পাতা বাহার পর্ব ৫৬

পাতা বাহার পর্ব ৫৬
বেলা শেখ 

সূর্য মহাশয় পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ঘড়িতে বেলা তিনটা। অরুণ ছেলেকে নিয়ে বাড়ির পথে। বাড়িতে অতিথি আসছে তাই টুকটাক দই মিষ্টি কিনতে একটু দেড়িই হলো! ভোর প্রশ্ন করে করে অরুণের কানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। তাঁরা কি নানুর বাড়িতে যাবে? নাকি না? অরুণ জবাবে না বলেছে। ভোর বিশ্বাস করে না। আম্মু তো বলেছে যাবে! তাহলে কারটা বিশ্বাস করবে?

বাবা ছেলে লিফট করে তাদের ফ্লোরে নেমে ডান দিকে অগ্রসর হয়। পেছনে রঞ্জু যার হাতে দই মিষ্টি সাথে টুকটাক আরো কিছু সরঞ্জাম। অরুণ কলিং বেল বাজিয়ে অপেক্ষা করে কেউ খোলে না। অরুণের কপালে ভাঁজ পড়ে। সে তো এক্সট্রা চাবিও রাখে নি আজ। আর বাড়ি ভর্তি মানুষ অথচ কেউ শুনছে না? অরুণ একনাগাড়ে বাজাতে থাকে কলিং বেল। তবুও রেসপন্স না পেলে অরুণ ফোন বের করে কল করার জন্য। পাতার নম্বর বন্ধ বলে। অরুণের কপাল বেয়ে শ্বেদজল গড়িয়ে পড়ে। কোনো বিপদ হয় নি তো? তাঁর বাহুজোড়ায় ব্যাথা হয় ক্ষীণ। অরুণ লম্বা শ্বাস টানে। হঠাৎ নব ঘুরিয়ে কেউ দরজা খুলে দিলো। অরুণ স্বস্তির শ্বাস ছাড়লো। আরেকটু হলেই বোধহয় তাঁর শ্বাস আটকে যেতো!
লতা দরজা খুলে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

-” সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি! কখন আপনারা আসবেন আর আমরা চলে যাবো! পাতা তো রেডি; অধৈর্য হয়ে বসে আছে!”
-” সত্যিই? তার মানে আমরা যাবো! ইয়ে ইয়ে!”
ভোর আনন্দের সাথে দৌড়ে ভেতরে চলে যায়। লতা অরুণের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে ভেতরে চলে গেল! অরুণ বিরক্ত হয়। রঞ্জুকে সব কিচেনে রাখতে বলে সে হনহনিয়ে গিয়ে ড্রয়িংরুমে বসা পাতাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
-” এই পাতাবাহার? ফোন বন্ধ কেন তোমার?”
পাতা চোখ রাঙিয়ে চায়। এই লোক কখনো সুধরানোর নয়। পাতা এখানে একা নয়! আতিকুর ইসলাম, লুবমান, রাতুল ভুঁইয়া সহ বাকিরাও আছে। তাদের উদ্দেশ্যে সালাম কালাম নেই এসে তাঁর উপর গলা ফাড়ছে? অরুণ বুঝতে পারলো বোধহয়। সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করে। টুকটাক কথা বলে পাতাকে আবার একই প্রশ্ন করে। পাতা স্বাভাবিকভাবেই বলল,
-” নষ্ট হয়ে গেছে!”

অরুণ কিছু বলে না আর! রাতুলের সাথে কথা বলতে থাকে। ভোর লাবিবকে তাদের নতুন ছোট বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছে। তাঁর ক্রিকেট সরঞ্জাম, খেলনা গাড়ি, ভিডিও গেম ইত্যাদি।
সকলের খাওয়া দাওয়া শেষে ড্রয়িংরুমে বৈঠক বসে। রাতুল পাতাকে নিয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলে অরুণ সাফ সাফ মানা করে দেয়। লতা নাক মুখ কুঁচকে নেয় এরকম ঘারত্যাড়া লোকও হয়! শুধু নিজেরটাই বোঝে! আতিকুর ইসলাম শান্ত ভাবে বলে,
-” দেখো অরুণ তুমি এখন আলাদা থাকো। বাড়িতে তোমরা তিনজন! তুমি তো অফিসেই থাকো। ভোর ছোট ! এই অবস্থায় পাতার একা বাড়িতে থাকা ঠিক হবে?”

-” আমি অফিস থেকে লিভ নিবো কিছু দিন। টুকটাক বাড়িতে বসেই কাজ করবো!”
-” তবুও আলাদা একটা সাপোর্টের প্রয়োজন! এই সময় মায়ের সঙ্গটা গুরুত্বপূর্ণ!”
-” তাহলে আম্মাকে রেখে যান!”
স্পষ্ট উত্তর অরুণের। লতাও কম না। সেও সাথে সাথে জবাব দেয়,
-” আম্মু নিজের সংসার লাটে উঠিয়ে আপনার সংসার সামলাবে নাকি! আশ্চর্য!”
পাতা বোনকে থামিয়ে দেয়। অরুণের কাছে এগিয়ে যায়। লোকটা আসলেই ম্যানারলেস। যেতে দিবি না ঠিকাছে তাই বলে এভাবে মুখের উপর মানা করে দিবি? ভদ্রভাবে বলা যায় না?ম্যানারলেস অভদ্র লোক! পাতা অরুণকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” আমরা আলাদা কথা বলি?”
অরুণ ছোট ছোট করে চায় তার দিকে। এই মেয়েটা তাঁর থেকে দূরে যাওয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে! সে উঠে পাতাকে নিয়ে রুমে চলে যায়।

-” আমি চিরদিনের জন্য যাচ্ছি না সেখানে! বাচ্চামো কেন করছেন? আমার মনটা ভালো নেই। একটু স্পেস দরকার আমার!”
অরুণের শান্ত নজর পাতাতে নিবদ্ধ! মেয়েটার চোখ মুখ মলিন। অরুণের ভালো লাগে না এই মলিনতা। তাঁর পাতাবাহার হাসবে, কিশোরীদের মতো চঞ্চল হরিনীর রূপ ঘুরেফিরে বেড়াবে। অরুণ হার মানে‌। পাতার বাড়ন্ত পেটে হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
-” আচ্ছা তুমি যেমনটা চাইবে। তবে সাবধানে থাকবে পাতাবাহার! নিজের আর আমার বাচ্চা দুটোর খেয়াল রাখবে।”
পাতা খানিক হাসার চেষ্টা করে বেরিয়ে যায়। অরুণ বিষন্ন চোখে চেয়ে থাকে! একটু পরেই বেরিয়ে যায় সবাই। ভোর তো সবার আগে আগে লাবিবের সাথে গাড়িতে উঠে বসে আছে। অরুণ পাতার কাঁধ জড়িয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দেয়। পরপর সবাই গাড়িতে উঠলে অরুণ রঞ্জুকে সাবধান বানী শুনিয়ে গাড়ি ছাড়তে বলে। গাড়িটি শা শা করে চলে যায়। পাতা গ্লাস নামিয়ে লনে দাঁড়িয়ে থাকা অরুণের দিকে তাকায়। অরুণের মলিন মুখটা দেখে পাতার হৃদয় কোনে জ্বলুনি অনুভূত হয়। আচ্ছা নাক উঁচু ম্যানারলেস লোকটা কি তাকে মনে করবে প্রতিক্ষণ? তার বিরহে হৃদয় ব্যাকুল হবে? প্রতিবার ‘পাতাবাহার’ ডাকার পর কি মনে হবে পাতা নেই তাঁর কাছে!! তাঁর কি মনটা আনচান করবে পাতাবাহারের জন্য? পাতাবাহার ডাকার পর শুধু ওই ছা’পোষার আগমনে লোকটার বুকটা কি খাঁ খাঁ করবে না? তাঁর জন্য চোখের কার্নিশে নোনাজল জমবে না?

গাড়িটা যতক্ষণ দেখা যায় অরুণ দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁরপর উদ্দেশ্য হীন হাঁটা দেয়। বাড়ি যায় না। ঘরের রাণী ঘরে নেই ঘরে গিয়ে কি করবে? ও ঘরে কেবলমাত্র শুন্যতা ও একাকিত্ব। একাকিত্ব বড্ড অপছন্দ অরুণের। একা ঘুরে ফিরে অরুণ বাড়ি ফেরে রাত দশটায়! দরজা খুলতে এক অবুঝ প্রাণী দৌড়ে এসে মিও মিও করে ডাকে। অরুণের মন খারাপির মাঝেও একটু হাসি পায়। একা তো নয় সে! আছে তো আরেক পাতাবাহার। সে বিড়ালটিকে তুলে নিয়ে রুমে চলে যায়!
-” পাতাবাহার সখি বিনা কেমন কাটছে প্রহর?”

নিজ ঘরে বসে আছে পাতা। শুধু বসে নেই নিজ পুরনো কিছু স্মৃতি হাতরিয়ে দেখছে। তাঁর ড্রয়িং খাতায় আঁকানো বিভিন্ন ড্রয়িং! পাতা সব উল্টে পাল্টে দেখে। হঠাৎ একটা স্কেটচ সামনে আসে। পাতা জিভ কামড়ে তড়িঘড়ি পাতা উল্টিয়ে নেয়। স্কেটচ টা শুভ স্যারের। অনেক আগে আঁকিয়ে ছিলো। খুব ভালো না হলেও খারাপও‌ হয় নি। এটা অরুণ সরকার দেখলে পাতাকে কাঁচা চিবিয়ে খেতো ঢেঁকুর অবধি তুলতো না। লোকটা ভোরের চেয়েও কয়েকগুণ হিংসুটে। তবে খুব একটা প্রকাশ করে না। পাতা স্মৃতির পাতা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে আরো দুটো ছবি বের করে। বাবা ছেলের ছবি! ফরমাল ড্রেস আপে বাবার হাত ধরে একটা স্কুল ড্রেস পরিহিত মিষ্টি ছেলে। পাশে পাতা আরেকটা অবয়ব আকাতে চেয়েছিলো। কিন্তু নিজ অবয়ব আকাতে তাঁর বেশ লজ্জা লাগায় আঁকায় নি। পাতা মুচকি হেসে পাতা উল্টাতে নিবে কিন্তু ঘরে আরো দুটো মানবের আগমন ঘটে। ভোর ও লাবিব! লাবিবের হাতে ফোন। সে পাতার বিছানায় বসে ফানি রিলস দেখা শুরু করে। ভোরও আলগোছে উঠে তাঁর পাশে বসে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখতে থাকে। একটু পরে আরেকজনের আগমন ঘটে। লতা মেয়েকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বলে,

-” আমি ,আমার মেয়ে আর তাঁর খালামুনি থাকবো এখানে। ভোর, লাবিব যাও মামুর ঘরে। ঘুমিয়ে পড়ো জলদি। আর ফোন দাও আমার কাছে?”
লাবিব তাঁর মা’কে ভয় পায়। মা’র মেজাজের ঠিক ঠিকানা নেই। বোঝে কম চিল্লায় বেশি। তাই সে কথা না বাড়িয়ে ফোন দিয়ে চলে যায়। ভোরকেও আসতে বলে। ভোর যায় না। পাতার দিকে তাকায় অসহায় চোখে। সে অন্য ঘরে থাকবে? তাঁর করুণ চোখের ভাষা পাতার বুঝতে বেগ পোহাতে হয় না। সে কিছু বলবে তাঁর আগে লতা বলে,
-” কি হলো ভোর? যাও?”
ভোরের মুখখানি ছোট হয়ে যায়। সে বিছানা থেকে নেমে মাথা নিচু করে চলে যেতে নেয়, পাতা পিছু ডাকে। ভোর উজ্জ্বল মুখে পাতার কাছে এগিয়ে আসে। আম্মু নিশ্চয়ই তাকে যেতে দিবে না! পাতা লতাকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলে,

-” ও আমার কাছেই থাকবে!”
-” এতো ছোট বেডে জায়গা হবে?”
-” না হলে মেয়েকে নিয়ে চলে যাও আপু। এটা আমার রুম!”
লতা বিস্ময় নিয়ে চায় পাতার দিকে। মানছে তাঁর উপর রেগে আছে পাতা তাই বলে এভাবে বলবে? সে হম্বিতম্বি করে রুম্পাকে তুলে নিয়ে চলে যাবে তখনই ভোর তাঁর ওড়নার একাংশ টেনে বলল,
-” আন্টি তুমিই থাকো আমি লাব্বু ভাইয়ের কাছে যাচ্ছি।”
লতা থেমে যায়। ভোর পাতার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে চলে যায়‌। রুম থেকে বেরোতেই তাঁর হাসি ফুরিয়ে যায়!
লতা পুনরায় মেয়েকে শুইয়ে দিয়ে দরজা লাগাতে যাবে পাতা দরজা বন্ধ করতে বারণ করে। লতা গিয়ে মেয়ের একপাশে শুয়ে পড়ল। পাতা শোয় না। লতা বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,

-” এই পাতা এখনো রেগে আছিস আমার উপর? আমি কি তোর খারাপ চাই বল? তখন রাগের মাথায় বলেছিলাম আর পাঠাবো না। তুই সত্যি ভেবে বসে আছিস! আমার ঘারে কটা মাথা জামাই পাগল তোকে জামাইয়ের থেকে আলাদা করবো! আর এমনিতেও অরুণ সরকারের তোপের মুখেও পড়ার শখ নেই। কিছুটা হলেও চিনি তাকে। তবে হ্যাঁ অহংকারী লোকটাকে একটু নাকানিচোবানি খাওয়াবো!”
পাতা বোনের দিকে চায়! শান্ত সুরে বলে,
-” আপু তোমাকে বলেছি না আমাদের ব্যাপারে নাক না গলাতে? আমাদের টা আমরা বুঝে নেবো! তোমাকে কিছু করতে হবেনা। আসলে তোমাকে বলাটা সবচেয়ে বড় ভুল হয়েছে আমার। সে যেমনি হোক আমার তো। আমি আমার মতো গুছিয়ে নিবো।”

পাতা মুখ মুচরে ব্যাঙ্গ স্বরে বলে,
-” আসছে মিসেস অরুণ সরকার। তুই পারিস না ব্যাটার কোলে উঠে বসে থাকতে! আচ্ছা গলাবো না নাক। তবে হ্যাঁ তোর ওই ইগোয়েস্টিক লোক আমার সাথে লাগতে এলে দেখিস তাঁর ইগোর রফাদফা না করলে আমি লতা নাম পাল্টে কচুর লতি রাখবো! আর গুছিয়ে নিবি লোকটাকে? আগে নিজেকে তো গুছিয়ে নে!”
পাতা ভ্রু কুঁচকে চায়। লতা রাগে গজগজ করতে করতে চোখ বুজে নেয়। পাতা মুচকি হেসে বলল,
-” আপু রেগে যেও না। তবে দুলাভাই সত্যি বলে তুমি বুঝো কম চিল্লাও বেশি।”
লতা বড় বড় করে চায়। গলা উঁচিয়ে বলে,
-” কি বললি তুই? এই সাহস থাকলে আবার বল!”
-” আমি বলি নি দুলাভাই বলেছে!”

পাতা ঠোঁট চেপে হেসে বলে। লতা রাতুলের গুষ্টির তুষ্টি করে। পাতার বেচারা দুলাভাইয়ের জন্য দুঃখ অনুভব হয়। কাল সকালে তাঁর খবর আছে। তন্মধ্যে দরজা খোলর শব্দ হয়। লতা পাতা দু’জনেই তাকায়। ভোর লতার দিকে আড়চোখে চেয়ে বলে,
-” ও ঘরে একটাই বেড। চারজন মানুষ! বালিশ তিনটে আছে। আমাকে বলল বালিশ নিয়ে যেতে!”
পাতা মুচকি হেসে বলল,
-” বালিশ দেবো না। তুমি দরজা বন্ধ করে আমার কাছে এসো!”
-” না না বালিশ দাও আম্মু!”
-” ওই অরুণ সরকারের মিনি ভার্সন? নাটক কম করো! এসে শুয়ে পড়ো জলদি করে!”
লতা বলে ভোরের উদ্দেশ্যে। পাতা নিশ্চয়ই জানতো ভোর আসবে তাই তো দরজা বন্ধ করে নি। লতা ভাবে তাঁর বোনটা খুবই সহজ সরল। এতো ভালো হতে হবে কেন? ভোর পাতার দিকে তাকালো। পাতা কাছে ডাকে ভোরকে।লতার উদ্দেশ্যে বলে,

-” আমার ছেলেকে নিয়ে কোনো মজা না আপু! নইলে তোমার মেয়েকে বউমা বানিয়ে প্রতিশোধ নিবো ভবিষ্যতে।”
ভোর লজ্জা পেয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় ওঠে। লতা হামি তুলে বলে,
-” মেয়েকে ঘরে খুঁটি বানিয়ে রাখবো তবুও তোর এই অতি ভদ্র ছেলের সাথে বিয়ে দেবো না। যে মেয়ের কপালে আছে তাঁর রফদফা করে ছাড়বে।”
পাতা ভোরকে মাঝে রেখে কিনারে শুতে বললে ভোর নাকচ করে বলে,
-” তুমি মাঝখানে শোবে আম্মু। রাতে ঘুমের মধ্যে পড়ে গেলে অনেক ব্যাথা পাবে!”
লতা খানিকটা অবাক হয়। এ নাকি ছোট বাচ্চা!! এতো পাতারও বাপ! পাতা মানা করলেও জেদি ভোর শোনে না। সে কিনারায় শুয়ে পড়ল। অগত্যা পাতা মাঝখানে শুয়ে ভোরকে নিজের দিকে টেনে নেয়। আদর করে বলে,

-” বাবার কথা মনে পড়ছে না ভোরের?”
লতা মনে মনে ভেংচি কাটলো। বাচ্চার মনে পড়ছে নাকি বাচ্চার মায়ের সে ঢের বুঝতে পারে। ভোর গোমড়া মুখে বলে,
-” ভোর মিস করছে তাঁর বাবাকে। অনেকটা!”
-” কথা বলবে? ফোন দিবো?”
ভোর জবাব না দিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দেয়। পাতা লতার থেকে ফোনটা নিয়ে কল লাগায় অরুণ সরকারকে।

স্নিগ্ধ কুয়াশায় ঢাকা ভোর বেলা। ঝোপ ঝাড়ে পাখির কিচিরমিচির শব্দে কানে বাজছে বেশ। বিহঙ্গের দল ডাকছে নাকি ঝগড়া করছে ঠাহর করা মুশকিল। কুয়াশার চাদরে মোড়ানো আশপাশের পরিবেশ দেখা গেলেও দূরের পরিবেশ ঠাহর করা যাচ্ছে না। এই কুয়াশায় ঢাকা ঠান্ডা পরিবেশে দুটো বাচ্চা পুরো প্যাকেট হয়ে ফুটবল খেলছে। একটার বছর দুয়েক হবে অপরটা সদ্য হাঁটা শিখেছে। আনাড়ি পায়ে কয়েকদম গিয়ে বসে পড়ে। তবুও ফুটবল দেখে তাঁর অদম্য কৌতূহল! এই বাচ্চা দুটোর বডিগার্ড আরেক পাঁচ বছরের বাচ্চা। সেও শীতের পোশাকে নিজেকে মুড়িয়ে বাগান থেকে ফুল তুলছে আর কানে গুজছে। ছোট বিচ্ছু দুটোর কানেও লাগিয়ে দিয়েছে। হঠাৎ বাড়ির ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,

-” আনি? এই কুয়াশায় বাইরে কেন বের হয়েছো ওদের নিয়ে? এখনি ভেতরে আসো?”
‘আচ্ছা দাদি!’ বলে আনিকা রুপ ও নয়নকে ডাকে। রূপ তাঁর ছোট ছোট ধারালো দাঁত দেখিয়ে হেসে বলে ‘যাবু না’ বলেই দৌড় লাগালো। নয়ন হেসে তার পিছু পিছু। আনিকা ‘বাঁদরের দল’ বলে তাদের পিছু নেয়। আনিকা নয়নকে ধরে ফেলে কিন্তু রূপকে ধরতে পারে না। গেইটের দিকে সে দৌড়ে যায়। আনিকা ফোঁস ফোঁস করে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ তার রাগি মুখ কনভার্ট হয়ে বিস্ময়ে হা হয়ে যায়! সে নয়নকে ফেলে দৌড়ে যায় ‘বড় চাচ্চু’ বলে। রূপক সরকারও চিনতে পারে তাঁর চাচ্চুকে। সে আগে ‘চাচু’ বলে অরুণের পা জাপ্টে ধরে। অরুণ কোলে তুলে নিয়ে আদর করে। আনিকা এলে তাঁকেও টেনে তোলে । আনিকা অরুণের গালে টপাটপ কয়েকদফা আদরের কার্যক্রম করে উচ্ছসিত গলায় বলে,

-” চাচ্চু তুমি আনি’কে ভুলে গেছো! আই মিসড ইয়ু!”
রূপও আনিকাকে অনুকরণ করে অরুণের গালে চুমু দিয়ে খিলখিলিয়ে হেসে বলে ‘আই মিচ উ চাচু’! অরুণ মুচকি হেসে দুটোকে নিয়ে পা বাড়ায়।
-” আই অলসো মিসড আনিবুড়ি, রূপ সোনা! কেমন আছো তোমরা?
-” ভালো আছি। চাচিমনির বাবু এসেছে?”
-” আসলে তো জানাতাম আনিবুড়ি! বাবুর আসতে আরেকটু সময় লাগবে।”
অরুণ দু’জন কে নিয়ে নয়নের সামনে দাঁড়ায়। নয়ন অরুণকে চেনে না। সে হাঁ করে চেয়ে আছে। মুখ দিয়ে লালা পড়ছে। অরুণ আনিকে পিঠে চড়তে বলে নয়নকে কোলে তুলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।
আরিয়ান ড্রয়িং রুমে বসে চা খাচ্ছিলো আর পেপার পড়ছিলো। হঠাৎ ভাইকে দেখে বেশ অবাক হয়। তবে প্রকাশ না করে স্বাভাবিক ভাবেই বলল,

-” সকাল সকাল সরকার বাড়ি এসে বাঁদর গলায় ঝুলিয়ে ঘুরছিস ভাই?”
অরুণ মুচকি হেসে সবকটাকে নামিয়ে দেয়। নয়ন ছাড়া পাওয়ার সাথে সাথেই আনাড়ি পায়ে কিচেনের দিকে ছোটে। রূপ আনি যায় না। তাঁরা চাচ্চুর হাত ধরে টানাটানি করে। অরুণ দুটোকে সোফায় বসিয়ে নিজেও বসে। আরিয়ানকে বলে,
-” কেমন আছিস? ছোটমা কোথায়? রুবি অফিসের জন্য বেরিয়েছে?”
-” ভালোই আছি। মা কিচেনে চা আনতে গেলো। রুবি একটু আগেই বেরিয়েছে!”
আরিয়ানের কথার মাঝেই আসমা বেগম চা নিয়ে আসলো। অরুণ মুচকি হেসে বলল,

-” কেমন আছো ছোট মা?”
-” ভালো থাকার জন্যই তো চলে গেলে ভালো না থেকে উপায়? চা নাও! নাকি কফি আনবো?”
অরুণ চা’য়ের কাপ হাতে নেয়।আসমা বেগমের খোঁচা দিয়ে কথা বলাও গায়ে লাগায় না সে। আসমা বেগম অরুণের সম্মুখে সোফায় বসে বলে,
-” ভোরকে সাথে আনতে পারতে! কেমন আছে ওরা? পাতার কি অবস্থা?”
-” ভালো ছোট মা! প্রেসার টা আপ ডাউন করে! আর মেয়েটা ভয় পায় অনেক। তাছাড়া সব ঠিকঠাক!”
-” প্রথম তো তাই ভয় পাবে, স্বাভাবিক!”

চা’য়ে চুমুক দিয়ে বলে আসমা বেগম। অরুণ আরো টুকটাক কথাবার্তা বলে তাদের সাথে। একা একা ফ্ল্যাটে ভালো লাগছিলো না তাঁর।তাই এখানে ছুটে আশা। বুকে অসহনীয় যন্ত্রণা হচ্ছিল! গত রাত থেকেই তাঁর হাঁসফাঁস লাগছিলো। রাত যেন কাটছিলোই না। মনে হয়েছে সময় থমকে গেছে। রাতে ভোরের সাথে কথা হয়েছিলো মিনিট দশেক! ভোরকে পাতার কাছে দিতে বলেছিলো। পাতা কথা বলে নি। ভোরকে ফিসফিসিয়ে বলেছিলো বলো আম্মু ঘুমিয়ে পড়েছে! তাঁর ফিসফিসিয়ে বলা কথা শুনেছিলো সে। একবার মেয়েটাকে হাতের কাছে পাক চড়িয়ে গাল লাল করে দিবে। বেয়াদব! তার সাথে ছলচাতুরি।আজ বিকেলেই যাবে সে! দেখে নেবে!

অরুণ আনিকাকে কোলে বসিয়ে দেয়। মেয়েটা পাগল করে রেখেছে। ভোর কি করছে? কেন আনো নি তাকে? ভোরের কি আনি’র কথা মনে পড়ে না? তুমি কি সত্যিই ভোরের জন্য লাল টুকটুকে বউ এনেছো? তাই ভোর আনি’কে ভুলে গেছে? আরো অনেক প্রশ্ন শুধু ভোরকে ঘিরে। অরুণ তাকে আশ্বস্ত করে বলে,
-” ভোরও তোমার কথা বলে সবসময়! বিয়ে করাই নি‌ এখনো। ওরকম দুষ্টু ছেলেকে কে বিয়ে করবে শুনি?”
আনি অরুণের কানে মুখ নিয়ে ধীমান সুরে বলে,
-” বড় চাচ্চু? আমি করবো! আনি হবে ভোরের লাল টুকটুকে বউ!”
অরুণ গোল গোল করে তাকালো আনিকা’র দিকে। আনিকা চাচ্চুর গাল জোড়া টেনে দেয়। অরুণ হেসে বলে,
-” আনিবুড়ি তো ভোরের বোন হয়!”
আনিকা ভেংচি কেটে বলে,
-” তো? লাল টুকটুকে বউ ও হবে!”

সারাদিন ব্যস্ততায় কাটে অরুণের! ব্যস্ততার ভিড়েও বুকটা শূন্য শূন্য লাগে। আগে তো নীড়ে ফিরে চঞ্চল চড়ুই জোড়ার কিচিরমিচির শব্দে তাঁর হৃদয়খানি শীতল পবনে জুড়িয়ে যেতো। এখন তো তাঁর নীড় ফাঁকা! বাড়ি ফিরলে তো ছেলে কোলে চড়ে চুমু দিয়ে মিষ্টি হেসে শ’ খানেক আবদার করবে না! গাল ফুলিয়ে এক অভিমানীনি বলবে না দেড়ি করে কেন ফিরলো! তাঁর ত্যাড়া উত্তরে অভিমানীনির অভিমান তো আর বেড়ে যাবে না। সেই অভিমান ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিতেও তাকে নিয়ে সুখানুভূতির রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো হবে না। অরুণ দেড়ি করেই বাড়ি ফিরে। ভেবেছিল চলে যাবে শ্বশুড় বাড়ি। কিন্তু যেতে পারে নি। সে পারবে না বিনা দাওয়াতে সেখানে যেতে। তাঁর সাথে যায় না ব্যাপারটা!

পূর্ববর্তী রাতের ন্যায় আজকের রাতটাও কেটে যায় হাঁসফাঁস করতে করতে। পরদিন অরুণ সিদ্ধান্ত নেয় যাবে শ্বশুড় বাড়ি সঙ্গে তিন নম্বর হাত; অর্থাৎ অজুহাত হিসেবে পাতার নতুন ফোন আর কিছু ওষুধ পত্র নিয়ে যাবে। সেই হিসেবে সারাদিন ব্যস্ত রেখে বিকেলে বাড়ি ফেরে। স্কাই ব্লু শার্ট ও জিন্সে নিজেকে রেডি করে। শার্টের উপর ধূসর রঙের হুডি পড়ে নেয়। শীতটা জেঁকে বসেছে। চুল সেট করার সময় ও মন মানসিকতা নেই শুধু চিরুনি চালায় কোনরকম। কালো ফ্রেমের চশমা চোখে পড়ে। আয়নায় নিজেকে দেখে! চেহারায় একটু বুড়ো বুড়ো ভাব দেখা যাচ্ছে তবে অরুণ জানে ওবাড়ি গিয়ে ইমার্জেন্সি ওষুধ নিলে ঠিক হয়ে যাবে! অরুণ ড্রেসিন টেবিলের উপর রাখা থেকে ঘড়ি পড়ে নেয়। ওয়ালেট নিতে পারে না। সেটা তো আরেকজনের দখলে! অরুণ চুলের ভাঁজে হাত চালিয়ে বলে,

-” দেখ পাতাবাহার ডোন্ট ডিস্টার্ব মি! তোমার সখি জানলে গর্দান নিবে তোমার। তাই ওয়ালেট দিয়ে দাও”
পাতাবাহার ছাড়ে না। ড্রসিন টেবিলে গা এলিয়ে চার পায়ে লুকিয়ে রাখতে চেষ্টা করে। ভাব এমন যেতে দেবে না অরুণ কে অথবা তাকেও সঙ্গে নিতে হবে। অরুণ তার গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে। বাটিতে ক্যাট ফুড দিলে বিড়ালটি খেতে যায়। অরুণ ওয়ালেট পকেটে পুরে হাত ধুয়ে আসে।
-” শোন পাতাবাহার? খেয়াল রেখো ফ্ল্যাটের আসছি আমি।”
বলে দরজা লক করে বেরিয়ে যায়। পাতাবাহার খাওয়া বাদ দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে মিও মিও ডাকে অনবরত! তাকে এভাবে ধোঁকা দিতে পারলো?

অরুণ মাগরিবের নামাজ আদায় করে শশুর বাড়ি ঢোকে।‌ হাতে মিষ্টি সহ বাচ্চাদের জন্য ফাস্টফুড ও হাওয়াই মিঠাই। কলিং বেল বাজালে দরজা খুলে যায় অতিদ্রুত। লতাকে দেখে অরুণ ভদ্রসুলভ জিজ্ঞেস করে,
-” কেমন আছো লতা?”
বলেই অরুণ ইতস্তত করে খানিকটা। সেদিন তাদের বাড়িতে ভালোমন্দ কিছুই বলে নি আজ বললো, মেয়েটা না পিঞ্চ মেরে কথা বলে! অরুণের ধারনা শতভাগ সত্য। লতা খোঁচা দেয়। অরুণ হজম করে নেয়; দোষটা তাঁর! লতা ওখানেই থেমে থাকে নি। সে আরো বলে,

-” ভাইয়া আমি পাতার সাত আট বছরের বড়! আপনি আমার ছোট বোনের জামাই। বয়সে ঢের ছোট হলেও সম্পর্কে বড় আমি। ননশ্বাস না কি বলে যেন সে যাই হোক আপু ডাকবেন। সম্মান দিলে সম্মান পাবেন। বুঝলেন?”
অরুণ থমথমে মুখে লতাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়! জবাব দেয় না। পাতাবাহারের রাগ অভিমান কমুক একটু। তাকে নিয়ে নিজ নীড়ে ফিরুক। পাতার কাছেও ঘেঁষতে দেবে না এই মেয়েকে। অরুণকে দেখেই রুম্পা ‘আনকেল আনকেল’ বলে দৌড়ে আসে। অরুণ কোলে তুলে নিয়ে তার হাতে একটা হাওয়াই মিঠাই দেয়। রুম্পার খুশি দেখে কে! অরুণ এদিকে ওদিকে তাকিয়ে পাতাকে খোঁজে। লাবনী আক্তার এগিয়ে এসে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মেয়ে জামাইয়ের হালচাল জিজ্ঞেস করতে। বিয়ের পর দ্বিতীয়বার পা রাখলো তাদের বাড়িতে। অরুণ পাতার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান লুবের সাথে ছাদে গিয়েছে চাঁদ দেখতে। অরুণের ভ্রু কুঁচকে যায়।এই ভর সন্ধ্যায় ছাদে? তাও এই পৌষের শীতে? অরুণ শাশুড়িকে বলে ছাদে চলে যায়। লতা ড্রয়িং রুমে বসে তাঁর কান্ড দেখে। পাতার খেয়াল রাখে লোকটা।
অরুণ একতলা বাড়ির ছাদে চলে যায়। অন্ধকার ছাদে শুধু রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টের সাদা নিয়ন বাতির আলো! আর উপরের এক ফালি চাঁদের জোৎস্না ঢালা। অরুণ গলা খাঁকারি দিলে সবাই এদিকে ফেরে। ভোর খুশিতে লাফিয়ে ওঠে। অরুণের পা জড়িয়ে বলে,

-” আই মিসড ইয়ু সো মাচ আব্বু কলিজা!”
-” আ’ম অলসো কলিজা!”
ভোর মাথা উঁচু করে মুচকি হাসলো। নিয়ন বাতি ও জোৎস্নার ম্লান আলোয় মিষ্টি হাসিটা যেন নিজস্ব দ্যুতি ছড়িয়ে দিলো! অরুণ ছেলের টুপিটা দিয়ে মাথা ভালো করে ঢেকে দেয়।
-” দুলাভাই কখন এলেন?”
লাবিবের কথায় অরুণ তার দিকে তাকিয়ে ভোরের হাত ধরে বলল,
-” মাত্রই এলাম! এই ভর সন্ধ্যায় ছাঁদে কি? ওই এক ফালি মলিন চাঁদে প্রেমিকার প্রতিচ্ছবি দেখতে পাও নাকি?”
লাবিব লজ্জায় মাথা চুলকিয়ে বলে,

-” আপনার চাঁদ তো আপনার নামে লিখিত দলিল যখন খুশি দেখতে পারবেন। আমরা তো পারি না ,তাই! বুঝতেই পারছেন?”
-” তাঁর মানে স্বীকার করছো কেউ আছে! শালামশাই ভালো ভেবেছিলাম তোমাকে! পরিচয় দাও? তোমারও ব্যবস্থা করে দিই!”
লুবমান যেন নিজের কথাই ফেঁসে গেলো! পরিচয় জানালে ব্যবস্থা করা দূর, দা বটি নিয়ে ধাওয়া করবে! লাবিব বলে,
-” কি যে বলেন না দুলাভাই! এই লাবিব ভোর? চলো আমরা নিচে যাই!”

বলেই তাদের নিয়ে নিচে যায়। অরুণ সাবধানে নামতে বলে তাদের। তাঁরা চলে যেতেই অরুণ ছাদের কিনারে দাঁড়ানো তাঁর রমনীর পানে চায়। পাতা সাথে সাথে অন্যদিকে ফেরে। লোকটা আজ আসবে পাতার ভাবনার বাহিরে ছিলো! হয়তো ভোরকে ছাড়া থাকতে পারছে না তাই চলে এসেছে। তাঁর জন্য তো আর আসে নি। অরুণ বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসে পাতার নিকট। পাতার গায়ের শালটা তুলে মাথায় ঘোমটার ন্যায় পড়িয়ে কপালে অধর ছুঁয়ে রাখে। ঘনঘন শ্বাস টানে। যেন বুঝিয়ে দিতে চায় অল্প ক্ষণের বিরহে অরুণ সরকারের নাজেহাল অবস্থা! পাতার ইচ্ছে করে উষ্ণ ওই বুকটায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে কিন্তু পাতা নিজেকে ধাতস্থ করে। অরুণের উষ্ণ বুকে হাত রেখে ঠেলে সরিয়ে দিতে চায়। অরুণ হাত জোড় বুকে চেপে রেখে করুণ গলায় বলে,

-” অনেক হয়েছে স্পেস! পাতাবাহার বাড়ি চলো? রাগ অভিমান যা দেখাবে আপন নীড়ে দেখিও! আমি সব অভিমান অভিযোগ মাথা পেতে নেবো! প্লিজ পাতাবাহার?”
অরুণ মনে মনে ভাবে বাড়ি ফিরে চলো পাতাবাহার! নইলে তাঁরও এখানে থাকার বন্দোবস্ত করো। সে বিনা দাওয়াতে এসেছে এতেই কেমন অপ্রস্তুত সে! এখন ছোচামো করে শশুর বাড়ি দিনের পর দিন থাকতে পারবে না সে। আবার এরকম বিরহে থাকতেও পারবে না।
পাতা থমকায়! লোকটা এতো গভীর গলায় ভোর ব্যতিত কাউকে অনুনয় করেছে কি না সন্দেহ! পাতা কিছু সময় চুপ থেকে বলে,

-” নিচে চলুন!”
অরুণ হতাশ হয়! হতাশ মিশ্রিত গলায় বলে,
-” যাবে না বাড়ি?”
-” আশ্চর্য! আমি বলেছি তো কিছু দিন থাকবো। বিয়ের পর মেয়েরা বাপের বাড়ি থাকে না? নিচে চলুন!”
পাতার কাঠকাঠ গলার স্বরে অরুণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিছু সময় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে পাতাকে পাঁজাকোলে নিয়ে সিঁড়ির পথ ধরে।

-” ইয়া আল্লাহ আমার জামাই পাগলি বউটাকে ফিরিয়ে দাও! তাঁর কানে কানে মন্ত্র পড়া কুচুটে শয়তানীদের মুখে ঝামা ঘষিয়ে দাও! আমিন! আমিন বলো পাতাবাহার?”
পাতা গরম চাহনি নিক্ষেপ করে। বর্বর লোক! অরুণ মুচকি হেসে পাতার ফুলো অষ্ঠাধরে সশব্দে চুম্বন করে সামনে তাকাতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে!

রাতুল ভুঁইয়া গলা খাঁকারি দিয়ে আশেপাশে তাকালো। কাউকেই খুঁজে না পেয়ে বত্রিশ পাটি বের করে হেসে বলে,
-” মুরুব্বি উঁহু উঁহু! আমি কিছু দেখি নি কিন্তু! দেখলেও তোমাদের জানিয়ে লজ্জাও দিবো না। তবে হ্যাঁ পেছনে শশুর মশাই আসছে! তাই বাকি কাজ পোস্ট পন্ড করে দাও!”
লজ্জায় পাতার বাচ্চাদের ন্যায় দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করছে! দুলাভাইয়ের জায়গায় আব্বু হলে লজ্জায় সে বাড়ি ছাড়তো! অরুণ অবশ্য স্বাভাবিক আছে এখন। সে পাতাকে নামিয়ে ভেতরে নিয়ে যায়‌। রাতুল তাদের পিছনে। চোখে মুখে চাপা হাসি!

পাতা রুমের ভেতর পায়চারি করছে গুটি গুটি পায়ে। একটা হাত বাড়ন্ত পেটে। ভোর ও লাবিব বিছানায় শুয়ে মোবাইলে গেম খেলছে।অরুণ বিছানায় বসে আছে বাবু হয়ে। তাকে দেখেই পাতার রাগ হচ্ছে অসম্ভব! অসভ্য বেহায়া বেলাজ লোক কোথাকার! রাতুল ভাইয়া পাতাকে দেখলেই পিঞ্চ মেরে কথা বলছে! ‘পাতার গোমড়া মুখো জামাই দেখি বেশ রোমান্টিক! তাই তো আমাদের পাতা জামাই বলতে অজ্ঞান!’ আর চোখাচোখি হতেই এমন করে হাসে পাতার লজ্জা বেড়ে যায়। সব দোষ এই বেলাজ ম্যানারলেস লোকটার! কথা হলো পাতা তাকে ঝাড়তে পারছে না তাই রাগ লাগছে! অরুণ পলকহীন তাকিয়ে থাকে পাতার দিকে। ঢিলেঢালা গোল ফ্রক ও টাওজার। ফ্রকের উপর একটা পাতলা সোয়েটার! শালে নিজেকে মুড়িয়ে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে যেন কোনো পুতুল! রাগে ফোঁস ফোঁস করছে! অরুণ হামি তুলে বলে,

-” সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করছো কেনো? হয়েছে টা কি? বলবে?”
পাতা কিচ্ছু বলে না। চুপচাপ হাঁটতে থাকে। অরুণ আবার বলে,
-” একটু স্থির হয়ে বসো না। নয়ন জুড়ে দেখি একটু! ঊনপঞ্চাশ ঘন্টা চোখের আড়ালে ছিলে!”
পাতা কেমন করে যেন চায়! লোকটা বলেছে এই কথা? নাকি সে ভুল শুনলো!অরুণও বলেই কেমন অস্বস্তিতে পড়ে। এসব ঢঙ্গী কথা সে কিভাবে বললো? কেমন নিব্বা টাইপ!
-” বাব্বাহ অরুণ সরকার এসব প্রেম বাক্য বলতে জানে?
পাতার কথায় অরুণ খানিকটা আমতা আমতা গলায় বলে,
-” না জানার কি আছে আশ্চর্য! তোমার কি কোনো প্রবলেম হচ্ছে? কেমন চিংড়ি মাছের মতো তিড়িং বিড়িং করছো! শান্ত হয়ে বসো না!”
প্রসঙ্গ পাল্টে নেয়। পাতা আড়চোখে অরুণকে দেখে। অরুণের ঘুম পাচ্ছে। কাল রাতে ঘুম হয় নি। আজকে হবে! তবে ঘুমোবে না সে। অভিমানীনির অভিমান ভেঙ্গে গুড়িয়ে সকাল সকাল নিজ নীড়ে ফিরবে তাকে সঙ্গে নিয়ে! সে ঘুম জড়ানো গলায় বলে,

-” এই পাতাবাহার ঘুম পাচ্ছে! রাত দশটা বাজতে চললো। ঘুমোবে না?”
-” হ্যাঁ ঘুমোবে তো! এখনি ঘুমোবে!”
তৃতীয় কোনো ব্যক্তির গলা শুনে অরুণ দরজার পানে তাকায়। রাতুল হাসিমুখে ভেতরে ঢুকে অরুণকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলে যেন বাচ্চাদের কানে না যায়,
-” ভাই শীতের রাত এমনিতেই দীর্ঘ তাঁর উপর উষ্ণতা দেয়া বউ কাছে না থাকলে সেই রাত কাটতেই চায় না। আপনাকে গত দু রাতের মতো আজকের রাতেও স্বাগতম! চলুন দুই সম্বন্ধী ভাই মিলে দুঃখ বিলাস করি!”
পাতা অবুঝ চোখে দু’জনকে পর্যবেক্ষণ করে। সে পুরো কথার মানে বুঝতে পারে নি। তবে অরুণের বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগে নি। সে পাতার দিকে তাকালো! তাঁর সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। সে রাতুলকে প্রশ্ন করে,
-” সমস্যা কোথায? তোমরা ফ্যামিলি নিয়ে লুবের ঘরে আমরা এ ঘরে! লুব আজ রাত ম্যানেজ করবে!”
রাতুল অরুণ পাশে বসে দুঃখি দুঃখি গলায় গুনগুন করে বলে,

-” কারে বোঝাবো মনের দুঃখ রে! আমি বুক চিড়িয়া!! ভাই আছে না আমার একমাত্র বউ? আর কিছু বলতে হবে?”
-” না! খুবই ভালো করে বুঝতে পেরেছি! বউকে একটু হাতের মুঠোয় রাখতে পারো না রাতুল? তাঁর নাক টা একটু বেশিই বড়!”
ত্যাক্ত গলায় বলে অরুণ। এই লতা মেয়েটা বেশি বাড়াবাড়ি করছে। পাতা বুঝতে পারে সম্পূর্ণটা। তাঁর হাঁসি পায়। ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
-” দুলাভাই ও ঘরে মনে হয় তিনটে বালিশ আছে। আরেকটা নিয়ে যাবেন! লেপও একটা এক্সট্রা আছে! শীত পড়েছে বেশ এটাও নিয়ে যান !”

পাতা বাহার পর্ব ৫৫

বলেই লেপ বের করে ওয়েড্রপ থেকে। অরুণ চোখ পাকায় পাতাকে। দাঁত দেখাচ্ছে মেয়েটা!এই সুন্দর দাঁত গুলো সে ভেঙ্গে দিবে। পাতা তাঁর কোলে সাদা ধবধবে নতুন লেপ রেখে বলে,
-” দুজনকেই শুভ রাত্রি!”
-” পাতাবাহার? হেসে নাও! এক পৌষে শীত যায় না। মাঘ মাসও আসবে অতি শীঘ্রই!”
বলেই অরুণ লেপ নিয়ে গটগট করে চলে যায়! পাতা হেসে ওঠে শব্দ করে।

পাতা বাহার পর্ব ৫৭