পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩৩

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩৩
সাদিয়া আক্তার

শাওয়ারের নিচে বসে আছে পুনম। গা ঘিনঘিন করছে তার মানুষ রুপি হায়েনাদের থাবা বুঝি এমনই অস্বস্তিকর বেদনার। প্রায় একঘণ্টা শাওয়ারের নিচে বসে থাকার পর হঠাৎই পুনমের কিছু মনে পড়ল।
কাল রাতে শাড়ি কিভাবে দিয়ে গেলো শের “এ আলী সাহেব আর সে বাসার ভিতরে ঢুকলই বা কিভাবে। আজকে অন্ধকারে যে আওয়াজটা পুনমের শুনেছিল সেরকমই আওয়াজ পুনম আগেও শুনেছে এবং কন্ঠটা অনেকাংশে চন্দ্র ভাইয়ের সাথে মিলে কেনো?? ভেবেই আরো এলোমেলো হয় পুনম। দীর্ঘ শাওয়ার শেষে দ্রুত ভেজা কাপড় পাল্টে ঘর থেকে বের হয়।
উদ্দেশ্য চন্দ্র ভাইয়ের ঘর আজ সেখানে কিছু খুজবে তবে চন্দ্রের ঘরের দরজায় ধাক্কা দিলে বুঝতে পারে সেটা লক করা অগত‍্যা পুনম নিজের ঘরে চলে যায়।

দীর্ঘক্ষণ ভেজার কারণে শরীর কেমন ম‍্যাজম‍্যাজ করছে কান্নার কারণে মাথাটাও ভাড় হয়ে আছে। তাই কেনো কিছু না ভেবে চুপচাপ বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয় মুহুর্তের মধ‍্যেই নিদ্রা ভর করে পুনমের চোখে।
বিকাল পাচঁটার দিকে প্রধান অতিথি আসলে তাকে অভ‍্যর্থনা জানায় ও তার বক্তিতার মাধ‍্যমে শেষ হয় অনুষ্ঠান। পুরো অনুষ্ঠানে চন্দ্র ছিলো নিশ্চুপ রিশানকে দায়িত্ব দিয়ে সে অন‍‍্য কাজ করেছে। তবে চোখে চোখে একজনের উপর ঠিকই নজর রেখেছে ধৈর্য্য ধারন করেছে কখন অনুষ্ঠান শেষ হবে আর কখন সে তার কাজ করবে অপেক্ষা ফল বুঝি সুমিষ্ট হয় তাইতো ঘন্টা দুইয়ের পরেই নিজের মোক্ষম সময় পেলো চন্দ্র।
পুরো ভার্সিটি খালি হলেও অনেকে এখনো আড্ডায় ব‍্যস্ত।
— দোস্ত আজকে টার্গেটটা মিস হলেও যেই মেয়েটার সাথে ধাক্কা লাগল তার গায়ের রঙ সুন্দর না হলেও ফিগার মাস্ত,, পেটটা একদম নরম তুলতুলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বলেই ছেলেটা হাসা শুরু করল। ওর কথা শুনে তার সাথে থাকা আরো ছেলেরাও হাসা শুরু করল একেরপর এক মেয়েলি কাঠামোতে অশ্লীল কথা বার্তা বলতে লাগল।
তাদের ধ‍্যান নেই তাদের পিছনে অন্ধকারে বসে যে তিনজন পুরুষের রক্ত টগবগ করছে। হাত নিষপিস করছে। আড্ডা অনেক্ষণ চলার পরে যে যার মতো চলে যেতে নিলে চন্দ্র লোকটিকে পিছন থেকে ডাক দেয়। লোকটি সেদিকে তাকাতে লোকটি মুখে কিছু স্প্রে করতে সেকেন্ডের মাথায় লোকটি ঢলে পরল।
— ভাই এই শা* তো আমগোর ভার্সিটির না আজকে প্রধান অতিথি আসছে ওর চ‍্যালা মুন্ডা।
— সে যেই হোক আমার অমূল্য সম্পদে হাত দিয়েছে দীর্ঘ দশ মিনিট আমার অন্তরদহনের কারণ ও ওকে ছেড়ে দেই কি করে।

চন্দ্র ইশারা করতেই রাব্বি সহ আর দুইজন জুনিয়র লোকটিকে উঠিয়ে নিল গাড়িতে। ক্র‍্যাক করে গাড়িটা সাহরান”স কোচিং সেন্টারের সামনে থামতেই রাব্বিরা লোকটি ধরাধরি করে বেজমেন্টে নিয়ে যায়। কোচিং সেন্টারের মালিকানা চন্দ্র নিজে তিতলা বিল্ডিংটা পুরোটাই চন্দ্রের তিনতলায় চন্দ্রের অফিস কক্ষ আর বাকী দুইতলায় ক্লাস রুম।
লোকটির যখন জ্ঞান ফিরে নিজেকে বাধা অবস্থায় পায় হাত পা এবং চোখটাও বাধা,,
— এই কেরে মরার পাখনা গজিয়েছে নাকি যে আমাকে ধরে এনেছিস কাকে ধরে এনেছিস জানোস তোরা??
— জানিনা কৃপা করিয়া আপনার পরিচয় বর্নণা করুন
শিহাবের ব‍্যাঙাত্বক কথায় রিশান রাব্বি সহ সবাই মিটিমিটি হাসে একা চন্দ্র নিশ্চুপ সে একদৃষ্টিতে লোকটির হাতের নখের দিকে তাকিয়ে আছে। এই নখ দিয়েই তো তার জোহরার পেটে আচর কেটেছিল। তার জোহরার পেটের চামড়া ছিলে রক্ত বের হয়েছিল। সেই রক্তক্ষরন তো তার বুকেও হয়েছিল তার জোহরার অশ্রু সেই পীড়া আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল।
চন্দ্রের ধ‍্যান ভাঙ্গে লোকটির থ্রেড মার্কা কথায়।

— তোর ঐ চাচা আমার বা*** ছিড়বে।
বলেই লোকটার বুক বরাবর লাথি মারে চেয়ার সহ লোকটা পরে যায় গলায় পারা দিয়ে বলে
— এই এই তুই মায়ের পেটে জন্ম নিস নাই। যেই মায়ের গর্ভে ছিলি যার বুকের দুগ্ধ খেয়ে নিজেকে পরিপুষ্ট করলি। সেও তো একজন নারী ছিল সেরকমই একজন নারীকে হেনস্থা করতে বুকটা একটুও কাপলো না। আজ তোর এই বুক চিরে দেখব সেখানে কতটা সাহস
চোখ বাধা পট্টির আড়ালে লোকটার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পরছে। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতেও পারছে না।
চন্দ্র তার গলা থেকে পা সরায় রাব্বি চেয়ার উঠিয়ে বসায় চন্দ্র তার সামনে বসে ঢকঢক করে পানি খায়। হাতের ইশারায় রাব্বিকে কিছু আনতে বললে রাব্বি একটা নকপ্লাস আর ব্লেড নিয়ে আসে।
চন্দ্র লোকটির হাতে ধরে স্লাইড করতে করতে মোলায়েম স্বরে বলে — এই হাত আজ ভুল জায়গাই পরেছে,, একটা নখ উঠিয়ে নিতে নিতে বলল — এই নখ আজ ভুল জায়গাই পরেছে,,
নখ উঠিয়ে নিতে লোকটি গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে উঠল।।
— তোদের মতো স‍্যাডিস্ট যারা বড় ছোট বাচ্চা মানে তাদের কঠিন শাস্তি হওয়া উচিৎ আজ তোকে সেই শাস্তি আমি দিব। আবার আরেকটি নখ উঠাতে উঠাতে বলল — তেরী ইয়‍্যে নাখ বহুত বাড়া গুস্তাখি কি ইয়‍্যে নখ মুঝে দে দে হারুন ইয়‍্যে নখ মুঝে দে দে,,,

বলেই পরপর দুই হাতের আঙ্গুলের নখ উঠিয়ে নিলো সেখান দিয়ে গলগল রক্ত পরছে। আর লোকটি গগনবিদারী চিৎকার দিচ্ছে তবুও যেনো চন্দ্রের থামার নাম নেই সে দাড়িয়ে লোকটার অন্ডোকোষ বরাবর লাথি মারল। পরপর দুইটা লাথি মেরে বলল — যেই পুরু*** বরাই করে চলিস সেটাই ফুলস্টপ করে দিলাম।
পকেট থেকে একটা ইনজেকশন পুশ করে দিতে লোকটা আবারও অজ্ঞান হলো। রাব্বিরা মিলে তাকে আবার ধরাধরি করে গাড়িতে উঠিয়ে আবার ভার্সিটির পিছনে ঝোপে ফেলে দিয়ে আসে।
চন্দ্রের রাগ মনে হয় এখনো কমছে না সামনের চেয়ারে আবার লাথি মারে। শিহাব রিশান এতোক্ষণ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে চন্দ্রের কারসাজি দেখছিল এখন না পেরে চন্দ্রকে ধরাধরি করে বসায়।
— ঐঐ বা** কেনো যেতে দিয়েছি জানিস কারণ ও এখানে থাকলে আমার হাতে মৃত্যু নিশ্চিত ওর রক্তে নিজের হাত কলুষিত করতে চাইনি তাই ওকে ওর প্রাপ‍্য শাস্তি দিয়ে ছেড়ে দিয়েছি।
— হ‍্যা হ‍্যা এখন তুই শান্ত হো
— শান্ত হব আমার কলিজায় হাত দিয়েছে ও আর আমি শান্ত হব। আমি শান্তই আছি নাহলে ওর মৃত্যু অবধারিত ছিলো।
বলেই রিশানের আনা পানির বালতি থেকে মগ ভর্তি পানি নিয়ে ঝপঝপ করে নিজের মাথায় ঢালতে শুরু করে।।

গভীর ঘুমে পুনম মুক্তির অনবরত দরজা ধাক্কায় ঢুলতে ঢুলতে গেট খুলে
— পূর্ণ চাচী,,,,,
বলেই হাপাতে থাকে। চাচী কথাটা শুনেই পুনমের চোখের ঘুম উড়ে যায় ঢোক গিলে বলে — আম্মুর কি হয়েছে আপু??
— চাচী ব‍্যাথায় কেমন যেনো করছে বাসায় বাবা,, চাচা কেউ নেই,,
মুক্তির কথা শেষ হওয়ার আগেই পুনম দৌড় দেয় বাবা মায়ের ঘরে। যেয়ে দেখে রোজিনা বেগম ব‍্যাথায় কাতরাচ্ছে চাদনী বেগম তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে।
— আপু চন্দ্র ভাই নাহলে রিশান,, শিহাব ভাই কাউকে ফোন করো।
— করেছি তারা কেউই ফোন ধরছে না। আব্বুর চাচার আসতে আরো সময় লাগবে তারা বেড়িয়ে পরেছে।
পুনম কাদতে কাদতে নিজের ঘরে যেয়ে রিশানের নাম্বারে কল দেয়। পরপর দুইবার কল দিলেও যখন ধরে না তখন মুক্তির থেকে চন্দ্রের নাম্বার নিয়ে চন্দ্রের নাম্বারে কল দেয়।।

মাথায় পানি ঢালছিল চন্দ্র পকেটে ফোন বাজতেই ঘোর কাটে মগ রেখে গামছা দিয়ে হাত মুছে ফোন বের করতেই দেখে পুনমের নাম্বার থেকে কল এসেছে।
ঢোক গিলল চন্দ্র এতোক্ষণের রাগটা যেনো বিলীন হলো নিমিষেই ভয় ঢুকল চন্দ্রের মনে আজ ওয়াশরুমে তার কথায় পুনম কিছু বুঝে ফেলেনি তো?? চন্দ্রের চুপসানো চেহারা দেখে শিহাব জিজ্ঞাসা করে — কে ফোন দিয়েছে??
— পুনম
চন্দ্রের কথা শুনে ভ্রু কুচকায় দুই ভাই পুনম কোনোকালে চন্দ্রকে ফোন দেয়ার মতো মেয়ে না।
রিশান কি মনে করে নিজের ফোন বের করে। দেখে পুনম তাকেও ফোন দিয়েছে পুনম মুক্তি সহ ছাব্বিশটা মিসড কল।

— চন্দ্র দ্রুত উঠা দেখ আমাকেও ফোন দিয়েছিল হয়তো কোনো বিপদ হতে পারে,,,,,
রিশানের কথায় চন্দ্র দ্রুত কল রিসিভ করে অপর পাশে থেকে পুনমের কান্নাভেজা কন্ঠ ভেসে আসে
— চন্দ্র ভাই আআম্মু কেমন জানি করছে,,,,
কোনোরকম এইটুকুই বলতে পারল। — একদম ভয় পাসনা আমি আসছি,,, বলেই ফোন কেটে দ্রুত নিজের বাইকের কাছে গেলো। তার পিছু পিছু শিহাব রিশানও বসল।
পনেরো মিনিটের রাস্তা আট মিনিটে পাড় করল। বাসায় ঢুকে দেখে রোজিনা বেগম ব‍্যাথা কাতরাচ্ছে পুনম পাশে বসে কাদছে চাদনী বেগম তাদের সামলাচ্ছে মুক্তি একটু পরপর ফোন দিচ্ছে।
— আব্বা চন্দ্র চাচীকে একটু ধর,,
— ভাই আমি আম্বুলেন্স কল করেছি আসছে,,,
চন্দ্রকে দেখে বলল চাদনী বেগম। শিহাব রিশান চন্দ্র রোজিনা বেগমকে ধরাধরি করে নামায়। ততক্ষণে অ‍্যাম্বুলেন্স এসে পরেছে।।
অ‍্যাম্বুলেন্সে সবাই উঠে বসে সাভার এনাম মেডিকেলে থামে দ্রুত গতিতে ট্রিটমেন্ট স্টার্ট করে রোজিনা বেগমের।
ওয়েটিং রুমে বসে আছে পুনম অঝোরে কাদছে তাকে মুক্তি সামলাচ্ছে পুনমের এই কান্নাও চন্দ্রের পছন্দ হলো না তবুও কিছু বলল না চাদনী বেগম মনে মনে দোয়া পরছে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার আসল — এখানে রোগীর সাথে কে আছেন,,,??
চন্দ্র এগিয়ে যায় — আমি

— অবস্থা ভালো নরমাল ডেলিভারী সম্ভব না দ্রুত পানি ভাঙছে সি সেকশন করাতে হবে।।
— আপনাদের যেটা করা লাগে করুন রোগীর ভালোর জন‍্য যা করা লাগে করুন আমরা দুইজনকেই সুস্থ চাই,,,
— তাহলে দ্রুত রিসিপশনে কথা বলুন বাকি প্রসেস তারাই বলবে।
রিশানকে এখানে রেখে চন্দ্র শিহাব যায় রিসিপশনে। আধঘন্টার মধ‍্যে রোজিনা বেগমের সিজারের সকল ব‍্যবস্থা করে তাকে অটিতে নিয়ে যায়।
ততক্ষণে পারভেজ সাহেব ও কামরুল সাহেব এসে পরেছে মিরাজ সাহেবদের খবর দেয়া হয়েছে তারা আসছে।
বাবার বুকে মাথা ঠেকিয়ে কাদছে পুনম। পারভেজ সাহেব অটি রুমের দিকে তাকিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলায়। পিছন থেকে রুপশা ও বাবার বুকে ঝাপিয়ে পরে চমকে ওঠে পারভেজ সাহেব পরেই বড় মেয়েকেও সামলে নেয়।।
— কি অবস্থা রিশান??
— সি সেকশন করানো লাগছে,,,

চন্দ্র রিশান সবার জন‍্য খাবার আনতে গিয়েছে।। রাত এগারোটা এখনো কারোই খাওয়া হয়নি।।
দশ মিনিট পর মহিলা ডাক্তার বের হয় হাসি মুখে কংগ্রাচুলেট করে বলল — ইটস বেবী বয়,, আলহামদুলিল্লাহ্ দুজনেই সুস্থ। বেবীকে দেখতে পারবেন একটু পরেই পরিষ্কার করে দেয়া হবে। বলেই চলে যায়। ডাক্তারের কথা শুনে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে
মিনিটের মাথায় সাথা কাপড়ে মুরানো ছোট্ট পাখিটাকে নিয়ে আসা হয়।
নার্স পারভেজ সাহেবের কোলে দিতে নিলে পিছন থেকে পুনম বলল — আব্বু আমি নেই,,,
মেয়ের কথায় সায় জানিয়ে সরে যায় পারভেজ। পুনম ভাইকে কোলে নেয় ধবধবে সাদা একটা ছোট্ট মুখ খানা পুনমের মনে শীতলতা বাড়িয়ে দেয়। ভাইয়ের হাত ধরে বিড়বিড় করে বলে

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩২

— শোকরিয়া খোদা তোমার কাছে শোকরিয়া তুমি আমার চাওয়া পূরণ করেছ।
রুপশা ভাইয়ের কাছে আসতে পুনম বলে — আপা দেখ বড় বড় চোখ করে সবাইকে দেখছে
পুনমের কথা শুনে সবাই একজোট হাসে। দূর থেকে চন্দ্র নিজের ভবিষ্যত ইম‍্যাজিন করে।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৩৪