প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৫৮ (২)
Drm Shohag
মাইরা নিজেকে সামলে নিতে চায়। মাথা নিচু করে নেয়। বেশ অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। ঘণ্টা বাজলো। সবাই ক্লাসের দিকে অগ্রসর হলো। তবে মাইরা উঠলো না। না তো উঠলো মিলা। মাইরার মাথা নিচু। মিলার দৃষ্টি মাইরার পানে। মেয়েটার চোখেমুখে অসহায়ত্ব।
মাইরা হঠাৎ-ই ভাঙা গলায় বলে,____”যে মা আমাকে পেটে ধরেছিল, সে কখনো সুখ পায়নি জানিস মিলা? কারণ শুনবি? তার গায়ের রঙ ছিল শ্যামলা। আমার আসল বাবা তাকে মানতো না। পছন্দ করতো না। আমার দাদি খুব ভালো মানুষ ছিল। সে আমার মা কে নিজের ছেলের থেকে আগলে রাখতো। হায়রে পুরুষ মানুষ! মায়ের গায়ের রঙ তার চেয়ে চাপা ছিল বলে মাকে মেনে নেয়নি, অথচ আমি হেঁটে হেঁটে মায়ের পেটে চলে এসেছিলাম।
কথাটা বলে মাইরা বিদ্রুপের হাসি হাসে। মিলার দিকে ভেজা চোখে তাকায়। অতঃপর বলে,____”কি বুঝলি মিলা?
মিলা অদ্ভুদ চোখে চেয়ে আছে মাইরার দিকে। মাইরা ম্লান হেসে বলে,____”সেই মা কে কখনো দেখিনি। কিন্তু আমাকে পেটে রেখেছিল, কথাটা ভাবলেই কেমন যেন লাগে। মায়ের স্পর্শ টা-ই পায়নি। কেন যেন কষ্ট হয় সেই না দেখা মায়ের জন্য। সে আমাকে পেটে নিয়ে স্বামীর লাথি খেয়েছে পেটে। তার দোষ ছিল গায়ের রঙ সাদা নয় কেন!
ওহ সেই বাবা আবার আমায় খুব ভালোবাসতো। কারণ আমার চামড়া সাদা, একদম তার মতো। মায়ের মতো হলে হয়তো সে নিজেই আমাকে ডাস্টবিনে ফেলে আসতো!”
মাইরার চোখ থেকে আক্ষেপের অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। একটু থেমে আবারও বলে,
“আমার সৎ মা টা খুব ভালো। ভাগ্য করে এমন সৎ মা পাওয়া যায়। কিন্তু আমার বাবা আমার সৎ মা কে কেন বিয়ে করেছিল জানিস? বউ ছাড়া পুরুষ মানুষের রাত যায় না বোধয়। তাই আবার বিয়ে করল। এবার বিয়ে করার সময় সেই আগের ভুল করেনি। একদম সাদা চামড়ার মেয়েকে বিয়ে করে আনলো। আমার মা মারা যাওয়ার কয়েকমাসের মধ্যেই বিয়ে করল। অযুহাত হিসেবে দিল দুধের বাচ্চার মা প্রয়োজন।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমি একটা কথা ভাবি, আমার গর্ভধারিণী মা যদি মারা না গিয়ে বেঁচে থাকতো কোনোভাবে। এরপর হঠাৎ একদিন এসে দেখত, সে দু’দিন নেই,, তাই তার স্বামী মনের মতো একটা ফর্সা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে। তাহলে আমার মায়ের মনের অবস্থা টা কি হত?”
মাইরা কথাটা বলে আকাশপানে তাকায়। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যায়। মাইরার ইচ্ছে করে মেঘের কোলে বসে ভেসে যেতে। মলিন হেসে বিড়বিড় করে,___”মেঘমালা তুমি যদি আমায় আমার গর্ভধারিণী মায়ের বুকে নিয়ে যেতে পারতে, তবে আমি তোমার কোলে উঠে যেতাম! কত ভালো হত!
ইশ! সত্যিই যদি এমন হতো!”
দৃষ্টিজোড়ায় অসহায়। চোখের কোণ ঘেষে অশ্রু গড়ায়। মাইরা চোখজোড়া নামিয়ে নেয় ঘাষের উপর। এরপর আবারও বলে,_
“আমার সৎ মা খুব ভালো। আমার বাবা তো আর তাকে ভালোবেসে বিয়ে করেনি। রূপ দেখে ঘরে এনেছে। আমার দায়িত্ব দিয়েছে তার হাতে। সে আমাকে নিজের মেয়ের মতো করে আগলে রেখেছে। কিন্তু বাবাও বেশিদিন থাকলো না। দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে গেল। আমার মনে হয়, আল্লাহ ঠিক-ই করেছে বাবাকে নিয়ে। আমার সৎ মায়ের আমার বাবার চেয়ে অনেক ভালো স্বামী প্রাপ্য। তাই হয়তো আমার বাবাকে আল্লাহ নিয়ে নিয়েছে।”
কথাগুলো বলে আবারও বেশ অনেকক্ষণ চুপ থাকলো মাইরা। চোখজোড়া বারবার ঝাপসা হয়। দু’হাতে ঝাপসা দৃষ্টি মুছে নেয়। এরপর ভাঙা গলায় বলে,_____”এসব গল্প আমার দাদির কাছে শুনেছিলাম। আমার দাদি আমার ক্লাস এইট এর শেষের দিকে মারা যায়। এরপর আরও একা লাগতো। প্রথম যখন শুনেছিলাম ওটা আমার সৎ মা। আসল মা নয়। খুব ভ’য় লাগতো তাকে। কিন্তু মা আমাকে জড়িয়ে নিয়ে আমার ভ’য় ভাঙাতো। এরপর সহজ হয়ে মায়ের সাথে থাকতাম সবসময়।
তবে আস্তে আস্তে বড় হলে বুঝতে পারলাম তার স্বামী আমায় পছন্দ করে না। না করার-ই কথা। আমি তো তাদের কেউ না।”
মাইরা থামে। লম্বা শ্বাস ফেলে আবারও দু’হাতে ঝাপসা চোখজোড়া মুছে নিয়ে বলে,_____”আমার গল্পের বই খুব ভালো লাগে। কিন্তু কখনো কিনতে পারিনি টাকার জন্য। আমার ফ্রেন্ডদের বোন বা যে কেউ, এদের থেকে বই আনতাম। তারপর পড়া শেষে ফেরত দিয়ে দিতাম। তারপর একদিন শিসওয়ালা কে পেলাম। কিভাবে যেন ভালোবাসলাম। আবার হারিয়েও ফেললাম। আবার ফিরে পেলাম। কিন্তু সে তো আমায় ভালোবাসে না।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে আগুনের মধ্যে গিয়ে বসে এই সাদা চামড়া পুড়িয়ে ফেলি। এরপর যে অল্প কয়েকজন আমায় ভালোবাসবে, ওইটুকু খাঁটি ভালোবাসা গুলো আমি অনুভব করব।”
এরপর থেমে যায় মাইরা। জড়িয়ে আসে কথা। বেশ কিছুক্ষণ পর কেমন করুণ কণ্ঠে বলে,____”আমার শিসওয়ালা আমায় না দেখে কেন ভালোবাসলো না মিলা? আমার ভীষণ ক’ষ্ট হয়।”
কথাটা বলে দু’হাতের মাঝে মুখ লুকায়। চোখ থেকে নিরব অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
ওভাবেই বিড়বিড় করে,_____”আমায় ভালোবাসার মতো কেউই নেই। গর্ভধারিণী মা নেই, বাবা নেই, সৎ মা থেকেও নেই, শিসওয়ালা আমার মোহে আটকে আছে।”
মিলা এগিয়ে এসে মাইরাকে জড়িয়ে ধরল। পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,___”রূপ দেখে মোহে পড়লে তারা যত্নের কথা ভুলে যায় মাইরা। তোর স্বামী তো তোকে যত্ন করে। তুই তোর সেই বাবার সাথে সবাইকে গুলিয়ে ফেলছিস কেন?”
মাইরা কিছু বললো না। মিলা বোঝানোর স্বরে বলে,____”তোদের মাঝে সম্পর্ক টা স্বাভাবিক কর। তোর স্বামীর ইচ্ছে পূরণ কর। নয়তো সেই দাদিমার ছেলের কথা মনে আছে? ওমন হলে? তখন তোর শিসওয়ালা হারিয়ে যাবে।”
মাইরা নাক টেনে বলে,____”হারিয়ে গেলে যাবে।”
মিলা হেসে বলে,____”তোর শিসওয়ালা অন্যকারো হয়ে যাবে।”
মাইরা মিলাকে ছেড়ে কণ্ঠে কিছুটা রাগ ঢেলে বলে,_____”শরীর না পেয়ে যারা অন্য নারীতে আসক্ত হয়, ওরা নোংরা হয়। ওরা ভালোবাসতে পারে না। ওদের ভালোবাসা নামক ফা’ল’তু জিনিস আমার লাগবে না। সেটা শিসওয়ালা হলেও।”
মিলা মিটিমিটি হেসে বলে,_____”তুই কতদিন ভার্জিন থাকার ডিসিশন নিলি?”
মাইরা বিব্রতবোধ করে। কোনোরকমে উত্তর করে,___”জানিনা”
মিলা বোঝানোর স্বরে বলে,____”তুই বেশি ভাবছিস। তোর দাদি শ্বাশুড়ির কথা ভুলে কেন যাস বারবার? আমি তোর ভালো চাই মাইরা। তোর যদি এই বিয়েটা ভেঙে যায়, তখন কি হবে ভেবেছিস একবারও? সমাজে একটা ডিভোর্সি মেয়ের জায়গা কোথায় থাকে জানিস না? তাদের তো বাবা মা থাকে। তবুও সেই মেয়েকে কত ভুগতে হয়। আর তোর পাশে কে থাকবে বল? তোর সৎ মা তোকে ভালোবাসে, কিন্তু চাইলেও তো পাশে থাকতে পারে না। তুই তোর স্বামীর ইচ্ছে পূরণ করে দে বোন। নয়তো পরিণতি অন্যকিছু হলে তোর কি হবে বল?”
মাইরা স্তব্ধ চোখে মিলার দিকে চেয়ে রইল। একটা কথাও বললো না। শুধু চেয়েই রইলো। মিলা বিরক্ত হয় মাইরার নিরবতায়। এ পর্যায়ে রে’গে বলে,____”তুই সবসময় দশলাইন বেশি বুঝিস। যখন রাস্তায় বের করে দিবে তখন এসব ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালাবে। ভালোবাসার আশায় বসে থাকতে থাকতে তোর স্বামী তোকে ধাক্কা মেরে বের করে দিয়ে, আরেক রূপবতীকে ঘরে তুলবে। তখন রাস্তায় ভিক্ষার থালা নিয়ে ঘুরিস। এতো আবেগ দিয়ে দুনিয়া চলে না। আবেগ এর ঠেলায় স্বামীকে কাছে আসতে না দিয়ে আঙুল চু’ষে খা। তারপর সে আরেকজনকে…..
আর বলতে পারে না। মাইরা রে’গে মিলার গালে একটা থা’প্প’ড় মেরে দেয়। মিলা অবাক হয়ে তাকায় মাইরার দিকে।
মাইরার চোখ দু’টো লাল। চোখ থেকে অবাধ্য নিঃশব্দ কান্নাগুলো টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ে। অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পরও মাইরাকে এমন এক ধ্যানে নিজের দিকে চেয়ে থাকতে দেখে খারাপ লাগে মিলার। মেয়েটা কেমন যেন শক পেয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় তো দেয়ই। মিলা বুঝল সে হাইপার হয়ে অনেক ভুলভাল বলে ফেলেছে। অতঃপর মাইরাকে ঝাঁকিয়ে বলে,____”স্যরি মাইরা!”
মাইরার ধ্যান ভাঙলো বোধয়। ভাঙা গলায় বলে,___”অন্যকে টানছিস কেন বারবার?”
মিলা ছোট করে বলে,___”কারণ ছেলেরা মৌমাছির মতো। এক ফুলে মধু না পেলে আরেক ফুলে মধুর সন্ধানে চলে যায়। আমার মা সবসময় এটা বলে।”
মাইরা ঢোক গিলল। অস্ফুটস্বরে বলে,____”ওহ।”
কথাটা বলে আনমনা হয়। চোখ থেকে আরও কয়েক ফোঁটা অবাধ্য অশ্রু গড়ালো।
বেশ কিছুক্ষণ পর মাইরা মাথা নিচু করে দু’হাতে চোখমুখ মুছে মিলার দিকে চেয়ে হেসে ফেলল। মিলার যে গালে থা’প্প’ড় দিয়েছে সে গালে একটা চুমু খেয়ে বলল,___”আমি স্যরি। মনে রাখিস না মার টা। চাইলে দশটা ফিরতি থা’প্প’ড় দিয়ে দিস আমাকে।”
এরপর কোলের উপর রাখা বইটি নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মাইরাকে উঠতে দেখে মিলাও উঠে দাঁড়ালো। মাইরা হেসে বলে,___”তুই ক্লাসে যা মিলা। আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।”
মিলা অবাক হলো না। মাইরা তো এমনই, সবসময় কেমন যেন হাসে। সে বুঝেছে মাইরা খুব কষ্ট পেয়েছে। মাইরা উল্টো ঘুরে দু’পা এগোলে মিলা বলে ওঠে,____”তুই কি আমার কথায় মন খারাপ করলি মাইরা? আমি তোর ভালো জন্যই বলতে চেয়েছিলাম। স্যরি!”
মাইরার পা থেমে যায়। মিলার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে মৃদু হেসে বলে,____
“নাহ রে! মন খা’রা’প করব কেন?
শুধু বুঝলাম মেয়েরা পুতুল। তাদের মাথার উপর ছায়া নামক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার মেশিন রূপি মানুষ থাকে। এই দেখ বিয়ের আগে আমার মা নামক ছায়া আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে একজনের সাথে বিয়ে দিয়ে দিল। এখন আমাকে সেই সংসার বাঁচাতে নিজেকে বিলিয়ে দিতে হবে। নয়তো স্বামী অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে যাবে। এখানে আমি সেই সিচুয়েশনে এর জন্য প্রস্তুত নই, তবুও আমার ইচ্ছেয় কি আসে যায়? সংসার বাঁচাতে হবে তো! আমাদের চাওয়া পাওয়া সব ছুঁড়ে ফেলে স্বামীর চাওয়া মেটাতে হবে। এটাই।”
কথাটা বলে আর দাঁড়ালো না। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে মলিন কণ্ঠে বলে,_____”ছোটবেলায় লুডু খেলতাম। আমার গুটি খেয়ে নিলে আমি কাঁদতাম। আর এখন জীবনের এতো জটিল জটিল খেলা দেখে হাসি।”
আরেকটু এগিয়ে গিয়ে থেমে যায় মাইরা। পিছু পিছু মিলা আসছে। মাইরা উল্টো ঘুরে মিলার দিকে তাকায়। মিলা অপরাধী চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা মিলার অবস্থা থেকে পেট চেপে হাসতে লাগলো। কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বলে,____”তুই এমন দেবদাস হয়ে গেলি কেন, বুঝলাম না। বোন রে জামাই প্যারা দিলে এসব কাজে লাগবে। তখনকার জন্য মন খা’রা’পের ডোজ জমিয়ে রাখ। ক্লাসে যা।”
মিলা মাইরার হাত ধরে বলে,_____”স্যরি মাইরা। তুই আমার কথায় কষ্ট পেয়েছিস জানি।”
মাইরা মৃদু হেসে বলে,____”কষ্ট কি সেটাই তো বুঝিনা। পাবো কি করে?
একটু থেমে উদাস কণ্ঠে বলে,
বাবা মারা যাওয়ায় আফসোস করিনা, যে আমার মাকে ভালোবাসেনি। অ’মানুষের মতো আচরণ করেছে আমার মায়ের সাথে, সে বেঁচে থাকলে আমি তাকে বাবা বলে ডাকতে পারতাম না কখনো। ওমন বাবা আমার নেই তাতেই শান্তি আমার।
মা মারা যাওয়াতেও আমি শান্তি পেয়েছি। বাঁচলে আবার আমার বাবার ঘরেই আসতো। আবার অ’ত্যা’চা’র সহ্য করতে হতো। ওমন অ’মানুষ নামক স্বামীর ঘরের চেয়ে মাটির তলা-ই মায়ের শান্তির জায়গা।
শুধু একটা তীব্র আফসোস হয়, সেদিন মায়ের সাথে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গর্ভধারিণী মায়ের বুকের উপর আমার একটুখানি জায়গা কেন হলো না!”
কথাগুলো বলে লম্বা করে শ্বাস ফেলল মাইরা। ডান হাতে ঝাপসা চোখ দু’টো স্বাভাবিক করে নিয়ে ডান পাশে তাকালো। হঠাৎ-ই হাত উঠিয়ে বলে,___”এই লিয়ানা দাঁড়া আমার জন্য। আমিও ওয়াশরুমে যাবো।”
কথাটা বলে দৌড় লাগায়। পিছু ফিরে মিলার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,___”ক্লাসে যা বান্ধবী।”
মিলা অসহায় চোখে চেয়ে রইলো।
লাস্ট দু’টো ক্লাস মাইরা হেসে খেলেই শেষ করে। মিলাকে চুপ দেখে ওকে খোঁচায়। মিলা হাসে নি। মাইরা কয়েকজন পরিচিত মেয়েদের থেকে বিদায় নিয়ে মিলার হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসে। মাঠের কোণায় গিয়ে ব্যাগ থেকে পানির পট বের করে পানি খায় মাইরা। পাশেই মিলা মন খা’রা’প করে দাঁড়িয়ে আছে। মাইরা বিরক্ত হয় মিলাকে দেখে। মিলাকে ধাক্কা দিয়ে বলে,___”এই তোর কয় নম্বর স্বামীর জন্য এমন মুখ করে রেখেছিস? বে’দ্দ’প মহিলা।”
মিলা কিছু বললো না। মাইরা বোতল থেকে ডান হাতের মুঠোয় পানি নিয়ে মিলার দিকে ছুঁড়ে দেয়। সেইসময় এইদিক দিয়ে এক মেডাম যাচ্ছিল। মিলা মুখ সরিয়ে নেয়ায় পানি গিয়ে পড়ে সেই মেডাম এর মুখে।
মাইরা এটা দেখে চোখ বড় বড় করে তাকায়। সময় নষ্ট না করে দিশেহারা হয়ে দৌড় লাগায় কমন রুমের দিকে। মিলার হাত ধরতে ভোলেনি।
ওদিকে সেই মেডাম আশেপাশে তাকিয়ে খুঁজলেও পেল না। অনেক স্টুডেন্ট এর মাঝে কাউকে ধরতে না পেরে বিরক্ত হয়ে চলে গেল।
মাইরা কমন রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপায়। মিলা রে’গে বলে,___”এই গরমে এতো দৌড়াস ক্যান? ভাল্লাগে না।”
মাইরা আশেপাশে সেই মেডাম কে না দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। মিলার দিকে চেয়ে বলে,___”তোর দোষ। তুই যখন দেখলি আমি পানি মারছি। তুই মুখটা আমার হাতের দিকে এগিয়ে দিবি না? তা না করে সরিয়ে নিয়েছিস। এজন্যই তো কেলেঙ্কারি টা ঘটলো।”
মিলা অবাক হয়ে তাকালো। কি লজিক এর!
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। মন খা’রা’প হলো তার। মলিন গলায় বলল,___”তুই মিথ্যে মিথ্যে হাসিস মাইরা। এসব মিথ্যে হাসি আমার ভালো লাগে না।”
মাইরা মৃদু হেসে বলল,____”বেশি ভাবছিস। মিথ্যে হাসবো কেন। হাসতে ভালো লাগে তাই হাসি। আচ্ছা থাক, উনি চলে আসবে এখন।”
মিলা আবারও বলে,___”তোর রা’গ হয় না মাইরা, তোর শিসওয়ালা তোকে তোর মতো করে ভালোবাসে না বলে?”
মাইরা মিলার দিকে চেয়ে থাকে। সময়ের সাথে চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু অশ্রু জমে। ঝাপসা চোখজোড়া বারবার পলক ঝাপটে বলে,____”রা’গ হবে কেন মিলা? ভালোবাসা কি বলে কয়ে হয়? ভালোবাসলেও যেমন কারো দোষ থাকে না। তেমন ভালোবাসতে না পারলেও তার কোনো দোষ থাকে না। এসব মন এর ব্যাপার। তাছাড়া উনি ভালো মানুষ। উনার মন অনেক ভালো। শুধু আমাকে মা’রা’র সময় একটুও মায়া কাজ করতো না।”
লাস্ট কথাটায় কেমন অসহায়ত্ব ফুটে উঠল। আবারও বলে,
“আমি ভাবতাম শিসওয়ালা আমাকে পছন্দ করতো, আমার জন্যই শিস বাজাতো, আমাকে শোনাতে যেত। কিন্তু এটার একটুও মেলেনি। উনি আমাকে চিনতোই না রে!”
মিলা অবাক হয়ে বলে,____”সত্যিই চিনতো না? কিভাবে বুঝলি?”
মাইরা মৃদু হেসে বলে,____”যে রাত গুলোয় মাঝে মাঝে উনার শিস শুনতে পেতাম। আমি তখন ভাবতাম, অনেকে থাকে না! লুকানো প্রেমিক, লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসতে পছন্দ করে! আমি ভাবতাম সে আমাকে ওভাবে ভালোবাসে। তাই আমার সামনে আসে না।
সেই রাতগুলোর মাঝে আমি একদিন তার পিছু দৌড়াচ্ছিলাম। আমি তাকে দেখতে চাইছিলাম। আর একটু হলেই তাকে দেখতে পেতাম। কিন্তু হঠাৎ-ই হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিলাম কাঁচা মাটিতে। পড়ে গিয়ে অনেকটা শব্দ করে ডেকেছিলাম,___”শিসওয়ালা?”
লোকটা খুব শক্ত কণ্ঠে বলেছিল,___”ডিজগাস্টিং।”
আমার ভীষণ খা’রা’প লেগেছিল। আমি পড়ে গিয়েছি, অথচ লোকটা কি বিরক্তিকর সুরে কথাটা বলল। তবে আমার থেকে একটু সামনেই একটা কুকুর ছিল। ঘেউঘেউ করে ডাকছিল। বেশি আবেগ ছিল তখন। ভেবেছিলাম, আমার পড়ে যাওয়া সে দেখেনি। আর ওই শব্দটা কুকুরের জন্য বলেছে। কিন্তু আমার ধারণা টা ভুল ছিল সেটা কয়েকদিন আগে বুঝলাম।”
কথাগুলো বলতে বলতে ঝাপসা চোখে মাইরা মিলার দিকে তাকালে দেখল মেয়েটা কৌতূহলী চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে। মাইরা মলিন হেসে বলে,___”কয়েকদিন আগে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি-ই সেই শিসওয়ালা তাইনা? সে উত্তর দিয়েছিল,___”আমার শরীরে পুষ্টি নেই? আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গিয়েছি কেন?”
এটা তখন বুঝিনি। উল্টে খুশি হয়েছি এটা ভেবে এটাই আমার শিসওয়ালা! পরে অনেক ভেবেচিন্তে বুঝলাম, সে আসলে সেদিন আমার পড়ে যাওয়া দেখেছিল। কিন্তু আমি তো উটকো ঝামেলা ছিলাম। তাই আমাকে একটুও সাহায্য করতে আসেনি। আমি বরাবরই তার অপরিচিত একজন ছিলাম। বিয়ের পর পরিচিত হয়েছি। তারপর তো জানিস-ই।”
কথাগুলো বলে মাইরা মিলার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,___”একটা জিনিস দেখবি?”
মিলা প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা মিলাকে টেনে একটা সাইড দিকে নিয়ে যায়। এরপর উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। সামান্য নিচু হয়ে বোরখা উঁচু করে, এরপর ডান পায়ের প্লাজু হাঁটুর নিচ বরাবর পর্যন্ত তুলে একটা কালচে জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখায়। মিলা অবাক হয়ে তাকায়। খুবই গভীর ক্ষ’ত। শুকনো। তবে খুব গভীর ছিল বোঝা যাচ্ছে। মাইরা প্লাজু ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর হেসে বলে,____
“হোঁচট খেয়ে পড়লাম, তার একটু পরেই শিসওয়ালা বাইক নিয়ে চলে যায়। আমি ধীরে ধীরে উঠে বসি। আশেপাশ অনেক অন্ধকার ছিল। ঝোঁকের বসে বেরিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু তখন একা একা খুব ভয় লাগছিল। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালে দেখলাম ডান পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতেই পারছি না। জোর খাঁটিয়ে হাঁটতে গেলে ঠাস করে পড়ে যাই আবারও।
কি যে অসহায় লাগছিল! সাথে ভ’য়। ৫ মিনিট এর পথ আমি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ৫০ মিনিটে বাড়ি ফিরেছিলাম। এরপর বাড়ি গিয়ে দেখলাম বেশ বড় একটা লোহা পায়ে ঢুকে গিয়েছে। ভয় লেগেছিল। একা একাই বের করলাম সেই লোহা।
মাকে বলিনি। মা নিজে থেকেই দেখেছিল পায়ের অবস্থা। এরপর আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি মাকে বলি। মা বকেছিল অনেক। কারণ তিনদিন পেরিয়ে গিয়েছিল। অথচ আমি কিছুই বলিনি। পরে মা স্যাভলন, ব্যন্ডেজ আরও ওষুধ এনে দিয়েছিল। ইনফেকশনের দিকে চলে গিয়েছিল। আমি সাতদিন কোর্সের জায়গায় একদিন ওষুধ খাওয়ার পর রাতে শুতে গিয়ে শুনলাম লাবিব এর বাবা মাকে অনেক বকছে আমায় ওষুধ কিনে দেয়ার জন্য।
সে রাতে এতো খা’রা’প লেগেছিল মিলা, বিশ্বাস করবি না! আমি ঘুমাতেই পারিনি সেই রাতটা। শ্বাসকষ্ট চাপ দিয়েছিল সে রাতে। আসলে আমার অ্যাজমার প্রবলেম ছিল না জানিস। কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাৎ অবস্থা এতো খা’রা’প হয়, বুঝিনা কারণ। সে যাক, পরেরদিন আমি সেই ডাক্তার চাচার দোকানে গিয়ে ওষুধ গুলো ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত এনে মায়ের হাতে দিয়ে দিয়েছিলাম। আমি জানতাম এসব ঝামেলা হবে, এজন্যই মাকে বলিনি।
এরকম করার কারণে মা আমার গায়ে সেদিন হাত তুলতে গিয়েও থেমে গিয়েছিল। আমি হেসেছিলাম। আমি নামক উটকো ঝামেলার জন্য মায়ের সংসারে অশান্তি হয়! পরে মা আবার ওষুধ এনে আমাকে জোর করে খাইয়ে খাইয়ে কোর্স কমপ্লিট করিয়েছিল।”
মিলা ভেজা চোখে মাইরার দিকে চেয়ে রইল। মাইরা ঝাপসা চোখজোড়া নিচে নামিয়ে মলিন গলায় বলে,
“আমি হোচট খেয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আর শিসওয়ালা আমায় দেখেও, ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। একবারও আমার দিকে তাকায়নি।”
কথাটা বলে থামে মাইরা। কান্নারা শব্দ করে বেরিয়ে আসতে চায়। মাইরা চোখ বুজে বেশ কসরত করে কান্না গিলে নিজেকে সামলায়।
তবুও চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি টুপ করে সাদা হিজাবের উপর পড়লো। যে অশ্রুতে কতশত অভিমান, অভিযোগ মিলিয়ে মিশিয়ে আছে। শুধু দেখার কেউ নেই।
মাইরা মাথা নিচু করে আবারও বলে,
“বিয়ের পরের দেয়া সেই থা’প্প’ড় গুলো তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন বুঝলাম এটাই সেই শিসওয়াল, যেমন খুশি হয়েছিলাম, ডানা ছাড়াই উড়তে ইচ্ছে করত খুশিতে।
তেমনি দমবন্ধ লাগতো। আসলে আমি আগে ভাবতাম শিসওয়ালা আমাকেও মনে মনে ভাবতো, একটু হলেও পছন্দ করতো। আর এদিকে সেই শিসওয়ালা-ই আমাকে নিয়ম করে থা’প্প’ড় মারতো। আমায় সহ্য করতে পারতো না।”
কথাগুলো বলার সময় মাইরার ঠোঁটের কোণে মলিন হাসি লেগে ছিল। ডানহাতে চোখমুখ মুছে নেয়। মৃদুহেসে বলে,___”এসব বাদ দে। অনেক ফা’ল’তু বকে ফেলেছি। চল ওয়াশরুমে যাই।”
কথাটা বলে মিলার হাত ধরে বলে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটতে থাকে। ওয়াশরুমে গিয়ে মাইরা ভালোভাবে মুখ ধুয়ে নেয়। চোখমুখ কিছুটা লাল। বেশ অনেকক্ষণ পানি দেয়ার পর একটু স্বাভাবিক লাগলো।
মিলার হাত ধরে আবারও মাঠের এসে দাঁড়ায় মাইরা। এরপর হেসে বলে,____”আজ আসছি। বাই।”
মিলা কিছুই বলল না। মাইরা মিলাকে এমন প্যাঁচামুখ করে থাকতে দেখতে দু’হাতে দু’গাল দু’দিকে টেনে বিরক্ত হয়ে বলে,___”হাসতে পারিস না? এমন প্যাঁচামুখো মানুষদের দেখলে আমার মে’জা’জ খা’রা’প লাগে।”
মিলা তবুও হাসলো না। মাইরা মিলার যে গালে থা’প্প’ড় দিয়েছিল সে গালে আরও দু’টো চুমু খেয়ে বলে,___”নে। এবার হাস ময়না। একটা থা’প্প’ড়ের বদলে তিনটে চুমু খেয়েছি। হয়েছে?”
মিলাকে একইভাবে চেয়ে থাকতে দেখে আরও দু’টো চুমু খেয়ে বলে,___”এইবার না হাসলে তোর খবর আছে। একটা থা’প্প’ড় মেরে পাঁচগুণ ফিরিয়ে দিয়েছি। জীবনে জামাইকেই একটা চুমু খাইনি। তোকে খেলাম।
মাইনষে আমাদের লেসবিয়ান পদবি দেওয়ার আগে হাস বে’দ্দ’প ছেমরি।”
এ পর্যায়ে মিলা না চাইতেও হেসে ফেলল। মাইরাও হাসলো। বিশ্বজয়ের হাসি হেসে মিলাকে বাই বলে মেইন গেইটের দিকে এগিয়ে যায়। প্রায় সবাই বেরিয়ে গিয়েছে। মাঠ একদম ফাঁকা বলা যায়। মাইরা আবারও পিছু ফিরে হাত নেড়ে মিলাকে টাটা বলে।
মিলা মলিন মুখে তাকিয়ে রইল মাইরার পানে। চোখের কোণে কেন যেন পানি জমলো।
মিলা একদিন মাইরার সাথে গল্পের মাঝে কথায় কথায় তার নামের অর্থ বলে মাইরাকেও জিজ্ঞেস করেছিল, মাইরা নামের অর্থ কি?
মাইরা উত্তর দিয়েছিল,___’অসাধারণ।’
মিলা অদ্ভুদভাবে মাইরার দিকে চেয়ে ভাবলো, মাইরা নামেই শুধু অসাধারণ নয়, বরং মাইরা তার নামের অর্থের সেই বৈশিষ্ট্যটাকে কি নিপুণভাবে রপ্ত করে নিয়েছে নিজের মাঝে। এই যে বাস্তবেও মাইরা অসাধারণ একটি মেয়ে।
যে মেয়ে বুক ভরা কষ্ট নিয়ে হাসে। শুধু হেসেই যায়। অন্যকে হাসাতে মেতে থাকে, যেন তার কাঁধে এই দায়িত্ব কেউ গছিয়ে দিয়েছে।
মিলা বোধয় মাইরার হাসিতে আর কখনো মন খুলে হাসতে পারবে না। সে যে জেনে গেল, মাইরার হাসিতেই শত-শত দুঃখ ঝরে পড়ে। শুধু মানুষ তা দেখতে পায় না। কারণ মাইরা খুব যত্নে তা লুকিয়ে রাখে।
মাইরা গেইটের দিকে তাকালে দেখল ইরফান আসছে। তাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মাইরা পায়ের গতি বাড়ায়। ঠোঁটের কোণে স্বচ্ছ হাসি ফুটে ওঠে। যার প্রতি এতো এতো অভিযোগ, তাকে দেখেই মনের কোণে সুখ উঁকি দেয়। কি অদ্ভুদ!
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়েই মুখে হেসে লেপ্টে মৃদুস্বরে গেয়ে ওঠে,____
❝ শখা তোমারে বাঁধিবো,
তোমারি থাকিবো,
বাসিবো ভালো শুধু তোমারে। ❞
মাইরা ইরফানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ইরফান মাইরার দিকে তাকায়। মাইরা মৃদু হেসে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইরফান ডান হাত মাইরার মুখে দিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,___”এতো ঘামলে কিভাবে?”
মাইরা ইরফানের কথা মুখ টিপে হাসে। মুখে এতো পানিকে এই লোক ঘাম বলছে। অতঃপর স্বাভাবিক হয়ে বলে,___”এটা পানি। ঘা…
মাইরার কথা থেমে যায়।
তখন যে মেডাম এর মুখে পানি পড়েছিল তাকে দেখেই মাইরা দ্রুত ইরফানের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। ইরফান ভ্রু কুঁচকে পিছু ফিরে মাইরার দিকে তাকায়। বিরক্ত হয়ে বলে,____”কি প্রবলেম?”
মাইরা দেখল ওই মেডাম উল্টোদিকে চলে গিয়েছে। এটা দেখে মাইরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ইরফানের দিকে চেয়ে মেকি হেসে বলে,____”কিছু না। টেস্ট করছিলাম আপনি আমাকে খুঁজে পান কি-না!”
ইরফান বিড়বিড় করে,___”স্টুপিট।”
মাইরার কিছু একটা মনে পড়তেই ইরফানের দিকে চেয়ে হঠাৎ-ই শব্দ করে হেসে দেয়। ইরফানের স্টুপিট কথাটা শুনেই মূলত তার মনে পড়লো কথাটা।
গতকাল বাড়ি থেকে আসার আগে লাবিব তাকে বলছিল,___’আপুই আপুই খুচিব ডুলাবাই টুপিট বয়।”
মাইরা অনেক ভেবেচিন্তে বের করেছে স্টুপিট কে লাবিব টুপিট বলেছে। আর শিখেছেও এই লোকের থেকে। ইরফান মাইরার দিকে চেয়ে চোখ ছোট ছোট করে বলে,____”হোয়াট? পা’গ’ল দের মতো হাসছ কেন ইডিয়ট?”
মাইরা বিরক্ত চোখে তাকালো ইরফানের দিকে। এখন এই লোকের জন্য হাসাও যাবে না? অ’স’হ্য লোক একটা।
মাইরার লাবিব আর মায়ের কথা মনে পড়ল। ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে বলে,____”আমাকে আবার কবে গ্রামে নিয়ে যাবেন?”
ইরফান বিড়বিড় করে,___”ডিজগাস্টিং শা’লার বউ হলে।”
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,___”কি বললেন?”
ইরফান গলা ঝেড়ে বলে,___”নাথিং।”
মাইরা আবারও জিজ্ঞেস করে,____”নিয়ে যাবেন?”
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,___”নো। এসব ভুলে যাও।”
কথাটা বলে মাইরার হাত ধরে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। মাইরার মন খা’রা’প হলো। ভুলে যাবে কি করে? পরিবার আবার ভোলা যায় না-কি! ঘাড় বাঁকিয়ে একবার ইরফানের দিকে তাকায়। এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকায়। ছোট্ট একটা চাপা শ্বাস ফেলে।
রাত তখন ১২ টার কাছাকাছি।
মাইরা মন খা’রা’প করে বেডের উপর বসে আছে। তার মনের কোণে এক রাতের স্মৃতি ভেসে ওঠে।
~ মাইরা যেদিন প্রথম একটি গানের সাথে সাথে শিস এর শব্দ পেয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছিল। আজও সেই প্রথমদিনের গানের সুরে শিস শুনতে পেয়ে বেরিয়ে আসে। আশেপাশে তাকিয়ে বারবার ডাকে, শিসওয়ালা বলে। এইতো এখনো শুনতে পাচ্ছে শিস। মাইরা আবারও কিছুটা শব্দ করে ডেকে ওঠে, __”শিসওয়ালা?”
তখনই থেমে যায় সেই শিস। কয়েক মুহূর্ত পেরিয়ে যেতেই আড়াল থেকে একটি অবয়ব বেরিয়ে আসে। মাইরার থেকে অনেকটা দূরত্ব। অন্ধকারের মাঝে মাইরা তেমন দেখতে না পেলেও বুঝল কোনো এক যুবক। মাইরা পিছন থেকে একটুও বুঝলো না লোকটা কে। হঠাৎ-ই লোকটি শিস বাজানো স্টার্ট করে। মাইরা স্তম্ভিত হয়। হাতপা শিরশির করে। লোকটি বাইকে উঠে পড়ে।
মাইরা অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,___”শিসওয়ালা?”
লোকটি এখনো শিস বাজায়। বাইকের সামনে দু’হাত রাখে। মাইরা এবার শব্দ করে ডেকে ওঠে,___”শিসওয়ালা?”
লোকটি সাথে সাথে গম্ভীর গলায় বলে ওঠে,____”ইয়াহ!”
কথাটা বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। তৎক্ষনাৎ বাইক স্টার্ট দিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।
মাইরা বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে লোকটির প্রস্থানের পানে। লোকটি তার ডাকে সাড়া দিয়েছে। মাইরার পুরো শরীর বিদুৎ শক খাওয়ার মতো কেঁপে ওঠে। কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত দূর থেকে সেই শিস এর মৃদু আওয়াজ ভেসে আসলো। একপর্যায়ে একেবারে মিলিয়ে গেল।
কথাগুলো ভেবে মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। লোকটি তাকে না চিনলে সেদিন তার ডাকে এভাবে সাড়া দিয়েছিল কেন?
মাইরার মনের কোণে আরও কিছু স্মৃতি ধরা দেয়।
তাদের বাড়ির সামনে অনেক বড় উঠান। সেখানে একটা চৌকি পাতা থাকে সবসময়। যে কেউ সেখানে এসে বিশ্রাম নেয়।
মাইরা একরাতে লম্বা গড়নের এক যুবককে সেই চৌকির উপর শুয়ে শুয়ে শিস বাজাতে দেখেছিল। মাইরা মুখ দেখতে পায় নি তার। সে বাড়ি বেরিয়ে আসতে আসতে সেই চৌকির জায়গা ফাঁকা হয়ে যায়। শিস ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।
এরপর মাইরা অনেক দিন পর পর মাঝে মাঝে সেই শিস শুনতে পেত। তারপর-ই একদিন সে হোঁচট খেয়ে পড়ল। আর তার শিসওয়ালা শিস বাজানো থামিয়ে বিরক্তির সুরে ডিজগাস্টিং বলে তাকে ফেলে চলে গেল।
মাইরা ভাবতো শিসওয়ালাও তাকে পছন্দ করতো। নয়তো তার ডাকে সাড়া দিল কেন? তাদের চৌকিতে এসে শুয়ে শুয়ে শিস বাজিয়েছিল কেন? কিন্তু তার বিয়ে ঠিক হলো, শিসওয়ালা আসলো না। মাইরার মন ভাঙলো। কষ্ট হলো। তার অমতে তার বিয়ে হয়ে গেল। কিন্তু বিয়ের পর থেকে ইরফানের হাতে থাপ্পড় খেয়ে খেয়ে মেয়েটার মন বিতৃষ্ণায় ভরে উঠেছিল। শিসওয়ালা কে আরও বেশি মনে পড়তো। মাইরার মনে হতো, শিসওয়ালার কি বিপদ হয়েছে? তাই তার কোনো খোঁজ নিল না!
কিশোরী মন তার। শিসওয়ালা কে ভুলতে পারে না।
তবুও সে নিজেকে বোঝালো ইরফান যেমন-ই হোক, তাকে এই সংসার করতে হবে। তার আদর্শ, ‘স্বামীকে রেখে অন্যকাউকে নিয়ে না ভাবা’। মাইরা শিসওয়ালাকে আর মনে করবে না ভাবলো। মনে পড়লেও এড়িয়ে যাবে।
সময় বহমান। ধীরে ধীরে ইরফান তার সাথে নরমাল হতে লাগলো। তখন মাইরার মনে হতো ইরফান কি তার বাবার মতোই? সে ফর্সা বলে হঠাৎ থাপ্পড় এর বদলে এতো কেয়ার করে? হাহ! কেয়ার! ইরফানের প্রতিটি কাজ মাইরার মাথার উপর দিয়ে গিয়েও আবার ঘুরে মাইরার মাথার ভেতর গেঁথে যেত। ইরফানের তাকে নিয়ে প্রতিটি অভিব্যক্ত, এই যেমন কখনো তার ঠোঁট, কখনো তার গলার নিচের তিল, কখনো তার পিঠের তিল, কখনো তাকে খেতে চাওয়া। এসব শুনে মাইরা যেমন অবুঝের মতো চেয়ে থাকতো, তেমনি বুঝদারের মতো কষ্ট পেত! তার শরীরের প্রতি ইরফানের কেন এতো ঝোঁক? ইরফান কখনো তার হার্ট নিয়ে কিছু বলতে তো পারে! আগে মন দিয়ে ভালোবেসে তারপর শরীরের প্রতি ঝুঁকলে খুব কি ক্ষতি!
তবে ইরফানের বাকি কাজগুলো, এই যেমন সে কিছু একটা চাইলে আরও কয়েকটা এনে দেয়া, এসবকে মাইরা কি নাম দিবে ভাবতো! কিন্তু তার বাবার করা কাজকর্ম আর ইরফানের হুটহাট কাছে টেনে নেয়ার ব্যাপার, এই দু’টো পাশাপাশি রাখলে তার ভীষণ কষ্ট হতো। সে আর কিছু ভাবতেই পারতো না।
ধীরে ধীরে ইরফানের যত্নে মাইরার মনে একটু ভালো লাগার আবির্ভাব হলো। ইরফান যেদিন তাকে মেলায় নিয়ে গেল, সেই নৌকায় ওঠালো। মাইরা সেদিন ভেবেই নিয়েছিল সেও আর পাঁচজনের মতো স্বামীর সাথেই জীবন কাটিয়ে দিবে। শিসওয়ালাকে ভুলে গিয়ে ইরফানকে নিয়ে ভাববে, ইরফান ভালোবাসলে বাসবে, নাহয় এই শরীরের প্রতি ঝুঁকেই থাকলো! মাইরার আর ভালো লাগে না জীবন নিয়ে এতো ভাবতে। যা হওয়ার হবে।
১৩ বছর বয়সে যার সামনে থেকে ভাতের থালা উল্টে ফেলে দেয়া হয়, যার মা তাকে পেটে নিয়ে লাথি খেয়ে দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে, যে কালো হলেই তার বাবা তাকে ডাস্টবিনে ফেলে দিত, তার জীবনে এক শিসওয়ালা এসেছিল। এতো কষ্টের মাঝেও মাইরা হাজারটা মিথ্যে হাসির আড়ালে শিসওয়ালার জন্য সত্য হাসতো। সেই মানুষটাও হারিয়ে গেল। তারপর তার বিয়ে হলো, আর বিয়ের পর সে মিথ্যে হাসির আয়োজন করত বলে তার স্বামী তাকে নিয়ম করে যত্ন করে মারতো।
আবার সে জানলো তার শিসওয়ালা-ই তার স্বামী। যে তাকে ভালোবাসেনি। ভালোবাসেনা বোধয়।
মাইরা সংগ্রাম করে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে হয় না। এতোকিছুর মাঝে তার মরে যাওয়ার অপশন টাই ভালো লাগে। তার না দেখা মায়ের পাশে ঘুমাতে ইচ্ছে করে।
ভাবলো যতদিন বাঁচবে, শিসওয়ালাকে ভুলে গিয়ে ইরফানকে নিয়েই ভাববে। যেই মেলায় গিয়ে ইরফানকে নিয়ে ভাবার সিদ্ধান্ত নিল, সেই মেলায় বসেই তার সামনে আসলো ইরফান-ই তার শিসওয়ালা। মাইরা স্তব্ধ হয়। আবারও তার সবকিছু এলোমেলো হয়। আবারও সে শিসওয়ালা কে ভাবতে বসে যায়! তার শিসওয়ালা তাকে মানতো না কেন? তাকে থা’প্প’ড় মারতো কেন? তবে কি সে তাকে চিনতো না? সেই বেশি ভাবতো?
আবারও উল্টো প্রশ্ন আসে,
তাহলে ইরফান তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল কেন? তাদের উঠানে এসে শিস বাজাতো কেন?
মাইরার এলোমেলো লাগে। আর কয়েকদিন আগে তো জানলো সেই হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরও ইরফান তাকে এভাবে দেখেও বিরক্ত হয়ে চলে গিয়েছিল। মাইরার এখন মনে হয়, তার শিসওয়ালা তাকে আসলেই চিনতো না।
‘মিলা মাইরাকে একটি গল্প শুনিয়েছিল।
এক ক্লাসে এক টেরা ছেলে ছিল, সে চেয়ে থাকতো একদিকে, একটি মেয়ে ভাবতো ছেলেটা তার দিকেই চেয়ে থাকে। মেয়েটিও মনে মনে সেই ছেলেকে পছন্দ করত। আর ছেলেটার দিক থেকে একটু ইঙ্গিত পেয়ে মেয়ে তো আকাশের তারা হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়। ছেলে তার কাছে নিজে থেকে আসে না বলে মেয়েটি নিজেই ছেলেটিকে গিয়ে তার মনের কথা জানালে ছেলেটি বলে, সে তো মেয়েটিকে কখনো দেখেইনি। একবারও তাকায়-ই নি। মেয়েটি একদম পার্ফেক্ট এক টেরার থেকে ছ্যাঁকা খেয়ে ছ্যাঁকাটেরা হয়ে গেল।’
মাইরা কথাটা ভাবতেই হেসে ফেলল। কিন্তু একটু পরেই তার মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে যায়। এই কাহিনীর মতোই তার জীবনে এক কাহিনী ঘটে গিয়েছে তার শিসওয়ালার সাথে। হয়তো শিসওয়ালা তাকে চিনতোই না, সে একটু বেশি-ই ভাবতো।
না চাইতেও মাইরার মনে অভিমান জমে। তার অভিযোগ, ইরফান কেন তার বাড়ির উঠানে, বাড়ির আশেপাশে গিয়ে শিস বাজাতো! কেন তার ডাকে সাড়া দিয়েছিল! আবার কেনই বা তাকে ফেলে চলে গিয়েছিল! তার খাতা ভর্তি শুধু ইরফানকে নিয়ে অভিমান,অভিযোগে ভর্তি। আবার মাঝে মাঝে মনে হয়। নাহ, তার অভিযোগ ভাগ্যকে দেয়া উচিৎ। ইরফান তাকে ভালো না-ই বাসতে পারে। এর জন্য সে তার প্রতি অভিযোগ কেন রাখবে?
কিন্তু তার ডাকে ইরফানের সাড়া দেয়া, একটু হলেও ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়া, এর জন্য তো মাইরা-ই কষ্ট পেয়েছে। তবে ইরফান কেন নির্দোষ হবে? কেন ইরফানকে অভিযোগের খাতা থেকে মুছে ফেলবে মাইরা? মুছবে না ইরফানকে অভিযোগের খাতা থেকে।
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে বেডের উপর ডান কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। কখন যে চোখে ঘুম ধরা দেয়, বুঝে পায় না। ঘুমঘুম চোখজোড়া বুজে নেয়। বন্ধ চোখের কোণ ঘেষে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। মাইরাও ঘুমিয়ে যায় মুখে ম্লান হাসি আর অশ্রু নিয়ে।
ইরফান বাড়ি ফিরে রাত ১ টায়। মাইরাকে বেডের উপর এলোমেলোভাবে ঘুমাতে দেখল। ইরফান এগিয়ে এসে মাইরা গলার ভাঁজে হাত দিয়ে চেক করে ঘেমেছে না-কি শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আছে। মাইরাকে স্বাভাবিক দেখে সে ওয়াশরুমে যায়। একেবারে শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে।
এরপর উদাম শরীরেরই মাইরার পাশে শুয়ে মাইরাকে তার দিকে টেনে নেয়। মাইরার শরীর ইরফানের ঠাণ্ডা বডি স্পর্শ লাগলে মেয়েটা কেমন কেঁপে ওঠে। ইরফান মাইরার গলা থেকে ওড়না সরিয়ে রাখল।
মাইরার চোখেমুখে বিরক্তির ভাঁজ পড়ে। ইরফান মাইরার ঠোঁটে চুমু খায়। মাইরা বিরক্ত হয়। ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে,___”শিসওয়ালা আমায় ভালোবাসে না।”
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৫৮
ইরফান মাইরাকে আরেকটু তার দিকে টেনে নিয়ে গলায় মুখ গুঁজে মৃদুস্বরে বলে,____”বাসে বার্ডফ্লাওয়ার।”
বেশ কিছু সময় পর মাথা তুলে মাইরার ঘুমন্ত মুখপানে চেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
“তোমার শিসওয়ালার ভালোবাসাময় সিংহাসনে আমার বার্ডফ্লাওয়ার রাজত্ব করে।”