পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৬১

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৬১
সাদিয়া আক্তার

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে চিলেকোঠায় আসর জমেছে বড়রা সবাই ঘুম ইহান লিমনরা চলে যেতে চাইলেও আজ থেকে গেছে বলা চলে রানিবানু রেখে দিয়েছে এখন চিলেকোঠায় তিনিই সবাই বসিয়েছে। সবাই মহানন্দে গল্প করলেও চন্দ্র বিরক্ত
— এই রানি বুড়ি তাড়াতাড়ি কাজের কথা সারো রাত হয়েছে ঘুমাব
— হ হ তোমার যে কি ঘুম হইব তা আমি ভালো করেই জানি
তার কথায় পুনম লজ্জা পেলেও চন্দ্র নিশ্চুপ তবে এখনো মুখশ্রী জুড়ে বিরক্তির আভাস।
— তা বইন এহন লজ্জা না পাইয়া বলো ঐ শয়তানডা কি কইছে
পুনম রেষ্টুরেন্টে হওয়া কথাগুলো বলল সাথে এও বলল লোকটা আজো বিয়ে করেননি। সবাই পুনমের কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল

— লোকটা খুব ভালোবাসতো বেলা ফুপিকে
লিমনের কথায় তাল মিলিয়ে ইহান বলল — আসলেই তবে সময় থাকতে সে হাত ধরতে পারেননি।
সবাই তার কথায় তাল মিলিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। অন‍্যান‍্য কথাও চলতে থাকল মুক্তি রুপশা কাল চলে যাবে তাই পুনম তাদের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে লিমন ইহান শিহাব রাইয়‍্যান একসাথে কথা বলছে। রিশান ঝিনুক একসাথে নিজেদের মধ‍্যে কথা বলছে রানি বানু সবার দিকে তাকিয়ে অশ্রুসিক্ত হাসল তার মেয়ের সংসারটা এভাবেই ভরপুর থাকুক সুখে থাকুক।
রানি বানুর একদিকে চোখ যেতেই বলল — কাইল সকালে তাইলে মিরাজ ও রমিজের লগে কথা কইতেই হইব।
— কি কথা নানু
রিমির কথায় সবাই রানি বানুর দিকে তাকায়। রানি বানু রিশান ও ঝিনুকের দিকে তাকিয়ে বলল

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— ঐ দুই ছেমরা ছেমরির
ঝিনুক তড়াক করে সরে যেতে নিলে রিশান আটকে দিলো রানি বানুর উদ্দেশ্যে বলল
— রানি বুড়ি নানু তোমার চরণ দুটি আমার সামনে দাও আগে চুম্মা দেই। আমার এতোদিনের ইচ্ছা পূরণ করবা তুমি
রিশান কথায় সবাই হেসে উঠল তখনই চন্দ্র বিরক্তি স্বরে বলল — আজ এই অব্দি গল্প সমাপ্ত করো ঘুম পেয়েছে
— ভাইয়া তুমি গেলে যাও পুনম থাকুক
মুক্তির কথা শুনে চন্দ্র লাফ দিয়ে ওঠে পুনমকে কোলে তুলে যেতে যেতে বলল — হো আর বাকি রাত বাপ্পারাজের মতো বেদনায় কাটাই,,,,
সবাই এবার উচ্চস্বরে হেসে উঠল। — তুমি চন্দ্রকে এভাবে ক্ষেপাও কেনো??
ইহানের প্রশ্নে মুক্তি বলল — ভাইকে কোনো কিছুতে বিরক্ত না করা গেলেও পুনমের ব‍্যাপারটা নিয়ে খুব বিরক্ত করা হয়।
ছাদের গেটের সামনে আসতেই পুনম চন্দ্রর গলা জড়িয়ে ধরল। চন্দ্র দিকে তাকিয়ে ধীর স্বরে বলল

— আমার দশ বছর বয়সের ছবি থেকে শুরু করে প্রত‍্যেক বছরের ছবি আপনার কাছে কিভাবে আসল??
— জোহরা তাহলে সিক্রেট লকার অপেন করেছে
মাথা ঝুকায় পুনম চন্দ্রর গলার দিকে তাকিয়ে বলল — আমার মতো কালুনির প্রতি এতোটা ভালোবাসা
— কে বলেছে আমার জোহরা কালো আমার জোহরা তো শ‍্যামবতি। শ‍্যাম বর্ণের এক মায়াবী রমনী আর রুপবতীরা সহজেই হাসিল হয় তবে মায়াবতীরা অনেক সাধনার হয়।
পুনম চন্দ্রর গলায় মুখ গুজে কেদেঁ দেয়। চন্দ্র ঘরে এসে খুব সাবধানে পুনমকে বিছানায় শোয়ায় চোখ দ্বারা অশ্রু শুষে নেয়
— উহু জোহরার মিষ্টি হাসি পছন্দ এই নোনতা অশ্রু নয়।
মিষ্টি করে হাসে পুনম চন্দ্র বিনা নোটিশে দখল করে তার জোহরার ওষ্টপুট।
চন্দ্রের রুক্ষতায় কেটে গেলেও আজ যেনো কেউ কাউকে ছাড়তে নারাজ ডুবে গেলো একে অপরের ভালোবাসার জোয়ারে।
রাত্রির কতটা প্রহর বলতে পারে না চন্দ্র চোখ মেলে তাকার বুকে থাকা পুনমকে আলগোছে বিছানায় শুয়িয়ে উঠে দাড়ায় বিছানার তোশোকের নিচে থেকে একটা ডাইরি বের করে। বারান্দায় বসে ফ্লোরে ডাইরির ভাজ থেকে একটা কলম নিয়ে লেখা শুরু করে

“” আমি চন্দ্র ” সাহরান আলী চন্দ্র ” বংশের বড় ছেলে গম্ভীর তবে সবার আদরের। কাজের উদ্দেশ্যে গ্রাম থেকে ঢাকায় পর্দাপণ করেছিলাম সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শহরের নতুন পরিবেশ খাপ খাওয়াতে কষ্টকর হলেও মেনে নিলাম আস্তে ধীরে দিনকাল ভালোই যাচ্ছিল আম্মুর লক্ষি ছেলে আব্বুর কম্পিটিটর সব মিলিয়ে হাসি খুশী জীবন।
অষ্টম শ্রেণির পর স্কুল পরিবর্তন করা লাগবে কারণ ঐ স্কুল অষ্টম শ্রেণি পযর্ন্তই ছিলো আবার ভর্তি হলাম নতুন স্কুলে। প্রথমে খারাপ লাগলেও পরে ধীরে ধীরে মানিয়ে নিলাম তখন হঠাৎই আব্বুর দোকানে আগুন লাগল আগুনে পুড়ে গেলো সব কিছু একটা পরিবারের ভবিষ্যত স্বপ্ন আশা সবকিছুই।
পরিবারে নেমে এলো অন্ধকার সেই অন্ধকারে এগিয়ে এলো আমার ছোট চাচা পারভেজ। সেই পরিবারের এমন অবস্থায় আমিও ঠিক করলাম একটা টিউশনি করাব ক্লাস নাইনে পড়ুয়া বাচ্চাকে কে দিবে টিউশন তবে একদিন স্কুল থেকে বেড়োনোর সময় পিছন থেকে প্লে তে পড়ুয়া একজন বাচ্চার গার্ডিয়ান ডাক দিল

— তুমি চন্দ্র তাইতো বাবা
— জ্বি আন্টি
— শুনেছি তুমি টিউশনি করাতে চাও
চন্দ্র তাকাতেই বলল — আমি তোমাদের পাশে বিল্ডিংয়ে থাকি আমার মেয়ের কাছেই শুনলাম আমার মেয়ে তোমার ক্লাসেই পড়ে মাইশা
— ওও জ্বী আন্টি বুঝেছি
— শুনেছি তুমি ক্লাস টপার তাই আমি চাই আমার রিকুটাও তোমার কাছে পড়ুক।
টিউশনি পাওয়ার আনন্দে বেশ খুশী হয় চন্দ্র বাসায় গিয়ে দৌড়ে মায়ের কাছে জানায় কামরুল সাহেব ও চাদনী বেগম রাজি হয়না তবুও পরিস্থিতিকে মেনে রাজী হয় কারণ ততোদিনে চন্দ্র দুইমাসের বেতন আটকে গেছে। পারভেজ সাহেবের পক্ষে এতো টানা সম্ভব হবে না ভেবে তারা তাকে পড়াতে দেয়।
চন্দ্র ও টিউশনি শুরু করে বাচ্চাটাকে পড়ানো শুরু করি প্রথম মাস ভালো গেলেও পরে আমাদের ক্লাসের মাইশা পড়ানোর সময় আমার পাশে এসে বসে থাকতো অস্বস্তি লাগলেও কিছু বলতাম না ইগনোর করতাম। ধীরে ধীরে মেয়েটার অত‍্যাচার বাড়তে লাগল তবুও চুপচাপ সব সয়ে যেতে লাগলাম কিছু বললাম না কারণ টিউশনিটা আমার দরকার সেটার টাকা দিয়েই স্কুলের বেতন দিতাম।।
এভাবেই দিন যেতে লাগল একদিন পড়াতে যেয়ে দেখি আন্টি বাসায় নেই রিকু আর মাইশা একা ভয় লাগল মনে তবুও রিকুর রুমে গিয়ে তাকে পড়াতে লাগলাম।
পড়ানো শেষে চলে আসতে নিলে পেছন থেকে গেঞ্জি টেনে ধরল মাইশা।

— কি হয়েছে মাইশা এভাবে টানলে কেনো??
— আমি তোমাকে এতো পছন্দ করি চন্দ্র সেটা কি তুমি বুঝ না
— দেখ মাইশা এটা ঠিক না আমি কোনো দিন এরকম ভাবিনি তোমাকে নিয়ে
মাইশা চন্দ্রর কাছে গেলো খুব কাছে চন্দ্র ধাক্কা দিলেও সরল না হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরল। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলাম তবে পারলাম না শুরু হলো ধস্তাধস্তি এর মধ‍্যে গেট খোলা পেয়ে আন্টি ভেতরে চলে আসল তাকে দেখে মাইশা আমার নামে যতখুশি অপবাদ দিতে লাগল
কন্ঠ নালি থেকে একটা শব্দও বের করতে পারলাম না। চিল্লাচিল্লি শুনে সবাই বের হলো সবাই ক্ষেপে গেলো আমার উপরে কেউ কেউ ক্ষোভ মিটাতে দুই চারটা থাপ্পড় ও দিলো। সবাই ঠিক করল মাইশার সাথেই আমার বিয়ে দিবে
তখনই কোথা থেকে ফেরেশতা হিসেবেই আম্মু আব্বুর সাথে আসল আমার চাচা পারভেজ। সাথে আমাকে ঝাপটে ধরল ছোট্ট দুটি হাত সেই হাতের ছোয়ায় নিজেকে কেমন শান্ত মনে হলো কেদেঁ কেদেঁ সবাইকে বলল তার চন্দ্র ভাই ভালো।
পারভেজ চাচা কাউকে কোনো জবাব না দিয়ে হাত টেনে নিয়ে আসল। সাথে মহিলাটিকে এও বলল — আমাদের ছেলে আপনার মেয়ে মনে রাখবেন।

সেই কথাটাই মহিলাটিকে চুপ করানোর জন‍্য যথেষ্ট। তবে শুরু হলো আমার ডিপ্রেশন ক্লাসে সবাই আঙ্গুল তুলে বলত আমি রেপিষ্ট। টিচারদের চোখে মনি আমিটাকে কেউ দেখতে পারত না। কেউ বন্ধু রইল না। তখনই সঙ্গী হিসেবেই আসল একজন যার পাল্লায় পরে ড্রাগের নেশায় নিজের ডিপ্রেশন ভুলতে লাগলাম অপমান ভুলতে লাগলাম। এমনো দিন গেছে আমি অপমানের কথা মনে হলে সুইসাইড করতে যেতাম অনেক দিন আম্মুর চোখে পড়ায় বেচে যায় ঘরে। কোনো রকম এস এস সি পরীক্ষা দিলাম আম্মুর দিকে তাকিয়ে।
একদিন রাতে নেশায় ডুবে আমিটা যখন ঘরে পৌঁছালাম দরজা খুলল ছোট্ট পাখিটা।
আঙ্গুল তুলে শাষনের স্বরে বলল — চন্দ্র ভাই এতো দেরী করলে কেনো পচা চন্দ্র ভাই তুমি জানো বড় চাচী তোমার জন‍্য কাদে অনেক অনেক ।। নেশাক্ত চোখে সেদিন ঐ পিচ্চিটার কথায় কি হলো বুঝলাম না সারারাত মায়ের কোলে কাদতে লাগলাম আর বলতে লাগলাম এখানে থেকে। এরপরেই চলে আসলাম সাভারে দিন কাটতে লাগল তবে পিচ্চিটাকে ভুলার বদলে আরো আকরে ধরতে লাগলাম।।

তবে যত বড় হতে লাগলাম পিচ্চিটা আমার থেকে দূরে যেতে লাগল। বুঝতাম মেয়েটা সবার কটুক্তি থেকে নিজেকে বাচানোর জন‍্যই গুটিয়ে নেয়। তখনই চাচাকে বললাম আমার পুনমকে চাই সেদিন চাচার চোখে খুশীর অশ্রু দেখতে পেলাম।। তবে আমার পথে সবচেয়ে বড় বাধা সে নিজেই তাই তাকে পাওয়ার সকল পন্থা অবলম্বন করলাম। পেয়েও গেলাম।।।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৬০

লেখা শেষে চন্দ্র ডাইরিটাতে আগুন ধরিয়ে দিলো। জ্বলন্ত আগুনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল — মা বোন ও জোহরা বাদে পৃথিবীর সকল নারী এই চন্দ্রর জন‍্য নিষিদ্ধ।

পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব ৬২