প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩৩
অনন্যা
চাঁদ আজ মেঘের আড়াল থেকে লুকোচুরি খেলতে ব্যস্ত।মেঘ সরে যেতেই সে তার সোনালি আলো দিয়ে মুখরিত করে ফেললো চারপাশ।আবছা আলোয় ফুটে উঠলো শহরটা।কোনো নব-দম্পতি হয়তো আজ চন্দ্রবিলাস করছে আবার হয়তো কেউ নিজের বিষণ্ণ ভরা জীবনের কথা উগড়ে দিচ্ছে চাঁদের দিকে তাকিয়ে।রোদেলা কোন দলের?রাহুল রোদেলাকে ছাদে নিয়ে আসে চন্দ্রবিলাস করবে বলে।রোদেলা আসলেও তার মন অন্যদিকে পড়ে রয়েছে।রাহুলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছে তার।আহনাফ আর কুহুরও ঐদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে হবে।তার ভাগ্য এতটা নির্মম না হলেও তো পারতো।বাহিরে যত’ই বলুক সে আহনাফের প্রতি তার ফিলিংস শুধু ভালোলাগা ছিল আসল কথা তো সে জানে।আহনাফ ভাইকে যে সে ঠিক কতটা ভালোবাসে।আর কোনোদিন কি কাউকে সে এভাবে ভালোবাসতে পারবে?হয়তো না।ঐদিন সে বিয়ে করবে না কিন্তু প্রিয় মানুষকে অন্যের হতে দেখবে।অদ্ভুদ এক যন্ত্রণায় বুকের ভেতরটা বিষিয়ে উঠলো তার। রাহুল বললো
-‘আগে কখনো এভাবে চাঁদ দেখা হয়নি আমার।আজ তুমি আছো বিধায় হঠাৎ ইচ্ছা করলো।ভালোই লাগছে তাই না?
রাহুল পাশে বসা রোদেলার দিকে তাকালো কথাটা বলে।রোদেলাকে অন্যমনষ্ক দেখে কপাল কুচকালো সে।তার পাশে বসে অন্যকাউকে ভাবছে! ব্যাপারটা মানতে পারলো না ঠিক সে।রোদেলার বাহুতে হাত রেখে বললো
-‘কি ভাবছো?
রোদেলা চমকে উঠলো।রাহুল বললো
-‘এতো গভীরভাবে কি ভাবছিলে?
রোদেলা মুচকি হেসে সুন্দর একটা মিথ্যা বললো
-‘আমাদের বিয়ের কথা ভাবছিলাম।প্রথম বিয়ে করবো জীবনে ভাবা তো লাগেই।
রাহুল শব্দ করে হাসে।এরপর আচমকা রোদেলার দিকে ঝুঁকে যায়।রোদেলা চমকে পেছনে নেয়ে মাথা।দোলনার শেষ মাথায় চেপে বসে।রাহুল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বললো
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-‘আরো বিয়ে করার ইচ্ছা আছে বুঝি?
-‘যদি ভালো…
-‘ওখানেই থেমে যাও বেবিগার্ল।রাহুল’ই তোমার একমাত্র মনের অধিকারী হবে।বুঝছো?
রোদেলার মনে একটা গান ভেসে এলো তখন–“তুই পাগল তোর মনও পাগল..আরেহ তুই পাগল তোর মনও পাগল..”।জোরপূর্বক হেসে বললো
-‘জ্বী আচ্ছা।
রাহুল সোজা হয়ে বসলো।রোদেলা হঠাৎ বলে উঠলো
-‘আপনি আগে কখনো প্রেম করেছেন?
রাহুল একটু থমকায়।মিথ্যা বলবে?সত্য বললে তো রোদেলার ভালো লাগবে না।কি একটা ভেবে সে বললো
-‘একজন ছিল।
রোদেলা চমকে গেল।সে তো ভেবেছিল না বলবে।কুহুর কথা কি বলে দিবে সে?রোদেলা বললো
-‘সে কোথায় এখন?
রাহুল মলিন হেসে বললো
-‘নেই…অনেক দূরে চলে গেছে।
রোদেলা মুখ কুচকায়।
-‘মরে গেছে নাকি?
রাহুল কথাটা শোনামাত্র ওর দিকে তাকায়।রোদেলা একটু ভড়কায়।
-‘ইয়ে..মানে..ওভাবে বলতে চাইনি..
-‘হুম মরে গেছে।
-‘কিহ্!
রাহুল আকাশের পানে তাকিয়ে নিজের অভিনয় শুরু করে দিল।
-‘তার সাথে অনলাইনে পরিচয় আমার।মিট করবে বলে বায়না ধরলো।আমি দেশে এসেছিলাম।তবে দেখা আর হয়নি।আসার সময় একটা গাড়ি এক্সিডেন্টে সে…
চোখ বুজে ফেললো রাহুল।রোদেলা মুখ কুচকে তাকিয়ে।ডিরেক্ট মেরেই দিল!শ্লা কি ব’জ্জা’দ! বাধ্য হয়ে সেও অভিনয় শুরু করলোওড়নাটা মুখে চেপে কাঁদার ভান করে বলে উঠলো
-‘এত কষ্ট আপনার জীবনে! আমি এবার ছ্যাকা দিয়ে সেই কষ্ট আরো বাড়িয়ে দিব ইনশাআল্লাহ।
রাহুল চমকে বললো—“হুয়াট?”
রোদেলা মেকি হেসে বললো
-‘বললাম আমার ভালোবাসা দিয়ে সব কষ্ট কমিয়ে দিব।
-‘ওহ!
রাহুল ভাঙা ভাঙা স্বরে বলে উঠলো
-‘জীবনে কখনো ভাবিনি যে তাকে ছাড়াও আমাকে একদিন থাকতে হবে।জীবন নিয়ে আবার যে ভাবতে পারবো এটাও কোনোদিন ভাবিনি।তোমাকে দেখে বাধ্য হলাম ভাবতে।
রোদেলা বড্ড অবাক হলো।রাহুলের অভিনয় কেউ ধরতে পারবে না।রোদেলা সিউর সে যদি রাহুলের ব্যাপারে সবটা না জানতো তাহলে সেও তার এই কান্নার ফাঁদে পা দিত।মনে মনে সে বললো
“পুরুষ কি সুন্দর অভিনয় করে রে! অভিনয়ের জন্য পুরুষ সেরা রে!”
সে তাও রাহুলের কাঁধে হাত দিয়ে তাকে সান্ত্বনার গীত শোনালো।
পুরোনো একটা গোডাউন।বাহির থেকে দেখে মনে হবে এ যেন কতকাল ধরে বন্ধ পড়ে রয়েছে।গোডাউনটা মেইন রোড থেকে অনেকটা ভেতরে।পেছনে রয়েছে পুরোনো এক কবরস্থান। দিনের বেলায়ও খুব কম লোকের দেখা পাওয়া যায় এখানে।রাতে তো প্রশ্নই আসে না।এই ভুতুরে রাস্তায় এক কোণে গাড়ি পার্ক করে নেমে এলো এক যুবক।পরণে একটা হুডি আর মাস্ক।গোডাউনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো সে।পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুললো।তালাটাতেও মরিচা ধরা।সে দুটো টোকা দিল।ভেতর থেকে শব্দ শোনা গেল।ধীরে ধীরে খুলে গেল দরজাটা।যুবকের হয়তো ঠোঁটের কোণ বেঁকে গেল।ভেতরে ধুলোয় ভরপুর।বোঝাই যাচ্ছে অনেকবছর ধরে বন্ধ এটা।চারদিক কিছু কার্টুন পড়ে রয়েছে।সেগুলোতেও ধুলো জমা। সে সামনে এগিয়ে গেল।ডান দিকের দরজাটার তালা খুললো সে।নিভুনিভু আলো জ্বলছে।যুবকটা আরেকটা দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়।তালা খোলাই এটার।সে দরজা খুললো।ক্যাচক্যাচ করে শব্দ হলো।নিস্তব্ধতায় মোড়া পরিবেশটাতে এটা যেন এক অজানা আতংক ছড়িয়ে দিল। নিচের দিকে যাওয়ার জন্য একটা সিড়ি রয়েছে এখানে।সে সিড়িতে পা ফেলে নিচের দিকে যেতে লাগলো।
গোঙানির শব্দ শোনাচ্ছে কারোর।সে নিচে নেমে দাঁড়ালো।এ যেন ভিতর দিয়ে ফিটফাট বাহির দিয়ে সদরঘাট।এখানে চারদিক আলোয় ঝলমল করছে।মেঝেতে রক্তের দাগ।মাঝে একটা চেয়ারে একটা লোককে বেঁধে রাখা হয়েছে।তার মুখ বাঁধা।গায়ে শুধু ছোট প্যান্ট বাদে আরকিছু নেই।গায়ে মারের দাগ বসে গেছে। তাকে এখনো একজন মেরেই চলেছে।তবে থামলো এবার যুবকটাকে দেখে।
-‘ হোয়াটস্ আপ ব্রো? বউয়ের আঁচল ছেড়ে বের হলি ফাইনাললি?
আদিতের কথায় কিঞ্চিৎ হাসলো সে।হুডি আর মাস্কটা খুলে ফেললো।এই গরমে হুডি পড়ে কোন ছাগলে! আলোয় ভেসে উঠলো আহনাফের মুখ।রাফি রডটা ফেলে দিল।জোরে শব্দ হলো এতে।আদিত বলে উঠলো
-‘ভাই তুমি একটু ঠাণ্ডা হও।এমন শব্দ করলে আমার’ই আত্মা কেঁপে উঠে।
পাশে বসা আরিফ বললো
-‘শা’লা স্বীকার করলেই কিন্তু আর মার খায় না।সৎ অপরাধী।দেখেছিস জীবনে এমন?
রাফি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে।আহনাফ বলে উঠলো
-‘এখনো বলেনি?
-‘নাহ
রাফি শুধু এতোটুকুই বললো।আহনাফ তাকায় লোকটার পানে। মধ্যবয়স্ক এক লোক।দেখে মনে হবে সাধা-সিধে…ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানে না।তার বাবা কত ভর্সা করতো এই লোকটাকে।আর সে তার কি নিষ্ঠুর প্রতিদান দিল।আহনাফ এতোদিন জানতো এই লোক মৃত।তাদের ড্রাইভার ছিল ইনি..মালেক বোরহান। তার মায়ের এক্সিডেন্টের দিন এই লোক’ই গাড়ি ড্রাইভ করছিল।বিশ্বস্ত একজন লোক ছিলেন।অথচ ইচ্ছা করে গাড়িটা খাদের দিকে নিয়ে গিয়েছিল এই লোক।আর নিজে লাফ দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।এটা আহনাফ জানতো না।সবাই জানে বোরহান মৃত। এনার জন্য’ই তার মা আজ বেঁচে নেই।আহনাফের কথাটা মাথায় আসতেই রাগ চেপে বসে মস্তিষ্কে।
-‘গরম ফুটন্ত পানি নিয়ে আয় রাফি..এর জ্ঞান ফেরাতে হবে।
রাফি কথামতো চলে গেল।নিচ থেকে একজন গার্ডকে বলে দিল সে।কিছুক্ষণের মাঝেই হাজির হলো গরম পানি নিয়ে।আহনাফ ইশারা করতেই লোকটার মুখে ছুঁড়ে মারলো সে।ধরফরিয়ে উঠলো বোরহান।গায়ের কাঁটা দাগগুলো যেন তাজা হয়ে উঠলো।জ্বলে খারখার হয়ে যাচ্ছে পুরো শরীর।চেঁচানোর চেষ্টা করেও পারছে না।তার মুখ বাঁধা।আহনাফ মুখের বাঁধন খুলে দিতে বললো।খুলে দিতেই লোকটা চিৎকার করে উঠে যন্ত্রণায়।আহনাফ কুটিল হেসে বলে
-‘এতেই এত চেঁচাচ্ছিস! আমার মা তো জ্বলন্ত আগুনে পুড়েছিল।তার জ্বালা ঠিক কতটুকু হয়েছিল তাহলে?
বোরহান চোখ মেলে তাকায়।এতবছর পরে আহনাফকে সে চিনতে পারলো না।সেই কোন ছোটকালে দেখেছিল এখন কি আর সেসব মনে আছে! আহনাফের মা শব্দটা শুনে হয়তো চিনলো সে।তাকে ঠিক মতো চিনিয়ে দিতে আহনাফ বললো
-‘চিনতে পেরেছিস আমাকে? আহনাফ শাহরিয়ার আমি।আহান শাহরিয়ারের বড় ছেলে…আহনাফ শাহরিয়ার।
বোরহান ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো।
-‘আ’আমারে ছাইড়া দিন…আ’আমি…
আহনাফ বলে উঠলো
-‘তুই আমার বউ নাকি যে জড়িয়ে ধরে রাখবো?তোকে কে এই কাজটা করতে বলেছিল সেটা বল।তাহলেই তো মুক্তি তোর।
-‘আ’আমাকে কেউ বলেনি…
আহনাফ দুইদিকে ঘাড় বাঁকালো।আদিত আর আরিফ চেয়ারে বসে সিগারেট টানছে।আদিত একটা গালি দিয়ে বললো
-‘এ দেখি মাইয়া মাইনসের থেকে ত্যারা।ভাই তুই পুরুষ তো?
আরিফ কিঞ্চিৎ হেসে বললো—“খুলে দেখলেই তো হয়।”
রাফি বললো
-‘ভিডিও করে ভাইরাল করে দিব একদম।
আহনাফ হাত উঁচু করে ওদের থামিয়ে দিল।
-‘দেখুন চাচা…হয় বলুন তানাহলে…
-‘তানাহলে?মাইরা ফেলবেন? মাইরা ফেলেন।
আহনাফ হেসে বলে উঠলো
-‘আপনার ছেলে দুটো গ্যারেজে কাজ করে না? বিয়েও তো করেছে।আর আপনার বউ তো…
লোকটা এবার ভয় পেল।সে কেঁদে বলে উঠলো
-‘ও’ওদের কিছু কইরেন না।ওদের কিছু হইলে আমি বাঁচুম না।
-‘তাহলে বল কে করতে বলেছিল এসব?
লোকটা থামে।এরপর বলে
-‘আপনারে কইলেও আমার পরিবার শেষ হইয়া যাইবো।ওরা মাইরা ফালাইবো।
-‘কিছু হবে না।আমি কথা দিচ্ছি।
বোরহান একটা শুকনো ঢোক গিলে।আহনাফ বিরক্ত হয় এনার নিরবতায়।সে চেঁচিয়ে বললো
-‘এক্ষুণি এর পরিবারের সবাইকে শেষ করে ফেলবি।লোক পাঠা দ্রুত।ছোট ছেলের ঘরে একটা বাচ্চা হয়েছে না? ওটাকেও মারবি।
বোরহান এবার বলে উঠলো
-‘নাআআ..আ’আমি বলছি..আমি বলছি আমাকে এই কাজটা করতে…..
বোরহান এবার গরগর করে একের পর এক সব বলতে থাকে।আহনাফ সবটা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল।সাখাওয়াত আলম না তার মানে? সে ভুল জানতো এতদিন?তবে বোরহানের কথা তার বিশ্বাস হচ্ছে না।
-‘সত্য বলছিস?
-‘আমার বউয়ের কসম।
আদিত বলে উঠলো
-‘ওরে শা’লা! মানে গেলে বউ যাক তুমি থাকো তাই তো?
-‘না সাহেব এটা সত্য।আচ্ছা..আমার কসম।
আরিফ বলে উঠলো
-‘কসম কাটবেন না।এটা পাপ।
বোরহান কি বলবে বুঝলো না।এরা বলে কসম কাটা পাপ! তাহদে মানুষ খুন কি পূণ্যের কাজ? প্রশ্নটা ভেতরেই চেপে রাখলেন তিনি।
-‘আমারে এইবার ছাইড়া দেন সাহেব।
আহনাফ তাকালো তার মানে।এদিকে অপরাধীর নাম শুনে সবাই
হা হয়ে গেছে।ইহা কীভাবে সম্ভব?আহনাফ হাসলো।জোরে জোরে হাসতে লাগলো।সবাই চমকে যায়।রাফি গালে হাত ঠেকিয়ে বসে রয়েছে,অনুভূতিহীনভাবে।আহনাফ হাসির মাঝেই বোরহানের মাথায় গুলি করে দিল।লোকটা হা করেছিল কিছু বলার জন্য তবে বলা আর হলো না।হা থেকেই তার প্রাণপাখি উড়াল দিল।আদিত অপর হাতের আপেলটা বোরহানের মুখের ভেতর দিয়ে দিল।এরপর ফোন বের করে বললো
-‘চিজ কাক্কুউউ…
মরা মানুষ আবার চিজ! আহনাফ বলে উঠলো
-‘এর ব্যবস্থা কর তোরা।আমার মাথা ঘুরছে।
-‘সে কি রে! ঐদিন’ই না বিয়ে করলি! এর মধ্যেই সব হয়ে গেল?
আদিতের কথা শুনে আহনাফ ওর পিঠে ধরাম করে গিল বসিয়ে দিল।আহনাফ গায়ের রক্ত মুছতে মুছতে বললো
-‘আমি বাসায় যাচ্ছি।তিলোত্তমা একা বাসায়…রাফি?
-‘হুঁ?
-‘এমনভাবে পড়ে আছিস কেন? জানা ছিল এদের মাঝেই কেউ হবে।এত অবাক হওয়ার তো কিছু নেই।এর অবস্থা কর একটা।আমি দেখছি মেইনকালপ্রিটকে।
রাফি মাথা নাড়ালো।আহনাফ হুডি , মাস্ক করে আবার বেরিয়ে পড়লো।পেছনে রেখে গেল কালো জগৎটাকে।
-‘আহনাফ কি করছেন?দরজাটা খুলুন না!
কুহু দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে বললো কথাটা।ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজে।আহনাফ দরজার ওপাশ থেকে বললো
-‘আর পাঁচ মিনিট।
কুহু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বিছানায় বসলো।এক ঘণ্টা হলো আহনাফ কুহুর কক্ষের দরজা বন্ধ করে রেখেছে।কি জানি কি করছে! কুহু বিছানায় বসলো।পড়নে এখনো সেই শাড়িটা।কুহু ফোনটা হাতে নিয়ে ফেইসবুকে গেল।রোদেলা কি যেন একটা স্টোরি দিয়েছে।কুহু সাথে সাথে সেটা দেখতে ক্লিক করলো।উপরে চাঁদের ছবি আর নিচে রাহুলের বাহু জড়িয়ে ধরা ছবি দিয়েছে।ক্যাপশন দিয়েছে সবার চাঁদ আর আমার চাঁদ।কুহু রাগে এবার ঠিক করে যে ওকে সব জানিয়ে দিবে।এভাবে আর কত! এই শয়তানটার সাথে বিয়ে হলে ওর জীবন শেষ।আর এক আহনাফ! বিয়ে নিয়ে কি তাড়া তার!
এই মাসের বিশ তারিখ’ই সে বিয়ে করবে।কোথায় ওদের বিয়েটা আটকাবে তা না!কুহুর হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়ে।এই মাসের বিশ তারিখ না রেনানের জন্মদিন? নাকি অন্যদিন? কুহু ভুলে গেল নাকি?নাহ্ বিশ তারিখ’ই তো।কেউ তো কিছু বললো না এই ব্যাপারে।কুহুর ভাবনার মাঝেই দরজা খোলার শব্দ হলো।আহনাফ এগিয়ে এলো।ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলা করছে তার।পড়নে কালো রঙের টি-শার্ট আর প্যান্ট।কুহু মুগ্ধ হয়ে যায়।এই ছেলটা এত সুন্দর কেন আল্লাহ মালুম।কত ফর্সা, লম্বা,বডি মাসেল কত সুন্দর! সবদিক থেকে পারফেক্ট। ছেলে মানুষ এত ফর্সা হবে কেন? সে হবে শ্যাম বর্ণের।কুহুকে পাশে দাঁড়ালে কেমন একটা দেখা যায় না এখন! সে শ্যামলা আর আহনাফ কত ফর্সা! আহনাফ কুহুকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো
-‘ম্যাডামের কি দেখা শেষ হয়েছে? আপনি বললে কিন্তু আমি শার্টও খুলে ফেলতে পারি।ভালো করে দেখতে পারবেন তাতে।খুলবো?
কুহু চোখ সরিয়ে নেয়।আমতা আমতা করে বলে
-‘আ’আমি আ’আপনাকে কেন দেখবো?আ’আমি তো…
আহনাফ ঠোঁট কামড়ে হেসে ওর কথার মাঝ পথেই বললো
-‘আরেহ লজ্জার কি আছে! আপনার জিনিস আপনি দেখবেন না তো কে দেখবে? এত বছর ধরে কষ্ট করে বডি বানালাম যেন বউ দেখে মুগ্ধ হয়।মুগ্ধ না হলে তো কষ্ট’ই বৃথা। ওয়েট..আমি শার্ট খুলছি..ভালো করে দেখুন।
আহনাফ শার্টের বোতামে হাত দিতেই কুহু চোখ বড় বড় করে ফেললো।কোলের বালিসটা ছুঁড়ে মেরে বললো
-‘আহনাফফ..স্টপপপ..
আহনাফ বালিসটা ধরে ফেললো।এরপর হো হো করে হাসতে লাগলো।কুহুর দিকে এগিয়ে এলো সে।এরপর দুই হাত সামনের দিকে করে জেন্টেলম্যানের মতো করে বললো
-‘প্লিজ ম্যাম..এই অধমের সাথে চলুন…
কুহু হাসলো। নামলো বিছানা থেকে।ড্রয়িংরুমে আসতেই কুহু হা হয়ে গেল।কোনো কৃত্রিম আলো নেই।মোমব্তির আলোয় পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠেছে।নিচে গোলাপির পাপড়ি।কুহুকে হা করে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহনাফ মিটিমিটি হাসে।এরপর বললো
-‘ক্যান্ডেল লাইট ডিনার রেডি ম্যাম…
ডাইনিং টেবিলের দিকে ইশারা করলো আহনাফ।কুহু কি বলবে বুঝতে পারলো না।স্বপ্ন দেখেছে বলেই তা পূরণ করতে হবে! আল্লাহ এমন একজনকে তার জীবনে পাঠাবে এটা সে কোনোদিন ভেবেছিল? কুহু হঠাৎ’ই আহনাফকে জাপটে জড়িয়ে ধরে।আহনাফ ভড়কে গেল।হৃদস্পন্দন থমকে গেল যেন।কুহু কান্না করছে।আফসোসের স্বরে বলছে
-‘আগে কেন এলেন না আমার জীবনে? কেন এত দেরি করলেন?
আহনাফ চোখ বুজে ফেললো।আহ্! অন্তঃকরণে শান্তির স্রোত বয়ে গেল তার।তিলোত্তমার এই আফসোসটাই তো সে দেখতে চেয়েছিল।আর কোনোকিছু চাওয়ার নেই তার।তিলোত্তমা তাকে বুঝেছে।তাকে কাছে টেনে নিয়েছে।আহনাফের ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে তার তিলোত্তমাকে।বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলার প্রয়াস যেন।কুহু কান্না করেই যাচ্ছে।আহনাফ এত জোরে ধরেছে যে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো তার।হুশে ফিরলো কুহু।আহনাফকে সরাতে চাইলো।আহনাফ ছাড়ছে না।কুহু বলে উঠলো
-‘ ছাড়ুন আমাকে…মেরে ফেলবেন নাকি?
আহনাফ বলে উঠলো
-‘মেরেই ফেলবো আজ।
-‘কিহ্?
আহনাফ কিছু বললো না।ধীরে ধীরে ছাড়লো তাকে।কুহুর চশমাটা খুলে ওর চোখ মুছিয়ে দিল।আহনাফ বললো
-‘তুমি চশমা ছাড়া দেখো না চোখে?
-‘কানা নই আমি।একটু পাওয়ারে ঘাটতি আছে তাই..
আহনাফ ওকে আবার চশমাটা পড়িয়ে দিল।কুহু বললো
-‘এসব কেন করতে গেলেন?
-‘বারেহ! আমার তিলোত্তমা স্বপ্ন দেখেছে আর আমি তা পূরণ করবো না?
কুহু বলে উঠলো
-‘এতো ভালোবাসবেন না আহনাফ।নাটক মনে হয় আমার কাছে।
আহনাফ প্রথমে হাসলেও পরে সেই হাসি উবে গেল।
-‘নাটক!
-‘নাটক নাহলে আপনি পাগল।স্বপ্ন দেখলেই পূরণ করতে হবে নাকি!
আহনাফ বলে উঠলো
-‘অবশ্যই পূরণ করতে হবে।আমার তিলোত্তমার সব স্বপ্ন আমি পূরণ করবো।
কুহু বলে উঠলো
-‘ধরেন আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি উড়তেছি।তাহলে?
-‘হেলিকপ্টার রাইডে নিয়ে যাব।
-‘অ্যাঁ!!
কুহু হো হো করে হাসতে লাগলো।আহনাফ কপাল কুচকায়।কুহু বললো
-‘এমনভাবে বললেন মনে হলো যেন হেলিকপ্টার না ঠেলাগাড়িটা।বাদ দিন ভাই।আজ করেছেন, করেছেন..আর যেন না দেখি এসব।টাকা ভেবেচিন্তে খরচ করবেন।অযথা খরচ করলে ভবিষ্যতে থালা হাতে ঘুরতে হবে আমাদের।
আহনাফ শব্দ করে হাসে।
-‘চাকরি করি না ঠিক তবে আয়ের উৎস আমার আছে।ওগুলো দিয়েই সারাজীবন চলে যাবে।এখন এসব বাদ দাও।আসো..ক্ষুধা লেগেছে না?
-‘হুম অনেক।
আহনাফ কুহুকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলের কাছে এলো।খাবার দেখে চক্ষু চড়কগাছ। চাউমিন,স্যুপ,পিৎজ্জা,বার্গার,বিরিয়ানিও আছে।এছাড়া আরো অনেক খাবার। সে আহনাফের দিকে তাকিয়ে বললো
-‘খাবার কম হয়ে গেল না?
আহনাফ বললো
-‘আমারও তাই মনে হচ্ছিল।আচ্ছা আমি বরং অরো কিছু..
কুহু তার কথার মাঝেই বলে উঠলো
-‘ডাকুন তাদের..
আহনাফ ভ্রু কুচকে বললো
-‘কাদের?
কুহু দাঁতে দাঁত চেপে বললো
-‘রাক্ষসদের, যারা এখন এগুলো খাবে।
আহনাফ বলে উঠলো
-‘কিন্তু এগুলো তো তোমার জন্য।
কুহু কি বলবে বুঝতে পারলো না ঠিক।সে বললো
-‘আপনি পাগল না আমি পাগল?
-‘মেইবি দুজনেই।
কুহু অসহায় স্বরে বললো
-‘আরে বাঙ্গির পোলা! এত খাবার কে খাবে?তোর নানা? ঘটে কি গোবরও নেই?
আহনাফের মুখটা ছোট হয়ে গেল।কুহু বললো
-‘এত খাবার একসাথে কোন সাধারণ মানুষ খেতে পারবে?
আহনাফ বললো
-‘তোমার তো এসব পছন্দ তাই…
-‘তাই সব একদিনেই আনতে হবে?কত টাকা অপচয় করেন আপনি, আহনাফ! টাকা বেশি হয়ে গেলে আমাকে দিয়ে দিন তাও এমন করে অপচয় করবেন না।কলিজা ছিঁড়ে যায়, ভাই।
-‘আচ্ছা যতটুকু পারো খাও।
কুহু বসলো চেয়ারে।মাথায় হাত তার।আহনাফ একটা শুকনো ঢোক গিললো যেন আরো একটা কাণ্ড ঘটিয়ে এসেছে সে।কুহু প্লেট ঠিক করছে দুজনের।
-‘ইয়ে.. তিলোত্তমা!
-‘আবার কি?
আহনাফ মিনমিন করে বললো
-‘আমি এসব আনহেলদি খাবার খাই না।তোমার মুড অফ ছিল তাই তোমার জন্য আনলাম আরকি।
কুহু এক ভ্রু উঁচু করে বললো
-‘বলতে কি চাইছেন?
আহনাফ বলেই ফেললো
-‘আমি না বাহির থেকে খেয়ে এসেছি।
কুহু এক লাফে দাঁড়িয়ে পড়লো।আহনাফ ভয়ে উঠে দু কদম পিছিয়ে গেল।এই ছেলে নাকি আবার একটু আগে একটা মার্ডার করেছে! শখের নারীর কাছে সব সিংহ’ই বিড়াল হয়ে যায়।আহনাফকে দেখে তাই বুঝা যাচ্ছে।কুহু রাগে থরথর করে কাঁপছে।আহনাফ বলে উঠলো
-‘য’যতটুকু খেতে পা’পারো খাও।বাকিটুকু বা’বাহিরের ভিখারিদের দিয়ে আসবো।
কুহু আহনাফের দিকে রাগে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।আহনাফ বুকে হাত দিয়ে বললো
-‘দম বন্ধ হয়ে যাবে এভাবে তাকিও না।
কুহু ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বসলো।আহনাফকে বকতে বকতে সে নিজের প্লেটে বিরিয়ানি নিল।আহনাফও বসলো।সে এক হাত গালে ঠেকিয়ে তাকে দেখছে।কুহু হঠাৎ প্রথম লোকমাটা আহনাফের মুখের কাছে ধরলো।আহনাফ হাসলো।সে এসব খাবার এড়িয়ে চলে তবে তার তিলোত্তমা নিজ হাতে খাইয়ে দিচ্ছে বলে খেল।তিলোত্তমার হাতে বিষ পান করতেও তার দ্বিধা নেই।কুহু বললো
-‘যাক, সব ঠিক আছে তাহলে।
-‘মানে?
-‘দেখলাম কেউ আবার বিষ মিশিয়ে রাখছিল নাকি..আপনার তো আবার শত্রুর অভাব নেই।খেয়ে যদি লটকে যেতাম?
আহনাফ চমকে তাকালো তার পানে।আয়হায়! এ দেখি ঘর শত্রু বিভীষণ! সে আরো ভাবলো ভালোবেসে খাইয়ে দিচ্ছে বোধহয়। কুহু এক লোকমা নিজের মুখে দিল।এরপর বললো
-‘বাকি খাবারগুলো একটু টেস্ট করুন তো।কিছু মিশিয়ে দেয়নি তো আবার?
আহনাফ কুহুর দিকে তাকিয়ে।কুহু তা খেয়াল করতেই ফিক করে হেসে ফেললো।আহনাফও হাসলো।খাওয়া শেষে আহনাফ জুস নিয়ে এলো ফ্রিজ থেকে।মূলত নিজের জন্য ওয়াইন এনেছে আর কুহুর জন্য অরেঞ্জ জুস্। কুহু আহনাফের জন্য আনা ওয়াইনের রং লাল দেখে বললো
-‘আমি লালটা খাবো।এটা কি স্ট্রবেরির?
আহনাফ দ্রুত বেগে বললো
-‘নাহহহ..এ’এটা তোমার জন্য না।তুমি এটা নাও..
কুহু কপাল কুচকালো।বললো
-‘কেন? এটাতে নির্ঘাত কিছু মেশানো তাই না?
-‘ভালোবাসা মেশানো।নাও এখন…
কুহু মুখ গোমড়া করলো।আহনাফ বলে উঠলো
-‘এটা বড়দের জন্য।তুমি পান করতে পারবে না এটা।রাগ করে না, সোনা।
কুহু কথা বলে না।আহনাফ ‘চ’ সূচক শব্দ করলো।এক গ্লাস পান করলে নেশা হয়ে যাবে?তার তো হয় না।আহনাফ হাল ছেড়ে বললো
-‘আচ্ছা লালটাই নাও।
কুহুর ঠোঁটে গাঢ় হাসির রেখা দেখা গেল।আহনাফ মনে মনে বললো—“নাটকবাজ!” কুহু গ্লাসটা মুখের সামনে আনতেই গন্ধে নাক কুচকে ফেলে।আহনাফ বললো
-‘আগেই বলেছিলাম..
কুহু মুখ ভেংচি কেটে পুরোটা একবারের পান করে ফেললো।আহনাফ অরেঞ্জ জুসটা টেবিলে রেখে দিল।কুহু পুরো গ্লাস খালি করে মুখটা মুছলো হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে।হঠাৎ’ই কেমন করে হাসতে লাগলো সে।
-‘কি খাওয়ালেন, আহনাফ! জীবনে খাইনি মাইরি।আরেকটু দিন না…
আহনাফ ভড়কে গেল।সে বলে উঠলো
প্রণয়ের অন্তিমক্ষণ পর্ব ৩২
-‘আ’আর তো নেই।
কুহু মুখ কুচকালো। বললো
-‘পঁচা জামাই…কথা নেই তোর সাথে।
আহনাফ একটা শুকনো ঢোক গিললো।নেশা হয়ে গেল নাকি এর?হঠাৎ কুহু হেসে উঠলো।আহনাফের দিকে কেমন করে যেন তাকালো।আহনাফ ঘাবড়ে গেল খানিকটা।তবে কি আজ পুরুষ নির্যাতন হবে এই ঘরে? আহনাফের ইজ্জত বাঁচবে তো আজ?কুহু ওর দিকে এগোতে নিলে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।কুহুও দাঁড়ালো।আহনাফ পেছনে যাচ্ছে এক পা এক পা করে।কুহু এগোচ্ছে।আহনাফ দেয়ালে ঠেকে গেল একটা সময়।দুই হাত ক্রস করে বললো
-‘ডোন্ট হরণ মাই ইজ্জত….
