প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪২

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪২
Writer Mahfuza Akter

সন্ধ্যা নেমেছে।
দিগন্তজুড়ে গাঢ় নীলের চাদরে ঢেকে গেছে আকাশ। বাতাসে হালকা শীতের ছোঁয়া। সৌহার্দ্যের ফিরতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি। বাড়ি নিস্তব্ধ।
তরী নিঃশব্দে পা ফেলে এগিয়ে গেল মালিহার ঘরের দিকে। ঘরের দরজা খোলা। ভেতরে বিছানার এক কোণে মালিহা বসে আছেন। ল্যাম্পের মৃদু আলোয় কাঁথা সেলাই করছেন নিঃশব্দে। তার লম্বা চুলগুলো খোলা, ঝরে পড়েছে পিঠ বেয়ে—মেঝে ছুঁয়ে বসে আছে যেন। আঙুলের নিপুণ স্পর্শে সুতোর ফোঁড় উঠছে, নেমে যাচ্ছে, আবার উঠছে—ঠিক যেন মনের গভীরে জমে থাকা না বলা কথাগুলোর মতো।

তরী এগিয়ে গিয়ে পিছন থেকে মালিহাকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ সাড়া পেয়ে মালিহা সামান্য চমকে উঠলেও মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
তিনি জানেন—এ শুধু তরীর স্পর্শ নয়, এটা তার অস্থির আত্মার জন্য এক শান্তির আশ্রয়।
তরী কাঁথার পাশে বসে পড়ল। মাথা হেলিয়ে দিল মালিহার কাঁধে। দীর্ঘ এক নিশ্বাস ফেলে সে বলল,
“তোমার গা থেকে এত মিষ্টি একটা গন্ধ আসে, ছোট মা… যেন মায়ের গায়ের ঘ্রাণ। মা বলতে যে গন্ধ কল্পনা করি, ঠিক তাই।”
মালিহার ঠোঁটে একটুখানি হাসির রেখা ফুটে উঠল।
কাঁথায় ফোঁড় তুলতে তুলতে শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“হয়তো তাই।”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

তরী একটু চুপ করে রইল। তারপর ধীরে গলায় বলল,
“জানি না কেন, এই গন্ধটা শুধু তোমার গা থেকেই পাই। কই, আমার মায়ের গা থেকে তো আসে না!
তবে তিনি তো কখনো জড়িয়ে ধরেননি,
তার কাছে ঘেঁষতেও তো দেয় না…”
তার ঠোঁটে একটুখানি মলিন হাসি, কিন্তু চোখে এক অসীম শূন্যতা। মালিহার মনে হলো, এই মেয়েটার মুখে এমন হাসি দেখা সবচেয়ে বেশি কষ্টের। যে হাসিতে আনন্দ নেই, আছে শুধু অভিমান আর না পাওয়ার দীর্ঘ সুর।
নিজেকে সামলে মালিহা কথা ঘোরালেন। সেলাই থামিয়ে একবার তরীর মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“সে যা-ই হোক, বল তো, তোর আর সৌহার্দ্যের কী খবর? দেখছি তো ওর সঙ্গে তোর দূরত্ব এখনো পুরো কাটেনি! আগের মতোই?”

তরী চোখ নামিয়ে ফেলল। কণ্ঠে হতাশার আবরণ:
“হ্যাঁ, আগের মতোই আছে। সে এখন আমার আশেপাশে ঘেঁষে না তেমন। সবসময় দূরে দূরে থাকে। মনে হয়… উনি আমাকে আর ভালোবাসে না।”
মালিহা হেসে ফেললেন। কিন্তু সেই হাসির ভেতরে যেন এক তীক্ষ্ণ মমতার কাঁটা ছিল। তিনি বললেন,
“দেখ, সবাই কিছু দেওয়ার প্রতিদান হিসেবে কিছু চায়। সৌহার্দ্য তো তোকে আজীবন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছে। এখন তার বিনিময়ে তুই কী দিয়েছিস? ভালোবাসা কেবল নেওয়ার জিনিস না, দেওয়ারও। তোরও তো তাকে ভালোবাসতে হবে, তরী। অন্তত জানাতে হবে তুই তার জন্য ঠিক কী অনুভব করিস।”
তরী চুপচাপ হয়ে গেল।

তার চোখে ভেসে উঠল সৌহার্দ্যের মুখ— যে তার দুঃসময়ে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, দুর্নাম থেকে বাঁচাতে তাকে বিয়ে করে একটা সুন্দর সম্পর্কে আবদ্ধ করেছে, যে মুখ নিঃস্বার্থভাবে তার পাশে থেকেছে, যে মানুষটা তাকে গ্রহণ করেছে জীবনের ভয়ঙ্করতম অধ্যায়ে, বিয়ের মতো একটা সিদ্ধান্তে কোনো দ্বিধা না করে তার পাশে দাঁড়িয়েছে, তার জন্য নিজের পরিবারকে ছেড়ে এতো দূর চলে এসেছে, তাকে বাঁচার নতুন জীবন দিয়েছে, জীবনের লক্ষ্য দিয়েছে।
তরীর বুকটা যেন হঠাৎ ভারী হয়ে এলো। সে ভাবল, সৌহার্দ্য তো সত্যিই অনেক কিছু দিয়েছে তাকে—
সামাজিক সম্মান, একটি নতুন পরিচয়, সম্পর্কের নিরাপত্তা, ভালোবাসা, নির্ভরতা। কিন্তু সে নিজে? সে তো কেবল নিয়েছে সৌহার্দ্যের জন্য কখনোই কিছু দেয়নি। একটিবারও বলে উঠতে পারেনি, “তোমার এই ভালোবাসার আমি কতটা কৃতজ্ঞ।”
তার চোখের কোণে জল জমে উঠল, কিন্তু সে চুপচাপ মুখ ঘুরিয়ে ফেলে বলল না কিছুই। তবে মালিহা বোঝেন—এই নীরবতা একরকম স্বীকারোক্তি।

মধু নিজের ঘরে বসে আছে। ডেস্কের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা দুটো মোটা আইনের বই – “পেনাল কোড” আর “কনস্টিটিউশনাল ল রিভিউ”। পৃষ্ঠা উল্টে যাচ্ছে, কিন্তু মাথার ভিতর ঢুকছে না একটাও শব্দ। ঘণ্টাখানেক হয়ে গেছে, তবু এক লাইনও মুখস্থ হয়নি। চোখ যেন শুধু শব্দ দেখে, মস্তিষ্ক কিছুই গ্রহণ করছে না।
মুখভর্তি বিরক্তি, চোখে অস্থিরতা। মধুর তীব্র অভিমান যেন বইয়ের পাতাগুলোকেও বিব্রত করে তুলেছে।
“একটু মনোযোগ দিতে পারিস না তুই?” নিজেকে নিজেই ধমক দিল সে।
“কী একটা মাথামোটা কাজ না করলে চলত না!”
বুকশেলফের দিকে তাকিয়ে যেন উত্তর খুঁজছিল, কিন্তু সেখানেও নীরবতা।
চোখের সামনে হঠাৎ ভেসে উঠল বিকেলের দৃশ্যটা।
প্রহরের গাড়ি থেকে নামার পর হঠাৎ খেয়াল হয়—পার্সটা হাতে নেই। এখন মনে পড়ছে, সেটা ব্যাকসিটেই রয়ে গেছে।

পার্সে লাইব্রেরি কার্ড, ডেবিট কার্ড, আর কিছু জরুরি কাগজ ছিল।
বুকে চাপা উত্তেজনা চেপে বসেছে, কিন্তু যেটা বেশি হচ্ছে সেটা হলো দ্বিধা। প্রহরকে ফোন করবে কি না, সেটা নিয়েই বড় দ্বন্দ্বে পড়ে গেছে সে। মাথার ভিতরে লড়াই—‘কল করব না’, ‘না, দরকার’, ‘আহ! এটা বলতে গেলে এক মিনিটের কথা’—এইসব ভাবনা চলছেই।
নখ কামড়াতে কামড়াতে বিড়বিড় করে উঠল,
“পৃথিবীতে কি একটাই গাড়ি ছিল আমার পার্স ফেলার জন্য? উফ্! লোকটার গলা শুনলেই মাথা ধরে যায়।”
শেষমেশ যত যাই ভাবুক, বাস্তবতার সামনে তো যুক্তিরই জয়। মধু দাঁত কামড়ে ফোনটা তুলে নিলো। কনট্যাক্ট লিস্টে ‘Mr. Insane’ নামে সেভ করা নম্বর খুঁজে বের করে একদম শেষ মুহূর্তে কল করল।
রিং যাচ্ছে… দীর্ঘ সময় রিং হয়ে শেষে কল রিসিভ হলো। মধু কিছু বলার আগেই ওপাশ থেকে এক গম্ভীর, রোবটিক কণ্ঠ ভেসে এলো:

“আন-অথারাইজড এন্ট্রান্স ডিটেক্টেড। বি এলার্ট এন্ড এনশিউর দ্য সেফটি অফ দ্য এরিয়া অ্যাজ সুন অ্যাজ পসিবল। গট ইট?”
মধু থতমত খেয়ে গেল। গলায় অবিশ্বাসের ছোঁয়া নিয়ে বলল,
“মানে? আপনি কী বললেন? এগুলো কাকে বলছেন?”
ওপাশে প্রহর তখনও বুঝে উঠতে পারেনি কী ঘটে গেল। এয়ারপডসে আগে থেকেই একটা সিকিউরিটি রিমাইন্ডার চলছিল—যেটা সে ভুলবশত এক্সটারনাল কলের মাঝেই চালিয়ে ফেলেছে।
মেয়েলি কণ্ঠ শুনে সে হকচকিয়ে গেল।
ঝটপট এয়ারপডস থেকে কান সরিয়ে ফোনটা পকেট থেকে বের করল। স্ক্রিনে মধুর নাম দেখে চোখ বড় বড় করে ফেললো সে। নিজের ওপর প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে মাটিতে বুট দিয়ে আঘাত করলো। ক্রোধ সংবরণ শেষে কল আনমিউট করে ঠান্ডা গলায় বললো, “কেন কল দিয়েছো বলো?”

মধুর মুখে বিস্ময়ের ছাপ এখনো স্পষ্ট।
“না, মানে… আপনি কিছুক্ষণ আগে আমায় কী যেন বললেন? এইসব ‘আন-অথারাইজড’ ইত্যাদি? কেউ যদি এসব হঠাৎ শোনে, পুলিশেই ফোন দেবে!”
প্রহরের গলা আরও কঠিন হয়ে উঠল।
“দ্যাট’স নান অফ ইয়োর বিজনেস। বলো, কেন কল দিয়েছো?”
মধুর বিস্ময় কেটে বিরক্তিতে রূপ নিলো। সে নাক কুঁচকে ফেললো, “আপনার ব্যাপারে কোনো আগ্রহও নেই আমার। শুধু এটা জানাতে কল দিয়েছিলাম যে, আমার পার্সটা আপনার গাড়ির ব্যাকসিটে ফেলে এসেছিলাম সম্ভবত। কালকে কখন কীভাবে নিতে পারবো সেটা জানাবেন।”
প্রহর এক মুহূর্ত চুপ থেকে বলল,

“কাল দুপুর একটা। নিয়ে যেও।”
মধু উত্তর দেওয়ার আগেই, ফোন কেটে গেল। অন্যপ্রান্ত নিঃশব্দ। মধু থ হয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। তারপর ফোনটা টেবিলে রেখে বুকের ভেতরের অজানা রাগটাকে চেপে ধরে পড়ার বইয়ের দিকে তাকাল।
“মি. ইনস্যান!”
সে গজগজ করে উঠল।
“একটা মানুষ কিভাবে এত বিরক্তিকর হতে পারে? পাথর? না রোবট?”
বইয়ের পাতায় চোখ রাখল আবার। শব্দগুলো নড়াচড়া করছে, কিন্তু অর্থ ধরা দিচ্ছে না। আসলে সমস্যাটা আইনের বইয়ে নয়—সমস্যা সেই এক অপ্রকাশ্য অস্থিরতায়, যা তার জীবনে প্রহর নামের এক অদ্ভুত সমীকরণ হয়ে গেঁথে যাচ্ছে।

মুগ্ধর অবস্থার বেশ উন্নতি হয়েছে। পরশু তাকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জও দিয়ে দেবে। মিসেস শিরিণ তাকে খাবার খাওয়ানো শেষে অবাক হয়ে বললেন, “আজ তুমি পুরোটা খাবার কিভাবে খেয়ে ফেললে? রোজ রোজ তোমার নাক ছিটকানো-ই তো শেষ হয় না!”
মুগ্ধ পানি খেয়ে বললো, “কারণ আমি এখন সুস্থ হয়ে গিয়েছি, মা!”
ড. শাহরিয়ার তার পাশেই বসে ছিলেন। তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললেন, “রোগের ওষুধের চেয়ে মনের ওষুধ বেশি ইফেক্টিভ মেইবি।”
পানি খাওয়ার মাঝে বাবার মুখে এমন কথা শুনে মুগ্ধর কাশি উঠে গেল। মিসেস শিরিণ ছেলেকে শান্ত করা শেষে বললেন, “মানে? তোমার কথার কোনো আগামাথা বুঝতে পারছি না।”
“ওসব বুঝবে না৷ চলো এখন বাইরে। ছেলেটাকে একটু রেস্ট নিতে দাও।”

ড. শাহরিয়ার তাকে বুঝিয়ে বাইরে নিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে মুগ্ধর দিকে তাকিয়ে ইশারায় বললেন, “ফোনে বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না।”
মুগ্ধ হাসলো। বাবা-মা বেরিয়ে যেতেই প্রহর অরুণীকে কল দিলো। এক রিং হওয়ার সাথে সাথেই কলটা রিসিভ করে অরুণী বললো, “কেমন আছো, মুগ্ধ?”
“আপনি এতোক্ষণ আমার কলের অপেক্ষায় ছিলেন?” মুগ্ধ কৌতুকের কন্ঠে বললো।
অরুণী থতমত খেয়ে বললো, “কই? না তো! ফোনটা আমার হাতের কাছেই ছিল, তাই দ্রুত রিসিভ করতে পারলাম।”
“আর মিথ্যা বলতে হবে না। আমি জানি।”
“কী জানো?”
“আপনার মনে আমার একটা পাকাপোক্ত জায়গা হয়েছে।”

অরুণী লজ্জা পেল এমন কথায়। আসলেই তার মনে এতো আবেগ কবে তৈরি হলো? সে তো কখনো টের পায়নি।
অরুণীর ভাবনার মাঝে মুগ্ধ বললো, “আপনার মনের পুরোটা জায়গা জুড়ে আমি থাকতে চাই, অরুণী।”
অরুণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমার মন-প্রাণ-হৃদয়-অনুভূতির জগতে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই এখন। তুমি হয়তো এখনও সৌহার্দ্যের কথা ভাবছো। কিন্তু সৌহার্দ্য আমার জীবনের এমন একটা অংশ ছিল যাকে আমি কখনো অস্বীকার করতে পারবো না। সৌহার্দ্য আমার প্রথম প্রেম ও প্রথম বেদনার নাম। ওকে ভুলতে পারবো না আমি। কিন্তু আমার পৃথিবীতে সে এখন এক আগন্তুক ছাড়া আর কিছুই না। তুমি বলেছিলে, ভালোবাসাকে ভালো রাখতে মাঝে মাঝে স্যাক্রিফাইস করতে হয়। আমি স্যাক্রিফাইস করেছি। আমি চাই ভালোবাসারা ভালো থাকুক। কিন্তু আমি নিজেও ভালো থাকতে চাই। আর দেরিতে হলেও আমি বুঝেছি বর্তমানে আমার ভালো থাকার একমাত্র কারণ তুমি। এখন আমার ভবিষ্যৎও তোমাকে ঘিরে। কারণ তোমার মতো করে আমাকে কেউ কখনো ভালোবাসবে না।”
মুগ্ধ হেসে বলে উঠলো, “আপনি আমার সামনে থাকলে এখন একটা গভীর চুমু দিয়ে বুঝিয়ে দিতাম যে, কেন আপনাকে এতো ভালোবাসি?”

অরুণী ওড়নায় মুখ লুকিয়ে নিজের লজ্জা সংবরন করতে চাইলো। কিন্তু তার গাল তবুও রক্তিম বর্ণ ধারণ করছে।
অরুণীর নীরবতা দেখে মুগ্ধ বললো, “আমার রোম্যান্টিক মোড অন হলেই আপনি সাইলেন্ট মোডে চলে যান। পরশু হসপিটাল থেকে বেরিয়ে সবার আগে আপনার লাজুক মুখটা দেখতে যাবো আমি।”
অরুণী উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বললো, “পরশু ডিসচার্জ দেবে তোমায়?”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪১

মুগ্ধ উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে বললো, “আই লাভ ইউ।”
অরুণী শ্বাসপ্রশ্বাস বেড়ে গেল। সে কোনো উত্তর দিতে পারলো না। দ্রুত কল কেটে বুকে হাত চেপে বসে রইলো, “এই ছেলে যেকোনো সময় আমার হার্ট অ্যাটাক করিয়ে ফেলবে মনে হচ্ছে।”

প্রণয়াসক্ত পূর্ণিমা সিজন ২ পর্ব ৪৩