প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৮
আদ্রিতা নিশি
বিকেলের গোধূলি লগ্ন। শীতল পরিবেশ।মৃদু বাতাস বইছে।আকাশেও মেঘের দেখা নেই।সাদা তুলোর ন্যায় মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। মনোমুগ্ধকর পরিবেশ। প্রকৃতিও নিত্যনতুন ভাবে তার নিজ সাজে সেজে উঠেছে।
অরিত্রিকা ছাদে কার্পেট বিছিয়ে বিকেল বিলাস করছে। আজ মনটাও ভীষণ ফুরফুরে।মন মেজাজ দুটোই ভালো।প্রণয়ের রঙিন প্রজাপতিরা তার মনের কুঠুরিতে উড়ে চলেছে।তার সাথে ছাদে উপস্থিত আছে সাদাত, অরিন, তিশা আর ইশরা। সকলেই সরু চোখে তাকিয়ে আছে অরিত্রিকার দিকে। অরিত্রিকার এইদিকে কোনো খেয়াল নেই সে তো খুশি মনে বিকেলের আবহাওয়া অনুভব করতে ব্যস্ত।
তিশার মুখ গম্ভীর। সে অরিত্রিকার ওপর রেগে আছে। কারণটা সারহানকে মানে তার ক্রাশকে চোখের সামনে দিয়ে বিয়ে করে নিলো অথচ সে খবর পর্যন্ত পেলো না। তাকে একবারও কল করে জানালো না। এতোটাই পর হয়ে গেলো সে।ভাবতেই কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো তিশা।
তিশা কাঁদো কাঁদো হয়ে নিরবতা ভেঙ্গে বলে উঠলো~ অরিত্রি রে তুই আমায় পর করে দিলি রে। বিয়ে করে বসে আছিস আমায় একবারও জানালি না। আমি কি তোর এতোই পর হয়ে গেলাম। আর কাউকে পেলিনা? খুঁজে খুঁজে আমার ক্রাশকেই বিয়ে করে নিলি?
সকলেই তিশার দিকে তাকালো।
অরিত্রিকা তিশার দিকে তাকিয়ে অনুতপ্ত হয়ে বললো~ সরি রে। আসলে হঠাৎ কিভাবে বিয়েটা হয়ে গেলো বুঝতে পারলাম না। টেনশনে ছিলাম তাই তোকে বলতে ভুলে গেছি। এটার জন্য আমি গিল্টি ফিল করছি।
তিশা মুখ গোমড়া করে বললো~আচ্ছা হয়েছে। তোর বিয়ে হয়েছে এটাতে খুশি হওয়ার থাকলেও খুশি হতে পারলাম না। আমার ক্রাশকে বিয়ে করে নিলি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অরিত্রিকা চোখ ছোট ছোট করে বললো~ তোর
ক্রাশ এখন আমার হাসবেন্ড। তাই কাকের মতো ক্রাশ ক্রাশ না করে দুলাভাই ডাকার অভ্যাস কর।
তিশা বললো~ বয়েই গেছে যা।ক্রাশ তো ক্রাশ থাকে।
সাদাত তখনই বলে উঠলো~ তিশা আমারও একটা সমস্যা আছে।
তিশা আগ্রহ নিয়ে বললো ~ কি?
সাদাত হতাশা নিয়ে বললো~আমি তো দুইদিন আগে হতে অরিত্রিকাকে ভাবি ডাকার প্রেকটিস শুরু করে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়েতে যেহেতু দেরি আছে এর মধ্যে ভাবি ডাক টায় অভ্যাস করে নেবো। কিন্তু কপাল তার আগেই চাচাতো বোন ভাবি হয়ে গেলো।
সাদাতের কথা শুনে তিনজনই হেসে দিলো।
অরিত্রিকা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাদাতকে বললো~ দুই দিন আগে মানে? কাহিনী কি বল।
সাদাত ভড়কে গেলো। ভুল কথা বলে ফেলায় জিভ কাটলো। অরিন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সাদাতের দিকে।এবার সে কি করবে?
অরিন বলে উঠলো~ তারমানে সারহান ভাই যে অরিত্রিকাকে বিয়ে করবে আগে থেকে জানতিস?
সাদাত তো একবারে ফেঁসে গেছে।একদম মাইনকার চিপায় পরেছে।
সাদাত তুতলিয়ে বললো~ আমি কিছু জানি না।
অরিত্রিকা আর অরিন দুজনেই একসাথে বলে উঠলো~ বলবি? নাকি আমরা তিনজন মিলে তোকে ভর্তা বানাবো?
সাদাত কিছুটা ভয় পেয়ে গেলো।এই তিনজন তাকে মারতে লাগলে সে ভর্তা হয়ে যাবে। সে বললো~ আরে আরে বলছি। হাইপার হওয়ার কিছু নেই।
সাদাত গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললো~ আসলে দুইদিন আগে ভাই তোকে বিয়ে করবে এমন কথা বাবাকে বলেছিলো।এর থেকে আমি বেশী কিছু জানিনা বইন।
সাদাত কোনো মতে কথা লুকিয়ে বাচলো।সে তো অনেককিছু জানে। সব বলে দিয়ে তার ভাই আর আস্ত রাখবে না। সাদাতের কথা শুনে অবাক হলেও ভাবনায় কিছুটা পিষ্ঠ হলো মস্তিষ্ক। তাহলে কি অরিত্রিকাকে সারহান আগে থেকে ভালোবাসতো?অরিত্রিকার মাথায়ও একই প্রশ্ন ঘুরছে আজ সে সারহানকে জিজ্ঞেস করবে তাকে কেনো বিয়ে করেছে? ভালোবাসে নাকি অন্যকিছু?
অরিত্রিকার ফোন বেজে চলেছে। হোয়াটসঅ্যাপ এ কেউ কল করেছে। অরিত্রিকার ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন হাতে নিলো। ইফা কল করেছে। তা দেখে কিছুটা ভাবুক হলো।
অরিত্রিকাকে কল রিসিভ করতে না দেখে অরিন বললো~ কল রিসিভ কেনো করছিস না?
অরিত্রিকা মলিন স্বরে বললো~ ইফা আপু কল করেছে।
অরিন বললো ~ ভিডিও কল করেছে। কল রিসিভ কর। ওর সাথে কতোদিন কথা হয়নি।
অরিত্রিকা কল রিসিভ করতেই ভেসে এলো ইফার কন্ঠ।
~ আরে অরিত্রিকা কেমন আছিস?
ইফার হাস্যজ্জ্বল চেহারা।
অরিত্রিকার হেসে বললো~ আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তুমি কেমন আছো আপু?
~ আমিও ভালো আছি। আশেপাশে তো আরও কয়েকজন আছে। তোমরা সবাই কেমন আছো?
সকলেই ইফার উত্তর দিয়ে খোঁজ খবর নিতে লাগলো।ইফা হেসে সবার সাথে কথা বলছে।অরিত্রিকার অস্বস্তি লাগছে।ইফা যদি জানে তার বিয়ে সারহান ভাইয়ের সাথে হয়েছে তাহলে কি রিয়েক্ট করবে?
ইফা তখনি বলে উঠলো~ শুনলাম অরির নাকি আকদ হলো গতকাল? অরি নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা রইল।
অরিত্রিকা চমকে উঠলো। বললো~ ধন্যবাদ আপু। তুমি কিভাবে জানলে?
~ফুপি রাতে কল দিয়েছিলো। বললো তোর বিয়ের কথা। বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই রইলি।আমি তোর বড় হয়েও এখনো সিঙ্গেল।
অরিত্রিকা শুধু হাসলো।
ইফা বললো~ সারাজীবন সুখে থাক ভালো থাক এটাই চাই। আচ্ছা আমি রাখছি। একটু বাহিরে যেতে হবে রাখছি।
~ঠিক আছে আপু।
ইফা কল কেটে দিলো। অরিত্রিকা ফোনের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। ইফার হাস্যজ্জ্বল চেহারা দেখেও মনের মাঝে খুঁত খুঁত লাগছে। ইফা কি আসলেই খুশি সারহান ভাইয়ের বিয়ে হওয়াতে? এসব ভেবে লাভ নেই আর।
ইশরা সবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো~ একটা কথা বলবো। কেউ কিছু মনে করবে না তো?
অরিত্রিকা বিরক্তি নিয়ে বললো ~ কিছু না ভেবে বলে ফেল তো।
ইশরা একপলক সকলের দিকে তাকালো। সকলে কেমন উৎসুক জনতার ন্যায় তাকিয়ে আছে।
ইশরা অস্বস্তি নিয়ে বললো~ আমার মনে হয় পৃহাল ভাইয়া হয়তো আমায় পছন্দ করে।
সকলে বিস্মিত হয়ে রইল। অরিত্রিকা কিছু বলবে তার আগেই ইশরা বলে উঠলো আবারও।
~ আমি এমনি এমনি বলছি না। মুন আপু আর রাই আপু দুজনে রাতে কথা বলছিলো। আমি তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় শুনলাম পৃহাল ভাইয়া নাকি আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো তোর আকদের পুরোটা সময়ে। তারা বলছিলো আমায় হয়তো পছন্দ করে। আজ যাওয়ার সময়েও খেয়াল করেছি। ওনার চাহনি অন্যরকম আকুলতা দেখেছি। এখন আমারও মনে হচ্ছে উনি হয়তো আমায় পছন্দ করেন।
অরিত্রিকা বিস্ময় নিয়েই বলে উঠলো~ বলিস কি?
সাদাত বললে~ আমিও খেয়াল করেছিলাম কাল।তোর দিকেই তাকিয়ে ছিলো ইশরা।
অরিন ভাবুক স্বরে বললো~ এখন কি হবে? এই শোন এসব ভাবিস না। পছন্দ করে ভালো কথা। বিয়ে তো করতে চায় না।উনি চলে গেছে ভালো হয়েছে।
তিশা অসহায় হয়ে বসে আছে। বসে বসে সকলের কথা শুনছে।
অরিত্রিকা তর্জনী উঁচু করে বললো~ তুই আবার পছন্দ করিস না তো ইশু?
ইশরা ঘাবড়ে গিয়ে বললো~ আরে তেমন কিছু না। আমি তো তোদের এমনই বললাম।
~ তাও ভালো।
————————-
রাত দশটা বাজে। সারহান একটু আগেই পার্টি অফিস হতে ফিরেছে।সামনে ইলেকশন তার বন্দবস্ত হচ্ছে।আজ মিটিং ছিলো দলের লোকের সাথে। ভাবতেই অবাক লাগে তার এমপি তো সে হতে চায় নি। কিন্তু ভাগ্য তাকে এখানে নিয়ে এসেছে। এমপি মহোদয়ের মৃ ত্যুর পরে তাদের দল হতে একজনকে এই পদে দাঁড়ানোর কথা বলা হয়। সকলেই সারহানকে দাঁড়াতে বলে। সারহানের ইচ্ছা না থাকলেও দলের আর মানুষের জন্য এমপি পদে দাঁড়িয়েছে সে। দুইদিন পরে বিরাট জনসভা আছে। তাকে জনগণের সামনে ভাষণ দিতে হবে। সেটা নিয়েই আজ মিটিং ছিলো। আজ সারাদিন এসব ব্যস্ততায় গিয়েছে। শরীর বড্ড ক্লান্ত তার।
সারহান ক্লান্ত শরীরে রুমে প্রবেশ করলো। চোখ বুলিয়ে নিলো। চোখদুটো অরিত্রিকাকে খুঁজছে। আশাহত হলো সে। অরিত্রিকা নেই রুমে। শার্ট খুলে রেখে ফ্রেশ হওয়ার জন্য যাবতীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করলো সে।
অরিত্রিকা দুই হাতে কফির মগ নিয়ে রুমে আসলো মাত্র। নিচ থেকে উপরে আসতেই তার অবস্থা নাজেহাল। শাড়ি পরে আসতে অনেকবার শাড়িতে পা বেঁধে পরে যাচ্ছিলো।লম্বা শ্বাস নিয়ে বেলকনিতে গেলো সে। অরিত্রিকা বসে পরলো কার্পেটে।কফির মগ্ন দুটো হাত হতে নিচে নামিয়ে রাখলো। অরিত্রিকা আজ নিজ হাতে বেলকনি সাজিয়েছে। নিজের মনমতো ফুল গাছ এনে সাজিয়ে রেখেছে।কার্পেট বিছিয়েছে।মনোমুগ্ধকর পরিবেশ বানানোর জন্য লাইটিং করেছে। টিপটাপ করে বাতিগুলো জ্বলছে।
সারহান ওয়াশরুম থেকে বের হলো। আলমারি হতে টি শার্ট পরে নিচে যাবে ওমনি কারো আওয়াজে থেমে গেলো।
~ বেলকনিতে আসুন তাড়াতাড়ি। আমি অপেক্ষা করছি।
অরিত্রিকার কন্ঠস্বর শুনে সারহান এগিয়ে গেলো সেদিকটায়।বেলকনিতে প্রবেশ করতেই লাইটিং আর সাজানো দেখে অবাক হলো সে।সে বুঝলো এটা অরিত্রিকার কাজ।ভালো লাগলো তার। তার ফাইরুজ আস্তে ধীরে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে তাহলে।
সারহানকে ঠাই হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অরিত্রিকা বললো~ আমার পাশে বসে পরুন। আজ আমরা একসাথে কফি ডেট করবো।
সারহান শুনে মৃদু হাসলো। সে অরিত্রিকার পাশে বসলো।অরিত্রিকা সারহানের হাতে কফি ধরিয়ে দিলো।
সারহান মৃদু হেসে বললো~ শুনেছি সকলে বিয়ের আগে কফি ডেট করে। এখন দেখছি বিয়ের পরেও কফি ডেট করে। ইন্টারেস্টিং।
অরিত্রিকা ভাব নিয়ে বললো~আমি সবসময় ইউনিক করার চেষ্টা করি।
সারহান মাথা দুলিয়ে সায় জানিয়ে বললো~ গুড। আই লাইক ইট।
অরিত্রিকা খুশি হলো শুনে। সে বললো~ কফি খেতে শুরু করুন। ঠান্ডা হয়ে যাবে।
সারহান কফিতে চুমুক দিলো।দুজনের দৃষ্টি বাহিরে।আনমনে রাতের প্রকৃতি দেখতে দেখতে কফি খেতে ব্যস্ত তারা। সারহানের ক্লান্তি এক নিমেশেই শেষ।মনও ফুরফুরে। শান্তি লাগছে খুব।তার যান্ত্রিক জীবনে ফাইরুজ নামক সুখের অভাব ছিলো বোধ হয়। তার জীবনে প্রেয়সী আসার পর থেকেই জীবনটাই নতুন মোড় নিলো।সারহান ভাবে তার প্রেয়সীর আগমন আগে কেনো ঘটলো না তার জীবনে? এই যে আজ তার সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। মনের মাঝে নিরব ঝড় থেমে গেছে। প্রণয় এসে ধরা দিচ্ছে মনের মধ্যিখানে।
দুজনের কফি খাওয়া শেষ।অরিত্রিকা সাহস করে সারহানের কাঁধে মাথা রাখলো।সারহান তাকিয়ে কিছু বললো না।মৌন রইল।
অরিত্রিকা বাঁকা চোখে তাকিয়ে শুধালো~ আপনি আমায় ভালোবাসেন?
সারহান শান্ত স্বরে বললো~ এই প্রশ্ন হঠাৎ?
অরিত্রিকা গুছিয়ে উত্তর দিলো ~ গতকাল হতে একই প্রশ্ন মাথায় ঘুরছে। অনেক ভেবেও উত্তর পেলাম না। হঠাৎ বিয়ের কথা বললেন কেনো?
সারহান সোজাসাপটা উত্তর দিলো ~ ভালোবাসি তাই।
অরিত্রিকা অপ্রত্যাশিত কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো।এটা কি শুনলো সারহান তাকে ভালোবাসে? বিশ্বাস হচ্ছে না তার।সবকিছু স্বপ্ন মনে হচ্ছে। এটা কীভাবে সম্ভব।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ৩৭
সারহান অরিত্রিকার কোমল হাত মুঠোবন্দী করে মৃদু হেসে বলে উঠলো~ জানিনা কখন তোকে দেখতে দেখতে ভালোবেসে ফেললাম।নিজেও বুঝলাম না। আমি যখন থেকে তোর মনে আমায় নিয়ে থাকা অনুভূতির কথা জেনেছি। তখন থেকেই প্রতিটা দিন তোকে নিয়ে বিচলিত হয়েছি।নানা ভাবনায় ডুবে গিয়েছি। তুই আমায় ভালোবাসিস কিনা বোঝার চেষ্টা করেছি। দিন যেতে লাগলো। সবশেষে বুঝলাম আমায় তুই কতোটা ভালোবাসিস। ততোদিনে আমিও তোর প্রতি দুর্বল হয়ে গিয়েছিলাম। ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোকে। তুই আমার হয়ে সারাজীবন থাকিস আমি তোকে আজীবন ভালোবেসে যাবো। তোকে ঘিরেই তো আমার সুখ।