প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮২

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮২
আদ্রিতা নিশি

আবিরের কথা শুনে সারহান মুহূর্তের জন্য খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেলেও তা মুখে ফুটতে দিল না। অনড় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। পরিস্থিতি লজ্জাজনক, অথচ তার ভেতরে লজ্জার লেশমাত্র নেই বিষয়টা সত্যিই বিস্ময়কর। মাঝরাতে এমন ধামাকাদার খবরে চৌধুরী বাড়ির সবাই হতবাক ও স্তব্ধ। সবার মনে একই প্রশ্ন এ কিভাবে সম্ভব? সারহানের অবস্থাও ভিন্ন নয়। হঠাৎ বাবা হওয়ার সংবাদ তাকে যেন শূন্যে ফেলে দিয়েছে। ডক্টর মনজুর সবার এই বিহ্বলতা দেখে মুচকি হেসে ফেললেন। রিসেপশন শেষ করে বাসরঘরে প্রবেশ করতেই বর শুনল সে বাবা হতে চলেছে! ঘটনা সত্যিই বিরল। সারহানের মুখের অভিব্যক্তি দেখেই ডক্টর বুঝলেন এমন অপ্রত্যাশিত খবর সে কল্পনাও করেনি।। গলা খাঁকড়ি দিয়ে পুনরায় বললেন;

“অরিত্রিকা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট।প্রথমবার মা হতে চলেছে। তাই ওর বিশেষ যত্ন ও খেয়াল রাখা প্রয়োজন। চেক-আপ করে দেখেছি, শরীর কিছুটা দুর্বল। সম্ভবত খাওয়া-দাওয়া ও ঘুম দুটোই নিয়মমাফিক হচ্ছে না। আমি কিছু ওষুধ, হালকা ব্যায়াম এবং খাবারের চার্ট লিখে দিচ্ছি। নিয়ম মেনে চললে আশা করি কোনো জটিলতা হবে না। আরশাদ সাহেব, আমার সাথে নিচে আসুন।”
আরশাদ সাহেব এতোক্ষণ ছেলের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে ছিলেন। এমন একটা খবরে তিনি বেশ চমকেছেন। ডক্টরের কথা শুনে নড়েচড়ে উঠলেন। নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়ে ত্যাছড়া কন্ঠে বিরবির করে বললেন;
“আমার ছেলে হয়ে এতটা অধৈর্য হলো কীভাবে? আর একটু ধৈর্য রাখা যেত না?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহান স্পষ্টই শুনতে পেল কথাটা, আর তাতে একটুও সন্দেহ রইল না তার বাবা ইচ্ছাকৃতভাবেই খোঁচা দিয়েছেন। সে রুদ্ধশ্বাসে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। ডক্টরের কথামতো অরিত্রিকা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। তার মানে… গ্রামে থাকার সময়ই! বাকিটা ভাবা সম্ভব হলো না। মাথাটা যেন হঠাৎ অচল হয়ে গেছে, চিন্তাধারা থমকে দাঁড়িয়েছে।
সামনে চোখ উঠাতেই দেখতে পেল সবার অদ্ভুত, হতবাক চাহনি একেবারে তার দিকে নিবদ্ধ। বিশেষ করে আজমল সাহেবের চোখে সন্দেহ আর বিস্ময়ের মিশ্র অদ্ভুত দৃষ্টি। সেই চাহনি যেন পরখ করে নিচ্ছে তাকে, যেমন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়া চোরকে জিজ্ঞাসাবাদের আগে গম্ভীরভাবে, ঠাণ্ডা চোখে মূল্যায়ন করা হয় ঠিক তেমন।
“দোস্ত! সবার আগে বিয়ে করলাম আমি আর সবার আগে বাপ হয়ে যাচ্ছিস তুই! এই অবিচার সইব কি করে?”
আবির বন্ধুর সামনে এসে এক বুক হতাশা নিয়ে হা হুতাশ করে বলল। সারহান কিছু বলল না। শুধু শীতল চাহনিতে তাকিয়ে শাণিত পায়ে রুমের দিকে পা বাড়াল। পিছু পিছু ছুটল আবির ও। আজমল সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। তিনি আপাতত চুপ করে রইলেন। আগে ঝটকার রেষ কাটুক তারপর ভাবা যাবে। তিনি ও মেয়ের কাছে গেলেন।
“আমি চাচ্চু হতে যাচ্ছি… ইরফান ভাই আমার হিসেব মিলছে না। ”

সাদাত ভাবনায় বিভোর হয়ে বিস্ময়াভিভূত কন্ঠে বলে উঠল। সে সত্যি বিশ্বাস করতে পারছে না কথাটা। বড় ভাই যে রিসেপশনের দিনই এতো বড় চমক দিবে তারা কেউ ভাবতে পারেনি। ইরফানের ধ্যান ভাঙল। সে সবার মুখের দিকে একবার তাকাল। অতঃপর অবাকতার রেষ নিয়ে বলল;
“আমার হিসেবও মিলছে না.. সাদাত। আমি.. বড়বাবা হতে যাচ্ছি! ভেবেই কেমন যেন লাগছে।”
সাদাত পূর্বের ন্যায় বলে উঠল;
“বড়বাবা, চাচ্চুর সাথে আমরা মামুও হচ্ছি ইরফান ভাই।”
ইরফান কিছু বলবে তার আগেই ইশরা গভীর ভাবনায় মত্ত হয়ে বলল;
“তারমানে লেভির ভাই অথবা বোন আসছে! দুজনে আমাদের এমন চমক দিলো যে ঘোর কাটিয়ে উঠতেই পারছি না।”

রাহা বিস্ময় ভাব কাটিয়ে থেমে থেমে বলল;
“আগে বিয়ে হলো অরিন আপুর আর বাচ্চা হবে অরিত্রিকার। যাই হোক, আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।”
অরিন এতোক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে শুনছিল। সে নিজেও অবাক ছোট বোনটার বাচ্চা হবে। সে এদের সামনে কিছু না বলে ছুটল অরিত্রিকাকে দেখতে। ইরফান হঠাৎ রসিয়ে বলল ;
“বাবা হওয়ার খবর শুনে সারহানের অবস্থা দেখার মতো ছিল। বেচারা নিজেও জানতো না তার জন্য কতো বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল।”
কথাটা শুনে সবাই হেসে উঠল। তারা সবাই অবশ্য এ বিষয়টা খেয়াল করেছে।

সারহান ডিভানে হেলান দিয়ে গাম্ভীর্য ভাব এঁটে চুপচাপ বসে আছে। তার দৃষ্টি নিবদ্ধ বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা অরিত্রিকার দিকে। মেয়েটা তাকে গ্যারাকলে ফেলে কি শান্তিতে ঘুমচ্ছে। রুম ভর্তি চৌধুরী বাড়ির সবাইকে দিয়ে। কেউ বিছানায় বসে আছে, কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে, কেউবা তার দিকে ক্রূর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে আছে। তানিয়া বেগম অরিত্রিকার কাছে থেকে উঠে এলেন। চোখ- মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই মনের ভেতরে কি চলছে। তিনি এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন ছেলের পাশে। নরম কন্ঠে বললেন;
“সারহান! কি হয়েছে? মুখ ওমন গম্ভীর করে কেন আছিস?”
সারহান চোখ তুলে চাইল না। গম্ভীর কণ্ঠে ছোট্ট করে প্রতিত্তোর করল;

“আমার কিছু হয়নি।”
তানিয়া বেগম বললেন;
“তোর কি মন খারাপ? মানে অরিত্রিকা মা হতে যাচ্ছে…. ”
সারহান সহসা দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“আমার বাচ্চা আসবে.. আমি কেন মন খারাপ করব?”
তানিয়া বেগম হাসলেন;
“সবাই ভাবছে তুই খুশি নস। তাই ওমন গম্ভীর মুখে বসে আছিস। আজকের দিনেও তুই নিজের আনন্দ – খুশি প্রকাশ করবি না বাপ?”

সারহান নিশ্চুপ, পাথরের মতো স্থির হয়ে রইল। তানিয়া বেগম হতাশ দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন। যখন প্রথম শুনেছিলেন অরিত্রিকা প্রেগন্যান্ট, তখন যেন আকাশ থেকে পড়েছিলেন তিনি। সাথী বেগমেরও অবস্থা ছিল হুবহু একই। সেই চমকের রেশ কাটতে সময় লেগেছিল বেশ কিছুক্ষণ। তবে ধীরে ধীরে বিস্ময় মিলিয়ে গিয়ে জায়গা নিয়েছিল আনন্দের জোয়ার।ছেলেকে আর প্রশ্নবাণে বিদ্ধ না করে তানিয়া বেগম চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে স্বামীর কাছে চলে গেলেন। এদিকে আবির বন্ধুর চারপাশে ঘুরঘুর করছে, উসখুস করছে কিছু বলার জন্য।কিন্তু সারহানের গম্ভীর, অনুচ্চারিত মুখাবয়ব দেখে সাহস সঞ্চয় করতে পারছে না।সাথী বেগম এবং আজমল সাহেব ছাড়া বাকিরা শেষ পর্যন্ত সাহস করে এগিয়ে এসে অভিনন্দন জানাল। তারপর এখনকার মতো বিদায় নিয়ে নিজেদের রুমে চলে গেল। কেবল আবিরের মন মানল না সে কোথাও গেল না, বরং স্থির হয়ে রইল বন্ধুর পাশে।
“দোস্ত! এবার নিউজ না হয়ে যায়, রাজশাহী ১ আসনের এমপি সারহান ইদায়াত চৌধুরী বাসর ঘরে ঢোকার ত্রিশ মিনিট পরেই বাবা হয়ে গেছে।”

আবির অবশেষে পেটের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করা কথাটা উগ্রে দিয়ে খ্রান্ত হলো। সারহান জ্বলন্ত চাহনিতে তাকাল। ইচ্ছে করল এটাকে মুখ সেলাই করে দিতে। আবির সেই চাহনি দেখে ক্যাবলা মার্কা হেসে বলল;
“এমন নিউজ হতেই পারে তাই বললাম। উমম.. আমাদের হিটলার শ্বশুর কিন্তু তোর দিকে চিলের মতো তাকিয়ে আছে। একটু সাবধানে থাকিস হ্যা! আর অভিনন্দন দোস্ত আংকেল, চাচ্চু বানানোর জন্য! ও আরেকটা কথা, রাত জাগা, ডায়াপার চেঞ্জ, আর কান্নার কনসার্টের জন্য রেডি হয়ে যা।”

কথাটা বলা শেষ করে আবির হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। সাথী বেগম এত বড় সুখবর পেয়ে আনন্দে অশ্রুসজল হয়ে উঠলেন। যদিও প্রথমে খবরটি শুনে তিনিও স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। পরে ব্যাপারটা স্বাভাবিকভাবে নিয়েছেন। একটা মেয়ের বিয়ে হলে বাচ্চা হবে এটাই তো প্রকৃতির নিয়ম। তিনি চোখের অশ্রু মুছে স্বামীর দিকে তাকাতেই দেখলেন আজমল সাহেব মুখ গম্ভীর করে বাঁকা চোখে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই দৃষ্টি যেন নীরব প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে। এটা দেখে সাথী বেগম বিছানা থেকে নেমে ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। চাপা স্বরে বললেন;
“আপনি ছেলেটার দিকে ওমন করে তাকিয়ে আছেন কেন মনে হচ্ছে কোনো চু*রি করেছে।”
আজমল সাহেব স্ত্রীর পানে চেয়ে গমগমে কন্ঠে বললেন;

“তেমনটাই ভাবো।”
“আজব তো! আপনি রুমে যান।”
“যাচ্ছি।”
কথাটা বলে সারহানের সামনে এগিয়ে গেলেন অথচ কোনো কথা না বলে বাঁকা চোখে তাকিয়ে থাকলেন। সারহান চাচার ওমন গোয়েন্দা চাহনি দেখে বিব্রত তো নয়ই, বরং ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হয়ে উঠল সারহান। বিয়ে করা স্ত্রী প্রেগন্যান্ট হয়েছে এতে স্বাভাবিক আনন্দ দেখানোর বদলে সবাই এমন ভাব করছে যেন সে বিয়ের বাইরে কোনো সম্পর্ক করে বসেছে। মেজাজ চেপে রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল সে, তারপর সরাসরি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল চাচার দিকে। ভদ্রলোকের চোখের গাম্ভীর্য আরও গভীর হলো।সেই চাহনি দেখে সারহান গলা খানিকটা উঁচু করে গম্ভীর স্বরে বলল,

“বাঁকা চোখে বারবার তাকাচ্ছেন কেন? মনে হচ্ছে নিজের বউয়ের সাথে নয়, অন্যের বউয়ের সাথে রোমান্স করেছি আমি! নানা হচ্ছেন খুশি হওয়ার বদলে গোয়েন্দার মতো আমাকে যাচাই করছেন। শেইম অন ইউ, চৌধুরী সাহেব।”
এহেন কথা শুনে আজমল সাহেবের মুখ থমথমে হয়ে গেল,হা হয়ে রইলেন তিনি। মুহূর্তেই বেশরম ধরনের কথায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলেন। খানিকটা লজ্জায় মিইয়ে মুখটা ছোট হয়ে গেল। সাথী বেগমও মুখে আঁচল চেপে ধরলেন; তার চোখেমুখেও লজ্জার আভা স্পষ্ট। ঠিক তখনই আরশাদ সাহেব ও তানিয়া বেগম রুমে ঢুকলেন। ছেলের মুখে এমন স্পষ্ট ও তীক্ষ্ণ কথা শুনে তারা দু’জনেই হতবিহ্বল হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইলেন।
“সবার ভাব দেখে মনে হচ্ছে আমি বাবা হয়নি, অন্যের বউকে টিজ করেছি।”

সারহান বিরক্তিপ্রকাশ করে বিরবির করে বলল। আজমল সাহেব থাকলেন না এ রুমে। তিনি দ্রুত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। এ ছেলের সামনে আর এক মুহুর্ত থাকা যাবে না। সাথী বেগম মেয়ের দিকে একপলক দেখে স্বামীর পিছু পিছু ছুটে গেলেন। আরশাদ সাহেব এবার এগিয়ে আসলেন। ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন;
“কি হয়েছে? আজমলকে ওসব কেন বললে?”
সারহান চোয়াল শক্ত করে দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“বিয়ে করেছি বাবা হবো এটা স্বাভাবিক অথচ আপনার ভাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিলেন মনে হচ্ছিল, আমি বিয়ের আগেই বাচ্চার বাপ হচ্ছি।”
তানিয়া বেগম হেসে ফেললেন, আর ছেলের লাগামহীন কথায় আরশাদ সাহেব খুকখুক করে কাশতে লাগলেন। খানিকটা থেমে আমতা আমতা করে বললেন,

“আসলে আমরা কেউই ভাবিনি… এত তাড়াতাড়ি দাদা-নানা হয়ে যাব। বুঝতেই তো পারছ, মেয়েটা এখনও বেশ ছোট,গতকালই বিশ বছরে পা দিল। পড়াশোনা করছে, কয়েক মাস পর অনার্স প্রথম বর্ষের পরীক্ষা। পড়াশোনা, পরীক্ষা আর বাচ্চা সামলানো সব একসাথে ওর জন্য বেশ চাপ হয়ে যাবে।”
সারহান চুপচাপ এসব কথাই ভাবছিল। পড়াশোনা, বাচ্চা মানুষ করা সবকিছু মিলিয়ে মেয়েটার জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে উঠবে। এমনিও সারাক্ষণ বাচ্চামি, লাফালাফি করতেই থাকে।সে তো চেয়েছিল অরিত্রিকার অনার্স শেষ হোক তারপর ভাববে এসব কিছু। কিন্তু তেমনটা আর হলো কই? সেসব চিন্তাকে ছাপিয়ে তার মস্তিষ্ক জুড়ে একটা কথাই ঘুরছে সে বাবা হবে। বাবা হওয়ার যে সুখ, সুন্দর অনুভূতি আছে তা আজ সে অনুভব করছে। এতোক্ষণ শক্ত বনে থাকার অভিনয়ে ভাটা পড়ল। চোখের কার্ণিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল আনন্দাশ্রু। সে ধপ করে বসে পড়ল ডিভানে।

“ কি হয়েছে সারহান? তুমি কি খুশি হওনি বাবা হওয়ার খবরে?”
আরশাদ সাহেব ছেলের ওমন অবস্থা দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন। সারহানের গুরুগম্ভীর মুখখানা অন্যরকম দেখালো। দুই চোখ রক্তাভ বর্ণ ধারণ করেছে। প্রথমবার বাবার সামনে নিজেকে প্রকাশ করল। ভেজা, নরম কন্ঠে বলল ;
“আমি অনেক খুশি হয়েছি বাবা! আমার বাচ্চা আসছে.. আমিও বাবা হবো।”
আরশাদ সাহেবের উদ্বিগ্নতা কমে এলো। তিনি ডিভানে বসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধ চাপড়ে হেসে বললেন;
“দাদু হবো জানার পর বেশ চমকে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে চমক দেওয়া ভালো। এতে হার্ট ঠিকঠাক ভাবে কাজ করছে কিনা বোঝা যায়।কংগ্রাচুলেশন মাই সান! দোয়া করি একজন আদর্শ বাবা হও।”
সারহানের গম্ভীরমুখ টা শিথিল হলো। ওষ্ঠ প্রসারিত করে মোলায়েম কন্ঠে বলল;

“দোয়া করবেন আপনার মতো একজন পারফেক্ট বাবা যেন হতে হতে পারি।”
আরশাদ সাহেব হাসি বজায় রেখে বললেন;
“দোয়া করি আমার থেকেও আরো বেশী পারফেক্ট একজন বাবা হও।”
“তেমনটাই যেন হতে পারি বাবা।”
“হবে, হবে।”
আরশাদ সাহেব ছেলেকে ছেড়ে দিলেন। তানিয়া বেগম হেসে বললেন;
“নাতি-নাতনির মুখ দেখতে পাবো ভেবেই খুশি লাগছে। আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ। ”
সারহান এবং আরশাদ সাহেবও আলহামদুলিল্লাহ বলল। অতঃপর আরশাদ সাহেব সারহানকে প্রেসক্রিপশনটা দিলেন। তারপর দুজনে চলে গেলেন।

বাসর সাজানো ফুলগুলো এখন নেই। সারহান সার্জেন্টকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছিল ডক্টর আসার আগেই। সে একপলক প্রেসক্রিপশনের দিকে তাকিয়ে দেখল। সেথায় নিচে লেখা আগামীকাল ডক্টরের এপোয়েনমেন্ট আছে। সেটা জায়গামতো সাবধানে রেখে দরজা আঁটকে দিয়ে সরাসরি এসে বসলো অরিত্রিকার পাশে। সে নিগূঢ় চাহনিতে তাকাল অরিত্রিকার ঘুমন্ত সুশ্রী মুখপানে। কেমন নিষ্পাপ ভঙ্গিতে ঘুমুচ্ছে। আজকের দিনটা তার কাছে ছিল চমকপ্রদ। যেমন নিভৃতসুধাকে তার রাজ্যে নিয়ে৷ এসেছে। অপরদিকে বাবা হওয়ার সুসংবাদ পেয়েছে। এ মুহূর্তে তার রাগ করার কথা ছিল অরিত্রিকার ওপর, কিন্তু বাবা হওয়ার আনন্দ যেন সব রাগ কর্পূরের ন্যায় মিলিয়ে গেছে। প্রথমবার বাবার সুখ কি এমনই হয়? বুক কাঁপতে থাকে, আনন্দে-বিস্ময়ে মন স্থির থাকে না, অজানা এক সুখে হৃদয় ভেসে যায়। ঠিক যেমনটা এই মুহূর্তে তার হচ্ছে। এ অনুভূতি ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব ও অবর্ণনীয়! সারহান আলতো করে হাত রাখল অরিত্রিকার মাথায়, ধীরে ধীরে বুলিয়ে দিল। ডাকতে ইচ্ছে করল, তবু না ডেকে নীরব থাকল। শুধু একবার গভীর তৃপ্তির শ্বাস ফেলল। অতঃপর মেয়েলী গালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে কন্ঠে কোমলতা ও আবেগ মিশিয়ে বলে উঠল ;
“আজকে আমি অনেক খুশি ফাইরুজ! ধন্যবাদ আমায় বাবা হওয়ার সুখবর শোনানোর জন্য।”

রাত পেরিয়ে সকাল। ঘড়ির কাটায় সকাল নয়টা দশ মিনিট। চৌধুরী বাড়ি আজ খুশির রোশনাইয়ে ভরপুর।নতুন অতিথির আগমনে পুরো বাড়ি সরগরম। রান্নাঘরে চলছে নানান পদ তৈরির ব্যস্ততা, সঙ্গে পায়েস, ফিরনি আর মিষ্টির বাহার।আজ আরশাদ সাহেব ও আজমল সাহেব অফিসে যাচ্ছেন না; বরং স্থানীয় এতিমখানায় গিয়ে বাচ্চাদের জন্য খাবার ও জামাকাপড় পৌঁছে দেবেন। মামুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইরফানও আজ অফিস বাদ দিয়েছে।আবির খুশির খবর শুধু ইনান ও তার পরিবারের মানুষদের জানিয়েছে। সারহান পার্টির লোকদের না জানানোর কড়া নির্দেশ দিয়েছে। তবে সারহানের বন্ধুদের কাছে খবর পৌঁছে গেছে, আর তাতেই শুরু হয়েছে কলের বন্যা। বন্ধুরা একের পর এক ফোন করে সারহানকে প্রায় জ্বালিয়ে দিচ্ছে। তাই পরিস্থিতি শান্ত না হওয়া পর্যন্ত আবির নিজেকে আড়াল করে রেখেছে।

অরিত্রিকা দীর্ঘ সময় ঘুমানোর পর ঘুম থেকে উঠল। নিদ্রাচ্ছন্ন ঢুলুঢুলু চোখ দুটো কচলে আশেপাশে তাকাতেই চমকে গেল। সে এই রুমে কি করছে? পরক্ষনে মস্তিস্কে চাপ দিতেই মনে পড়ল গতকাল রিসেপশন হয়েছে। সে হাসল। তখুনি খেয়াল করল বিছানাটা ফুল দিয়ে সজ্জিত ছিলো। কিন্তু এখন নেই। কোথায় গেল ফুলগুলো? সে একটু উদাসীন হয়ে গেল। বিছানা থেকে নামবে এমন সময়,দেখল তার পরনে থ্রিপিস। শাড়ি, ফুলের গহনা নেই। সে আরেকদফা চমকাল। হম্বিতম্বি করে বিছানা থেকে নেমে দৌড়ে গেল ড্রেসিং টেবিলের নেই। একি সাজসজ্জা ও নেই। তার ছোট্ট মস্তিষ্ক যেন অচল হয়ে গেল। তার মনে পড়ল ওয়াশরুম থেকে বের হওয়ার পর হাঁটছিল তখন হঠাৎ চোখের সামনে অন্ধকার নেমে আসে। তারপর আর কিছু মনে মনে নেই। সে শুকনো ঢোক গিলে ব্যাকুল দৃষ্টিতে আশে পাশে তাকিয়ে সারহানকে খুঁজতে লাগল। না পেয়ে চঞ্চল পায়ে দৌড়ে বাহিরে যেতে গিয়ে কারো সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই কেউ একজন ধরে ফেলল। অরিত্রিকাও নিজেকে বাঁচাতে মানুষটার শার্ট আঁকড়ে ধরে চোখ মুখ খিঁচে রইল।

“সুস্থ হতেই আবার লাফালাফি শুরু করে দিয়েছিস?”
গুরুগম্ভীর পুরুষালী কন্ঠস্বর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করতেই অরিত্রিকা কেঁপে উঠল। নিজেকে সামলে পিটপিট করে চাইল দন্ডায়মান মানুষটির দিকে। তুখোর, তীক্ষ্ণ চাহনিতে অভ্যন্তরীণ সত্তা টলে উঠল। সে ওষ্ঠ ভিজিয়ে সহসা বলল;
“আমি তো সুস্থই ছিলাম।”
সারহানের কপালের মধ্যাংশে চার – পাঁচটা ভাজ পড়ল। মেয়েলী শরীরটা আস্তে করে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে দাঁড়াল। ভ্রুকুটি নাচিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল;
“ গতকাল রাতেই বুঝতে পেরেছি কতোটা সুস্থ তুই। কবে থেকে এমন হচ্ছে তোর?”
অরিত্রিকা নেত্রপল্লব ঝাপটে অবুঝের ন্যায় শুধালো ;

“কেমন?”
“মাথা ঘুরছিল আর… ”
“আপনি ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন সেই কষ্টে আমার এমন হয়েছে। মানে আপনার ভালোবাসার অভাবে অসুখের মতো ফিলিংস আসছিলো। জানেন, আপনি ছিলেন সেই কয়দিন আমি ঠিকঠাক ভাবে খেতে,ঘুমাতে পারিনি। আপনি এসেছেন দেখবেন এখন আমি একদম সুস্থ হয়ে যাব।”
অরিত্রিকা একগাল হেসে মনের কথা উগ্রে দিল। সারহান এমন অদ্ভুত কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। মেয়েটা এসব বিষয়কে সিরিয়াসলি নিচ্ছে না! পরক্ষণে তির্যক চাহনিতে তাকিয়ে বিরবির করে আওড়ালো ;
“ভালোবাসার অভাবে না অতিরিক্ত ভালোবাসার জন্য অসুখের মতো ফিলিংস আসছে তোর।”
অরিত্রিকা কথাটা শুনতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করল;

“কিছু বললেন?”
সারহান অরিত্রিকার হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে বিছানায় বসিয়ে দিলো। সেও পাশে বসল। কন্ঠ নরম করে বলল;
“গতকাল রাতে মনজুর আংকেল এসেছিলেন।”
অরিত্রিকা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল;
“ডক্টর আংকেল কেন এসেছিলেন?”
“তোর চেক-আপ করতে।”
“আমার!”
“হুমম তোর।”
“কি হয়েছে আমার? কি বললেন উনি?”

অরিত্রিকার চোখ মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। কেমন ভীতিগ্রস্ত চাহনিতে তাকিয়ে জানার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। সারহান ঘুমু ঘুমু সুশ্রী মেয়েলী মুখপানে নিবিড় চাহনিতে তাকায়। সে বুঝতে পারল মেয়েটা ভয়ে আছে। সারহানকে চুপ থাকতে দেখে অরিত্রিকা পুনরায় উদগ্রীব হয়ে বলল;
“আমার কি বড় কোনো অসুখ হয়েছে সারহান ভাই? বলুন না ডক্টর আংকেল চেক- আপ করে কি বলেছেন?”
ভাই শব্দটা শুনে সারহানে মুখ অতিশয় গম্ভীর হয়ে উঠল। মেয়েটা কি বিয়ের পরেও তাকে বাচ্চার মামা বানানোর পায়তারা করছে? সেটাই তো করছে। আকদের পর থেকে কতোবার নিষেধ করেছে ভাই বলে যেন না ডাকে অথচ সেই সম্বোধনেই প্রতিনিয়ত ডেকে যায়। সে তপ্ত শ্বাস ফেলল। গাম্ভীর্য ভাব কমিয়ে স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল;
“দুই মাস ধরে আমার বাচ্চা পেটে নিয়ে ঘুরছিস অথচ আমাকে জানাসনি—এটাই বলেছেন আংকেল।”

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮১ (২)

“আপনার বাচ্চা এটা আবার কোন রোগ…. আপনার বাচ্চা…. মানে.. আমার পেটে…!”
অরিত্রিকা প্রথমে না বুঝে কথাটা বলছিল। পরক্ষণে যখন বুঝতে পারল তখন লাফিয়ে উঠে বিস্ময়ে, উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠল। সারহান নির্লিপ্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইল। অমন এক কান্ড ঘটিয়ে এমন ভাব করছে যেন কিছুই জানে না। এ মেয়ে আদৌও কি কোনোদিন সিরিয়াস হবে?

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮২ (২)