প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৮
আদ্রিতা নিশি
রাতভর বৃষ্টি, দমকা হাওয়ায় অশান্ত ছিল প্রকৃতি। ভোরের আলো ফোটার পর পর উজ্জ্বল সোনালী রশ্মিতে প্রকৃতি যেন নতুন রুপে আবর্তিত হয়েছে। বৃষ্টিস্নাত রাতের পর বৈশাখের রৌদ্রস্নাত সকাল শহরকে নতুনভাবে রাঙিয়ে তুলেছে। মৃদু মন্দ বাতাস মিষ্টি মেয় রোদ অপার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিচ্ছে। সময়টা সকাল নয়টা। চৌধুরী ভিলার লিভিং রুমে বসে আছেন আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব। লিভিংরুম জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে পিনপিনে নিরবতা। দুপাশের দুই সোফায় তাদের অবস্থান দৃঢ়। দুজনের মুখাবয়ব গম্ভীর এবং অশান্ত। সকালের খাবার খাওয়া শেষ করে দুই ভাই জরুরী ভঙ্গিমায় আলোচনায় বসেছেন।
কিন্তু কারো মুখে কোনো কথার আনাগোনা নেই। নিশ্চুপ হয়ে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ মস্তিষ্কে নিজ নিজ মনে আকাশ কুসুম ভেবে চলেছেন। তানিয়া বেগম এবং সাথী বেগম কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছেন কথোপকথন শোনার জন্য। কিন্তু মিনিট দশেক ধরে দাঁড়িয়ে থেকেও কোনো বাক্য শুনতে পেলেন না। ইসমা বেগমের মনের অবস্থা বেহাল। তিনি চিন্তিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন দুই ভাইয়ের বউদের থেকে কিছুটা দূরে। রাত থেকে ইরফানকে কল দিয়ে পাচ্ছেন না। কোথায় আছে, কি করছে কিছুই জানেন না। মুখ ফুটে বাড়ির কাউকে বিষয়টা বলার সাহস সঞ্চার করতে পারছেন না। অতিরিক্ত চিন্তায় প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে। অপরদিকে দু-ভাইয়ের সকাল সকাল আলোচনা সভা যেন উদ্বিগ্ন করছে। সাদাত বাবা পাশে বক্ষপটে হাত গুঁজে এক ধ্যানে তাকিয়ে চাচার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছে। অরিন চুপচাপ করিডোরে দাড়িয়ে লক্ষ্য রাখছে বাবার দিকে। কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো বড়সর ঘটনা ঘটবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আজমল সাহেব চক্ষুদ্বয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরিববারে সকলের অবস্থান দেখে নিলেন। কিন্তু অরিত্রিকার দেখে পেলেন না। মেয়েটাকে রাতে ডেকেছিলেন কিন্তু আসেনি। হয়তো অভিমান এবং রাগ করেছে! তিনি দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। বড় ভাইয়ের দিকে তাকালেন। নিস্তব্ধতা ভেঙে গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললেন ;
“ ভাইসাব আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল। ”
আরশাদ সাহেব নড়ে উঠলেন। স্বাভাবিক ভাবে বললেন ;
“ কি বলবে বলো।”
আজমল সাহেব বললেন ;
“ গতকালের ঘটনা নিশ্চয়ই শুনেছেন! ”
আরশাদ সাহেব মাথা দুলিয়ে বললেন ;
“ ইরফানের বিষয়টা! শুনেছি রাতে। ”
“ ইরফান চাইছে অরিত্রিকাকে শীঘ্রই বিয়ে করতে। গতকাল বিষয়টা নিয়ে তুমুল কথা-কাটাকাটি হয়েছে আমার সাথে। প্রথমে রাগ করলেও পরে সেসব অবশ্য যুক্তিসঙ্গত লেগেছে। অরিত্রিকার বয়স উনিশ বছর। কয়েকমাস পরে বিশ বছরে পড়বে। মেয়েটা ম্যাচিউর হচ্ছে ধীরে ধীরে। সাংসারিক বিষয়াদি বুঝতে শিখছে। সবদিক পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি ইরফান এবং অরিত্রিকার বিয়ে দ্রুত দিয়ে দিবো। ”
“ ইরফান এবং অরিত্রিকার দুজনের কথা শুনেছি। মেয়েটার বিয়েতে মত নেই তবুও জোর করে বিয়ে দিতে চাইছো। এটা আমি সমর্থন করি না। ”
“ ভাইসাব অরিত্রিকা আমার সিদ্ধান্তে কখনো অমত করবে না। হঠাৎ বিয়ে ঠিক করে রাখার বিষয়টা সামনে এসেছে তাই হয়তো এমন করছে। ”
“ তোমার উচিত মেয়েটার সাথে কথা বলে জানা কেনো ইরফানকে বিয়ে করবে না। তারপর না হয় বিয়ের বিষয় নিয়ে ভেবে দেখো। ”
আরশাদ সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন। আজমল সাহেব সাহেব যেন শুনেও শুনলেন না। পূর্বের ন্যায় দৃঢ় বিশ্বাসের সহিত বললেন ;
“ সেসবে দরকার নেই। আমি বলেছি ইরফানের সাথে অরিত্রিকার বিয়ে দেব, দিয়েই ছাড়ব। আপনি জানেন, আমি কখনো ওয়াদা ভঙ্গ করি না। ”
দুজনের কথোপকথনের মাঝে উপস্থিত হলো সারহান। বক্ষ টান করে দম্ভক ভঙ্গিমায় পদযুগল ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এসে বসল বাবার পাশে। বাবা এবং চাচার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকাল। অতঃপর আগ্রহসহকারে জিজ্ঞেস করল ;
“ কার বিয়ের কথা চলছে? ”
আরশাদ সাহেবের মুখাবয়ব বিবস এবং রক্তশূণ্য হয়ে গেল। তানিয়া বেগম অজানা আতংকে শিউরে উঠলেন। সাথী বেগম এবং ইসমা বেগম নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সাদাতের ওষ্ঠজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল বাঁকা হাসি। মনে মনে বলল “ চাচা আজ আপনার জেদ ছুটে পালাবে সঙ্গে আপনিও। ” আজমল সাহেব হাসার ভাণ করে বললেন ;
“ অরিত্রিকা আর ইরফানের বিয়ের কথা চলছে। ”
তিনি থেমে আরশাদ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন ;
“ ভাইসাব আগামী শুক্রবার বিয়ের দিন ঠিক করলে কেমন হয়? ”
আরশাদ সাহেব আমতা আমতা করে বললেন ;
“ তোমার যা ভালো হয় করো। ”
সাথী বেগম চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে ধপাধপ পা ফেলে এগিয়ে আসলো। স্বামীর পানে অগ্নিশর্মা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললেন ;
“ আপনি বাড়াবাড়ি করছেন কেন? মেয়েটা তো বলল ইরফানকে বিয়ে করবে না। তবে কেন জোরজবরদস্তি করে বিয়ে দিতে চাইছেন? ”
আজমল সাহেব রেগে গেলেন ;
“ তুমি চুপ থাকো সাথী। ”
“ আমি চুপ থাকব না। ”
“ আমায় রাগিয়ে দিও না। ”
তানিয়া বেগম এগিয়ে এসে সাথী বেগমের বাহু ধরে ফিসফিসিয়ে বললেন ;
“ চুপ করো সাথী। এখন মাথা গরম করে পরিস্থিতি বিগড়ে দিয়ো না। ”
সাথী বেগমের কাতর কন্ঠস্বর ;
“ কিন্তু ভাবী আমার মেয়েটা.. ”
“ তোমার মেয়ে যা চাইবে তাই হবে। আপাতত চুপ থাকো।”
সাথী বেগম চুপ হয়ে গেলেন। কিন্তু মনের উদ্বিগ্ন ভাব কমলো না। আরশাদ সাহেব এবং সাদাতের তীক্ষ্ণ এবং প্রগাঢ় চাহনি নিবদ্ধ সারহানকে দেখছে। সারহানের চক্ষুদ্বয় রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। চোখ মুখ শক্ত এবং অস্বাভাবিক। ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসছে। নাকের পাটাতন রাগে ক্রমে ফুলছে। ভাবমূর্তি গম্ভীর এবং নিরবচেতা। এহেন চাহনি দেখে বোঝা যাচ্ছে তান্ডবের পূর্বাভাস ।
অরিন বাবার মুখে ছোট বোনের অতিশীঘ্র বিয়ে কথা শুনে চমকেছে। একমুহুর্ত দেরী না করিডোর থেকে দৌড়ে লিভিং রুমে আসে। হাঁপানো ভঙ্গিমায় বলে ;
“ আব্বু তুমি একজন বুদ্ধিমান মানুষ হয়ে কেন অবুঝের মতো করছো? ”
আজমল সাহেব কপাল কোঁচকালেন ;
“ তুমি ছোট হয়ে বড়দের মধ্যে কথা বলতে এসো না। আমি আমার ছোট মেয়েকে যথেষ্ট ভালোবাসি। যা কিছু করছি ওর ভালোর জন্য করছি। ”
“ আব্বু এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে নিয়ে চাপ কেন দিচ্ছো? অরিত্রি এখনো ছোট। ”
“ আঠারো বছর পেরিয়েছে। যথেষ্ট বুদ্ধি হয়েছে। দরকার হলে আকদ করিয়ে রাখব তারপর দুই তিন বছর পর বিয়ে উঠিয়ে দেবো। এসব নিয়ে কথা বাড়িয়ো না। ”
অরিন মুখ বেজার করে গিয়ে দাঁড়ায় তানিয়া বেগমের পাশে। তানিয়া বেগম বললেন ;
“ তাড়াহুড়ো করে বিয়ে দিয়ে মেয়েটার পড়াশোনা নষ্ট করতে চাইছো? ”
আজমল সাহেব গম্ভীর কণ্ঠে বললেন ;
“ বিয়ে হলে পড়াশোনা নষ্ট হয় না। অনেকে বিয়ের পর পড়াশোনা করে এবং পড়াশোনা শেষ করে চাকরী করে। সবকিছু মনের ওপর ডিপেন্ড করে ভাবী। ”
“ যা ভালো বোঝো তাই করো। আমাদের কথার দাম তোমার কাছে নেই বুঝেছি। ”
“ আপা তোমার ছেলে কোথায়? এখনো ঘুম থেকে উঠেনি? ”
আজমল সাহেবের প্রশ্নাত্নকস্বর। ইসমা বেগম ঘাবড়ে গেলেন। তটস্থ ভঙ্গিতে মিথ্যা বললেন ;
“ ইরফান সকালে ওর বন্ধুর বাসায় গেছে। ”
আজমল সাহেবের শান্তস্বর ;
“ ওহহ। আগামী শুক্রবার বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে চাইছি তোমার মতামত কী? ”
ইসমা বেগম জড়বস্তুর ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। ললাট জুড়ে ঘাম নিঃসরণ হচ্ছে। আতংক, ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন। উত্তর দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। ভীত দৃষ্টি স্থির ভাইপোর শক্ত মুখাবয়বের দিকে। মিনমিন করে বলেন ;
“ আপনি যা ভালো বুঝেন তাই করেন। ”
“ আচ্ছা। তাহলে আগামী শুক্রবার অরিত্রিকা এবং ইরফানের আকদের দিন ঠিক করা হলো। ”
আরশাদ সাহেব হাসলেন। উপস্থিত সকলে হতাশায় জর্জরিত হলেন। কিন্তু সারহান পূর্বের ন্যায় ঠাই হয়ে নিরবে গর্জে উঠছে। তা পুঙ্খ ভাবে নজরে রাখছেন আরশাদ সাহেব। অরিত্রিকা এবং ইশরা কথোপকথনে ব্যস্ততার ভেতরে উপস্থিত হয়েছে লিভিং রুমে। ইশরা ছোট মামার এমন সিদ্ধান্তে বাকরুদ্ধ, হতবিহ্বল। অরিত্রিকা আচানক এহেন সিদ্ধান্তে সজোরে ধাক্কা খেয়েছে। সে থমকিত, স্তব্ধ এবং বিমূঢ়। কিছুক্ষণ পূর্বের কথা যেন বিষাক্ত তীরের ন্যায় বক্ষে লেগেছে। কেমন যেন অসহ্যকর চিনচিনে ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সে এলোমেলো পায়ে বাবার সামনে এগিয়ে যায়। আ’হত দৃষ্টি ফেলে ওষ্ঠ ভিজিয়ে ভারাক্রান্ত কন্ঠে বলল ;
“ আব্বু আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। এমুহূর্তে পড়ালেখায় মনোযোগী হতে চাই। ”
আজমল সাহেব রাগলেন না। বরং কোমল কন্ঠে বললেন ;
“ আকদ করিয়ে রাখব শুধু। তোমার পড়াশোনা শেষ হলে বিয়ে উঠিয়ে দেবো। এতে তোমার পড়াশোনার তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। ”
অরিত্রিকা আশাহত হয়। মুখশ্রী মলিন হয়ে আসে। সবকিছু অসহ্য লাগছে। অশান্ত মন ডেকে বলছে — “অরিত্রিকা তুই সারহান ভাইকে ভালোবাসিস সকলের সামনে বলে দে। ” অপরদিকে, মস্তিষ্ক বলছে —“ পরিবারের সবার সামনে বেহায়ার মতো ভালোবাসার কথা বলিস না। বললে সবাই তোকে নির্লজ্জ, ঠোঁটকাটা মেয়ে ভাববে। ” অশান্ত মন এবং মস্তিষ্কের নিরব দ্বন্দ্বে বেহাল অবস্থা তার। লজ্জা, বিবেকের তাড়নায় বিপর্যস্ত অবস্থা। অতি কষ্টে কথা বলার প্রয়াস চালায় কিন্তু কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসছে। ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসতে চাইছে দুর্বিপাক নিয়ে সত্যটুকু। অথচ বলতে পারে না। ভেতরে ভেতরে হাঁপিয়ে উঠে! চক্ষুদ্বয় ঘোলা হয়ে আসে। হাত – পা ঠান্ডা হয়ে আসে। মাথা ভনভন করে ঘুরছে। অরিত্রিকা থেমে থেমে শ্বাস টানে। নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। ভালোবাসার জ্বালা ক্ষণে ক্ষণে টের পেতে থাকে। এতো দ্রুত দুর্বিষহ, অসহনীয় পরিস্থিতিতে আটকে পড়বে কে জানতো। নিজেকে ধাতস্ত করে একবুক আশা নিয়ে মলিন চাহনিতে তাকায় সারহানের পানে। নিশ্চুপ এবং নির্বাক ভঙ্গিমা দেখে আশাহত হয়। এতো কিছুর পরেও চুপ করে আছে কেন মানুষটা? তবে কী পূর্বের মতো চুপ করে থাকবেন! কিছু বলবেন না! তবে কেন ভালোবাসলেন? শঙ্কিত, আতংকিত হয় অন্তঃকোণ। দিশেহারা হয়ে যায় সে।
ইসমা বেগম মৃদু হাসার ভাণ করে বললেন ;
“ ঠিক আছে ভাইসাব। ”
আজমল সাহেব হাসলেন। আরশাদ সাহেবের অবস্থা নাজেহাল। তিনি বারবার তাকাচ্ছেন ছেলের দিকে। দম্ভক ভঙ্গিমা এবং ভাবমূর্তি মোটেও সুবিধের লাগছে না। এতোক্ষণ চুপচাপ কেনো আছে? তিনি আশা করেছিলেন এক দফা ঝড়ো হাওয়া বইবে। কিন্তু নিরবতা, নিস্তব্ধতা যেন আরো আতংকিত করে তুলছে।
“ ভাইসাব মাঝখানে আর চারদিন আছে। আপনি আকদের জন্য ডেকোরেশন এবং খাবার দিকটা দেখেন। আমি বাকীটা সামলে নেবো। ”
আজমল সাহেবের মুখবিবর হাস্যজ্জ্বল এবং তৃপ্তির ছোঁয়া। আরশাদ সাহেব বললেন ;
“ বিয়ে নিয়ে তাড়াহুড়ো করা ঠিক নয়। যদি আরেকটু সময় নিয়ে ভাবতে…”
আজমল সাহেব হাস্যরত কন্ঠে বললেন ;
“ আপনি মিছেমিছি ভয় পাচ্ছেন। আমি সারারাত ভেবে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ”
আরশাদ সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেললেন। ভাইয়ের বিরুদ্ধে কিছু বলার ভাষা পেলেন না। তিনি জানেন ছোট ভাই তার একরোখা, জেদি। যা বলবে তাই করে ছাড়বে। কিন্তু ছেলের কথা ভেবে মন খারাপ লাগছে। তিনি প্রস্তাব রাখতেন বিয়ের কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে নেই। এখন যদি প্রস্তাব রাখতেন তাহলে পরিস্থিতি বিগড়ে যেত। সারহান শব্দ করে উঠে দাঁড়ায়। উপস্থিত সকলে হচকচিয়ে যায়। ইশরা দৌড়ে অরিনের কাছে আসে। খামচে ধরে হাত। ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিতে বিরবির করে বলে ;
“ আপু টর্নেডো আসতে চলেছে। ”
অরিন কৌতুহলী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে ;
“ টর্নেডো আসবে কে বলল তোকে? ”
“ আরে আপু এই টর্নেডো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না, এই টর্নেডো ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে নেওয়ার টর্নেডো। ”
“ কী আবোলতাবোল বকছিস! ”
“ আবোলতাবোল নয় সত্যি। ”
ইশরা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আওড়ায়। অরিন ইঙ্গিতপূর্ণ কথা বুঝতে পারলো না। সে মুখ গোমড়া করে সামনে তাকিয়ে রইল। তানিয়া বেগমের মুখে শঙ্কা স্পষ্ট। তিনি বুঝতে পেরেছেন এ মুহুর্তে কী ঘটতে পারে। অপরদিকে, সাদাত লাফিয়ে পেছনে সরে গেল। তার বুঝতে বাকী নেই কী ঘটতে চলেছে। সারহান এগিয়ে এসে আজমল সাহেবের সামনে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলে ;
“ এ বিয়ে হবে না। ”
আজমল সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। চোখ গরম করে বললেন;
“ কী বললে? ”
সারহানের ক্রোধের মাত্রা বাড়ে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ রেখে পুনরায় বলে ;
“ অরিত্রিকা এবং ইরফানের বিয়ে হবে না, আমি হতে দেব না। ”
পুরুষালী কন্ঠ হতে ভেসে এলো তীক্ষ্ণ, ধারালো অ*স্ত্রের ন্যায় গর্জে উঠা হিমশীতল দৃঢ় কন্ঠস্বর। চক্ষুদ্বয় অতিশয় শান্ত এবং অস্বাভাবিক। পুরু ভ্রুযুগল কুঁচকানো। মুখাবয়ব অস্বাভাবিক কঠোর। চিবুক শক্ত। বক্ষপট দৃঢ়তা এবং কঠোর খোলসে মোড়ানো। চৌধুরী বাড়ির সকলের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল শব্দগুচ্ছ। সকলে স্তব্ধ হয়ে গেল যেন। এ মুহুর্তে এহেন কথা বলবে সারহান কেউ ভাবেনি। শুধু সাদাতের ওষ্ঠজুড়ে বিরাজ করছে মিটিমিটি হাসি। মনে মনে ভাবছে “ সারহান ভাই রকড বাকি সবাই শকড। ”
আজমল সাহেব গমগমে কন্ঠে বললেন ;
“ এসব কী বলছো? তুমি বিয়ে হতে দেবে না কেন? ”
সারহান শক্ত কন্ঠে বলল ;
“ কারনটা আপনি খুব ভালো করে জানেন চাচা। ”
আজমল সাহেব থমথমে গলায় বললেন ;
“ মানে? ”
ইসমা বেগম থরথরিয়ে কেঁপে উঠলেন। মুখ ফ্যাকাসে। এক অদৃশ্য আতংকে সিঁটিয়ে গেলেন। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন আরশাদ সাহেবের কাছে। ভয়ার্ত কন্ঠে বললেন ;
“ ভাইসাব সারহানকে থামান। ও যদি মুখ খোলে সব শেষ হয়ে যাবে। ”
আরশাদ সাহেবের কপাল অবাক হলেন ছোট বোনের কথা শুনে। জিজ্ঞেস করলেন ;
“ সারহান মুখ খুললে কী হবে? আর তুমি ভয় পাচ্ছো কেন ইসমা? ”
ইসমা বেগমের কপাল দরদর করে ঘামছে। বড় ভাইয়ে কথায় হচকচিয়ে উঠলেন। বুঝতে পারলেন মুখ ফসকে ভুলভাল বলে ফেলেছেন৷ হাসার ভাণ করে বললেন ;
“ ভাইসাব বিয়ে যেহেতু ঠিকঠাক তাহলে সারহান হুট করে বিয়ে ভাঙার কথা বলে পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে চাইলে। ওকে থামান। ”
আরশাদ সাহেবের মুখ গম্ভীর হয়ে এলো ;
“ সারহান তুমি বিয়ের বিষয় নিয়ে কোনো কথা বলো না। তোমার চাচা যা করতে চাইছে করতে দাও। ”
সারহান বাবার দিকে র*ক্তচক্ষু চাহনিতে তাকাল। ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ আপনাকে গতকাল রাতে বলেছিলাম। আমি আমার রাস্তা নিজে ক্লিয়ার করব আপনি কিন্তু কিছু বলতে আসবেন না। তাহলে আজ কেন বলছেন?”
আরশাদ সাহেবের মুখখানা চুপসে গেল। আজমল সাহেব বড়ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কৌতুহল নিয়ে বললেন ;
“ কীসের রাস্তা ক্লিয়ার ভাইসাব?”
আরশাদ সাহেব বিপাকে পড়ে গেলেন। ইনিয়েবিনিয়ে বললেন ;
“ আসলে সারহান একটা কাজ করতে বলেছিল আমায় কিন্তু ব্যস্ততায় কাজটা করিনি তাই বলছে আরকি। ”
“ কিন্তু আপনার ছেলে অরিত্রিকা আর ইরফানের বিয়ে কেন হতে দেবে না?”
সারহান পুরূ কন্ঠে বলল ;
“ চাচা, আমি থাকতে অরিত্রিকার বিয়ে অন্য কোথাও হবে না, আমি হতে দেবো না। ”
আজমল সাহেব ক্ষেপে গেলেন ;
“ আমার মেয়ের বিয়ে আমি কোথায় দিবো, না,দিবো সেটা আমার ব্যাপার। তুমি কেন আমার বিয়ে ভাঙতে চাইছো? কারণ কী? ”
সারহান একপলক অরিত্রিকার মিইয়ে যাওয়া, ভয়ার্ত, আতংকগ্রস্থ মুখখানার দিকে নজর ফেলল। মেয়েটা আকুলতা নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। অতঃপর সূঁচালো দৃষ্টি স্থির করে। আরশাদ সাহেব হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে গেলেন ছেলের দিকে। প্রশস্ত কাঁধে হাত রেখে চাপা স্বরে বললেন ;
“ সারহান চুপ করো। তোর চাচার সাথে আমাদের সম্পর্কটা ভাঙো না। ”
সারহানের নির্লিপ্ত এবং দৃঢ় কন্ঠস্বর;
“ তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমার কাজে বাঁধা দিও না তুমি। ”
“ বোঝার চেষ্টা করো। ”
“ সব কিছু আয়ত্ত্বের বাইরে চলে গেছে। এখন বুঝে লাভ নেই। ”
আরশাদ সাহেব হতাশ হলেন। কিছুটা পিছিয়ে এসে দাঁড়ালেন। সারহান তীক্ষ্ণ চাহনি আজমল সাহেবের দিকে স্থির রেখে স্বভাবসিদ্ধ রুক্ষতা নিয়ে উচ্চস্বরে বলল ;
“ বিয়ে কেন হতে দেবো না জানেন? কারণ আমি অরিত্রিকাকে বিয়ে করতে চাই।”
আরেকদফা থমকাল চৌধুরী বাড়ির সকলে। স্তম্ভিত হয়ে উৎসুক ভঙ্গিমায় হতবাক দৃষ্টিতে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। সাদাত ভাইয়ের মুখে কথাটি শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে লাফিয়ে উঠল। ইচ্ছে করল চিৎকার করে গান গাইতে। কিন্তু এই মুহুর্তে গান গাওয়া যাবে না। গাইলে পিঠে দু’চারটা পিটানি পড়বে। অরিত্রিকার অন্তঃকোণ শীতল হয়ে গেল। চমকিত, থমকিত অবিশ্বাস্য ভঙ্গিতে আঁখিদ্বয় কয়েকবার ঝাপটালো। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অবশেষে কল্পপুরুষ মুখ খুলল। অজানা ভয় এবং আনন্দে সংমিশ্রণে বুক ভারী হয়ে আসে। চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠে। আচমকা কথায় নড়বড়ে হয়ে গেল তার পদযুগল। পিছিয়ে পড়ে যেতেই তানিয়া বেগম ছুটে গিয়ে ধরলেন। দুহাতে আগলে নিলেন বক্ষে।
আজমল সাহেব বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। স্তম্ভিত, থমকিত দৃষ্টি স্থির হয়ে আছে। ভাষাশূন্য কন্ঠনালী! মস্তিষ্ক বিপর্যস্ত, নির্বাক। আরশাদ সাহেব কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কন্ঠনালী রোধ! হতাশ এবং আশ্চর্যিত। বড় ছেলের সাহসে তিনি হতবাক। সাথী বেগম একের পর এক ঘটনায় স্তব্ধ হয়ে গেছেন। মুখে যেন কোনো কথা নেই। সারহান এমন কিছু বলবে তা ছিল কল্পনার বাহিরে। অরিন নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে আছে। ইশরা ঝটকা খেয়েও স্বাভাবিক আছে। সে চারিদিক তাকিয়ে সবার অবস্থা দেখে। অতঃপর ফিসফিসিয়ে বলে ;
“ টর্নেডো চলে এসেছে আপু। ”
অরিন যান্ত্রিক কন্ঠে বলে ;
“ সারহান ভাই অরিত্রিকাকে ভালোবাসে? ”
“ হ্যা আপু। শুধু সারহান ভাই নয় অরিত্রিকা ভালোবাসে। ”
অরিন বাকরুদ্ধ। আজমল সাহেব নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন কঠোর গলায় বললেন ;
“ এসব কি বলছো তুমি? অরিত্রিকার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তাও বেয়াদবের মতো কথাবার্তা বলছো। ”
সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“ বিয়ে ঠিক হয়েছে, বিয়ে এখনো হয়নি। আমি এসব কথা কেন বলছি আপনি নিশ্চয়ই জানেন। তবে কেন বুঝেও না বোঝার ভাণ করছেন। ”
আজমল সাহেব যেন ক্ষুব্ধ হলেন ;
“ তোমার সাহস কী করে হলো অরিত্রিকাকে বিয়ে করার কথা বলার? ”
“ আমার সাহসের এখনো কিছুই দেখেননি চাচা। ”
“ বিয়ে করবে বলার মতো দুঃসাহসিক কথা কীভাবে বলতে পারলে? একবারে মুখে বাঁধে নি? ”
অরিত্রিকার ভয়ে গুটিশুটি মে*রে তানিয়া বেগমের বক্ষে পড়ে রয়। আসন্ন তান্ডবের পূর্বাভাসে বক্ষ ধরফর করে উঠে। শঙ্কা, আতংকে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। ভীত পানে সংকুচিত নয়নে সারহান এবং আজমল সাহেবের দিকে তাকাচ্ছে।
সারহান সটান হয়ে দাঁড়িয়ে কাষ্ঠপিষ্ঠ স্বরে জবাব দেয় ;
“ না বাঁধে নি। আমি ফাইরুজকে ভালোবাসি এবং বিয়ে করতে চাই। আমি ছাড়া ফাইরুজ অন্য কারো বউ হবে না। ”
আজমল সাহেবের হতচকিত হয়ে গেলেন। বড় ভাইয়ের ছেলের একরোখা মনোভাব যেন বিহ্বলিত করছে প্রতিনিয়ত। রাগ,বিস্ময়ে জর্জরিত তিনি।
সারহান এক পলক তাকায় অরিত্রিকার দিকে। পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকায় আজমল সাহেবের দিকে। ক্ষোভ,রাগ মিশেল কন্ঠে চিল্লিয়ে বলল ;
“ আমার অনুভূতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন আপনি। অথচ আপনি ইচ্ছাকৃত অরিত্রিকার সাথে ইরফানের বিয়ে ঠিক করেছিলেন। আমার অপরাধ কী ছিল বলুন? জানি উত্তর দিবেন না । সবার সামনে আপনার উত্তর আমি দিয়ে দিচ্ছি। কারণ হলো রাজনীতি। আমি রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম তাই আপনি এবং আপনার বোন মিলে আমার ভালোবাসা কেড়ে নেওয়ার নিখুঁত চক্রান্ত করেছিলেন। বলতে গেলে সফলও হয়েছিলেন! আমি আপনাদের স্বার্থে ভালোবাসার মানুষ ত্যাগ করেছিলাম। আপনারা আমায় বাধ্য করেছিলেন। কিন্তু দিন শেষে আপনারা নির্বোধ প্রমাণিত হয়েছেন। আপনারা ভুলে গিয়েছিলেন সারহান ইদায়াত চৌধুরী এতো সহজে তার ফাইরুজকে ভুলবে না, ছাড়বে না। ”
সারহান থেমে পূর্বের ন্যায় বলে ;
“ আপনি এবং আপনার বোন আমার গুরুজন তাই কিছু বললাম না। অন্য কেউ হলে তাদের সারহান কি জিনিস দেখিয়ে দিতাম। ”
আরশাদ সাহেব আঁতকে উঠলেন। সারহানকে উদ্দেশ্য করে বললেন ;
“ এসব তুমি কি বলছো? পাগল হয়ে গেছো? ”
সারহানের কপালের মধ্যাংশে ভাজ পড়ে। বজ্রকন্ঠে হুংকার ছেড়ে বলে ;
“ যা সত্যি তাই বলছি। ”
“ সারহান শান্ত হও। ”
“ বাবা, তুমি কথা বলো না। তোমার ভাইকে আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই ফাইরুজ শুধু সারহান ইদায়াত চৌধুরীর বউ হবে আর আগামী শুক্রবার আমার এবং ফাইরুজের বিয়ে হবে। ”
সারহান স্পষ্ট করে বলল। আজমল সাহেব শুনে চিৎকার করে বললেন ;
“ অসম্ভব। তোমার সাথে আমার মেয়েকে বিয়ে দেবো না। ”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৪৭
সারহান বাঁকা হাসে। কয়েক কদম এগিয়ে অরিত্রিকার সামনে দাঁড়ায়। অতি শান্ত কন্ঠে বলে ;
“ আমাকে ভালোবাসিস ফাইরুজ? ”
সকলে হতবাক নেত্রে তাকালো সারহান অরিত্রিকার দিকে। বিস্ময়াভূত মনোভাব। অরিত্রিকা কেঁপে উঠে। বক্ষস্থল অশান্ত হয়ে যায়। সে তানিয়া বেগমের বক্ষ থেকে মাথা উঁচিয়ে অবাক চাহনিতে তাকায় সামনে দন্ডায়মান মানুষটির দিকে।