প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৩
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকার কর্ণকুহরে প্রবেশ করল সারহানের বলা কথাটি। কিন্তু সে প্রতিক্রিয়া স্বরুপ নিশ্চুপ রইল। লজ্জায়, অস্বস্তিতে জর্জরিত মুখখানা তখনো নিবদ্ধ মেঝেতে। চঞ্চল মন এবং সত্তা অশান্ত। মনে চাপা উত্তেজনার ঝড় নিয়ে কাঠখোট্টা গম্ভীর মানুষটাকে চরম অসভ্য উপাধিতে ভূষিত করল মেয়েলী মন। একটা সুশীলা মেয়ের সামনে উন্মুক্ত শরীরে বসে থাকা এবং তা নিয়ে খোঁচা দিয়ে কথা বলে বোঝানো মোটেও ভদ্র ছেলের কর্ম নয়। কিয়ৎ সময় ওমন অবতারে দেখলে নিশ্চিত শ্বাসকষ্টের রোগীর ন্যায় হাঁপাতে হাঁপাতে দম আঁটকে অক্কা পেয়ে চান্দের দেশে পাড়ি জমাতো। তখন নিউজ চ্যানেলে শিরোনাম হতো — উনিশ বছরের এক রমণী এমপির শ্যামবর্ণের উন্মুক্ত শরীর দেখে দম বন্ধ হয়ে তাতা থৈথৈ করে অক্কা পেয়েছে। ইশ!
কী জ*ঘন্য ব্যাপারখানা হতো। তার মান সম্মান সব ধূলোয় লুটোপুটি খেত। খানিকটা উৎকন্ঠা চেপে রাখল নিজের মাঝে। আপাতত কোনো প্রকার বাক্য ব্যয় করা যাবে না। সে ভদ্র নম্র মেয়ের ন্যায় ঠাই হয়ে দাঁড়িয়ে রইল যেন শ্যামমানব বুঝতে না পারে তার মেয়েলী সত্তার উত্থান-পতন। অনুভূতিরা বড্ড দিশেহারা,ছন্নছাড়া পাখির ন্যায়। বক্ষপিঞ্জর ব্যাকুল প্রায় অবাধ্য অনুভূতির স্পর্শে। এহেন বিব্রতকর ক্ষণকালে নিজেকে সামলে নেওয়া অতিব জরুরী। নয়তো বড়সড় অঘটন ঘটবে। যা মোটেও ভালো হবে না। সে লম্বা করে শ্বাস টেনে নিল। ওষ্ঠকোণে বিরাজমান লাজুক হাসি ক্রমশ কমে এলো। মুখাবয়বে স্পষ্ট ফুটে উঠল অস্বস্তি ভাব। সারহান ঈষৎ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। অনুমান করে নিল মেয়েলী সত্তার উত্তাল হৃদগহ্বরের লুকায়িত অনুভূতির ফোয়ারা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কফিটা অনেক বেশী তেঁতো লাগছে। এতে উল্টোপাল্টা কিছু মিশিয়ে আনিস নি তো?”
সারহান কফি নিয়ে আয়েশ করে বসেছে ডিভানে। ভাবমূর্তি অতি শান্ত। কন্ঠস্বর স্বাভাবিক। অরিত্রিকা অস্বস্তি ভাব ঠেলে সরাসরি তাকাল সামনে বসে থাকা মানুষটার দিকে। হতভম্ব হয়ে বলল ;
“শুধু কফি পাউডার মিশিয়েছি পানিতে আর কিছু মেশাইনি আমি।”
সারহান ঘাড় বাকিয়ে জানালার গ্লাস ভেদ করে বাহিরে তাকাল। তীক্ষ্ণ এবং প্রখর চাহনি। বাহিরে দমকা বাতাস বইছে। ভেসে আসছে মেঘপুঞ্জের গুরুমগুরুম শব্দ। হয়তো বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষণ পরে। সে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তাকায় অরিত্রিকার দিকে। শান্ত কন্ঠে বলে;
“বিশ্বাস না হলে খেয়ে দেখ।”
অরিত্রিকার মুখ ভার হয়ে এলো। বিরস কণ্ঠে বলল;
“হয়তো কফি পাউডার বেশী পড়ে গেছে। আবার কফি বানিয়ে আনবো?”
“দরকার নেই।এদিকে আয়।”
অরিত্রিকা বিলম্ব না করে এগিয়ে গেল। একদম সারহানের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আগ্রহী হয়ে তাকিয়ে রইল মানুষটার মুখপাণে। সারহান হাতে থাকা কফির মগটি বাড়িয়ে দিয়ে দৃঢ় কন্ঠে বলল ;
“নাউ ড্রিংক ইট।”
অরিত্রিকা আশ্চর্যিত হলো। সে কফিটা খাবে? তেঁতো করলার মতো কফিটা গিলে খেতে হবে? এ কেমন শাস্তি! ছোট্ট জীবনে কীসের শাস্তি ঘাড়ের ওপর এসে পড়ল? তার হাত পা ছুড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হলো। কেন কফিটা বানাতে গেল? সেধে এসে তেঁতো কফিটা দিতে এসে বিপদে পড়ে গেল। চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে এসেছে। মন বিদ্রোহ করে বলছে— অর্ধ অক্কা না পেতে চাইলে কাঠখোট্টা স্পেশাল গোমড়ামুখো কফি খাস না। এখান থেকে দ্রুত পালিয়ে নিজেকে বাঁচা। সেও নিরবে পণ করল অদ্ভুত কফিটা ছুঁয়ে এবং তাকিয়ে দেখবে না। সারহান ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা করল নেওয়ার জন্য। সে তীক্ষ্ণ, ধারালো চোখের চাহনিতে চমকে গেল। অনিচ্ছায় স্বত্বেও হাত বাড়িয়ে নিল কফির মগটা। মুখ কুঁচকে তাকাল পোড়ামুখো তেঁতো কফিটার দিকে। নিজের প্রতি করুণা হলো। এটা খেলে কি তার পেটটা সুস্থ থাকবে? নাকি অচিরে পেটের গরবরে অসুখে পড়বে?
“চুপচাপ দাঁড়িয়ে না থেকে খা।”
সারাহানের গম্ভীরকন্ঠে ভাবনার ছেদ ঘটে। কিঞ্চিৎ চমকে উঠে। নিজের প্রতি মায়া ছেড়ে কাঁদো কাঁদো মুখ করে সাহসী ভঙ্গিমায় ওষ্ঠদ্বয় ছুঁইয়ে চুমুক দিল কফিতে। কফি গলা অব্দি নামতেই তেঁতোর কারণে মুখাবয়ব পাংশুটে হয়ে গেল। মগ থেকে ওষ্ঠদ্বয় বিচ্ছেদ ঘটিয়ে খুক খুক করে কেশে উঠল। কি বিচ্ছিরি খেতে! এসব কোন পাগলের খায়? কোনো স্বাদ নেই। মনে হচ্ছে ভিন্নগ্রহের প্রাণীর খাবার খেয়েছে। তবে কেন যেন মনে হলো কফিটা তেঁতো হলেও ঠিক আছে। অতিরিক্ত তেঁতোভাব নেই। তবে কেন সারহান ভাই মিথ্যা বলল? সারহান গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“কফির মগটা এবার আমায় দে।”
অরিত্রিকা যেন শুনলনা। সারহান উঠে ছো মে*রে কফির মগটা নিয়ে পুনরায় বসল ডিভানে। অরিত্রিকা চমকে উঠল। তটস্থ ভঙ্গিতে তাকাল সারহানের দিকে। পুরুষালী ওষ্ঠদ্বয় তখন ছুঁয়ে গেছে কফি মগে। লম্বা চুমুক দিয়ে অর্ধেক কফি শেষ করার দৃশ্য বিস্মিত হয়ে দেখল। এটা কী হলো? সারহান পায়ের ওপর পা তুলে বসে। কফির মগটা টি টেবিলে রাখে শব্দ করে। অতঃপর ঠান্ডা স্বরে বলল ;
“কফিটার স্বাদ অন্যরকম লাগল। কেমন যেন মিষ্টি মিষ্টি স্বাদ।”
অরিত্রিকা অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে সন্দিহান কন্ঠে বলল;
“ মিষ্টি!আমি তো খেয়ে দেখলাম তেঁতো।”
“তোর ঠোঁটের ছোঁয়ায় মিষ্টি হয়ে গেছে।”
“আপনি আমার সাথে ফ্লার্ট করছেন?”
সারহান নিঃশব্দে হেসে। অরিত্রিকা অবাক হয়ে গেল। এই মানুষটা এতো ধূর্ত কেন? ইচ্ছাকৃত তাকে বিদঘুটে কফিটা খাওয়ালো। সে মুখ গোমড়া করে কটমট করে তাকিয়ে রইল। সারহান উঠে আসল। দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। বাঁকা হেসে বলল;
“ফ্লার্ট করছি না, সত্যি বলছি।”
অরিত্রিকা বোকা বনে গেল। ভাবল, মেয়েদের ঠোঁটে কি সত্যি মিষ্টিজাতীয় কোনো দ্রব্য থাকে? কখনো বইয়ে এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাই নি। নিশ্চিত কাঠখোট্টা মানুষটা তাকে মিথ্যা কথা বলছে। সে মেকি রাগ দেখিয়ে বলল ;
“আপনি আমার সাথে মজা করছেন?”
সারহান দুরত্বটুকু সন্তপর্ণে মিটিয়ে নিল। কপাল কুঁচকে স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল;
“নোপ! আমার মজা করার অভ্যেস নেই।”
সারহান সন্নিকটে আসায় অরিত্রিকা হচকচিয়ে গেল। লজ্জা এবং অস্বস্তিতে জর্জরিত হয়ে গেল সে। রাগটুকু বিসর্জন দিয়ে কোনো মতো বলে উঠল;
“দেখুন!”
সারহানের মাঝে কোনো হেলদোল নেই।সে তীক্ষ্ণ চাহনি তাকিয়ে আছে মেয়েলী মুখশ্রীতে। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল;
“দেখা।”
“সারহান ভাই আপনি কিন্তু অসভ্যের মতো আচরণ করছেন।”
“তোর কাছে অসভ্য হওয়াই যায়। আফটার অল তুই আমার হবু বউ।”
“আপনার এক অঙ্গে কতো রুপ সারহান ভাই। আপনি খানিকটা পিছিয়ে দাঁড়ান। আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি।”
অরিত্রিকা শুকনো ঢোক গিলে বলল। সারহান আচমকা অরিত্রিকাকে এক হাত দ্বারা বাহু বন্ধনে আবদ্ধ করল। অন্য হাত রাখল গালে। মেয়েলী শরীরটা খানিকটা কেঁপে উঠল। বিস্ফোরিত নয়নে তাকাল শ্যামমানবের মুখপানে। অবিশ্বাস্য ভঙ্গিমায় নেত্রপল্লব ঝাপটাল। তখনি অতি শান্ত কন্ঠের পুরুষালী কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল।
“একটু সাহসী হওয়া দরকার তোর। মাত্র তিনদিন বাকী আকদের। তারপর তুই শুধু আমার হবি। রাতে যদি সামান্য কাছে আসি তখন ভয় পেয়ে চেতনা হারিয়ে রুমে পড়ে থাকলে বাড়িতে সবাই কি ভাববে? নিশ্চিত ভাববে আমি তোর সাথে উল্টোপাল্টা করার চেষ্টা করেছি তাই জ্ঞান হারিয়েছিস।তোর ভয়ের কারণে বাড়ির সবার কাছে আমার মান সম্মান সম্মান নিয়ে টানাটানি বেঁধে যাবে। তাই ভয়, কাঁপাকাপি অভ্যাস বাদ দে। ”
অরিত্রিকা হাস ফাঁস করে উঠল। লজ্জায় ফর্সা গাল দুটো গরম হয়ে গেল। লালচে আমায় ছেয়ে গেল মুখশ্রী। অশান্ত মন বলে উঠল— তোর কল্পপুরুষ চরম অসভ্য অরিত্রিকা। যাকে শুদ্ধ, নম্র ভদ্রে র আসরে বসিয়ে সাহস করে রুমে এসেছিস — সে তেমন নয়। এ মুহুর্তে এখানে থাকিস না অরিত্রি। তোর জন্য সময়টা মোটেও সুবিধার নয়। সে মানুষটার হাত ছাড়িয়ে পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। হাতের বাঁধন যেন দৃঢ় হলো। গম্ভীর মানুষটার পুরুষালী বক্ষে মিশে গেল। নাসিক্যরন্ধ্রে প্রবেশ করল পরিচিত পুরুষালী ঘ্রাণ। মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল। বক্ষস্থল তখন বেসামাল অনুভূতির তান্ডবে বিপর্যস্ত। কেঁপে কেঁপে উঠছে অন্তঃস্থল। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করল। খানিকটা উঁচু কন্ঠে বলল ;
“আমি রুমে যাব।”
অরিত্রিকার গালে পুরুষালী অমসৃণ হাতের স্পর্শ দৃঢ় হলো। নিচু কন্ঠে শুধালো ;
“আমায় ভয় পাচ্ছিস?”
অরিত্রিকা তৎক্ষনাৎ জবাব দিতে পারল না। থরথরিয়ে কেঁপে উঠল। পরক্ষণে অন্যত্র দৃষ্টি ফেলে ওষ্ঠ ভিজিয়ে মিনমিন করে বলল ;
“উহু।”
“তবে?”
“তিশা, রাহা এসেছে। ওরা দুজনে অপেক্ষা করছে আমার জন্য।”
“আজকের মতো ছেড়ে দিলাম তোকে। বিয়ের পরে ছেড়ে দিতে বললে সহজে ছাড় পাবি না আগেই বলে দিলাম।”
সারহান মৃদু হেসে বলল। কন্ঠস্বর অদ্ভুত। অরিত্রিকা চকিত নয়নে তাকাল মানুষটির দ্বিধাহীন, স্বাভাবিক মুখপানে। লজ্জা, অস্থিরতায় স্বাভাবিক থাকা দায় হয়ে পড়ল। থরথর করে কেঁপে উঠল শরীর। নিজেকে আড়ষ্টতায় গুটিয়ে নিল। সারহান গভীর নয়নে পরখ করল মেয়েটার ভাবমূর্তি। বেগতিক অবস্থা দেখে অতঃপর অরিত্রিকাকে ছেড়ে দিয়ে টাউজারের পকেটে দুহাত রেখে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। অরিত্রিকা ছাড়া পেয়ে কোনোদিক না তাকিয়ে ছুটলো রুমের দিকে। সারহান অপলক চেয়ে রইল সেদিকে। ওষ্ঠকোণে ফুটে উঠল ফিচেল হাসি। ফাইরুজের ভয়ার্ত মুখশ্রী তাকে ভীষণ টানে।
লিভিং রুমের সোফায় হেলান দিয়ে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে বসে আছে ইশরা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে থেমে থেমে। হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। সেই মোহনীয় দৃশ্য অপলক চেয়ে আয়েশ করে বসে দেখছে সাদাত। চক্ষুদ্বয়ে মুগ্ধতার ভীড়। ভালোলাগা, ভালোবাসার সংমিশ্রণে জন্ম নিয়েছে অদ্ভুত অনুভূতি। অজ্ঞাত এ অনুভূতির নাম কি? প্রণয়, মায়া নাকি মোহ? সে জানে না। এ অনুভূতি তার কাছে একদম নতুন। পূর্বে অজানা, নামহীন অনুভূতির সাথে পরিচয় হয়নি সে। এসব ছাপিয়ে মস্তিষ্ক হানা দিল আকর্ষণ শব্দটি। কেমন যেন অসহনীয় ঠেকল। খানিকটা বিরক্ত হলো। একজন ছেলে একজন মেয়ের প্রতি আকর্ষিত হয় বয়স কিংবা জৈবিক আলোড়নে। কিন্তু সাদাত মনে মনে ঘোর বিরোধীতা করল শব্দটির। আকর্ষণ হলে এক -দেড় মাসে ছুটে যেত। তেমনটা হয়নি— হওয়ার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। শুধু সে চায় ইশরা তার হোক সারাজীবনের জন্য। প্রথম থেকে অনুভব করেছে মেয়েটাকে তার ভালোলাগে। এর থেকে বেশী কিছু নয়। কখনো মেয়েটাকে খারাপ নজরে বা চিন্তায় রাখেনি। প্রতিবার কথা চলন- বলনে মুগ্ধ হয়েছে। প্রথম থেকে বক্ষপিঞ্জরে এক অদৃশ্য টান অনুভব করেছে। প্রতিটা ক্ষণ মস্তিষ্ক জুড়ে ইশরা নামক মেয়েটা ঘুরেছে। এই তো এখনো ঘুরছে। তবে বয়স নামক বেড়াজালে আটকেছে সে। আগামীকাল তার জন্মদিন বিশ বছর পূর্ণ হয়ে একুশ বছরে পড়বে। এ বয়সে ভালোবাসা নামক কঠিন অসুখে ভোগা যেন অকল্পনীয় এবং অবিশ্বাস্য । সাদাত দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। বিরবির করে বলে উঠল ;
“আমি জানিনা, প্রণয়, মোহ এবং মায়া কী। তবে এতটুকু জানি, তোকে আমার চাই ইশু, সারাজীবনের জন্য নিজের করে চাই।”
ইশরা নড়েচড়ে উঠল তখনি। পিটপিটিয়ে ঘুমু ঘুমু চক্ষুদ্বয় মেলে সোজা হয়ে হয়ে বসল। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল সাদাতের দিকে। সাদাত তখন নিশ্চুপ। তবে পূর্বের ন্যায় তাকিয়ে রয়েছে কোনো হেলদোল নেই। সে কপালে ভাজ ফেলে শুধায় ;
“মাথা ব্যথা কমেছে?”
সাদাত মাথা দুলিয়ে মৃদু হেসে বলল;
“হ্যা কমেছে। তো মিস ইশরা শেখ ঘুম কেমন হলো?”
ইশরা নড়েচড়ে বসল। হাসার ভাণ করে বলল;
“ একদম ফার্স্ট ক্লাস। কখন তোর মাথা টিপে দেওয়ার সময় ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতে পারিনি। বেশীক্ষণ ঘুমিয়েছি?”
“নাহ। মাত্র আধাঘন্টা ঘুমিয়েছিস।”
“ওহহ আচ্ছা।উমম তুই বিরবির করে কি বলছিলি?”
“প্রণয়,মায়া এবং মোহ নিয়ে রিসার্চ করছিলাম।”
সাদাত দ্বিধাহীন সহজ ভাষায় স্বীকারোক্তি দিল। ইশরা বিস্মিত হলো। ভ্রুকুটি নাচিয়ে বলল ;
“ভালোবাসা বিশেষজ্ঞ হওয়ার চেষ্টায় আছিস নাকি সাদাত?”
সাদাত হাসল ;
“আরে নাহ। প্লে বয় থেকে প্রেমিক হওয়ার জন্য চেষ্টা করছি।”
“কার প্রেমিক? নতুন আবার কাকে জুটিয়েছিস?”
“গতকাল রাতে যার কথা বলেছিলাম তার।”
সাদাত নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল। ইশরার মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল। সন্দিহান কন্ঠে বলল;
“এই তোর হাবভাব একদম সুবিধার লাগছে না আমার। প্রেমিক মহাশয়ের রিসার্চের ফলাফল কী বের হলো? ”
শেষোক্ত কথাটি খোঁচা দিয়ে বলল।সাদাত তা স্পষ্ট বুঝতে পারল। বেজায় বিরক্ত হলো। তবুও মেজাজ সামলে বলল;
“তোকে বলার কোনো ইচ্ছে নেই।”
“ওমা কেন?”
“বললে নিশ্চিত তুই আমার কথা নিয়ে মজা করবি।”
“আমাকে অবিশ্বাস করিস বুঝেছি। আমি প্রমিজ করলাম তোর কথা নিয়ে মজা করব না। এবার দ্রুত বল।”
ইশরা উৎকন্ঠিত ভাব নিয়ে বলল। সাদাত ভেবেছিল বলবে না। কিন্তু কেন যেন ইচ্ছে হলো কিছু কথা বলতে। ভাবমূর্তি স্বাভাবিক করে শান্ত কন্ঠে বলল;
“জানিস, প্রেম, ভালোবাসার নাকি বয়স মানে না। এসবের ক্ষেত্রে বয়স সংখ্যা মাত্র। বয়সকে উপেক্ষা করে মনের ভাবাবেগকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমার ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটেছে। বয়সকে উপেক্ষা করে মনের ভাবাবেগকে প্রাধান্য দিয়ে বসলাম।ছন্নছাড়া, বাধনছাড়া অবাধ্য মনটা হঠাৎ কাউকে দেখে থমকাল, ভালোলাগল। ধীরে ধীরে ভালোলাগা গাঢ় হলো। দৃঢ় হলো অনুভূতি। ভালোলাগার থেকে বেশী কিছু হয়ে গেল কয়েকদিনে। হয়তো ভালোবাসা নামক মোহে পড়ছিলাম। প্রশ্ন আসে,একটা বিশ বছরের ছেলে ভালোবাসার কী বোঝে? আমার ভাষ্যমতে, এ বয়সের ছেলে মেয়েরা ভালোবাসা কী না বুঝে ফ্যান্টাসিতে ভোগে। অতঃপর ভালোলাগা, আকর্ষণের নাম রেখে দেয় ভালোবাসা। আমিও প্রথমে তেমনটাই ভাবলাম। কিন্তু আমার ধারণা ভুল করে দিয়ে অবাধ্য অনুভূতিরা গর্জে উঠে বিরোধীতা করে বলল— তোর মতো প্লে বয় টাইপ ছেলে এক নম্র ভদ্র সুন্দরী মেয়ের প্রেমে পড়েছে।
আমি সেসব কথা মানলাম না। মনে ভাবনাগুলো চাপা দিয়ে নিজের মতো চলতে লাগলাম।কিন্তু ধীরে ধীরে বুঝতে পারলাম আমি সত্যি তাকে পাওয়ার জন্য ছটফট করছি, নিজের অজান্তে ভালোবেসে ফেলছি, তাকে ভাবতে ভাবতে নিদ্রাহীন রাত কাটাচ্ছি । সেই মেয়েটিকে ছাড়া জীবনটা অসহ্য লাগতে শুরু করল। নিজেকে কেমন যেন উন্মাদের ন্যায় মনে হতো। পরক্ষণে ভাবলাম, নম্র ভদ্র মেয়েটার থেকে দূরে থাকব। তাহলে হয়তো এসব অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবো। তেমনটা করার চেষ্টা করলাম। তাকে ভোলার জন্য অন্য মেয়েদের সাথে কথা বললাম। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। উল্টো পূর্বের তুলনায় বেশী আসক্ত হয়ে গেল। আমার অবাধ্য মন ততদিনে ঘোষণা করে দিয়েছে — তোর মনে চলমান তান্ডব আকর্ষণ নয় বরং ভালোবাসা। মেয়েটাকে সারাজীবনের জন্য নিজের করে নে সাদাত। কারণ তুই সত্যি তাকে ভালোবাসিস।”
ইশরা হতবাক হয়ে শুনল। স্তম্ভিত নয়নে তাকিয়ে রইল সাদাতের দিকে। এতোক্ষণে বলা কথাগুলো যেন সত্য মনে হলো। কোনো কথায় মিথ্যার কোনো আভাস নেই। এ বয়সে সত্যি কি ভালোবাসা সম্ভব? মেয়েটা কে? নানা ভাবনায় বিভোর হয়ে পড়ে সে। কৌতুহলী ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করে ;
“ মেয়েটা কে সাদাত?”
সাদাত প্রাণখুলে হাসে ;
“মেয়েটা আমার আশেপাশে আছে। এই তো আমার কাছে, মনের মাঝে। কল্পনায়,বাস্তবে সব জায়গায় তার বিচরণ।”
ইশরা বিভ্রান্ত হয়ে গেল। ছেলেটার কথার আগামাথা খুঁজে পেল না সে। মুখ ভার করে বসে রইল। সাদাত হাসি থামিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলল;
“কখনো কখনো অব্যক্ত কথার মাঝেও উত্তর খুঁজে নিতে হয় ইশরা। সবসময় অপর পাশের মানুষটার মনের কথা ব্যক্ত করার সাহস হয়ে ওঠে না।”
সাদাত কথাটা বলে হেলেদুলে উঠে চলে গেল। ইশরা বোকার ন্যায় বসে রইল সেথায়। অপলক চেয়ে রইল সাদাতের দিকে। বদমাশটার কথায় কি কোনো ইঙ্গিতপূর্ণ কথা ছিল? হয়তো ছিল কিন্তু মস্তিষ্কে তা ধরা দিল না।
“তুমি এ বাড়িতে হঠাৎ থেকে গেলে কেন অরিন?”
আবির আধশোয়া হয়ে বসে আছে নিজের রুমের বিছানায়। বাম হাত কনুই থেকে হাতের তালু অব্দি ব্যান্ডেজে মোড়ানো। নয়ন তালুকদারের ছেলেপুলেদের ধা*রালো অ*স্ত্রের আঘাতে হাতে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে দুই সপ্তাহ হাত দ্বারা কোনো কাজ করা যাবে না। কিছুক্ষণ পূর্বে চৌধুরী বাড়ির সদস্যরা বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। অরিনকেও নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে যায়নি। আবিরকে এমন অবস্থাতে রেখে যেতে ইচ্ছে করেনি। মানুষটার আহত অবস্থা দেখে কষ্ট অনুভব হচ্ছে। ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে তার মন। অদৃশ্য এক টানে এ বাড়িতে থেকে গেছে। এটাই হয়তো বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনের ক্ষমতা।
অরিন পরিবারের সদস্যদের বিদায় দিয়ে আবিরের রুমে এসেছিল। তখনি আবিরের বলা কথাটা কর্ণকুহরে প্রবেশ করল। সে ক্লান্ত ভঙ্গিমায় এসে আবিরের পাশে ধপ করে বসল। কপাল কুঁচকে দ্বিধাহীন কন্ঠে জবাব দিল;
“আপনার জন্য থেকে গেলাম। চলে গেলে খুশি হতেন বুঝি?”
আবির গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে তাকাল। গাম্ভীর্যভাব নিয়ে বলল ;
“আমাদের বিয়ে এখনো উঠানো হয়নি। এসময় শশুড় বাড়ি থাকলে বিষয়টা অন্য রকম দেখায়। ”
অরিন রেগে গেল।রাগান্বিত কন্ঠে বলল ;
“আপনি যদি আ*হত না হতেন তাহলে আপনার মাথায় লাঠি দিয়ে বারি মে*রে দিতাম। অসহ্য লোক একটা। ”
আবির অবাক হওয়ার ভাণ করে বলল;
“ আমার অপরাধ কী অরিন?”
“আপনার অপরাধ আমার সাথে ভালোভাবে কথা না বলা। রাগ করে আমাদের বাড়িতে না যাওয়া। একটা চু*মু খেতে দেয়নি তাই কেউ রাগ করে। বজ্জাত লোক কোথাকার।”
“ আমি কি ছোট মানুষ চু*মুর মতো মিষ্টি জিনিস না খেতে পেয়ে রাগ করে মুখ ফুলিয়ে রাখব? ”
“তাহলে কেন মেসেজ করার পরেও আমাদের বাড়িতে যাননি? জানেন কতো ঝামেলা হয়েছিল?”
“ হ্যা জানি। আমার বন্ধু নিজের রাস্তা ক্লিয়ার করতে জানে তাই আমি যাইনি।”
“ মেনে নিলাম। আপনি যেহেতু আমার ওপর রেগে নেই তাহলে বউকে ভুলে বাড়িতে আর পার্টি অফিসে পরে থাকার কারণ কি?”
“ আমি জানি,তুমি আমায় মন থেকে মেনে নিতে পারোনি অরিন। তাহলে এ বাড়িতে কেন থেকে গেলে? আমায় করুণা দেখাতে?”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫২
আবির উদাসীন ভঙ্গিতে আচমকা বলে উঠল। অরিন চমকালো, থমকাল। স্তম্ভিত নয়নে তাকাল আবিরের দিকে। কন্ঠনালী রোধ হয়ে আসল। উক্ত কথাটি যেন বি*ষসম মনে হলো। যা ছড়িয়ে পড়ল রন্ধ্রে রন্ধ্রে। চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রুকণা। অভিমানে,রাগে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠল ভেতরটা। মানুষটা কীভাবে বলতে পারল কথাটা?