প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৫
মুসতারিন মুসাররাত
মির্জা বাড়ির ডায়নিংয়ে উপস্থিত সবাই যেন নীরবশ্রোতা। এদিকে তামান্না হাত দু’টো নাড়িয়ে নাড়িয়ে অনড়গল কথা বলে যাচ্ছে। হেনতেন বিয়ের প্ল্যান প্রোগ্রামিং নিয়ে কথা বলে বলে ওনার মুখটা একটুও বন্ধ হওয়ার ফুরসত পাচ্ছে না। নেওয়াজ সাহেব চুপচাপ। কিছু বললে স্ত্রীর কাছে এক পয়সার দাম পাওয়া যাবে না। তাই অহেতুক কথা না বলে নিশ্চুপ আছেন। শাহারিয়ার মির্জা বোনের সাথে সায় মিলিয়ে মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলছেন। তনুজা-ইভান আর নিতি ছাড়া ছোট-বড় সবাই উপস্থিত ছিলো। এমন সময় দিব্য এসে আড়চোখে চারিদিকে অবলোকন করে চেয়ার টেনে বসে। ফুপি আর বাবার কথা শ্রবণ করে সেকেন্ডেই ঠাহর করে আজ ডিনার কম বিয়ের শলা পরামর্শ চলছে। কাঁচের জগটা হাতে তুলে পানি ঢালতে ঢালতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে দিব্য বলল,
-“ মাম্মা আমার কিছু বলার আছে।”
তামান্না ঢের বি’র’ক্ত হলেন। গুরুত্বপূর্ণ কথা চলছে তার মধ্যে এই ছেলে বা হাত দিয়ে দিলো। শিরিন খাবার সার্ভ করতে করতেই ছেলের মুখের দিকে তাকালেন। দিব্য নির্বিকার মুখাবয়ব করে কোনো ভণিতা ছাড়াই সোজাসুজি স্পষ্ট কণ্ঠে বলল,
-“ মাম্মা আমি নিতিকে বিয়ে করতে চাই।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছেলের এহেন নির্লিপ্ত কথায় শাহারিয়ার সাহেবের কান দু’টো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। আচমকা গলায় খাবার আঁটকে বিষম খেয়ে কাঁশতে থাকলেন। নুরজাহান কেবল একটুকরো রুটি ছিঁ’ড়ে মুখে পুরে ছিলেন। চিবাতে ভুলে বসে; ঘাড় ঘুরিয়ে নাতির দিকে চাইলেন। তামান্নার মেজাজ লহমায় তুঙ্গে উঠল। কপালে গাঢ় ভাঁজ ফেলে অসহ্যকর চাহনিতে তাকায়। শিরিনের কান দুটো অবিশ্বাস্য ঠেকছে। চোখদুটো বিস্ময়ে কোটর ছাড়িয়ে যাওয়ার জো হয়েছে। খাবার মুখে তোলার জন্য নৃত্য কেবল হা করেছিলো; তাজ্জব বনে তার হা যেন তিনগুণ বাড়ে। ঢকঢক করে এক গ্লাস পানি সাবাড় করে নিজেকে স্বাভাবিক করেন শাহারিয়ার মির্জা। রাগান্বিত মুখবিবরে ছেলের দিকে চাইলেন। শাসিয়ে উঠলেন,
-“ দিব্য মাথা ঠিক আছে তোমার? কী বলতে চাইছো তুমি?”
দিব্যর ত্যাড়া জবাব,
-“ কেনো শুনতে পাওনি? কী বললাম শুনোনি?”
শাহারিয়ার মির্জা নড়েচড়ে বসলেন। আওয়াজ চড়িয়ে বললেন,
-“ দিব্য আমি মোটেই তোমার সাথে ফা’জ’লামি করছি না। এতদিন তো বে’য়া’দ’বি করতেই, আজ সকলের সামনে ফা’জ’লা’মি করছো। দিন দিন তোমার অধঃপতন দেখে আমি হতাশ না হয়ে পারছি না।”
-“ পাপা তোমার সাথে আমার ফা’জ’লা’মি করার সম্পর্ক নয়। আমি মোটেই ফা’জ’লা’মি করছি না। যা বলছি ভেবেচিন্তে আর সিরিয়াসলি।”
শাহারিয়ার মির্জা কড়া চোখে তাকিয়ে কিছু বলবেন সেই মূহূর্তে নুরজাহান বেগম চোখ দিয়ে ইশারা করে থামিয়ে দিলেন। নুরজাহান বেগম শান্ত কণ্ঠে শুধালেন,
-“ ছোট দাদুভাই তুমি জানো নিতির বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছে? তা আজ হঠাৎ তোমার এমন বলার কারন কী?”
দিব্য ভ্যাবাচ্যাকা খায়। গা-ধী নিতির উপর মে’জা’জ চ’ড়লো। উত্তরে কী বলবে ভেবে দিশেহারা! কোনো রকমে কয়েকটা শব্দ গুছিয়ে জড়তা নিয়ে বলল,
-“ বিয়ের কথা শুনেই তো এখন বলতে বাধ্য হয়েছি।”
শাহারিয়ার মির্জা রা’গে ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। আঙুল উঁচিয়ে উচ্চস্বরে বললেন,
-“ তোমার লজ্জা করছে না? এখানে বড়রা সবাই আছে তার মধ্যে এভাবে নি’র্ল’জ্জের মতো কথা বলতে। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে। এখন এসে তুমি তামাশার কথা বলছো।”
থেমে স্ত্রীর দিকে রা’গি দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
-“ শিরিন তোমার ছেলেকে বোঝাও। তার না আর ক’দিন পরেই ফ্লাইট। এখন আবার কোন নাটক করতে, সিনক্রিয়েট করতে, এরকম ভং ধরে কথাবার্তা বলছে।”
এরমধ্যে নেওয়াজ সাহেব মুখের থেকে তালা খুললেন। অমায়িক কণ্ঠে বললেন,
-“ ভাইজান আপনি শান্ত হয়ে বসুন। মাথা ঠান্ডা রেখে আগে দিব্যর পুরো কথা শুনুন। ছেলেটা কী বলতে চাইছে আগে শুনি। তারপর ভালো করে জেনেশুনে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।”
তামান্না খেকিয়ে উঠলেন,
-“ আর কী শুনবে, হ্যাঁ? শুনতে পাওনি ও কী বলল? ভালো করে শুনে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কী আছে? আর কীসের সিদ্ধান্ত নিবে? কী বলতে চাইছো তুমি?”
স্ত্রীর একাধিক প্রশ্নবাণে মুখটা ম্লান হলেও নেওয়াজ সাহেব চুপ রইলেন না। ওনার মনে খটকা লাগলো। দুপুরে পাত্রপক্ষের সামনে মেয়েকে কেমন বিষন্ন মলিন লাগছিলো। আর দিব্য যেহেতু এরকম বলছে। কোনো কানেকশন তো নিশ্চয় আছে। চশমাটা ঠেলে ঠিক করে তীক্ষ্ণ চোখে দিব্যর দিকে চাইলেন নেওয়াজ সাহেব। নরম গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
-“ দিব্য বাবা তুমি নিতিকে পছন্দ করো? দ্যাখো বাবা তোমার আরো আগে বলা উচিত ছিলো। একে তো বিয়ের ডেট ফিক্সড করা হয়েছে। আর সর্বোপরি নিতিরও নিজস্ব মতামতের ব্যাপার আছে।”
দিব্যর অসহ্য ঠেকছে। নিতিকে সবার সামনে ছোট করবে না বলে সত্যিটা লুকিয়ে রেখেছে। এখন যে এভাবে নিজেকে সবার চক্ষুশূ’ল হতে হবে তা কস্মিনকালেও ভাবেনি। চোখদুটো বুজে এক নিঃশ্বাসে অধৈর্য স্বরে বলে উঠল দিব্য,
-“ আমরা একে অপরকে পছন্দ করি।”
শিরিন অবিশ্বাস্য চোখে চাইলেন। তামান্না রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
-“ ভাইজান এখনো চুপ করে আছো যে। কিছু বলো। তোমার ছেলেকে বুঝাও। আর এক সপ্তাহ পরেই মেয়ের বিয়ে। এখন এসব বলে-কয়ে বিয়েটা যেনো ভেঙে না দেয়।”
শাহারিয়ার মির্জা হম্বিতম্বি শুরু করলেন। নুরজাহান ছেলেকে শান্ত হতে বললেন। নেওয়াজ সাহেব নৃত্যকে আদেশ স্বরুপ বললেন,
-“ নৃত্য এক্ষুনি গিয়ে আপুকে ডেকে আনো। যাও!”
নৃত্য মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ত্রস্ত পায়ে যায়। তামান্না ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
-“ নিতিকে ডাকার কী দরকার?”
উত্তর দিলেন না নেওয়াজ সাহেব।
নিতি মাথাটা নুইয়ে ওড়নার আস্তিন মুঠো করে ধরে আছে। নিতির বাবা শিরিন সুলতানাকে ইশারায় কিছু বোঝালেন। শিরিন বুঝে নেন। পরপর নিতির পাশে গিয়ে, মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল স্বরে শুধালেন,
-“ নিতি মামণি! ভ’য় পাওয়ার কিচ্ছু নেই। আর লজ্জা না পেয়ে সত্যি করে বলো; তুমি দিব্যকে পছন্দ করো?”
নিতি দৃষ্টি জমিনে নিবন্ধ করে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে। কেনো জানি ভ’য় হচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে আসছে। গলাটা একটু কাঁপলো বোধহয়। জবাবে মাথা উপর-নিচ করে বলল,
-“ হ-হ্যা।”
মাথা নুইয়ে থাকলেও মায়ের অ/গ্নিচক্ষু তার দিকে তাক করানো ঠিক আঁচ করতে পারে নিতি। নেওয়াজ সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“ নিতি মা আমার। তোমার আরো আগে এটা বলা উচিত ছিলো। আমি এক জায়গায় কথা দিয়েছি। তবে যাইহোক আমি এমন বাবা না যে নিজের ইগো, কথা রাখতে; মেয়ের চাওয়া-পাওয়া, মেয়ের খুশির জলাঞ্জলি দিবো।”
নিতির প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। মেয়েদের মন বড় আ’জ’ব বোধহয়! হঠাৎ ওর মনে হচ্ছে নিজের খুশির জন্য, নিজের ভালোবাসার জন্য বাবাকে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলল। নিজেকে স্বা’র্থপর মনে হচ্ছে ওর। নেওয়াজ সাহেব শ্বাশুড়িকে উদ্দেশ্য করে নম্র ভদ্র চিত্তে বললেন,
-“ আম্মা আপনি যেহেতু মুরব্বি। আর এই বাড়ির প্রধান হর্তাকর্তা আপনিই। ভাইজানও আছেন। আমি আমার মতামত জানাতে চাই। আমি বরাবরই আমার মেয়েদেরকে সব বিষয়ে প্রায়োরিটি দিয়ে আসি। আর আমার মনেহয় আমার মেয়েরা উ’চ্ছৃ’ঙ্খল নয়। ওদের মধ্যে যথেষ্ট আদব-কায়দা, লেহাজ আছে।”
থেমে,
-“ একজনকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পছন্দ করা খা’রা:প নয়। সারাটা জীবন যার সাথে কাটাবে নিজের পছন্দ মত হওয়াই ভালো। আমি মেয়ের জন্য একটা জামা কিনতে গিয়েও দু’বার শুনে নেই এটা তোমার পছন্দ হয়েছে তো। আর এতো বিয়ের ব্যাপার। সারাজীবনের ব্যাপার। আমার ভুল হয়েছিলো এ ব্যাপারে আমি সরাসরি মেয়ের সাথে কথা বলিনি। আমি ওর মা’কে দিয়েছিলাম মেয়ের মতামত জানার দায়িত্ব। এটাই আমার সবচেয়ে বড় ভুল ছিলো। যাজ্ঞে এসব বলে এখন লাভ নেই। আপনাদের যদি দ্বিমত না থাকে তাহলে, আমি ওদের জানাশোনাকে প্রায়োরিটি দিতে চাই। আর আমার বন্ধুকে ফোন করে মাফ চেয়ে নিবো। ব্যাপার না, একটু সম্মান ক্ষুন্ন হলেও যদি আমার মেয়ের মুখে হাসি ফুটে; তাহলে আমি তাই করবো।”
শাহারিয়ার মির্জা নিরুত্তর। দ্বিমত-দ্বিধা নেই। তবে তামান্নার মুখ দেখেই অনুমান করা যাচ্ছে সে অসন্তুষ্ট। তামান্না প্রতিবাদ করে উঠলেন,
-“ মাথা খা’রা’প হয়েছে তোমার? এক জায়গায় কথা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ওদের সাথে সাথে তুমিও বাচ্চামি কথাবার্তা বলছো।”
-“ তামান্না এখনো ঘটা করে কাউকে বিয়ের কথা বলা হয়নি।”
নেওয়াজ সাহেব মেয়েদের উদ্দেশ্যে বললেন,
-“ নিতি-নৃত্য তোমরা রুমে যাও।”
নিতির তীব্র অনুশোচনা হতে লাগলো। এখন মাম্মা রু’ড আচরণ করবে। পরিবেশ উত্তপ্ত করবে। ফুপির কথাবার্তা শুনে দিব্যর মেজাজ চ’ড়ে যায়। বে’য়া’দবি করে ফেলার তুমুল সম্ভাবনা; তাই আর দেরি না করে গটগট পা ফেলে প্রস্থান করে দিব্য। পরপর নিতি-নৃত্য রুমের দিকে পা বাড়ায়। তামান্না চেঁচামেচি শুরু করলেন,
-“ নিতি ছোট এটা ওর আবেগের বয়স। ওর সাথে সাথে আমরা অবুঝ হতে পারি না। এই সিদ্ধান্ত আমি মানি না। মেয়েকে আমি ওখানেই বিয়ে দিতে চাই।”
নুরজাহান বেগম গম্ভীর মুখে বললেন,
-“ আহ্! তামান্না। বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। চুপ কর এবার।”
শাহারিয়ার মির্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উপরে চলে গেলেন। শিরিনও পিছুপিছু গেলেন। ননদের উপর রাগও হলো বটে। নিজের ছেলের সাথে বিয়ে না দিতে চাওয়ার এই কথাবার্তা শুনে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে মন চাইলেও; কিছু ভেবে কথাগুলো কণ্ঠনালী অবধি আসতেই গিলে নেন। ভাই-ভাবী যাওয়ার পর তামান্না স্বামীর উপর বেশি তেতে উঠলেন। রাগে গজগজ করতে করতে বললেন,
-“ আমি কিচ্ছুতেই নিতিকে দিব্যর সাথে বিয়ে দিবো না। দরকার পড়লে আমি এই বাড়ি থেকে চলে যাবো। তাও মেয়েকে এখানে বিয়ে দিবো না। নিজের ভাইয়ের ছেলে হলেও, আমার আদরের মেয়েকে একটা ব’দমে’জা’জি, রা’গি, জেদি ছেলের সাথে দিতে পারবো না। এছাড়াও__”
নুরজাহান ধ’ম’ক দিয়ে উঠলেন,
-“ তামান্না রুমে যা। এখনো সময় আছে ঠান্ডা মাথায় ভেবে দ্যাখ।”
দিব্য লাগাতার কল লিস্টে উপরে থাকা নম্বরে কল দিয়ে যাচ্ছে। সেই অনেকক্ষণ আগে থেকেই কল দিচ্ছে, কিন্তু রিং হয়ে হয়ে কে’টে যাচ্ছে। দিব্য দাঁতে দাঁত চেপে শেষ বারের মত কল দেয়। এবার রিসিভ না হলে সোজা বাইক নিয়ে চলে যাবে। গিয়ে ফোন রিসিভ না করার শা’স্তি স্বরুপ পৌষ মাসের হাড়কাঁপানো শীতের রাতে এক ঘন্টা ডুবায় চুবিয়ে রাখবে। ওপাশের ব্যক্তির ভাগ্য সহায় হলো। তাই তো কনকনে শীতে ডুবায় থাকার পানিশমেন্ট পেতে হলো না। ফোন তুলল। দিব্য দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
-“ ফোন তুলছিস না কেনো? সেই তখন থেকে লাগাতার কল দিয়ে যাচ্ছি।”
ওপাশ থেকে ভিতুসন্ত্রস্ত স্বর আসলো,
-“ হ-হঠাৎ তোর কল দেখে ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। তুই হঠাৎ! না মানে।”
-“ শোন, আমি যা যা বলব মন দিয়ে শুনবি। আর ঠিকঠাক পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে সেটাই করবি।”
ওপাশ থেকে কাঁপাকাঁপা স্বর আসে,
-“ ক-কী করতে হবে?”
-“____________। ক্লিয়ার?”
-“ অসম্ভব। এখনই তো আমার নার্ভাস লাগছে। ভ’য় হচ্ছে। লাগানো তিনটে দাঁত ওর থা/প্প/ড়ে খুলে না যায়। সব শুনে তোর মতো ও যদি আবার..”
-“ ও আমার মতো নয়। আমার থেকে ওর ধৈর্য্য বেশি। ও সহজেই স্টিম পয়েন্টে যায় না। আর যদি রাগের বশে দু চারটে চ-ড়, ঘু-ষি দেয়ও এটা তোর কৃতকর্মের ফল। আমি যেভাবে যেভাবে যা যা বললাম তাই তাইই বলবি। তা না হলে এবার তোকে আর তৃষাকে একসাথে শ্বশুরবাড়ি পাঠাবো। এই শ্বশুর বাড়িতে কিন্তু __থেরাপি হয়। বুঝতে পারছিস এবার?”
ওপাশ থেকে সুড়সুড় করে সোজা উত্তর আসলো,
-“ আচ্ছা। আচ্ছা ভাই, ঠিক আছে। যেমনটা বলেছিস, ঠিক তেমনই বলবো।”
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই টুটটুট করে কল কে’টে দেয় দিব্য। তারপর আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে বলে,
-“ তৃষা…সেদিন ছেড়ে দেওয়া ভুল হয়েছিলো। এবার দ্বিগুন মাশুল গুনতে রেডি থেকো। একেবারে বকেয়ার সাথে বোনাসসহ পাবে।”
রাত গভীর। পুরো বাড়ি নিস্তব্ধ গুমোট। ইভান সবেমাত্র ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে বিছানায় বসে। তনুজা ঘুমে বিভোর। তনুজার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রীতে নিষ্পলক চাউনিতে চেয়ে চেয়ে দেখে ইভান। মুখের উপর থাকা অবাধ্য বেবি হেয়ার আলতো হাতে সরিয়ে দেয় ইভান। হঠাৎ ইভানের দৃষ্টি তনুজার হাতে পড়তেই বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে। তনুজার হাতের পো-ড়া দেখে কষ্ট অনুভব হয়। ইভান তড়িৎ গতিতে ফাস্ট এইড বক্স থেকে কাংখিত অয়েন্টমেন্ট হাতে নেয়। যত্ন সহকারে আলগোছে তনুজার হাতে লাগিয়ে দেয়। ইভানের অবচেতন মন ভাবে,
-“ না চাইতেও তোমাকে বোধহয় খুব বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছি। সরি!”
ইভানের স্পর্শে ঘুমের মধ্যে তনুজা নড়েচড়ে। ঘুমের ঘোরেও চোখের ঘনপল্লব নড়ল, সাথে একটু আলগা হয়। পরপর চোখদুটো বুঁজে যায়। মনে হচ্ছে আবেশে, স্পর্শে ঘুমটা আরো গভীর হলো। তনুজার কোমড়ে থাকা কমফোর্টার গলা অবধি টেনে দেয় ইভান। সুন্দর করে কমফোর্টার জড়িয়ে দিয়ে তনুজার মুখের দিকে ঝুঁকে অস্ফুটে আওড়ায়,
-“ এক নীরব কষ্ট অনুশোচনা আমার ভেতরটা জ্বা’লি’য়ে-পু’ড়িয়ে দিচ্ছে! অথচ আমি কারো কাছে কষ্টটা প্রকাশ করতে পারছি না। আ’ম সো সরি তনুজা। নিজের মনকে বোঝাতে আমার একটু সময় প্রয়োজন।”
সকালে বাড়িতে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে। বেলা হতে চললো, তবুও সবাই রুমেই। বুয়ার থেকে কাল রাতের ঘটনা সবটা শুনেছে। কাল সারাদিন শরীরের উপর বেশ প্রেশার পড়ায় খুব ক্লান্ত ছিলো। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিলো ডিনার না করেই।
তনুজার আজ সকাল সকাল বাড়ি যাওয়ার কথা। কালকেই দিদুন পারমিশন দিয়েছিলো। তনুজা রেডি হয়ে রুম থেকে বেরুনোর সময় ব্যালকনির দোরগোড়ায় দাঁড়ায়। ইভান দুই হাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে উদাসীন হয়ে দাঁড়িয়ে। তনুজার কথায় সম্বিত ফিরে ঘুরে তাকায়।
-“ আসছি।”
তনুজা সৌজন্যমূলক বলে। ইভান গম্ভীর স্বরে বলল,
-“ বেড টেবিলের উপর দ্যাখো অয়েন্টমেন্ট আর মেডিসিন রাখা আছে। অয়েন্টমেন্টটা দিনে দু থেকে তিনবার হাতে ইউস করবে। আর মেডিসিন…খাবে।”
তনুজা হতবাক হয়। কখন দেখলো? তনুজার ভাবনার চরকায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে ইভান ফের বলল,
-“ একটু কেয়ারফুলি চলো। টেইক কেয়ার।”
তনুজার চোখদুটো ছলছল করে ওঠে। চোখের জল আড়াল করতে, নিজের কষ্ট লুকাতে তড়িৎ উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়ায়। মিহি স্বরে বলল,
-“ আসছি, ভালো থাকবেন।”
দিদুনকে বলে তনুজা গাড়ির কাছে যেতেই ড্রাইভার দরজা খুলে দেয়। গাড়িতে পা দেওয়ার আগে তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা তুলে দোতলার ব্যালকনিতে চায়। তনুজাকে মাথা ঘুরাতে দেখে ইভান উল্টোদিক পিঠ করে ঘুরে দাঁড়ায়। তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অবচেতন মন বলে,
-“ সয্য করতে করতে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেছি। তারপরও মনকে বোঝাই, আজ নয়তো কাল সবটা ঠিক হয়ে যাবে। তবে আমি বোধহয় ভুল। এখন আমি বুঝতে পারছি। আমি আপনার কাছে অতটাও গুরুত্বপূর্ণ নই। যতটা আমি ভেবেছিলাম।”
অফিসে বসে ফাইলে নজর বুলাতে বুলাতে হাতঘড়িতে সময় দেখে ইভান। পরপর ফোন হাতে নিয়ে কল করে। রিসিভ হতেই ওপাশ থেকে বড় করে সালাম আসলো,
-“ আসসালামুয়ালাইকুম স্যার।”
ইভান উত্তর দিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলো,
-“ ম্যাডামকে ঠিকঠাক বাসায় পৌঁছে দিয়েছেন?”
বয়স্ক ড্রাইভার অপ্রস্তুত হয়। আমতা আমতা করে বলল,
-“ জ-জি স্যার। ম্যাডাম এতক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে।”
ইভানের কপালে ভাঁজ পড়ল। পরপর গলার স্বর চড়িয়ে বলল,
প্রণয়ের বাঁধন পর্ব ২৪
-“ হোয়াট রা’বিশ! পৌঁছে গিয়েছে মানে? আপনি তনুজাকে বাসায় ড্রপ করে দিয়ে আসেননি?”
-“ জ্বি-না, জ্বি জ্বি স্যার! ম্যাডাম সহিসালামতে বাসায় গিয়েছেন।”
ইভান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। খট করে কল কে’টে কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে। তবে কাজে মন বসছে না আজ। মনটা আনচান করছে।