পাতা বাহার পর্ব ৫৩

পাতা বাহার পর্ব ৫৩
বেলা শেখ 

বর্ষপুঞ্জিতে অক্টোবরের বিদায় লগ্নে নভেম্বর উঁকি ঝুঁকি দিচ্ছে। কখনো হালকা শীতের আমেজ তো কখনো গরমের আভাস। গ্রামীণ আধভাঙা রাস্তায় একটা গাড়ি চলছে ধীরগতিতে অতি সাবধানতা অবলম্বন করে। শীতল পবনের দোলা বদ্ধ জানালায় কড়া নাড়ছে অনবরত। ভোর, পাতা সেই জানালা খোলার জন্য অরুণের কাছে অনুনয় বিনয় করলেও কাজ হয় না। অরুণের এক উত্তর ঠান্ডা লেগেই আছে জ্বরকে নিমন্ত্রণ দেওয়ার মানেই হয় না। ভোর গাল ফুলিয়ে বসে থাকে। পাতা অরুণের দিকে কটমট করে চেয়ে ভোরকে এটা ওটা বলে সান্ত্বনা দেয়।

অল্পক্ষণের ব্যবধানে কালো রঙ্গের গাড়িটা একটা বাড়ির সামনে থেমে যায়! পাতা অতি আগ্রহের সাথে তড়িঘড়ি দরজা খুলে বের হয়।অরুণ চাপা স্বরে ধমক দেয় তাড়াহুড়ো করার জন্য। পাতা গাল ফুলিয়ে নাক মুখ কুঁচকে বাগানবিলাসে আচ্ছাদিত গেটের দিকে তাকিয়ে রয়। অরুণ ভোরকে সহ নিজেও নেমে পড়ে। ড্রাইভার লাগেজ বের করে। গাড়ির শব্দে গেট খুলে অনেকেই বেরিয়ে আসে। অরুণ ভোরকে সহ পাতার পাশে দাঁড়াতেই পাতা ফিসফিসিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” ম্যানারসকে যাঁতাকলে পিষ্ট করে গলাধঃকরণ করানোর পর উগড়ে দেওয়া ম্যানারলেস লোক! প্লিজ সবার সামনে আমার নাক কাটবেন না। লক্ষ্মীমন্তর ছেলের মতো সবাইকে সালাম দিবেন সাথে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করবেন!”
অরুণ আড়চোখে তাঁর দিকে চায়! পাতার সেদিক ধ্যান নেই। সে এগিয়ে গিয়ে সকলের সাথে কুশল বিনিময় করে। পারুলকে জড়িয়ে ধরে তাঁর পরিচিত ও প্রিয় মা মা ঘ্রাণটা শুষে নেয় জোঁকের ন্যায়। রক্তের সম্পর্কের মা না হোক, মা তো! যার মা মা গন্ধ শুঁকে ছোট্ট পাতা বড় হয়েছে। পারুল পাতার মাথায় হাত বুলিয়ে এটা ওটি জিজ্ঞেস করে। অরুণ সবার উদ্দেশ্যে সালাম জানায়। তাঁর পর পরই ভোর মিষ্টি করে সালাম দেয়। কাওছার তাকে অরুণের থেকে ছাড়িয়ে কোলে তুলে অরুণের সাথে কথায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। পারুল তাদের বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার তাগাদা দিলে পাতা পা বাড়ায়; অরুণ তার পিছু। হঠাৎ ঝড়ের গতিতে এসে কেউ পাতাকে জড়িয়ে ‘পাতুপু’ বলে চিল্লিয়ে আনন্দ প্রকাশ করে। পাতা পেছনে হেলে যায় খানিকটা। তবে তার পিঠ পেছনে অরুণ থাকায় কোনো সমস্যা হয় নি। নইলে ব্যালেন্স ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে যেতো। অরুণের স্বাভাবিক মুখাবয়ব গম্ভীর হয়। পাতার কাঁধে হাত রেখে বলে,

-” এভাবে কে ধরে? যদি কিছু হতো?”
প্রিয় ঘার ঘুরিয়ে অরুণের দিকে চায়। তবে পাতাকে ছাড়ে না। অরুণের গোমড়া মুখ খানি দেখে প্রিয় ভেংচি কেটে বলে,
-” আমার পাতুপুকে আমি যেভাবে খুশি ধরবো আপনার তাতে কি?”
মনে মনে ‘বেয়াদব’ সম্মধোন করে অরুণ! বয়সে তিনগুণ বড় লোকের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে? আর কি বললো? আমার পাতুপু! তাদের ছিলো হয়তোবা। কিন্তু এখন এই পাতা ইসলাম শুধু তাঁর পাতাবাহার। পাতা চোখ রাঙায় প্রিয়কে! পারুল বেগমও ধমক লাগায় একটা। মাঝ থেকে কাওছার বলে,

-” আরে দুলাভাই আমাদের! একটা টক ঝাল মিষ্টি টাইপ সম্পর্ক! তুমি এসবের মাঝে কথা বলো না তো চাচি!”
পারুল আড়চোখে অরুণের গোমড়া মুখখানি দেখে মাথার ঘোমটা আরেকটু টেনে বিড়বিড় করে প্রিয়কে বকতে বকতে চলে যায়। পাতা ভিতরে প্রবেশ করেই একে একে সকলের সাথে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অরুণ নামক মানবটাকে ভুলেই বসে। ভোরকে কাওছার হাঁটে নিয়ে যায়। অরুণ নিষেধ করলেও ভোর জেদ করেই যায়। পাতা জুবাইদা সহ আরো চেনা জানা আত্নীয় স্বজনের কথা বলছে। অরুণ তার পাশে দাঁড়িয়ে। বসার জন্য চেয়ার দিলেও সে পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে সিনা টান টান করে। নজর তাঁর কিশোরী প্রিয়’র কর্মকান্ডে। মেয়েটা শালে ঢাকা পাতার আট মাসের বাড়ন্ত পেটে আঁকি বুকি করছে। সেথায় কান পেতে এটা ওটা বলছে। অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করছে। ব্যাপারটা অরুণের মোটেও সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ধমকে বলতে,

”বেয়াদব মেয়ে ডোন্ট টাচ হার!এটা তোমার পাতা আপু নয়।এটা অরুণ সরকারের হৃদয়ের একাংশ; বুক পাঁজরের হাড়। তার কলিজার আম্মু; তার অনাগত মা’য়ের প্রসূতি”
অরুণ নিজ ছেলেমানুষী ভাবনায় বিরক্ত হয়। পাতার উপরেও বিরক্ত হয়। মেয়েটা এসেই রসের আলাপ জুড়ে দিয়েছে। বিরক্তিকর!
তন্মধ্যে আকলিমা বেগমের আগমন ঘটে। মুখ গহ্বরে পান চিবোতে চিবোতে এগিয়ে এসে অরুণের সম্মুখে পিক ফেলে বলে,
-” এই ছেমড়ি তোর জামাইয়ের দেহি গাইটে গাইটে অহংকার! সালাম কালাম দিতে জানে না!”
অরুণের গা গুলিয়ে আসে জর্দার উটকো গন্ধে। তাঁর উপর সম্মুখে ফেলা থুতু। সে নাক মুখ কুঁচকে সালাম দেয় সাথে ছোট্ট করে জিজ্ঞেস করে

-“কেমন আছেন?”
আকলিমা বেগম মুখ বাঁকিয়ে সালামের জবাব দিলো। ত্যাছড়া নজরে পাতার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” দাদি কইতে হের শরম লাগে নাকি?”
পাতা মুচকি হেসে অরুণের দিকে তাকালো। মুচকি হাসলেও তাঁর চোখ যে ভিন্ন কথা বলে। অরুণ পকেট থেকে টিস্যু বের করে নাক মুখ ঘষে আকলিমা বেগমের উদ্দেশ্যে বলে,
-“ভালো আছেন দাদি?”
আকলিমা বেগম লাল টকটকে রঙিন অধরে একগাল হেসে বলে,
-” খুব ভালো আছি! তোমার কি খব্বর? বছর না যাইতেই পেট বাঁধাই দিলা ছেমড়ির!”
অরুণের কান ভারি হয়। মুখাবয়ব শক্ত! ঘাড়ে হাত বুলিয়ে মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টায়।পাতা কপালে ভাঁজ ফেলে দাদির কথার জবাব দেয়,

-” এক পা কবরে, এখনো সোদবুদ্ধি হলো না দাদি? এখন নামায কালাম নিয়ে পড়ে থাকার কথা অথচ তোমার কুচুটে স্বভাব যাবার নয়! ভালো হয়ে যাও দাদি!”
আকলিমা বেগম ছোট বেলা থেকেই পাতাকে সহ্য করতে পারেন না। তিনি চাননি তাঁর নাতির বিয়েতে এই অপয়ার আগমন ঘটুক। কিন্তু তাঁর কথাকে কেউ গ্রাহ্যই করে নি। এসেছে পটের বিবি! তিনি পুনরায় পানের পিক ফেলে পাতার উদ্দেশ্যে খেঁকিয়ে ওঠে,

-” ওই ছেমড়ি মুহে দেহি খুব বুলি ফুটছে! ফুটবো না? বড়লোক জামাই পাইছোস। টাকার গরম দেহাস আমারে? ভুইলা যাইস না আমার বাড়ির দুয়ারে বড় হইছোস! আমার পোলার দয়ায় বাইচা ছিলি!”
-” তোমার পোলায় নিজ প্রয়োজনে হাতে পায়ে ধইরা আনছে দাদি! প্রয়োজন ফুরায় গেলে ধাক্কা দিয়ে বাইর কইরাও দিছে। ভাববে না সবসময় তোমার মিষ্টি মধুর কথা শুনে চুপ থাকবো; কখনো প্রতিত্তরে মিষ্টি ফিরিয়ে দিবো! ভোরের বাবা ঘরে চলুন?”
অরুণের বাহু ধরে একপ্রকার টেনে ঘরে নিয়ে যায়। উঠোনে বুড়িটা আহাজারি করতে ব্যস্ত। জুবাইদার মা ফাতেমা তাকে শান্ত করাতে ব্যস্ত হয়। ছেলের বিয়ে,বাড়ি ভর্তি মেহমান! সবাই কি ভাববে?

-” তুমি এসব কথা শুনে অভ্যস্ত হতে পারো আমি নই! এইজন্যই আসতে চাইছিলাম না পাতাবাহার। কিন্তু তোমার অহেতুক জেদ..! আমি ড্রাইভারকে কল করে গাড়ি ঘুরাতে বলছি ! উই আর লিভিং নাও!”
বলেই অরুণ ফোন বের করে।পাতা খপ করে ফোনটা কেড়ে নিয়ে বলে,
-” আরে ওই বুড়ির কথা কানে নিচ্ছেন কেন? আমি বলেছিলাম তো ও এমনি। আপনি যাস্ট ইগনোর করবেন তাকে।”
-” গিভ মি মায় ফোন?”

শক্ত গলায় বলে অরুণ! পাতা দেয়। সদ্য বের করা কাপড়চোপড় পুনরায় লাগেজে ভরতে থাকে থমথমে মুখে। চোখে নোনাজলের আবির্ভাব ঘটলো বলে। অরুণ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফোনটা পকেটে রেখে পরনের ব্লেজার খুলে বিছানায় ছুড়ে বলে,
-” ওকে ফাইন! যাচ্ছি না। তবে এই মধু মিশ্রিত বাক্য পুনরায় আমার কানে পৌঁছালে তোমার খবর আছে পাতাবাহার!”

পাতার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। অরুণের কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায় হাসি মুখে। অরুণ বিছানায় বসে ধপ করে। গম্ভীর মুখে পাতার মাথার স্কার্ফ খুলে দিল! পাতা চুপচাপ ভদ্র মেয়ের মতো দাঁড়িয়ে! লোকটার গোমড়া মুখ ভালো লাগে না তার। হাসি মুখে লোকটাকে কতটা আকর্ষণীয় লাগে! আচ্ছা সে যদি লোকটার গালে চুমু দেয় তাহলে কি লোকটার মেজাজটা ঠান্ডা হবে? ভাবনার সাথে সাথেই কাজ! পাতার নরম হৃষ্টপুষ্ট অধরজোড়া অরুণের ললাট ছুঁয়ে যায়। মুখভঙ্গি অপরিবর্তিত দেখে অধরজোড়া কপোল ছোঁয়। কাজ হলো বোধকরি! অরুণ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে পাতার কোমড় জড়িয়ে বাড়ন্ত পেটে কান পেতে রয়।

-” সাবধানে চলাফেরা করবে। আর প্রিয় মেয়েটার থেকে অতি সাবধানে। তখন পেছনে আমি না থাকলে কি হতো?”
-” আপনি থাকবেন না কেন? আপনার সবসময় থাকতে হবে। আর প্রিয়, ফরহাদ আমি বলতে অজ্ঞান। এতো দিন পর দেখা হওয়ায় পাগলামি করেছে।”
পাতা মুচকি হেসে বলে। অরুণ সোজা হয়ে পাতার গায়ের শালটা ভালোভাবে জড়িয়ে বলে,
-” হুম! কিশোরী বয়সে এরকম চঞ্চলতা স্বাভাবিক। বাট আমার পঁচিশ বছর বয়সী রমনীর কিশোরীর মতো আচরণ খানিকটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে!”
-” কিশোরী বয়সে প্রাপ্তবয়স্ক সুলভ আচরণ করতে বাধ্য হয়েছি এখন বয়স্ক কালে কিশোরী সুলভ আচরণ করায় আপনার সব দন্ডাদেশ শিরধার্য মহামান্য!”
স্বাভাবিক সুর পাতার। অরুণ শান্ত নয়নে চেয়ে তার বধুয়ার পানে। বাইরে থেকে প্রিয় উঁচু গলায় ‘পাতুপু’ বলে ডাক দেয়। অরুণের চোখে মুখে ফুটে ওঠে বিরক্তের রেশ!

কাল বিয়ে আজ গায়ে হলুদ। বাড়ি মেয়ে বউ’রা পাটায় কাঁচা হলুদ বাটছে। একটু পরেই কাওছারকে হলুদ স্নান করানো হবে। তাই এতো তোড়জোড়। অরুণ ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। হালকা আকাশি রঙের শার্ট ও কালো জিন্স পরনে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। ঘরে নেটওয়ার্কের সমস্যা হওয়ায় ফোন কানে উঠোনের এককোণে দাঁড়ালো। পুরো উঠোনে চোখ বুলিয়ে পাতাকে খোঁজে! আশ্চর্য মেয়েটা কই গেলো? ভোরকেও দেখা যাচ্ছে না। অরুণ খেয়াল করে উঠোনে উপস্থিত সকলের মাঝে চাপা গুঞ্জন! উপস্থিত জনরার মাঝে এক মধ্যবয়সী মহিলা বলে,
“এই পাতার জামাই? চাচি যে বললো বুড়ো? বেশ দেখতে! তবে চুল গুলো পাকতে শুরু করে্ছে!”
অরুণ গেইট পেরিয়ে বাইরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হয় কিন্তু জুবাইদার ‘দুলাভাই’ ডাকে তা সম্ভবপর হয় না। সে ফোনটা কেটে পকেটে পুরে এগিয়ে যায়!

জুবাইদা পাটাতনে হলুন পিষ্ট করতে করতে তাঁর আশেপাশে উপস্থিত সকল মহিলাদের উদ্দেশ্যে বলে,
-” এই পাতার হাসবেন্ড। অরুণ সরকার। তোমাদের গ্রামের আরেক জামাই!”
অরুণ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়েই সালাম দেয়। সবাই টুকটাক প্রশ্ন করে। অরুণ তোপের মুখে জবাব দেয়। এরকম পরিস্থিতিতে সে প্রথমবার পড়লো। হঠাৎ এক আঁটসাঁট গোছের মহিলা তীক্ষ্ণ গলায় বলে,
-” আমি তোমার চাচি শাশুড়ি লাগি। ওই মিষ্টি করে ছেলেটা তোমার? বেশ আদুরে দেখতে। ওর আপন মা বেঁচে আছে?”

অরুণ মহিলাটির দিকে তাকালো। ঘোমটা দিয়ে অর্ধেক মুখ ঢেকে রেখেছে। তবে সে ঠাহর করতে পারলো মহিলাটা তার চেয়ে ঢের ছোট তবুও কি অবলিলায় তুমি সম্বোধন করলো। সে তাঁর কথায় জবাব দিবে এর আগেই জুবাইদা বলে ওঠে,
-” দিব্বি বেঁচে আছে চাচি! তালাক হলেই সে নতুন সংসার পেতেছে!”
-” তালাক কেন দিলা?”
অরুণের উদ্দেশ্যে বলে এক বৃদ্ধা। অরুণের মুখশ্রীর আদল পরিবর্তন হয় নিমিত্তে ছোট্ট করে জবাব দেয়,
-” বনিবনা হয় নি।”
আরেক বৃদ্ধা ফোড়ন কেটে বলে,
-” তাই দেইখা তালাক দিবা? বাচ্চাডার কথা ভাইব্বা না? সৎ মা যতই ভালো হউক আপন মায়ের মতো হয় না। যদিও আমাদের পাতা ভালো মাইয়া। সে তোমার পোলারে ভালো বাসবো। তবুও আপন মায়ের খোরাক মিটানো কম কথা না।”

অরুণ আর একটা কথাও বলে না। কলের বাহানায় উঠে পড়ে। উঠে পড়েও রেহায় পায় না।‌ কাওছার ও তার বন্ধুরা অরুণকে একপ্রকার টেনে নিয়ে যায় বাড়ির বাহির উঠোনে। যেখানে কাওছারকে হলুদ স্নান করানো হবে। একটু পরেই শুরু হয় হলুদ লাগানো। অরুণ ভোরের হাতটা ধরে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। ভোর এটা ওটা জিজ্ঞেস করে অরুণ জবাব দেয় না। পাতা মহিলাদের ভিড়ের মধ্যে থেকে অরুণের নাখোশ মুখাবয়ব দেখতে পায়।
প্রিয়, কাওছারকে হলুদ মাখিয়ে হাতের মুঠোয় হলুদ বাটা নিয়ে সরে আসে। অরুণের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় আচানাক লাফ দিয়ে অরুণের পুরো মুখে হলুদ মাখিয়ে দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে বলল,

-” দুলাভাই হলুদ লাগিয়ে দিলাম এখন একটু হাসুন! সবসময় হুতুম পেঁচার মতো মুখ বানিয়ে রাখেন ক্যান?”
অরুণের চোখে মুখে অবাকতা। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পাতার দিকে চায়! পাতা কাঁচুমাচু মুখে ইশারায় কান ধরে স্যরি বলে; শান্ত থাকতে বলে। অরুণ কিছু বলে না আর। ভোরকে নিয়ে সরে আসতে নিবে জুবাইদার হাসবেন্ড সহ সবাই অরুণকে একপ্রকার পাকড়াও করে হলুদে গোসল করিয়ে দেয়! ভোর খিলখিলিয়ে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম।অরুণ শীতল চোখে ছেলের প্রাণখোলা হাসি চেয়ে চেয়ে দেখে। কাওছার চিল্লিয়ে বলে,
-” দুলাভাই আজ হলুদ দিলাম কাল বিয়ে বাড়িতে কোনো অপ্সরার দেখা মিললে নিকাহনামা পড়িয়ে দিবো। রাগ করিয়েন না হ্যাঁ?”

অরুণ তাঁর দিকে চায়! এবার অধরকোণে ক্ষীণকায় হাসির গল্প। পানি ভর্তি কলস হাতে তুলে কাওছারের বন্ধু,জুবাইদার হাসবেন্ডকে ভিজিয়ে দিয়ে কাওছারের উদ্দেশ্যে বলে,
-” অপ্সরীর দেখা না মিললে তোমার অপ্সরার সাথে তো নিকাহনামা পড়ার অনুমতি দিবে না! তাই তুমি চুপ থাকো বালক।”
কাওছারের মুখখানি চুপসে গেল। বাকি সবাই হেসে ওঠে। খুনসুটির মাঝে হলুদ পর্ব শেষ হলে পাতা অরুণ ও ভোরকে নিয়ে পুকুর ঘাটে আসে। উদ্দেশ্য গোসল করা। বিকেল হওয়ায় পুকুর পাড়ে খুব একটা ভিড় নেই। কাওছারের বন্ধুরা নেমে সাঁতার কাটছে। ভোর পুকুর দেখে নাক ছিঁটকিয়ে বলে,
-” ইয়ু! কি নোংরা পানি! আব্বু তুমি এখানে গোসল করবে না। ওই আংকেলরা নিশ্চয়ই পানিতে হিসু করেছে! ছিঃ!”
মুখ বিকৃত করে বলে ভোর। অরুণের বোচা নাক পুকুর দেখেই উঁচুতে উঠেছে। তবে সবাইকে সাচ্ছন্দ্যে গোসল করতে দেখায় একটু দমে যায়। কিন্তু এখন ছেলের কথায় অরুণ গমগমে গলায় বলে,

-” আমি পুকুরে গোসল করবো না পাতাবাহার!”
পাতা শানিত নজরে চায়।
-” আশ্চর্য লোক তো আপনি! কি প্রবলেম পুকুরে? সবাইতো গোসল করছে? কি সুন্দর টলমলে একদম ফ্রেশ!”
” সেটাইতো প্রবলেম! না জানি কত লোকের ইউরিন মিশ্রিত এই টলমলে ফ্রেশ পানি!”
বিড়বিড় করে বলে অরুণ। পাতার কানে যায়।‌সে মুখ মুচড়িয়ে বলে,
-” ওহ্ হো! এটাতে লোকের ইউরিন মিশে আছে আর আপনাদের তথাকথিত সুইমিং পুলে লোকেরা … থাক কিছু বললাম না!”

ভোর বাবার হয়ে বুক ফুলিয়ে বলে,
-” আব্বু সুইমিং পুলেও গোসল করে না। শুধু বাথটাবে গোসল করে। আমার আব্বু এখানে গোসল করবে না। এতক্ষণে আঙ্কেল গুলো নিশ্চয়ই তিন চারবার হিসু করে দিয়েছে! ইয়াক কি গন্ধ।”
এক হাতে নাক ধরে অপরহাতে অরুণের বাহু ধরে টানাটানি করে ভোর! পাতা চরম মাত্রায় হতাশ!
-” দেখুন বাড়ির দুটো গোসলখানায় লম্বা সিরিয়াল..”
-” তুমি আছো তো। সিরিয়াল ভেঙ্গে আমার ব্যবস্থা করে দাও!”
অরুণের কথায় খানিকটা অনুনয়ের সুর! পাতা কি আর মানা করতে পারে নাকি?

বিয়ে বাড়ি মেহমানে ভরপুর। ঘুমোনোর জায়গা সংকুলান হবে অতি স্বাভাবিক! প্রতি ঘরের মেঝেতে আলাদাভাবে বিছানা পাতা হয়েছে। মেহমানদের বিছানায় আর বাড়ির লোক মেঝেতে ঘুমোনোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এসবের মাঝে বাড়ির জামাইদের জন্য আলাদা আলাদা ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এ কথা জানার পরেই অরুণ স্বস্তির শ্বাস টেনেছে। এমনিতেই অচেনা ঘর তার কাছে জেলখানা স্বরূপ তাঁর উপর অচেনা লোকের সাথে বেড শেয়ার রিমান্ডে নেয়ার মতোই! তবে বিপত্তি একটা বেঁধেই যায়। আর বিপত্তিটা হলো প্রিয়। সে জেদ ধরে পাতার কাছে ঘুমোবে। অরুণ তাকে কিছুই বলে নি। শুধু ভোরকে চুপিসারে বলেছে পাতাবাহার প্রিয়কে অনেক ভালোবাসে আদর করে। ব্যস ভোর যেতে দেবে না পাতাকে। প্রিয়ও আরেক নাছোড়বান্দা সে পাতাকে নিয়ে যাবেই। নইলে এখানেই থাকবে তার পাতুপুর সাথে। অরুণের মেজাজ বিগড়ে যায়। আশ্চর্য তার কলিজাটাও এতো নাছোড়বান্দা নয়। পাতা ভোরকে কি বোঝালো কে জানে ভোর পাতাকে যেতে দিলো। নাহ্ মেজাজটা ধরে রাখতে পারলো না অরুণ! পাতা বেরিয়ে যেতেই ধরাম করে দরজা বন্ধ করে ভোরের দিকে তাকায়। ভোর এগিয়ে এসে অরুণের কোলে ওঠে। গলা জড়িয়ে গালে টপাটপ চুমু দিয়ে বলে,

-” আম্মু ওই আন্টিকে ও রেখে এখনি চলে আসবে!”
সত্যি সত্যিই কেউ দরজায় টোকা দেয়‌। অরুণ সন্দেহ মনে দরজা খুলতেই পাতার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা দেখা যায়। ফোলা ফোলা মুখে মিষ্টি হাসিটা বেশ লাগে অরুণের। তার বিগড়ে যাওয়া মেজাজ ঠিক হয়ে যায় নিমিত্তে। পাতা ভিতরে প্রবেশ করে না উঁকি ঝুঁকি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
-” এই নাক উঁচু ম্যানারলেস লোক! সাথে তাঁর মিনি প্যাকেট? রাতের জোৎস্না ঢালা চাঁদের আলোয় স্নান করবেন? আধভাঙা মাটির রাস্তায় পায়ে পায়ে হাঁটবেন?”
অরুণ ভ্রু কুঁচকে ছোট ছোট চোখে চায়! ভোর হাসিমুখে তার জবাব শোনায়,
-” আম্মু আমি হাঁটবো! তবে চাঁদের আলোয় কিভাবে গোসল করে?”
পাতার মুখের হাসি ছড়িয়ে পড়ে। ভেতরে প্রবেশ করে লাগেজ থেকে বড় শাল বের করে অরুণের দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” এই যে বীর বাহাদুর আপনাকে তো শীত ছুঁতে পারে না! তবুও গায়ে জড়িয়ে নিন! আর চুপিসারে আমার সাথে চলুন নইলে সবাই পিছু নিবে!”

অরুণ ভোরকে সহ শালে জড়িয়ে পাতার বাহু চেপে হাঁটা দেয়। দরজা ভিজিয়ে তাঁরা বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে মাটির রাস্তায় হাঁটতে শুরু করে। ভোর বাবার কোল থেকে নেমে আগে আগে হাঁটছে। অরুণের এক বাহু জড়িয়ে পাতা আস্তে আস্তে হাঁটছে। রোমাঞ্চকর একটি মুহূর্ত। হালকা কুয়াশা ধুয়োর মতো কুন্ডলী পাকিয়ে আচ্ছাদিত করে রেখেছে চারিপাশ। কুয়াশায় ঢাকা এক ফালি শশধর; শশধরের ম্লান আলোয় অন্ধকারে সব আবছা আবছা দেখা যাচ্ছে । দু ধারে ধান ক্ষেত! পাকা সোনালী ধানে কুয়াশা পড়ে বিবর্ণ রূপ ধারণ করছে। উপর থেকে টপটপ করে একটু পর পর কুয়াশা পড়ছে। ভোর সামনে হাঁটলেও একটু পর পর পেছনে ফিরে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে। বড় ধূসর রঙের শালটা অরুণ ভাঁজ করে ভোরকে মুড়িয়ে দিয়েছে যেন ঠান্ডা না লাগে। শালে আবৃত ভোরকে ভুতের ছানা লাগছে! একদম কিউট ভুতের ছানা! ভোর প্রতিবারের মতো পিছন ফিরে বলে,

-” আচ্ছা আম্মু ভুতেরা কেন রাতের বেলা বের হয়? ওরা কি দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে?”
-” রাতের বেলা তো অন্ধকার থাকে। অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে ভূত প্রেত মানুষকে ভয় দেখায়। দিনে শুধু ভর দুপুরে আর সন্ধায় একটু নির্জন জায়গায় উঁকি ঝুঁকি দেয়। সাবধান!”
ভোরের গা ছমছম করে। সে হাঁটার গতি কমিয়ে বাবার সামনে হাঁটে। ভয়ঙ্কর ভুত গুলো যদি তাঁর মতো সুন্দর আদুরে বাচ্চাকে কিডন্যাপ করে? প্রিয় আন্টি বলেছে ভুত ভোরের মতো মিষ্টি বাচ্চাদের ধরে নিয়ে বিয়ে করে। পাতা তাঁর কান্ডে মুচকি হাসলো। অরুণ ছেলেকে টেনে কোলে উঠিয়ে বলে,

-” আব্বু ভুত বলতে কিছু হয় না। এটা মানুষের ভ্রম! মানুষের ভেতরের দূর্বলতা। তবে হ্যাঁ জিনের অস্তিত্ব আছে। তন্মধ্যে কিছু ভালো কিছু খারাপ। ভালো জিন আল্লাহর ইবাদতে ব্যস্ত। খারাপ জিন অনেক মানুষকে ডিস্টার্ব করে!”
ভোরের ভয় কমে তো নাই আরো বেড়ে যায়। সে বাবার কাঁধে মুখ লুকিয়ে বিড়বিড় করে দোয়া ইউনুস পাঠ করে। হুজুর শিখিয়েছে তাকে। অরুণ মুচকি হেসে ছেলেকে শক্ত করে জড়িয়ে চুমু খায়। পাতার উদ্দেশ্যে বলে,
-” তোমার ওই বাঁদর কাজিন প্রিয় ছেলেটাকে ভুতের গল্প শুনিয়ে ভয় দেখিয়েছে! আস্ত ইঁচড়ে পাকা মেয়ে!”
পাতা অরুণের বাহুতে আলতো করে চিমটি কেটে বলে,

-” প্রিয়’র নামে আজেবাজে কথা না। ও খুবই মিষ্টি মেয়ে। ওকে ওসব ভুতের গল্প আমি শুনিয়েছিলাম। সেই ছোট বেলায়! ও, ফরহাদ যখন গল্প শোনার জন্য বায়না করতো তখন ভুতের গল্প বলতাম যেন একটা শেষ হলে আরেকটা শোনার বায়না না ধরে!”
-” বাহ্ ভুতকে যমের ন্যায় ভয় পাওয়া মহিলা ভুতের গল্প শোনাতো? আশ্চর্যের বিষয়!”
বলেই হালকা শব্দে হাসে অরুণ! পাতা হামি তুলে বলে,
-” অসভ্য বর্বর ম্যানারলেস লোক! ভুত নেই এই কথা আমি দিনের বেলা বিশ্বাস করলেও রাতের বেলা মনেপ্রাণে অবিশ্বাস করি যে!”

ভোর বাবার কাঁধ থেকে মুখ তুলে পাতার দিকে তাকিয়ে থাকে। অরুণ শব্দ করে হেসে দেয়। নিস্তব্ধ অন্তঃসারশূন্য পরিবেশে তার ভারী শব্দের হাসি যেন প্রতিধ্বনিত হয়। পাতা হা করে চেয়ে তার হাসি গিলে। অরুণ খেয়াল করে পাতার মাথায় টোকা দিয়ে হাঁটতে বলে। আরেকটু পথ হাঁটার পর তারা ফিরতি পথ ধরে। পাতা মাঝপথে হঠাৎ বলে,
-” এই ভোরের বাবা একটা গান শোনান তো? এই নিরিবিলি পরিবেশে একটা শ্রুতিমধুর গান সুখ কলসের কানায় কানায় পূর্ণ করবে।”

-” আম্মু জানো? আব্বু খুব সুন্দর করে গান গাইতে জানে একদম অরিজিৎ সিংয়ের মতো!”
উৎফুল্লের সাথে বলে ওঠে ভোর! পাতা অবাক স্বরে বলে,
-” তাই নাকি? তাহলে তো শুনতেই হয়! আর ভোর? তুমি অরিজিৎ সিংকে চেনো?”
ভোর উপর নিচ মাথা নেড়ে সায় জানালো।
-” চিনি তো! আব্বু, ফুপ্পি সবাই তাঁর গান শোনে! ফুপ্পি তো ওনার ইয়া বড় ফ্যান!”
-” তাই?”
-” হুম! আব্বু বলো না একটা গান?”

অরুণ সরাসরি নাকচ করে। ভোর নাছোড়বান্দা! বাবাকে গাইতেই হবে। পাতাও জোড় করে। অরুণ একপ্রকার বাধ্য হয়ে রাজি হয়! গলা খাঁকারি দিয়ে গুনগুন করে গেয়ে ওঠে
~বড় ইচ্ছে করছে ডাকতে তাঁর গন্ধে মেঘ ঢাকতে কেন সন্ধ্যে সন্ধ্যে নামলে সে পালায়!
এইটুকুই গাওয়ার সুযোগ পায় সে। আর গাইতে পারে না। পাতা মুখে হাত রেখে হাসছে অল্প শব্দে। সে হাসি আটকানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারে নি। এতোটা বাজে গায় লোকটা! ভোর বিরক্ত হয়ে বলে,
-” উফ্ আম্মু হাসছো কেন? কত সুন্দর হচ্ছিলো! আব্বু গাও না?”
অরুণের বুঝতে বাকি থাকে না গানের চক্করে তাঁর মানসম্মান মাটির রাস্তায় হামাগুড়ি দিচ্ছে। পাতা হাসি থামিয়ে বলে,

-” হ্যাঁ হ্যাঁ ভোরের বাবা গা’নতো? অনেক সুন্দর হচ্ছে। অরিজিৎ সিং শুনলে গর্বে তার পেট থুরি বুক ফুলে উঠতো!”
ছোট ভোর বুঝতে পারে যে তাঁর আব্বুর লেগপুল করা হচ্ছে! তাঁর মোটেও ভালো লাগে না। নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে,
-” তুমি আব্বুকে ইনসাল্ট কেন করছো? আব্বু অনেক সুন্দর গায় । এখন তোমার ভালো না লাগলে তোমার সমস্যা! আব্বু সুন্দর গাইতে পারে।”
পাতা অরুণের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলে,
-” আচ্ছা আচ্ছা আমার কানে সমস্যা আছে হয়তোবা। তোমার বাবা খুব সুন্দর গায়। তাঁর মতো কেউ গাইতেই পারে না। স্বয়ং কাক মহাশয়ও নয়!”
ভোর রাগি রাগি চোখে চায় পাতার দিকে। আবছা অন্ধকারে তার রাগি মুখ দেখে পাতা কান ধরে স্যরি বলে। অরুণ ছেলের গালে ঠোঁট ডুবিয়ে চুমু দিয়ে ডাকে,

-” আমার কলিজা!”
পাতা সুর তুলে অরুণের বেসুরে গাওয়া গানটা গুনগুনিয়ে গায়। সুরেলা শোনালেও ভোর মুখ বিকৃত করে বলে,
-” অনেক পঁচা হয়েছে। ভুতের গল্পের মতো ভয়ঙ্কর আম্মু!”

পরদিন বাড়ির অধিকাংশ পুরুষই কাওছারের সাথে বরযাত্রী হিসেবে রওয়ানা হয়। হাতে গোনা কয়েকজন মেয়ে তন্মধ্যে বাচ্চা মেয়েরাই বেশি। বরযাত্রী যাওয়ার পর জুবাইদা সহ কাওছারের কাজিনরা মিলে বাসরঘর সাজানোর জন্য লেগে পড়ে। কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হবে তাই মালা গাঁথে।‌পাতা তাদের সাহায্য করতে নিজেও সুই সুতা হাতে বসে পড়ে জুবাইদার পাশে। টুকটাক কথা বলে আনাড়ি হাতে মালা গাঁথে। জুবাইদা পাতাকে আপাদমস্তক দেখে। পাতা আসার পর থেকেই তাঁর নজর কাড়তে সক্ষম হয়। আগের সেই জীর্ণশীর্ণ শরীর নেই। স্বাস্থ্যবতী হয়েছে। বাচ্চা পেটে আসার কারণেই বোধকরি সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে। পাতা এমনিতেই সুন্দর আর মাতৃত্বের স্বাদ পেয়ে সেই সৌন্দর্য কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। তাছাড়া বেশভূষায় আভিজাত্যের ছোঁয়া। যেই মেয়েটা তাঁর পুরনো জামাকাপড়ে অভ্যস্ত ছিলো সেই মেয়েটি তাঁর চেয়েও দামি পোশাক গায়ে জড়িয়ে!! হাতে, কানে, নাকে স্বর্ণের ছোঁয়া! তার ভিতরে ঈর্ষা নামক বীজ বপন হয়। সে পাতার দিকে তাকিয়ে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলে,

-” দুলাভাই তোকে খুব ভালোবাসে তাই না? অনেক যত্নে রাখে নিশ্চয়ই?”
পাতা জুবাইদার দিকে চায়। মুখায়ব লাজে রাঙা হয়ে আসে। মুচকি হেসে মাথা নাড়ল। জুবাইদার মনে মনে ভেঙায়! বুইড়া ব্যাটা কচি বউ পেয়েছে আদরে রাখবে না? সে মুখে হাসি ঝুলিয়ে বলে,
-” রাখবে না? আমাদের পাতা এতো সুন্দর। বাচ্চাটা কোন ঝামেলা করে? মানে তোর পিঠপিছে বাপের কানঠাসা করে? রাতে তোদের মাঝখানে থাকার জন্য জেদ করে?”
পাতা স্বাভাবিক নেয় কথাগুলো।তাই স্বাভাবিকভাবেই জবাব দেয়,
-” না রে! ভোরের মতো আদুরে বাচ্চা খুব কম। মনটা একদম কাঁচের ন্যায় সচ্ছ। খুব ভালোবাসে আমাকে।”
-” তোর কাছে সব বাচ্চারাই তো সচ্ছ। বিচ্ছুমন্ত বাচ্চাও তোর কাছে ভদ্র!”

জুবাইদা মুখ বাঁকিয়ে বলে।পাতা প্রতিত্তরে মুচকি হাসলো। জুবাইদা হঠাৎ পাতার গালে হাত রেখে বিষন্ন গলায় বলে,
-“তোর আমার খুব একটা না জমলেও আমি তোকে বোনের মতোই ভাবি। বিয়ের আগে যেন তেন ছিলি। বিয়ের পরেও একই! তুই আমার কথায় কিছু মনে করিস না। বাট এটাই বাস্তবতা।তোর ভাগ্যটাই অপ্রসন্ন ।তোর কপালে সর্বদা ব্যবহৃত জিনিসপত্র জোটে! ছোট বেলায় আমার পুরনো জামা, জুতো! ওবাড়ি লতাপুর ব্যবহৃত জিনিসপত্র। এখন তোর ভবিষ্যত! তোর হাসবেন্ড টাও অন্যকারো ছিলো! ভাব পাতা সে অন্য একজনকে প্রাণপণে ভালোবাসতো। তাদের ভালোবাসার নিশান ভোর। যদিও তাঁরা এখন ভিন্ন পথে। কিন্তু তাদের পথ এক ছিলো। শুনেছি প্রথম ভালোবাসা কখনো ভোলার নয়। দুলাভাইয়ের হৃদয়ের এককোনায় হয়তো এখনো তাঁর প্রথম ভালোবাসা লুকিয়ে আছে। তোকে ভালোবাসে ,আদর যত্ন করে ঠিক আছে। ভেবে দেখেছিস কেন করে? তার স্বার্থেই। তুই ভোরকে ভালোবাসিস তাই সে তোকে আদর যত্ন করে। ভালোও বাসে হয়তো। শোন সে এরকম, এরচেয়েও বেশিই হয়তোবা অন্য কাউকে ভালো বেসেছে। তোকে যেটুকু যত্ন করে তার চেয়েও বেশি যত্ন পূর্বে কারো জন্য করেছে। তোর কাছে সে একমাত্র অপশন হলেও তুই তাঁর সেকেন্ড অপশন। তুই যে দুলাভাইকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসিস তা তোর চোখে মুখে স্পষ্ট। কিন্তু দুলাভাই তোকে কতটুকু বাসে? নিশ্চয়ই তাঁর কাছে ছেলে আগে! পাতা তোর জন্য আমার কষ্ট হয়! তুই…”

জুবাইদাকে থামিয়ে দেয় পাতা। জুবাইদা ছোট থেকেই তাকে খুব একটা ভালো চোখে দেখতো না। বলা চলে সহ্যই করতে পারে না।‌হঠাৎ এতো দরদ কেন? পাতা ঢের বুঝতে পারে।সে জুবাইদার কথা গুলোতে প্রভাবিত হতে চায় না। কিন্তু কথা গুলো মনের কোথাও একটু আঁচড় কাটতে সক্ষম হয়। পাতা বুঝতে দেয় না জুবাইদাকে। নইলে মেয়েটা সেই আঁচড় ঘায়ে পরিণত করবে। গাল থেকে জুবাইদার হাত ঝটকায় সরিয়ে কাঠ কাঠ গলায় বলে,
-” আমার জন্য তোর এতো দরদ হজম হচ্ছে না জুবা। শোন তোর দুলাভাই মানুষটা একদম খাঁটি নয় কিন্তু ভেজাল যুক্তও নয় তোর জামাইয়ের মতো! তাঁর পাস্ট ছিলো আই এক্সেপ্ট। তাঁর ভবিষ্যত আমি, ভোর আর এই অনাগত সন্তান। অতিত ভেবে কষ্ট কেন পাবো? আর হ্যাঁ ভোর আমার ছেলে। তোর দুলাভাইকে আপন করার আগে ভোরকে আপন করে নিয়েছি। আমার প্রতি এতো কনসার্ন না দেখিয়ে নিজ পতি বাচ্চার প্রতি একটু কনসার্ন হতে পারিস। তাহলে দু দিন পর পর বাপের বাড়ি খুঁটি গেড়ে থাকতে হবে না।”

পাতা সুই সুতা রেখে উঠে চলে যায়। শুনতে পায় জুবাইদার ক্ষোভ ঢালা বাক্য,
-” অন্যের বাড়ি আশ্রিতার মতো থেকেছিস তাই তোর কাছে জামাইয়ের পাস্ট মেটার নাও করতে পারে পাতা! তোর মতো আগাছার..”

আর শুনতে পায় না পাতা। জুবায়দার ছুঁড়ির ধারের ন্যায় কথাগুলো পাতার বুকে লেগেছে। যতই কঠোরতা দেখাক, জবাব দিক, আবেগী পাতার মনটায় আঁচড় ঘা’য়ে পরিণত হয়। বন্ধ ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে পাতা। তার কিছু ভালো লাগছে না। সব অসহ্য লাগে। এখানে আসা উচিত হয় নি তাঁর। সে বেশ ছিলো তাঁর সংসারে। এই জুবাইদার কটু কথা পাতার মস্তিষ্কের ভিতর কিলবিল করতে থাকে। সে অরুণ সরকারকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তাঁর জীবনে প্রথম পুরুষ অরুণ সরকার অথচ সে লোকটার জীবনে দ্বিতীয় নারী। প্রথম নারী তাঁর প্রাক্তন স্ত্রী! যাকে লোকটা পাগলের মতো ভালোবাসতো! আচ্ছা এখনো কি ভালোবাসে? জুবায়দা যে বললো প্রথম ভালোবাসা ভোলার নয়! কথাটা সত্যি? সেও শুনেছিলো কোথাও।

আচ্ছা লোকটা কি পাতাকে ভালোবাসে? বাসলেও তা কি নিজ স্বার্থে? সে ভোরকে আপন করে নিয়েছে, তাই লোকটাও কি তাকে আপন করে নিয়েছে? পাতা বালিশে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে দেয়। সেই ক্ষীণ শব্দ ঘরের বাইরে যায় না, না কারো কর্ণ গহ্বরে বাড়ি খায়। পাতা উঠে বসে বালিশ ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দেয়। নিজ বৃদ্ধাঙ্গুলির গোড়ায় শক্ত করে কামড় বসায় নিজ রাগ নিবারণের চেষ্টায়। ব্যর্থ পাতার রাগ কমে না, বেড়ে যায়। নিচে নেমে বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুড়ে ফ্লোরে বসে কাঁদতে থাকে।

পাতা বাহার পর্ব ৫২(২)

বিছানার নিচ থেকে লাগেজ বের করে অরুণ সরকারের টি শার্ট, জিন্স ছুঁড়ে ফেলে। পাগল পাগল লাগছে। তাঁর সঙ্গে কেন এমন হয়? সে কেন অরুণ সরকারের জীবনে প্রথম নারী হলো না! কেন বর্ষা নামক মহিলার আগে লোকটার জীবনে তাঁর আগমন হলো না! কেন ভোর তাঁর গর্ভে এলো না! পাতা নিজ বাড়ন্ত পেটে হাত রেখে ফোঁপায়। তাঁর সুখ কেন কারো সহ্য হয়না!

পাতা বাহার পর্ব ৫৩ (২)