প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ১৭
অনন্যা
সিকদার কুঞ্জে জমেছে আজ ভাইয়েদের আড্ডা।তিন ভাইয়ের আড্ডায় বাড়িটা যেন আজ আবার প্রাণ ফিরে পেল।রাহুলও বসেই ছিল।তার নজর সামনে বসা রোদেলার দিকে।আহনাফ না আসায় তার মনটা খারাপ হয়ে গেছে।রাহুল দেখলো তার মুখটা।মেয়েটা অনেক বেশি সুন্দর।রাহুলের নজর গিয়ে আটকালো রোদেলার গোলাপি অধরজোড়ায়।একটা শুকনো ঢোক গিললো সে।হঠাৎ ফোনে একটা নোটিফিকেশনের শব্দ আসায় ঘোর থেকে বের হলো সে।তাকালো ফোনের দিকে।বাঁকা হাসলো সে।কি একটা ভেবে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো সে।বলে উঠলো
-‘তোমরা কন্টিনিউ করো…আমি আর লিটল্ গার্ল একটু শহরটা ঘুরে দেখি।ডু ইউ হ্যাভ প্রব্লেম..প্রিন্সেস?
রোদেলা বড্ড বিরক্ত এইসব নামে ডাকায়।তবে সেটা প্রকাশ করলো।সে একটা অযুহাত দিতে যাবে তখন তার মা বলে উঠলো
-‘এতো ভালো কথা।কিসের প্রব্লেম থাকবে ওর?যা যা..ঘুরে আয়।
রোদেলা বিরক্তভরা নয়নে মায়ের দিকে তাকালো।জেরিন বেগম চোখ রাঙালেন।চুপসে গেল মেয়েটা।রাহুল বাঁকা হাসলো।মনে মনে বললো
“বিরাট বড় একটা সারপ্রাইজ রেডি করেছি আজ তোমার জন্য, বেবিগার্ল।কি যে একটা সিচুয়েশন ক্রিয়েট হবে ভাবলেই মনটা খুশিতে ভরে যাচ্ছে।”
রোদেলা সিড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল।রাহুলও নিজের রুমে গেল।মনটা আজ তার বেশ উড়ু উড়ু করছে।
আকাশ মেঘাচ্ছন্ন।হালকা বাতাস বয়ে চলেছে বাহিরে।কুহু পার্কের একটা বেঞ্চে বসে রয়েছে।জায়গাটাতে তেমন মানুষ নেই।বাচ্চারা খেলছে আর তাদের বাবা-মায়েরা সুদূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে।আবার হয়তো কেউ এমনিই হাঁটছে।কুহুর এই জায়গাটা বেশ পছন্দের।বাচ্চাদের খিলখিল করা হাসির শব্দ তার ভীষণ ভালো লাগে।আগে প্রায় সময় পেলে সে এখানে এসে সময় কাটাতো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তবে কুহু এখন বিরক্ত বোধ করছে।আধা ঘণ্টা হলো সে এসেছে অথচ আহনাফের খবর নেই।কল্পনায় আহনাফকে এলোপাথারি মারলো কিছুক্ষণ।শ্লা! এতো দেরি লাগে আসতে! তুই কি মেয়ে যে মেকাপ করতে দেরি হচ্ছে! কুহুর বড্ড বেশি রাগ হচ্ছে।ঠিক সেই মুহূর্তে আহনাফ এসে উপস্থিত হলো।কুহু রাগি রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আহনাফ বলতে লাগলো
-‘ট্রাস্ট মি..রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিল।
কুহু উঠে দাঁড়ালো।আহনাফ পিছিয়ে গেল যেন সে এই পুচকে মেয়েটাকে ভয় পেয়েছে।কুহু বুকের সাথে দুই হাত বাঁধলো।ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকালো আহনাফের দিকে।আহনাফের এক হাত পেছনে রাখা।সে আরেকহাতে কানের লতি ধরে অপরাধী সুরে বললো
-‘সরি….আর হবে না।
কুহু কপাল কুচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো তার দিকে।আহনাফ আবার এক’ই সুরে বললো
-‘এবারের মতো কি মাফ করা যায় না, তিলোত্তমা?
কুহু ফোঁস করে শ্বাস ফেললো।মনে হচ্ছে যেন তারা প্রেমিক-প্রেমিকা।তবে সে আজ কিছু বললো না।একটু পর এই ছেলে নিজেই ঘৃণায় তার দিকে ফিরে তাকাবে না।এখন আর রাগ দেখিয়ে কি হবে! কুহু কিছু না বলে বেঞ্চে বসলো।আহনাফ তার দিকে একটু ঝুঁকে বললো
-‘ম্যাডামের কি রাগ কমেছে?
কুহু বললো
-‘আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড নই।নাটক বন্ধ করুন।
-‘হতে কতক্ষণ? হুম?
কুহু কিছু বলতে নিলে আহনাফ তার অপর হাত সামনে আনলো।একগুচ্ছো লাল গোলাপ! কুহু হতভম্ব। সে অবাক নয়নে আহনাফের দিকে তাকালো।আহনাফ বললো
-‘দেরি হওয়ার জন্য অধমের এই সামান্য উপহার দয়া করে গ্রহণ করুন, রাণী সাহেবা।
কুহু ফিক করে হেসে ফেললো।
-‘রাণী?তা কোন রাজ্যের রাণী আমি?
আহনাফ বুকের বাম পাশে হাত দিয়ে দেখিয়ে বললো
-‘ঠিক এই রাজ্যের…
কুহু বললো
-‘তাহলে এটা আপনি নিয়ে ঘুরছেন কেন? হসপিটাল চলুন বের করে আনি।
আহনাফ মাথা নাড়িয়ে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে বললো
-‘যো হুকুম রাণী সাহেবা।
কুহু হেসে হেসে বললো
-‘নাটক কি শেষ হয়েছে আপনার?তাহলে কাজের কথায় আসি?
কুহুর মুখ গম্ভীর হলো।আহনাফ ফুলের দিকে ইশারা করলো।কুহু বললো
-‘আমি আপনার গার্লফ্রেন্ড নই।এই ফুল কেন নিব আমি? নিব না।
আহনাফের ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল।আরেকটু ঝুঁকে বললো
-‘তাহলে ঐদিন গাড়িতে উঠতে না চাওয়ার কারণে যেটা করতে চেয়েছিলাম সেটা এখানে করবো।
কুহু চোখ বড়বড় করে তাকালো।মনে পড়ে গেল ঐদিনকার কথা।কুহু কিছুতেই আহনাফের সাথে যাবে না।শেষমেষ আহনাফ গাড়ি থেকে বেরোলো।গাড়িতে না উঠলে নাকি এই রাস্তায় তাকে চুমু খাবে।কি সাংঘাতিক লোক! কুহু প্রথমে ভয় না পেলেও পরে যখন আহনাফ তার হাত ধরে টান মারলো তখন ভয় পেল সে।এরপরে গাড়িতে উঠতে রাজি হয় সে। তার ভাবনার মাঝেই আহনাফ তুড়ি বাজালো।
-‘কোথায় হারিয়ে গেলেন, ম্যাডাম?
কুহু নাকের ডগা ফুলিয়ে ঝাড়ি মেরে ফুলগুলো নিল।আহনাফ আপাদমস্তক দেখলো তাকে।লাল লাল ফুলের ছাপে শুভ্র রঙের একটা জামা পড়া।কোমড় সমান চুলগুলো বাতাসে দুলছে।
তিলোত্তমা নামটা দারুন মানিয়েছে তাকে।আহনাফ মুচকি হাসলো।পাশে বসলো সে।এরপর বললো
-‘ভার্সিটিতে যাচ্ছো না কেন?
-‘ভাল্লাগে না।
-‘কেন?
কুহু ‘চ’ সূচক শব্দ করলো।
-‘আপনি শুধু শুধুই মটকা গরম করছেন আমার।
আহনাফ হাসলো।দুজন নিরব রইলো কিয়ৎক্ষণ।কুহু আকাশের দিকে তাকিয়ে।মেঘাচ্ছন্ন আকাশটা যেন তার মনের’ই প্রতিচ্ছবি।তবে তার জীবনে কি এই মেঘ সরে গিয়ে কোনোদিন সূর্য উঠবে? কুহু আকাশের দিকে তাকিয়েই আহনাফকে জিজ্ঞাসা করলো
-‘আপনি আকাশ দেখেন,মিস্টার খাটাশ?
আহনাফের মুডের জিঙ্গালালা করতে বোধহয় এই খাটাশ নামটাই যথেষ্ট ছিল।তার চোখ-মুখ বিরক্তিতে ছেয়ে গেল।কুহু আহনাফের থেকে উত্তর না পেয়ে রাগি স্বরে বললো
-‘বলছেন না কেন?
আহনাফ থমকায়।ছোট্ট পুচকি একটা মেয়ে কিনা তাকে ধমকায়! যে আহনাফের ভয়ে সবাই কাঁপে সেই আহনাফকে ধমকায়! অবশ্য তার আসল রূপ তো এই মেয়ে এখনো দেখেনি।আহনাফ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললো
-‘দিন শেষে যখন দীর্ঘশ্বাসের ভারে জীবনটা ভারী হয়ে উঠে তখন দেখি।
কুহু হাসলো।তাচ্ছিল্যের হাসি।সে বললো
-‘আমার জীবনের প্রতিটি পাতায় দীর্ঘশ্বাসের গল্প।বড্ড দীর্ঘ সেই গল্প।
-‘কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আছি।সমস্যা নেই।
কুহু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।চোখের কোণের পানি মুছলো সে।এরপর বললো
-‘আপনি আমার সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন মেইবি।বাবা-মা নেই এটা জানেন বোধহয়।
আহনাফ উপরনিচ মাথা ঝাঁকালো।কুহু বলতে শুরু করলো
-‘বাবা-মায়ের চেহারা মনে নেই আমার।দাদির কাছেই মানুষ হয়েছি আমি।বাবা একজন ডাক্তার ছিলেন।আমাদের আর্থিক অবস্থাও বেশ ভালো ছিল।শুনেছি দশ বছর পর মায়ের গর্ভে সন্তান এসেছিল।খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলেন সবাই।তবে সেই খুশি বেশি বছর স্থায়ী হয় না।কয়েকবছর পরেই ওনারা একটা এক্সিডেন্টে মারা যায়।আমার দাদির একটামাত্র ছেলে ছিল।আর সন্তান ছিল না ওনার।একমাত্র ছেলে আর বৌমাকে হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে গিয়েছিলেন।আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলেছেন।এরপর সব ঠিকঠাক’ই চলছিল।আমিও বড় হতে লাগলাম।বাড়িতে শুধু আমি আর দাদিই থাকতাম।আমার সবটা জুড়ে ছিলেন তিনি।
দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো কুহু।আহনাফ তার দিকেই তাকিয়ে শুনছে সবটা।
-‘আমি ক্লাস এইট থেকে নাইনে অত্যন্ত ভালো রেজাল্ট করে উত্তীর্ণ হলাম।তখন দাদি খুশি হয়ে আমাকে একটা স্মার্ট ফোন কিনে দিলেন।আমি একবার বায়না ধরেছিলাম সেটাই পূরণ করেছিলেন আরকি।স্মার্ট ফোন পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়েছিলাম।বান্ধবীদের থেকে শুনতাম আমি ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম সম্পর্কে।অনেক আগ্রহ জেগেছিল শুনে।আমিও খুললাম একটা ফেইসবুক আইডি।নাম কি দিলাম জানেন?
আহনাফ বললো—“কি?”
কুহু হেসে বললো
-‘সিংগিং কুইন।
আহনাফ ফিক করে হেসে ফেললো।কুহুও হাসলো।এরপর বললো
-‘তখন আমি শুধু অবাক আর অবাক হতাম।কতকিছু জানা যায় ফেইসবুকের মাধ্যমে! তখন যার আইডিই সামনে পেতাম তাকেই ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাতাম।এরপর আবার তারা এক্সেপ্ট করলে নিজে থেকেই হাই-হ্যালো পাঠাতাম।তবে তাদের সাথে সেই হাই-হ্যালো পর্যন্ত’ই সীমাবদ্ধ থাকতো। এরকম করে একবার একজনের সাথে আমার পরিচয় হয়।তার সাথে অনেক কথা হতো আমার।অজান্তেই দুজন ফ্রেন্ড হয়ে যাই।
আহনাফ হতাশার শ্বাস ছেড়ে বললো
-‘তোমার মতো তারছিড়াকে এতো তাড়াতাড়ি ফোন দেওয়া মোটেই উচিত হয়নি।
কুহু বললো
-‘এই প্রথম একটা ভালো কথা বলেছেন আপনি।
আহনাফ কিছু বললো না।সে তো ভেবেছিল এই বুঝি “বাঙ্গির পোলা” বলে চেঁচিয়ে উঠবে।বেঁচে গেল সে এ যাত্রায়।কুহু বলতে লাগলো
-‘সে অন্যরকম ছিল,,জানেন!
-‘প্রথম প্রথম সবাই’ই অমন পীরসাহেব সেজে থাকে।
কুহু বললো
-‘আমি তো আর সেটা বুঝিনি।তবে সে না অন্য সবার মতো কখনো আমার ছবি চাইনি।আমিও চাইনি কখনো।একদিন সে আমাকে কল করলো।আমার জন্মদিন ছিল।বারোটা বাজে উইশ করতে কল দিয়েছিল।প্রথম যখন তার ভয়েস শুনলাম আমি বলতে পারেন ক্রাশ খেয়েছিলাম।এতো সুন্দর তার ভয়েস!
আহনাফ মাথা নাড়াচ্ছে উপর নিচ।এদিকে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে এসেছে।ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে তাও।
-‘ওহ.. আমার আইডির নাম সিংগিং কুইন থাকায় সে ভেবেছিল আমি গান গাইতে পারি।সেও অনেক ভালো গান গায়।মূলত এজন্যই কথা শুরু হয়েছিল আমাদের।এরপর থেকে প্রায় তার সাথে কলে কথা হতো।কথা বলতে বলতে একসময় অভ্যাস হয়ে গেল তা।একদিন কথা বলতে না পারলে মনে হতো দম বন্ধ হয়ে আসছে।আসলে কি বলুন তো! মানুষ হচ্ছে অভ্যাসের দাস।একবার একটা জিনিস অভ্যাস হয়ে গেলে তা থেকে বেরিয়ে আসা খুব কষ্টের হয়ে উঠে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকাশের পানে তাকালো কুহু।
-‘এরপর?
আহনাফের কথা শুনে কুহু আবার বলতে শুরু করলো
-‘তবে আমাদের প্রেমের একটা অদ্ভুদ বিষয় কি ছিল জানেন? আমরা কখনো ওসব বাবু, সোনা তিন বেলা আই লাভ ইউ বলতাম না।ওরকম আলগা পিরিত ছিল না। সে আমার নামের সাথে মিলিয়ে আমাকে একটা নিকনেম দিয়েছিল….”বার্ড”।
আহনাফ দাঁতে দাঁত চেপে বললো—-“তারপর?”
-‘তারপর হঠাৎ একদিন সে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়।কল করে না, ম্যাসেজের রিপ্লাই করে না।আমি ভেঙে পড়েছিলাম অনেকটা।কার থেকে খোঁজ নিব কিচ্ছু ভেবে পাচ্ছিলাম না।কারণ তার পরিচিত এমন কাউকে আমি জানতাম না।আর সেও এই দেশে থাকতো না। কিছুদিনের মাথায় আমার দাদি অসুস্থ হয়ে পড়ে হঠাৎ।হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে।আমি যেন দিশেহারা হয়ে গেলাম।সব আপনজন আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।আল্লাহ’র কাছে কত করে চাইলাম দাদিকে সুস্থ করে দিতে আল্লাহ দিলেন না বরং তাকে নিজের কাছে নিয়ে গেলেন।
কুহুর চোখ থেকে দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো।আহনাফ নিজের রুমালটা পকেট থেকে বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিল।কুহু নিল না।হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে ফেললো।আহনাফ কিছু বলতে যাবে তখন তার এমন একটা কথা মাথায় এলো যে সে নিজেই রুমালটা দূরে ছুড়ে মারলো।কুহু ভাবলো রেগে ছুড়ে মেরেছে।হুহ্! তার কি এতে!
এদিকে আহনাফ ভাবছে অন্য কথা।এই রুমালটা ওয়াশরুমে পড়ে গিয়েছিল।সে তো টিস্যু দিয়ে তা কোনোমতে পকেটে রেখেছিল ভেবেছিল বেরিয়ে ফেলে দিবে।ভুলেই গেছে! যাক ভালোই হয়েছে রুমালটা নেয়নি।আচ্ছা বাঁচা বেঁচে গেছে! সে মেকি হেসে বললো
-‘তারপর?
কুহু যেন গভীর ভাবে ভাবছে কিছু।এরপর? এরপরের ঘটনা সে কি বলবে আহনাফকে?সে বলে উঠলো
-‘কেমন খাটাশ লোক আপনি! এতক্ষণ ধরে এতোকিছু বললাম গলা শুকিয়ে যায়নি বুঝি! কিছু ঠাণ্ডা অফার করলেও তো পারেন?
আহনাফ এক ভ্রু উঁচু করে বললো
-‘ঠাণ্ডা অফার?
কুহু বলে উঠলো
-‘আপনার মাইন্ডটা আমার গায়ের রঙের মতো।কালো!
কুহু ফিক করে হেসে ফেললো কথাটা বলে।তবে আহনাফের ভালো লাগলো না কথাটা।সে ধমকে বললো
-‘চাপকে পিঠের ছাল তুলে ফেলবো।বেয়াদব!
কুহু কপাল কুচকে তাকালো তার দিকে।আহনাফ উঠে যেতে নিলে কুহু বললো
-‘উঁহু থাক। পরে আনবেন।আগে বলে নেই সবটা।
আহনাফ বসলো।কুহু আকাশের দিকে তাকালো আবার।
-‘মামা খবর পেয়ে আমাকে নিতে এলেন।আমাদের ঐ বাড়িটা ছেড়ে চলে আসলাম মামার সাথে।বাড়ির সাথে ফেলে এলাম সেই অতীত।আমি তখন ধরেই গিয়েছিলাম যে সে আমাকে ঠকিয়েছে।প্রথম কিছুদিন ভয়ে থাকতাম।কারণ আমি তাকে আমার ছবি দিয়েছিলাম।তাকেও দেখেছিলাম। যদি আমার ছবিগুলো ইডিট করে উল্টোপাল্টা কিছু করে সেই ভয়ে থাকতাম।কারণ তখন প্রায় এমনকিছু খবর শোনা গিয়েছিল।কিন্তু নাহ্ এমনকিছু হলো না। সবকিছু ঠিক’ই ছিল।আমিও নতুন স্কুল, নতুন বন্ধুবান্ধব পেয়ে তাকে ভুলার চেষ্টা করছিলাম।হঠাৎ একদিন স্কুল ছুটির পর আমি তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেলাম।প্রথমে ভেবেছিলাম আমার ভ্রম।পরে যখন সে এগিয়ে এলো আমি ফ্রিজড্ হয়ে গিয়েছিলাম।আমাদের ফার্স্ট মিট যে এভাবে হবে ধারণাও করিনি।আমি তো ভেবেছিলাম সে আমার সাথে ফাজলামো করেছে, আমাকে ঠকিয়েছে সে।আমি কান্নায় ভেঙে পড়েছিলাম তাকে দেখে।সে তখন কতকিছু বলে যে আমাকে মানালো! আমাকে সারপ্রাইজ দিতে নাকি যোগাযোগ বন্ধ করেছিল।
কুহু তাচ্ছিল্য করে হাসলো।
-‘সে আমাদের বাড়ির এড্রেস জানতো।সেখান থেকে আমার এই ঠিকানা জানতে পারে।যাইহোক পরে তার সাথে প্রায় দেখা হতো আমার।একদিন সে আমাকে বললো ঘুরতে নিয়ে যাবে।স্কুলে না গিয়ে তার সাথে ঘুরতে যেতে বললো।আমি প্রথমে মানা করে দেই।সে জোর করে না আমাকে।এই জিনিসটা অনেক ভালো লাগতো আমার।মানে তার মাঝে এমনকিছু আপনি পাবেন না যে তাকে খারাপ বলে মনে হবে।তবে কে জানতো বলুন যে ওটা একটা ফাঁদ ছিল? ভালো মানুষের পেছনে এতো বড় একটা হায়না লুকিয়ে আছে?…
কুহুর চোখ পানিতে টলমল করছে।আহনাফ তাকিয়ে সেদিকে।
-‘আমি নিজে থেকেই রাজি হয়েছিলাম যেতে। কারণ তাকে আমি বিশ্বাস করতাম।আর সেটাই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।ও আমাকে নিয়ে গিয়ে…আ’আমাকে..
কুহু কথা বলতে পারছে না যেন।ও কেমন যেন করতে লাগলো।আহনাফ ওর হাতের উপর হাত রাখতেই ও ছিটকে হাত সরিয়ে নেয়।হাতটা কেমন করে ডলতে থাকে।
-‘টা’টাচ করবেন না।ও’ও আমাকে…ছুঁয়েছিল…বড্ড বাজে ছিল সেই স্পর্শ।আ’আমি পালিয়েছিলাম…বিশ্বাস করুন ও আ’আমাকে কিছু করতে পারেনি.. আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম পালাতে। আর পালিয়েছিলামও।হঠাৎ তখন একটা গাড়ি সামনে এসে যায়।এরপর…
কুহু ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে।আহনাফ বলতে লাগলো
-‘রিল্যাক্স, তিলোত্তমা! ও তো কিছু করেনি।তাহলে এমন করছো কেন? রিল্যাক্স!
কুহু ভাঙা ভাঙা স্বরে বললো
-‘বাট আই ওয়াস রে/পড্….
কুহু চোখ বুজে বললো কথাটা।আহনাফ কিছু বললো না।কুহুর সময় লাগলো নিজেকে সামলাতে।
-‘আমার একসপ্তাহ পর জ্ঞান আসে।আমি হসপিটালে নিজেকে দেখি।পাশে আয়ান ভাইয়া বসে।ওনার চোখে মুখে ছিল বিষণ্ণতার ভার।আয়ান ভাইয়া আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে যতটা না খুশি হয় তার চেয়ে বিষণ্ণতা দেখা যায়।সে প্রথমে আমাকে কিছু বলেনি।যখন মামি এসে আমাকে এলোপাথারি মারতে লাগলেন আর হায়-হুতাশ করে বলতে লাগলেন তখন আমার যা লোঝার আমি বুঝে গিয়েছিলাম।
আহনাফ চোখ বুজে ফেললো।কুহু বললো
-‘ হ’হসপিটালের রিপোর্টে এসেছিল যে আমাকে গণ/ধ/র্ষণ করা হয়েছে আর আমি কোনোদিনও মা হতে পারবো না।
জামার একটা অংশ শক্ত করে চেপে ধরলো কুহু।এসব কথা বলতেও তার ঘৃণা লাগে।নিজের উপর ঘৃণা হয় তার।আহনাফও আজকের পর থেকে তাকে ঘৃণা করবে সে জানে।আর পেছনে ঘুরবে না আর তিলোত্তমা, তিলোত্তমা করবে না।ভালোই তো হবে।সে তো এটাই চেয়েছিল।রোদেলা তার ভালোবাসাকে পাক।বেস্টফ্রেন্ডের ভালোবাসা কেড়ে নিতে পারবে না সে।হঠাৎ নিজের হাতে ঠাণ্ডার কিছুর স্পর্শ পেতে থমকালো সে।আহনাফ একটা কোল্ড ড্রিংকস্ তার হাতে ধরে রেখেছে।কুহু হাত সরিয়ে নিল।আহনাফ তার অপর হাতেরটাতে চুমুক দিয়ে বললো
-‘বড্ড গরম পড়েছে আজ।বৃষ্টি আসলে মন্দ হয় না।তোমার বৃষ্টি কেমন লাগে, তিলোত্তমা?
কুহু ভড়কালো।হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার দিকে।
-‘এটা কোথায় নিয়ে এলেন?
রাহুল গাড়ি থেকে নেমে অপর পাশের দরজা খুললো।রোদেলা আশেপাশে দেখতে লাগলো।রাহুল বললো
-‘জায়গাটা সুন্দর না?কি সুন্দর বাচ্চারা খেলছে! মানুষজনও কম।
রাহুল বাঁকা হাসছে।রোদেলা দেখতে লাগলো চারদিক।হঠাৎ তার নজর সুদূরে বসা আহনাফ আর কুহুর দিকে গিয়ে আটলকালো।প্রথমে ভাবলো ভুল দেখছে সে।পরক্ষণেই রাহুল কেমন অবাক হওয়ার ভান করে বলে উঠলো
-‘আরে! আহনাফ না? মেয়েটা কে পাশে বসে?ওর গার্লফ্রেন্ড?উমম..তোমার ফ্রেন্ড না ওটা?
রোদেলা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো।কুহুর হাতের লাল গোলাপের দিকে নজর গেল তার।আহনাফ কেমন হেসে হেসে কথা বলছে তার সাথে।কুহু অবশ্য আহনাফের দিকে তাকিয়েই রয়েছে.. কথা বলছে কম।রোদেলার পুরো পৃথিবীটা দুলে উঠলো যেন।একটা শুকনো ঢোক গিললো সে।রাহুল বলে উঠলো
-‘প্রেম করছে ওরা দুজন! ওয়াও! মানিয়েছে কিন্তু! তাই না বলো? ঐদিন ভার্সিটিতে তাহলে আমি ঠিক’ই দেখেছিলাম।
রোদেলা রাহুলের দিকে তাকালো।কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো
-‘ক’কি দে’দেখেছেন?
-‘আর বলো না! আমি তো তোমাকে খুঁজছিলাম।তো হঠাৎ একটা ক্লাস থেকে কেমন ফিসফিস কথা শুনতে পেলাম।দরজাটা হালকা খুলে দেখলাম যে ওরা..মানে..বুঝোই তো।আমি ভেবেছিলাম আমি ভুল দেখেছি।এই ব্যাপারে তেমন একটা পাত্তা দেইনি।এখন তো দেখছি ঠিক’ই দেখেছিলাম।
রোদেলার পা অবশ হয়ে আসছে যেন।মনটা বারবার বলছে..আহনাফ ভাই এমন না।আর কুহু! কুহু তো জানে যে সে আহনাফ ভাইকে কতটা ভালোবাসে! তাহলে সে কেন..নাহ্ এটা সত্য নয়।আর আ’আহনাফ ভাই তো সেদিন নিজের মুখে তাকে মনের কথা বলেছিল।রোদেলা বুঝতে পারছে না কিছু।মাথাটা ঘুরছে তার।হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।সবাই যার যার মতো ছাউনির নিচে যেতে দৌঁড়াতে লাগলো।রাহুল রোদেলার হাত ধরে গাড়িতে বসাতে নিলে রোদেলা হঠাৎ একটা নাম শুনে থেমে যায়।
-‘তিলোত্তমা…রান…হাহা…তাড়াতাড়ি…
রোদেলার মুখে হাসি ফুটলো।এই তো তার আহনাফ ভাই তাকে ডেকেছে।হাসিমাখা বদনখানা পেছনে ঘুরতেই হাসি মুছে গেল। আহনাফ আর কুহু দৌড়াচ্ছে পুরো মাঠ জুড়ে।আহনাফ কুহুকে বলছিল তার মানে! রোদেলার পায়ের তলার মাটি সরে যায়।এতো বছর ধরে যাকে ভালোবেসে আসলো সে আজ অন্য একজনকে ভালোবাসে! তারমানে সেদিন আহনাফ কুহু মনে করে তার সাথে কথা বলেছিল! তিলোত্তমা তাকে নয় বরং কুহুকে বলেছিল!আর কুহু! কুহু কি করে পারলো তার আহনাফ ভাইকে তার থেকে কেড়ে নিতে? ও তো সব জানতো।রোদেলার ভেতরটা আজ ভেঙে চূড়ে গেল।হৃদয়টা চূর্ণ-বিচূর্ণ হলো আজ।নোনা জল গড়িয়ে পড়ছে তার কাজলকালো চোখ থেকে। চোখের পানি বৃষ্টির সাথে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে আজ
প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ১৬
-‘কেন আমাকে ভালোবাসলেন না, আহনাফ ভাই?কেন ভালোবাসলেন না?
মেয়েটা বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।এতো বড় একটা ধাক্কা সে নিতে পারছে না।ঢলে পড়লো রাহুলের বুকে। রাহুল ধরে ফেললো সাথে সাথে। বাঁকা হাসলো সে।উদ্দেশ্য সফল তার।বৃষ্টিতে জুবুথুবু অবস্থা তাদের।আহনাফ আর কুহুর দিকে তাকিয়ে কেমন সুর টেনে বললো
-‘দেখে ফেলেছি….হাহাহা
