পূর্ণতা পর্ব ২৮
নন্দিনী নীলা
পূর্ণতা চিৎকার এ রুম চেঞ্জ করতে হলো স্মরণ কে। স্মরণ পূর্ণতার সামনে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যাবার সময় ফিসফিসিয়ে বলল,“ ইশ এমন সেন্সিটিভ যদি আমায় নিয়ে হতে… আফসোস। সব আবেগ, অনুভূতি তো একজায়গায় সীমাবদ্ধ করে রেখেছ আমি কি বানের জলে ভেসে এসেছি?”
পূর্ণতা কটমট করে তাকায়।
স্মরণ রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই পূর্ণতা ওর মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রাগী কন্ঠে বলল,“ উনাকে এই রুমে থাকতে দিয়েছ কেন? বাসায় কি রুমের অভাব পরেছে?”
রোজিনা বেগম থতমত খেয়ে গেলেন। পূর্ণতা এতো রাগ করবে তিনি বুঝতে পারেন নাই।
রোজিনা বেগম বললেন,“ এতো রাগ করছিস কেন?”
“ রাগ করব না বলছ।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ দেখ আমি তেমন কিছু ভেবে থাকতে দেয়নি। এই রুমটা পরিষ্কার ছিল তাই এখানে থাকার কথা বলেছি। কয়েকদিনের তো ব্যাপার তাই আর কি তুই এতো রাগ করবি জানলে দিতাম না।”
পূর্ণতা রাগে কটমট করে চলে গেল।
স্মরণ ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখের সামনে একটা দোলনা দোল খাচ্ছে। কিন্তু বসার অনুমতি নেই। কাজের বুয়ার থেকে সতর্কতা বানি পেয়েছে। এই দোলনায় নাকি পূর্ণতা কাউকে বসার অনুমতি দেয় না। স্মরণ দোলনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।
দোলনার দিকে তাকিয়ে স্মরণ বিড়বিড় করল,“ এই দোলনায় মতো আমিও তোমার জীবনের একটা অংশ হতে চাই পূর্ণতা। আমাকে এই দোলনার মতো রাখবে। কাউকে ছুঁতে দেবে না।”
মেজাজ গরম হয়ে ছিল পূর্ণতার ছাদে এসে একটু মনটা ভালো করতে চাইছিল। কিন্তু ছাদে এসেও শান্তি নেই ও দেখতে পেল আগে থেকেই স্মরণ ছাদে দাঁড়িয়ে একাই পাগলের মতো বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ও কপাল কুঁচকে এগিয়ে গেল স্মরণের দিকে নিঃশব্দ পায়ে।
তারপর কর্কশ কন্ঠে বলল,“ আপনি এখানে কি করছেন?”
চমকে উঠল স্মরণ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাতেই দেখতে পেল পূর্ণতা কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। চোখেমুখে রাগ উপচে পড়ছে যেন। স্মরণ পিছু ঘুরে ছাদের দেয়ালে হেলান দিয়ে সরাসরি তাকাল পূর্ণতার দিকে তারপর বলল,“ তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। এতো লেট করলে যে..!”
পূর্ণতার কুঁচকে রাখা ভ্রু জোড়া আরো বেশি কুঁচকে গেল। ও বিমূঢ় কন্ঠে বলল,“ হোয়াট?”
স্মরণ ঠোঁটের কোনে হাঁসি এনে বলল,“ মানে তোমার সাথে একটু এই খোলা ছাদে বসে গল্প করতে ইচ্ছে করছিল।”
“ আপনি ভাবছেন….আমি আপনার সাথে গল্প করবো?” তাচ্ছিল্য কন্ঠে বলল পূর্ণতা।
স্মরণ বলল,“ না করার কি আছে। আমি তো আর তোমার সাথে প্রেম করার জন্য বসে নেই যে তুমি না করবে।”
পূর্ণতা স্মরণ দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দোলনায় গিয়ে বসল। স্মরণ কয়েক কদম এগিয়ে দোলনার কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে।
অতঃপর বলল,“ শুনলাম তুমি নাকি এই দোলনায় কাউকে বসতে দাও না।”
পূর্ণতা উত্তর দিল না। নিজের মতো দোলনায় বসে দোল খেতে লাগল । স্মরণ উত্তর না পেয়ে গালে হাত দিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আছে।
পূর্ণতা বিরক্তি নিয়ে বলল,“ অসভ্যের মতো তাকিয়ে আছেন কেন?”
স্মরণ পূর্ণতার কথায় থতমত খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তারপর বলল,“ কি করব তুমি তো কথা বলছ না। তাই তাকিয়ে থাকা ছাড়া কাজ পাচ্ছি না।”
পূর্ণতা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করল স্মরণের দিকে অতঃপর রাগান্বিত স্বরে বলল,“ বলুন কি বলবেন?”
স্মরণ পূর্ণতার কথায় হো হো করে হেসে উঠল। পূর্ণতা কটমট করে তাকিয়ে আছে ওর বেয়াদবের মতো হাসতে দেখে।
“ কি আর বলব? আমার কথা তো সব উদ্ভট তোমার ভাস্যমতে। শুনলে তুমি সেই মেজাজ গরম করে চিৎকার চেঁচামেচি করবে।”
“ তাহলে এখানে থেকে যান আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দিন।”
স্মরণ পূর্ণতার দিকে দুই সেকেন্ড চেয়ে থেকে ওকে বলে চলে গেল। পূর্ণতা চোখ বন্ধ করে শান্তির নিঃশ্বাস ফেলল। স্মরণ চলে যাওয়ার পর কিছুটা শান্তি অনুভব করছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো ওর সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ও চোখ মেলেই দেখল স্মরণ দাঁত কেলিয়ে হাসছে।
পূর্ণতা রাগে বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,“ আপনি যাননি?”
“ চলে যাচ্ছিলাম ভাবলাম একটা কথা বলেই যাই। না বলে শান্তি পাচ্ছিলাম না। এতো সুন্দর রোমান্টিক একটা ওয়েদার, চারিদিকে থেকে ঝড়ের মতো হাওয়া আসছে। বাতাসে তোমার খোলা চুল উড়ছে।”
পূর্ণতা চুলে হাত দিয়ে বলল,“ আমায় চুল বাঁধা। চোখ গেছে নাকি?”
স্মরণ মৃদু হেসে বলল,“ আরে আমি কল্পনা করছি। ওই দেখো পশ্চিম আকাশে রক্তিম হয়ে সূর্য ডুবে যাচ্ছে। পরিবেশ করে তুলেছে গোধূলি লগ্নের প্রেমময়। চারিদিকে হতে পাখির কিচিরমিচির শব্দে গানের মতো অনুভূতি হচ্ছে। যেন আমাদের দুজনের মনকে পুলকিত করতে গান গাইছে ওরা। এই সুন্দর মনোরম পরিবেশে কথাটা না বলাটা ভারী অন্যায় হয়ে যাবে।”
পূর্ণতা কঠিন সুরে বলল,“ কি কথা? বলে দ্রুত এখানে থেকে বিদায় হোন।”
স্মরণ পূর্ণতার চোখে চোখ রেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“ অতীত আঁকড়ে ধরে কতদিন থাকবে? অতীত ভুলে কি সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না?”
পূর্ণতা ধমক দিতে চাইছিল কিন্তু কেন জানি দিতে ইচ্ছে করল না। উনাকে বুঝাতে হবে উনি যতই চেষ্টা করুক কাজ হবেনা। রাগ করে চিৎকার করে একে বুঝানো যাবে না। পূর্ণতা দোলনায় ফের বসল।
তারপর বলল,“ অতীত কীভাবে ভুলে যাব বলতে পারেন? অতীত তো জীবনেরই অংশ। জীবনের প্রথম ধাপ যা আমরা না চাইতেও ফেলে আসি। অতীত ভুলে কেউ থাকতে পারবে না। এই যে আমি কয়েকদিন পর হয়তো আমিও আপনার জীবনের একটা অতীত হয়ে থেকে যাব।আমি আপনার জীবনের ভালো অতীত নাই হতে পারি কিন্তু আমার অতীত খুব সুন্দর। যাকে আমি চিরকাল বাঁচিয়ে রাখব।”
স্মরণ বলল,“ তোমাকে আমি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ তিন প্রজন্মেই চাই পূর্ণতা।”
“ আপনার সাথে শান্তিতে একটু কথা বলতে মন স্থির করেছি। তাই এইসব বলে আমার মুডটা নষ্ট করবেন না।”
স্মরণ মুখে হাত দিয়ে বলল,“ সরি, এইযে মুখে হাত দিলাম। তুমি কথা বলবে আর আমি তোমার কথায় ব্যঘাত দেব ইম্পসিবল আমিতো জন্ম জন্ম তোমার সাথে কথা শুনে যেতে চাই।”
পূর্ণতা একটা তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল,“ আমার কথা গুলো শোনার পর হয়ত কথা তো দূরে থাক আমার উপস্থিতি আপনার পছন্দের বাইরে চলে যাবে।”
স্মরণ বাচ্চাদের মতো মুখে আঙুল দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। পূর্ণতার তা দেখে হাসি পাচ্ছিল নিজেকে সামলে সিরিয়াস হতে যাবে। তখনি স্মরণ মুখ থেকে হাত সরি চট করেই দুই কানে আঙুল ঢুকিয়ে কান বন্ধ করে বলল,“ তাহলে থাক। যেসব শুনলে আমি তোমায় সহ্য করতে পারব না। আমি সেটা শুনতে চাই না।”
পূর্ণতা কিংকিতৃব্যবিমূঢ় হয়ে হাতের ইশারায় বলল,“ কানে থেকে হাত সরান।”
“ নো আমি তোমাকে পছন্দ করি, ভালোবাসি এখানে অপছন্দের কোন জায়গা নেই। তুমি কিছু বলেই আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না। আমি সেই সুযোগ তোমায় দিতে পারব না পূর্ণতা। আই রিয়েলি লাভ ইউ। ভালো না বাসো আমার অনুভূতি কে নষ্ট করো না।”
“ মাথা মোটা হাদারাম একটা।”
রাগে পূর্ণতা মুখশ্রীর রক্তিম হয়ে উঠল। স্মরণ কানে আঙুল ধরেই নিচে চলে গেল।
পূর্ণতা ওর যাওয়ার দিকে চেয়ে আছে বোকা হয়ে।
“ এটা কি পাগল নাকি? অসহ্য করে ফেলল আমায়।”
পূর্ণতার মেজাজ টাই নষ্ট হয়ে গেল। স্মরণের এমন আচরণে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইল। তারপর নিজেও গটগট করে নিচে চলে এলো। মুডটাই নষ্ট করে দিয়েছে এই লোকটা আস্ত একটা পাগল।
পূর্ণতা বসে আছে রেস্টুরেন্টে অনেকদিন পর সব ফ্রেন্ড রা একসাথে হয়েছে। মায়া বাদে সবাই একসাথে হয়েছে।
পূর্ণতা চশমা পরে এসেছে। তাই নিয়ে ওরা ওকে নিয়ে হাসিতামাশা করছে। পূর্ণতা ওদের কথায় চশমা খুলে ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল,“ এটা পরে আসা উচিত হয়নি।”
দিঘি ওর বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বলল,“ তোকে চশমায় কিন্তু সেই লাগছিল পূর্ণ।”
পূর্ণতা পাল্টা জবাব দিতে যাবে খেয়াল করে স্মরণ এককোণে বসে ওর উপর নজর রাখছে। স্মরণ কে দেখে পূর্ণতার মেজাজ গরম হয়ে যায়। চোখ দুটো ও বড়ো বড়ো হয়ে যায়। উনি এখানে কি করছে? রাগে পূর্ণতার শরীর কাঁপছে। চোখমুখ শক্ত করে ওর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। স্মরণ পূর্ণতার দিকে দেখে চোখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকায় এমন ভান ধরে যেন পূর্ণতা কে দেখেইনি।
পূর্ণতা জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবছে। উনি আমায় ফলো করছে? এতো বড়ো স্পর্ধা উনার!
রাসেল পূর্ণতার দিকে চেয়ে বলল,“ কি হলো রাগে ফুস ফুস করছিস কেন?”
পূর্ণতা দৃষ্টি সরিয়ে কিছু না বলল।
“ তুই মায়ায় বাসা গিয়েছিলি। আমার বাসায় গেলি না।” অভিমানী কন্ঠে বলল দিঘি।
“ অনেক কাহিনী করে গিয়েছিলাম। যাওয়ার পর ও কাহিনী কম হয়নি।”
“ যেভাবে যাস। গিয়েছিলি তো। আমাদের বাসায় কবে যাবি বল।”
পূর্ণতা বলল,“ তাড়াতাড়ি বিয়ে করে নে যাবনি।”
পূর্ণতার কথায় হাসির রোল পড়ে গেল সবার মধ্যে। সবাই হাসিতামাশা করতে লাগল। পূর্ণতা ও হাসছে ভুলেই গেল স্মরণ ওর উপর নজরদারি করছে।
রিতু খেয়াল করল পাশের টেবিলে থেকে স্মরণ কে উঁকিঝুঁকি মারতে। রিতু ফিসফিস করে সবাইকে বলল,“ ওই ছেলেটা আমাদের টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় কাউকে পছন্দ করেছে।”
পূর্ণতা চমকে উঠল। স্মরণের কথা বলতে গিয়েও বলা হয়নি ওদের। এখন বললে হিতের বিপরীত হবে তাই পূর্ণতা দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করল। কিন্তু বাসায় গিয়ে এর শোধ পূর্ণতা তুলবে। চোখ পাকিয়ে তাকাল স্মরণের দিকে। স্মরণ নিজেও থতমত খেয়ে গেল পূর্ণতা কে রেগে আগুন হতে দেখে।
বাসায় ফিরে পূর্ণতা রেগে স্মরণের অপেক্ষা করতে লাগল আজকে বাসায় ফিরুক। তারপর মজা বুঝাবে ওকে ফলো করার হিসেব নিবে। পূর্ণতা রেগে রুমে পায়চারি করছে অদ্ভুত আসছেনা কেন? ভয়ে পালিয়ে গেল নাকি। উফফ বাঁচা গেল। পূর্ণতা খাটের কোনায় পা ঝুলিয়ে বসতেই বাইরে স্মরণ কে দেখল নিজের রুমে যাচ্ছে।
পূর্ণতা দাঁড়িয়ে পড়ল।
দ্রুত এগিয়ে এসে বলল,“ দাঁড়ান।”
স্মরণ হাসিমুখে দাঁড়িয়ে পড়ল। পিছু ঘুরে পূর্ণতার চোখে চোখ মিলিয়ে বলল,“ হুম বলো।”
পূর্ণতা রাগে কটমট করে বলল,“ আপনি আমার পিছু নিয়েছিলেন কেন?”
স্মরণ চরম অবাক হবার ভান করে বলল,“ আমি তোমার পিছু নিলাম কখন?”
পূর্ণতা রাগে ফেটে পড়ল স্মরণের অস্বীকার দেখে। কি সুন্দর অবলিলায় অস্বীকার করছে?
“ দেখুন, আপনি কিন্তু কাজটা ঠিক করছেন না। আমি আমার ফ্রেন্ডদের সাথে মিট করেছি আপনি সেখানে অব্দি চলে গিয়েছেন। এভাবে আমায়..”
পূর্ণতার মুখের কথা কেড়ে নিল স্মরণ বলল,“দেখো আমি এমনিতেই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। বাসায় একা একা বোরিং হয়ে গেছি। তুমি তো আর পাত্তা দিচ্ছে না। তাই একটু বাইরে গিয়েছিলাম কিন্তু এক্সিডেন্টলি আমাদের জায়গাটা মিলে গিয়েছি দ্যাটস ইট। আমি তোমায় সত্যিই ফলো করিনি।”
“ আপনি মিথ্যা বলছেন। আপনি ইচ্ছাকৃত আমায় ফলো করেছে। এখন কি সুন্দর ভাবে বানোয়াট গল্প বানাচ্ছেন।” রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল পূর্ণতা।
স্মরণ পেটে হাত ভাঁজ করে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আজকে ও সত্যি পূর্ণতা কে ফলো করেনি। কিন্তু ফলো না করেও দেখা পেয়ে নজরেই রেখেছে। এদিকে পূর্ণতা ওর সত্যি কথা বিলিভ করছে না তাই ও স্থির হয়ে পূর্ণতা রাগ হজম করল। পূর্ণতা রেগে আরো কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিল।
স্মরণ পূর্ণতাকে কথা শেষ করে চলে যেতে দেখে পিছনে ডেকে বলল,“ পূর্ণতা নেক্সট টাইম থেকে আমি তোমায় এক সেকেন্ডের জন্য ও নজরের বাইরে রাখব না।”
পূর্ণতা রেগে তাকাল স্মরণের দিকে। স্মরণ পূর্ণতার রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,“ তোমাকে রাগলে সুন্দর লাগে না বেশি। কিন্তু আমি তো তোমায় ভালোবাসি তাই রাগটাকে আপন করার চেষ্টা করতে হবে।”
বলেই স্মরণ হেঁটে চলে গেল।
পূর্ণতা ডিনারের সময় নিচে নেমে দেখল শাহিন আলম ও স্মরণ কি নিয়ে যেন খুব হাসিতামাশা করছে। পূর্ণতা সামনে পা বাড়াল না। ও নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে দুজনকে দেখছে। ওর মনে সন্দেহের দানা বাড়তে লাগল। স্মরণের কি মানুষ কে জাদু করার শক্তি আছে? আমার বাবার মতো রাগী গম্ভীর মানুষকে কীভাবে এতোটা হাত করল? বাবা স্মরণের সাথে এতো স্বাভাবিক হয়েছে?
যেন স্মরণ তার নিজের ছেলে। দেখে গা জ্বলে উঠল পূর্ণতার। নিচে না নেমে পূর্ণতা ফের উপরে উঠে এলো। সোজা প্রভাতের রুমে এসে থেমেছে।
রুমে প্রবেশ করে বিছানায় বসতেই পুরোনো অনেক স্মৃতি তরতাজা হয়ে উঠল। চোখের সামনে হাজারো স্মৃতি ভেসে উঠল। পূর্ণতা রুমের আনাচে কানাচে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিল চঞ্চল চোখে। সব কিছুই আগের মতো শুধু তুমি নেই।
পূর্ণতা চোখে জল জমে উঠল। ও বিড়বিড় করল,“ তুমি থেকে সব এলোমেলো হয়ে গেলেও আমি ভালোয় থাকতাম। সব ঠিক আছে শুধু তুমি নেই। তোমাকে হারানোর মতো ভয়ংকর কষ্ট আমি কখনোই পায়নি প্রভাত।”
পূর্ণতা চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল। দরজায় নজর পরতেই স্মরণ কে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে নিল। এইমাত্র না নিচে ছিল এখানে এলো কখন?
পূর্ণতা প্রশ্নবিদ্ধ চোখ এ তাকিয়ে আছে। স্মরণ ভেতরে ঢুকে এলো।
“ আপনি এখানে কি করছেন?”
স্মরণ দৃষ্টি ঘুরিয়ে বলল,“ তোমায় নজরে নজরে রাখছি। তখন কি বলেছিলাম ভুলে গেছো? ফলো না করেও তার ভাগীদার হয়েছি। আর তোমার পিছু থাকতে আমার বিরক্তি আসে না বরঞ্চ ভালোই লাগে।”
“ আপনি এইসব পাগলামী ছেড়ে রাজশাহী ফিরে যাবেন কবে?” গম্ভীর মুখে বলল পূর্ণতা।
স্মরণ বিছানায় বসতে এগিয়ে গেল। পূর্ণতা চিৎকার করে উঠল,“বাইরে আসুন।”
স্মরণ কোমর সোজা করে দাঁড়িয়ে বলল,“ ওকে ওকে দাঁড়িয়েই আছি, কুল। এখানে একটু বসলেই তোমার প্রেমিকের জায়গা আমি নিয়ে নিতে পারব না। এতো ভীতু কেন তুমি?”
পূর্ণতা শান্ত হয়ে বলল,“ আমি চাইনা তার জিনিস আপনি স্পর্শ করুন।”
“ আচ্ছা করলাম না।” গা ঝাড়া দিয়ে বলল।
পূর্ণতা বাঁকা চোখে স্মরণের দিকে তাকিয়ে বলল,“ এখানে থেকে যান। আপনার জন্য কি আমি নিজের বাসায় ও দুই মিনিট শান্তিতে থাকতে পারব না?”
“ তুমি এখানে এসে শান্তি কোথায় পাচ্ছ? কেউ শান্তিতে চোখের জল ফেলে? তোমার ভেতরে তো অশান্তি ভয়ে যাচ্ছে।”
“ আমার পার্সোনাল ম্যাটারে হস্তক্ষেপ করবেন না। সবকিছু কিন্তু ভালো লাগে না।”
পূর্ণতার রাগ দেখে স্মরণ কথা বাড়াল না। পূর্ণতা কে একা ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।
স্মরণ হুট করেই বাসা থেকে চলে গেছে। আজকে পঞ্চম দিন ছিল। স্মরণের নাম্বার টাও পূর্ণতা দের বাসার কেউ জানে না। পূর্ণতার মা বাবা স্মরণের চিন্তার খাবার গিলছে না। পূর্ণতা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে শান্তিতে বসে আছে। তার মানে আপদ বিদেয় হয়েছে। শান্তির একটা নিঃশ্বাস নিল পূর্ণতা। সারাদিন পেরিয়ে রাত নেমেছে ধরনীর বুকে।
রোজিনা বেগম স্মরণের রুমে গিয়ে দেখল স্মরণের প্রয়োজনীয় সবকিছু ফেলেই গিয়েছে। সেসব দেখে তিনি আরো বেশি দুশ্চিন্তা করতে লাগল।
তার দুশ্চিন্তা দেখে পূর্ণতা বাঁকা চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি দেখছি।
রোজিনা বেগম সোফায় স্বামীর পাশে বসে বললেন,“ ছেলেটা এভাবে না বলে হুট করে কোথায় চলে গেল? আমার তো খুব টেনশন হচ্ছে কোন বিপদ হলো না তো?”
শাহিন আলম বললেন,“ নাম্বার টাও নেওয়া হয়নি যে একটু কল করে খোঁজ নিব। এতো দিন ছেলেটা বাসায় থেকে গেল নাম্বার টাও নেওয়া হয়নি।”
তার কন্ঠে তীব্র আক্ষেপ। যেন নাম্বার না নিতে পেরে বড়ো অন্যায় করে ফেলেছে। পূর্ণতা অনেকদিন পর একটু শান্তি পাচ্ছে নিজের বাসায় একটু শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছে। ও কিচেনে থেকে একটা শসা ধুয়ে নিয়ে এলো। এরপর সোফায় বসে টিভি ছেড়ে দিল।
তারপর মায়ের দিকে বিরক্তিকর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,“ এতো টেনশন করবার কি আছে? হয়ত নিজের বাসায় ফিরে গেছে। তোমরা তো যাকে পাও মাথায় তুলে নাচতে শুরু করে দাও। কিন্তু সে তার রূপ দেখিয়ে চলে গেছে। এবার অন্তত মানুষ চিনতে শিখো।”
রোজিনা বেগম চিন্তিত পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে বললেন,“ছেলেটা তো রুমে নিজের সব কিছু ফেলে গেছে। এভাবে কি কেউ চলে যায়? ছেলেটার কোন বিপদ আপদ হলো নাকি আমার খুব ভয় লাগছে।”
শাহিন আলম বললেন,“ এখন কি করব পুলিশের কাছে যাব নাকি?”
বাবা মায়ের আলোচনা শুনে পূর্ণতা স্তম্ভিত। এদের মাথা কি একেবারে গেছে?
ওই লোকটার জন্য থানায় যাবে?
পূর্ণতা বাবার দিকে চেয়ে বলল,“ সামান্য বিষয় টাকে এতো জটিল কেন করছেন? এসব করার দরকার নেই।”
শাহিন আলম বললেন,“ করতে হবে আমাদের বাড়িতে ছিল আমাদের একটা দায়িত্ব আছে তো। এভাবে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে পারি না। স্মরণ কোথায়.. কেমন আছে? জানতে হবে তো।”
“ তাই বলে থানায়। আমি নাম্বারের ব্যবস্থা করছি। দয়া করে আপনারা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বাদ দেন। কোথাকার কে তার চিন্তায় মরে যাচ্ছে।”
অসহ্য চোখে পূর্ণতা বাবার দিকে থেকে চোখ সরিয়ে উঠে দাঁড়াল। একটু শান্তি নেই এই বাসায়। আপদ বিদেয় হয়েছে এখন আবার ওকে তার খোঁজ নিতে হবে। হায় কপাল।
পূর্ণতা রুমে এসে মায়ার নাম্বারে কল দিল। মায়া কল রিসিভ করছে না। দরকারে একটা কেও পাওয়া যায় না। পূর্ণতা মায়ার হাজব্যান্ড কে কল করল এবং তিনি দ্রুত কল রিসিভ করল। তিনি মায়ার কাছে ফোন নিয়ে দিল। এখন পূর্ণতা নাম্বার চাইতে হাঁসফাঁস করছে। কি মনে করবে এভাবে নাম্বার চাইলে?
বাবার বাড়াবাড়ি থামাতে তো নাম্বারের ব্যবস্থা করতেই হবে নয়ত দেখা যাবে সত্যিই থানায় চলে যাবে। পূর্ণতা জানে স্মরণ ঠিক আছে শুধু শুধু এসব করে ঝামেলা বাড়ানোর কি দরকার?
মায়ার কাছে পূর্ণতা যখন বলল,“ মিস্টার স্মরণের নাম্বার টা একটু দিবি?”
মায়া বলল,“ ওকে আমি নাম্বার মেসেজ করে পাঠাচ্ছি।”
পূর্ণতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মেসেজের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়া এতো সহজেই নাম্বার দিয়ে দিবে ভাবেনি। ওকে কিছুই বলল না? অদ্ভুত! পূর্ণতা মায়ার বিহেভ এ কিছু থতমত খেয়ে গেল। যেন মায়া আগে থেকেই জানত পূর্ণতা স্মরণের নাম্বার চাইবে।
পূর্ণতা নাম্বার নিয়ে নিচে এসে দেখে স্মরণ সোফায় আরাম করে বসে আছে। শাহিন আলম তাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করছে।
পূর্ণতা স্মরণ কে দেখে তেরে এগিয়ে গেল। শাহিন আলম এবং রোজিনা বেগম মুখ লুকানোর চেষ্টা করছে। পূর্ণতার কথা দুজনের একজন ও পাত্তা দেয়নি। এখন পূর্ণতার কথাটাই সঠিক হয়েছে স্মরণ ভালোই আছে আজ সারাদিন সে বন্ধুর বাসায় ছিল।
পূর্ণতাকে রেগে এগিয়ে আসাতে দেখে স্মরণ কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। পূর্ণতা বাবা মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে স্মরণ দিকে দৃষ্টি স্থির করে বলল,“ কি বলেছিলাম? এই লোকটার কিছুই হয়নি অযথা বাড়াবাড়ি করো না। নাম্বারের জন্য মরে যাচ্ছিলে। একজন তো থানায় গিয়ে জিডি পর্যন্ত করতে লাফাচ্ছিল। উনি দিব্যি বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়েছে আর উনারা তাহার চিন্তায় পেশার হায় হচ্ছিল।”
রাগে গজগজ করে পূর্ণতা জায়গা ত্যাগ করল।
স্মরণ স্তব্ধ হয়ে পূর্ণতা রাগ দেখল।
শাহিন আলমের দিকে তাকিয়ে স্মরণ বলল,“ সরি আঙ্কেল আসলে আমার ফ্রেন্ডের বউয়ের সিজার ছিল ভোরেই কল দিয়ে জানাল রক্তের প্রয়োজন। এজন্য তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গিয়েছিলাম। রক্ত দিয়েও ওর স্ত্রীকে বাঁচাতে পারলাম না। তাই সারাদিন বন্ধুর সাথেই ছিলাম। ওর এই অবস্থায় ওকে ফেলে আসতে পারিনি।”
শাহিন আলমের প্রথমে বন্ধুর বাসায় ছিল শুনে মনে মনে রাগ লাগছিল। ছেলেটার জন্য সারাদিন এতো দুশ্চিন্তা করলাম আর ছেলেটা বন্ধুর বাসায় গিয়ে ফুর্তি করেছে?
কিন্তু এখন স্মরণের কথা শুনে তার মন নরম হয়ে উঠল।
তিনি বললেন,“ বন্ধুর দুঃখের সময় তার পাশে ছিলে ভালো কাজ করেছ।”
রোজিনা বেগম বললেন,” তোমার জন্য চিন্তা করেছি অনেক। আমাদের বাসায় আছো হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই কোথায় গেলে। এজন্য ভয় করছিল কোন বিপদ হয়ে গেল নাকি।”
পূর্ণতা পর্ব ২৭
স্মরণ অপরাধী কন্ঠে বলল,“ আপনারা অনেক ভালো মানুষ আন্টি। আপনাদের মতো মানুষ আমি খুব কমই দেখেছি। আপনার বাসায় এসেছিলাম আপনাদের মেয়ের মনে একটু জায়গা তৈরি করতে। কিন্তু সেটা আমি পারব কিনা জানিনা। তবে আপনাদের ভালোবাসার করি আজীবন মনে রাখব।”