প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮১

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮১
আদ্রিতা নিশি

“পুরুষেরা নারীতে মোহ খোঁজে, ভালোবাসে, তারপর মনের মতো হলে বিয়ে করে। অধিকাংশ সময় সেই ভালোবাসা হয় শর্তসাপেক্ষ, নির্দোষতার বিনিময়ে অথচ আপনি আমায় আমার সমস্ত কলঙ্ক, ব্য*থা, দাগসহ গ্রহণ করেছেন,ভালোবেসে আগলে রেখেছেন। নিঃস্বার্থভাবে কীভাবে ভালোবাসতে হয় তা আপনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। এভাবো কতো জন ভালোবাসতে পারে বলুন?”
রাত গভীর অথচ কপোত-কপোতী ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ সময় পরে একে অপরের সঙ্গে একটু সময় কাটাচ্ছে। হঠাৎ অরিত্রিকা সারহানের পানে তাকাল। কেমন যেন অদ্ভুত কন্ঠে বলে উঠল। সারহান তড়িৎ বেগে তাকাল। নিরাবেগ চাহনি নিক্ষেপ করল মেয়েলী মুখশ্রীতে! তৎক্ষণাৎ মৃদু-গম্ভীর কন্ঠে প্রতিত্তোর করল;

“ভালোবাসা যদি শর্ত মেনে হয়!তবে সেটাকে লেনদেন বলে, ভালোবাসা বলে না। আমি তোকে
অতীত সমেত ঘৃণা না করে, তোর পুরো অস্তিত্বকে ভালোবেসেছি। কলঙ্ক যদি সমাজের দেওয়া হয় তবে সেটা আমার কাছে অর্থহীন। তুই যেমন, সেই তোকেই আমি সারহান ইদায়াত চৌধুরী চেয়েছি, চিরকাল চাইব।”
অরিত্রিকার অন্তঃস্থিত সত্তা কেঁপে উঠল। সে মোহাবিষ্ট চাহনিতে তাকিয়ে রইল। অনুভব করল মানুষটার সম্পূর্ণ কথার মর্মার্থ। সারহান নিগূঢ় চাহনিতে পরখ করল। যথাসম্ভব সংযত কন্ঠে বলল;
“আর কোনোদিন অতীত মনে করে কষ্ট পাবি না। বলেছিলাম, তোর অতীত আমার কাছে ম্যাটার করে না।”
অরিত্রিকা ম্লান হাসল। অতীত তো ভুলেই বসেছে মানুষটার ভালোবাসায়। হঠাৎ এ মুহুর্তে কথাটা মনে হতেই বলল। একটু অপরাধীর মতো মনে হলো। মুখ কাচুমাচু করে বলল;
“স্যরি। আর কোনোদিন এসব কথা মনে করব না।”
“মনে থাকে যেন।”
“হুম।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আজমল সাহেব সারহানকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে এসেছেন। চিলেকোঠা পেরিয়ে পা রাখতেই দেখলেন সারহান রেলিঙ ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। পাশেই অরিত্রিকা কথা বলছে। তিনি গলা খাঁকড়ি দিয়ে এগিয়ে আসলেন। অরিত্রিকা চমকে সামনে তাকাল। বাবাকে আসতে দেখে মুখ শুকিয়ে গেল। খানিকটা লজ্জাও পেল। সারহান ঘাড় বাঁকিয়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সামনে। চাচাকে দেখে সটান হয়ে দাঁড়াল। কিন্তু কোনো হেলদোল দেখা গেল না। নির্লিপ্ত ভাবলেশহীন ভাবে থাকলো। আজমল সাহেব এসে সামনাসামনি দাঁড়ালেন। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন;
“মা, তুমি নিচে যাও।”
অরিত্রিকা একবার সারহানের পানে তাকিয়ে মাথা দুলিয়ে ভদ্র মেয়ের মতো বলল;
“আচ্ছা আব্বু।”

কথাটা বলে অরিত্রিকা সেখান থেকে প্রস্থান করল। আজমল সাহেব নিরবতা ভেঙে বলে উঠলেন ;
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা বলার ছিলো।”
সারহানের কপাল কুঁচকে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল ;
“বলুন।”
“আমি তোমায় কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করব। সেই প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও।”
“কি জানতে চান?”
“নিশাদ আমার মেয়ের সাথে তিনবছর আগে কি করেছিল? আমার থেকে কিছু লুকানোর চেষ্টা করো না।”
“আপনি পুরনো ঘটনা কেন টেনে আনছেন?”

সারহান গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলল। আজমল সাহেব শান্ত কন্ঠে বলল;
“কারণ আমার মনে হচ্ছে তুমি কিছু লুকিয়েছো। কতোবার জানাতে চেয়েছি অথচ তুমি এড়িয়ে গিয়েছো।”
সারহান বিরক্তিবোধ করল। তবুও সংযত কন্ঠে বলল;
“আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারদের মা*রার হুমকি দিয়েছিলো। তাই ফাইরুজ ভয় পেয়েছিল। নিশাদ ব্ল্যাকমেইল করে যা বলেছিল ভয়ে সেটাই করেছিলো। আপনি যা ভাবছেন তেমন কিছু হয়নি।”
“সত্যি বলছো?”
“জ্বি।”

“আমার ছোট্ট মেয়েটা কতো কিছু সহ্য করেছে অথচ আমি বুঝতেও পারিনি। তুমি না বললে ওকে আমরা মানসিকভাবে সাপোর্ট করতেও পারতাম না। তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ আমি।”
“যা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন বর্তমান নিয়ে ভাবুন।”
সারহান স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলে উঠল। আজমল সাহেব হঠাৎ সারহানের এক হাত ধরল। কেমন ভঙ্গুর কন্ঠে বললেন;
“আমাকে ক্ষমা করে দিও সারহান। তোমার অনুভূতির কথা জেনেও ইসমার কথা মেনে নিয়েছিলাম। সেসময় আমি নিজেও দোটানায় ভুগছিলাম। বোনটা হাতে পায়ে ধরে আবদার করেছিল তাই ফেলতে পারিনি।”
সারহান অন্যহাত চাচার হাতের ওপর আস্বস্ত করার জন্য রেখে দৃঢ় কন্ঠে বলল;

“আপনার বোন ইমোশনাল কথাবার্তা বলে ফাঁদে ফেলেছিল। আপনিও সেই ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। উনার জন্য আমাদের পরিবারটা শেষ হয়ে গেছে। দয়া করে উনার মতো স্বার্থপর মানুষের নাম পরবর্তীতে নিবেন না।”
“বলার ভাষা নেই আমার। তুমি শুধু বলো আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো?”
“আপনি আমার গুরুজন। বয়সে অনেকটা বড়। এভাবে ক্ষমা চাইবেন না। ওটা একটা ভুল ছিলো। বুঝতে পেরেছেন এটাই অনেক।”
“আমার মেয়েটাকে আগলে রেখো সারাজীবন আব্বা।”

“জ্বি, সারাজীবন আগলে রাখবো।”
সারহান নম্র কন্ঠে ছোট্ট প্রতিত্তোর করল। আজমল সাহেব চোখের অশ্রু মুছে বললেন;
“নিচে যাও, ঘুমিয়ে পড়ো। জার্নি করে এসেছো রাত জাগলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
সারহান চাচার এমন অমায়িক ব্যবহার দেখে বলল;
“যাচ্ছি। আপনার কথা শুনে, মনে হচ্ছে ছোট মেয়ের জামাই ভীষণ পছন্দ হয়েছে?”
আজমল সাহেব কথার ধরণ শুনে হাসলেন;
“বড় – ছোট দুই মেয়ের জামাই পছন্দ হয়েছে। পছন্দ না করে কোনো উপায় আছে?”
সারহান নিঃশব্দে হাসল। আজমল সাহেব আবিরকে মন থেকে মেয়ের জামাই হিসেবে অনেক আগেই মেনে নিয়েছেন। তবে তার ক্ষেত্রে ওমন মনোভাব কখনো প্রকাশ করেননি তবে আজ করলেন। সে বলল;

“চলুন।”
আজমল সাহেব বললেন ;
“চলো।”

রাত পেরিয়ে ভোর হয়েছে। আজকের আবহাওয়া অন্য দিনের চেয়ে আলাদা। বর্ষাকালে যেমন সকাল-বিকেল নিয়মমাফিক বৃষ্টি হয়, আজ তেমন কিছুই নেই। চারপাশ ভরে আছে সূর্যের সোনালি আলোয়! বৃষ্টি না হলেও প্রকৃতিতে বইছে শীতল হাওয়া। সব মিলিয়ে পরিবেশটা অনাবিল রোমাঞ্চে ভরা। আজ শুক্রবার— সারহান ও অরিত্রিকার রিসেপশন। রাজশাহী-১ আসনের এমপির রিসেপশন বলে কথা, আয়োজনও তাই স্বভাবতই জাঁকজমকপূর্ণ। রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের – দলীয় সাধারণ কর্মীদের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন, সারহানে বন্ধুমহল আমন্ত্রিত। এমনকি ইলহামের পরিবার, আয়নাল সাহেব আর আহিয়াদ-মীরাতের পরিবারকেও নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। যেহেতু অনুষ্ঠানটি কমিউনিটি সেন্টারে হবে, তাই বাড়িতে ভিড় তেমন নেই।সবাই সোজাসুজি সেন্টারের দিকেই রওনা দেবে। চৌধুরী বাড়িতে ভোর থেকে সবাই তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। সারহান ব্যতিত বাড়ির বড়-ছোট ছেলেরা কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। বাড়ির বউ – মেয়েরাও নানা কাজে ব্যস্ত। গতরাতে ডেকোরেশন লোকজন গোটা বাড়ি সাজিয়ে ও লাইটিং করে দিয়ে গিয়েছে। সাদাত এবং আবির সেই রাত জেগে সেসব ঠিকমতো করছে কিনা তা নজরে রেখেছে।

সকাল দশটা বাজে। সারহান কিছুক্ষণ পূর্বে ঘুম থেকে উঠেছে। ফ্রেশ হয়ে অরিত্রিকার রুমে গিয়েছিল মেয়েটাকে একপলক দেখার জন্য। কিন্তু গিয়ে পাইনি। সে ছাদ,লিভিং রুমে না পেয়ে কিচেনে এসেছে। তানিয়া বেগম আরশাদ সাহেবের জন্য পরোটা ভাজছিলেন। হঠাৎ ছেলের আগমনে অবাক হলেন। জিজ্ঞেস করলেন;
“তুই কিচেনে এসেছিস কেন? কফি লাগলে কাউকে দিয়ে বলে পাঠাতে পারতিস, আমি বানিয়ে দিয়ে পাঠাতাম।”
সারহান অতিশয় গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“কফি চাই না। ফাইরুজকে চাই। ও কোথায় গেছে দেখেছো? কখন থেকে খুঁজছি কিন্তু ম্যাডামের কোনো খবর নেই। ”
তানিয়া বেগম ছেলের কথা শুনে হাসলেন;

“বাড়িতে থাকলে তো খুঁজে পাবি।”
সারহান ভ্রুযুগল গুটিয়ে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল;
“ফাইরুজ বাড়িতে নেই মানে? কোথায় গেছে?”
তানিয়া বেগম বললেন;
“পার্লারে গেছে।”
“আমাকে না বলে চলে গেল?”
“তুই ঘুমিয়েছিলি তাই ডাকেনি।”
“কখন গেছে?”
“সাতটার আগে।”
তানিয়া বেগম গ্যাসের চুলাটা বন্ধ করে বললেন। সারহান প্রশ্নাত্মক কন্ঠে বলল ;
“কার সাথে পার্লারে গেছে?”
তানিয়া বেগম বললেন;

“ইরফান ওদের পার্লারে নিয়ে গেছে। অরিত্রিকার সাথে ইশরা রাহাও আছে।”
সারহান আর কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করে কিচেন থেকে বেরিয়ে গেল। লিভিং রুমে এসে বসতেই আবির কোথাও থেকে উড়ে এসে ঠাস করে পাশে বসে পড়ল।হেসে বলে উঠল;
“দোস্ত!অবশেষে তোর বাসর সাজানোর সুযোগ এসেছে। আগেই বলে রাখছি দুই লাখ টাকা না দিলে রুমে ঢুকতে দেবো না।”
সারহান চ বর্গীয় শব্দ করে গমগমে কন্ঠে বলল;

“তুই এসব ছাড়া আর অন্যকিছু ভাবতে পারিস না?”
“নাহ। তোর পকেট ফাঁকা করার জন্য মনটা আকুপাকু করছে।”
“তুই ব্যতিত সবাইকে টাকা দেবো। বয়স তো কম হয়নি তাও বাচ্চামী করছিস।”
“তুই এটা বলতে পারলি দোস্ত?”
“পারলাম।”
সারহান ভাবলেশহীন ভাবে বলে উঠল। আবির মন খারাপ করার ভাণ করে বলল;
“বয়স মাত্র আঠাশ- উনত্রিশের কোঠায় আর তুই আমাকে বুড়ো বানিয়ে দিলি?”
সারহান টাউজারের পকেট থেকে ফোনটা বের করে লক খুলে নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল;

“তাহলে কি বাচ্চা বলবো?”
আবির মুখ ভার করে বলল;
“তোর সাথে কথা বলাই বেকার।”
সারহান গুরুগম্ভীর কন্ঠে বলল;
“তাহলে চুপ করে থাক।”
“হিটালারের জামাই।”
“ইউ অলসো।”
কথাটি বলে সারহান অরিত্রিকাকে কল দিতে উদ্যত হলো। কিন্তু তার দৃষ্টি স্থির হলো হোয়াটসঅ্যাপে আসা মেসেজে। সাড়ে সাতটার সময় মেয়েটা তাকে মেসেজে। সে দ্রুত ক্লিক করল মেসেজে। তখুনি ফোন স্কিনে ভেসে উঠল বার্তাটি ;

“গুড মর্নিং, নেতাসাহেব! আমি ইরফান ভাই, ইশরা আর রাহাকে সঙ্গে নিয়ে পার্লারে যাচ্ছি। আপনাকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তখন আপনি ঘুমাচ্ছিলেন।তাই ডাকিনি শুধু এই মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দিলাম।
— আপনার বিবিজান”
সারহান মেসেজটা পড়ে একটু ঠান্ডা হলো। সে তৎক্ষনাৎ কল করল অরিত্রিকাকে। কিন্তু কল রিসিভ করল না। আরও কয়েকবার কল দিয়ে না পেয়ে ইরফানকে কল দিলো। অপর পাশ হতে রিসিভ হতেই সারহান বলে উঠল;
“কোথায় আছিস?”
ইরফান জবাব দিলো ;

“পার্লারের সামনে গাড়িতে বসে আছি।”
“ফাইরুজ… ”
“অরিত্রিকা, রাহা আর ইশরা পার্লারে র ভেতরে আছে।”
“কখন আসবি?”
“দেরী হবে। এখান থেকে সরাসরি কমিউনিটি সেন্টারে যাব।”
“ওকে ওদের নিয়ে সাবধানে যাস।”
কথাটি বলে কল কাটলো সারহান। আবির বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল;
“দোস্ত! অরিত্রিকাকে একটু কম সাজতে বল।”
সারহান ভ্রুযুগল কুঁচকে বলল;
“কেন?”

“আরে! মনে নেই তোর, অরিন রিসিপশনের দিন পার্লার থেকে সেজে এসেছিল। আমি তো দেখে চমকে গিয়েছিলাম। লাফিয়ে উঠে বলেছিলাম আমার বউ এক্সচেঞ্জ হয়ে গেছে। এতো সাজের জন্য আমি আমার একমাত্র বউকে চিনতে পারিনি। রাতে এটা নিয়ে কি ঝগড়াটাই না লেগেছিল ওর সাথে। মেকআপ করে চেহারা পাল্টে এলে কোনো দোষ নেই। কিন্তু চিনতে না পারলেই দোষ!”
“এই জন্য মনের কানেকশন থাকতে হয়।”
“তারমানে তুই বলতে চাইছিস আমার ভালোবাসায় কমতি আছে?”
“আমি কখন বললাম?”
সারহান কন্ঠে নির্লিপ্ততা নিয়ে বলল। আবির কটমট করে তাকিয়ে রইল। সাদাত সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। হেলেদুলে এসে অপর পাশের সোফায় বসে ক্লান্ত ভঙ্গিমায় বসল। সারহান জিজ্ঞেস করল;
“কোথায় থেকে আসছিস?”

সাদাত ক্লান্ত ভঙ্গিমায় মুখ গোমড়া করে বলল;
“ইশরার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
সারহানের চোখে মুখে গাম্ভীর্যতা নামল। আবির সন্দিহান কন্ঠে বলল;
“কিন্তু তোমার চোখ মুখ ওমন ইয়ের মতো হয়ে আছে কেন?”
“কারণ ওর সাথে দেখা করতে পারিনি। লেডিস্ পার্লারে ঢোকা যাবে না বলে ঢুকতে দেয়নি।”
“শালাবাবু! কয়েকঘন্টা পরে রিসিপশন। তখন তো দেখতে পেতেই। এতো অধৈর্য হলে হয়? বড় ভাইয়ের থেকে ধৈয ধারণ করা শিখে নাও।”
“ভাইয়ের মতো ধৈর্যবান হওয়া সম্ভব নয় ভাইয়া। আমার ভাই একপিসই আছে। যার মতো হওয়া প্রায় অসম্ভব।”
“তা ঠিক বলেছো। শোনো, সামনে এক্সাম। পড়াশোনা করো। তারপর অনার্স থার্ড ইয়ারে উঠলে সুযোগ বুঝে আংকেলকে ইশরার কথাটা জানাও।”

আবির বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিমায় বলল। সাদাত সোফায় শরীর এলিয়ে দিয়ে বলল ;
“আমি বাবাকে বলতে পারবো না। ভাইয়ের ওপর সব দায়িত্ব দিয়েছি। দেখা যাক কি করে।”
আবির বিস্মিত চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে। বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে বলল;
“দোস্ত! তুই আংকেলকে সাদাত আর ইশরার ব্যাপারে বলবি এখনি? ওরা তো এখনো ছোট।”
সারহান ফোঁস করে শ্বাস ফেলল। গমগমে কন্ঠে বলল;
“সাদাত পড়াশোনা শেষ করে জব না করা পর্যন্ত বাবাকে এসব বিষয়ে কোনো কথা বলবো না।”
সাদাত লাফিয়ে উঠে বলল;

“ভাই! এটা তুমি বলতে পারলে?”
সারহান গাম্ভীর্যতা বজায় রেখে বলল;
“পারলাম। সামনে এক্সাম ভালোভাবে পড়। সিজিপিএ তিন পয়েন্ট পঞ্চাশের কম হলে ইশরাকে বিয়ে করার কথা ভুলে যা।”
“ভাই, তুমি আমায় ব্ল্যাকমেইল করছো?”
“হুমম করছি।”

দুপুর গড়িয়ে বারোটা পেরিয়েছে। রাজশাহীর সবচেয়ে বড় লোটাস কমিউনিটি সেন্টারে রিসেপশনের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে। আমন্ত্রিত অতিথিরা ইতোমধ্যেই আসতে শুরু করেছেন। পুরো কমিউনিটি সেন্টার রাজকীয় শোভায় সেজে উঠেছে। মেহমানদের পদাচারণায় মুখোর চারিপাশ। ওয়েডিং স্টেজে বসে আছে সারহান।তার পরনে ক্রিম রঙের শেরওয়ানি হালকা এমব্রয়ডারিতে সাজানো, সোজা কাটের মার্জিত ডিজাইন। রঙের কোমলতা আর পরিমিত সাজসজ্জায় যেন গম্ভীর ব্যক্তিত্বে এনে দিয়েছে আভিজাত্যপূর্ণ ফর্মাল আবহ। বরবেশে তাকে দেখতে আকর্ষণীয় লাগছে।

“ইরফান কোথায়? এখনো আসছে না কেন?”
সারহান পাশে বসা আবিরকে উদ্দেশ্য করে বলল। আবির আচানক কথা শুনে চমকে গেল। সে শাড়ি এবং সাজগোজ করে ঘুরাফেরা করা অরিনের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল;
“ আর দশ মিনিট লাগবে আসতে।”
সারহান বিরক্ত প্রকাশ করে বলল;
“এতো দেরী হয় পার্লার থেকে আসতে? ”
“অরিত্রিকার সাজা হয়নি তাই বোধ হয় দেরী হচ্ছে।”
“মেয়েদের সাজগোজ করতে এতো সময় লাগে! ওহ গড। ”
“আহা! বন্ধু আজকের মতো একটু শান্তশিষ্ট, ভদ্র লেজ বিশিষ্ট হয়ে থাক। আগামীকাল থেকে না থাকলেও হবে।”
“বেশী কথা না বলে ইরফানকে কল দে। কতো দূর জিজ্ঞেস কর।”

সারহান কথা বলা শেষ করতেই প্রাক্তন এমপি সহ দলের কিছু নেতা কর্মীরা স্টেজে এসে দেখা করতে আসলো। আবির উঠে সাক্ষাৎ করে স্টেজ থেকে নেমে বাহিরের দিকে গেল। এদিকটায় কথোপকথন ভেসে আসছে তাই কথা বলতে অসুবিধা হবে। আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আমন্ত্রিত মেহমানদের স্বাগতম জানাচ্ছেন। তানিয়া বেগম এবং সাথী বেগম অরিন ও রাহার পরিবারের সাথে দাঁড়িয়ে গল্প করছেন।
“ পাঁচমিনিটের মধ্যে চলে আসবে ওরা।”
আবির কথা বলা শেষ করে এসে বলল। সারহান শুনলো। সে কিছু বলতে যাবে এমন সময় ভার্সিটির বন্ধুমহল এসে হাজির হলো। পৃহাল, ইফাত ও ইলহাম এসে সারহানকে জড়িয়ে ধরল। সারহান হকচকিয়ে গেল। মুন ও রাই হেসে উঠল। তারপর সবাই উচ্ছ্বসিত ভাব নিয়ে শুভকামনা জানালো। আবির হিমিকে কোলে নিয়ে ওদের সাথে কথা বলায় মশগুল হয়ে গেল।

“আমি ভেবেছিলাম তোরা আসবি না।”
সারহান শেরওয়ানী টেনেটুনে ঠিক করে স্বাভাবিক ভাবে বলল। পৃহাল ভাব নিয়ে বলল;
“ব্যাটা আকদ তাড়াহুড়ো করে করেছিলি তাই আসতে পারিনি। এবার আগেই ছুটি নিয়ে আসার জন্য রেডি হয়েছিলাম। আকদ মিস করলেও রিসিপশন মিস করা যাবে না।”
সারহান বলল;
“গতকাল কেন আসিসনি? ”
রাই বলল;
“ইফাতের জন্য আসতে পারিনি। ব্যাটার গতকাল ছুটি ছিল না।”
সারহান ইফাতের দিকে তাকিয়ে বলল;
“ওহহ আচ্ছা। তোর আর মুনের বিয়ে কবে? আর কতোদিন আমার ফ্রেন্ডকে সিঙ্গেল রাখবি।”
ইফাত হাসল;
“আর মাত্র তিনমাস। ডিসেম্বরের লাস্টে ফাইনালি তোর সিঙ্গেল বান্ধবীকে বিয়ে করছি।”
সবাই হেসে উঠল। মুন লজ্জা পেল। সারহান দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“গুড। ইলহামকে কোথায় পেলি?”
মুন বলল;

“ব্যাটাকে ওর বাড়ি নিয়ে এসেছে ওরা। ও আসতেই চাইছিলো না।”
সারহানের কপালে সূক্ষ্ম ভাজ পড়ল। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল;
“রিসিপশনে কেন আসতে চাসনি?”
ইলহাম ভড়কে গেল ;
“ইয়ে মানে এমনি।”
“যদি না আসতিস তোর খবর করতাম।”
“এসেছি তো। ভয় দেখানো বাদ দে।”
“তোরা বাবা মা, চাচা – চাচীর সাথে দেখা করেছিস?”
“দুই আংকেলের সাথে দেখা করেছি। আন্টিদের সঙ্গে দেখা হয়নি।”
পৃহাল বলে উঠল। সারহান স্বাভাবিক ভাবে বলল;
“দেখা করে আয়।”
সবাই আচ্ছা বলে চলে গেল। কোথাও থেকে সাদাত দৌড়ে আসলো। সারহানের কাছে এসে আস্তে করে বলল;
“ভাই তোমার বিবিজান চলে এসেছে।”

কথাটি বলে সাদাত যেভাবে এসেছিল সেভাবে দৌড়ে নিচে চলে গেল।সারহান তড়াক গতিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল প্রবেশ পথের দিকে। তার দৃষ্টি স্থির হলো সেথায়। দুপাশে মানুষজন সরে দাঁড়িয়েছে। মাঝখান দিয়ে সরু কার্পেটে ফুল বিছানো রাস্তা স্টেজ অব্দি। প্রবেশ পথের রাহা এবং ইশারা সামনে দাঁড়ানো। তাদের পেছনে অরিত্রিকা রয়েছে কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সাদাত, ইরফান,পৃহাল এবং আফ্রিদি লাল রঙের কাপড়ের ফুলেল চাদর আগে পিছে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সারহানের তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো দ্বিতীয় বার নববধূ রুপে নিভৃতসুধাকে দেখতে মরিয়া হয়ে উঠে। অন্তঃস্থিত মন বিচলিত হয়। কিন্তু অরিত্রিকাকে ভালোভাবে দেখতে না পেয়ে আশাহত হয়। নিচ থেকে সারহানের বন্ধুমহল বন্ধুর ওমন অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসে। আবির ঠেস দিয়ে বলে;

“ভাই! তোর আকদের দুই মাস হয়ে গেছে। কিন্তু তোকে দেখে মনে হচ্ছে আজ তোর বিয়ে।”
সারহান আবিরের কথার জবাব না দিয়ে একদম স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়ায়। তার খেয়াল হয় আশেপাশে মিডিয়া, ক্যামেরাম্যানরা ভিডিও করছে। কিছুক্ষণ পরেই মৃদু আওয়াজে গান শুরু হয়।
❝ Salma sitaron wali shagna di shab ayi re
Banno se banne ki milne jo root layi re
Shehnai yoon Goonji sabki ankhein Bhar ayi re ❞

রাহা ও ইশরা হাসি মুখে দুপাশে সরে গেল। অরিত্রিকা সহালকা হেসে বউসাজে আস্তে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগল। চারজন ফুলেল চাদর মাথার ওপর স্থির রেখে হাসি মুখে আসতে লাগল। সারহানের তৃষ্ণার্ত চক্ষুদ্বয় থমকে গেল বধূরুপে অরিত্রিকাকে দেখে। সুগভীর তীক্ষ্ণ চোখ যেন মুগ্ধতায় ডুবে গেল। বক্ষের ভেতর বইয়ে গেল এক স্নিগ্ধ অনুভূতি। মেরুন-ওয়াইন রঙের রেশমি লেহেঙ্গাতে অরিত্রিকাকে মোহনীয় লাগছে। লেহেঙ্গার প্রান্তে সোনালি জরির সূক্ষ্ম নকশা মৃদু আলোয় ঝলমল করে উঠছে। গলা জুড়ে হার, কানে দুল, হাত ভর্তি চুড়ি, মাথায় টিকলি সাজে নেই কোনো বাড়তি আড়ম্বর।তবু আছে শান্ত আভিজাত্যে চোখ ফেরানো দায় । খোলা চুল স্টাইল করে বাঁধা তা কাঁধে আলতো ভর করেছে। এ সাজ মুখশ্রীতে এনেছে অনন্য আবেদন। গাঢ় রঙের লিপস্টিকে মোড়ানো ঠোঁট আর ডাগর আঁখিযুগলের লাজুক চাহনির উপস্থিতি এতটাই মনোমুগ্ধকর যে ভিড়ের মধ্যেও দৃষ্টি আটকে যাবে শুধু তার দিকেই। অরিত্রিকা এসে স্টেজের কাছে দাঁড়াতেই নুপুরের ঝংকারে প্রতিধ্বনিত হলো চতুর্দিক। সারহানের ধ্যান ভাঙল। সে অতি শান্ত আবিষ্ট চাহনিতে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। মেয়েটা বোধ হয় লজ্জা পেল। দ্রুত দৃষ্টি নত করে মৃদু হাসল। সারহান কারো চাহনি পরখ না করে এগিয়ে গেল সেদিকে। অতঃপর অরিত্রিকার দিকে হাত বাড়িয়ে সুগভীর কন্ঠে বলল;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮০

“আসুন বিবিজান।”
অরিত্রিকা আপনি সম্বোধন করায় হতবাক হয়ে চাইল। পরক্ষণে সামলে নিয়ে হাতটা বাড়িয়ে রাখল প্রিয় পুরুষের হাতে। তখুনি সারহান আলতো করে ধরল মেয়েলী হাত। মুহুর্তেই সারহানের বন্ধুমহল, সাদাত, ইশরা, রাহা, ইফা সহ অনেকে চিল্লিয়ে উঠল। সেসব তোয়াক্কা না করে অরিত্রিকার হাত ধরে সারহান স্টেজে তুলে আনলো। অরিত্রিকা চিল্লানোর আওয়াজে ভীষণ লজ্জা পেল। একদম লজ্জাবতী পাতার ন্যায় মিইয়ে গেল।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮১ (২)