প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৩
মুসতারিন মুসাররাত
শুক্রবার দিন সবকিছুতেই দারুণ একটা পবিত্র পবিত্র ভাব বিরাজ করে। দূরের মসজিদ থেকে আজানের সুমধুর ধ্বনি ভেসে আসছে। মির্জা বাড়ির কিচেন থেকে বিভিন্ন মশলাপাতির গন্ধ ভুরভুর করছে। হরেক রকমের পদ রান্না করা হচ্ছে। মাছ-মাংসের গন্ধে তনুজার গা-টা আজ কেমন জানি গুলিয়ে আসছে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে। তনুজা খুন্তি দিয়ে প্যানে কিছু নাড়তে ব্যস্ত। এমন সময় তামান্না আসলেন। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিক-ওদিক দেখে বললেন,
-” আর কতদূর? ওনারা তো কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এলো বলে। সময় মতো রান্না শেষ হবে তো।”
দীর্ঘক্ষণ আ’গু’নের আঁচে থেকে পৌষ মাসেও তনুজার কপালে ঘাম জমেছে। কপাল বেয়ে মুখের সাইডে থাকা বেবি হেয়ার কানের পিঠে গুঁজে নেয় তনুজা। ক্লান্তিতে ওর চোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। প্রত্যুত্তরে মিহি স্বরে বলল,
-” ফুপি, এই তো শেষের দিকে প্রায়।”
তামান্না কেবিনেটের উপর থাকা খাবারের ঢাকনা খুলে খুলে দেখছেন। কণ্ঠে আদেশ জারি করলেন,
-” সাদা ভাত দেখছি এখনো রান্না হয়নি। বাসমতি চালের সাদা ভাত রান্না করো। আর শোন; সেইসময় বারবার যেনো বলা না লাগে ফলমূল সুন্দর করে কে’টে সাজিয়ে রেখো। ও হ্যা, রান্না শেষে সালাদের জন্য শসা আর গাজর কে’টে রাখবে। সাথে লেবুও রাখবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এরমধ্যে শিরিন সুলতানা আসলেন। তামান্নার হুকুম শুনে বি”র”ক্ত হলেন। তনুজাকে ডেকে বললেন,
-” তনুজা।”
তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
-” হ্যা, মামণি।”
-” সেই সকাল থেকে কিচেনে আছো। রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। বাকি কাজ বুয়ারা আছে করে নিবে। কিছুক্ষণ পর মেহমান আসবে, শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে নাও। বড়রা রেডি হয়ে হাত-পা তুলে ঘুরছে, আর বাচ্চা একটা মেয়ে হয়ে তুমি এখনও কিচেনেই আছো।”
তামান্নাকে পিন মে/রে কথাটা বলে শিরিন। তামান্নার মুখে গ্রহণ লাগে যেন। সেকেন্ডেই মুখটা থমথমে গম্ভীর হয়ে যায়। ওনার কাছে আদিখ্যেতা ঠেকল। তবে ভাবীর মুখের উপর কিছু বলার স্পর্ধা দেখালেন না। মনেমনেই রাগ-ক্ষোভ ঝাড়লেন। তনুজা বলল,
-” হাতের কাজটা শেষ করেই যাচ্ছি। আর একটু বাকি আছে। সমস্যা নেই মামণি।”
শিরিনের হাতে থাকা মুঠোফোন শব্দ করে বেজে উঠল। যাওয়ার আগে আদেশের সুরে বললেন,
-” আচ্ছা। তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। আমি একটু পরই আসছি; এসে যেনো তোমাকে কিচেনে না দেখি।”
ফোন রিসিভ করে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে যায় শিরিন। এরমধ্যে কিচেনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নিতির বাবা হালকা কেশে ডাকলেন,
-” তামান্না আছো?”
মহিলা মুখাবয়ব এমন করলেন যেনো বেশ বি’র’ক্ত হলেন। এগিয়ে কর্কশ স্বরে বললেন,
-” হ্যা বলো। কী হয়েছে কী? এত ডাকছো যে?”
তনুজা ফুপা শ্বশুরের উপস্থিত টের পেয়ে শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দেয়। ভদ্রলোক কলেজের বাংলার লেকচারার। চাকরির সুবাদে অন্যজেলায় থাকেন। ছুটির দিনগুলোতে নিজ বাড়ি আর শ্বশুরবাড়ি থাকেন। নিজের বউয়ের থেকে মুখ ঝামটা নিত্যকার বিষয় মানুষটার কাছে। তবে বাড়ির নতুন বউয়ের সামনে এহেন কর্কশ বিহেভে ভেতরে ভেতরে আ’হ’ত হলেন নেওয়াজ সাহেব। লজ্জিত হোন। মুখটা ম্লান হয়ে আসলো। শুধালেন,
-” আমার সাদা পাঞ্জাবিটা খুঁজে পাচ্ছি না। কোথায় রেখেছো?”
-” কোথায় থাকবে। কেবিনেটে বা আলমারিতে দ্যাখো; আছে হয়তো সেখানে। তাছাড়া যাবে কোথায়।”
নেওয়াজ সাহেব গলার স্বর নিচু করে বললেন,
-” খুঁজে দেখলাম। পাইনি জন্যই তো তোমাকে বলছি।”
-” নৃত্যকে বলো খুঁজে দিতে। আর নয়তো চশমাটা পড়ে ভালো করে খুঁজে দ্যাখো। বয়স বাড়ছে সাথে চোখ দু’টো তোমার যাচ্ছে।”
একজন আদর্শ স্ত্রী হলে নিজে গিয়ে খুঁজে দিতো। এতটা আশা ভদ্রলোক করেনও না। তারপরও একটু ভালো করেও তো বলা যেতো। এই ভেবে বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরোয় ওনার। কিছু ভেবে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে হঠাৎ বললেন,
-” এখানে এসব আয়োজন না করে বাড়িতে করলে ভালো হতো না। না মানে মেয়ের বিয়ে-শাদির ব্যাপার নানার বাড়িতে করলে, কেমন দৃষ্টিকটু লাগবে না। এখন তো এসব বলে লাভ নেই। একটু ভেবে দেখো, বিয়ের পুরো বিষয়টা বাড়িতে করলে….”
কথার মাঝে দাঁড়ি টেনে দিয়ে উঁচু স্বরে বললেন,
-” ওই অজপাড়া গাঁয়ে গিয়ে আমার মেয়ের বিয়ে দিবো। ওখানকার লোকজন না জানে কালচার না জানে..”
একবার স্প্রিংয়ে টান পড়লে যেমন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কিছুক্ষণ দুলতে থাকে। ঠিক তেমনি তামান্নার মুখটা স্প্রিংয়ের মতো একাএকাই চলতে থাকল। ভদ্রলোক কথাটা বলে যেন বেশ বেকায়দায় পড়লেন। বলে কাজের কাজ কিছুই হলো না। আরো নতুন বউ আবার কাজের লোকদের সামনে এহেন কথাবার্তা শুনে অ’প’মানিত বোধ করলেন। ভদ্রলোক ম্লান মুখে প্রস্থান করলেন।
কাজ করতে গিয়ে আচমকা ফুটন্ত তেল তনুজার হাতে ছিটে পরে। প্যানে টগবগ করা গরম তেল পরার সাথে সাথেই কব্জি থেকে ইঞ্চি দুই উপরে পরপর দু-তিনটা ফোসকা উঠে। তনুজা বাম হাতের সাহায্যে ডান হাতটা চেপে ধরে চোখ বুজে নেয়। হাতটা ভীষণ জ্বা’লাপো’ড়া করছে। কাজের বুয়া দেখে তড়িৎ হইহই করে উঠল,
-” অ্যাইরে ভাবিমণি তো হাতটা পুড়াইয়া ফালাইলেন। ইশশ্ রে! কত্তখানি জাইগা জুইড়া ফোস্কা উঠছে। ম্যালা কষ্ট হইতাছে? পুড়তাছে? জলদি ঘরে গিয়া ওষুদ লাগাইয়া ন্যান।”
বুয়ার সহজ-সরল মনের অভিব্যক্তি দেখে তনুজা আলতো হাসল। ওর বলতে ইচ্ছে করল,
-” যার গোটা জীবনটাই কষ্টের যাতনার! তার কাছে এই সামান্য জ্বলন-ব্যাথা কিছুই না। শরীরের ব্যাথা ঔষধ দিলে নিমিষেই দূর হয়ে যাবে। কারো উপেক্ষায় – অবহেলায় যে প্রতিনিয়ত দম বন্ধ হয়ে আসছে! অসহনীয় যাতনায় ছটফটিয়ে দ-গ্ধ হচ্ছি! মনের এই কষ্ট উপশমের পাথেয় যিনি; তিনি কী আদৌ আর বুঝবেন? রাগ-ক্ষোভ, অভিমান দূরে ঠেলে সবটা স্বাভাবিক করে নিবে কী? মনের সেই যন্ত্রণা-কষ্টের কাছে শরীরের এই সাময়িক কষ্ট তো কিছুই না।”
অবচেতন মন এসব ভেবে মনেমনেই তাচ্ছিল্য হাসে তনুজার। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখে বলল,
-” ঔষধ নিতে হবে না। এটা তেমন কিছুই না। এমনি ঠিক হয়ে যাবে।”
এইবলে তনুজা কাজ করতে নেয়। কাজের মেয়েটা বাঁধ সাধল। বেগম সাহেবা একটু আগে এসে কি বলেছেন এই বলে তনুজাকে এক প্রকার জোর করে রুমে পাঠায়। এ-ও বলে বাকি কাজ সে করে নিবে।
কাজের মেয়ের নির্ভেজাল সরল ভালোবাসা দেখে তনুজা আপ্লুত হয়। আসলে এই পৃথিবীটা বড় অদ্ভুত। তার থেকেও বেশি অদ্ভুত মনুষ্য জাতি। এইযে শিক্ষিত হলেও অনেকের মধ্যে মনুষ্যত্ব থাকে না। সুন্দর মন সবারই থাকে না। মানুষের ক্লাস কখনো অর্থ আর স্ট্যাটাসের উপর ভিত্তি করে করতে হয় না। একজন মানুষ কতটুকু ভালো, কতটুকু মানবিক গুন সম্পন্ন এর উপর ভিত্তি করে ক্লাসিফিকেশন করতে হয়। তবেই না ভালোর চর্চা হয়, ভালোর প্রতি উৎসাহিত করে।
তনুজা রুমে প্রবেশ করে দেখে ইভান শাওয়ার নিয়ে বেরুচ্ছে। একপল তনুজার দিকে তাকিয়েই তড়িৎ দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয় ইভান। তনুজার কষ্ট অনুভব হয়। আগ বাড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করলেও, দাঁতে দাঁত চেপে ইচ্ছে সংবরণ করে ও। তনুজা শাড়ি আর প্রয়োজনীয় জিনিস বের করতে থাকে। ইভান কেবিনেট খুলে কিছু খুঁজছিলো। তনুজা আন্দাজ করে বলল,
-” টিশার্ট বাকিসব বাম পাশের পাল্লায় রাখা আছে। কালকে গুছানোর সময় এদিকে যায়গা হচ্ছিলো না, তাই ওপাশে রেখেছি।”
ইভান ওপাশের পাল্লা না খুলে এখান থেকেই একটা নেভি-ব্লু কালারের টিশার্ট বের করে গায়ে জড়িয়ে নিলো। তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকল।
আয়নার সামনে বসে তনুজা। শ্যাম্পু করা চুলগুলো চিরুনি করে ছেড়ে দেয়। হাতে স্বর্ণের কয়েকটা চিকন চুড়ি পড়ে নেয়। ডান হাতের চুড়ি গুলো গিয়ে হাতের পোড়াতে ঘর্ষণ লেগে ব্যাথা করছে। ওদিকে বাড়িতে মেহমান আসবে, হালকা গহনা না পড়লে দিদুন রাগ-ঢাক করবেন। অগত্যা তনুজা চুড়ি পরে। ইভান ব্যালকনি থেকে রুমে ঢুকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে যেতে থাকে। তনুজা উঠে দাঁড়ায়। চোখে টলমলে পানি নিয়ে ডাকল,
-” ইভান।”
ইভানের পা থেমে যায়। উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে নিরুত্তর নিশ্চুপ রয়। কাজলটানা মৃগ নয়ন পানিতে টইটম্বুর করছে তনুজার। বুক ভরা হতাশা আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে নিম্নস্বরে বলল,
-” জীবন সহজ নয়! সহজ করে নিতে হয়! অপেক্ষা করে, সহ্য করে, ধৈর্য্য ধরতে হয়।”
থেমে ম্লান স্বরে ফের বলল,
-” ইভান আমি আর কত ধৈর্য্য ধরব? আপনার ইগনোরে আমি সত্যিই ভীষণ কষ্ট পাচ্ছি। প্রতিনিয়ত আমার নিঃশ্বাস আঁটকে আসছে। মনে হচ্ছে আমি সাফোকেটিংয়ে ভুগছি। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন আমায়।”
ইভান নাতো টু শব্দটি করলো; আর নাতো ফিরে তাকায়। কথাটা না শোনার মতো গটগট পা ফেলে প্রস্থান করে। তনুজা ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে চোখের অশ্রু বিসর্জন দেয়।
নীরবের ফ্যামেলিকে লাঞ্চের ইনভাইট করা হয়েছে। ওনারা খানিকক্ষণ আগেই আসছে। নীরবের বাবা, নেওয়াজ সাহেব আর শাহারিয়ার সাহেব এখনো নামাজ শেষ করে ফেরেনি। নীরবের মা ড্রয়িংরুমে বসে শিরিন সুলতানা আর তামান্নার সাথে গল্প করছেন। এরমধ্যে তামান্না তনুজাকে ডেকে নিতিকে আনতে বলেন। নিতি রেডি হয়ে ঘরময় অস্থিরতায় পায়চারী করছে। যখন থেকে শুনেছে নীরব আসেনি তখন থেকে ওর ছটফটানি কয়েক দফা বেড়ে যায়। এরমধ্যে তনুজা গিয়ে জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল,
-” মাশাআল্লাহ! শাড়িতে তোমাকে ভারী মিষ্টি আর খুব বেশিই সুন্দর লাগছে। যদিও তুমি এমনিতেও সুন্দরী!”
ফর্সা গায়ে মেরুন রঙের জামদানিতে নিতিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। নিতি সৌজন্যতা করতে নিরস কণ্ঠে বলল,
-” থ্যাংকস।”
-” চলো এবার। নিচে তোমাকে ডাকছে।”
তনুজা তাড়া দেয়। নিতি আগে তনুজা দু’কদম পিছে। করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় দিব্যর সামনাসামনি পরে নিতি। দিব্য কয়েক হাত দূরত্বে, বাইকের চাবি আঙুলের ডগায় ঘুরাতে ঘুরাতে আসছিলো। নিতিকে শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে একটু অবাক হয়। বাড়ির খবরাখবর আজকাল তেমন কিছুই রাখে না দিব্য। নিচে অচেনা কাউকে দেখেও জানার আগ্রহ হয়নি “কে?” দিব্যর চোখে চোখ মিলতেই নিতির ভেতরের দুষ্টুমিরা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। নিতি মুখের উপর থাকা চুলগুলো কানের পিঠে গুজতে গুজতে স্লো ভয়েজে সুর করে গাইল,
-” পা’গ’ল তুজহে মায় কারদুংগি এখদিন পিয়ার মে এখদিন পিয়ার মে।”
এতটুকু গেয়ে বাম চোখ টিপল নিতি। পরপর তড়িৎ একহাত চোখে ধরে পিছনে ঘুরে তনুজাকে বলল,
-” ভাবিমণি দ্যাখো! দ্যাখো তো চোখে কিছু একটা পড়ল হয়তো।”
দিব্য ভ্যাবাচ্যাকা খায়। বো’কা বনে যায়। এত তাড়াতাড়ি সবকিছু ঘটলো যে বেচারা ঠাহর করতে পারল না। তনুজা মনোযোগ দিয়ে নিতির চোখে দেখতে থাকে। তনুজা থাকায় দিব্য আর নিতিকে নিয়ে ঘাটল না। কিছুই না বলে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। দিব্য চলে যেতেই নিতি স্বাভাবিক ভাবে তাকায়।
-” থাক! থাক! লাগবে না, ভাবিমণি। ঠিক হয়ে গিয়েছে। পোকা উড়ে গিয়েছে।”
নিতি দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলে। তনুজা নির্বোধের মতোন চেয়ে রয়। ওর মাথার একহাত উপর দিয়ে যায় সব।
পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে। শহরে শীতের আমেজ পড়েছে। বিকেলের নরম রোদ ব্যালকনিতে দাঁড়ানো দিব্যর গা ছুঁয়ে দিচ্ছে। একহাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে অন্যহাতে জ্বলন্ত সিগারেট দুই ঠোঁটের মাঝখানে চেপে দাঁড়িয়ে দিব্য। এমন সময় মেয়েলি রিনরিনে স্বর ঝংকার তুলল,
-” সিগারেট খায় বো’কা’রা।”
দিব্য পরপর উর্ধ্বমুখী ধোঁয়া ছেড়ে হাতের অবশিষ্ট সিগারেট গ্রীল দিয়ে নিচে ছুঁড়ে ফেলল। নিতির দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বলল,
-” তুই?”
নিতি দুই হাত বুকে ভাঁজ করে দাঁড়ায়। ও বলল,
-” সিগারেট খেয়ে ঠোঁট দুটো পু’ড়া’চ্ছো। তোমার বউয়ের নিশ্চিত ওই কালচে ঠোঁটে চুমু খেতে একদম রুচি হবে না।”
দিব্য রাগটা কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল। সফেদ দন্তপাটি কটমট করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
-” নি..তি। খেয়ে কাজ নেই তোর! শুধু আসিস মেজাজ খা’রা’প করতে আমার।”
নিতি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,
-” কাজেই এসেছি এখন। আমার তোমাকে জরুরী কিছু বলার আছে।”
দিব্য গা ছাড়া ভাবে থাকল। নিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথাটা নুইয়ে একদম নিচু স্বরে বলল,
-” নেক্সট ফ্রাইডেতে বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে।”
দিব্য চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে নিতির দিকে সরু চোখে তাকায়। ভ্রু কুঁচকে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-” তোহ!”
কীভাবে বলবে ভেবে কূলকিনারা পাচ্ছে না নিতি। নিতির মধ্যে জড়তারা ভীড় জমিয়েছে। কথাগুলো কণ্ঠনালীতে আঁটকে আসছে; মুখ ফুটে বেরুতে গড়িমসি করছে। এরমধ্যে দিব্য বাঁকা চোখে চেয়ে বলল,
-” তোর বিয়ে নেক্সট সপ্তাহে; সেখানে আমার কাজ কী? হ্যা আমার কাজ অবশ্য একটা আছে। তুই কী এখন আমাকে এটা বলতে আসছিস, যে আমি আজই যেনো সাউন্ড বক্স নিয়ে আসি। আর সাথে শহরের নামকরা ফটোগ্রাফারকে বলে আসি। হলুদের দিন থেকে শুরু করে একদম বিদায় পর্যন্ত যেন অবিরাম ফটো তুলে যায়। তোরা মেয়েরা তো বিয়েতে এসবই চাস। তা তোর বিয়েতে গিফট হিসেবে আমার তরফ থেকে এতটুকু আমি করতেই পারি।”
নিতি প্রচন্ড বিরক্ত হলো। বলল,
-” আরে ধূর! আমাকে বলতে দিবে তো। একটু সময় দিবে। তা না যা মনে হচ্ছে বলেই যাচ্ছো। আমি এই বিয়েটা করতে চাই না।”
দিব্য নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
-” এটা আমাকে বলছিস কেনো? তুই বিয়ে করতে চাস না এটা শুনে আমি কী করবো? ফুপিকে বল। এন্ড তোর বাপকে গিয়ে বল। তোর বাপ নেওয়াজ শরীফ না তোর সব আবদার শোনে।”
নিতি তেতে উঠল,
-” উফ্ফ! আবার আমার পাপাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করছো। কথাটা মাম্মা বা পাপা কাউকে বলার আগে তোমাকে বলা জরুরী। তাই তোমাকে বলছি।”
থেমে বুক ভরে শ্বাস নেয় নিতি। চোখদুটো বুঁজে মুখস্থ পাঠের ন্যায় গড়গড় করে বলল,
-” আমি এই বিয়েটা করতে চাই না। কজ আমি তোমাকে পছন্দ করি। শুধু পছন্দই নয় এর থেকে বেশি কিছু।”
ধীরে ধীরে চোখ মেলে দিব্যর দিকে তাকায় নিতি। দিব্যর মুখভঙ্গি স্বাভাবিক। নিতি ভয়ে ভয়ে ছিলো কথাটা শোনার সাথে সাথে গালে ঠাস করে চ’ড় না পরে। তবে দিব্যকে নির্বিকার দেখে নিতি ভড়কায়। নিতি ম্লান স্বরে বলল,
-” ভেবেছিলাম আজ সাহস করে মিস্টার নীরবকে বলবো বিয়েটা ক্যান্সেল করতে। কিন্তু ও ব্যাটা ইমার্জেন্সি পেশেন্ট নিয়ে ব্যস্ত থাকায় আসতে পারেনি। এদিকে আজকেই আন্টি আংকেল ডেট ফিক্সড করেছেন। আর জানি না মাম্মা এত তাড়াতাড়ি কেনো ডেট বললো। পাপা সামনের মাসের কথা বলছিলো। কিন্তু মাম্মা আগ বাড়িয়ে নেক্সট ফ্রাইডে বলে। এখন আমি কী করবো বুঝতে পারছি না?”
-” বিয়েটা করে নে।”
-” আমি মোটেই প্রাঙ্ক করছি না। আমি সিরিয়াসলি বলছি। আমার সত্যিই তোমাকে সেই কিশোরী বয়স থেকেই ভালো লাগে। সব কিছু ভুলে আমাকে মেনে নেওয়া কী খুব বেশিই অসম্ভব? এই ইম্পসিবল কে পসিবেলে কনভার্ট করলে খুব বেশিই কী ক্ষ’তি হবে? কারো হৃদয়ের গহীনে লুকানো একতরফা ভালোবাসার পূর্ণতা দেওয়া যায় না?”
নিতির অসহায় চোখ। কণ্ঠে ঝরল করুণ আবদার। দিব্যর পাথুরে কঠিন হৃদয় এতটুকু নাড়া দিলো না। কাটকাট গলায় বলল,
-” ইম্পসিবল। একেবারেই সম্ভব নয়। যা হুট এখান থেকে।”
নিতির ভীষণ কান্না পেলো। সাথে রাগ হলো। কিছুপল থম মে’রে দাঁড়িয়ে রইল নির্লিপ্ত। হঠাৎ কিছু ভেবে বাচ্চামোর সুরে বলল,
-” আমি…আমি সু’ইসাইড করব।”
দিব্য স্বাভাবিক মুখাবয়ব করে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
-” কীভাবে?”
নিতি কয়েক সেকেন্ড ভাবল। মহা আবিষ্কার করার মতোন মুখভঙ্গি করে বলল,
-” উমম! ব্লে’ড দিয়ে হাতের শিরাগুলো কেটেকুটে।”
-” একটান দেওয়ার পর ব্লা’ড দেখে তুই সেন্সলেস হয়ে পড়বি। তাই এই পদ্ধতিতে তুই উপরে যেতে পারবি না; আ’ম ড্যাম শিওর।”
-” ওকে। এটা বাদ হারপিক খাবো। নাইন্টি নাইন পার্সেন্ট জিবাণু ধ্বংসকারী হারপিক নিশ্চয় এক নিতিকে নিমিষেই.”
এতটুকু বলে এক আঙুল গলায় টান দেয়। তারপর উপরের দিকে ইশারা করে বলল,
-” নিমিষেই নিতির লাইফ খতম করে একদম উপরে পাঠিয়ে দিবে। সোজা পটল তুলাবে।”
দিব্য নাকমুখ সিটকিয়ে বলল,
-” ছ্যাহ! ইতর কোথাকার! আমাকে রিকোয়েস্ট করলে, ভালো নামকরা কোম্পানির ইঁদুর মা/রা বি//ষ এনে দিতে পারি। যা হারপিকের থেকেও দ্বিগুণ কার্যকারী। সাথে অল্প সময়েই…খ’ত’ম করবে।”
নিতির চোখদুটো কপালে উঠল। এহেন খা’রাপ মানুষ নিতি বাপের জন্মে নয়, দাদার জন্মে নয়, কোন জন্মেই দেখেনি। কত্তবড় খারাপ হলে মানুষ এমনটা বলে। কোথায় সু’ই’সা’ইডের কথাশুনে চিক্কুর লাগা দিবে, তা না আরো ইন্সপায়ার্ড করছে। খা’টাশ কী আর সাধে বলি! এসব ভেবে নিতি কাঁদো কাঁদো ফেস করল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
-” তোমাকে হেল্প করতে হবে না। আমি নিজেই ব্যবস্থা করে নিবো হুম। ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়। ঠিক একটা না একটা উপায় আমি নিজেই বের করে নিবো।”
রাগে গজগজ করতে করতে নিতি পা বাড়ায়।
-” ধ্যাত আমারি ভুল। খিচুড়ির মতো লোককে বিরিয়ানি ভেবে ভুল করেছি। এন্ড এত তোষামোদ করাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল। হু।”
বিড়বিড় করতে করতে পা চালিয়ে প্রস্থান করতে নিয়ে; আচমকা শাড়ির কুচিতে উস্টা খেয়ে পরে যেতে নেয় নিতি। এমন মূহুর্তে একটা শক্তপোক্ত রুক্ষ হাত নিতির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। নিতি ভ’য়ে খিচে চোখ বন্ধ করে ফেলে। পিটপিট করে চোখ মেলে দেখে দিব্য একহাতে কোমড় জড়িয়ে নিতির দিকে ঝুঁকে। নিতি নিচের দিকে কাত হয়ে আছে। একটু আগের কথা ভেবেই নিতির আকাশসম রাগ হয়। তাই ঠোঁট উল্টে বলল,
-” ছাড়ো! ছাড়ো আমাকে। এখন এতো ধরতে হবে না তোমাকে। আমি এ.”
নিতির মুখের কথা মুখেই থাকে। নিতির বলতে দেরি দিব্যর ছাড়তে দেরি হয় না। কথাটা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। নিতি ধপাস করে ফ্লোরে পরে যায়। নিতি ফ্লোরে দুইহাত ঠেস দিয়ে বিস্ময়কর চাউনিতে চেয়ে চেঁচিয়ে বলল,
-” এটা কী হলো?”
-” কেনো? তুই যা বললি তাইই তো করলাম। তুই-ই তো ছাড়তে বললি।”
কথাটা বলে চুলের মধ্যে আঙুল চালনা করে সুন্দর করে নিতিকে পাশ কাটিয়ে রুমে যায় দিব্য। নিতি কোমড়ে হাত দিয়ে মনেমনে দিব্যকে আচ্ছা মতো ব’কে।
নিতি রুমে গিয়ে শাড়ি খুলে থ্রি পিস পরে নেয়। শাড়িটা বিছানায় এলোমেলো ফেলে রুম থেকে বেরোয় আর বিড়বিড় করতে থাকে,
-” আস্ত খা’টা’শ একটা। এত করে বললাম মন গললো না। ঠিক আছে আমিও বিয়ে করে নিবো। তুই থাক সারাজীবন দেবদাস হয়ে। তনুজা ভাবি যদি মেনে নিয়ে সংসার করতে পারে আমি কেনো পারব না।”
মনটা ভীষণ বিক্ষিপ্ত আছে। মন-মেজাজ স্বাভাবিক করতে নিতি ছাদে যায়। নৃত্য ছাদে দোলনায় বসে দোল খাচ্ছে আর ডিটেকটিভ উপন্যাস পড়ছে। নিতি গিয়ে গুমড়া মুখ করে পাশে বসে। নৃত্য শুধায়,
-” মন খারাপ তোমার?”
-” উঁহু।”
হাতের বইটা বন্ধ করে পাশে নামিয়ে নৃত্য বলল,
-” অ্যাই আপু চলো ব্যাডমিন্টন খেলি। খেললে পরে দেখবা নিমিষেই মন ভালো হয়ে যাবে। আমি বইটা রেখে ফেদার আর র্যাকেট নিয়ে আসছি। খেলবে আমার সাথে। প্লিজ না করো না।”
নিতি বিরক্ত হয়ে বলল,
-” নৃত্য আমার ভালো লাগছে না। প্লিজ কানের পাশে ঘ্যানঘ্যান করিস না।”
নৃত্যের মুখটা ম্লান হয়। তা দেখে নিতির খারাপ লাগল। এবার মোলায়েম স্বরে বলল,
-” বোন মন খা’রাপ করিস না। এখন নয়। পরে খেলব।”
নৃত্য হাসিহাসি মুখ করে বলল,
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২২ (২)
-” ওকে ব্যাপার না। আচ্ছা আমার না জলপাই খেতে ইচ্ছে করছে। তুমি যদি কয়েকটা জলপাই পেরে দিতে। লবণ, মরিচের গুঁড়া দিয়ে খাবো।”
নিতি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। নৃত্য উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-” বইটা রুমে রেখে আসি। তুমি পারতে থাকো কেমন।”
কথাটা শেষ করে নৃত্য ভো দৌড় দেয়।
নিতি উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের রেলিং ঘেঁষে থাকা জলপাই গাছটার দিকে তাকায়। গাছটা বিশাল বড়সড়। একটা ডাল ছাঁদ ঘেঁষে আছে। নিতি দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে নাগাল পাচ্ছিলো না। তাই রেলিংয়ের উপর দাঁড়ায়।
ফোন কানে চেপে কারো সাথে কথা বলতে বলতে দিব্য ছাদে আসছিলো। ছাদে কয়েক পা ফেলতেই ওর চোখ যায়..