প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪২
আদ্রিতা নিশি
ইরফান শ্বাস টেনে নিলো। সাহস সঞ্চার করে দ্রুততার সহিত বলল ;
“ আই লাভ ইউ অরিত্রিকা। ”
অরিত্রিকা এতোক্ষণ আগ্রহী ভঙ্গিতে ইরফানের কথা শোনার জন্য নীরব ভঙ্গিতে বসে অপেক্ষা করছিল। অপেক্ষার প্রহর পেরিয়ে যখন অপ্রত্যাশিত বাক্য শ্রবণ হলো তখন স্তব্ধ হয়ে গেল সে। বাক শক্তি যেন হারিয়ে গেল কোথাও। অবিশ্বাস্য চাহনিতে দৃষ্টি স্থির করল সামনে দন্ডায়মান মানুষটার দিকে। সেই চাহনিতে স্পষ্ট প্রকাশ পাচ্ছে অবাকতার রেষ। বোঝা যাচ্ছে এমন কিছু আশা করেনি মেয়েটা। ইরফান অরিত্রিকার ভাবমূর্তি পরখ করল নিঃশব্দে। তবুও প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আজকের এমন পরিস্থিতি দুইদিন পরেও আসতো। তাই অর্ধেক কথা বলার পর অর্ধেক গোপন রাখা বোকামী। মনের গহীন হতে তপ্ত শ্বাস বেরিয়ে আসে। পূর্বের ন্যায় বলে ওঠে ;
“অরিত্রিকা, তোকে ভালোবাসি প্রায় দেড় বছর হতে চলল। ঠিক কোন মুহূর্তে, কোন বিকেলের গোধূলী লগ্ন বা কোন নিস্তব্ধ রাতে তোর জন্য আমার মনে এমন অনুভব জন্ম নিয়েছিল তা আমি বুঝে উঠতে পারিনি। তবে আজ স্পষ্ট মনে পড়ে চৌধুরী ভিলা ছেড়ে আসার কয়েক মাস পর রাজশাহী কলেজের বাংলা বিভাগের ভবনের সামনে তোকে প্রথম দেখি। দিনটি ছিল পহেলা ফাল্গুন।প্রকৃতি সেদিন যেন নিজেই বসন্তের সাজে সেজে উঠেছিল।সেইদিন কলেজজুড়ে চলছিল সাংস্কৃতিক আয়োজন। চারপাশে হাসি, রঙ আর সুরের মাধুর্য। ছেলেরা সাদা-হলুদ পাঞ্জাবিতে, মেয়েরা ঝলমলে হলুদ শাড়িতে। আমি গিয়েছিলাম বন্ধুদের সঙ্গে নিছক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখার উদ্দেশ্যে। ভাবিনি হঠাৎ করে তোকে দেখে আমার সমস্ত সময় থমকে যাবে। তোর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি যেন বসন্তকে ছুঁয়ে ফেলেছিলাম। হলুদ শাড়িতে তোকে দেখে যে মোহনীয় আবেশে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ব তা কোনো কল্পনাতেও ছিল না।পহেলা ফাল্গুন আমার জীবনে ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ এনেছিল অরিত্রিকা। সেদিন থেকেই অফিসের ছুটি পেলেই তোদের বাড়ির পথ ধরি। সকলের অগোচরে নিঃশব্দে তোকে দেখি দূর থেকে শুধু একটিবারের জন্য। কারও চোখে না পড়ে, কেবল তোকে দেখে ফেরার মাঝে যে তৃপ্তি খুঁজে পাই তা ভাষায় ধরা যায় না।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইরফান এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে নিজের মাঝে গোপন অনুভূতির ব্যাখ্যা দিলো। কথাগুলো বলতে কোনো সংকোচ বা ভয়ের দেখা মিলল না তার মাঝে। নিজের মাঝে এমন পরিবর্তন দেখে অবাক হলো। পরমুহূর্তে আকাঙ্খিত দৃষ্টি স্থির করল অরিত্রিকার দিকে। দেখল মেয়েটি মূর্তির ন্যায় থমথমে মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। চাহনি অতি গভীর যেন দুটো চোখে নিঃশব্দে কোনো বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়েছে। অরিত্রিকার শরীর কেঁপে উঠল। মন অশান্ত হয়ে উঠল। নিজেকে কেমন যেন দিশেহারা লাগলো। ইরফান ভাই তাকে ভালোবাসে। এই শব্দগুচ্ছ প্রতিধ্বনিত হলো বারংবার। সে কখনো ইরফানকে বড় ভাই ব্যতিত অন্য কোনো দৃষ্টিতে দেখেনি। কখনো কল্পনা করেনি এমন কিছু শুনবে। ছোট থেকে বড় হয়েছে দীর্ঘ সময়ে ছোট বোন বড় ভাইকে যেমন ভালোবাসে তেমন ভালোবেসেছে। মাঝে মাঝে বড় ভাই হিসেবে আবদার করেছে। ইরফান সেই আবদার পূরণ করেছে। ফুপাতো ভাই হলেও নিজের ভাইয়ের মতো বন্ডিং গড়ে উঠেছিল কিন্তু সারহানের সাথে ছোটবেলা থেকে কোনো অজানা কারণে দুরত্ব ছিল। নিজের ভাই ভাবা ছিল দূরের কথা। দুজনে ছিল একে অপরের নীরব শত্রু। হয়তো সারহানের গম্ভীর, কাঠখোট্টা আচরণ ছিল এর মূল কারণ।
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টেনে পুনরায় তাকায়। তপ্ত দুপুরে ঘাম জমে কপালের মধ্যাংশে। বিক্ষিপ্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে মন। তার ভয় এবং আশংকা সত্যি হলো। ইরফানের মনোভাব বুঝতে পেরে দুরত্ব বজায় রেখে যেন কোনো লাভ হলো না। তিক্ত সত্যি তার সামনে আসল। সারহান ভাই যদি এসব জানে তাহলে কী হবে? ভেবে শঙ্কিত হলো। শুকনো ঢোক গিলল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার ভাণ করে সংযত কন্ঠে বলল ;
“ দয়া করে এসব কথা আমায় দ্বিতীয়বার বলবেন না ইরফান ভাই। ”
ইরফান বিস্মিত হলো। পরক্ষণে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হলো। উত্তেজিত হয়ে বলল ;
“ কেনো বলবো না ? তোকে ভালোবাসি তাই বলছি। এতে কি কোনো পাপ করেছি? ”
“ ভালোবাসা পাপ নয় ইরফান ভাই। ”
“ তাহলে কেন আমায় নিষেধ করছিস? ”
ইরফান শক্ত গলায় কথাটা বলল। অরিত্রিকা চমকে গেল। সরাসরি বলল ;
“ ভালোবাসার কথা বলে আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট করবেন না। ”
ইরফান তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল ;
“ লাইক সিরিয়াসলি! ভালোবাসার কথা বলে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট করছি? তোর মুখে কথাটা কেমন যেন বিদঘুটে শোনাল। ”
“ আপনি চুপ করুন। বাড়ির কেউ এসব শুনলে তুলকালাম বেঁধে যাবে। ”
“ তুলকালাম বেঁধে যাক, হু কেয়ারস্! এবার বল আমার মধ্যে কিসের কমতি আছে? ”
“ আপনার মাঝে কোনো কমতি নেই ইরফান ভাই।”
অরিত্রিকা দৃঢ় কন্ঠে বলল। ইরফান দুই কদম এগিয়ে আসল। ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির রেখা টানল। শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ আমি তোকে বিয়ে করতে চাই অরিত্রিকা। তুই এখন রাজি হয়ে যা তাহলে আজকে বিকেলের মধ্যে বিয়েটা করে ফেলবো। ”
অরিত্রিকা ধরফরিয়ে উঠল। তড়িৎ বেগে দোলনা থেকে নেমে দাঁড়াল। লেভি আচমকা হুরমুড়িয়ে ওঠায় ভয়ে লাফ দিয়ে ছুটল নিচের দিকে। ইরফান পুনরায় বলল ;
“ মামু আর মামীকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। উনাদের আমি বুঝিয়ে বললে বুঝতে পারবেন আমাদের দিকটা। ”
অরিত্রিকার রাগে গা জ্বলে উঠল। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা এক প্রকার অসহ্য এবং বিরক্তিকর মনে হলো। ভালোবাসার কথা বলে সোজা বিয়ে পর্যন্ত নিয়ে গেল। রাগান্বিত কন্ঠে বলল ;
“ আমি আপনাকে বড় ভাই ব্যতিত অন্য কোনো নজরে দেখিনি। তাই আপনাকে বিয়ে করা অসম্ভব। ”
“ আমি তোর নিজের ভাই নই। ফুপাতো ভাই হই তোর।”
“ ফুপাতো ভাই হলেও আপনাকে আমি নিজের ভাইয়ের মতো ভেবে এসেছি। আপনি আমাকে ভালোবাসেন কিন্তু আমি আপনাকে বাসি না। এসব ভাবনা মাথায় থেকে ঝেড়ে ফেলুন ইরফান ভাই। আপনি যা চাইছেন তা কখনো হওয়ার নয়। ”
ইরফানের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ক্রোধে জর্জরিত হয়ে গেল সে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে অতি শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ কেনো হওয়ার নয়? মামু -মামীর কথা ভেবে এসব বলছিস? ”
অরিত্রিকা দুপাশে মাথা নাড়িয়ে গমগমে কন্ঠে বলল ;
“ নাহ। ”
“ আমার মা মেনে নেবে না তাই এসব বলছিস? ”
“ নাহহ। ”
“ কাউকে ভালোবাসিস? ”
ইরফান অদ্ভুত হেসে প্রশ্ন করল। প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থমকে গেল অরিত্রিকা। কিছুটা ভয় পেল। ইরফান ভাই হঠাৎ কেন এমন প্রশ্ন করলেন? তিনি কি কিছু বুঝতে পেরেছেন? নাকি এমনি বললেন? সে নিজেকে সামলে নিলো। চোখ মুখ শক্ত করে বলল ;
“ আপনাকে কেনো বলবো? ”
ইরফান কাঠিন্যতা এঁটে বলল ;
“ তোকে আমি বিয়ে করছি তাই বিয়ের আগে জানা দরকার তোর জীবনে আর কেউ আছে কি না? ”
“ আপনাকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছি আমি আপনাকে বিয়ে করবো না। তবু কেন বারবার একই কথা বলছেন?”
“ কারণটা তোর মা বাবাকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর। ”
“ কথা ঘুরাবেন না ইরফান ভাই। ”
“ ওকে কথা ঘোরাবো না। আগে বল তুই আমাকে বিয়ে করবি। ”
“ বিয়ে কি কোনো খেলা? হঠাৎ এসে বললেন আর আমি রাজি হয়ে গেলাম? ”
অরিত্রিকা রাগান্বিত ভঙ্গিতে চিল্লিয়ে বলল। ইরফান রাগে গজগজ করে উঠল। আচমকা এগিয়ে এসে অরিত্রিকার দুবাহু ধরল শক্ত ভাবে। অগ্নিশর্মা দৃষ্টি স্থির করল অরিত্রিকার রাগান্বিত মুখপানে। অরিত্রিকার দুবাহু ব্যথায় টনটন করে উঠল। রাগাশ্রয়ী মুখশ্রী ব্যথায় কুঁচকে গেল। সে ফুঁপিয়ে উঠল। চক্ষুদ্বয়ে ভীড় করল অশ্রুকণা। ভেজা নিস্পৃহ কন্ঠে বলল ;
“ আমার হাত ছাড়ুন ইরফান ভাই। আমার হাতে ব্যথা লাগছে। ”
ইরফান উপেক্ষা করল বাক্যটুকু। শুনেও শুনল না। রাশভারি কন্ঠে বলল ;
“ আমারও বুকে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। তীব্র ব্যথায় শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তোকে হারানোর ভয় জেঁকে ধরেছে মনে। কিন্তু তুই বুঝেও অবুঝ। কেন বুঝতে পারছিস না আমার মনের অবস্থা? ”
“ আপনি নিজের মাঝে নেই। দয়া করে শান্ত হোন। ”
“ শান্ত হতে পারছি না অরিত্রিকা। বুকের মধ্যে যন্ত্রণা হচ্ছে। সকালের দৃশ্যটা দেখে আগুন জ্বলছে বুকে। এ আগুন তুই নিভাতে পারিস, এ যন্ত্রণা তুই নিবারণ করতে পারিস। প্লিজ অরিত্রিকা আমাকে ফিরিয়ে দিস না। তোকে ছাড়া আমি ম’রে যাব। ”
“ আপনার কথা রাখা সম্ভব নয়। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। আপনাকে আমি নিজের বড় ভাইয়ের মতো মনে করি।”
অরিত্রিকা ব্যথায় মুখ কুঁচকে কাটকাট স্বরে বলল। ইরফান দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলল ;
“ আমাকে বড় ভাইয়ের চোখে দেখিস আর সারহানকে প্রেমিকের চোখে? সত্যি করে বল সারহানকে ভালোবাসিস তাই আমাকে রিজেক্ট করছিস? ”
অরিত্রিকা ইরফানের মুখে অপ্রত্যাশিত কথাটা শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেল। নিমেষেই বুঝে ফেলল পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। সে ভীতগ্রস্থ হলো। থমথমে গলায় বলল ;
“ যা সত্যি তাই বলেছি। আপনি আমাদের ঝামেলার মাঝে সারহান ভাইকে আনছেন কেনো? ”
“ সারহানকে ভালোবাসিস? ”
“ বলবো না। আপনি আমায় ছাড়ুন, হাতে লাগছে।”
“ আগে বল তারপর ছাড়ব। সত্যি কথা বল নয়তো জোর করে বিয়ে করবো তোকে।”
“ আপনি পাগল হয়ে গেছেন? ”
“ হ্যা আমি পাগল হয়ে গেছি। তোর জন্য পাগল হয়ে গেছি। দেড় বছর গোপনে ভালোবেসে যখন মানুষ জানতে পারে তার ভালোবাসার মানুষটি অন্য কাউকে ভালোবাসে তখন পাগল হয়ে যায়। দ্রুত বল অরিত্রিকা।”
“ হ্যা আমি সারহান ভাইকে ভালোবাসি। এবার ছাড়ুন আমায় উন্মাদ লোক। ”
অরিত্রিকা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল। ইরফান অরিত্রিকার দুবাহু ছেড়ে দিলো। স্তব্ধ হয়ে রইল সে। অনুভূতিহীন মানুষের ন্যায় চুপ হয়ে গেল। সে বাকরুদ্ধ। প্রেয়সীর মুখে তিক্ত সত্যি যেন বক্ষে তোলপাড় শুরু করে দিল। অরিত্রিকা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। ইরফান ভাইয়ের কর্মকান্ড তাকে হতাশ করেছে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে এই মানুষটাকে সে বড় ভাইয়ের আসনে বসিয়েছিল। অশ্রুসিক্ত লোচনে ইরফানের দিকে তাকাল। ইরফান সেই চাহনিতে পুনরায় থমকে যায়। মিলিয়ে যায় স্তব্ধতা। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। অতি শান্ত কন্ঠে বলল ;
“ সারহানকে ভালোবাসলেও তুই আমার বাগদত্তা অরিত্রিকা। তোকে যখন ভালোবেসেছি তোকে সম্পূর্ণ নিজের করে না পাওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হবো না। খুব শীঘ্রই দুই পরিবারের সম্মতিতে আমাদের বিয়ে হবে। ”
ইরফান একটু থেমে মলিন হেসে বলল ;
“ ভালোবাসি বসন্তিকা। ভালোবাসি তোকে।”
ইরফানের পেছনে ছুটে যাওয়ার মতো কোনো শক্তি অবশিষ্ট ছিল না অরিত্রিকার শরীরে। তার বলা প্রতিটি শব্দ যেন বুকে শূল হয়ে বিঁধছিল। “তুই আমার বাগদত্তা” শব্দগুলো কর্ণকুহরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল বারংবার। বুকের মধ্যে ঝড় উঠেছিল, মনে হচ্ছিল কেউ যেন হাহাকার করে উঠছে ভিতরে।অরিত্রিকা ধপ করে বসে পড়ে ছাদের মেঝেতে। দুহাতে নিজের চুল আঁকড়ে ধরে হু হু করে কাঁদতে থাকে। কান্নার শব্দ ছাদের নিস্তব্ধতায় ছড়িয়ে পড়ে এক অপার ব্যথার মতো। কিছুক্ষণের জন্য সময় থমকে যায় যেন।তারপর হঠাৎ করে মনের পর্দায় ভেসে ওঠে সারহান ভাইয়ের বলা কথা “কখনো যদি ভালোবাসার জন্য পরিবারের বিপক্ষে যেতে হয়, তখন কী করবি?” তার হৃদয়টা ধকধক করে ওঠে। একটাই প্রশ্ন ক্রমাগত ঘুরপাক খেতে থাকে মনে।
তবে কী সত্যিই তার মা-বাবা কিছু লুকিয়েছে?
“ তিক্ত অতীতকে পিছু ফেলে, নিজের মস্তিষ্কে চলা দ্বিধাকে পরোয়া না করে যখন নিজের জীবনে এগিয়ে চললাম তখন পুনরায় কেন ফিরে আসতে চাইছো ইশতিয়াক? আমাকে কষ্টের সাগরে ডুবিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলে। যখন আমি তোমায় এবং তোমার সাথে কাটানো মুহুর্ত ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছি তখন তুমি চাইছো আমার জীবনে ফিরে আসতে। তুমি যা চাইছো তা কখনো সম্ভব নয়। আমার এবং আবিরের বিয়ে হয়ে গেছে। আমি আবিরকে নিয়ে জীবনে এগিয়ে যেতে। আমি অতীতকে বর্তমানে ঠাই দিয়ে কোনো ভুল করতে চাই না।”
অরিন মলিন মুখে বসে আছে বেলকনিতে রাখা চেয়ারটায়। মনটা ভীষণ উদাসীন। অতীতের তিক্ত স্মৃতি ও জঘ ন্য মানুষটার করা প্রতারণার কথা মনে পড়ছে। গতকাল রাতে অচেনা নাম্বার থেকে তাকে কেউ মেসেজ করেছিল। মেসেজে লেখা ছিল
“ অরিন আমি তোমাকে পুনরায় ফিরে পেতে চাই। তোমার থেকে দূরে গিয়ে বুঝেছি তুমি ছিলে আমার জীবনের আলো। বুঝতে পেরেছি আমি তোমায় কতোটা ভালোবাসি। তোমার বিয়ে হয়েছে শুনেছি। তা শুনে ভীষণ কষ্ট পেয়েছি। বিগত দুইদিন ধরে ঘুমাতে পারিনি। আমি জানি তুমি আমায় ভালোবাসো। এমন কি আমার জন্য তুমি তোমার হাসবেন্ডকে ডিভোর্স দিতে পারো। আমি তোমাকে পেতে চাই। তোমার বিয়ে হয়েছে তবুও যদি তোমার হাসবেন্ডকে ডিভোর্স দিয়ে পুনরায় আমার কাছে ফিরে আসতে চাও আমি তোমাকে সাদরে গ্রহণ করবো। আগের মতো ভালোবাসবো। ”
সকালে ফোনটি হাতে নিয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল সে। ফোন স্কিনে নজর পড়তেই থমকে গিয়েছিল। মেসেজটি পড়ে বুঝতে পেরেছিল মানুষটা তার প্রাক্তন প্রেমিক ইশতিয়াক। মুহুর্তেই গা গুলিয়ে উঠেছিল। পূর্বের ন্যায় চোখ ফেটে কান্না আসেনি তার। দুই চোখে বিরাজ করছিলো ঘৃণার সমাহার। মানুষ কতোটা জানো*য়ার হলে হাসবেন্ডকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা বলে? এটাও বুঝতে পেরেছিল ইশতিয়াক তাকে কখনো ভালোবাসেনি। ভালোবাসলে কখনো তাকে ধোঁকা দিতো না। অরিন মেসেজ ডিলিট করে দিয়েছে। সে চায় না এসব উটকো কাহিনী নিয়ে দুজনের মাঝে ঝামেলা হোক। আবিরকে তার অপছন্দ নয়। মানুষটা এক কথায় তার সম্মান বাঁচিয়ে বিয়ে করেছে। অতীতের কথা তুলেনি দ্বিতীয়বার। সে চায় না মানুষটাকে হারাতে। সে চায় দুজন মিলে ছোট্ট সংসার গড়ে তুলতে।
“ অরিন আপু ভেতরে আসব?”
রুমের দরজার ওপাশ হতে ডেকে চলেছে ইশরা। কন্ঠস্বর উদ্বিগ্নভাব। হয়তো কোনো কান্ড ঘটিয়ে তার কাছে এসেছে। সে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে। রুমে আসতে আসতে বলে ;
“ ভেতরে আয়। ”
কথাটা শেষ করতেই হুরমুড়িয়ে ঢুকল সাদাত এবং ইশরা। দুজনকে ভীষণ চিন্তিত দেখাল। বোঝা যাচ্ছে দুজনে হয়তো দৌড়দৌড়ি করেছে। সে একটু ভাবুক হলো। অতঃপর জিজ্ঞেস করল ;
“ কী হয়েছে তোদের? চেহারা এমন লাগছে কেনো?”
ইশরা দ্রুততার সহিত উত্তর দিলো;
“ আপু অরিত্রিকাকে দেখেছো? ”
“ অরিত্রিকাকে সকালে দেখেছিলাম লিভিংরুমে। হয়তো ভার্সিটিতে গিয়েছে। ”
“ ভার্সিটিতে যায় নি। ”
“ তাহলে দেখ বাগানে কিংবা ছাদে গিয়ে বসে আছে।”
সাদাত বলল;
“ বাগানে নেই অরিত্রিকা। হয়তো ছাদে আছে। ”
অরিন সন্দেহবাতিক কন্ঠে বলল ;
“ অরিত্রিকাকে কেনো খুঁজছিস? ”
“ গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। আচ্ছা আমরা আসছি। ”
সাদাত উক্ত কথাটি বলে রুম থেকে দৌড়ে বেড়িয়ে গেল। ইশরাও ছুটলো পিছু পিছু। অরিন অবাক হয়ে দেখল দুজনকে। নিশ্চয়ই তিনজনে মিলে কান্ড ঘটিয়েছে।
“ সাদাত সারহান ভাই কল করে কেন তোকে বলল অরিত্রিকাকে নজরে রাখতে? কোনো কিছু কি ঘটতে চলেছে? ”
“ আমার আশেপাশে থাকতে নিষেধ করেছি তোকে। ”
সাদাত এবং ইশরা অরিনের রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে ছাদের দিকে যাচ্ছে। দুজন পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। সকাল থেকে তেমন একটা কথা হয়নি দুজনের। দুজনে দুরত্ব বজায় রেখে চলছিল। কিছুক্ষণ আগে সারহান কল দিয়ে বলেছিল অরিত্রিকাকে নজরে রাখতে। ব্যাস তখন থেকে পুরো বাড়ি বাগান খুঁজেও অরিত্রিকার দেখা মেলেনি। তখন উপায় না পেয়ে জিজ্ঞেস করেছিল ইশরাকে অরিত্রিকা কোথায়? ইশরা উত্তর দিয়েছিল সে দেখেনি। ইশরা সাদাতকে জিজ্ঞেস করেছিল কেন খুঁজছে অরিত্রিকাকে?তখন সাদাত চিন্তিত ভঙ্গিতে সারহানের বলা কথাগুলো বলেছিল। তারপর দুজনে অরিনের কাছে গিয়েছিল।
ইশরা কটমট করে তাকাল সাদাতের দিকে। মুখ বেঁকিয়ে বলল ;
“ নাটক কম কর সাদুর বাচ্চা।
সাদাত গম্ভীর কন্ঠে বলল ;
“ আমাকে দেখে মনে হচ্ছে নাটক করছি? ”
“ একটু একটু মনে হচ্ছে। এবার বল সকালে সামান্য বিষয় নিয়ে আমার ওপর রেগে গেলি কেনো? ”
“ বলবো না। ”
“ কেনো বলবি না? ”
“ আমার ইচ্ছে তাই।”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪১ (২)
সাদাত ধপাধপ পা ফেলে চিলেকোঠা পেরিয়ে ছাদে পা রাখল। ইশরার মুখ গোমড়া হয়ে গেল। সাদাতের হঠাৎ এমন ব্যবহারের কারণ খুঁজে পেলো না। সে আর কিছু না ভেবে ছুটলো ছাদের দিকে। দুজনে কিছুটা দূরে যেতে খেয়াল করল পশ্চিমপাশের দিকে দোলনার পাশে এলোমেলো ভঙ্গিতে বসে আছে অরিত্রিকা। মুখাবয়ব অস্বাভাবিক লাল। দুজনে এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠল। অরিত্রিকা বলে চিৎকার দিয়ে দুজনে ছুটে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। ইশরা দুহাতে আগলে নিলো অরিত্রিকাকে। অরিত্রিকা তখনি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।