প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১১

প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১১
শার্লিন হাসান

জাইমা লাইব্রেরিতে এসেছে কিছু বই কালেক্ট করতে কম নিজে বসে,বসে গল্পের বই পড়তে। তার সাথে আরশানও এসেছে। জাইমা যখন আসছিল, তখন আরশানের সাথে তার দেখা হয়। কথা বলতে,বলতে দু’জন এদিকে চলে এসেছে। জাইমা আরশানকে রেখে
কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে কিছু কালজয়ী বই কালেক্ট করে। ভীড়ের সারি থেকে সরে নিরিবিলি জায়গাটায় বসে। টেবিলের উপর বেশ কয়েক বই। সে ব্যাগ থেকে, ‘বুকপকেটের মায়াবিনী’ বইটা বের করে বাকী অংয় পড়া শুরু করে। আরশান একের পর এক কথা বলে যাচ্ছে। জাইমার সেসবে হুঁশ নেই।

জাইমার নিষ্ক্রিয়তা আরশানের পছন্দ হলো না। উঠে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ঘুরাঘুরি করে। লাইব্রেরির ভীড় প্রায় কমে গেছে। তাদের এখানে তেমন কারোর আসার সম্ভাবনা নেই। বইয়ের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে জাইমাকে উপর নিচ পরখ করছে আরশান। থ্রি-পিস পরে এসেছে। মেয়েটা ভীষণ মিশুক আর বাচ্চা টাইপের। খুব সহজেই কীভাবে মানুষ বিশ্বাস করে নেয়। আরশান তো ভাবছে, জাইমার সাথের পরিচয়টা সুন্দর ছিলো। মৃদু মুচকি হেঁসে সে জাইমার দিকে এগিয়ে যায়। জাইমা সে যে পড়ায় মনোযোগ দিলো, তার খবর নেই। আরশান জাইমার অনেকটা কাছাকাছি দাঁড়ায়। বইয়ের দিকে একনজর তাকায়। জাইমার পিঠের দিকে ঝুঁকে ঘাড়ের উপর থুঁতনি ঠেকাতে যাবে, এমন সময় ডাক পড়ে। আরশান ছিটকে সরে যায়। জাইমা বই রেখে তাকাতে দেখে ইশরাক রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জাইমা ইশরাককে দেখে কোন প্রতিক্রিয়া করেনি। জাইমার চুপ থাকা দেখে ইশরাক এগিয়ে আসে। আরশান ইশরাককে দেখে সালাম দেয়। আরশানের দিকে তাকিয়ে গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলে, “মিস মৈশানী ক্লাস বাদ দিয়ে এখানে কী করছেন?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

জাইমা মুখ বাঁকায়। জবাব দেয়না। ইশরাক আরশানের দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি এখানে কী করছ? লাইব্রেরির পরিবেশ নষ্ট করার মতলব নিয়ে এসেছ নাকী?”
“ক..কী যে বলেন না স্যার। আমি জাস্ট এসেছি জাইমাকে বই কালেক্ট করাতে হেল্প করার জন্য।”
জাইমা আরশানের দিকে তাকিয়ে জবাব দেয়, “কোথায় হেল্প করতে এসেছ? তুমি তো এসেছ তোমার কী বই নেওয়ার জন্য। আর তুমি এখনো রয়ে গেছ? আমি তো ভেবেছিলাম চলে গেছ।”
“নাহ যাইনি, চলো এখন যাই।”

জাইমা মাথা নাড়ায়। উঠতে গেলে ইশরাক ধমকে বলে, “তোমার যাওয়া তুমি যাও। মৈশানী তোমার সাথে যাবে না।”
আরশান কথা বাড়ায়না। চলে যায়। ইশরাক এগিয়ে আসে। জাইমা গুটিশুটি মেরে বসে থাকে। জাইমার সামনে দাঁড়িয়ে ইশরাক একনজর জাইমাকে পরখ করে। পরক্ষণে টেবিলের উপর থাকা বইটা হাতে নেয়। যেটা এতোক্ষণ জাইমা পড়ছিল। ইশরাক বইয়ের কভারে হাত বুলায়। নাম পড়ে, ‘বুকপকেটের মায়াবিনী’ লেখা। পুনরায় সেটা রেখে দেয়। ইশরাকের বই রাখা হতে জাইমা সেটা খপ করে ধরে ব্যাগে ঢুকিয়ে নেয়। নিজের কালেক্ট করা বইগুলো হাতে নিতে ইশরাক বলে, “আপনার সাথে আরশানের পরিচয় কয়দিনের?”

“সেটা আপনাকে কেন বলব?”
“আমার জানার ইচ্ছে হয়েছে।”
“তাহলে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকুন। এটাই আপনার শাস্তি।”
“ওয়েট! হুয়াট? আমি কেন কান ধরব?”
“মনে নেই, মেহেরের প্রেজেন্টেশন কবে? সেটা জিজ্ঞেস করায় আপনি আমায় পুরো ক্লাস দাঁড় করিয়ে রেখেছেন। ভুলে গেছেন?”
ইশরাকের মনে পড়ে সে কথা। জাইমা তো ক্লাসে ক্ষতি করে এসব জিজ্ঞেস করেছিল। সেজন্য তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে ইশরাক। জাইমা নিজের বই হাতে উঠে দাঁড়ায়। ইশরাক তর্জনী দেখিয়ে গম্ভীর স্বরে বলে, “আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।”

“ওই বেশিদিন না। ভার্সিটি আসার কয়েকদিন পর। ও আমার বাবার বন্ধু।”
“আপনি শিওর?”
জাইমা উপরনিচ মাথা নাড়ায়। ইশরাক অবাক হয়ে বলে, “আপনার মতো গাধা দু’টো নেই। আপনার বাবাকে জিজ্ঞেস করিয়েন। এরপর যখন শুনবেন ও কোন কিছুই হয়না। তখন বুঝবেন, গাধামী ছাড়া আবশ্যক।”
জাইমা বইগুলো হাতের কাছের তাকে রেখে দিতে,দিতে বলে,
“এক্সকিউজ মি! গাধা কাকে বলছেন? আপনার ধারণা আছে, আমি সম্পর্কে। মৈশানী খানম জাইমা। বাবার একমাত্র মেয়ে। এই মূহুর্তে চাইলে আপনাকে….
দু’টো মোটা বই এসে জাইমার ঘাড়ে পড়ে। ব্যাথায় আহ্ করে উঠে। ইশরাক প্যান্টের পকেটে দু-হাত গুঁজে জাইমার কার্যকলাপ দেখছে। জাইমা কিছু বলেনি

বইগুলো উঠিয়ে জায়গায় রেখে, হাত ঝাড়া দেয়। বিড়বিড় করে বলে, ” সব শত্রু।”
জাইমার কথার মাঝে ব্যাঘাত ঘটিয়ে ইশরাক বলে, ” মিস ড্রামা ফ্যাক্টরী, আসি আল্লাহ হাফেজ।”
ইশরাক হাঁটা ধরলে জাইমা চেঁচিয়ে বলে, “ড্রামা ফ্যাক্টরী মানে? আপনি জানেন আমার বাবার নিজের ফ্যাক্টরী আছে।”
জাইমার কথা মৃদু কর্ণ কুহর হতে ইশরাক হেঁসে উঠে। বেরিয়ে যায় লাইব্রেরি থেকে। জাইমা মুখটা ভোতা করে ইশরাকের পেছন,পেছন আসে।
ছুটির সময় লিফটের কাছে এসে দাঁড়ায় জাইমার। ভীড়ের ভেতর ঢুকে আগে,আগে চলে আসবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় জাইমা। সে ঢুকতে,ঢুকতে লিফটের দরজাই বন্ধ হয়ে গেছে। বিরক্তি নিয়ে আবারো দাঁড়িয়ে যায়। কিছুক্ষণ ওয়েট করার পর খালি লিফট আসতে ইশরাক প্রবেশ করে। জাইমা ইশরাককে দেখে আর যায়নি। সেখানেই দাঁড়িয়ে রয়। ইশরাক হাত দিয়ে ইশারা করে ভেতরে আসতে। জাইমা মাথা নাড়ায়। সে যাবেনা। জাইমার মতামত পেয়ে ইশরাক বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে নেয়। লিফটের দরজা বন্ধ করে নেয়। জাইমা ইশরাকের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে, ক্ষণে ক্ষণে মুখ বাঁকাচ্ছে।

সন্ধ্যায় রাহেলা খান ইশরাককে জিজ্ঞেস করেন, “জাইমাকে তোমার পছন্দ হয়েছে? তুমি রাজী থাকলে আমি বাকী বিষয়ে কথা বলব।”
জনসম্মুখে এরকম প্রশ্ন শোনে ইশরাক কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে যায়। সবার দিকে একনজর তাকায়। জাইমা সম্পর্কে বলতে গেলে, “জাইমার উল্টাপাল্টা কাজকর্ম ছাড়া বাকী সবই ইশরাকের পছন্দ হয়েছে। বিয়ে করলে ঠকবেনা সে। কিন্তু এই মেয়ের বাচ্চামি,উল্টাপাল্টা কাজকর্ম কতদিন সামলাবে? সমস্যা নেই, উনিশ-বিশ হলে চড় থাপ্পড় মারার অভ্যাস আছে ইশরাকের।”
ইশরাককে চুপ থাকতে দেখে সাজেদ খান বলেন, “তোমার পছন্দ হয়নি?”
“এরকম কিছুনা। সে মাশাআল্লাহ সুন্দর। তবে উল্টাপাল্টা কাজকর্ম বেশি করে। মনে হয়না, ওর বিয়েটা খুব তাড়াতাড়ি দিয়ে দিচ্ছ তোমরা?”

“ওর বয়স আঠারো পেরিয়েছে। ছোট কই?”
“দেখো তোমরা যা ভালো মনে করো।”
ইশরাকের কথায় সবাই একযোগে বলে উঠে, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
অবশেষে সে বিয়েতে রাজী। ইরা তার চাচ্চুর কোলে বসে দাদাকে শাসিয়ে বলে, ‘দুস্তু আন্নি পুচা কাজ কুরে। চাচ্চু কুষ্তু পাবে।”
ইশরাক ইরার দুগাল টেনে বলে, “তুমি খুশি মা?”
“ইয়েস। মাম্মাম আচবে।”

ইশরাক মৃদু হাসে। রাহেলা খান সাজেদ খানের দিকে তাকিয়ে বলেন, “এবার অন্তত সব ঠিক করে নেও। খুব সামান্য ব্যপারে দু’জন রাগ করেছ। যেটা রাগ হিসাবে না ধরলেও হয়।”
সাজেদ খান জবাব দেন না। ইশরাক বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন রাহেলা খনা বলেন, “আমি বাসায় যাব। সাজ্জাদের সাথে কথা বলে সব ঠিকঠাক করব। তোমরা গিয়ে বিয়ের ডেট দিবে।”
“ইশরাক বিয়েতে অনুষ্ঠান করতে চাও?”
সাথে, সাথে জবাব আসে, “একদম না। বিয়েটা সাদামাটা ভাবেই হবে। পরের দিন সন্ধ্যায় না-হয় পার্টি রাখব।”
ইশরাকের কথাটাই রইলো। এখন মূল উদ্দেশ্য বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করা। রাহেলা খান রাতের দিকে জাইমাকে কল দেয়। খোঁজখবর জিজ্ঞেস করার আগেই জাইমা বলে বসে, “বাসায় আসবে না বুড়ি? থাকো আমাকে ছাড়া। তুমি বড্ড পাষাণ বুঝেছ? কল দিয়েছ কেন? ওহে জাইমার খোঁজ নিতে? জাইমা তোমার কেউ হয়?”

“আরে আমার বনুর কত রাগ জমে গেছে। আগামী কালকেই আসছি।”
“সত্যিইই?”
“হ্যাঁ।”
“আমি খুশি। শোন, আজকে তোমার আদরের গুণধর নাতনি গোলামেরপুত একটা। একটা সিনিয়রের সাথে আমার ভাব জমেছে সে নাকী আমার বাবার বন্ধুর ছেলে। এখন তোমার নাতি বলছে, সে নাকী কোন বন্ধুর ছেলে না, আমাকে বোকা বানিয়েছে। কথা সেটা না দাদী। যাই হোক সিনিয়র তো? আমার প্রেমের একটা ব্যবস্থা হচ্ছিল। ওই গোলামেরপুত সব ব্যবস্থাতে পানি ঢেলে দিয়েছে।”
“হ্যাঁ ঠিক করেছে। এমনিতেও হবু বউয়ের প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য পালন করা খারাপ না।”
“না। আমি ওর বউ হবোনা। অন্য কাউকে বিয়ে করব ওই মর্ম কর্মকে না।”
“সবাই রাজী। তুমিও রাজী ছিলে এতোদিন।”
“তো? মর্মকে আমার লাগবে না। ওর গার্লফ্রেন্ড আছে না?লোহা নাকী পোহা জানি। তার সাথে বিয়ে দাও, আমি খুশি হবো।”

“আমার নাতি প্রেম করেনা।”
“লোহার সাথে করে। মানে পোহা।”
“আরেহ কীসব বলছ? পোহা তো ওর বোনের মতো। এছাড়া তোমার সাথে ওর বিয়ে ঠিক করা।”
কথাটা শেষ হতে রুমে উপস্থিত হয় ইশরাক। রাহেলা খানের পাশে এসে বসে। ইশরাক চোখ দিয়ে ইশরা করে জিজ্ঞেস করে, ‘কে?’
তখন রাহেলা খান কলটা লাউডস্পিকারে দেন। জাইমা চট করে বলে ওঠে, “দাদী তুমি জানো না। ওই প্রফেসর মানে মর্ম কর্ম আমাকে ক্লাসে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ওইদিন তো বাসা থেকে তাড়িয়ে দিলো। তুমি বলো ওই গোলামেরপুতকে আমি বিয়ে করব? প্রশ্নই আসেনা।”
“তোমার সাথে আমি পরে কথা বলছি।”

কল কেটে দেন রাহেলা খান। জাইমা যে গালি দিবে ভাবতে পারেননি। ইশরাক মুখটা গম্ভীর করে নেয়। দাদীর হাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। মৃদু হেঁসে বলে, “ওই মেয়ে তো পাগল। একদিন তো আমায় পেছন থেকে থাপ্পড় দিয়ে, গালি উচ্চারণ করে বলে, ‘এতো দেরিতে আসলি কেন?’
পরে বলেছে, ওর ফ্রেন্ড ভেবেছে। সেজন্য কিছু বলিনি। আর ও আর কী কী করেছে তুমি জানো?”
“কী?”
“ওকে বলেছি এসাইনমেন্ট জমা দিতে ও এসাইনমেন্ট করেনি উল্টো ওর পরিবারের লোকজনকে মৃত বলে চালিয়ে দিয়েছে।”
“কীহ্?”
“হ্যাঁ। ড্রামা ফ্যাক্টরী।”

ইশরাকের কথায় রাহেলা খান বলেন, “ড্রামা ফ্যাক্টরীকে বউ হিসাবে পছন্দ হয়েছে?”
“সব ঠিকঠাক। শুধু যে গালি দেয় আর উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করে সেটা একটু…
” ঠিক হয়ে যাবে। ও তো ওর বাবা মায়ের সামনে গালি দেয়না। উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করলেও সেটা প্রকাশ কম করে। সেজন্য এই বিষয়ে তেমন শাসন পায়না। তবে তুমি সবটা গুছিয়ে দিও। আমার জাইমা ভীষণ চঞ্চলা,কোমল মনের। কষ্ট দিও না,আগলে রেখো।”

প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১০

“সেটা বুঝেছি প্রথম দেখায়।”
“দোয়া রইলো। শাদী মোবারক মর্ম।”
দাদীর কথায় ইশরাক মৃদু হেঁসে বলে, “বিয়ে এখনো ঠিক হয়নি। হলে, নাহয় শাদী মোবারক জানিও।”

প্রণয়ের প্রিয়কাহন পর্ব ১২