প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৭
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকার কিডন্যাপ হওয়ার আসল ঘটনা সারহান সকলের সামনে খোলাসা করেছে আজ। যা জেনে বাড়ির প্রতিটি সদস্য হতবাক হয়ে গেছেন।তারা ভাবতেও পারেনি নিশাদ এমন একটা ঘৃ ণ্য কাজের সাথে জড়িত।সারহান কিভাবে অরিত্রিকাকে উদ্ধার করেছে তাও বলেছে নিজ মুখে।সারহান হোটেলে প্রবেশ করার আগেই পুলিশকে কল করে কিড ন্যাপের বিষয়টা জানায়।
সারহান হোটেলে প্রবেশ করার কিছুক্ষণ পরেই হাজির হয় পুলিশ। অরিত্রিকাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বাহিরে থাকা নিশাদের লোকজনকে এরেস্ট করে। সারহান একমুহূর্ত দেরি না করে নিশাদের একজন লোককে শিখিয়ে নিয়ে যায় কাজি এসেছে এটা বলার জন্য।সেই প্ল্যানমাফিক কাজ ও হয়। দরজা খুলতেই সারহানের আক্রমণের শিকার হয় নিশাদ। পুলিশ পরে এসে নিশাদকে আধম রা অবস্থায় উদ্ধার করে হসপিটালে নিয়ে যায়।সাথে মিহিও যায়। এখন বর্তমানে নিশাদ জেলে আছে। তার নামে থানায় অপ হরণের কেস করা হয়েছে।
সারহান ভীষণ ক্লান্ত। বন্ধুমহল আর ভাই বোনদের কোনো মতে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে সে ছুটেছে নিজ রুমে। গত রাত হতে আজ রাত পর্যন্ত দৌড়োদৌড়ি, টেনশন মিলিয়ে তার অবস্থা বেগতিক।ক্লান্ত শরীরে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করলো। দরজা আঁটকে পাঞ্জাবি খুলে ডিভানে ছুড়ে দিলো। শরীর মেজমেজ করছে। কেমন অসহ্য লাগছে। গোসল করলে হয়তো শান্তি লাগবে,ফ্রেশ লাগবে। সারহান আলমারি হতে টাউজার বের করে তাওয়ালে হাতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরিত্রিকা সারহানের বেলকনিতে এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে বাহিরের পরিবেশ দেখছিলো। মন আজ অনেকটা শান্ত ন্যায়। আজ তার শখের পুরুষের সাথে বিয়ে হয়েছে ভাবতেই রঙিন প্রজাপতি আকাশে উড়ছে। ইস, মানুষটা যে তার একান্তই নিজের। অরিত্রিকা বেলকনি হতে রুমে প্রবেশ করলো। চোখ বুলিয়ে দেখলো সারহান এসেছে কি না? ডিভানে পাঞ্জাবি রাখা দেখে বুঝলো মহাশয় মাত্রই রুমে এসেছেন। ওয়াশরুম হতে ঝর্ণা থেকে পরা পানির আওয়াজ ভেসে আসছে। সে বুঝলো সারহান ভাই ওয়াশরুমে। অরিত্রিকা ধীর পায়ে এগিয়ে বিছানার এককোণে বসলো। আশে পাশে তাকিয়ে রুমটা পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। ভাবতেই পারছে না আজ থেকে এটা তার ও রুম। তবুও অস্বস্তি হচ্ছে।
সারহান গোসল সেরে বের হয়েছে।তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে এগিয়ে আসতেই চোখ পরলো অরিত্রিকার দিকে। হালকা গোলাপী রঙের শাড়ি পরে আছে অরিত্রিকা।শাড়িতে গোল্ডেন সুতোর হালকা কাজ। গহনা বলতে কানে, হাতে, গলায় সোনার হালকা কাজের গহনা। মুখে কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া নেই। এমন সাধারণ রুপে দেখেই সারহান মুগ্ধ হলো। মেয়েটাকে আজ বড় লাগছে তার কাছে। শাড়ি পরলে কি মেয়েরা বড় হয়ে যায়?মনের নিজের অনুভূতিকে দমিয়ে রেখে স্বাভাবিক ভাবে চলা খুবই মুশকিল।যার জন্য এতোগুলো দিন প্রণয়ানুভূতি গোপনে আগলে রেখে সে আজ তার রাজ্যের রাণী। অরিত্রিকা তার অর্ধাঙ্গিনী ভাবতেই বুকের মাঝে স্নিগ্ধ হাওয়া বয়ে গেলো।
সারহান তোয়ালে হাতেই এগিয়ে গেলো অরিত্রিকার দিকে। অরিত্রিকা চোখ তুলে সামনে তাকাতেই দেখতে পেলো সারহানকে। তাকাতেই সারহানকে উন্মুক্ত শরীরে দেখে লজ্জায় হাসফাস করতে লাগলো।সারহান তা দেখে মৃদু হেসে আলমারি হতে টি শার্ট বের করে পরে নিলো।
সারহান অরিত্রিকার সামনে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠলো~ এভাবে দেখার অভ্যাস করে নে। এখন থেকে প্রতিদিনই এমন দৃশ্য দেখতে হবে।
অরিত্রিকা লজ্জায় নেতিয়ে পরলো।মন বলছে মাটি ফাঁক করে ঢুকে যেতে। সে এক দৃষ্টিতে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। সারহান তা দেখে ড্রেসিং টেবিলের কাছে গিয়ে এলোমেলো চুল আঁচড়াতে লাগলো।আয়নার ভেতরে অরিত্রিকার প্রতিবিম্ব স্পষ্ট দৃশ্যমান। লজ্জায় মুখ তুলছে না।
সারহান অরিত্রিকাকে জিজ্ঞেস করলো~ তুই এখানে কেনো? অরিন বললো রিসেপশনের আগে তুই তোর রুমে থাকবি আর আমি আমার রুমে। আগে যেমন ভাবে থাকতাম তেমন ভাবে। এটাই নাকি কেউ একজন অরিনকে দিয়ে আমার কানে দিতে বলেছে?
অরিত্রিকা সংকোচ নিয়ে সারহানের দিকে তাকালো। কীভাবে বলবে দুজন দুই রুমে থাকবে যতোদিন অনুষ্ঠান না করা হয় ততোদিন।
অরিত্রিকা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে বললো~ আমি এসব বিষয়ে কিছু জানি না।
সারহান তা শুনে প্রতিত্তোর করলো~ আমি জানি। এটা নিশ্চয়ই আমার শ্বশুর মশাইয়ের বুদ্ধি। বাবার হুকুম না শুনে আমার রুমে আসার সাহস কিভাবে হলো?
অরিত্রিকা নিচু স্বরে বললো~ বড় মা আর মা বলেছে আজ থেকে আপনার রুমে থাকতে তাই।
সারহান চিরুনি রেখে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বারোটা বাজে। সে বললো~অনেক রাত হয়েছে। গত রাত থেকে অনেক কিছু ফেস করেছিস। এবার ঘুমিয়ে পর।
অরিত্রিকা একটু চমকালো বোধহয়।আজ রাতে এমন কিছু আশা করেনি সে।সারহানের আগের ন্যায় ব্যবহার দেখে অবাক হওয়ার কথা।তবুও উৎকন্ঠা চেপে বিছানার একপাশে শুয়ে পরলো।
সারহান একপলক দেখে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো~ শাড়ি পরে অসুবিধা হবে ঘুমাতে। যেটায় কম্ফোর্ট ফিল করিস সেটা পরে আয়।
অরিত্রিকা মিনমিনে কন্ঠে বললো~ নাহ আমার অসুবিধা হবে না।
সারহান কথা বাড়ালো না। সে লাইট অফ করে বিছানার অন্য পাশে শুয়ে পরলো। অরিত্রিকা অস্বস্তি নিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে। কেমন অদ্ভুত লাগছে।শরীর ক্লান্ত থাকলেও ঘুম আসছে না। অদ্ভুত ভাবনা ঘিরে ধরেছে।বিছানা বদল হওয়ায় শান্তি পাচ্ছে না। একটু পর পর নড়ছে।সারহান অন্ধকারে অরিত্রিকার দিকে তাকালো।সে বুঝলো হয়তো অরিত্রিকার কোনো সমস্যা হচ্ছে।
সারহান ভ্রু কুঁচকে বললো~ নড়ছিস কেনো?কোনো সমস্যা?
অরিত্রিকা নড়া বন্ধ অস্বস্তি নিয়ে বললো~ নাহহ।
কিছুটা সময় কেটে গেলেও দুজনের চোখে ঘুম নেই। সারহান এক হাত কপালে রেখে গভীর চিন্তা করছে। সে জানে অরিত্রিকা ঘুমায় নি। হঠাৎ করে বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে দুজন।একে অপরকে জানার জন্য সময় প্রয়োজন। অরিত্রিকা তার থেকে আট বছরের ছোট। এখনো চঞ্চল, বাচ্চামী করে। তার সাথে মানিয়ে নিতে একটু বেগ পোহাতে হবে। কারণ দুজনে দু মেরুর বাসিন্দা।
সারহান নিরবতা ভেঙ্গে শান্ত কন্ঠে বললো~ ঘুমাসনি কেনো?
অরিত্রিকা চমকে সারহানের পাশে ঘুরলো। এখনো তারমানে সারহান ভাই ঘুমায়নি।
অরিত্রিকা বললো~ঘুম আসছে না। তাই তো ঘুমাইনি।আপনি এখনো জেগে কেনো আছেন সারহান ভাই?
সারহান ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। হাসবেন্ডকে কে ভাই ডাকে? পোড়া কপাল তার।সবার সামনে ডাকলে সম্মান শেষ।
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বললো ~ আমি তোর কি হই?
অরিত্রিকা জিভ কাটলো।সে বললো~ ভুলে গেছিলাম তাই ভুলে বলে ফেলেছি।
~ তোর হাত দে এইদিকে।
অরিত্রিকা কিছু না বুঝে হাত বাড়িয়ে দিলো অন্ধকারে। সারহান অরিত্রিকার হাত ধরে টান দিলো।অরিত্রিকা হঠাৎ টান দেওয়াতে সারহানের কাছে এগিয়ে গেলো
সারহান অরিত্রিকাকে জরিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো~ এবার ঘুমিয়ে পর।
অরিত্রিকার যেনো হার্টবিট দ্রুত গতিতে লাফাচ্ছে।সে লজ্জায় চুপ করে সারহানের হাতের বাঁধনে পরে রইল।
আজ ভোরে সারহানের বন্ধুমহল ঢাকায় রওনা দিয়েছে। মুন আর ইফাতের বিয়ের জন্য সকলকে ইনভাইট করেছে। পৃহালের মুড অফ ছিলো। কারণটা সম্পর্কে অবগত নয় সে। যাওয়ার সময় পিছু ফিরে বারবার ইশরার দিকে তাকিয়েছে। ইশরা সাধারণ দৃষ্টিতে তাকালেই পৃহালের দৃষ্টিতে ছিলো আকুলতা। হয়তো কাউকে হঠাৎ ভালো লেগেছে কিন্তু কোনো কারণে তা অপ্রকাশিত রয়ে যায়। মুখ ফুটে বলার সাহস থাকে না। তবে কি সে ভালোবেসেছিলো ইশরাকে? এই ভাবনা নিয়েই বিদায় নিয়েছিলো সে।
অরিত্রিকা আজও শাড়ি পরেছে। সারহান শাড়ি পরতে নিষেধ করেছিলো তবুও জেদ করে পরেছে নিজে নিজে। নিজেকে পরিপাটি করে নিচে নেমেছে। আসার আগে বেশ কয়েকবার নিজেকে বেশ কয়েকবার দেখে নিয়েছে। মন্দ লাগেনি তাকে।
খাবার টেবিলে সকলেই উপস্থিত। তানিয়া বেগম সাথী বেগম খাবার পরিবেশন করছেন। অরিন তার হাসবেন্ডকে আপ্যায়ন করতে ব্যস্ত। অরিত্রিকা সবার দিকে একবার তাকালো। কেমন লজ্জা লাগছে তার। লজ্জা আড়াল করে সারহানের পাশে ধপ করে বসে পরলো। সারহান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো।
আরশাদ সাহেব আজ বেশ খুশি। ঝামেলা ছাড়াই বিয়ে সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে একটা খটকা আছে তার মনে। এতো সহজে রাজি কেনো হলো?
আরশাদ সাহেব আজমল সাহেবকে বললেন~ মেয়ের বিয়েতে সহজে রাজি হয়ে গেলে কারণটা কি? আমি তো ভেবেছিলাম ঝামেলা করবে অনেক।
সকলেই উৎসুক জনতার ন্যায় তাকালো আরশাদ সাহেবের দিকে। কি উত্তর দেয় তা শুনতে সবাই আগ্রহী।
আজমল সাহেব হেসে বললেন~ যোগ্য পাত্র পেলে কোনো বাবা হাতছাড়া করে না। তার ওপর মেয়েরও পছন্দ আছে। বিয়েতেও মত দিয়েছে সেখানে বাবা হিসেবে মেয়ের মতকে প্রাধান্য দিয়েছি।
আরশাদ সাহেব ভাব নিয়ে বললেন~ ছেলে কার দেখতে হবে না?আমার ছেলে বলে কথা যোগ্য তো হবেই।
আরশাদ সাহেবের কথা শুনে একযোগে হেসে দিলো অরিত্রিকা কিছুটা লজ্জা পেলো।সারহান তো অরিত্রিকার স্নিগ্ধ হাসি দেখে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে।
অরিত্রিকা নিচতলা হতে রুমে ঢুকতেই দেখলো সারহান কোথাও যাওয়ার জন্য বের হচ্ছে।সে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে বিছানায় বসলো।অরিত্রিকা সামনে দন্ডায়মান শ্যাম পুরুষের কাজ দেখতে ব্যস্ত। মানুষটার সকল কাজই তার কাছে পারফেক্ট লাগে। সারহান আয়নার সামনে পারফিউম ইউজ করছে।
সারহান আয়নার দিকে খেয়াল করে অরিত্রিকাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কপাল কুঁচকে বললো~ কি দেখছিস?
অরিত্রিকা মৃদু হাসলো। হাসি বজায় রেখে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো ~ আমার কল্প পুরুষকে।
সারহান পেছনে ফিরে তাকিয়ে বললো~ দেখা শেষ হয়নি এখনো?
অরিত্রিকা হেসেই বললো~ উহু।আপনার দিকে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকলেও আমার দেখা শেষ হবে না।
সারহান শার্টের হাতা গুটিয়ে বললো ~ এই দিকে আয়।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৬
অরিত্রিকা উঠে সারহানের কাছে গেলো। সারহান অরিত্রিকাকে নিজের কাছে টেনে হীম শীতল কন্ঠে বললো~ আমার সাদা কালো জীবন রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য তোরই প্রয়োজন ছিলো। এবার বুঝেছি তোর মতো পিচ্চি মানুষের ভালোবাসার অভাবে যন্ত্র মানব হয়ে যাচ্ছিলাম।এখন তুই আমার জীবনে এসেছিস এবার তোর স্নিগ্ধ পরশে প্রেমিক পুরুষ হয়ে উঠবো।