প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩১
অনন্যা
বৃষ্টিভেজা স্নিগ্ধ সকাল।পাখির কিচির মিচির শব্দে মোহরিত প্রকৃতি।আজ বৃষ্টি নেই তবে আকাশ মেঘলা।মাঝে মাঝে মেঘের আড়াল থেকে সূয্যিমামা উঁকি দিচ্ছে।রাফি আজকে বড্ড ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে ঘুম থেকে উঠলো।স্বপ্নটা কি দেখে মাইরি! রাহুলের ঠোঁটে আলকাতরা মেখে এসেছে!আহা! এরকম স্বপ্ন সে রোজ দেখতে চায়।থাপ্পরও না মেরেছিল! পৈশাচিক এক শান্তি লাগছে রাফির।না জানি বাস্তবে মারতে পারলে কতটা আনন্দ হতো! রাফি লালা করতে করতে ওয়াসরুম চলে গেল।এরপর বেরিয়ে মর্নিং ওয়াকের জন্য বের হলো।ঘড়ির কাঁটা ছয়ের ঘরে।রাফি গুণগুণ করে গান গাইতে গাইতে বের হলো।দরজা লক করে চাবি পকেটে ঢোকালো।হঠাৎ আদিতকে আসতে দেখে সে কপাল কুচকালো।হাত উঁচু করে ডাক দিল সে
-‘আদিত ভাই…
আদিত চমকে উঠলো।রাফিকে এই সময় আশা করেনি বোধহয়।হালকা হেসে এগিয়ে গেল।
-‘হেই..কি খবর?এতো সকালে বাহিরে?
-‘এই একটু হাঁটতে বের হলাম। আপনি এখানে?
আদিত আমতা আমতা করতে লাগলো উত্তর দিতে গিয়ে।রাফি একবার সামনে কুহুদের বাড়ির দিকে তাকালো।এরপরেই দুষ্টু হেসে এক আঙুল নেড়ে বলতে লাগলো
-‘হুম হুম…হুম হুম….
আদিত মাথার পেছনে হাত দিয়ে হাসলো।
-‘কিন্তু রাইফা আপু তো এতো সকালে বের হয় না।মানে আমি কখনো দেখিনি আরকি।
আদিত মুচকি হেসে বললো
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘আজকে আসবে।কথা বলবে বললো..
রাফি আবার দুষ্টু হাসে। বলতে লাগলো..
-‘অয়অয়…
আদিত লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে।রাফি হো হো করে হেসে ফেললো।এরপর বলে উঠলো
-‘ট্রিট দিতে ভুইলেন না ভাই।
আদিত হাত সরিয়ে বলে উঠলো
-‘ডিরেক্ট বিয়েতে আসিস।
-‘অয়হয় অয়হয়…
রাফি আবার এক আঙুল নেড়ে নেড়ে দুষ্টু হেসে বললো।আদিত লাজুক হাসে।হঠাৎ একটু সামনে এক রমণী এসে দাঁড়ায়।নীল রঙের এক থ্রি পিস তার পরণে।আদিত থমকে গেল।আপনাআপনি মুখটা হা হয়ে গেল।মনে হচ্ছে সামনে এক পরি দাঁড়িয়ে।রাফি ওর তাকানো অনুসারে তাকাতেই আবার দুষ্টু হাসে।কানে কানে বললো—“বেস্ট অফ লাক, ভাই।” আদিত হুশে ফিরলো।রাফি চলে গেল।আদিত এগিয়ে যায় রাইফার দিকে।রাইফা অন্যদিক তাকিয়ে ছিল।আদিতকে দেখেছে সে।রাফির সাথে দেখে ডাকেনি আর।
গতকাল রাত তিনটা পর্যন্ত সে আদিতের সাথে কথা বলেছে।ছেলেটা নাছোড়বান্দা।বলে কিনা বিয়ে না করলে সুইসাইড করে ফেলবে! রাইফা অনেক বুঝিয়েছে কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হয়নি।রাইফা সারারাত ছটফট করেছে ব্যাপারটা নিয়ে।আদিত তার জুনিয়র।জুনিয়রের সাথে কি করে বিয়ে..?আদিত ছেলেটাকে সে যতদূর দেখেছে খারাপ নয়।দেখতে শুনতেও ভালো।জুনিয়র না হলে এক কথায় সে রাজি হয়ে যেত।কিন্তু…তাদের পরিবারও এটা মানবে না।অনেক ঝামেলা হবে।তাই রাইফা ঠিক করেছে একে সামনাসামনি বুঝাবে।তাই সকাল সকাল’ই ডেকেছে।
-‘হাই..রাইফেল!
রাইফা হুশে ফিরে।মুচকি হেসে বলে
-‘আপু…কল মি আপু।
আদিত একটু ভেবে বলে
-‘আপা ডাকি তাহলে?
রাইফা কপাল কুচকে বললো
-‘আপু আর আপায় তফাৎ কি?
আদিত দাঁত কেলিয়ে বললো
-‘আ তে আধা পা তে পাগল।আপা মানে আধা পাগল।
-‘অ্যা!!!
-‘জ্বী আপা।
-‘আমি পাগল?
-‘অর্ধেক।তানাহলে আপু বলে ডাকতে বলতে না।
রাইফা ক্ষেপলো এবার।
-‘চুপ বেয়াদব! তোমার আর আমার এইজ গ্যাপ জানো?
-‘তিন বছর এক মাস পাঁচ দিন।
রাইফা অবাক’ই হলো।এতোকিছু কিভাবে জানে? নিজেকে সামলে সে বলে
-‘ওদিকটায় চলো।
আদিত বাধ্য ছেলের মতো রাইফার পিছে আসে।একটা বট গাছের নিচে বসার জায়গা করা।ওরা সেখানটায় দূরত্ব রেখে বসে।কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটলো।পাখির কিচিরমিচির শব্দ’ই শুনলো দুজন।রাইফা নিজেকে ঠিকঠাক করে নিরবতা ভেঙে বলে উঠলো
-‘দেখো আদিত! তুমি যেটা ভালোবাসা ভাবছো সেটা ভালোলাগা ছাড়া আরকিছুই না।তোমাদের বয়সটাই এমন।অনেককিছুই ভাল্লাগবে এখন।কিন্তু পরে রিগ্রেট করবে এর জন্য।আর আমি চাই না সেটা।বুঝতে পারছো তুমি আমার কথা?
আদিত বলে উঠলো
-‘তোমার কি আমাকে টিনেজার মনে হয়?
-‘তেমনটা না..
-‘তাহলে? ভালোলাগা আর ভালোবাসার মাঝের তফাৎ আমি যথেষ্ট বুঝি।আজ পর্যন্ত প্রপোজাল কম পাইনি।কই কারো প্রতি তো এমন ফিলিংস কাজ করেনি।কাউকে দেখে তো হৃদপিণ্ডটা ঢোলের মতো বাজেনি।তোমাকে দেখেই কেন?
রাইফা হাসলো।এরপর বললো
-‘প্রথম প্রথম এমন মনে হবে।এরপর যত দিন যাবে বিরক্ত কাজ করবে।আমি তোমার চেয়ে বয়সে বড়।একটাসময় তোমার নিজের’ই খারাপ লাগবে বিষয়টা।পরে আফসোসের থেকে এখন একটা কচি মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও।
আদিতের মুচকি হেসে বললো
-‘তোমার প্রতি আমার বিরক্ত কাজ করবে! হাসালে আপা।
-‘বন্ধ করো আপা বলা।
রাইফা দাঁত কটমট করে বললো।আদিত বললো
-‘তুমিই না ডাকতে বললে?
-‘আপু ডাকতে বলছি।তুমি ইনডাউয়রেক্টলি পাগল বলে অপমান করছো।
-‘ ইনডাউয়রেক্টলি! আমি তো সরাসরিই বলছি তুমি পাগল।
আদিতের সোজাসাপ্টা উত্তর শুনে মেজাজ বিগড়ায় মেয়েটার।কিন্তু এখন রাগলে চলবে না।সে কোমল স্বরে বললো
-‘আদিত! তোমার জীবন কেবল শুরু এখন।অনেকটা পথ বাকি তোমার।আমার প্রতি তোমার এই ফিলিংস কেবল কিছু সময়ের জন্য।আমি এখানে আর কিছুদিন আছি।আমি চলে গেলে তোমার এসব ফিলিংসও শেষ হয়ে যাবে।ভুলে যাবে তুমি আমাকে।জীবন এমন’ই আদিত।আজ যেটাকে তুমি নিজের সবকিছু মনে করছো কাল সেটা ছাড়াই তুমি বিনা বাধায় চলতে পারবে
আদিত শুনলো সবটা।কেন যেন রাগ লাগছে তার।সে নিজেকে শান্ত রেখেই বললো
-‘ওয়েল..আমার ফিলিংসগুলো তার মানে ওয়ান সাইড? তোমার আমার প্রতি কোনো অনুভূতি কাজ করে না?
রাইফা নিরুত্তর।সত্যিই কি এটা ওয়ান সাইড? আদিত যদি আজ তার জুনিয়র না হতো সে কি মানা করতো? হয়তো না।বয়সটা একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের মাঝে।এই দেয়াল ভাঙতে গেলে যে হাজার বাঁধা আসবে।রাইফা চায় না আদিত তার জন্য কোনো ঝামেলায় পড়ুক।ছেলেটার সবে মাত্র ক্যারিয়ার শুরু হবে।রাইফা ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললো
-‘নাহ্ করে না।
আদিতের মনে হলো ওর বুকের বাঁ পাশটায় কেউ তীর ছুঁড়ে মেরেছে।আদিত অত্যন্ত হাসি-খুশি প্রাণবন্ত একটা ছেলে।জীবনে কষ্ট আসলেও সেই কষ্ট তার ঠোঁটে সবসময় থাকা হাসি দেখে নিজেই লজ্জা পেয়ে চলে গেছে।আজ প্রথমবার হৃদয়ে ব্যথা অনুভব করছে সে।রাইফা বললো
-‘তোমার জীবনে আল্লাহ ভালো একজনকে পাঠাবে।কচি একটা মেয়েকে পাঠাবে দেখো।
রাইফা কথাটা বলে খিলখিল করে হেসে উঠে।আদিত দেখলো তা।বিমোহিত হলো তার অক্ষিযুগল।আবার প্রেমে পড়লো সে এই মেয়েটার।আদিত হেসে বললো
-‘রিজেক্ট করলে?
রাইফা বললো
-‘রিজেক্ট! প্রশ্ন’ই আসে না।তোমাকে তো আমি তোমার সঠিক পথটা দেখিয়ে দিচ্ছি।তুমি ছেলে হিসেবে যথেষ্ট ভালো আদিত।তুমি আমাকে সবসময় পাশে পাবে একজন বন্ধু হিসেবে।এর থেকে বেশি কিছু আশা রেখো না।
আদিত ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো।তখন হঠাৎ তার দুঃখে দুঃখিত হয়ে একটা কাক তার হাতের উপর পটি করে কা কা করতে করতে উড়ে চলে গেল।হতভম্ব হলো সে। রাইফা হা হয়ে গেল।এরপর জোরে জোরে হাসতে লাগলো।আদিত তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলে
-‘হাতি কাদায় পড়লে চামচিকাও লাথি মারে।কর..কর..যা খুশি কর।সময় তো তোদের’ই।
রাইফা হাসি থামালো।আদিত বললো
-‘এটাই তোমার শেষ সিদ্ধান্ত? তুমি বিয়ে করবে না আমাকে?
রাইফা মুচকি হেসে বলে
-‘আমি তোমার যোগ্য নই।তুমি আমার থেকে হাজারগুণ বেটার ডিজার্ভ করো।
আদিত পকেট থেকে তাৎক্ষণাৎ একটা ছোট্ট শিশি বের করে।মুখ খুলে কিছু দানা বের করে মুখে পুড়ে দিল।এত দ্রুত সে কাজটা করলো যে রাইফা বাঁধা দেওয়ার সময় পেল না।আদিত গলায় হাত দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলো।শরীর হেলে পড়েছে তার। আদিত হেসে বহু কষ্টে বলে উঠলো
-‘আজ মৃত্যুর পথে দাঁড়িয়েও আমি তোমাকে বলতে চাই…ভালোবাসি আমার সিনিয়র প্রেমিকা..ভা”লো”বা”সি..
আদিত ছটফট করছে।রাইফা চিৎকার করে উঠলো—“আদিতত!”
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই কুহু চোখ কুচকে ফেলে।মেঘের আড়ালে সূর্যটা ঢেকে যেতেই আবার সে চোখ ঠিক করে।আবার মেঘ সরে গিয়ে আলোটা পড়তেই সে ঘুমের মাঝে ‘চ’ সূচক শব্দ করে।আহনাফ খুব মনোযোগ সহকারে তা দেখছে।মেয়েটাকে ঘুমের মাঝে কি যে মায়াবি লাগে! ফোলা ফোলা গাল দুটোতে গাঢ় করে চুমু খেতে ইচ্ছা করে।খেয়েছেও একটু আগে।মেয়েটা এতোটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন যে বুঝতেও পারেনি।রাতে কুহুর কথায় সে অন্য রুমে ঘুমায়।আহনাফ চায় না তাকে জোর করতে।সে চায় তিলোত্তমা তার জন্য ছটফট করুক।তাকে একটাবার কাছে পাওয়ার ব্যথায় মরিয়া হোক।আহনাফ কুহুর বিরক্তভরা মুখটা দেখে উঠে পর্দা দিয়ে ঢেকে দেয় জানালাটা।একবার উঁকি দিয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে
-‘বেয়াদব সূর্য! তুমি জানো না আমার বউ ঘুমাচ্ছে! কেন ডিস্টার্ব করছো তাকে? ক্ষমতা থাকলে আজ তোমাকে আমি ধ্বংস করে ফেলতাম দুষ্টু সূর্য।
সূর্যটা বোধহয় আহনাফকে ব্যঙ্গ করতে তার প্রখরতা বাড়ালো।হয়তো কথা বলতে পারলে বলতো—“বহুত ভয় পেয়েছি স্যার।দেখুন ভয়ে কেমন কাঁপছি!.. যা ভাগ শালা বউ পাগল!”
আহনাফ পর্দা টেনে দিয়ে তার কথা হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল।নিছের ভাবনায় নিজেই হাসে আহনাফ।বউ পাগলা আহনাফ! নাইস নেইম।সে কুহুর পাশে গিয়ে দুই পা উঠিয়ে বসে আবার।দুই হাত গালে ঠেকিয়ে মনোযোগ সহকারে নিজের স্ত্রীকে দেখছে সে।কেমন ঘুমে কাহিল হয়ে আছে সে।হঠাৎ আহনাফ খেয়াল করলো কুহু মুচকি মুচকি হাসছে।কিরেহ! স্বপ্ন দেখছে নাকি?
আহনাফ ওর মুখটা কাছে নেয় একটু।কুহুর হাসির রেখা দীর্ঘ হয়।কি এমন দেখছে যে এতো হাসছে! হঠাৎ আবার হাসি বিলীন হয়ে যায় মেয়েটার।কেমন ছটফট করতে লাগলো সে যেন কোনো মূল্যবান কিছু তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে কেউ।বিরবির করছে কিছু একটা।আহনাফ কান নেয় ওর ঠোঁটের কাছে।অস্পষ্ট তবুও বুঝলো সে।কুহু তার নাম নিচ্ছে! আহনাফ! হঠাৎ কুহু কেমন ঘামতে লাগলো।আহনাফ হতভম্ব হলো।এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দেয় সে।কুহুর অস্থিরতা কমাতে সে ওকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরে আলতো হাতে।এরপর আস্তে করে নরম স্বরে বলে
-‘এই তো তিলোত্তমা…এখানেই আছি আমি..ভয় নেই।রিল্যাক্স…
কুহু শান্ত হয়।অস্থিরতা কমে তার।ঠোঁটের কোণে আবার হাসির রেখা দেখা যায় তার।আহনাফ বুঝতে পারে না এমনকি দেখছে যে হাসছে আবার কাদঁছে আবার হাসছে! হঠাৎ কুহু তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।আহনাফ ওসব ভাবনা থেকে বেরোয়।মুচকি হাসে সে।কপালে চুমু খেয়ে বলে—“লক্ষী বউ আমার।”
-‘আটত্রিশ..উনচল্লিশ..চ”ল্লি”শ..
রোদেলা হা হয়ে গেল পঞ্চাশবারের মতো।তার চারদিকে শাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে।পাশে চল্লিশ ডোজন বিভিন্ন রঙের চুড়ি।রোদেলা তো চল্লিশটা রঙের নামও জানে না।আর এখানে এতো রঙের শাড়ি..চুড়ি! রাত থেকে সকাল পর্যন্ত শুধু গুণেই চলেছে মেয়েটা।আর প্রত্যেকবার অবাক হচ্ছে।গতরাতে পার্সেলটাতে এগুলো এসেছে।সারাটারাত ঘুমাতে পারেনি সে।গুণছে তো গুণছেই।খুশির থেকে হতভম্ব বেশি হয়েছে।এতো এতো জিনিস তাকে ঐ লোক পাঠালো! মেয়েদের এতোগুলো শাড়ি,চুড়ি গিফট্ পাওয়া যেন স্বপ্নের ব্যাপার।রোদেলা আহনাফের দুঃখ ভুলে এগুলো নিয়ে মেতেছিল সারাটারাত।খুশিতেই বোধহয় ঘুমটা উড়ে গিয়েছিল তার।কত কত শাড়ি আল্লাহ! বিভিন্ন ধরনের শাড়ি রয়েছে এখানে।রোদেলা সবগুলো শাড়ি গায়ে ফেলে দেখছে কেমন লাগে।এতো শাড়ি,চুড়ি রাখবে কোথায় সেটাও চিন্তার বিষয়।ব্যাপারটা ভাবতেই খিলখিল করে হেসে ফেলে।আজ জিনিস আছে অথচ জায়গার অভাব পড়েছে।এ যেন অন্য এক আনন্দ।গুনগুন করে গান গাইতে লাগলো সে।
শাড়িগুলো একে একে আলমারিতে রাখতে লাগলো।শাড়িগুলো চোখ ধাঁধানো সুন্দর।লোকটার চয়েজ অনেক ভালো মানতেই হবে।
রোদেলা উৎফুল্ল মনে সবকয়টা চুড়িও সাজিয়ে রাখলো।এরপর হাই তুলে বিছানায় ধপাস করে শুয়ে পড়লো।গাঙ্গে যাক ভার্সিটি।অন্যদের থেকে নোট নিয়ে নিবে সে।এখন ঘুমাবে একটু।শান্তির ঘুম দিবে সে।
দেয়ালে লাগানো বড় স্ক্রিনটাতে এসব দেখে রাফি হাসে।যাক মন ভালো হয়েছে মেয়েটার এটাই অনেক।শাড়ি,চুড়ি এতো ভালোবাসে মেয়েরা! রাফি কফির কাপে চুমুক দিয়ে ভাবে বিষয়টা।শাড়ির একটা শোরুম খুললে কেমন হয়? রোদেলাকে গিফট্ করে দিবে সেটা।মেয়েটা এই খুশিতে যদি রাফিকে মেনে নেয়..আহা! রাফির চোখ খুশিতে ঝলমল করে উঠে।পরক্ষণেই ভাবে
-‘টাকা তো গাছে ধরে..! ফাউল আইডিয়া একদম।
-‘কিছু হবে না তোমার…আমি আছি আদিত…
রাইফা আদিতকে একটা রিক্সায় করে হসপিটাল নিয়ে যাচ্ছে।আদিত বেহুশ।রাইফা তাড়া দিল
-‘মামা একটু তাড়াতাড়ি চলুন না!
-‘যাইতাছি মা..
রাইফার চোখ থেকে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ে।আদিতের মাথা তার কাঁধে।রাইফা বলতে লাগলো
-‘এই আদিত! চোখ খোলা রাখো..আদিত? আদিততত..
রাইফা ভয়ে কাঁপতে থাকে রীতিমত।সে আদিতে পার্লস্ চেক করলো।পার্লস্ চলছে।নিশ্চিন্ত হলো একটু।কিছুক্ষণ বাদে তারা হসপিটাল এসে পৌঁছায়।রাইফা চেঁচিয়ে ডাকতে থাকে।কিছু লোক স্ট্রেচার নিয়ে হাজির হয় সাথে সাথে।এতো সকালে ডাক্তার এসেছে কিনা কে জানে! রাইফা আদিতের হাত ধরে রেখেছে।ছেলেটার মুখে রক্ত।রিক্সায় উঠে হঠাৎ খেয়াল করে রক্ত পড়ছে তার মুখ থেকে।রাইফা ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলে।হাসপাতালে প্রবেশ করতেই একজন ডাক্তার আর নার্স ছুটে এলো।দুজনের মুখে মাস্ক।রাইফা ভাঙা স্বরে বলতে লাগলো
-‘ডাক্তার..ও’ওকে ঠিক করে দিন।
ডাক্তার আদিতের পার্লস্ চেইক করে।এরপর দুদিকে মাথা নাড়িয়ে কেমন বিষণ্ণ স্বরে জিজ্ঞাসা করে
-‘আপনি পেসেন্টের কি হন?
রাইফা এক মুহূর্তের জন্য থমকায়।কি বলবে সে? একটু সময় নিয়ে বললো
-‘ব’বন্ধু…
-‘ওনার পার্লস্ খুব স্লো চলছে…মেইবি সময় শেষ ওনার।খুব ক্ষতিকর কিছু খেয়ে ফেলেছে।
রাইফা থমকে যায়।তার জন্য ছেলেটা বি’ষ খেয়ে ফেললো! হায় আল্লাহ! রাইফা বলে উঠলো
-‘এভাবে বলবেন না প্লিজ…ওকে ঠিক করে দিন।
-‘আচ্ছা আমরা শেষ চেষ্টা করবো…
আদিতকে নিয়ে যেতে লাগলো।রাইফা ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।হঠাৎ আদিত জোরে শ্বাস নেয় একটা।মুখ থেকে রক্ত পড়ে গড়গড়িয়ে।রাইফা দৌঁড়ে যায় ওর নিকট।
-‘আদিত..কিছু হবে না তোমার…
আদিত নিভু নিভু তাকায়।ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি।বহু কষ্টে বলে
-‘এ’একবার ভা…ভালো…ভালোবাসি ব”বলবে?মিথ্যা হলেও…
রাইফার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে।এতটা পাগল কেন হলো ছেলেটা তার জন্য! আদিতের প্রতি রাইফার যে কোনো ফিলিংস নেই এমন তো না।তবে সে সবটা আবেগ বেবে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল।আদিতের ভালোর জন্য বুঝাতে চেয়েছিল তাকে।কিন্তু এখন বুঝতে পারছে সে দুর্বল আদিতের প্রতি।তার জুনিয়র ছেলেটার প্রতি সে দুর্বল।আদিতকে হারানোর বয় জেঁকে বসেছে তার মাঝে।কেন এমন হলো?দুদিনের একটা ছেলের জন্য এত ফিলিংস! বেশিদিন তো হয়ওনি সে আদিতকে চিনেছে।এটা আবেগ নাকি ভালোবাসা?দুদিনের এই অনুভূতির নাম কি দিবে সে?নিজের মনকে বুঝাতে আদিতকে বকাঝকা করতো।চেষ্টা করতো এড়িয়ে যাওয়ার।কিন্তু পারলো কই? রাইফা অঝোরে কেঁদে বলে উঠলো
-‘ভালোবাসি আদিত…এটা ওয়ান সাইড নয় আদিত।আমিও তোমাকে ভালোবাসি।
আদিত চোখ বুজে নেয়।এটা শুনে মরেও বুঝি শান্তি।আদিত বলে উঠলো
-‘সত্যি তো?
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ সত্যি…আই লাভ ইউ।
হঠাৎ হাত তালির শব্দ শোনা গেল।চমকে উঠলো রাইফা।নার্স মেয়েটা হাত তালি দিচ্ছে সাথে এবার ডাক্তারও।হঠাৎ পেছন থেকে একজন বলে উঠলো
-‘জামাই রাজি বউ রাজি
রাফি আনবে কাজী..
বিয়ে করলে তোমাকেই করবে ভাইয়ে ধরছিল বাজি।
ভাবি সাজবে বউ..ভাই সাজবে জামাই
বিয়ার পর তোমাদের আমি খাওয়াবো যে সেমাই
আহা খাওয়াবো আমি সেমাই…
-‘হেহে আমাকে নাতাশা আপু কল করে বলছে।
রাইফা ভড়কে গেল রাফিকে দেখে।কান্না থামিয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রয়েছে।ডাক্তার আর নার্স মাস্ক খুলতেই রাইফা চমকে উঠলো।আরিফ আর নাতাশা! হঠাৎ আদিত উঠে বসলো।লাল রঙা ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি তার।দুই হাত দুই দিকে পাখির মতো মেলে বললো
-‘আমিও তোমাকে ভালোবাসি.. জান..
রাইফার কপাল কুচকে আসে।তার মানে আদিত নাটক করছিল! এতো বড় ধোকা! আদিত বলে উঠলো
-‘কাম সিনিয়র ব…
ঠাসস করে একটা থাপ্পর পড়লো আদিতের গালে।সবার হাসি বন্ধ হয়ে গেল।রাইফা চেঁচিয়ে উঠলো
-‘এগুলো মজা করার বিষয়? ফালতু ছেলে কোথাকারের! আমার ফিলিংস নিয়ে মজা নিচ্ছ তুমি! কতটা ভয় পেয়েছিলাম আমি ধারণা আছে তোমার! এগুলো নিয়ে মজা করে কেউ? রাসকেল!
সকাল বিধায় হসপিটালে তেমন মানুষ নেই।তবে দুই-চারজন যারা আছেন তারা হা করে তাকিয়ে।আদিত এসব পরোয়া না করে দাঁত কেলিয়ে অপর গাল বাড়িয়ে দিয়ে বললো
-‘আরেক গালে দাও প্লিজ তানাহলে আমার বিয়ে হবে না আবার।
রাইফা চেতে ওর কলার ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো
-‘খুন করে ফেলবো তোমাকে আমি।এসব নিয়ে মজা করে কেউ?ইউ ইডিয়েট…
আদিত ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বললো
-‘আমার সাথে কোনো কথা বলবে না তুমি।আই হেইট ইউ।শুনেছো?
আদিত বলে উঠলো
-‘তুমি করো হেইট
আমি করি লাভ
তুমি হবে মা
আমি হবো বাপ
রাফি বলে উঠলো
-‘ওয়াহ ভাই ওয়াহ! সেই…
রাইফা রাফির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।রাফি চুপসে গেল।রাইফা আদিতের দিকে কটমট করে তাকিয়ে বলে উঠলো
-‘তোমাকে তো ইচ্ছা করছে…
রাইফা আশেপাশে কিছু খুঁজে না পেয়ে নিজের জুতোটা হাতে নিয়ে নেয়।আদিত ওরে বাবাগো বলে লাফিয়ে নামে স্ট্রেচার থেকে।রাইফা ছুটলো ওর পেছনে।আদিত বাহিরের দিকে ছুটলো।ছুটছে আর চিৎকার করে বলছে
-‘শুনছো পৃথিবী…আমার সিনিয়র প্রেমিকাও আমাকে ভালোবাসে।আমার ভালোবাসা ওয়ান সাইড নাআআ…
আকাশ ভেঙে বারিধারা নামে তখন। রাইফা থেমে যায়।আদিতও থামে।আদিত পেছন ফিরে তাকায়।এরপর দুদিকে হাত মেলে বলে
-‘বুকে দহন নিভিয়ে দাও রাইফেল…
রাইফা প্রথমেই গেল না।ভাবলো কিছু।এরপর ছুট্টে গিয়ে লাফিয়ে পড়লো আদিতের বুকে।আদিত তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল ওকে নিয়ে।বৃষ্টিতে ভিজে যুবথবু দুজন।আদিত শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তাকে।
পেছনে আসছিল আয়ান।রাইফা নাকি কোন ছেলের সাথে হসপিটাল এসেছে এটা এক লোক তাদের বাসায় জানায়।আশেপাশে এই একটা হসপিটাল’ই আছে।তাই সে এখানে আসছিল।রাইফা আর আদিতকে ওভাবে দেখে ওর হাত থেকে ছাতাটা পড়ে যায়।হা হয়ে গেছে সে।এক পা এক পা করে পেছনে যেতে লাগলো।এতোটা আশ্চর্য তো কুহুর বিয়ের খবর শুনেও হয়নি সে।পেছনে যে ড্রেনের ঢাকনা খোলা ছিল সেটা ভুলে গেল।অসাবধানতায় ড্রেনে গিয়ে পড়লো সে।
প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩০
“ওমাআআআ!”
চিৎকার শুনে আদিত আর রাইফা পেছনে তাকায়।কাউকে না দেখতে পেয়ে আদিত বলে
-‘হবে কোনো মদন টদন..বাদ দাও…হাগ মি টাইটলি…
রাইফাও পাত্তা দিল না।
