প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৫

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৫
Drm Shohag

ইরফান, মাইরা কে হসপিটাল নিয়ে এসেছে শুদ্ধ আর তারেক নেওয়াজ। সাথে রুমা নেওয়াজ আছেন।
সীমান্তর সাথে কথা বলেছে শুদ্ধ। মাইরার ব্যাপারে জেনে শুদ্ধ স্পিচ লেস হয়ে গিয়েছে।
মেয়েটা কত বড় অসুখ নিজের মাঝে লালন করছিল, তারা কেউ বুঝতেই পারেনি। প্রায় তিন মাস আগে মাইরা এই হসপিটালেই একবার এসেছিল, অর্থাৎ ইরফানের সাথে বিয়ের পর পর-ই মাইরা হসপিটালে এসেছিল। ওইটুকু মেয়ের এতো সাহস? শুদ্ধ ভেবে পায় না। এতো বড় রোগ নিয়ে মেয়েটা কিভাবে দিব্যি হেসে খেলে বেড়ায়?
ইরফান মাইরার টেনশনে অতিরিক্ত স্ট্রেস নিতে না পেরে প্যানিক অ্যাটাক থেকে নাক দিয়ে র’ক্ত এসেছে। ইরফান যখন ক্লাস সিক্সে পড়ে, তখন একবার নাক দিয়ে র’ক্ত এসেছিল। তবে তখন এর তীব্রতা অনেক কম ছিল। আজকের ইরফান টোটালি অস্বাভাবিক। সামনে কি হবে? এই ভেবেই ছেলেটা কুল পায় না।
ফাইজ শুদ্ধর পাশে বসে। নাছিম শুদ্ধর অপর পাশের চেয়ারে বসে বলে,

– বার্বি ডল এখন কেমন আছে?
শুদ্ধ ভাবনার জগৎ থেকে বের হয়। চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– মাইরার চিন্তা করার জন্য ওর সোয়ামি কানাডা থেকে চলে এসেছে। তুই এখনও ওকে বার্বি ডল ডাক টা ছাড়তে পারলি না?
নাছিম হঠাৎ-ই শুদ্ধ কে টেনে দাঁড় করায়। সবাই এখানে আছে। নাছিম ফাইজের উদ্দেশ্যে বলে,
– ফাইজ ২০ মিনিটে আসছি আমরা। তুই এদিকটা সামলা।
শুদ্ধ নাছিমের পিছু যেতে যেতে বলে,
– আরে কোথায় যাচ্ছিস? ওরা এখানে একা। ইরফান, মাইরাকে রেখে কিভাবে যাব এভাবে?
নাছিম শুনলো না। শুদ্ধকে টেনেই তার গাড়ির কাছে নিয়ে যায়।
গাড়িতে উঠে ফাইজ গাড়ির স্পিড বাড়ায়। শুদ্ধ বিরক্ত চোখে চেয়ে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– আরে আমার এখন ফা’ল’তু কথা বলতে ভালো লাগতেছে না। কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস?
নাছিম বেশ কিছুক্ষণ গাড়ি ড্রাইভ করে অন্তরার বাড়ির সামনে গাড়ি থামায়। এরপর গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। শুদ্ধও বেরিয়ে আসে। নাছিম বড় বড় পা ফেলে অন্তরার বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে নিজেও এগিয়ে যায়।
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে নাছিম সমানে অন্তরার বাড়ির কলিংবেল বাজায়। শুদ্ধ নাছিমের হাত সরিয়ে বলে,
– আরে কলিংবেল কি দোষ করল, ছাড় এটাকে।
তাদের কথার মাঝেই অন্তরা এসে দরজা খুলে দেয়। সামনে নাছিম আর শুদ্ধকে দেখে হেসে বলে,
– তোরা! ভেতরে আয়।

কথাটা বলে পিছন ঘুরতে নেয়, তখন-ই নাছিম কষিয়ে একটা থা’প্প’ড় মেরে দেয় অন্তরার গালে। অন্তরা একটুও বুঝতে না পারায় থা’প্প’ড় খেয়ে দরজার সাথে জোরে ধাক্কা খায়। শুদ্ধ হতভম্ব হয়ে যায়। অন্তরা সোজা হয়ে দাঁড়াতেই একই গালে নাছিম আরেকটা থা’প্প’ড় মেরে দেয়। অন্তরা পড়তে পড়তে বেঁচে যায়। নাছিম চিৎকার করে বলে,
– এটা একটা কালনাগিনী। এর মতো বে’য়া’দ’ব মেয়ে আমি আমার লাইফে দেখিনি।
কথাটা বলে আবারও এগিয়ে যেতে নিলে শুদ্ধ নাছিমকে টেনে ধরে বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– নাছিম দাঁড়া। কি করছিস?
নাছিম চিল্লিয়ে বলে,
– এই তোর ফোন দে। ফোন দে তোর।
অন্তরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের কোণে পানি। বাসায় কেউ নেই। তার বাবা গ্রামে। নুসরাত ফ্রেন্ড এর বাসায় গিয়েছে। নাছিম আবারও চিল্লিয়ে বলে,

– অন্তরা তোর ফোন দে।
অন্তরা কেঁপে ওঠে। নিজেকে সামলে এগিয়ে এসে রে’গে বলে,
– মারলি কেন আমাকে?
নাছিম শুদ্ধকে ধাক্কা দিয়ে বলে,
– আরও হিসেব বাকি আছে। আগে তোর ফোন দে।
কথা বলতে বলতেই অন্তরার ফোন পাশেই টেবিলের উপর বেজে ওঠে। নাছিম বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গিয়ে ফোন অন করে। লক নেই ফোনে। অন্তরা এগিয়ে এসে বলে,
– আমার ফোন দে।
নাছিম জ্বলন্ত চোখে তাকায় অন্তরার দিকে। অন্তরা চুপসে যায়। নাছিম ঘেটেঘেটে একটা ভয়েস রেকর্ড অন করে। যেটা অন্তরা মাইরাকে শুনিয়েছিল। ভয়েসটি শুনে শুদ্ধ অবাক হয়ে একবার অন্তরার দিকে তাকায় আরেকবার নাছিমের দিকে। অন্তরা ঢোক গিলে। নাছিম অন্তরার ফোন আঁছড়ে ফেলে চিৎকার করে বলে,
– আমাদের ফ্রেন্ডসার্কেলে এমন বে’য়া’দ’ব মেয়েকে কে এলাউ করেছিল? শুদ্ধ তুই করেছিলি না? তুই-ই করেছিলি। সব দোষ তোর। এই অন্তরা বার্বি ডলকে গিয়ে এই এডিট করা ভয়েস শুনিয়ে ভুল বুঝিয়েছে, ওকে কিছু বলবি না শুদ্ধ?
শুদ্ধ বিস্ময় চোখে অন্তরার পানে তাকায়। নাছিম আবারও চিৎকার করে বলে,

– আমি বলেছিলাম, বার্বিডলের ক্ষ’তি করবি না। কিন্তু ও তো স্বার্থপর, ওর কারো ভালো সহ্য হয় না।
অন্তরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সে যেদিন মাইরাকে ভয়েস শুনিয়েছিল, নাছিম সেই ক্যাফেতেই ছিল। তাকে সেদিনও জেরা করেছিল, সন্দেহ করেছিল। আজ এতো শিওর হয়ে কিভাবে আসলো বুঝলো না অন্তরা।
নাছিম রাগান্বিত স্বরে বলে,

– বার্বি ডলের যদি কিছু হয়, একে আমি ছাড়বো না শুদ্ধ, তোর সামনে বলে গেলাম। ইরফানকে বললে তো ইরফান ওকে জ’বাই করে দিয়ে যাবে। দরকার হলে সেই ব্যবস্থাই করব।
কথাটা বলে বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। শুদ্ধ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আরও বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর হঠাৎ-ই মাথা তুলে অন্তরার দিকে তাকিয়ে বলে,
– মাইরার ব্রেইন টিউমার। খবর পেয়ে ইরফান কানাডা থেকে চলে এসেছে সব ফেলে। তোর এতো সুন্দর কাজের জন্য ওর ব্রেনে ভালোই চাপ পড়েছে। মাইরার কিছু হলে নিজেকে কখনো ক্ষমা করতে পারবি অন্তরা?
অন্তরা অবাক হয়ে তাকায় শুদ্ধর দিকে। দু’চোখ ভেদ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। শুদ্ধ তাচ্ছিল্য হেসে বলে,
– পারবি হয়তো ক্ষমা করতে, কারণ তোর তো সেই বোধ-ই নেই। মনুষ্যত্ব হারিয়ে গিয়েছে তোর মাঝ থেকে। নয়তো ওইটুকু বাচ্চা একটা মেয়ে, যে তোর ছোট বোনের চেয়েও ছোট, তার পিছনে লাগলি কিভাবে!
যাইহোক, ভালো থাকিস। কখনো আমাদের বন্ধু পরিচয় দিয়ে নিজের সাথে সাথে আমাদেরকেও ছোট করিস না।
কথাগুলো বলে শুদ্ধ আর এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না এখানে। গটগট পায়ে বেরিয়ে যায় বাসা থেকে। অন্তরা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। দু’চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়তে থাকে। বিড়বিড় করল,
– মাইরা

নাছিম গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে ঘোরাতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– তোর কাছে ওই ভয়েস রেকর্ড টা আছে না?
শুদ্ধ পাশের সিটে বসে চোখ বুজে আছে। নাছিমের কথা শুনে চোখ মেলে বলে,
– আছে।
নাছিম ডান হাতে ঝাপসা চোখজোড়া মুছে বলে,
– বার্বি ডল কে এই রেকর্ড শুনিয়ে এর ভুল ভাঙিয়ে দিবি। নয়তো ওর ব্রেইনে আরও বেশি চাপ পড়বে।
শুদ্ধ বেশ কিছুক্ষণ নাছিমের দিকে তাকিয়ে রইল। মৃদুস্বরে বলে,
– মাইরাকে অনেক ভালোবাসিস তাই-না?
নাছিম গাড়ির ব্রেক কষল। সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বুজল। শুদ্ধ নাছিমের দিকেই তাকিয়ে। নাছিম চোখ বুজে রেখেই মৃদুস্বরে বলে,
– আমি শুধু চাই, বার্বি ডল ভালো থাকুক। বার্বি ডল কে ভালো রাখতে সব করতে পারি।
শুদ্ধ অবাক হয়ে বলে,

– মাইরাকে ইরফানের সাথে দেখে তোর কষ্ট হয়না?
নাছিম ঢোক গিলে ভারী গলায় বলে,
– ভীষণ কষ্ট হয়। কিন্তু বার্বি ডল কে চাওয়ার অধিকার আমার নেই। বার্বিডল ইরফানকে মন দিয়ে, তাকে চাওয়ার অধিকার আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে।
আর আমি নিজের থেকে বার্বিডলকে কষ্ট দেয়ার অধিকার কেড়ে নিয়েছি।
এরপর চোখ খুলে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– বার্বি ডল ভালো হয়ে যাবে তো শুদ্ধ?
শুদ্ধ অবাক হয়ে নাছিমের দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুস্বরে বলে,
– এভাবেও ভালোবাসা যায়?
নাছিম মলিন হেসে বলে,
– যায়। ভালোবাসার মানুষকে ভালো থাকতে দেখার মাঝেও এক আলাদা শান্তি আছে, হাজারো আক্ষেপের মাঝে একটুখানি স্বস্তি আছে, বুকের বা পাশে চিনচিন ব্য’থার পাশেই একটি সুখকর প্রশান্তি আছে।
শুদ্ধ নিরব দৃষ্টিতে নাছিমের পানে চেয়ে রইল। নাছিম দু’হাতে তার ঝাপসা চোখজোড়া মুছে আবারও গাড়ি স্টার্ট দেয়।

হসপিটালে পৌঁছে শুদ্ধ ধীরে ধীরে মাইরার কেবিনের দিকে এগিয়ে যায়। তার নিজেকে কেমন যেন অসহায় লাগছে। ইরফানের এই অবস্থা মাইরার এই রোগ সবমিলিয়ে সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে আছে।
মাইরার কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে শুদ্ধ। ভেতরে ইনায়া, ফারাহ, আছে।
রুমা নেওয়াজ আর তারেক নেওয়াজ বাইরে বসে আছেন।
মাইরা বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে।
ইনায়া মাইরার দু’হাত তার দু’হাতের মাঝে নিয়ে কান্নামাখা গলায় বলে,
– তুমি এমনটা কি করে করতে পারলে মাইরা? আমরা তোমার কেউ নই?
মাইরা নিরবে চোখের পানি ফেলে। ভাঙা গলায় বলে,
– স্যরি আপু। তোমার ভাইয়া কেমন আছে?
ইনায়া নাক টেনে বলে,

– ভালো আছে। ভাইয়া ভালো আছে মাইরা। কিন্তু তুমি এটা কি করেছ বোন? আমার ভীষণ খা’রা’প লাগছে। আমাদের একটাবার কেন বললে না?
মাইরা চোখ বুজে নেয়। চোখের কোণ ঘেঁষে পানি গড়িয়ে পড়ে।
শুদ্ধ নিজেকে স্বাভাবিক করল। মুখ হাসি ফোটালো। এরপর এগিয়ে আসতে আসতে ইনায়ার উদ্দেশ্যে হেসে বলে,
– মাইরা অসুস্থ, ঠিক আছে। কিন্তু ও তো সুস্থ হবেই। তুই ছাগলের তিন নম্বর বাচ্চার মতো এমন ভ্যা ভ্যা করছিস কেন?
ইনায়া বিরক্ত চোখে তাকায় শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধর কথায় মাইরা চোখে পানি নিয়েই হেসে ফেলে। শুদ্ধ ফারাহ’র দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। এরপর মাইরার উদ্দেশ্যে বলে,
– মাইরা তুমি আমার মেলায় হারিয়ে যাওয়া বোন। দ্রুত সুস্থ হয়ে নাও তো। আমি একা একা এতোগুলো মানুষকে জ্বালাতে পারি? তুমি-ই বলো? তুমি দ্রুত সুস্থ হও, এরপর খুব সুন্দর সুন্দর প্ল্যান বানিয়ে সবাইকে ধরে ধরে জ্বালাবো।
শুদ্ধর কথায় মাইরা আবারও হাসলো। ফারাহ-ও মৃদু হাসলো। শুদ্ধ ফারাহ’র দিকে তাকায়। হাত বাড়িয়ে ফারাহকে কাছে ডাকলে ফারাহ শুদ্ধর পাশে এসে দাঁড়ায়। শুদ্ধ ফারাহ’র হাত ধরে বলে,

– দেখো তো মাইরা, তোমার ভাইয়ের বউ হিসেবে পছন্দ হয়?
মাইরা শুদ্ধ আর ফারাহ’র দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
– আপনাদের একসাথে খুব সুন্দর লাগছে ভাইয়া।
শুদ্ধ অসহায় মুখ করে বলে,
– দেখলে? এতো সুন্দর জুটি আমাদের। কিন্তু আমাদের বিয়ে তো আমার বোন ছাড়া হবে না। তোমার সুস্থ হওয়া কতটা জরুরি একবার ভাবো!
মাইরা মলিন মুখে তাকিয়ে থাকে শুদ্ধ আর ফারাহ’র দিকে। সে তো বাঁচবেই না। তবে সবাই তাকে নিয়ে এতো স্বপ্ন কেন দেখছে?
শুদ্ধ একটি চেয়ার টেনে মাইরার পাশ বরাবর বসল। এরপর পকেট থেকে ব্লুটুথ বের করে মাইরার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
– মাইরা এটা কানে দিতে পারবে? মাথা ব্য’থা করছে কি এখন?
মাইরা মাথা নাড়িয়ে বলে,
– নাহ ভাইয়া এখন ঠিক আছি। কিন্তু এটা দিয়ে কি করব?
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,
– আগে কানে দাও। তারপর নিজেই বুঝতে পারবে।
মাইরা কথা না বাড়িয়ে ব্লুটুথ কানে দেয়। শুদ্ধ ভলিউম মিডিয়াম এর চেয়েও হালকা করে রেকর্ড টি অন করে দেয়।
ইরফান : আই লাইক ইউ।
অন্তরা : তুমি সত্যি আমাকে পছন্দ কর ইরফান?
………………………কবে বিয়ে করবে আমায়?
ইরফান : হোয়াট ননসেন্স,……………….
You are my good friend. I like you for that. Nothing else.

মাইরা অবাক হয়ে তাকায় শুদ্ধর দিকে। না চাইতেও চোখজোড়া থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,
– যেহেতু অন্তরা আমাদের ফ্রেন্ড,তাই কিছুটা দায় আমাদেরও। আমি অন্তরার হয়ে স্যরি মাইরা!
মাইরা কান থেকে ব্লুটুথ খুলে রাখে। তার শিসওয়ালা কে সে ভুল বুঝেছে? মাইরার কান্না পায়। সে তার শিসওয়ালাকে কেন ভুল বুঝলো? সে তো বুঝতো, ইরফান তার কত যত্ন করে, কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ ইরফানকে বুঝতে না পেরে সে ভুল বুঝেছে। তার শিসওয়ালা কি অনেক কষ্ট পেয়েছে? ইরফানের মুখটা মাইরার মুখের সামনে ভাসে। বিড়বিড় করে,
– শিসওয়ালা আমি স্যরি গো!

শুদ্ধ পকেট থেকে একটি কাগজ বের করে। সে গতকাল ইরফানের বাড়ি গিয়েছিল অফিসের কাজে একটা প্রয়োজনে। ইরফানের ঘরের মেঝেতে এই কাগজটি পেয়েছিল। মাইরা বাড়ি ছিল না। সে কাগজের ভাঁজটি খুলে, প্রথম তিনটি শব্দ পড়েই বুঝেছিল ইরফান মাইরাকে লিখেছে। সে আর পড়েনি। তবে ইরফানকে জ্বালানোর জন্য নিজের কাছে রেখেছিল। কিন্তু আজ যখন দেখল মাইরা ইরফানকে ভুল বুঝে আছে, তার কেন যেন মনে হলো মাইরা ইরফানের এই লেখাটুকু পড়েনি। হয়তো জানেইনা।
ভাবনা রেখে কাগজটি এগিয়ে দেয় মাইরার দিকে। মৃদুস্বরে বলে,
– মাইরা দেখ তো এইটা কি?

মাইরা মাথা তুলে তাকায়৷ শুদ্ধর হাতের দিকে তাকালে অবাক হয়। পরিচিত ঠেকল কাগজটি। শুদ্ধ হেসে বলে,
– নাও। ইরফানের ঘরেই পেয়েছি। উপরের লাইনটা পড়েছি শুধু। ভেবেছিলাম অন্য কোনো কাজে লাগাবো। কিন্তু এভাবে কাজে লেগে যাবে ভাবিনি। তুমি হয়তো এটা পড়নি তাই না মাইরা?
মাইরা প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে আছে শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ আবারও তাড়া দিলে মাইরা শুদ্ধর হাত থেকে কাগজটি নিয়ে মেলে ধরে। প্রথমেই চোখে পড়ে,
আমার একান্ত বার্ডফ্লাওয়ার,
আমার বার্ডফ্লাওয়ার কে জানো? আমার মাইরা পরী।
এটুকু পড়েই মাইরার পুরো শরীরে কিছু যেন তড়িৎ গতিতে প্রবাহিত হলো। এই লেখা যে তার শিসওয়ালার লেখা। সে ইরফানের লেখা চেনে। দেখেছিল বেশ কয়েকবার। তার শিসওয়ালা তাকে ভালোবাসে? তার শিসওয়ালা তাকে ভালোবেসে বার্ডফ্লাওয়ার ডাকে? এজন্য ওই ফোনের পাসওয়ার্ডও দিয়েছিল এটা? সে তার শিসওয়ালার পরী? মাইরার চোখজোড়া পানিতে টইটুম্বুর হয়। কখন যে টুপটুপ করে পানির ফোঁটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে মেয়েটা বুঝতেই পারে না।

ইতি
তোমার একান্ত শিসওয়ালা
চিঠিটুকু পড়ে মাইরা বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে আছে।ইরফান এটা তাকে লিখেছে? তার শিসওয়ালা তার থেকে শাস্তি মাথা পেতে নিতে চেয়েছে? তার অভিমান, অভিযোগ মুছে দিতে চেয়েছে? মাইরার চোখ থেকে টপটপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে। সে তার শিসওয়ালাকে রেখে কি করে যাবে?

মাইরা যখন গ্রামে থাকতো, তখন থেকেই মাঝে মাঝেই মাথা ব্য’থা করতো তার। মাকে বলতে গিয়েও বলেনি। সামান্য পা কেটেছিল, ওষুধ খেয়েছে বলেই কত কথা শুনতে হয়েছে মাকে। খাবার-ই খেতে পায়নি। সেখানে এসব বলা মানে আরও অশান্তি বাড়ানো।
এরপর বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর তারেক নেওয়াজ তাকে সবসময় হাত খরচের জন্য একটা মোটা অঙ্কের টাকা দিতো। মাইরা সেই টাকা দিয়েই একবার লুকিয়ে ডক্টরের কাছে এসেছিল, আর জানতেও পেরেছিল তার এই অসুখের কথা। এতো এতো কষ্টভরা জীবন নিয়ে সে সত্যিই ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল। সে ওষুধ কেনেনি আর। ভেবেছিল, যে কয়দিন বাঁচবে সেই কয়দিন এভাবে হেসেখেলেই দিন পার করে দিবে। কিন্তু তার শিসওয়ালাকে ছাড়া সে হেসে খেলে দিন পার করতে পারেনি। যখন একবারের জন্যও ভেবেছিল, তার শিসওয়ালা অন্যকাউকে পছন্দ করে, তখন মাইরার ভীষণ কষ্ট হচ্ছিল। তার ম’রে যাওয়ার তাড়া আরও বেড়ে গেল। তাই হসপিটালে এসেছিল তার কন্ডিশন জানতে। আর ওষুধ না খাওয়ায় কন্ডিশন আরও খা’রা’প-ই হয়েছে। উন্নতি আর হয়নি।
কিন্তু সে মরে গেলে তার শিসওয়ালার কি হবে? তার শিসওয়ালাও তো তাকে ভীষণ ভালোবাসে।
তার বাঁচতে ইচ্ছে করছে যে। আর বাঁচা যাবে না? পানিতে টইটুম্বুর আঁখি নিয়ে শুদ্ধর দিকে তাকালে শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,

– আমার ভাই কিন্তু পা’গ’ল প্রেমিক মাইরা। এই যে তোমার অসুস্থতার খবর পেয়ে সেই সুদূর কানাডা থেকে চলে এসেছে। এসে এতো এতো মেন্টাল স্ট্রেসে জ্ঞান হারিয়েছে। এতোসবের পিছনের কারণ তুমি। তোমাকে কিন্তু অবশ্যই সুস্থ হতে হবে মাইরা।
মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। কান্নামাখা গলায় বলে,
– উনাকে একটু দেখতে দিবেন ভাইয়া?
শুদ্ধ বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই। কিন্তু তুমি কান্না থামাও। তোমাকে প্রেশার কম দিব বলেই সব বললাম। ইরফান একদমই ঠিক আছে, বুঝলে?

মাইরা মাথা নিচু করে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। তার শিসওয়ালা তাকে ভালোবাসে। আজ তো তার ভীষণ খুশি হওয়ার দিন। কিন্তু সে হতে পারছে না। সে যে মরে যাবে। তার খুব ইচ্ছে করছে বাঁচতে।
রুমা নেওয়াজ ভেতরে এসে মাইরাকে কাঁদতে দেখে এগিয়ে এসে মাইরার পাশে বসে। মাইরা ভেজা চোখে তাকায় তার শ্বাশুড়ির দিকে। রুমা নেওয়াজ মাইরার চোখের পানি মুছে দিয়ে মৃদুস্বরে বলেন,
– ঠিক হয়ে যাবে মা। কান্না কর না।
মাইরা রুমা নেওয়াজ কে জড়িয়ে ধরল। রুমা নেওয়াজ-ও মাইরাকে আগলে নিল। শুদ্ধ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে বেরিয়ে যায়।

শুদ্ধ ইরফানের মাথার কাছে বসে আছে। অপর পাশে ফাইজ। এক কোণায় তারেক নেওয়াজ। ইরফানের একবার জ্ঞান ফিরেছিল। কিন্তু ডক্টর বলেছে, ইরফানকে রেস্ট নিতে হবে। নয়তো আবারও সেইম প্রবলেম হতে পারে। ইরফান যা মানুষ, কারো কথা শুনবে না। তাই আপাতত একটা কম ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে, এজন্য ইরফান এখনো বেডে শুয়ে আছে।
সবাই মূলত মাইরাকে নিয়ে চিন্তিত। ডক্টর বলেছে, যত দ্রুত সম্ভব মাইরার অপারেশন করাতে হবে।
ইরফান একটু একটু করে চোখ মেলে তাকায়। প্রথমে চারপাশ অন্ধকার লাগলেও ধীরে ধীরে সব পরিষ্কার হয়। মনে পড়ে, তার কোলে তার বার্ডফ্লাওয়ার ছিল। তারপর?
মনে করতে না পেরে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। দ্রুত বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। শুদ্ধ, ফাইজ আর তার বাবাকে দেখে চারপাশে চোখ বুলায়। আর কেউ নেই। তার বার্ডফ্লাওয়ার কোথায়? তার বার্ডফ্লাওয়ার সিক। তারেক নেওয়াজ এর দিকে এগিয়ে গিয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,

– বাবা আমার বার্ডফ্লাওয়ার কোথায়?
তারেক নেওয়াজ ছেলের দিকে অসহায় চোখে তাকায়। ইরফান তার বাবার থেকে উত্তর না পেয়ে শুদ্ধ, ফাইজের দিকে চেয়ে শক্ত গলায় বলে,
– আমার বার্ডফ্লাওয়ার কোথায়?
শুদ্ধ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। মাইরাকে সে কিছুক্ষণ আগে একবার দেখতে গিয়েছিল, মেয়েটি মাথা ব্য’থায় কেমন হাসফাস করছিল। ডক্টর সাময়িক ট্রিটমেন্ট দিয়েছে।
ইরফান ওকে এভাবে দেখলে আবারও যদি সেইম সিচুয়েশন হয়, তখন ইরফানের চিকিৎসা-ই করবে না-কি মাইরার চিকিৎসা করবে?
শুদ্ধ ইরফানকে ধরে টেনে আনতে চাইলে ইরফান হাত ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে চিৎকার করে বলে,

– কি করেছিস আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে তোরা?
তারেক নেওয়াজ এগিয়ে এসে বলেন,
– ইরফান বসো। তোমার সাথে আলোচনা করব আমরা।
ইরফান দু’হাতে মাথার চুল টেনে ধরে বলে,
– কোথায় রেখেছ আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে তোমরা? কেন বলছো না?
ফাইজ ইরফানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
– মাইরার চিকিৎসা করাতে হবে তো! বোস একটু। কথা বলি।
ইরফান আবারও চিৎকার করে বলে,
– বলেছিনা?, আগে আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে দেখব, এরপর সব কথা হবে। কোথায় ও বল?
বলতে বলতে বেডে একটা লাথি দিল। বেড কয়েক হাত দূরে সরে যায়৷ তখনই দু’জন নার্স ইরফানের কেবিনে প্রবেশ করে এগিয়ে আসে। একজন বলে ওঠে, – স্যার আপনি অসুস্থ,
তারেক নেওয়াজ উঁচু গলায় বলে,

– ইরফান তুমি অসুস্থ। শান্ত হও।
ইরফান চিৎকার করে বলে,
– অসুস্থ মাই ফুট। কি করেছ তোমরা আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে? প্লিজ বলো!
ইরফানের লাস্ট কথাটায় কেমন অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।
শুদ্ধ এগিয়ে এসে ইরফানের পাশে দাঁড়ায়। কিছু বলার আগেই ইরফান কেবিন থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,
– ওকে ফাইন, আমি নিজেই খুঁজে নিচ্ছি আমার বার্ডফ্লাওয়ারকে। তোমাদের বলতে হবে না।
শুদ্ধ পিছু পিছু দৌড়ে যায়। ফাইজও পিছু পিছু যায়। তারেক নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেডের উপর বসেন। তিনি কথা বলার ভাষা হারিয়েছেন। তার কেন যেন আল্লাহর কাছে অভিযোগ করতে ইচ্ছে করল। একটা মেয়েকে আর কত কষ্ট সহ্য করতে হবে? আল্লাহ আর কত পরীক্ষা নিবে ওইটুকু মেয়ের? একটু পরই ভাবলো, নাহ আল্লাহকে কি করে অভিযোগ দিবে! তাঁর দয়াতেই তো এখনো বেঁচে আছে মাইরা। তিনি দয়া করলেই মেয়েটা আবারও সুস্থ হবেন। কিন্তু তারেক নেওয়াজের ভীষণ অসহায় লাগলো। মেয়েটাকে ভালো রাখতে পারলেন না তিনি। এই আক্ষেপ কোনোদিন যাবে না তার।

ইরফান মাইরার কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশেই শুদ্ধ। ফাইজ একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
ইরফান বাইরে দাঁড়িয়েই কেবিনের ভেতরে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। তার মায়ের বুকে মাইরা। মেয়েটা চোখ বুজে আছে। ইরফান রোবোটের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই।
শুদ্ধ ঢোক গিলে ইরফানের দিকে তাকায়। ভাগ্যিস মাইরা আগের মতো করছে না। ঘুমিয়েছে বোধয়। নয়তো ইরফান আরও কি কি পা’গ’লামি করত কে জানে!
ইরফান ধীরে ধীরে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। রুমা নেওয়াজ ছেলেকে দেখে অবাক হয়। ফারাহ, ইনায়াও তাকায়। ইরফানের দৃষ্টি তার মায়ের বুকে থাকা মাইরার পানে। মাইরার মুখ লাল হয়ে আছে। কেমন শুকিয়ে গিয়েছে মুখটা। ইরফান ঢোক গিলে। সে এতো উইক কবে ছিল? সে মনে করতে পারে না।
রুমা নেওয়াজ মাইরাকে বালিশে শুইয়ে দেয়। এরপর দাঁড়িয়ে ইরফানের দিকে এগিয়ে এসে বলে,

– ইরফান তুমি ঠিক আছো?
মাইরা একটু নড়েচড়ে ওঠে। সে পুরোপুরি ঘুমায়নি। হালকা ঘুম এসেছিল চোখে। যেন ইরফানকে স্বপ্নে দেখছে।
ইরফান তার মায়ের কথায় দৃষ্টি ঘুরিয়ে তার মায়ের দিকে তাকায়। রুমা নেওয়াজের তার শক্তপোক্ত ছেলেটার চোখেমুখে এমন অসহায়ত্ব দেখে ভীষণ কষ্ট হলো। ইরফানের গালে হাত দিয়ে বলে,
– মাইরাকে সাহস দিও। তুমি ভেঙে পড়লে ওকে সুস্থ করবে কে বাবা?
ইরফান আবারও মাইরার দিকে তাকায়। শুকনো ঢোক গিলে নেয়। এরপর ধীর পায়ে এগিয়ে যায় মাইরার দিকে। সে ডাকতে চাইছে মাইরাকে, কিন্তু ভেতর থেকে কণ্ঠের আওয়াজ বের হয় না।
ইরফান ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে একদম মাইরার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। বহুকষ্টে উচ্চারণ করে,
– বার্ডফ্লাওয়ার?

ইরফানের কণ্ঠে অসহায়ত্ব। মাইরা দ্রুত চোখ মেলে তাকায়। সে এতোক্ষণ ভাবছিল স্বপ্ন দেখছে। হালকা ঘুম, আবার কিছুটা জেগে থাকায় বুঝতে পারছিল না। ইরফানের বার্ডফ্লাওয়ার ডাক টা যেন তড়িৎ গতিতে মাইরার কানে এসে বারি খায়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালে ইরফানকে দেখে তার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। ইরফানের দিকে চেয়েই ধীরে ধীরে উঠে বসে।
ইরফানের গায়ে একটি শার্ট জড়ানো, যার হাতা একদম ছেড়ে দেয়া। চুলগুলো কেমন এলোমেলো। চোখদুটো ভীষণ লাল!
মাইরা যে মানুষটাকে ঘুমিয়েও কখনো এতো অগোছালো দেখেনি, সেই মানুষটা আজ তার অসুস্থতায় এতো অগোছালো। মাইরার বুক ফেটে কান্না আসে। ইরফানের লালিত চোখের দিকে তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে আওড়ায়,
– শিসওয়ালা?
ইরফান ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে মাইরাকে দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। মাইরার মুখ ইরফানের বুকে ঠেকে। মেয়েটি চোখ বুজে নেয়।

দু’হাতে ইরফানের পিঠের দিকে শার্ট খামচে ধরে। নিঃশব্দে কাঁদে মেয়েটা। তার শিসওয়ালার সাথে সে বাঁচতে চায়। ইরফান চোখ বুজে আছে। হাতের বাঁধন শক্ত, যেন মাইরাকে ছেড়ে দিলেই হারিয়ে ফেলবে। মাইরা ফুঁপিয়ে কাঁদে।
রুমা নেওয়াজ ঝাপসা চোখে ছেলেমেয়ে দু’টোর দিকে তাকালেন। কে বলবে, এদের মধ্যে মোহাব্বত নেই? কেউ বিলিভ করবে? এই যে মাইরার এই অবস্থায় তার ছেলেটা এতো ভেঙে পড়েছে, তারা কেউ কল্পনা করেছিল? উল্টে দু’দিন আগেও একবার হলেও ভেবেছিল, ইরফান কি মাইরাকে এখনো মেনে নিতে পারছে না? অথচ সময়ের ব্যবধানে কি থেকে কি হয়ে গেল? ছেলেমেয়েকে একা ছাড়তে রুমা নেওয়াজ কেবিন থেকে বেরিয়ে যান।
এরপর ইনায়াও মায়ের সাথে বেরিয়ে যায়। শুদ্ধ মলিন মুখে তাকিয়ে রইল দু’জন মানুষের দিকে। সে চুটকি বাজিয়ে মানুষকে হাসাতে তো পারে! কিন্তু অসুস্থ মানুষকে সুস্থ কি করে করবে সে উপায় তো তার জানা নেই। নিরবে ফারাহ’র হাত ধরে কেবিন থেকে বাইরে বেরিয়ে যায়। ফারাহ ঝাপসা চোখে একবার শুদ্ধর দিকে তাকায়। শুদ্ধ ফারাহকে শুধু দেখল। আর কিছু বলল না। ইরফানকে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না তার।

বাইরে ফাইজ দাঁড়ানো। ইনায়া এগিয়ে গিয়ে ফাইজের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। ফাইজ ইনায়ার গালে হাত দিয়ে দেখে ইনায়ার চোখে পানি। মৃদুস্বরে বলে,
– লিটল কুইন, মাইরার এখন মেন্টালি সাপোর্ট দরকার। আর কাঁদবে না কখনো ওর সামনে, মনে থাকবে?”
ইনায়া ফাইজের বুকে মুখ ঠেকিয়ে ভাঙা গলায় বলে,
– আমার তো নিজের বোন নেই। ওকেই আমি প্রথম ছোট বোনের মতো পেয়েছি। ও ভীষণ ভালো মেয়ে জানেন? আল্লাহ কেন ওর সাথে এমন করল?
ফাইজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ইনায়াকে নিয়ে গিয়ে একজায়গায় বসল।

মাইরার দু’হাত ইরফানের পিঠে। বুকে মুখ ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে, – শিসওয়ালা?
ইরফান মাইরাকে তার বুকে শক্ত কর ধরে রাখলো।
বেশ অনেক সময় পর ইরফান মাইরাকে ছেড়ে দু’হাতের আঁজলায় মাইরার মুখটা নেয়। মাইরা কান্নামাখা চোখে ইরফানের চোখের দিকে তাকায়। ইরফান দু’হাতে মাইরার মুখ মুছে দিয়ে ভারী গলায় বলে,
– ডোন্ট ক্রাই। কাঁদলে থা’প্প’ড় দিয়ে সব দাঁত ফেলব তোমার স্টুপিট!
ইরফানের কণ্ঠে একটুও জোর নেই। মাইরার আরও কান্না পায়। ইরফানের এসব কথায় যে মাইরা এখন ভালোবাসা খুঁজে পেল। সে না থাকলে তার শিসওয়ালার এসব ভালোবাসা তো আর পাবে না! মাইরা তার ডান হাত ইরফানের গালে দিয়ে ঠোঁট উল্টে ডাকে,

– শিসওয়ালা?
ইরফান মাইরার ডান গালে হাত দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– বলো।
মাইরা কিছু বলে না। চুপচাপ দেখে ইরফানকে। তার শিসওয়ালা তাকে ভালোবাসে। কথাটা ভাবতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে।
ইরফান মাইরাকে টেনে তার কোলে বসায়। মাইরা পিটপিট করে ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে। ইরফান মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– মাথা ব্য’থা করছে?
মাইরা নাক টেনে বলে,

– একটু একটু।
ইরফান মাইরার মাথায় চুমু খেয়ে বলে,
– ঠিক হয়ে যাবে।
এরপর মাইরার গলায় হাত দিয়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দেয়। চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– এখানে এসি নেই?
মাইরা মাথা নেড়ে বলে,
– আছে। আমার ঠাণ্ডা লাগে।
ইরফান মাইরার দিকে তাকায়। মাইরা ভেজা চোখে ইরফানের দিকেই চেয়ে আছে। মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবারও বলে,

– আপনি আমার শিসওয়ালা?
ইরফান বা হাতে মাইরাকে তার বুকে জড়িয়ে নেয়। কপালে চুমু খেয়ে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার ছাড়া আর কার শিসওয়ালা হব আমি?
মাইরা ইরফানের বুকে ডান গাল ঠেকিয়ে রেখে মাথা উঁচু করে। চোখজোড়া উপর দিকে করে ইরফানের পানে চেয়ে বাচ্চাদের মতো করে বলে,
– আপনার বার্ডফ্লাওয়ার কে?
ইরফান বুঝলো, মাইরা ইচ্ছে করে এমন করছে, তার মুখ থেকে বের করানোর জন্য। ইরফান একটু ঝুঁকে মাইরার ঠোঁটজোড়ায় শুকনো চুমু খেয়ে মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– ইউ নো? আমি বার্ডফ্লাওয়ার ছাড়া অন্য কোনো মেয়েকে টাচ করিনা।
মাইরার হাসি পায়। লোকটা কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে উত্তর দেয়। মুখ বাঁকিয়ে বিড়বিড় করে, – খ’বি’শ লোক।
ইরফান মাইরার কপালে গাল ঠেকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,

– দুপুরে খেয়েছিলে?
মাইরা ইরফানের দিকে তাকিয়ে ছোট করে বলে,
– খাইনি। আমার ক্ষুধা লেগেছে।
ইরফান মাইরার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটার মুখে সবসময় একটা বাচ্চামি ভাব থাকে। অথচ কাজগুলো কত বড় বড়। ইরফান ভারী ঢোক গিলে মৃদুস্বরে বলে,
– কি খাবে?
মাইরা ইরফানের দিকেই চেয়ে ছিল। ইরফানের চিন্তিত মুখটা দেখে তার মন ভার হয়ে গিয়েছে। ইরফানের বুক থেকে মাথা তুলে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলে,
– আমি কি বাঁচবো না শিসওয়ালা?
ইরফান সাথে সাথে মাইরার দু’গাল তার দু’হাতের আঁজলায় নিয়ে কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– শিসওয়ালার দেহে প্রাণ থাকতে বার্ডফ্লাওয়ারের নিঃশ্বাস কখনো বন্ধ হবে না।
একটু থেমে ওভাবেই চোখ বুজে বলে,

– যদি একজনের আয়ু কমিয়ে আরেকজনের আয়ু বাড়ানো যেত!
তবে শিসওয়ালা তার সব আয়ু বার্ডফ্লাওয়ারের নামে লিখে দিত।
মাইরা দু’হাতে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে। নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দেয়। ইরফান মাইরার ঠোঁটজোড়ার সাথে তার ঠোঁটজোড়া লাগিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৪

– হুশ! ডোন্ট ক্রাই বার্ডফ্লাওয়ার। কিচ্ছু হবে না তোমার।
মাইরা আরও শক্ত করে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরল। সে বাঁচতে চায় তার শিসওয়ালার বুকে।

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৬