প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৪ (২)

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৪ (২)
আদ্রিতা নিশি

হাসপাতালে একপ্রকার হুলুস্থুল কাণ্ড লেগে গেছে। চৌধুরী বাড়ির নতুন দুই অতিথিকে নিয়ে সবার মধ্যে টানাটানি লেগে গেছে।একসময় একজনের কোলে, আবার পরক্ষণেই অন্য কারও বাহুডোরে। পরিবারের প্রতিটি সদস্য তাদের আদর–সোহাগে ভরিয়ে দিচ্ছে। সারহান দেয়ালে ঠেস দিয়ে নির্বিকার চিত্তে সবার কান্ডকারখানা দেখছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় বাচ্চাদের বাবা নয়, একজন অতিথি হয়ে এসেছেন শুধু চৌধুরী বাড়ির রাজপুত্র ও রাজকন্যাকে দেখতে। অনিমেষ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে, কর্তার কোলে থাকা নবজাতকের দিকে —কি মোহনীয় দৃশ্য! চারপাশে বাড়ির গিন্নিরা ঘিরে থেকে স্নেহে ভরিয়ে দিচ্ছেন তাদের। এরই মধ্যে খবর পৌঁছে গেছে সারহানের বন্ধুমহলে। অনেকে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছে, তাদের মধ্যে ইলহামও রয়েছে।

“দোস্ত! দেখ সানিয়াত একদম তোর মতো গম্ভীর হয়েছে। আমার দিকে কেমন চোখ-মুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছে।”
আবির সানিয়াতকে কোলে তুলে নিয়ে বন্ধুর সামনে এসে দাঁড়াল। ওষ্ঠ কোণে একরকম ধূর্ত হাসি খেলে গেল, স্বরটাও ইচ্ছে করে টেনে টেনে বলল।সারহান হঠাৎ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মুহূর্তেই তার মুখের স্থিরতা বদলে গেল। একপলক সানিয়াতের দিকে তাকিয়ে গর্বের সহিত বলল;
“কার ছেলে দেখতে হবে না!”
আবির চক্ষুদ্বয় ছোট করে অদ্ভুত কন্ঠে বলল;

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“শুধু তোর না শালিকারও ছেলে। দোস্ত, তাই বলে তোর হুবহু ডুবলিকেট হলো? এ ছেলে বড় হলে নিশ্চয়ই বাপের মতো গম্ভীর, রগচটা, খিটিমিটি মেজাজের হবে।”
সারহান তীক্ষ্ণ চাহনিতে চাইল। এখনি তার ছেলেকে নিয়ে গবেষণা করছে? সে সানিয়াতকে কোলে নিল। দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“আমার ছেলে, আমার মতোই হবে।”
আবির এবার হাসল;
“আমি কখন বললাম তোর ছেলে পাশের বাড়ির দাদার মতো হবে?”

সারহান চোখ-মুখ শক্ত করে তাকাতেই হঠাৎ সরে গেল আবির। মুহূর্তের মধ্যে আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে গেল পরিবেশ। সানিয়াতকে কোলে নিয়ে বসার জায়গায় বসল সারহান। স্নেহভরা দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। সদ্যোজাত সেই মুখখানি বাবার দিকে গোলগোল চোখ মেলে চেয়ে আছে। মুখে ফর্সা, লালচে আভা ফুটে উঠেছে। দুটো ক্ষুদ্র হাত মাঝে মাঝে নড়ছে, গোলাপি শীর্ণ ওষ্ঠদ্বয়ও কাঁপছে হালকা ভঙ্গিতে।
সারহান ছেলের ক্ষুদ্র শরীরটিকে বুকের কাছে টেনে নিল। আঙুলের ডগা দিয়ে আস্তে করে ধরল ছোট্ট হাত। সঙ্গে সঙ্গে বাবুর মুখ আরও গম্ভীর হয়ে উঠল, কপালে পড়ল ছোট্ট ভাঁজ। দৃশ্যটা দেখে সারহান এক মুহূর্ত অবাক হলো। পরক্ষণে নিঃশব্দে হেসে ফেলল। স্নেহান্ধ কন্ঠে বলল;

“বাবার রাজপুত্র, বাবার মতো হয়েছে।”
ছোট্ট কপালে আরও একবার ওষ্ঠ ছুঁইয়ে প্রসন্নতা নিয়ে বলল ;
“আমার বাবা,আল্লাহ তোমায় দীর্ঘ হায়াত দিক। একজন ভালো মানুষ হও। বাবার সবচেয়ে বড় দোয়া এটাই।”
সারহান নিবিড় চাহনিতে দেখতে লাগল তার র*ক্ত, তার ছোট্ট অস্তিত্বকে। তখুনি তানিয়া বেগম এলেন। হেসে বললেন;
“আমার দাদুভাইকে দে। আমিও একটু আদর করি।”
সারহান মায়ের দিকে নবজাতকে এগিয়ে দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল;
“নাও, তোমার নানুভাইকে।”
সানিয়াতকে কোলে নিয়ে ছেলের কথার ধরণ শুনে হেসে ফেললেন তানিয়া বেগম। অতঃপর হেটে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পূর্বে মুন চলে গিয়েছে। কারণ হিমির স্কুল ছুটি হবে। সাদাত ভাতিজিকে কোলে নিয়ে এসে সারহানের কোলে দিল। অতঃপর হেসে বলল;

“ভাই, তোমার মেয়ে অরিত্রিকার মতোই চঞ্চল হয়েছে। এখনি দ্রুত হাত-পা নড়াচ্ছে, হাসছে, কাঁদছে।”
সারহান সাদা তোয়ালেতে জড়ানো মেয়ের দিকে তাকায়। বাবু এখন ঘুমুচ্ছে অথচ শীর্ণ ওষ্ঠজুড়ে ক্ষীণ হাসি। মুহুর্তে মনে পড়ে গেল ছোট বেলায় অরিত্রিকা এমনভাবে ঘুমতো। সাদাত ঠিকই বলেছে তার রাজকন্যা একদম মায়ের মতো হয়েছে। হঠাৎ কি মনে করে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকাল। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করল;
“ফাইরুজ, আমার রাজকন্যার নাম ঠিক করে রেখেছে?”
সাদাত মাথা চুলকে হেসে বলল;
“হুম। তবে তোমার রাজকন্যার নামটা তোমার রানীর থেকে শুনে নিও ভাই।”

কথাটা বলে সাদাত হাসতে হাসতে চলে গেল। সে এক লম্বা শ্বাস ছাড়ল। মনে মনে বিস্মিত— এতো ছোট্ট মেয়ে, অথচ মাথায় কত বুদ্ধি! দুই সন্তানের বাবা হবে সেই খবরটা গোপন রাখল? তবু তার অবাক হওয়াটা থামছে না। আসলে অরিত্রিকার কথার ভঙ্গি, হাঁটা-চলার ভঙ্গিমায় সে সন্দেহ করেছিল বটে, কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। প্রথমবার যখন আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট দেখিয়েছিল তখনও কিছু আঁচ করতে পারেনি। কারণ সদ্য ভ্রণ আকৃতি হওয়ায় অস্পষ্ট লাগছিল। কিন্তু পরেরবার আর কিছু জানালোই না।এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলল সারহান। চোখ সরাল অতীতের অব্যক্ত প্রশ্ন থেকে, স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইল মেয়ের ঘুমন্ত মুখের দিকে। মুখখানিতে অদ্ভুত প্রশান্তি, সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিয়েছে তার। তৃপ্ত শ্বাস টেনে কোমল কন্ঠে আওড়ালো;

“আমার রাজকন্যা, আমার আম্মা! আল্লাহ তোমায় দীর্ঘ হায়াত দিক। একজন ভালো মানুষ হও।”
কথাটি বলে সারহান ছোট্ট হাতটায় ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিল। কেন জানি সারহানের মনে হতে লাগল, আজ তার জীবন যেন সম্পূর্ণ হয়ে গেছে। স্ত্রী আছে, সন্তান আছে, চারপাশে আপনজনদের ভালোবাসায় ভরা এক পরিবার আছে। এরচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে! বুকের ভেতর শান্তির ঢেউ বয়ে গেল। মনে হলো, যদি সারাজীবন এভাবেই সবাইকে নিয়ে হাসি-খুশি থাকতে পারে, তবে এ জীবনেই তার সমস্ত চাওয়া পূর্ণ হয়ে যাবে। এর বাইরে আর কিছুর প্রয়োজন নেই তার।

“স্যার আপনার স্ত্রীর জ্ঞান ফিরেছে।”
ভাবনার মাঝেই নার্সের কণ্ঠস্বর শুনে সারহানের মনোবৃত্তি শেষ হলো। মেয়েকে কোলে আঁকড়ে ধরে সে উঠে দাঁড়াল।অবশেষে কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখার সময় এসেছে। এতোক্ষণ বাচ্চাদের দোলাচলিতে মগ্ন থেকেও মন পড়ে ছিল অরিত্রিকার দিকে।শান্ত, নির্ভীক পায়ে এগিয়ে গিয়ে আরশাদ সাহেবের কোলে মেয়েকে দিয়ে কেবিনের দিকে হাঁটতে লাগল। দরজার কাছে পৌঁছে হাতটা ঠিক করতে গিয়ে পকেটেথাকা ফোনে বারবার মেসেজ আসতে লাগল। চার-পাঁচবারের পুনরাবৃত্তি। সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, দরজা খোলা রেখে ফোনটা বের করল। লক স্কিন খুলে মেসেজ বক্স ওপেন করতেই কয়েকটি বার্তা চোখে পড়ল। হঠাৎ তার চোখ আঁটকে গেল একটা মেসেজে। মেসেজটি—
“Get ready… the real blast is yet to come.”

সারহান কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। সামনে তাকাতেই দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল বিছানায় শুয়ে থাকা অরিত্রিকার ফ্যাকাশে, শীর্ণ মুখে। বুক অব্দি টেনে রাখা সাদা চাদরের নিচে নিস্তেজ ভঙ্গিতে চোখ বুজে আছে সে। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সারহান বেডের পাশে রাখা চেয়ারটা টেনে বসল।সে নিবিড় চাহনিতে পরখ করল, প্রাণবন্ত, উজ্জ্বল মুখশ্রী এখন বিধ্বস্ত আর নিস্তেজ। তা দেখেই বুকের ভেতর কষ্টে মোচড় দিয়ে উঠল। দৃঢ়, অমসৃণ হাত বাড়িয়ে আলতো করে চেপে ধরল মেয়েটির নরম হাতখানা। স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই টের পেল হালকা কাঁপুনি! তবে কি জেগে আছে?

অরিত্রিকা হাতে উষ্ণ ছোঁয়া পেতেই হালকা নড়ে উঠল। কোনো এক দৈব অনুভূতিতে বুঝে গেল এ স্পর্শ তার প্রিয় পুরুষের, তার নেতাসাহেব, তার কল্পপুরুষেরই। তা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন স্পষ্ট করে জানিয়ে দিল তাকে। ধীরে ধীরে ঘুমে ভারী হয়ে আসা চোখের পাতা তুলল সে। তন্দ্রামাখা চোখ মেলে সামনে তাকাতেই কাঙ্খিত মানুষটিকে দেখতে পেল। মুহূর্তেই চোখ ভিজে উঠল অশ্রুতে। তবে এ কান্না কষ্টের নয়, এ তো নিখাদ সুখের অশ্রু। মা–বাবা হওয়ার অপরিমেয় আনন্দে ভরে উঠেছে তার সত্তা। ওষ্ঠ কামড়ে কান্না সামলাতে চেষ্টা করল অরিত্রিকা। ভেজা কন্ঠে থেমে থেমে উচ্চারণ করল;

“সানিয়াত, সারাহ-র বাবা!”
সারহানের সুগভীর তীক্ষ্ণ চক্ষুদ্বয় সমুদ্রের ন্যায় শান্ত দেখাল। স্পষ্ট শুনতে পেল মেয়েটার বলা সম্বোধন। সে ঝুঁকে আসলো। কোমল কন্ঠে জবাব নিল;
“হুম।”
“আমার ওপর রেগে আছেন?”
“তোর ওপর রেগে থাকার কথা ছিল বুঝি?”
“জানি না।”
“তাহলে হঠাৎ এমন প্রশ্ন কেন করছিস?”
সারহান গভীর চাহনিতে তাকিয়ে মোলায়েম কন্ঠে বলল। অরিত্রিকা মিইয়ে গেল। ভেজা নেত্রপল্লব মেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। অন্য হাতে ভেজা চক্ষুদ্বয় মুছে মিনমিন করে বলল;

“এতোক্ষণ আসেননি তাই।”
সারহান লম্বা শ্বাস ফেলল। স্বভাবসিদ্ধ কন্ঠে বলল;
“কিছুক্ষণ আগে নার্স খবর দিয়েছে।”
“উমম..আপনি সত্যি রেগে নেই তো?”
“কেন রেগে থাকব?”
“ সারাহ্ র কথা আপনাকে জানায়নি তাই। সত্যি বলছি, আপনাকে রাগানোর ইচ্ছে ছিল না। আমি তো… আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম।”
“আমি রেগে নেই তোর ওপর।”
সারহান অতি শান্ত কন্ঠে প্রতিত্তোর করল। অরিত্রিকা উদ্বিগ্ন ভাব কমে এলো। তবুও ক্ষীণ স্বরে বলল;

“তাহলে আপনি অন্যরকম ভাবে কথা বলছেন কেন?”
সারহানের কপালের মধ্যাংশে চার-পাঁচেক ভাজ পড়ল। কন্ঠে কৌতুহলতা এনে শুধালো;
“অন্যরকম বলতে কি বোঝাচ্ছিস?”
“গম্ভীরভাবে কথা না বলে শান্ত নদীর মতো কথা বলছেন!”
“আমি শান্ত নদীর মতো কথা বলছি!”
কথাটা আওড়ে ওষ্ঠ কামড়ে হাসল সারহান। অরিত্রিকার মনে হঠাৎ অভিমান জমলো। সে উপন্যাসের মতো করে বলার চেষ্টা করেছে অথচ মানুষটা তার কথা নিয়ে হাসছে? নিজের ভাবাবেগ সংবরণ করে শুধালো ;
“আপনি হাসছেন কেন?”

সারহানের ওষ্ঠদ্বয় প্রসারিত হয়;
“শান্ত নদীর মতো কথা কেউ বলে না। উপন্যাস পড়েছিস কিন্তু তেমন ভাবে বলতে পারিস না। এখনো ভুলভাল বললি।”
“আপনি কি করে জানলেন আমি ভুল বলেছি। উমম.. আপনি সঠিকটা বলুন।”
“আপনার কথাগুলো শান্ত নদীর মতো মৃদু ও প্রশান্ত লাগছে বিবিজান!।”
সারহান হাসি কমিয়ে আওড়ালো। অরিত্রিকা বিস্মিত হলো। মানুষটা ইনি বিনিয়ে কাব্যিক ভঙ্গিতে কথাটা বলল? ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের স্টুডেন্ট হয়ে কিভাবে বললেন? ভাবনার মাঝেই সারহান বলে উঠল;
“হয়তো আমি-ই একমাত্র বাবা, যে স্ত্রীর ডেলিভারির পর জেনেছে একসঙ্গে এক ছেলে আর এক মেয়ের বাবা হয়েছে।”
অরিত্রিকা ওষ্ঠ এলিয়ে মিষ্টি করে হাসল;
“ভাবুন এটা আমার তরফ থেকে আপনার জন্য সারপ্রাইজ ছিল।”
“আমার রাজকন্যার নামটাও না বলে ঠিক করে রেখেছিস?”
“হুমম।”
“শুনি, কি নাম রেখেছিস?”
“ সারাহ্ আমীরাহ্… ”
“সারাহ্ আমীরাহ্ চৌধুরী।

সারহান তার রাজকন্যার নামটা আওড়ায়। অরিত্রিকা কিছুক্ষণ মৌন থেকে হাসি বজায় রেখে বলল;
“সারহান ভাই.. ওরা দেখতে কিন্তু আপনার মতো হয়েছে।”
সারহানের মুখাবয়ব অতিশয় গম্ভীর হয়ে উঠল। দৃঢ় কন্ঠে বলল;
“তোর বাচ্চার বাবা হয়ে গেছি। এবার অন্তত ভাই বলা বাদ দে।”
অরিত্রিকা থতমত খেয়ে গেল। এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টানোর চেষ্টা করল। ক্ষীণ কন্ঠে বলল;
“আমরা কখন বাড়ি ফিরব?”
“বিকেলে।”

“বাবুরা কোথায়?”
“ ওরা মা, চাচীর কাছে আছে।”
“ওরা কি কান্না করছে, জ্বালাচ্ছে?”
অরিত্রিকা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল। সারহান বলল;
“উহু! আমার আম্মা ঘুমচ্ছে আর আমার বাবা গম্ভীর মুখ করে সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে।”
অরিত্রিকা বিস্মিত হয়ে বলল;
“সানিয়াত আপনার মতো হয়েছে নেতাসাহেব! আমার পেটে নয়মাস থেকে আপনার মতো কীভাবে হলো?”
সারহান এহেন প্রশ্ন শুনে তির্যক চাহনিতে তাকাল। গর্বের সহিত বলল;
“কারণ সানিয়াত আমার ছেলে।”
অরিত্রিকা বিরবির করে বলল;
“হুহ! বাপ কা ব্যাটা।”
“কি বিরবির করছিস?”
“কিছু না।”
“বল।”

“আপনি আমায় আজ আমায় একটুও ভালোবাসেনি। বুঝেছি বাবুদের পেয়ে আমায় ভুলে গেছেন।”
অরিত্রিকা কিছুক্ষণ মৌন থেকে হঠাৎ কেমন অভিমানী কন্ঠে বলল। সারহান আশ্চর্যিত হলো। পরক্ষণে মুখাবয়বে স্বাভাবিকতা ধরা দিল। শীতল চাহনিতে তাকিয়ে বলল;
“হসপিটালে আছি।”
অরিত্রিকা অবুঝের ন্যায় বলল ;
“তো।”
“নাথিং।”
“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবেন?”

অরিত্রিকা ইতস্তত বোধ করল। কুন্ঠা ঠেলে আচানক আবদার করে বলল। সারহানের চাহনি গাঢ় হয়।সে দেরী না করে ঝুঁকে মেয়েলী শরীরটাকে দুহাতে আলিঙ্গন করল। মেয়েটা কেমন শান্ত হয়ে গেল। প্রিয় মানুষের বুকে মাথা রেখে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করল। মিহি কন্ঠে আওড়াল ;
“আপনিই আমার সব দুঃখ-কষ্টের অবসান, আমার শান্তি, আমার একমাত্র ভরসা আর কল্পনায় কল্পিত সেই কল্পপুরুষ ।”
সারহানের কর্ণকুহরে প্রবেশ করল মেয়েলী আবেগিত স্বর। সে আরও দৃঢ় ভাবে জড়িয়ে ধরল। চুলের ভাঁজে ওষ্ঠপুট ছুঁইয়ে উষ্ণ কন্ঠে বলল;
“তুই আমার পূর্ণতা—আমার অর্ধাঙ্গিনী, আমার নিঃশর্ত প্রিয়তমা।”

“লেভি বেবি, তুমি তোমার ভাই-বোনদের দেখে রাখছো। কতো সুন্দর মুহুর্ত! ওয়েট তোমাদের তিনজনের ছবি তুলি।”
কথাটা বলে সাদাত পকেট থেকে ফোনটা বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিল। তারপর হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে অরিত্রিকা, সারহানের হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিল। এর মাঝে অরিত্রিকা বেলকনি থেকে রুমে আসল। তার দৃষ্টি গেল সাদাতের দিকে। বিছানায় বসে বলল;
“ভার্সিটিতে না গিয়ে এখানে কি করছিস?”
সাদাত ভার্সিটিতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল। বের হওয়ার আগে মনে হলো ভাইয়ের দুই আদরের ছানাপোনাকে না দেখে যাওয়া যায় না। তাই ভালোবাসায় টানেই তাদের দেখতে চলে এল।সে ফোনটা পকেটে ঢুকালো। স্বাভাবিক ভাবে বলল;

“ভাতিজা-ভাতিজিকে দেখতে এসেছিলাম। দেখা হয়ে গেছে এবার চললাম ভাবী।”
সাদাত সহালকা হেসে প্রস্থান করল।অরিত্রিকা হালকা হেসে শান্ত চাহনিতে ঘুমন্ত বাচ্চাদের দিকে তাকাল। কত নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে তারা! পাশেই লেভিকে শান্ত ভঙ্গিমায় বসে থাকতে দেখে ওষ্ঠকোণ প্রসারিত হলো। সে নিঃশব্দে পাশে শুয়ে পড়ল। হসপিটাল থেকে ফেরার পর তিনদিন কেটে গেছে। বাড়িতে ফিরেই দুই বাচ্চাকে সামলাতে কিছুটা হিমশিম খেতে হচ্ছে। তবে সারহান, তানিয়া বেগম আর সাথী বেগম পাশে থাকায় চাপটা তুলনামূলক কমই লাগছে।প্রথম দুইদিন চৌধুরী বাড়ির গিন্নিরা তাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিলেন এবং এ রুমে থেকে ছিলেন বাচ্চাদের দেখাশোনা করার জন্য। কিন্তু তৃতীয় দিনে আর থাকতে পারেননি, কারণ সারহান স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল সে বউ আর বাচ্চাদের ছেড়ে থাকতে পারবে না। এই কথায় অরিত্রিকা ভীষণ লজ্জা পেয়েছিল। শেষমেশ তানিয়া বেগম ও সাথী বেগম ছেলের সাথে না পেরে কিছু বিষয়াদি বুঝিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন।গতরাতে হঠাৎ রাত দুইটার সময় সানিয়াতের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কান্নায় ফেটে পড়েছিল ছোট্টটি। তখন সারহান নিজেই উঠে তাকে কোলে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শান্ত করতে থাকে, মিষ্টি কথা বলে আবার ঘুম পাড়ায়। অরিত্রিকাকে একবারও ডাকেনি।এসব ছোট্ট ছোট্ট স্মৃতি মনে করতে করতে অজান্তেই তন্দ্রায় হারিয়ে গেল অরিত্রিকা।

অরিন এই বাড়িতে এসেছে চারদিন হলো, আরও কয়েকদিন থাকবে। এতে আবিরের কোনো আপত্তি নেই। তবে সেও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে বউ যতদিন থাকবে, সেও ততদিন এখানেই থাকবে।গতকাল অরিত্রিকার বন্ধুরা এসেছিল বাচ্চাদের দেখতে। তার আগের দিন এসেছিল সারহানের বন্ধুরা। ঘরভর্তি হাসি-আনন্দ আর কোলাহলে মুহূর্তগুলো আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছিল।
“ভাইয়া পরীক্ষায় পাশ করেছি মিষ্টি খান।”
লিভিংরুমে বসে আবির পায়ের ওপর পা তুলে ফোন টিপছিল। পাশেই অরিন ফল খাচ্ছে। এ সময় রাহা মিষ্টির বক্স নিয়ে এসে হাসি মুখ বলল। সে আর অরিত্রিকা দুজনে মোটামুটি ভালো সিজিপিএ নিয়ে পাশ করছে। যদি পড়তো তাহলে আরও ভালো আসতো। আবির ফোনটা বন্ধ করল। অতঃপর হেসে বক্স থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে টপ করে খেয়ে নিল।

“তিন-চারদিন পর মিষ্টি খাওয়াচ্ছো।”
আবির মিষ্টি সাবার করে দিয়ে বলল। রাহা হেসে প্রতিত্তোর করল ;
“নতুন সদস্যরা আসায় অনেক মিষ্টি খাওয়া হয়েছে। তাই ভাবলাম দুই একদিন পর সবাইকে রেজাল্ট উপলক্ষে মিষ্টি খাওয়াই।”
আবির আফসোস নিয়ে বলল;
“তুমি তাও মিষ্টি খাইয়েছো। কিন্তু শালিকা কিংবা আমার বন্ধু রেজাল্ট উপলক্ষে মিষ্টি খাওয়ালো না। কেজি দুয়েক কালো জাম খেতে চেয়েছিলাম ইহাই কি আমার দোষ হইয়াছিল!”
রাহা শব্দ করে হেসে উঠল। অরিন মেকি রাগ দেখিয়ে বলল;
“আপনাকে আমি মিষ্টি খেতে নিষেধ করেছি আবির।”
আবির দুষ্ট হাসি হেসে বলল;

“তুমি যদি নিয়ম করে চু*মু খাও তাহলে আর খাবনা মিষ্টি। ”
রাহা হাসতে হাসতে দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। অরিন চাপা স্বরে বলল;
“আপনি একটা ঠোঁটকাটা আবির। রাহার সামনে কি সব বলছেন?”
“ইয়ে মানে বউজান! মুখ ফসকে বেরিয়ে গেছে।”
“সবসময়ই আপনার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়! হুম!”
“আরে ডার্লিং, রাগ করো না।”
“আবার শুরু করছেন?”
অরিন রাগত স্বরে বলল। আবির অসহায় চাহনিতে তাকিয়ে বলল;
“আরে রাগ করো না। আমাদের চ্যাম্পের গরম লাগবে।”
অরিন কটমট করে তাকিয়ে বলল;
“অসহ্য!”

কথাটা বলে অরিন নিজের রুমের দিকে চলে গেল। আবির মুখ ভার করে বসে রইল। বউয়ের মুড সুইংয়ের তোপে তার জীবন ফ্রাই হয়ে যাচ্ছে। তবুও চুপচাপ সহ্য করছে একমাত্র বউকে ভালোবাসে তাই। সারহান বাহির থেকে মাত্র এলো। সদর দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল আবির মুখ ভার করে বসে আছে। সে পাত্তা না দিয়ে নির্বিকারচিত্তে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগল।
“বাপ হয়ে ভাব বেড়ে গেছে তোর? আমিও কয়েকদিন পর বাপ হবো। তখন তোর থেকেও বেশী ভাব নিয়ে ঘুরব।”
সারহান থেমে গেল। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল আবিরের দিকে। গম্ভীর কন্ঠে বলল;
“আগে বাপ হো।”

কথাটা বলে সারহান সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেল। আবির মুখখানা তক্তব্যক্ত করল। বিরবির করে বলল;
“না আছে বউয়ের কাছে সম্মান, না আছে বন্ধুর কাছে সম্মান। যাই, একটু শ্বশুরআব্বাকে জ্বালিয়ে আসি।”
সে উঠে দাঁড়াল। অতঃপর হাসতে হাসতে সদর দরজা পেরিয়ে বাগানের দিকে চলে গেল।
সারহান রুমে ঢুকেই থমকে গেল। অরিত্রিকা আর বাচ্চারা তখন গভীর ঘুমে ডুবে আছে। কিছুটা দূরে লেভিও নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে। তাদের কাছে এগিয়ে গেল না সে।বাহির থেকে আসা ধুলো-ময়লা মিশ্রিত গা নিয়ে কাছে যাওয়া ঠিক হবে না। তাই ফোন আর ওয়ালেট টেবিলে রেখে তোয়ালে ও কাপড় নিয়ে সরাসরি ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।মিনিট দশেক পর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে আলমারি থেকে একটি টি-শার্ট বের করে পরে নিল। এবার ধীর পায়ে এগিয়ে গেল বাচ্চাদের দিকে। নিঃশব্দে বিছানায় বসে নিবিড় দৃষ্টিতে দেখতে লাগল সানিয়াত আর সারাহকে।

ওরা কাঁথার মধ্যে গুটিশুটি হয়ে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে। তার চক্ষুদ্বয়ে ভরে উঠল স্নেহ।কিছুক্ষণ পরে দৃষ্টি ঘুরল অরিত্রিকার দিকে। ঘুমন্ত মুখখানি কী মায়াবী লাগছে! অবাক হয়ে ভাবতে থাকে সারহান, সেই সপ্তদশী কিশোরী যার প্রেমে পড়েছিল প্রায় চারবছর পূর্বে, আজ সে দুই সন্তানের মা। তবুও সৌন্দর্যে, আপন মহিমায় একই রকম মোহনীয় লাগে। একেই বলে ভালোবাসার মানুষকে সবসময় সব রুপে ভালোলাগে।ঘুমন্ত অরিত্রিকাকে ডাকল না সে। শুধু নীরবে আবার বাচ্চাদের দিকে দৃষ্টি স্থির করল। আলতো হাতে বাচ্চাদের মাথায় স্নেহে ছুঁয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ পরপর অরিত্রিকার দিকে তাকাতে লাগল।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৪

এ চাহনি যেন প্রেমিক যেভাবে প্রেমিকার পানে দ্বিধাহীন, মুগ্ধভাবে সর্বক্ষণ চেয়ে থাকতে পারে ঠিক তেমন। বছরের মধ্যের সময়। আবহাওয়া উষ্ণ ও শীতল। বাতাসে ভ্যাপসা গরমের আবির্ভাব। তবে এ মুহুর্তে বেলকনির খোলা দরজা দিয়ে হুরহুর করে দমকা হাওয়া আসছে। সেই হাওয়া যেন প্রেমময় তীব্রতা নিয়ে সারহানের কর্ণে ফিসফিসিয়ে বলে যায় —
❝দুই বিপরীত সত্তা মিলিয়াছিল প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে,
অকস্মাৎ প্রেমোচ্ছ্বাসের ঘূর্ণিতে আবদ্ধ হইল অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে।❞

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ৮৫