছেন?”

এতো আদুরে বাচ্চাটা! দেখলেই গাল টিপে দিতে ইচ্ছে করে! সৈয়দ মুচকি হেসে তার ফুলো গাল টেনে দিয়ে বলে,
-” ভোরের আম্মু প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমে!”
ভোর মিনমিনে গলায় ‘থ্যাংক ইয়ু’ বলেই দৌড়ে চলে যায় প্রিন্সিপাল ম্যামের রুমের সামনে। তবে ভিতরে প্রবেশ করে না। ম্যাম তাকে কাছে পেলেই চুমু খাবে। ভোরের লজ্জা করে তখন!
পাতা প্রিন্সিপাল ম্যামের রুম থেকে বের হয়ে ভোরকে দেখে মুচকি হাসলো। মাথার এলোমেলো চুল গুলো ঠিক করে হাত ধরে স্কুল মাঠ পেরিয়ে বেরিয়ে আসে। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে গেটেই অপেক্ষায় ছিলো। তাঁরা উঠতেই গাড়ি টান দেয়। পাতা ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে,

-” ভাইয়া সঞ্জিবনী ক্লিনিকে যাবেন!”
-” ম্যাডাম কোনো সমস্যা?”
-” না! ওই ক্লিনিকে আমার এক বান্ধবী বসে।তার সাথেই দেখা করতে যাবো!”
মিথ্যে কথা! তবে পুরোটা নয়! ওটা লতাপুর বান্ধবী। একজন গায়েনী বিশেষজ্ঞ ডাক্তার। লতাপু তাকে বলেছে দেখা করতে। পাতাও ভাবে দেখা করাই যায়। ব্যাপারটায় এনশিওর হতে হবে। রিপোর্ট হাতে এলেই সে বিশ্বাস করবে। আর পাতা এটাও ঠিক করে রিপোর্ট পজেটিভ এলে জানাবে অরুণ সরকারকে। ভয় পাবে না একটুও! কেন ভয় পাবে? সে কি ইচ্ছে করে করেছে নাকি।সে সর্বদা সজাগ থেকেছে তবুও কিভাবে হলো সে জানে না। এখন উপর ওয়ালা চায় কেউ আসুক! সেখানে পাতা কিভাবে আঁটকে রাখবে তাকে! তবুও ভয় করে তাঁর।লোকটার থেকে দূরে যাওয়ার ভয়! পাতা সুখানুভূতির সাথে শ্বাস নিতে শিখেছে। সেই অনুভূতি থেকে মুখ থুবড়ে পড়লে পাতা সত্যিই মরে যাবে।

এদিকে ভোর পাতাকে একের পর এক প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছে। আম্মুর কতগুলো বান্ধবী? তাঁরা কেমন? আগে কেন বলেনি ভোরকে! পাতা ভুজুং ভাজুং বুঝিয়ে তাকে শান্ত করেছে। বুকে জড়িয়ে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ভোর ঘুমায় নি।
তাঁরা ক্লিনিকের সামনে পৌঁছালে পাতা ভোরকে বুঝিয়ে গাড়িতে থাকতে বলে সে জলদি চলে আসবে। ভোর বোঝে না। জেদ ধরে সেও সাথে যাবে কোনো কথা শুনবে না। অগত্যা পাতা তাকে নিয়েই ভেতরে চলে যায়। ভোর পাতার হাত ধরে নাচতে নাচতে হাঁটছে।
পাতা ভোর চলে যেতেই ড্রাইভার কল লাগায় অরুণ সরকারকে।

একটা ছোট বাচ্চা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে অনবরত। একটু আগেই গোসল করানো হয়েছে। মিনু পা মেলে বসে বাচ্চাটাকে পায়ের উপর বসিয়ে দিয়েছে। হাতে লোশন মেখে বাচ্চাটার গায়ে মালিশ করছে আর এটা ওটা বলছে। আনিকা গালে হাত দিয়ে বাচ্চাটার পাশে বসে আছে। রূপ আভারির কোলে বসে বাবু বাবু বলে ডাকছে আর খিলখিলিয়ে হাসছে। আভারি বসে দেখছে তার পঁচিশ দিনের ছেলেকে। খুশি উজাড় করে তাদের সংসারে আগমন ঘটেছে এই ছেলের! তাদের বুড়ো বয়সের সঙ্গির আগমন ঘটেছে। মিনুর চোখে মুখেও এক অনবদ্য দ্যুতি ছড়িয়ে পড়েছে। তার আনন্দ সীমার অন্ত নেই! সে ছেলের নাম রেখেছে নয়ন! তাদের বুড়ো বুড়ির নয়নের মনি! আনিকা গালে হাত রেখে গোমড়া মুখে বলে,

-” তোমার ছেলে পঁচা মিনু খালা! একদম ভোরের মতো! শুধু কাঁদে!”
মিনু মুচকি হেসে বলে,
-” ও তো ছোট তাই কাঁন্দে। আনিবুড়িও তো ছোট্ট বেলায় অনেক কান্দিতো!”
আনিকা নাক মুখ কুঁচকে বিছানা থেকে নেমে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
-” আনিকা মোটেই কাদতো না। আনিকা তো ব্রেভ গার্ল! কাঁদে তো ভোর, রূপ আর তোমার ছেলে নয়ন।”
সে ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে মা বাবাকে দেখতে পায়। রুবি আরিয়ানের পাশে বসে।আরিয়ান কেস সংলগ্ন কিছু ফাইল স্টাডি করছে। আনিকা কাছে গিয়ে ফাইল সরিয়ে রেখে বাবার কোল দখল করে বলে,

-” আনি মিসড ভোর সো মাচ!চাচিমনি বড় চাচ্চু সবাইকেই মিস করছে! আব্বু তুমি সবাইকে নিয়ে আসো না?
আরিয়ানের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায় নিমিষেই। শক্ত গলায় আনিকাকে বলে,
-” কাল এক্সাম আছে না তোমার? যাও পড়তে বসো?”
আনিকা ভয় পায়। দৌড়ে চলে যায় নিজ ঘরে। আসমা বেগম সবটা লক্ষ্য করে। কফির মগটা এনে ছেলের সম্মুখে রাখে। সামনের সোফায় বসে বলে,
-” আরিয়ান প্রায় তিনমাসের মতোই হলো ওরা চলে গেছে। আমি বলছি কি তুই একবার ওখানে যা ওদের আনতে! তুই আনতে গেলে ওরা মানা করতে পারবে না!”
আরিয়ান কফির মগে চুমুক দিয়ে বলে,

-” আমি কেন আনতে যাবো? জেনেবুঝে সৎ ভাই ভাইয়ের পরিবারকে টেনে নিজ সংসারে নিয়ে আসবোই বা কেন? দূরে আছে সেও ভালো আছে আমিও ভালো আছি!”
রুবি ভ্রু উঁচিয়ে ত্যাছড়া নজরে তাকায়! আসমা বেগম অবাক হয় বেশ! আরিয়ান এসব বলতে পারলো? সে গম্ভীর মুখে বলে,
-” আরিয়ান এসব কেমন কথা? ভাই হয় ও তোর!”
-” না মা ভাই না সৎ ভাই হয়!বাবা এক হলেও আমাদের দুজনের মা আলাদা।”
আসমা বেগম বাকহারা। আরিয়ানের মুখে এসব শুনবে সে কখনো ভাবে নি। রুবি গালে হাত দিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে। তাঁর চোখে মুখেও একটু অবাকতার রেশ!
আরিয়ান স্বাভাবিক গলায় ফাইল দেখতে দেখতে বলে,

-” মা? ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক খুব একটা সুবিধার ছিল না। না আমি ভাইকে ভাইয়ের চোখে দেখতাম না ভাই আমাকে। সাপে নেউলে সম্পর্ক ছিলো! তবে বাবা চলে যাওয়ার পর সম্পর্কের ভিত্তি পাল্টায়। ভাই আমার বনে যায়। আমি ভাইকে ভাই ভাবলেও ভাই সেটা এখনো ভাবেই নি। সে আমাকে সৎ ভাইয়ের চোখেই দেখে। বাচ্চাদের মাঝে নোক ঝোঁক হয়। ভাই ভোরকে মারে। মারবে কেন? সেদিন ভাই ভোরকে মারলো! কথাকাটাকাটি হলো রুবির সাথে! রুবি কে? পরের মেয়ে না? সে কি বলল না বলল তাঁর উপর ভিত্তি করে ভাই বাড়ি কেন ছাড়বে? আমার সাথে একবার কথা বলেছে? একবার কথা বলে দেখতো! আমি কি অ্যাকশন নিতাম! কিন্তু না সে চলে গেলো!”
কথা শেষ করে আরিয়ান মাথা উঁচু করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” তবে আমার মনে হয় কি জানো? সেদিন রাতে আমার তোমার আর রুবির মাঝে যে কথা হয়েছিলো পাতা মেয়েটা সবটা শুনেছে। শুনে নিশ্চয়ই বসে থাকে নি। ভাইয়ের কান ভারি করেছে। যার জন্য ভাই এতো জলদি..”
তাকে থামিয়ে দিয়ে আসমা বেগম আত্নবিশ্বাসী হয়ে বলে,

-” পাতাকে আমি চিনি। সে ওরকম মেয়েই না। ও যদি শুনেও থাকে কথোপকথন তবুও বলবে না অরুণকে। এটুকু বিশ্বাস আছে। মেয়েটা নরম শোভা সাথে ভালো মনের। তার মধ্যে কোনো প্যাঁচ ধাচ নেই। না কোনো হিংসা বিদ্বেষ!”
রুবির দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে আসমা বেগম। তাঁর নজর যেন কটাক্ষ করছে রুবিকে। রুবি দাঁড়িয়ে বলে,
-” মা কথাগুলো আপনি আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তাই তো?বড় ভাবীরা চলে গেছে এরজন্য আপনারা আমাকে দোষ দিচ্ছেন। হ্যাঁ আমি দোষী। ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাই নি?

আমার ছেলেটা সেদিন দম আটকে মরতে বসেছিলো। যদি ভোরের ওমন অবস্থা করতো আমার ছেলে অরুণ ভাইয়া চুপ বসে থাকতো? তার ছেলে তাঁর কলিজা আমার ছেলে প্লাস্টিক? ছেলের ওমন অবস্থায় ভয় পেয়েছিলাম। ভাইয়াকে কটুক্তি করেছি ভোরকে কথা শুনিয়েছি। ভুল ছিল আমার! সেদিন বুঝতে না পারলেও পরদিন অনুতাপে পুরে ক্ষমাও চেয়েছিলাম হাত ধরে। উনি প্রতিক্রিয়া জানান নি। অনুরোধ করি নি বাড়ি ছেড়ে না যাওয়ার জন্য?

প্রতিদিন অফিসে সময় সুযোগ পেলেই ক্ষমা চাই। বাড়ি ফিরতে অনুরোধ করি।উনি কানেই তোলেন না। মনে হয় আমি মাছি তাঁর আগেপিছে ঘুরঘুর করছি।অরুণ ভাইয়া বলেছিলো আদুরির মতো আমিও তার ছোট বোন! আদুরি ভুল করলে এভাবে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারতো?এখন পায়ে ধরাই বাকি আছে। আপনারা বললে কাল দেখা হলেই পা ধরে ক্ষমা চাইবো!”
বলেই হন হন করে চলে যায়! আরিয়ান তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
-” ওর কথাগুলো কিছুটা হলে যুক্তিসঙ্গত মা! তুমি একবার গিয়ে ভাইয়ের সাথে কথা বলো! ভাই তোমাকে সম্মান করে।”

অরুণ সরকার ছেলের ফোন ফোন পাওয়া মাত্রই বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়েছে। নিজেই ড্রাইভ করে হাওয়ার বেগে বাড়ি ফিরেছে। লিফট থেকে বের হয়ে কলিং বেল বাজায়। দরজা খুলে যায়। নজরে আসে তাঁর আদুরে কলিজা! অরুণ গম্ভীর মুখে হাসি ফুটে ওঠে। ছেলেকে কোলে তুলে দরজা বন্ধ করে দেয়। গালে চুমু দিয়ে বলে,
-” আমার কলিজা ভয় পাচ্ছে! কোথায় তোমার আম্মু?”
ভোর ড্রয়িংরুমের সোফার দিকে ইশারা করে বাবার গলা জড়িয়ে ধরে। কিছু বলে না। অরুণ পা চালায়। ড্রয়িং রুমে পাতা একা নয়। ওই বাঁদর ইমনের মা উপস্থিত। ইমনের মা অরুণকে দেখে হেসে বলে,
-” ভালো আছো বাবা? তোমার দেখা পাওয়া তো আকাশের চাঁদ পাওয়ার মতো! সবসময় কাজ নিয়ে পড়ে থাকলে হবে? বউ বাচ্চার দিকেও একটু তাকিও!”

অরুণ মাথা কাত করে পাতার দিকে তাকিয়ে ঘরে চলে যায় পাশ কাটিয়ে। ইমনের মা কপাল কুঞ্চিত করে বলে,
-” পাতা তুমি কি মিষ্টি! আর তোমার জামাই দেখি করলার মতো! মুখে রসকষ কিছুই নেই। ভদ্রতার খাতিরে কিছু বলতে পারতো! সামাজিকতা জানে না দেখছি।”
পাতা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরে। লোকটা সত্যিই ম্যানারলেস! ম্যানারের ‘এম’ টাও জানেন না। নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! পাতা মিনমিনে গলায় বলে,
-” উনি কম কথা বলে! অপরিচিত লোক জনদের সাথে মিশতে পারে না। কি বলবে বুঝতে পারে না। আপনি কিছু মনে করবেন না প্লিজ!”
ইমনের মা হেসে বলে,

-” আরে না কিছু মনে করি নি। ছেলে মানুষ একটু আকটু ইগোস্টিক হয়। আমি উঠি হ্যাঁ ?তোমার জামাই এসেছে তার সাথে সময় স্পেন্ড করো!”
বিদায় নিয়ে চলে যান তিনি। পাতা ঘরে যায়! দেখতে পায় ফ্লোরে পড়ে আছে স্যুট বুট! পাতাবাহার সেগুলো টানছে। ভোর বিছানায় বসে। পাতা হতাশ ভঙ্গিতে ফ্লোর থেকে শার্ট স্যুট তুলে রাখে। অরুণ হুডি ট্রাওজার পড়ে ভোরকে ইশারা করে। ভোর বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে। পাতার কপাল কুঞ্চিত হয়। চলে গেল কেন? সে অরুণের দিকে প্রশ্নাতীত চাহনিতে চায়। অরুণ বিছানায় বসে পাতাকে কাছে ডাকে। পাতার সন্দেহ হয়। তবুও এগিয়ে যায়! অরুণ পাতা কপালে গলায় হাত রেখে তাপমাত্রা পরখ করে। স্বভাবিকই তো! দুহাত মুঠোয় ভরে শান্ত গলায় সুধায়,

-“পাতাবাহার কি হয়েছে? শরীর খারাপ?”
পাতা অবাক স্বরে বলে,
-” কই নাতো!”
অরুণ শান্ত চোখে পাতার দিকে তাকায়! কিছু সময় চুপ থেকে জিজ্ঞেস করে,
-” কি হয়েছে তোমার? কি লুকাচ্ছো আমার থেকে?”
পাতা যেন ঝটকা খায়! অরুণের হাত থেকে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নজর লুকিয়ে স্বাভাবিক সুরে বলে,
-” কি হবে? কি লুকাবো! সকাল থেকে কি আবোলতাবোল বকে যাচ্ছেন!”
-” ক্লিনিকে কেন গিয়েছিলে?”
পাতার ভয় হয়। তবে স্বাভাবিক ভাবে বলে,
-” আমার পেছনে স্পাই লাগিয়েছেন নাকি? সে বলে নি কেন গিয়েছিলাম?”
অরুণ হেসে বলে,

-” তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছিলাম!”
পাতা এবার ঘাবড়ে যায়!
-” এক কলেজ ফ্রেন্ডের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম ফিমেল ফ্রেন্ড। অনেক দিন হলো যোগাযোগ করছিল! ওই ক্লিনিকে ও রেগুলার বসে।”
অরুণের মুখের আদল নিমিষেই পরিবর্তন হয়! পাতা বুকটা ধুকপুক করে। লোকটা বিশ্বাস করেছে কি? আচ্ছা সত্যিটা বলেদিবে? নাহ্। রিপোর্ট এলে সিওর হয়ে একেবারে কাল বলবে। ঠান্ডা মাথায় গুছিয়ে বলবে। ইয়া আল্লাহ শুধু আজকের দিনটা ম্যানেজ করে দাও!

-” আজ জলদি এলেন যে? আমি খাবার গরম করি কেমন?”
বলেই পাতা বেরিয়ে যাবে কিন্তু অরুণের কথায় থেমে যায়!
-” পাতাবাহার মিথ্যে কথা আমি সহ্য করতে পারি না। তুমি আমার থেকে কথা লুকাচ্ছো! আমি সকালেও জিজ্ঞেস করেছি। হয়েছে টা কি! তুমি আমার কথা গুরুত্বই দিচ্ছ না!”
পাতা বিরক্ত হয়। সাথে রাগও হয় বেশ! এমনিতেই চাপের মাঝে আছে সে। টেনশনে মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম। মেজাজ হারিয়ে সে এক প্রকার চিল্লিয়ে বলে,
-” আমি একদিন গুরুত্ব দেই নি, আপনার ইগো তে লেগেছে। অথচ‌ আপনি কখনই আমার কথায় গুরুত্ব দেন না। আমি আপনার পার্সোনাল ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে আপনি চুপ করে যান। উত্তর দেয়া বা হু হা করার প্রয়োজনটুকু বোধ করেন না। আলগোছে ইগনোর করেন। আপনি বলেছিলেন না কি হয়েছে আমার? হ্যাঁ কিছু তো হয়েছে! পার্সোনাল ম্যাটার।সময় হলে আপনাকেও জানাবো। আপনার অতি মুল্যবান সময় অপচয় করার দরকার নেই!”
অরুণ চোয়াল শক্ত হয়। উঠে দাঁড়িয়ে শক্ত হাতের মুঠো পকেটে লুকিয়ে বলে,

-” ব্লাড সেম্পল কেন নিলো ডক্টর?”
পাতা এবার অবাক হয়। কে বলল লোকটাকে? তাকে প্রশ্ন করতে হয় না। অরুণ নিজ থেকেই বলে,
-” ভোর একটু আগে ফোন করে বলল!ছেলেটা ভয়ে আছে। ডাক্তার কেন তার আম্মুর রক্ত নিবে!”
দরজার কাছে শব্দ হয়। পাতা দরজার দিকে তাকাতেই ভোর দরজা বন্ধ করে দৌড়ে চলে যায় ড্রয়িং রুমে। হাত পা গুটিয়ে মলিন মুখে বসে থাকে চুপটি করে।
পাতা ভোরের প্রস্থান দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অরুণের দিকে সরাসরি তাকিয়ে বলে,
-” কাল জানাবো আমি! প্লিজ ফোর্স করবেন না জানার জন্য। বলবো আমি। একটু সময় দিন শুধু!”
অরুণ এগিয়ে আসে। পাতার গাল টিপে কপালে চুমু দিয়ে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। পাতা উদাস মনে আয়নায় নিজ প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজেই নিজেকে সুধায়,
-“পাতু তুই কি একটু বেশিই ভাবছিস না? লোকটা কিছুটা হলেও ভালোবাসে তোকে। যে আসবে সে লোকটারই অংশ।কেন ভুলে যাস!”

নিরবতা বিরাজ করছে পুরো ফ্ল্যাট জুড়ে। সর্বক্ষণ হইচই মাতিয়ে রাখা ভোর সরকারও আজ চুপচাপ। অরুণ ল্যাপটপ সমেত সোফায় বসে কাজ করছে সাথে ভোরকে ড্রয়িং করানো দেখিয়ে দিচ্ছে। পাতা চুপচাপ বসে। কারো সাথেই কথা বলছে না। না ভোর না অরুণ! কিছু সময় এভাবেই বসে থেকে পাতা উঠে রুমে চলে যায়। কাপড় চেঞ্জ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে। চোখের পাতায় ঘুম না নামলেও চোখ বুজে শুয়ে থাকে। একটু পরে অনুভব করে কেউ রুমে এসেছে। পাতা অল্প চোখ খুলে দেখে ভোর আসছে। একেবারে চুপি চুপি করে যেন চুরি করবে। ভোর বেড সাইডের নিকটবর্তী দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করে আম্মু ঘুমিয়েছে কি না। পাতার চোখ বন্ধ দেখে ভোরের চোখে মুখে আঁধার ঘনিয়ে আসে। আম্মু তাকে না নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে!

ভোরকে আদর না করেই! পাতাবাহার ভোরকে দেখে লেজ নাড়িয়ে উঠে আসে। ভোর বিছানায় উঠে জ্যাকেট মুজো খুলে ছুঁড়ে ফেলে বিড়ালটিকে কোলে বসিয়ে বিড়বিড় করে আম্মুর নামে নালিশ করে। পাতাবাহার মিও মিও করে ভোরের উষ্ণ পেটে মুখ ঘষে আরামে গা এলিয়ে দেয়। ভোর ভেংচি কেটে সোফার উদ্দেশ্যে ছুড়ে মারে। পাতার গায়ে থাকা কম্বল টেনে গায়ে জড়িয়ে কিনারা ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। উশখুশ করে এপাশ ফিরে তো আবার ওপাশ। আম্মু নিশ্চয়ই রেগে আছে তাঁর উপর! আম্মুর প্রমিজ ভেঙে সে আব্বুকে সব বলে দিয়েছে। কেন দেবে না? ওই আন্টি টা আম্মুর হাতে সুঁই ফুটিয়ে কতখানি রক্ত নিলো। তাঁর ভয় লেগেছিল তো। ডাক্তার আন্টি তাঁর আম্মুর রক্ত কেন নিবে? তাই তো আব্বুকে বলে দিয়েছে। ভোর এ পাশ ওপাশ করতে থাকে। পাতা মৃদু চোখ খুলে তার কান্ড কারখানা পর্যবেক্ষণ করেছে। ভোর কম্বলের ভিতরে ঢুকে চুপচাপ শুয়ে থাকে; আস্তে আস্তে গড়াগড়ি খেয়ে পাতার দিকে এগিয়ে যায়। চুপটি করে পাতার উপর হাত তুলে দেয়। একটু পর পা তুলে দিলো। সময় নিয়ে বুকে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে বলে,

-” ভোর লাভস ইয়ু সো মাচ আম্মু!”
পাতার অধরকোনে হাসি ফুটে ওঠে। ভোরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চুমু দেয় তবে কিছু বলে না। ভোরও কিছু বলে না। চুপটি করে মুখ লুকিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। পাতার চোখেও ঘুম নামতে শুরু করে। তবে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে ঘুম যেন হাওয়া হয়ে যায়। নিশ্চয়ই লোকটা এসেছে! পাতা স্বাভাবিক ভাবে চোখ বুজে ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে। খুবই কঠিনতম একটা কাজ এটি। পাতার চোখ পিটপিট করে। মনে হয় এই খুলে যাবে। পাতা কম্বলে আপাদমস্তক ঢেকে নেয় সুবিধার্থে। অরুণ সব লক্ষ্য করে। হুডি খুলে পাতার পাশে শোয়। কম্বল টেনে গলা পর্যন্ত ঢেকে দেয়। পেছন থেকে জাপ্টে ধরে। একহাত পাতার ঘার গলিয়ে পেঁচিয়ে নেয়। আরেক হাত কামিজ ভেদ করে যায়। বরফ শীতল হাতের স্পর্শে পাতার কাঁপন ধরে।এতো ঠান্ডা কেন হাত? অরুণ কানের কাছে অধর নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

পাতা বাহার পর্ব ৪৮

-” আমি জানি তুমি জেগে আছো!”
পাতা ধরা পরেও প্রতিত্তর করে না। সেভাবেই ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকে। অরুণ আবার বলে,
-” পাতাবাহার? বলবে না কি হয়েছে তোমার? হুম?”
পাতার বুকটা কেঁপে উঠলো আদুরে স্বরে। ইচ্ছে করলো লোকটাকে শক্ত করে জড়িয়ে সবটা বলে দিতে। কিন্তু নিজ ইচ্ছেকে প্রাধান্য না দিয়ে পাতা সেভাবেই ঘুমের ভান করে শুয়ে থাকে। একসময় ঘুমিয়েও যায়।

পাতা বাহার পর্ব ৪৯ (২)