প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৮
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকা লিভিং রুমের সোফায় শরীর এলিয়ে চুপচাপ বসে আছে। আনমনা ভাব নিয়ে গভীর ভাবনায় মত্ত সে। গতকাল রাত থেকে কেমন যেন আজব অনুভুতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার অগোচরে কিছু একটা ঘটে চলেছে অথচ সেসব সম্পর্কে একদম অবগত নয় সে। জ্বরের কবলে পড়ে সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আড়মোড়া ভেঙে উঠে নিভু নিভু চক্ষদ্বয় মেলে তাকায়। দুর্বলচিত্তে কোনো মতো বিছানায় হেলান দেয়। হঠাৎ নজর পড়ে মেঝের দিকে। মেঝেতে পড়ে আছে র*ক্তেমাখা তুলো।
দেখে অনেক অবাক হয়েছিল বটে। পরক্ষণে সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিল তার রুমে কেউ এসেছিলো কিনা? সবার উত্তর না বোধক ছিলো। অচেনা মানুষ তো তার রুমে আসার সাহস করবে না। তবে কে এসেছিল? শুধু একজন ব্যক্তিকে এখনো জিজ্ঞেস করেনি। সে হলো সারহান ভাই। অরিত্রিকা সেসব ভাবনা চাপা দেয় মনের গহীনে। সে জানে পাষান্ড মানুষটা কখনো তার ক্ষতে মলম লাগাতে আসবে না। তাদের মাঝে তেমন সম্পর্ক নেই। যতোটুকু আছে শুধু পারিবারিক সম্পর্ক এর থেকে বেশী কিছু নয়। তিনি শুধু মানুষকে অপমান এবং ধমকাতে পারেন। কাউকে সহানুভূতি দেখাতে পারেন না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব জোহরের নামাজ পড়ে বাড়িতে প্রবেশ করলেন। সাথে সাদাতও আছে। তিনজন নিজেদের মাঝে নানা বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে এগিয়ে এলেন লিভিং রুমে দিকে। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব সোফায় বসলেও সাদাত নিজের রুমে চলে গেল। অরিত্রিকার ধ্যান ভাঙল দুজনের কথোপকথনে। সে আনমনা ভাব উপেক্ষা করে বড় বাবা এবং বাবার দিকে তাকাল মলিন মুখে।
আরশাদ সাহেব অরিত্রিকার দিকে তাকিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল ;
“ আম্মা জ্বর কমেছে? ”
অরিত্রিকা মাথায় ওড়না ঠিকঠাক ভাবে দিলো। হালকা হেসে বলল;
“ হুমম কমেছে।”
“ দুইদিন ভার্সিটি যাওয়া অফ দাও। এই শরীরে যাওয়ার দরকার নেই।”
“ আচ্ছা। ”
অরিত্রিকা ভদ্র মেয়ের মতো মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আরশাদ সাহেব হাসলেন। ভাইয়ের ছোট মেয়েটা তার ভীষণ আদরের। নিজের মেয়ে না থাকায় ভাইয়ের মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো আদর করেন। ছোট বেলায় অরিত্রিকা কোনো কিছু আবদার করলে তা ফেলতে পারেননি। পছন্দসই খেলনা, ড্রেস কিনে এনে দিয়েছেন। দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে যাচ্ছে। আর তো কয়েকবছর তারপর মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে অন্যঘরে পাঠাতে হবে। ভাবলেই কেমন বুকটা ভারী হয়ে আসে।
আজমল সাহেব এর মাঝে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলেন ;
“ তুমি বড্ড বেশি খামখেয়ালী হয়ে যাচ্ছো। নিজের প্রতি যত্ন নিচ্ছো না, টাইম মতো খাবার খাচ্ছো না। এমন কেন করছো এই বাড়িতে এসে? আমার উপর রেগে আছো এখনো? ”
অরিত্রিকা পূর্ণ দৃষ্টি মেলে নিষ্পাপ চাহনিতে তাকায় বাবার দিকে। ওষ্ঠ উল্টে বলে ;
“ উহু রেগে নেই। ”
“ তাহলে এমন আচরণ করছো কেন?”
“ এমনি। ”
অরিত্রিকা মিনমিনে করে জবাব দেয়। আজমল সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেললেন। বললেন ;
“ ডেইলি রুটিন মেইনটেইন করে চলবে। এমন উড়নচণ্ডী ভাবে চলাফেরা করা যাবেনা। মনে রেখো বড় হচ্ছো? ”
অরিত্রিকার মন ভার হয়ে এলো। মলিন মুখে বলল;
“ তুমি কি আমার স্বাধীনতা কেঁড়ে নিতে চাইছো আব্বু?”
আজমল সাহেব আশ্চর্য হলেন। বিস্মিত চোখে তাকালেন মেয়ের মুখপানে। আরশাদ সাহেব গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললেন ;
“ আজমল তুমি চুপ করো। অরিত্রিকা এখনো ছোট। আর এমন বয়সে একটুআধটু দুষ্টমি করবে স্বাভাবিক। ”
“ ছোট বলে মাথায় তুলবেন না ভাইসাব। এরপর দেখবেন ছোটরা আমাদের মাথায় বসে তবলা বাজাবে আর আমরা সেই তালে নাচবো। ”
আজমল সাহেব গম্ভীর মুখে কথাটি বলে উঠে চলে গেলেন। আরশাদ সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে হেসে উঠলেন। তিনি উঠে অরিত্রিকার মাথায় পিতৃসুলভ আদুরে হাত বুলিয়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।
এরমাঝেই অরিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে প্রবেশ করল বাড়িতে। কলেজ ব্যাগ কাঁধে আঁকড়ে কোনো মতো হেলেদুলে অসুস্থ রোগীর ন্যায় হেঁটে এসে অরিত্রিকার সামনে এসে দাঁড়াল। ম্লানমুখে জিজ্ঞেস করল ;
“ কি অবস্থা তোর?”
অরিত্রিকা জবাব দেয় ;
“ এখন একটু ভালো। ”
“ ফ্রেশ হয়ে আসছি। তারপর কথা বলছি।”
“ আচ্ছা। ”
অরিন টলতে টলতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেল। অরিত্রিকা হতাশার শ্বাস টানলো। মনে মনে বকলো ইশরাকে। এই মেয়ে ফ্রেশ হতে কখন গিয়েছে। এখনো আসার কোনো নাম নেই। মনে হয় ওয়াশরুমে বসে বসে ঘুমুচ্ছে। চৌধুরী নিবাসে আজ সার্ভেন্টরা বেশ তোড়জোড় লাগিয়েছে পরিষ্কার, পরিছন্নতা এবং জামা কাপড় ওয়াশ করতে। বাড়িতে হঠাৎ এতো আয়োজনের কারণ বোধগম্য হলো তার। এসব বিষয়ে জানার আগ্রহ জন্মালো না। যা ইচ্ছে হোক তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এখন শুধু একটু শান্তি প্রয়োজন। কিন্তু তার কপালে সহজে এসব নেই। ইস আজ একটু শাড়ি পড়ে সেজেগুজে পদ্মার পাড়ে বান্ধবীদের সাথে ঘুরতে যেতে চেয়েছিল। তা আর হলো না। সারহান ভাইয়ের টর্নেডোর ন্যায় থাপ্পড়ে সব প্ল্যান উড়িয়ে নিয়ে গেছে। বদলোক কোথাকার। এই মানুষটার কপালে বউ জুটবে না হুহ্!
“ অরিত্রিকা সুস্থ লাগছে এখন? ”
আচমকা ইরফানের কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই ধরফরিয়ে উঠল অরিত্রিকা। চঞ্চল ভঙ্গিতে আতংকিত দৃষ্টিতে তাকাল পাশে। ইরফান তার থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে বসে আছে। শুকনো উদাসীন মুখে তার দিকে উদ্বিগ্ন হয়ে তাকিয়ে আছে। চোখ লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চুলগুলো কেমন উসকোখুসকো হয়ে আছে। শার্ট কুঁচনো। অরিত্রিকা কিছুটা অবাক হলো এমন এলোমেলো চেহারা দেখে। স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিলো ;
“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। আপনি কখন এলেন বগুড়া থেকে? ”
ইরফান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। ধীরুজ কন্ঠে বলে ;
“ এইমাত্র আসলাম। ”
অরিত্রিকার সদর দরজার দিকে তাকিয়ে শুধায় ;
“ ফুপি আসেনি? ”
“ নাহ। ”
“ আপনি একা ফিরে এসেছেন ইরফান ভাই। ”
“ হুম।”
“আপনার আর ফুপীর তো একসাথে আসার কথা ছিল তবে?”
“ গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ফিরে এসেছি। ”
ইরফান শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে প্রতিত্তোর করে। অরিত্রিকা একপলক ইরফানের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অন্যত্র তাকিয়ে ছোট্ট করে বলে উঠে;
“ ওহহ। ”
ইরফান উঠে দাঁড়াল। একপলক অরিত্রিকার মুখশ্রীতে তাকিয়ে পরখ করল। দৃষ্টি স্থির হলো ওষ্ঠকোণের ক্ষতে এবং গালে। বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করল ;
“ ঠোঁটের কোণে কাটলো কীভাবে আর গালে কী হয়েছে? ”
“ ইশরার থেকে জেনে নিয়েন। আমার আর এক কথা বলতে ভালো লাগছে না। ”
ইরফান বোধ হয় একটু কষ্ট পেল এহেন। দমে গেল কিছুটা। ম্লান মুখে তাকিয়ে রইল মেয়েটার দিকে। অরিত্রিকা আড়চোখে তাকাল। পুনরায় প্রশ্ন করল ;
“ কিছু বলবেন? ”
ইরফান অদ্ভুত হাসল ;
“ অরিন, ইশরা আর তোর জন্য গিফট নিয়ে এসেছি। রাতে আমার রুমে এসে নিয়ে যাস। ”
“ আমার জন্য কী গিফট এনেছেন? ”
“ তোর পছন্দের কোনো জিনিস এনেছি। রাতে দেখিস। ”
ইরফান কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে আর কিছু না বলে মৃদু হেসে প্রস্থান করল সেখান থেকে। অরিত্রিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল সেদিকে। মানুষটার আচরণ আজ কেন উদ্ভট লাগছে? ভাবসাব মোটেও ভালো ঠেকছে না। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই আরেক দফা চমকে গেল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠল ;
“ আপনি? ”
“ আমি এসে তোদের কথা বলায় ডিস্টার্ব করলাম বুঝি?”
সারহান সোফায় গা এলিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল। অরিত্রিকার চক্ষুদ্বয় সংকুচিত হয়ে গেল। বিরক্তি ভাব নিয়ে বলল ;
“ আপনি সবসময় বেশী বোঝেন সারহান ভাই। ”
সারহান বাঁকা হেসে বলল ;
“ তোর মতো কম বুঝে ষ্টুপিড উপাধী পাওয়ার থেকে বেশী বোঝা অনেক ভালো। ”
“ আপনি একটা অসহ্য। ”
“ আর তুই একটা ইডিয়েট। ”
“ ইডিয়েট কেন বললেন আমায়? ”
অরিত্রিকা ফুঁসে উঠল। সারহান তা উপেক্ষা করে হেয়ালিপূর্ণ ভঙ্গিতে বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল ;
“ যে মানুষের বিহেভ দেখে তার মনে চলমান অব্যক্ত কথা বোঝার ক্ষমতা নেই আমার ভাষ্যমতে তাকে এক কথায় ইডিয়েট বলে। ”
অরিত্রিকার কপাল কুঁচকে গেল। বোকার ন্যায় বলল;
“ কি বুঝবো? আর কার মনে কী চলছে? ”
“ ষ্টুপিড একটা। পড়াশোনা করেও ব্রেন এখনো হাঁটুর নিচে। ”
“ সারহান ভাই আপনি কিন্তু আমায় অপমান করছেন। ”
“ অপমান করার যোগ্য তুই। তাই অপমান করছি। ”
সারহান ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠল। অরিত্রিকা কটমট করে তাকাল মানুষটার দিকে। রাগে নাকের পাটাতন ফুলতে লাগল। সারহান তা অবলোকন করে ভরাট কন্ঠে বলল;
“ আমার দিকে মঞ্জুলীকার মতো তাকিয়ে থাকবি না। ”
অরিত্রিকার মেজাজ বিগড়ে গেল। তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠল;
“ আপনি.. আপনি! আপনি হলে মঞ্জুলীকার বয়ফ্রেন্ড মঞ্জু। ”
গরগর করে উল্টাপাল্টা বকে ক্ষ্রান্ত হলো অরিত্রিকা। রাগের বশে কি বলে ফেলেছে মনে পড়তেই জিভ কাটলো। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকাল সারহানের দিকে। সারহানের মাঝে কোনো দোলাচল দেখা গেল না। সে সোফা থেকে উঠে পড়ে। পরনের সাদা পাঞ্জাবি টেনেটুনে ঠিক করে। একপলক অরিত্রিকার ভীতু মুখখানার দিকে দৃষ্টি স্থির করে সদর দরজার দিকে চলে যায়। তখনি ভরাট কন্ঠের শব্দগুচ্ছ প্রতিধ্বনিত হয় ;
“ তোর মতো ইডিয়েটের বয়ফ্রেন্ড হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই আমার। ”
অরিত্রিকা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল সারহানের দিকে। অতিশয় বিস্ময়ের অতল গহীনে ডুবে গেছে।
পরিত্যক্ত গোডাউনের ভেতরের পরিবেশ সাধারণত খুবই নির্জন এবং গা ছমছমে। চারপাশে পরিবেশ ধুলো-ময়লা পরিপূর্ণ । গোডাউন দীর্ঘদিন বদ্ধ অবস্থায় থাকায় ভেতরে বিদঘুটে গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে আছে। আধ পাকা করা গোডাউনের মেঝেতে ময়লা – আবর্জনায় কেমন স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। ছাদে ঝুলে থাকা মাকড়সার জালে বিদঘুটে পরিবেশ তৈরী হয়েছে। ভাঙা দরজা-জানালার কারণে সূর্যের আলো খুব কম প্রবেশ করছে। সকাল হয়েছে তো বোঝার উপায় নেই।বিদঘুটে গন্ধটা ধুলো-মাটির সাথে পুরোনো কাঠ আর স্যাঁতসেঁতে ভেপসা পরিবেশের মিশ্রণ। একপাশে পুরোনো মালপত্র বা ভাঙাচোরা বাক্স পড়ে অযত্ন অবহেলায় পড়ে আছে। পায়ের নিচে শুকনো পাতা কাগজ কাচের টুকরো দৃশ্যমান। পরিত্যক্ত গোডাউনের স্যাতস্যাতে পচা কাঠের গন্ধে ভরা।
দূর হতে অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা ছোট রুমের দেখা মিলছে। সেখানে তিনটি চেয়ারে তিনজনকে শক্ত মোটা রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। অতি শক্তি প্রয়োগ করে বাঁধায় তাদের দেহ আর চেয়ারের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। ঘরের ভেপসা শীতল বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ এবং দেয়ালের ফাটলে জমে থাকা শ্যাওলা আর ছাদ থেকে গড়িয়ে পড়া পানির ধারা পরিবেশকে আরও গুমোট করে তুলেছে। তিনজনের ক্ষত ভরা চেহারা অর্ধেক সেই অন্ধকারে ঢাকা। তবে যা দৃশ্যমান তা খুবই ভয়ানক। বখাটে ছেলেগুলোর ফোলা চোখ, ফেটে যাওয়া ঠোঁট, আর মুখের পাশে জমে থাকা র*ক্তের শুকনো দাগ। কপাল বেয়ে মেঝেতে পড়ছে তাজা গরম র*ক্ত। কালসিটে পড়া শরীরে আঘাতের চিহ্ন।শরীর দুর্বল এবং নিস্তেজ। তাদের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে। থেমে থেমে দীর্ঘ শ্বাস নিচ্ছে। অতিরিক্ত র’ক্ত ক্ষরণের জন্য সকলে প্রায় অর্ধমৃত। হাত-পায়ের র*ক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে ফুলে উঠেছে এবং তার আঙুলগুলো মৃতের মতো নীলচে দেখাচ্ছে। তাদের শরীরের শার্ট ছেড়া,সেই ছেড়া অংশ দিয়ে শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। বক্ষ বরাবর গভীর ক্ষত এবং কালসিটে দাগ পড়েছে। কিছু জায়গায় হালকা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। তার চোখের গভীরে তীব্র যন্ত্রণা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে বখাটেগুলো। এখান থেকে পালানোর কোনো উপায় নেই তাদের। ব্যক্ত জানে সে গোডাউনে একা নয় আরও কয়েকজন লোক আছে। তারা সকলে এমপির লোক এটাও কানে এসেছে। এমপির লোকগুলো গোডাউনের বাহিরে অবস্থান করছে।শুধু সময় আর অপেক্ষা।
গোডাউনের বহু পুরনো মরিচীকা ধরা গেট খুলে প্রবেশ করল সারহান। পুরনো আমলের লোহার গেটের কর্কশ শব্দে কেঁপে উঠল ভেতরে থাকা বখাটেগুলো। তার পেছনে আবির এবং ইনান সহ আরও পাঁচজন দেহরক্ষী অনুসরণ করে প্রবেশ করল। সারহান ওষ্ঠকোণে বক্র হাসি ফুটিয়ে আশে পাশে না তাকিয়ে দাম্ভিকতার সহিত শাণিত পায়ে এগিয়ে গেল চেয়ারে বেঁধে রাখা বখাটেগুলোর দিকে। তারা কারো উপস্থিতির আভাস পেতেই দুর্বল চোখে সামনের দিকে তাকায়। ক্ষীণ আলোয় চোখে পরে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠামদেহী পুরুষালী অবয়ব।পেছনের মানুষগুলোর উপস্থিতি চোখে পরল তাদের। এতোক্ষণ তারা শান্ত থাকলেও অশান্ত হয়ে উঠল মুহুর্তেই। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো তাদের। আজ তাদের নিস্তার নেই। জীবনের মায়ায় কেঁদে উঠল তিনজন।
সারহান আবিরকে ইশারা করল। আবির সেই ইশারা অনুসরণ করে এগিয়ে গিয়ে লাইটের সুইচ অন করে দিল। পরিত্যক্ত রুমটা আলোয় আলোকিত হয়ে গেল। সারহানের দৃষ্টি তিনজনের ওপর নিবন্ধ। সেই চাহনিতে নেই কোনো মায়া দয়া। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে প্রকাশ পাচ্ছে একরাশ ক্ষোভ এবং ক্রোধ। তিনজনের গোঙানির শব্দ যেন পাষাণ মানুষটার হৃদয় গোলাতে অক্ষম।
“ অরিত্রির হাত স্পর্শ করার দুঃসাহস দেখিয়েছিলো কোন বাস্টার্ড? ”
নিস্তব্ধ রুমের সকলে হঠাৎ সারহানের বজ্র কন্ঠের হুংকারে আঁতকে উঠল। তিনজন বখাটের অবস্থা বেহাল। ভার্সিটিতে গতকাল হ্যারাস করেছিল দুই মেয়েকে। তার ফল স্বরুপ আজ তাদের এমন ভয়াবহ অবস্থা। এমপির পরিবারের মেয়ের গায়ে হাত দিয়েছে এর শাস্তি কঠিন হবে। সারহান রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চক্ষুদ্বয় রক্তাভ বর্ণ ধারণ করছে। মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে হিংস্রতা। চোয়াল অতিশয় থমথমে এবং কঠিন। কারোর কোনো উত্তর না পেয়ে পুনরায় শক্ত কন্ঠে শুধায় ;
“ অরিত্রির শরীরে হাত দিয়েছে কে? হু ইজ হি? ”
তিনজনের মধ্যে একজন কেঁদে উঠল। বলল ;
“ এমপি সাহেব আমি কিছু করি নাই। আমারে ছাইড়া দেন। ”
সারহান কুটিল হেসে বলল ;
“ ঠিক আছে ছেড়ে দেব। আগে বল কে অরিত্রিকে স্পর্শ করার স্পর্ধা দেখিয়েছে। ”
ছেলেটির মুখ চকচক করে উঠল। ব্যথা ভুলে তড়িঘড়ি করে বলল ;
“ আতিক।”
“ আতিক কে? ”
“ মাঝখানের চেয়ারে যাকে বাঁধা রয়েছে সে। ”
সারহান ভ্রু যুগল বাঁকিয়ে তাকাল আতিকের দিকে। আতিক ভয়ে থরথর করে কাঁপছে । চোখ দিয়ে অনবরত নোনাজল ঝরছে। মৃত্যু ভয়ে আত্মা শুকিয়ে আসছে। সারহান তা পরখ করে ওষ্ঠ বাঁকায়। দাম্ভিকতা বজায় রেখে এগিয়ে যায় আতিকের দিকে। কুটিল হেসে বলে উঠে ;
“আতিক, জানিস, তোকে দেখে আমার মনে একটুও মায়া হচ্ছে না! বরং ইচ্ছে করছে এই মুহূর্তেই তোর গলায় নিজের হাতে ছু*ড়ি চালিয়ে দিই! কিন্তু না আমি তা করব না! কারণ তোদের মতো নীচ মানুষকে এত সহজে মৃত্যুর স্বাদ দেওয়া মানে শাস্তিকে হালকা করে দেওয়া। এবার তোদের নজর ভুল জায়গায় পড়েছে! আমার সম্মানে হাত দিয়েছিস।তার শাস্তি তোকে পেতেই হবে! সে শাস্তি এমন হবে যা তোদের অস্তিত্বের প্রতিটি কণায় ভয় হয়ে গেঁথে থাকবে! তোদের প্রতিটি নিশ্বাসে, প্রতিটি রাতের ঘুমহীন আতঙ্কে সেই পাপের মূল্য দিতে হবে!”
বখাটে তিনজন ভয়ে কেঁপে উঠল। সারহান আবিরের দিকে হাত বাড়ায়। আবির তা দেখে হাতে থাকা ব*ন্দুক সারহানের হাতে তুলে দেয়। সারহানের মুখাবয়ব কঠিন হয়ে উঠে। ব*ন্দুক সরাসরি তাক করে আতিকের বাহু বরাবর। ভাবমূর্তি পরিবর্তন করে নিজের মাঝে ঘুমন্ত হিংস্র মনোভাব বের করে আনে। ক্রোধ মিশ্রিত চাহনিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চস্বরে বলে উঠে ;
“অরিত্রির শরীরে তোর কলুষিত, ঘৃণ্য, দুর্গন্ধময় হাতের স্পর্শ পড়েছে। সেই হাত কি অক্ষ*ত রেখে দেওয়া যায়, আতিক? সেই হাত কি আর থাকার যোগ্য?আজ আমি ন্যায়ের শাস্তি দেব! যে হাত অপবিত্র করেছে অরিত্রির শরীর, যে হাত সাহস করেছে স্পর্শ করার সেই হাত শান্তিস্বরুপ আজ তোকে হারাতেই হবে! আমি নিশ্চিত করব তুই প্রতিটা মুহূর্তে বুঝিস নারীর অসম্মানের মূল্য কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে!”
আতিক ভয়ে থরথর করে কাঁপতে থেকে। কন্দনরত কন্ঠে বলে উঠে ;
“ আমারে ছাইড়া দেন এমপি সাহেব। আমার ভুল হইয়া গেছে। আর কোনোদিন এমন জঘন্য কাজ করমু না। আমারে মাফ করে দেন।”
“ যা মাফ করে দিলাম।”
সারহান ফিচেল হেসে হঠাৎ বলে উঠে। সকলে হতবিহ্বল হয়ে যায় এমন কান্ডে। আতিকসহ আরও দুজনের জানে পানি আসে। ভয় মিলিয়ে যায় বাতাসে। কিন্তু সেই খুশি স্থায়ী হয় না। বুলেটের শব্দে কেঁপে উঠে রুম। কারো ভয়াবহ আর্তনাদে নিস্তব্ধতা ভেঙে যায় মুহুর্তে। সবাই হচকচিয়ে গেল। আতংকে বুক কেঁপে উঠে। ভয়ার্ত নজরে তাকায় সারহানের দিকে। সারহানের সাদা পাঞ্জাবিতে লাল তাজা র*ক্তের ছিটকে আসা দাগ। গম্ভীর মুখে র*ক্তের ছিটা এসে পড়ছে। ওষ্ঠকোণে রহস্যময় হাসি। সূঁচালো দৃষ্টি আতিকের পানে। আতিকের শরীর ঝিমিয়ে গেছে। চক্ষুদ্বয় আধখোলা। জিভে বের হয়ে আছে। বু*লেটের আঘাতে একহাত ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে গেছে। গল*গল করে র*ক্ত পড়ে রুমের মেঝে ভেসে যাচ্ছে। হাতের মাংস ঝাঝড়া হয়ে গেছে। কী বিভৎস দৃশ্য।
সারহান পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে লেগে থাকা র*ক্ত মুছে নেয়। দৃঢ় কন্ঠে আওড়ায় ;
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৭
“নারীর শরীর ছুঁয়ে দেখার লোভ কখনোই একজন সভ্য ও সম্মানিত পুরুষের চরিত্রের পরিচায়ক হতে পারে না! এটা তোদের মতো নর্দমার কীটদের নোংরা প্রবৃত্তি। যাদের অস্তিত্ব এই সমাজের জন্য কলঙ্ক!তোদের জন্য একটাই প্রাপ্য নৃশংস শাস্তি! তোদের মতো পাঁকজীবীদের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই! মৃত্যুই তোদের একমাত্র মুক্তি, বাস্টার্ডদের দল!”