পারমিতা পর্ব ১৭

পারমিতা পর্ব ১৭
Nabila Ahmed

মিতা হোটেল থেকে কতক্ষণে হেটে আইফেল টাওয়ারের সামনে এসেছে তা খেয়াল করার সময় পায় নি। চারিদিকের সৌন্দর্য দেখে যেন এক মিনিটের জন্যও চোখ সরাতে পারছে না। আইফেল টাওয়ারের একটু কাছাকাছি আসতেই আলোক সজ্জা আবারও জ্বলতে শুরু করেছে। যেমনটা মিতা হোটেলে রেডি হওয়ার সময় ও দেখেছিলো।
আবারও আলোক সজ্জা হতে দেখেই কাধ ব্যাগ থেকে তাড়াতাড়ি করে মোবাইল বের করে নেয় মিতা। উদ্দেশ্য সুন্দর কিছু ছবি তুলে রাখা, নিজের ফ্রেন্ডদের আর মায়া চৌধুরীকে পাঠাতে হবে। মোবাইলের ক্যামেরা অন করতেই নিজের কাধে কারো হাতের স্পর্শ অনুভব করে মিতা। ঘুরে তাকাতেই অরিয়নকে দেখতে পায়। অরিয়নের দিকে তাকাতেই অরিয়ন মিতার হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নেয়।

–কি? ছবি তুলবো তাড়াতাড়ি দেও।
বিরক্ত হয়ে বলে মিতা।
মিতা যেন এক মিনিটের জন্যও অপেক্ষা করতে পারছে না। অধৈর্য্য হয়ে পরছে।
–কি হলো দেও, এখনি আবার বন্ধ হয়ে যাবে এরকম করা।
রাগে হাত পা অরিয়নের দিকে ছুড়ে দিতে দিতে আইফেল টাওয়ারের দিকে তাকায় মিতা।
–বিনা অনুমতিতে আলোক সজ্জার সময় ছবি তোলা নিষেধ।
মিতার দিকে তাকিয়ে বলে অরিয়ন।
–কিহ?
অবাক হয়ে বলে মিতা।
–হ্যাঁ। এটা ওদের নিয়ম।
জবাব দেয় অরিয়ন।
–ধুর, এখন?
মন খারাপ করে বলে মিতা।
–এখন কিছু না, অনুমতি নিয়ে পিক তুলে দিবো।
বলে অরিয়ন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

–সত্যি?
খুশি হয়ে বলে মিতা।
–হ্যাঁ, তবে আজ না।
–কেনো?
মন খারাপ করে জবাব দেয় মিতা।
–কারণ কাল আবার আসতে হবে, টাওয়ারের উপরে উঠবি না?
মিতার মোবাইল নিজের পকেটে ঢুকিয়ে হাটতে হাটতে বলে অরিয়ন।
–আইফেল টাওয়ারের উপরে উঠা যায়?
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে মিতা।
–হ্যাঁ।
–তাহলে এখন কোথায় যাবো আমরা?
অরিয়নের পিছন পিছন হাটতে হাটতে বলে মিতা।
–আশপাশ ঘুরে দেখবি এরপর ডিনার করবি এরপর চলে যাব।
বলে অরিয়ন।

রেস্টুরেন্টে বসে আছে মিতা। ওয়েটার একে একে খাবার দিয়ে গেছে। হাতে চামচ নিয়ে খাবারের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিতা। অরিয়নকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।
মিতা হঠাৎ করে চামচ নিয়ে একা একা খাওয়া শুরু করে দিয়েছে। রাগে মুখের মধ্যে খাবার একের পর এক নিয়ে নিচ্ছে, ঠিক মতো চাবাতেও পারছে না মিতা, তাও গিলার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
অরিয়ন যখন ডিনার করার কথা বলেছিলো, মিতা ভেবেছিলো একসাথে ডিনার করবে কিন্তু মিতার ভুল ভাঙ্গে যখন খাবার অর্ডার দিয়েই অরিয়ন “তুই খা,আমি আসছি একটুপর” বলেই বের হয়ে যায়। নিজের বোকামি দেখে যেন নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না মিতার। ভালো নাই বাসতে পারে তাই বলে কি নর্মাল কাজিনদের মতো খাবারটাও এক সাথে খেতে পারেনি অরিয়ন?
একের পর এক খাবার মুখের মধ্যে ঢুকানোর কারণে খাবার দিয়ে গাল ফুলে আছে মিতার। দুঃখে, কষ্টে চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে।

রেষ্টুরেন্টের বাইরে সিগারেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে অরিয়ন। সেইন নদী ঘিরে তৈরি এই বিখ্যাত আইফেল টাওয়ার দেখতে এবারই প্রথম আসেনি অরিয়ন। এর আগেও এসেছিলো, এসেছিলো নিজের হবু বউ, নিজের লাইফপার্টনার, নিজের জিএফ আফরিনকে নিয়ে। এই নদী, এই টাওয়ার, প্যারিসের এই রাস্তাঘাট যেন বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে সব কিছুতে আফরিনের ছোঁয়া রয়েছে। তার উপর পরী, পরীর মুখটা দেখলেই ইদানীং অস্বস্তি অনুভব হচ্ছে অরিয়নের। চোখে ফুঁটে উঠা সেই তীব্র ভালোবাসা দেখলেই নিজেকে একটা ব্যর্থ পুরুষ মনে হয় অরিয়নের। অন্য কাউকে ভালোবাসা দেওয়ার মতো, নিজের মধ্যে আর কিছুই নেই অরিয়নের। যা আছে তা হলো শুধুই দুঃখ,কষ্ট, নিজের ভাঙ্গা মন, যেই মন ভালোবাসতে জানেনা। পরীকে মিথ্যে আশ্বাস দিতে চায় না বলেই যতোটা পারছে পরীর থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছে অরিয়ন। সিগারেটে টান দিতে দিতেই নিজের মোবাইল বের করে অরিয়ন, গ্যালারি খুলে আফরিনের ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে।

সিগারেট খাওয়া শেষ হতেই রেস্টুরেন্টে ফিরে আসে অরিয়ন। ভিতরে প্রবেশ করে টেবিলের কাছে পরীকে দেখতে না পেয়ে প্রথমে একটু ঘাবড়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই শান্ত হয় ওয়াশরুমে গিয়েছে ভেবে। চেয়ার টেনে বসে অপেক্ষা করছে অরিয়ন। একটু পরেই ওয়েটার এসে টেবিল পরিষ্কার করতে থাকে।
–Apportez la facture.(বিলটা নিয়ে আসুন)
ওয়েটারের উদ্দেশ্যে বলে অরিয়ন।
–La facture est payée, monsieur.(বিল পরিশোধ করা হয়ে গেছে, স্যার)
জবাব দেয় ওয়েটার।
ওয়েটারের কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায় অরিয়ন। “বিল পরিশোধ করলো কে? আর পরী?” কথাটা ভাবতে ভাবতেই দৌড়ে লেডিস ওয়াশরুমের কাছে চলে যায় অরিয়ন। দরজায় সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কোনো মহিলার বের হওয়ার, পাশাপাশি মোবাইলে পরীকে অনবরত কল দিয়ে যাচ্ছে অরিয়ন। “পিক আউ দা কল, পিক আপ, পিক আপ” বিরবির করে বলতে বলতে নিজের চুল টেনে ধরেছে অরিয়ন। কিন্তু অপর পাশ থেকে কল রিসিভ হলো না। ওয়াশরুমের দরজা খুলতেই বেরিয়ে আসে ২০/২২ বছরের এক তরুণী।

–Avez-vous vu une fille à l’intérieur ? Il existe des jeans et des hauts, ainsi que des pardessus.
(ভিতরে কী একটা মেয়েকে দেখতে পেয়েছেন? জিন্স আর টপস পরা, সাথে ওভারকোটও আছে।)
মেয়েটির সামনে গিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলে অরিয়ন।
–Il n’y a personne à l’intérieur.
(ভিতরে কেউ নেই)
মেয়েটির জবাব শুনেই দৌড়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে পরে অরিয়ন। রাস্তা থেকে শুরু করে আশেপাশের সব জায়গায় পাগলের মতো খুজতে থাকে পরীকে।

হোটেল রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে মিতা। ওভারকোট খুলে সোফায় ছুরে ফেলে দেয়। চোখ মুখ লাল হয়ে আছে। বিছানার উপর বসতেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে।
“কেনো ওদের বিয়েটা হলো না? কেনো ওর প্রতি আমার সম্মান,শ্রদ্ধাকে ভালোবাসায় রূপ দিলেন,কেনো প্রথম থেকেই ওর মনে আমার জন্য কিছু দিলেন না,কেনো ও আমার সাথে নর্মাল মানুষের মতো ব্যবহার করতে পারে না? কেন? কেন? কেন?” কাঁদতে কাঁদতে ভাবতে থাকে মিতা।
বিধাতার এই নিষ্ঠুর পরীক্ষা মিতার আর সহ্য হচ্ছে না।
” আই হেট ইউ অরিয়ন, বাট আই হেট মাইসেল্ফ মোর ফর লাভিং ইউ দিস মাচ” কাঁদতে কাঁদতে বিরবির করে বলে মিতা।
রেস্টুরেন্টে খাওয়ার সময় অরিয়ন ছিলো না বলেই রাগ করে নিজেই হোটেলে একা একা চলে এসেছে মিতা। ভাগ্যিস বাংলাদেশ থেকে আসার সময় হাবিব চৌধুরী মিতাকে ইউরো ( ফ্রান্সের মুদ্রার নাম) দিয়ে দিয়েছিলো, তা দিয়েই বিল পরিশোধ করে চলে আসে মিতা। এতোই যখন একা একা থাকার শখ তাহলে আর কোথাও অরিয়নের সাথে যাবে না বলে ঠিক করেছে মিতা।

রেস্টুরেন্ট আর হোটেলের আশেপাশে যত জায়গা আছে সব কিছু তন্নতন্ন করে খুজে ফেলেছে অরিয়ন। কম করে হলেও হাজারবার কল করেছে মিতাকে কিন্তু মিতা কল ধরেনি। একা একা চিনে হোটেলে পৌছাতে পেরেছে কি না তাও জানেনা অরিয়ন। তাড়াতাড়ি করে হোটেল রুমে প্রবেশ করতে গিয়েই সামনে হাটতে থাকা লোকের সাথে ধাক্কা খায় অরিয়ন।
–সরি, ম্যান।
তাড়াতাড়ি করে সরি বলে অরিয়ন।
–ইটস ওকে।
জবাব দেয় লোকটি।
নিজের রুমের লক খুলতে খুলতেই দেখতে পায় ধাক্কা খাওয়া লোকটি পাশের রুমে প্রবেশ করেছে।
লক খুলতেই যেন অরিয়নের রাগ আকাশ ছুয়ে নিলো। যত টেনশন ছিলো তা সব পরিনত হয়েছে রাগে। বিছানায় বসে মোবাইল টিপছে মিতা।

–আর ইউ ফা*কং সিরিয়াস।
দাঁতে দাঁত চেপে রাগে মিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে অরিয়ন।
দরজা খোলার শব্দেই বুঝতে পেরেছিলো অরিয়ন এসেছে। তাও রাগ করেছিল বলেই কথা বলতে ইচ্ছা করেনি মিতার। অরিয়নের কথা শুনে মোবাইল রেখে অরিয়নের দিকে তাকিয়ে থাকে মিতা।
–তোকে আমি পাগলের মতো এখানে সেখানে খুজেছি, আর তুই…তুই না বলে এখানে এসে বসে আছিস।
মিতার আরও কাছাকাছি গিয়ে বলে অরিয়ন।
–ওহ, নিজেকে এখন পাগল মনে হচ্ছে?
বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জবাব দেয় মিতা।
–যখন আমাকে এই অচেনা দেশে রুমের মধ্যে একা ফেলে চলে গিয়েছিলে তখন মনে হয়নি আমার কেমন লাগবে? যখন অচেনা রেস্টুরেন্টে একটা অচেনা মানুষের মতো রেখে চলে গেলে তখন মনে হয়নি আমার কেমন লাগবে? এখন নিজের সময় নিজেকে পাগল মনে হচ্ছে?
দাঁতে দাঁত চেপে মিতাও কথাগুলো বলে।

–তাই কল রিসিভ করিস নি।
শান্ত গলায় বলে অরিয়ন।
–হ্যাঁ, তাই করিনি। করিনি কারণ তোমার মতো অচেনা মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আমার।
–আমি অচেনা তোর?
–হ্যাঁ,অচেনা। তোমাকে তো চিনিনা আমি। কে তুমি? এই অরিয়ন তো আমার সেই অরিয়ন ভাইয়া না! যে আমার চোখের পানি দেখলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিতো। যে আমার সাথে একদিন কথা না বলে থাকতেই পারতো না। যে আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিলো। তুমি আমার সেই অরিয়ন ভাইয়া নও।
কথাগুলো বলে থেমে যায় মিতা, প্রতিটা কথা যেন বার বার গলায় আটকে যাচ্ছে।
–তুমি শুধুমাত্র একজন সেলফিশ, ব্যর্থ প্রেমিক। যার কাছে আমাদের কারো মূল্য নেই।
আবারও বলে উঠে মিতা।
–কি এমন ক্ষতি করেছি আমি, হ্যাঁ? তুমি একটা নর্মাল মানুষের মতো আমার সাথে বসে খাওয়া দাওয়াও করতে পারো না? আমার সাথে বসে কথা বলতে পারো না? আই এম ইউর ওয়াইফ অরিয়ন,ওয়াইফ।
চেচিয়ে বলে মিতা।

–পরী!!
চেচিয়ে উঠে অরিয়ন।
–ঐ নামে ডাকবে না আমাকে। ঐ নাম আমার কাছে এখন হাস্যকর মনে হয়।
মিতাও চেচিয়ে বলে।
–কি বললি তুই?
দু পা মিতার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে অরিয়ন।
–বলেছি আমাকে পরী ডাকবে না। আমার নাম পারমিতা, হয় মিতা ডাকবে আর না হয় পারমিতা কিন্তু প…
অরিয়নের কি হলো জানেনা, শুধু জানে পরী ডাকতে না করাটা শুনতেই যেন মাথায় আগুন উঠে গেলো। নিমিষেই নিজের হাত দিয়ে মিতার গলা চে*পে ধরেছে দেওয়ালের সাথে।
–পরী ডাকতে পারবো না আমি? আমি…অরিয়ন.. তোর অরিয়ন ভাইয়া তোকে পরী ডাকতে পারবো না?
তাচ্ছিল্যের এক হাসি দিয়ে মিতার কাছাকাছি নিজের মুখ নিয়ে বলে অরিয়ন।

–তুমি কবে থেকে আমার হলে?
তাচ্ছিল্যের সুরে মিতাও বলে।
–আমি তোর কি না তাতে কিছু যায় আসে না কিন্তু তুই..তুই আমার পরী।
মিতার গ*লায় প্রেসার দিয়ে চে*পে ধরে বলে অরিয়ন।
–তোর মা, তোর বাবা এমনকি তোর নিজেরও অধিকার নেই আমাকে পরী ডাকতে না করার।
মিতার নাকের সাথে নিজের নাম স্পর্শ করিয়ে বলে অরিয়ন।
গ*লায় চা*প পড়ার কারণে মিতার জন্য শ্বাস নেওয়াটা ধীরে ধীরে কষ্টকর হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। তার উপর অরিয়নের কথা শুনে আর অরিয়নের চোখের দিকে তাকায়েই যেন মিতার আত্না কেঁপে উঠলো ভয়ে। নিজের হাত দিয়ে অরিয়নের বুকে ধাক্কা দিতেই সরে যায় অরিয়ন।
মিতার ধাক্কায় যেন ঘোর কাটলো অরিয়নের। কি করছিলো তা যেন নিজেও জানেনা। অবাক হয়ে একবার নিজের হাতের দিকে আবার একবার মিতার দিকে তাকিয়ে রইল। মিতার মুখ থেকে গলায় দিকে চোখ যেতেই অরিয়নের চোখ বড় বড় হয়ে যায়। নিজের আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট ভেসে আছে মিতার গলায়।

–আই এম সরি পরী, আই এম সো সরি, কি হলো আমি জানিনা।
নিজের হাত দিয়ে মিতার গলায় আলতো করে ছুঁয়ে বলতে থাকে অরিয়ন।
মিতা কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না। অরিয়নের এইরূপ ব্যবহার তো কখনো দেখেনি মিতা।
–হোয়াই আর ইউ বিভেবিং লাইক দিস?
অরিয়নের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে মিতা।

পারমিতা পর্ব ১৬

–লাইক হোয়াট?
মিতার থেকে দু কদম পিছিয়ে এসে প্রশ্ন করে অরিয়ন।
–লাইক এ টক্সিক ম্যান।
বলে ফেলে মিতা।
অবাক হয়ে মিতার দিকে তাকিয়ে রইল অরিয়ন।

পারমিতা পর্ব ১৮