প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৭
আদ্রিতা নিশি
“মুনের বাসায় যাওয়ার মেইন কারণ ছিল হিমি। মুন হিমিকে এডপ্ট করতে চায়। সেসব বিষয় নিয়ে আমার সাথে ডিসকাশ করার জন্য ডেকেছিল আর মুন এনগেজড। ডিসেম্বরের লাস্টে ওর বিয়ে।”
“আমাকে এসব কেনো বলছেন? আমি কি জানতে চেয়েছি?”
“জানতে চাসনি কিন্তু মনে মনে আমাকে এবং মুনকে নিয়ে আজগুবি চিন্তাভাবনা করছিস তা বুঝতে পারছি।”
“আমি আপনাদের নিয়ে কোনো আজগুবি চিন্তাভাবনা করিনি।”
অরিত্রিকা মুখ বাঁকিয়ে বলল। সারহান তা দেখে অগোচরে নিঃশব্দে হাসল। মেয়েটার ভাবমূর্তি বলে দিচ্ছে এখনো তার ওপর ভীষণ রেগে আছে। কিন্তু কখনো স্বীকার করবে না। উল্টো রাগ দেখিয়ে মুখ গোমড়া করে বসে থাকবে। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে শক্ত হাতে স্টিয়ারিংয়ে শক্ত করে হাত রেখে ড্রাইভিংয়ে মনোযোগী হলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি জোড়া স্থির করলো ব্যস্ত নগরীর রাস্তার দিকে। তারা মুনের বাসা থেকে বেড়িয়েছে সন্ধ্যার পরে। আবিরের বাসায় যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু কোনো কারণবশত প্লান ক্যান্সেল করে দুজনে গাড়ি নিয়ে বাড়িমুখো রওনা দিয়েছে। অরিত্রিকা মুখ গোমড়া করে ফোন হাতে ড্রাইভিং সিটের পাশে বসেছে। অনবরত ইশরাকে কল করে যাচ্ছে। কিন্তু অপর পাশ হতে কল রিসিভ হচ্ছে না। সে একমুহুর্তে বেজায় বিরক্ত হলো। বিরক্তির মাত্রা ক্রমশ বাড়তে লাগল। মুখ চোখ কুঁচকে গেল। প্রয়োজনের সময় কাউকে কল দিলে পাওয়া যায় না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সে চটে যাওয়া মেজাজে ফোনটা পার্সে ঢুকিয়ে রাখল। গাড়ির গ্লাস খুলে বাহিরের প্রকৃতির দিকে তাকাল। রাত হয়ে এসেছে। অন্ধকারে মিশে গেছে সবুজ গাছপালা। রাস্তাটা একদম শুনশান এবং নিরব। আশেপাশে কোনো মানুষের দেখা নেই। টি বাঁধের এ রাস্তায় রাতের বেলায় তেমন মানুষ দেখা যায় না। বলতে গেলে এখানে রাত মানেই জনশূন্য এলাকা। এই এলাকায় রাতের আঁধারে ছিন*তাই কারী ঘটনা ঘটে তাই মানুষজন রাতে কম বের হয়। এক কথায় নির্জন জনমানবশূন্য ভুতুড়ে এলাকা। অরিত্রিকা পলকহীন চেয়ে আছে বাহিরের দিকে। বাহির হতে আসা শীতল হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে তাকে। খোলা চুলগুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। সে হাত দ্বারা সামনের চুলগুলো কানের পৃষ্ঠে গুঁজে নেয়। দৃষ্টি ঘুরিয়ে সরাসরি তাকায় সারহানের দিকে। গাড়ির ভেতরের মৃদু সাদাটে আলোয় স্পষ্ট দেখতে পায় সারহানকে। চপল চাহনি স্থির হয় কৃষ্ণ বর্ণের চুলে। চুলগুলো ভীষণ এলোমেলো যেন বিক্ষিপ্ত হাওয়া ইচ্ছাকৃত ছুঁয়ে গেছে শ্যামমানবের কৃষ্ণ বর্ণের চুলগুলো। সে নেত্রপল্লব ঝাপটালো। বক্ষস্থলে শীতল শিহরণ বইয়ে গেল কল্পপুরুষের স্নিগ্ধ রুপ দেখে। ইচ্ছে করল আলতো করে হাত ডুবিয়ে দিতে মানুষটার চুলে। পরক্ষণে নিজের ভাবনায় লজ্জিত অনুভব করল। তবুও দৃষ্টি অন্যত্র ঘোরালো না বরং এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল।
“পদ্মার পাড়ে যাবি?”
সারহানের গম্ভীর কন্ঠস্বর কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা নড়ে চড়ে উঠল। অবাধ্য দৃষ্টি সংযত করল। নিজেকে স্বাভাবিক করে সামনে তাকিয়ে ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিলো;
“উহু বাড়ি চলুন।”
সারহান দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল;
“এখনো মন খারাপ করে আছিস?”
অরিত্রিকা হেসে জবাব দিলো ;
“আমি মন খারাপ করিনি।”
সারহানের কপাল কুঁচকে গেল। পুরূ কন্ঠে বলল;
“তাহলে তোর পছন্দের জায়গায় নিয়ে যেতে চাইছি অথচ তুই যেতে চাইছিস না।”
“অন্য একদিন যাবো। সারহান ভাই!”
“বল।”
“সাদাতের জন্য জন্মদিনের গিফট কেনা হয়নি। গিফট কিনতে হবে। শপিংমলে যাবো। আপনি নিয়ে যাবেন আমায়?”
“কোন শপিংমলে যাবি?”
সারহান গাড়ি খানিকটা শ্লো করল। স্বাভাবিক ভাবে জানতে চাইল। অরিত্রিকা খুশি হয়ে গেল। চনমনে ভঙ্গিমায় বলে উঠল;
“আপনার ইচ্ছে মতো যেকোনো একটা শপিংমলে নিয়ে চলুন।”
সারহান শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করল ;
“আচ্ছা।”
সারহান গাড়ি নিয়ে সাহেববাজার পেরিয়েছে। শপিংমলের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে। সেখান থেকে সাদাতের জন্য উপহার কিনে বাড়িতে রওনা দিবে। অরিত্রিকা আজ ভীষণ এক্সাইটেড। কারণ এই প্রথমবার সারহান ভাই কোনো প্রশ্ন ছাড়াই তার মানছে। মনটা যেন আজ আকাশে বাতাসে দোল খাচ্ছে। সে উচ্ছস্বিত ভাব চাপা রেখেছে অতি কষ্টে। ফুরফুরে মেজাজে ভাবতে লাগল যদি তার প্রতিটি কথা মানুষটা মানতো তাহলে অনেক ভালো হতো।
“রুহান আর কতোক্ষণ লাগবে কেনাকাটা করতে। বিরক্ত লাগছে আমার। আমি বাহিরে গেলাম তুই আর রুদ্র এখানে থাক।”
অরিত্রিকার আকদ উপলক্ষে অরিত্রিকার বন্ধুমহলে শপিং করতে মলে এসেছে। সকালে আজমল সাহেব সবাইকে ইনভাইট করেছেন। যখন থেকে ইনভাইট পেয়েছে তখন থেকে রুদ্র, রুহান এবং তিশার মাথা খারাপ হয়ে গেছে শপিং করার জন্য। তিনজনে অনবরত কল দিয়ে রাহাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। রাহা বেচারী তিনজনের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে বন্ধুমহলকে নিয়ে বিকেলে শপিং করতে এসেছে। এখন রাত হয়ে এসেছে অথচ এদের জামা কাপড় কিছু কেনা হয়নি। সে এতে বিরক্ত হচ্ছে। মেয়েদের শপিং করতে দেরী হয় এটা মানা যায়। কিন্তু ছেলেদের শপিং করতে তাদের থেকে বেশী সময় লাগে আজ জানলো। সে কপাল চাপড়ালো। কেন যে এদের সাথে আসতে গেল। রুদ্র এবং রুহান নিজেদের জন্য একের পর এক শার্ট দেখে যাচ্ছে। রাহার বিরক্তিসূচক কন্ঠস্বর শুনলো ঠিকই কিন্তু ব্যস্ততাকে পুঁজি বানিয়ে উপেক্ষা করল। রাহা চটে গেল দুজনের নির্লিপ্ত ভঙ্গিমা দেখে। সে চটে গেল। ক্রোধ নিয়ে ধপাধপ পা ফেলে বাহিরে গিয়ে দাঁড়াল।
ইরফান তাহসিনের সাথে দেখা করতে শপিংমলে এসেছিল। তাহসিন ইরফানের বাল্যকালের বন্ধু। বগুড়াতে থাকাকালীন একসাথে পড়াশোনা করেছে তারা। অনেকদিন পর হঠাৎ বন্ধু কল দিয়ে বলল সে রাজশাহী এসেছে এবং তার দেখা করতে চায়। সে আগেপিছে না ভেবে সময় ব্যয় না করে দেখা করতে আসে। তাহসিন রাজশাহীতে এসেছিল বোনের বিয়ের শপিং করতে। তাই অন্যত্র দেখা না,করে সরাসরি চলে এসেছে শপিং মলে অবস্থান করা বন্ধুর সাথে দেখা করতে। সে তাহসিনকে বিদায় দিয়ে দ্বিতীয় তলায় আসতেই খেয়াল করল রাহা একটা জেন্টস শপের সামনে একা দাঁড়িয়ে আছে। চোখ মুখ দেখে বুঝতে পারলো মেয়েটা কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ রেগে আছে। সে মুখ গম্ভীর করে হেটে আসল। কিন্তু রাহার সামনে দাঁড়ালো না। এক প্রকার উপেক্ষা করে সাইড কেটে বেরিয়ে গেল।
“ইরফান ভাইয়া! ”
পেছন থেকে মেয়েলী কন্ঠস্বর ভেসে এলো। ইরফানের পা জোড়া ততক্ষণাৎ থেকে গেল। সে অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও দাঁড়াল। ভ্রুযুগল কুঁচকে পেছনে ফিরে তাকাল। রাহা ইরফানকে দাঁড়াতে দেখে হাস্যরত মুখে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। সরাসরি গিয়ে দন্ডায়মান মানবটির সামনে দাঁড়াল। একগাল হেসে জিজ্ঞেস করল;
“আপনি এখানে! ভাবতেই অবাক লাগছে আপনার সাথে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখা হয়ে গেল। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো আপনি আমায় দেখেও না দেখার ভাণ করে চলে যাচ্ছিলেন।”
ইরফানের ভ্রু বেঁকে গেল।গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“দেখলেই কথা বলতে হবে এমন কোনো শর্ত দিয়েছিলে নাকি আমায়?”
“আমি আপনাকে শর্ত দিতে কেন যাবো? পরিচিত মানুষের সাথে দেখা হলে ভদ্রতার খাতিরে কথা বলতে হয় এটা জানেন না?”
“নাহ জানিনা। এখন কি করবে? শিখিয়ে দিবে?”
“আপনি আজব মানুষ তো। যেচে ঝগড়া করছেন।”
“ঝগড়া করছি না। আমি তোমার পরিচিত কিন্তু খোঁজ খবর নেওয়ার মতো সম্পর্ক আমাদের মাঝে গড়ে ওঠেনি। গট ইট?”
ইরফান লহু স্বরে বলে উঠল। রাহার রাগ হলো। ইচ্ছে করলো সামনে দাঁড়ানো মানুষটার মাথা ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু নিজের মনের ইচ্ছা চাপা রাখল। নিজেকে শান্ত করল। ভাবলো, হয়তো অরিত্রিকার বিয়ের শোকে ইয়ারফোন ভাইয়ার কষ্ট রাগে রুপান্তরিত হয়েছে। সে এসব উদ্ভট কথা ভেবে নিজেকে সামলে নিলো। অপমানিত বোধ করলেও আমলে নিলো না। পূর্ণ দৃষ্টি মেলে তাকাল ইরফানের দিকে। হাসার ভাণ করে বলল;
“আমি বোধ হয় আপনাকে ডিস্টার্ব করে ফেললাম। আই অ্যাম স্যরি ভাইয়া। আপনি যেতে পারেন। ”
কথাটা শেষ করে পিছু ফিরে এগিয়ে যেতে লাগল। কন্ঠে ছিল অভিমানের ছোঁয়া। পেছনে ফেলে আসা মানুষটা কি বুঝল তা? ইরফান তপ্ত শ্বাস ফেলল। বুঝতে পারলো মেয়েটার সাথে রুঢ় আচরণ করা একদম ঠিক হয়নি। সে ইচ্ছেকৃত ভাবে কোনো কিছু বলেনি। বিগত কয়েকদিন ধরে মন ও মস্তিষ্কের অবস্থা ঠিক নেই। পরশুদিন অরিত্রিকার আকদ। সেসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিধ্বস্ত সে। তাই রাহার ওপর রাগ দেখিয়ে ফেলেছে। নিজের আচরণে অনুতপ্ত সে। কিন্তু প্রকাশ করলো না। আচানক পেছন থেকে গাম্ভীর্য ভাব নিয়ে বলল;
“আজকেও কাউকে না নিয়ে রাতে একা একা শপিং করতে চলে এসেছো? তোমরা মেয়েরা ত্যাড়া কেনো? ”
রাহা থেমে গেল। হতভম্ব হয়ে তাকাল ইরফানের দিকে। পরক্ষণে ফুঁসে উঠে বলল;
“আপনি আমায় ত্যাড়া বললেন?”
ইরফান এগিয়ে এলো। প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে সটান হয়ে দাঁড়াল। স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“আমি তোমাকে ত্যাড়া বলিনি। শপিংমলে কেন এসেছো?”
রাহা কোমড়ে হাত গুঁজে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল;
“শপিং করতে এসেছি।”
“একা এসেছো?”
“নাহ। ফ্রেন্ড’দের সাথে এসেছি।”
“তোমার ফ্রেন্ডরা কই?”
“ওই যে দেখুন শার্ট ট্রায়াল দিচ্ছে।”
রাহা গমগমে কন্ঠে জেন্টস শপের দিকে হাত দিয়ে ইশারা করে বলল। ইরফান সেদিকে তাকাল। দেখল দুটো ছেলে শার্ট পড়ে একে অপরকে দেখাচ্ছে। সে পুনরায় রাহার দিকে তাকাল। ভ্রু নাচিয়ে অদ্ভুত কন্ঠে বলল ;
“ছেলে ফ্রেন্ড! ”
রাহা চক্ষুদ্বয় ছোট করে ইরফানের দিকে তাকাল। গমগমে কন্ঠে বলল;
“হ্যা ছেলে ফ্রেন্ড।”
“সবাই একসাথে শপিং করতে এসেছো কোনো প্রোগ্রাম আছে নাকি?”
“হ্যা। অরি…।”
রাহা কথাটা সম্পূর্ণ না করে থেমে গেল। মাথা ততক্ষণাৎ নিচু করলো। মুখ ফসকে অরিত্রিকার আকদের কথাটা বলে ফেলছিল। সে ইরফানের মনের অবস্থা জানে। মানুষটাকে স্বাভাবিক দেখালেও মোটেও স্বাভাবিক নেই। বারবার অরিত্রিকার নাম না নেওয়া ভালো। ইরফান রাহার আচরণ লক্ষ্য করল। বুঝতে পারল কিছু একটা লুকানোর প্রয়াস চালাচ্ছে। সে জোর করল না। স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“তুমি এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? শপিং করা শেষ?”
রাহা মাথা নাড়িয়ে জবাব দিলো ;
“ উহু। ”
“শপিং দ্রুত শেষ করে বাড়িতে যাও।”
“আচ্ছা।”
রাহা ভদ্র মেয়ের মতো ছোট্ট করে উত্তর দিয়ে চুপ করে রইল। ইরফান এহেন ব্যবহারে অবাক হলো বটে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। আগ বাড়িয়ে কোনো কথা না বলে সেখান থেকে প্রস্থান করলো। রাহা চোখ উঁচিয়ে সামনে তাকাল। পলকহীন চাহনিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে।
সারহান ও অরিত্রিকা লিভিং রুমে প্রবেশ করতেই দেখতে পেলো বাড়ির সবাই সোফায় বসে গভীর আলোচনায় মগ্ন। অরিত্রিকা বিস্মিত হয়ে গেল সোফায় বসে থাকা অরিন এবং আবিরকে বসে থাকতে দেখে। এরা কখন এলো? নিশ্চিয়ই এতোক্ষণে বাড়ির সবাই জেনে গেছে সে আর সারহান ভাই আবির ভাইয়ার বাড়িতে যাওয়া নাম করে অন্য কোথাও গিয়েছিল? যদি এই বিষয়টা নিয়ে তার বাবা তুলকালাম বাধিয়ে দেয়!এতোটুকু ভেবে অজানা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। দ্রুত পায়ে পিছিয়ে গিয়ে সারহানের পেছনে লুকানোর বৃথা চেষ্টা চালালো। সারহান অরিত্রিকার কান্ড দেখল শুধু। হাতে শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে দ্বিধাহীনভাবে দাম্ভিকতা নিয়ে এগিয়ে গেল সবার দিকে।
“হবু বউকে নিয়ে ঘোরাঘুরি শেষ হলো?”
সারহানকে দেখে আবির সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে খোঁচা দিয়ে বলে উঠল। সবাই কথা বন্ধ করে তাকাল সারহানের দিকে। আজমল সাহেবের মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি কপাল কুঁচকে সারহানের পেছনে থাকা অরিত্রিকার দিকে তাকালো। আরশাদ সাহেব ছেলের দিকে বিরক্তি সূচক চাহনিতে তাকাল। পরশু আকদ অথচ ছেলের কোনো কান্ড জ্ঞান নেই। বাড়িতে আবিরের বাড়িতে যাওয়ার কথা বলে অরিত্রিকাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছে। তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম মুখে আঁচল গুঁজে হাসছেন। অরিন অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে।
সারহান সবার প্রতিক্রিয়া উপেক্ষা করে ভাবলেশহীন ভাবে জবাব দিলো ;
“চৌধুরী বাড়ির কর্তাদের জন্য হবু বউ নিয়ে ঘোরাঘুরি করার মতো সুযোগ আছে?”
আবির দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল;
“আরে আমার শশুড়দের দোষ কেনো দিচ্ছিস? উনারা কত্তো ভালো জানিস?”
“হ্যা জানি। জাস্ট কয়েক ঘন্টার জন্য অরিত্রিকাকে নিয়ে বেড়িয়েছি তাই তোর হিটলার শশুড় পঞ্চাশবার কল দিয়েছে এবং ভয়েজে হুমকি দিয়েছে ‘অরিত্রিকাকে নিয়ে একঘন্টার মধ্যে বাড়ি না ফিরলে আমার সাথে ছোট মেয়ের বিয়ে দিবেন না!’ আমি কি উনার মেয়েকে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবো?”
“আসলে শশুড় মশাই তোকে আর আমাকে একদম ভরসা করেননা।”
সাথী বেগম আশ্চর্যিত হলেন। আজমল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বিস্মিত স্বরে বললেন;
“আপনি সারহানকে হুমকি দিয়েছেন?”
আজমল সাহেবের মুখখানা গম্ভীর হয়ে উঠল। গমগমে কন্ঠে বলল;
“হ্যা হুমকি দিয়েছি। সারহানকে আমি একদম ভরসা করতে পারিনা। ”
“তাহলে মেয়ের বিয়ে দিচ্ছেন কেনো?”
“মেয়ের পছন্দ তাই।”
আরশাদ সাহেব মুখ খুললেন। সারহানকে উদ্দেশ্য করে শক্ত কন্ঠে বললেন;
“পরশুদিন আকদ। তারপরে দুজন ঘুরতে গেলে কেউ কিছু বলতো না।”
সারহান বিরক্তবোধ করল। ভরাট কন্ঠে বলল;
“আমি আমার উডবি ওয়াইফকে নিয়ে ঘুরতে যেতেই পারি।”
“বিয়ের আগে ঘোরাঘুরি পছন্দ নয় আমার।”
“দাদাজান আপনাকেও এই কথাটি বলেছিল। কিন্তু আপনি উনার কথা অগ্রাহ্য করেছিলেন।”
সারহান চোখ মুখ শক্ত করে লহু স্বরে বলল। আরশাদ সাহেবের মুখখানা থমথমে হয়ে গেল। আবির উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। তানিয়া বেগমও হেসে ফেললেন। হাস্যরত মুখে তাকালেন স্বামীর পানে। আজমল সাহেব হতাশ হয়ে আওড়ালেন ;
“এ জীবনে বোধ হয় শশুড় হওয়ার সম্মানটুকু পাবো না। হে সৃষ্টিকর্তা, কি পাপ করেছিলাম জীবনে!পাপের ফলস্বরূপ দুইটা বেয়াড়া জামাই কেনো দিলে?”
সারহান আজমল সাহেবের বলা কথা স্পষ্ট শুনতে পেলো। বাঁকা হেসে বলল;
“কারণ সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীতেই আপনাকে শাস্তির আওতায় আনতে চাইছেন।”
কথাটা সম্পূর্ণ করে শাণিত পায়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। সারহানের পেছনে লুকিয়ে থাকা অরিত্রিকা এবার সকলের সামনে দৃশ্যমান হলো। সবাইকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসার ভাণ করে বলল;
“কেমন আছো সবাই?”
আজমল সাহেব ভরাট কন্ঠে বলে উঠলেন;
“সারহানের সাথে কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে?”
অরিত্রিকার হাসি উবে গেল। মুখ ভার করে জবাব দিলো;
“মুন আপুর বাসায় গিয়েছিলাম।”
“মুন কে?”
“সারহান ভাইয়ের বান্ধবী।”
অরিত্রিকা লিভিং রুমে একমুহূর্ত দেরী না করে এক দৌড় দিলো। গন্তব্য হলো তার রুম। আজমল সাহেবের মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল। তিনি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। হাঁটা শুরু করলেন নিজের রুমের দিকে। বাকিরাও নিজেদের কাজে করতে চলে গেলো। শুধু সেখানে বসে রইল ইরফান। সদর দরজার বাহিরে এতোক্ষণ লুকিয়ে ছিল ইশরা ও সাদাত। দুজনে অপেক্ষা করছিল লিভিং রুম থেকে চলে যাওয়ার। কিন্তু সে ভাবনায় পানি ঢেলে দিয়ে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে রইল আবির। সাদাত ইশরাকে ইশারা করল নিঃশব্দে ভেতরে প্রবেশ করার। ইশরা মাথা নাড়িয়ে ইশারা করে বলল ঠিক আছে। অতঃপর দুজনে বিড়ালের ন্যায় শব্দ না করে ধীরে ধীরে লিভিংরুমে প্রবেশ করল। সোফার পেছন দিয়ে চোরের মতো যেতে লাগল।
“তোমাদের দুজনকে চৌধুরী বাড়ির কাঠগড়ায় উঠানো উচিত। বাড়ির কাউকে না বলে ঘুরতে গিয়েছিলে? সবাইকে ডেকে বলবো?”
সাদাত ও ইশরা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে গেল৷ ধরা পড়া চোরের ন্যায় মুখখানা নত করে দুজনে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল আবিরের সামনে। আবির দুজনের অবস্থা দেখে হাসল৷ সে সাদাত এবং ইশরাকে আগেই খেয়াল করেছে। কিন্তু ভাণ করেছিল সে তাদের দেখেনি। এই দুটোর ভাবভঙ্গি মোটেও সুবিধার নয়। ইশরা চলন বলন স্বাভাবিক থাকলেও সাদাতের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত। সে পায়ের ওপর পা তুলে বসল। নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলল;
“কোথায় গিয়েছিলে তোমরা?”
ইশারা শুকনো ঢোক গিলল। সাদাত গলা খাঁকড়ি দিয়ে জবাব দিলো ;
“নোঙর রেস্টুরেন্টে।”
“কেনো গিয়েছিলে?”
“ঘুরতে।”
“বাড়ির কাউকে জানিয়ে গিয়েছো? ”
“নাহ।”
আবির ভরাট কন্ঠে বলল;
“ইশরা তুমি নিজের রুমে যাও।”
ইশরা মুখখানা তুলে তাকাল সাদাতের দিকে। সাদাত ইশারা করল রুমে যেতে। ইশরা বিরোধীতা না করে সরাসরি নিজের রুমে চলে গেল। আবির বলল;
“সাদাত আমার পাশে বসো। ”
সাদাত গিয়ে বসল আবিরের পাশে। তার মুখাবয়বে ফুটে উঠেছে চিন্তিত ভাব। আবির তা খেয়াল করে রসিকতা করে বলল;
“কি হলো শালাবাবু কাকে নিয়ে চিন্তা করছো?”
সাদাত আবিরের দিকে তাকাল। হাসার ভাণ করে বলল;
“কাউকে নিয়ে চিন্তা করছি না।”
“ওহহ আচ্ছা।শালাবাবু! প্রেমে পড়েছো নাকি?”
“ভাইয়া আমি ভদ্র ছেলে। প্রেমে টেমে পড়ি না।”
“ভদ্র ছেলেরাও প্রেমে পড়ে। যেমন তোমার বড় ভাই।”
“আমার এখনো প্রেম করার বয়স হয়নি ভাইয়া।”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৫৬
সাদাতের কথা শুনে আবির হেসে উঠল। হাসি বজায় রেখে বলল;
“কিন্তু তোমার চোখ মুখ অন্য কথা বলছে। আমি যদি ভুল না হই তুমি ইশরাকে পছন্দ করো।”
সাদাত চমকে গেল। মুখখানা বিবস বর্ণ ধারণ করল। আবির সাদাতের কাঁধ চাপড়ে বলল;
“তারমানে একদম ঠিক ধরেছি। শোনো শালাবাবু, সময় থাকতে বলে দাও ইশরাকে। তারপর যা হবে দেখা যাবে।”