প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৭ (২)
আদ্রিতা নিশি
“সারহান! তুই তো জানিস আমার মা এমন জ*ঘন্য কাজ করতে পারে না। উনাদের মিথ্যা অভিযোগ করতে বারণ কর। মায়ের বিরুদ্ধে এসব কথা সহ্য করতে পারছি না।”
ইরফান সারহানের দিকে তাকিয়ে আকুলিত কন্ঠে বলল। সারহানের মুখাবয়ব অতিশয় কঠিন হয়ে উঠল। সে অরিনকে ইশারা করল অরিত্রিকাকে ধরার জন্য। অরিন ইশারা লক্ষ্য করে এসে বোনকে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালো। সাথী বেগম মন ভার করে ইশরাকে ধরে নিয়ে বসিয়ে মায়ের মতো আগলে নিলো। মেয়েটা তখনো ফুপিয়ে কাঁদছে। তানিয়া বেগম স্বামীকে কল করে দ্রুত আসার কথা বলে হন্তদন্ত হয়ে নিচে এসেছে কি অবস্থা দেখার জন্য। সারহান তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকায় ইরফান এবং ইসমা বেগমের দিকে। মা সমতুল্য ফুপির করুণ অবস্থা দেখে মায়া হয় না! মায়া হবে কেন? যে মানুষটা তার ভালোবাসার মানুষকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে, তাকে মা*রার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেছে এবং সম্পত্তির লোভে চৌধুরী বাড়িকে ভেঙে দিয়েছে তাকে কিভাবে ক্ষমা করবে? সুযোগ দিয়েছিল শুধরানোর কিন্তু তা করেনি। উল্টো তার নামে উল্টোপাল্টা বুঝিয়ে আজমল সাহেবকে হাত করে অরিত্রিকা এবং ইরফানের বিয়ে দিতে চেয়েছিল।
“ফুপিকে জিজ্ঞেস কর পুলিশ যা বলছে তা সত্যি কিনা?”
সারহান কাঠিন্যেতা এঁটে লহু স্বরে বলল। ইরফান আরেকদফা থমকাল। তার মানতে কষ্ট হলো সারহান এমন আচরণ করছে। তবুও মনের দ্বিধা কাটাতে মায়ের দিকে তাকাল। অনুনয় করে জানতে চাইল;
“মা! সত্যিটা বলো।”
ইসমা বেগম অঝোরে কেঁদে যাচ্ছেন। তিনি ছেলের কথা শুনে মাথা নত করলেন। কি জবাব দিবেন? পুলিশ যা বলছে সব সত্যি। টাকার লোভে এ পথে পা বাড়িয়েছিল। আজ সেই লোভ গলার কাটা হয়ে বিঁধছে। ইরফান মায়ের নির্লিপ্ততা, নিশ্চুপতা দেখে বিষাদময় হাসল। তার চতুর মস্তিষ্ক বুঝতে সক্ষম হলো না বলা কথা। সে ইসমা বেগমকে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়াল। চক্ষুদ্বয় বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। ছেলে হয়ে মায়ের অপরাধ মেনে নেওয়া বড্ড কষ্টকর তা ঢেড় বুঝল। তবুও কন্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল;
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তোমার থেকে বিশ্বাসঘাতকতা আশা করিনি মা। আমি ছেলে হয়ে তোমার না বলা কথাগুলো বুঝে নিয়েছি। আফসোস, তুমি একবার আমার, ইশরার এবং মামুদের কথা ভাবলে না। মা হয়ে আরেক মায়ের বুক খালি করতে দ্বিতীয়বার ভাবলে না।তবুও মনে প্রাণে চাইব সবকিছু যেন মিথ্যা হোক। আমার সব ধারণার ভুল প্রমাণিত হোক।”
কথাটা বলেই বিষন্নতা মিশ্রিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে এলোমেলো পায়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল ইরফান। রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা দিলো। লিভিং রুমের উপস্থিত সবাই শব্দে চমকে উঠল। এরপরেই ওই রুম থেকে চিৎকার এবং ভাংচুরের শব্দ পাওয়া গেল। সাদাত শুনে দৌড়ে গেল রুমের দিকে। রাহা ভয় পেয়েছে তবুও ছুটলো সেদিকে। ইসমা বেগমের কান্নার বেগ বাড়লো। তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সারহানের দুহাত জড়িয়ে ধরলেন। অনুতপ্ত কন্দনরত কন্ঠে বলতে লাগলেন;
“সারহান বাপ! মাফ করে দে। আমি টাকার লোভে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তাই ভুল করে ফেলেছি৷ আমায় মাফ করে দে। তোর পায়ে পড়ি বাপ।”
সারহান অনড় হয়ে রইল। অনুভূতিহীন মূর্তিরন্যায় দাঁড়িয়ে কথাগুলো শুনল। তবুও কঠিন মন যেন টলল না। সে সূঁচালো চাহনি তাকাল ফুপির দিকে। রুদ্ধ কন্ঠে বলল;
“আপনাকে শোধরানোর সুযোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু আপনি শোধরাননি। উল্টো আমার শত্রুর সাথে হাত মিলিয়ে আমায় মা*রার প্লানে সামিল হলেন। জনসভায় আমাকে মা*রার ছক করা হলো। আমার পিতাস্বরূপ চাচার শরীরে বুলেট লাগল, র*ক্ত ঝড়লো। আপনি সেসব ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি। আপনাকে ওয়ার্নিং দিয়েছিলাম মনে পড়ছে? এখন না মনে পড়লেও থানায় গেলে মনে পড়বে।”
উপস্থিত সবাই সারহানের বলা কথা শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। চকিত চাহনিতে নির্বাক ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে রইল। সারহান পুলিশকে ইশারা করল এরেস্ট করার জন্য। একজন মহিলা পুলিশ এগিয়ে এসে ইসমা বেগমের দুহাতে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করে বললেন ;
“চলুন।”
ইসমা বেগম উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে বললেন;
“আমি ভুল করেছি। সারহান, তানিয়া ভাবী, সাথী ভাবী আমায় মাফ করে দেন। আমি কখনো এমন ভুল করব না।”
অপরাধে জড়িয়ে যাওয়া মহিলাটি আরও আহাজারি, বিলাপ করলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসলো না। মহিলা পুলিশ ইসমা বেগমকে টেনে হিঁচড়ে সদর দরজা পেরিয়ে নিয়ে গেলেন। পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়ার সময় আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেবের সাথে দেখা হলো। কিন্তু কথা বলার সুযোগ হলো না। গাড়ি টান দিলো থানার উদ্দেশ্যে।
“ইসমা! আমার বোন এমনটা করতে পারে না।”
কথাটি বলেই আজমল সাহেব মাথায় হাত দিয়ে সোফায় বসে পড়লেন। অরিরিক্তি দুশ্চিন্তায় প্রেশার বাড়ছে।তার বিশ্বাস হচ্ছে না নিজের বোন এমন একটা চক্রান্তের সাথে যুক্ত। সাথী বেগম দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিয়ে অশান্ত কন্ঠে বললেন;
“আপনি শান্ত হোন।”
আজমল সাহেব পানির গ্লাসটা স্ত্রীর হাত থেকে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে গ্লাস টেবিলে রাখলেন। অতঃপর কাতর গলায় বললেন;
“আমি কিভাবে শান্ত হবো সাথী? আমার বোনটা এমন এক অভিযোগে গ্রেফতার হলো যেটা মেনে নেওয়া অসম্ভব।”
“আমাদেরও বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু আপা নিজের মুখে স্বীকার করেছেন।”
“আমার বিশ্বাস, ভরসা এক মুহুর্তে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। আমাদের পরিবারে আবার ভাঙন ধরল। আমার বোন হয়ে কিভাবে পারলো সারহানকে খু*ন করার পরিকল্পনা করতে? কিভাবে পারলো আমার মেয়েকে ব্ল্যাকমেইল করতে? টাকার দরকার ছিলো। মুখ ফুটে বলতো দিয়ে দিতাম।”
কথাটা বলে আজমল সাহেব দু-চোখ বন্ধ করে রইলেন। আরশাদ সাহেব সোফায় বসে আছে। মুখে কোনো কথা নেই। হঠাৎ এহেন খবরে মস্তিষ্ক বিপর্যস্ত! ছোট বোনের বিশ্বাসঘাতকতা ভেতর থেকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে। তিনি ভাবতেই শিউরে উঠছেন তার বড় সন্তানকে হ*ত্যা করার ষড়যন্ত্রে সামিল ছিল ইসমা বেগম। তিনি নিস্পৃহ চাহনিতে তাকালেন দাঁড়িয়ে থাকা সারহানের দিকে। অদ্ভুত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন;
“ইসমার ব্যাপারে এসব কবে জেনেছো?”
সারহান বাবার দিকে তাকায়। স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে জবাব দেয় ;
“প্রথম থেকেই জানতাম।”
আরশাদ সাহেব চমকালেন বোধ হয়। তা আড়াল করে ভারাক্রান্ত কন্ঠে বললেন;
“চুপ করে ছিলে কেন?”
“দ্বিতীয়বারের মতো পরিবার, সম্পর্ক ভাঙার সাহস হয়নি আমার। আপনাকে আরও একবার ভঙ্গুর, অসহায় অবস্থায় ফেলতে চাইনি। আপনাদের সবাইকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসি তো তাই কষ্ট দিতে চাই না। তাই গোপন রেখেছিলাম।”
“ইসমাকে সাবধান করোনি?”
“করেছিলাম। কিন্তু চৌধুরী বাড়ির র*ক্ত শরীরে এতো সহজে নিজের লক্ষ্য থেকে ফিরে আসবে?”
কথাটা বলে সারহান শানিত পায়ে সেখান থেকে নিজের রুমে পা বাড়াল। সবাই সেদিকে তাকাল। অরিত্রিকা ভেজা নেত্রপল্লব ঝাপটে সারহান ভাইয়ের দিকে অনিমেষ তাকিয়ে রইল। তার মন বলছে মানুষটা ভালো নেই। তবুও সবার সামনে কাঠিন্যতার খোলসে আঁটকে স্বাভাবিক থাকছেন।
“আপনি একটু স্বাভাবিক হোন। এভাবে ভেঙে পড়বেন না। এমনটাও তো হতে পারে পুলিশের অভিযোগ পরে মিথ্যা হতে পারে। আন্টি নির্দোষ প্রমাণিত হতে পারে।”
দুই ঘণ্টা দরজা বন্ধ রাখার পর অবশেষে সারহানের কথায় ইরফান দরজা খুলতে বাধ্য হয়। সারহান এসে ধীরে ধীরে ইরফানকে সব বোঝানোর চেষ্টা করে। এমনকি তিন বছর আগের কিছু ঘটনা তুলে ধরে যেগুলোর মাধ্যমে ইরফান প্রথমবারের মতো ইসমা বেগমের আসল উদ্দেশ্য জানতে পারে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি আঘাত পায় সে, যখন জানতে পারে অরিত্রিকার সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক করার মূল কারণ ছিল চৌধুরী বাড়ির সম্পত্তি।তবুও, এখনও অনেক প্রশ্নের উত্তর মেলেনি।
কিছু জিজ্ঞেস করলেও সারহান চুপ থেকেছে। অনেক কথা না বলেই চলে যায় সে।সারহানের চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর রাহা রুমে প্রবেশ করে। চতুর্দিকে চোখ বুলিয়েই আঁতকে ওঠে।রুমজুড়ে যেন বিশৃঙ্খলার ছাপ। কোথাও কিছু ভাঙা, কোথাও ছড়ানো কাগজ। সব মিলিয়ে তাণ্ডবলীলা! ভীত, উদ্বিগ্ন রাহা ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় বিছানার দিকে যেখানে ইরফান নিঃশব্দে বসে আছে। তার মুখাবয়ব অতিশয় থমথমে। রাহা দূরত্ব রেখে সাহস করে বসে পড়ে বিছানার প্রান্তে। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর মৃদু কণ্ঠে, দ্বিধান্বিতভাবে কথা শুরু করে।
ইরফানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করে মেয়েলী কন্ঠস্বর। তবুও তাকায় না। মেঝেতে দৃষ্টি স্থির রেখে নিরলস কন্ঠে বলল;
“মা নির্দোষ প্রমাণিত হবে না রাহা। আমার মা অপরাধ করেছে। ”
রাহার বুকটা মুচড়ে উঠল। ইরফানের কষ্ট সহ্য হচ্ছে না। মানুষটা কতো কষ্ট পাবে? একবার একতরফা ভালোবেসে কষ্ট পেয়েছে। আবার মায়ের জন্য কষ্ট পাচ্ছে। তার চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠে। নিজেকে সামলানোর বৃথা প্রয়াস করে বলে;
“চলুন,অনেক রাত হয়েছে খেতে ডাকছে আন্টিরা।”
“আমার গলা দিয়ে ভাত নামবে না।”
“বেশী খেতে হবে না। অল্প একটু খাবেন। রুমে খাবেন? খাবার আনবো?”
“তুমি গিয়ে খেয়ে নাও। আমার জন্য চিন্তা করো না।”
“আপনার জন্য চিন্তা করবো না কেন? আপনি আমার হাসবেন্ড হোন। ওয়াইফ হিসেবে আপনাকে নিয়ে চিন্তা করাটা স্বাভাবিক।”
রাহা কন্ঠে অধিকারবোধ ঢেলে বলল। ইরফান চকিত নয়নে তাকাল রাহার মুখপানে। তার চোখে মুখে বিস্ময় ভাব স্পষ্ট। কন্ঠে বিস্ময়াভাব নিয়ে বলল;
“তুমি বিয়েটা মন থেকে মেনে নিয়েছো?”
রাহা হাসল;
“বিয়েটা যেমন ভাবেই হোক না কেন শরিয়া মোতাবেক আমরা স্বামী- স্ত্রী। যখন আমাদের বিয়ে হয়েছে তখন থেকে মন থেকে স্বামী হিসেবে মেনেছি।”
“তুমি সত্যি অদ্ভুত মেয়ে!”
“অদ্ভুতের কি দেখলেন? যা সত্যি তাই বললাম।”
“তুমি স্পষ্টভাষী মেয়েমানুষ। তোমার মতো এমন মেয়ে কম দেখেছি।”
“এসব কথা বাদ দিন। চলুন সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”
কথাটা বলে রাহা হঠাৎ ইরফানের হাতটা ধরল। মেয়েলী হাতের স্পর্শে চমকে গেল ইরফান। সে সরাসরি তাকাল হাতের দিকে। রাহা এহেন চাহনিতে বিব্রতবোধ করল। দ্রুত হাতটা সরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলল;
“সরি।”
ইরফান দীর্ঘ শ্বাস টেনে বলল;
“ইটস ওকে।”
তার দৃষ্টি রাহার দিকে নিবদ্ধ। মনটা যেন শান্ত। সে গভীরভাবে ভাবল কিছু! দৃষ্টি সরিয়ে টেবিলে থাকা ফ্যামিলি ফটোর দিকে তাকাল। আনমনা ভাব নিয়ে বিরস কন্ঠে আওড়ালো ;
“কারও বিদায়ই হয়তো ছিল, কারও আগমনের আয়োজন। সৃষ্টি কর্তার পরিকল্পনা আমরা বুঝি না।নিয়তির বাঁকে বাঁকে সে লিখে রাখে এমন কিছু গল্প, যেখানে হারানোর মাঝেই লুকিয়ে থাকে নতুন করে পাওয়ার ইশারা। সত্যিই, নিয়তির খেলা বড় অদ্ভুত!”
ইশরা ভাইকে ডাকতে এসেছিল। কিন্তু এসে মন ভালো করা এমন দৃশ্য দেখতে পাবে তা কল্পনাতীত ছিলো। তার ভারাক্রান্ত মনটা একটু শান্ত হলো। রাহাকে তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। হঠাৎ করেই বিয়ে হয়েছে। তবুও যে এতো তাড়াতাড়ি তার ভাইকে মেনে নিয়েছে, স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে এটাই অনেক। অবশেষে ইরফান ভাই নতুন করে জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার সঙ্গী পেয়েছে এতেই শান্তি। সে দাঁড়ায় না আস্তেধীরে সেখান থেকে প্রস্থান করে।
“ইশু!”
লিভিং রুমে আসতেই পিছু থেকে ডেকে উঠল সাদাত। সে তৎক্ষনাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে পিছু তাকাল। নিভু কন্ঠে বলল;
“বল।”
সাদাত এগিয়ে আসে সামনাসামনি দাঁড়ায়। শীতল চাহনিতে তাকিয়ে বলল;
“চল, বাহিরে থেকে হেঁটে আসি।”
ইশরা বিরোধিতা করে বলল;
“বাহিরে যেতে ইচ্ছে করছে না।”
“বাগানের আশে পাশে দিয়ে হাঁটব। রাতের হাওয়া শরীরে লাগলে ভালো লাগবে।”
“তুই বুঝতে কেন চাইছিস না! ভালোলাগছে না আমার। ”
“আমার সাথে চল ভালো লাগবে।”
কথাটা বলে সাদাত ইশরার হাত ধরে টেনে বাহিরে নিয়ে গেল। মেয়েটা কিছু বলার সময় অব্দি পেল না। উপায়ন্তর না পেয়ে গেল। দুজনে এসে থামল বাগানের সামনের রাস্তায়। অম্বরে মেঘপুঞ্জ নেই। তবে অর্ধচন্দ্র দৃশ্যমাণ। বাহিরের আবহাওয়া শীতল। হালকা হাওয়া বইছে।
“আইসক্রিম, ফুচকা খাবি?”
সাদাত ইশরার সামনে দাঁড়িয়ে ভ্রু নাচিয়ে শুধালো। ইশরা সরাসরি তাকাল সাদাতের দিকে। সে বুঝতে পারল ছেলেটা তার মন ভালো করার চেষ্টা করছে। মনটা যেন প্রশান্তিতে ভরে গেল। তার ওষ্ঠকোণে এক চিলতে হাসি ফুটল ;
“কোনটাই খাবো না। তুই আছিস, কথা বলছিস এতেই হবে।”
সাদাতের দু’চোখে মুগ্ধতা বিরাজ করল। সেও ক্ষীণ হাসল। মাথা চুলকে নাটকীয় ভাবে বলল;
“তোর কথায় প্রথমবার লজ্জা পেলাম।”
“তোর লজ্জাও আছে?”
“আমি তো জানতাম আমার লজ্জা নেই। কিন্তু তোর কথায় উপলব্ধি করলাম একটু আকটু লজ্জা শরম আছে।”
“তাও ভালো লজ্জা শরম আছে একটু।”
“হুমম। শোন, এভাবে হাসিখুশি থাকবি। কান্নাকাটি করলে খবর আছে কিন্তু।”
সাদাত হাসি থামিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল। ইশরার মুখখানা থমথমে হয়ে গেল। বিষন্ন স্বরে বলল;
“মানুষের জীবনে সবসময় খুশি থাকে না সাদাত। এই যে আমার এ মুহুর্তে কষ্ট হচ্ছে, দমবন্ধ হয়ে আসছে, কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমি সেসব করতে পারছি না।”
সাদাতের মুখটা ভার হয়ে যায়। খানিকটা এগিয়ে এসে ইশরার হাত দুটো মুঠোবন্দি করে কোমল কন্ঠে বলল;
“ফুপির জন্য কষ্ট আমিও পাচ্ছি। আবার রাগও হচ্ছে। তোকে বলে বোঝাতে পারব না ভেতরটায় কি ঝড় বইছে। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখছি। মনে মনে, চাইছি সব অভিযোগ মিথ্যা হোক।”
“মায়ের করা কৃতকর্মের জন্য আমাকে ঘৃণা করিস না, দূরে ঠেলে দিস না সাদাত! তাহলে আমি নিঃশেষ হয়ে যাব। তুই তো জানিস, আমি স্বার্থপর নই।”
“পাগলি কোথাকার! তোকে কেন ঘৃণা করব, দূরে সরিয়ে দিবো? যা করেছে ফুপি করেছে। উনার শাস্তি তোকে কেন দেবো? ভালোবাসি তোকে। এতো সহজে ছাড়ার প্রশ্নই আসে না। ইশরা শেখ যতদিন মিসেস সাদাত আসতাফ চৌধুরী না হয় ততদিন আমি পিছু ছাড়বো না।”
কথাটা বলে ইশরার গালের অশ্রু মুছে দিলো। ইশরা অশ্রুত চকিত নয়নে তাকাল সাদাতের দিকে। অন্তঃস্থিত সত্তায় যেন শীতল শিহরণ বইয়ে গেল। কেন যেন দুঃখ, কষ্ট উধাও হয়ে গেল। সাদাত সেই চাহনি দেখে ক্ষীণ হাসল।
রাত গভীর হচ্ছে। সময়টা এগারোটারও বেশি। সারহানের রুমের বাতিটা এখনও জ্বলছে, দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। অরিত্রিকা খাবার হাতে দাঁড়িয়ে, সারহানকে খাওয়াতে এসেছে। মানুষটা না খেয়েই রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে আছে কেন, তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না সে।অরিত্রিকা কয়েকবার জোরে ডাকল, দরজায় টোকাও দিল। কোনো সাড়া নেই। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠছে সে। মাথায় নানা চিন্তা ভিড় করতে থাকে। কয়েকবার নক করার পর অবশেষে ধীরে ধীরে খুলে যায় দরজাটা।সামনে দাঁড়িয়ে সারহান। চোখেমুখে ক্লান্তির ছাপ, কিন্তু কিছু বলছে না। অরিত্রিকা প্রশ্ন করার আগেই তার মুখে ভর করে একরাশ নিঃশব্দ উদ্বেগ।
“আপনি দরজা কেন খুলছিলেন না? জানেন, কতোটা ভয় পেয়েছিলাম?”
অরিত্রিকা উদ্বিগ্নচিত্তে কাতর গলায় সারহানের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল। সারহান নির্জীব, বিবস চাহনিতে পরখ করল মেয়েলী শঙ্কিত মুখশ্রী। সে দরজার সামনে থেকে ভেতরে হেঁটে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে প্রতিত্তোর করল ;
“তোর সামনে জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছি। ভয় পাওয়ার মতো কিছু ঘটেনি।”
অরিত্রিকা অসময়ে ত্যাড়ামী কথা শুনে রেগে গেল। হাতে থাকা খাবারটা নিয়ে ধপাধপ পা ফেলে ছোট টি – টেবিলে শব্দ করে রেখে জ্বলন্ত চাহনিতে তাকাল। রাগত স্বরে বলল;
“দেখছিই তো জীবন্ত দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু আমি আপনার জন্য দুশ্চিন্তা করছিলাম অথচ আপনি তা উপেক্ষা করে কথা শোনাচ্ছেন।”
সারহান পায়ের ওপর পা তুলে ডিভানে আয়েশ করে বসল। পূর্বের ন্যায় বলে উঠল ;
“তোকে উপেক্ষা করিনি। এবার বল কেন এসেছিস?”
অরিত্রিকা গমগমে কন্ঠে বলল;
“আপনার খাবার নিয়ে এসেছি।”
“রাগ না দেখিয়ে খাইয়ে দে।”
“আমি?”
“তুই ছাড়া অন্য কাউকে দেখতে পাচ্ছি না আমি।”
“আমি কিভাবে?”
অরিত্রিকার রাগ নিভে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল। সারহান শীতল চাহনি নিক্ষেপ করল। ভরাট কন্ঠে বলল;
“তোর হাত আছে?”
অরিত্রিকা বোকা বনে গেল। দুই হাত দেখিয়ে বলল;
“এই তো হাত।”
“হাত দিয়ে খাইয়ে দে।”
“কিন্তু।”
“অর্ডার করছি তোকে। বাহানা করা বাদ দিয়ে যা বলেছি তাই কর।”
অরিত্রিকা ভেংচি কাটল। সে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে আসল। অতঃপর এগিয়ে গিয়ে সারহানের পাশে বসল। টি-টেবিলের ওপর থেকে খাবারে থালাটা নিয়ে রুটি ছিঁড়ে সবজিতে ডুবিয়ে সারহানকে খাইয়ে দিলো। সারহান প্রণয়িনীর মুখ ভার দেখে নিঃশব্দে হাসল। অরিত্রিকা লক্ষ্য করে ত্যাছড়া কন্ঠে বলল;
“এতো বড় মানুষ হয়ে আমার মতো পুঁচকে মেয়ের হাতে খাচ্ছেন, লজ্জা লাগছে না।”
সারহান খাবার গিলে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল;
“বউ পুঁচকে হয় না। সত্যি বলতে তোর হাতে খেতে লজ্জা লাগছে না। তবে বিবাহিত ফিলিংস আসছে।”
অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বড় করে তাকায়। আরেক লোকমা খাইয়ে দিয়ে অবাক হওয়ার ভাণ করে বলে;
“তাই! এতোদিন বিবাহিত হওয়ার ফিলিংস আসেনি বুঝি?”
সারহান ভাবলেশহীন কন্ঠে বলল ;
“উহু! তোর ডাকে ভাই ভাই ফিলিংস আসতো। তবে দুইদিন আগে বিবাহিত এবং বর হওয়ার ফিলিংস এসেছে।”
“নির্লজ্জ।”
“আর কিছু বলার বাকী থাকলে বলতে পারিস। এখন মাইন্ড করব না।”
“মুখে লাগাম টানুন।”
“সম্ভব না।”
সারহান বাঁকা হেসে বলল। অরিত্রিকা চোখমুখ কুঁচকে তাকাল৷ সারহান ভাই এমন নির্লজ্জ কথাবার্তা বলতে পারে? ভাবতেই অবাক লাগছে। সারহান টেবিল থেকে পানির বোতলটা নিয়ে দু’ঢোক পানি খেল। পুনরায় দৃষ্টি স্থির করে ভ্রু নাচিয়ে বলল;
“সকাল থেকে আমাকে দেখে লুকিয়ে থাকছিস কেন?”
অরিত্রিকা ভড়কে গেল। আমতা আমতা করে বলল;
“কোথায় লুকিয়ে থাকছি? এই তো আপনার সামনে বসে আছি।”
“সত্যি করে বল কাহিনী কি?”
“কোনো কাহিনী নেই।”
অরিত্রিকা মাথা নিচু করে মিথ্যা বলল। সে মানুষটার থেকে লুকিয়ে বেড়াচ্ছে লজ্জায়। আরেকটা কারণ অবশ্য আছে — তাজিয়া তালুকদার। আবির ভাইয়ের থেকে ঘটনাটা যখন থেকে জেনেছে তখন থেকে ইচ্ছাকৃত সারহান ভাইকে উপেক্ষা করছে। সে খাবারের থালাটা টেবিলে রাখে। দ্বিধাদ্বন্দ্বিত মন নিয়ে মানুষটির দিকে তাকায়। সংকোচ ঝেড়ে সরাসরি প্রশ্ন করে;
“আমি ব্যতিত কেউ আপনাকে ভালোবেসেছে সারহান ভাই?
সারহান অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশ্নে স্বাভাবিক রইল। নিগূঢ় চাহনিতে তাকাল শঙ্কিত, বিবর্ণ মুখপানে। হঠাৎ এমন প্রশ্ন সম্মুখীন হওয়ায় সে নার্ভাস হয়নি। সে রুদ্ধ শ্বাস ফেলে। কোনো ভণিতা না করে দৃঢ় কন্ঠে স্বীকারোক্তি টানে;
“হুমম। ভালোবেসেছে।”
অরিত্রিকার বক্ষপিঞ্জর যেন দুমড়ে মুচড়ে গেল। তবুও ওষ্ঠকোণে মলিন হাসি এঁটে বলল;
“অনেক ভালোবাসতো?”
সারহান অনাগ্রহী ভঙ্গিতে বলল;
“হয়তো বাসতো।”
“নাম কি তার?”
“তাজিয়া তালুকদার।”
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৭৭
“তাজ আপুকে আপনি কেন ভালোবাসলেন না?”
“তোকে ভালোবাসতাম তাই।”
সারহান অতি শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করল। অরিত্রিকা আরেকদফা চমকাল। সে বিস্মায়াবিষ্ট চাহনিতে অপলক তাকিয়ে রইল। সারহান সেই চাহনি দেখে সহালকা হেসে বলল;
“প্রথম ভালোবাসার অনুভূতি সবসময় অমলিন থাকে। যে হৃদয়ে তুই স্থান পেয়েছিস, সেখানে আর কারো অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।”
কথাটা শেষ করে সারহান ডিভান থেকে উঠে যায়। সে আস্তে ধীরে এগিয়ে যায় বেলকনির দিকে। পেছনে ফেলে যায় এক অবুঝ রমনীকে। যে তার মন এবং মস্তিষ্কের টানাপোড়েনে নিমগ্ন। হয়তো ভালোবাসার গভীরতা বোঝার চেষ্টা করছে।