প্রণয়ের সুর ২ পর্ব ১৬

প্রণয়ের সুর ২ পর্ব ১৬
মহুয়া আমরিন বিন্দু

সাহিলের পেছনে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সোহানা,মেয়েটা এখনো যেনো ভ্র’ম থেকেই বের হতে পারছে না,কি থেকে কি হয়ে গেলো তার সাথে!
ভোর রাতের সেই ঘটনা মনে পড়তেই কেমন গা বিষি”য়ে উঠলো।
তখন রাত সারে তিনটে, পরের দিন সকালে সোহানা কে হসপিটাল থেকে ছাড়া হবে,সে তো বেশ চিন্তায়ই ছিলো হসপিটালের বিল দেওয়া লাগবে এসব ভেবে,কিন্তু সাহিল এসে জানালো যেহেতু সে হসপিটালের একজন কর্মকর্তা তাই তাকে ফ্রি তে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে হসপিটাল কতৃপক্ষ থেকে সব কিছু দেওয়া হয়েছে,সোহানা যেনো হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলো,যেখানে প্রাইভেট হসপিটালে একদিন থাকলেই প্রায় বিশ হাজারের মতো খরচ হয় সেখানে সে তো সপ্তাহ খানেক থাকছে তার কতো টাকা আসবে ধারনা করা যায়!
একজন নার্স এসে সোহানা কে চেক”আপ করে গেলো।সাহিল এসেছিলো এর মধ্যে একবার, তার আজও নাইট ডিউটি পড়েছে।সোহানা সাহিল কে যতোটা রাগী কঠোর মনে করতো মানুষ টা ততোটাও কঠোর না।রোগীদের ক্ষেত্রে সে একটু বেশিই যত্নশীল!

নিয়মমাফিক সোহানাকে শেষ রাতে দেখতে আসলো সাহিল,সোহানা বিষয় টাকে তেমন খারা’প ভাবে নেয়নি।সাহিলের ক্ষেত্রে ও তাই,সাহিল এসেই সোহানার সাথে টুকটাক কথা বললো,সাথে ইরফানের কথাও জানালো, ওই ডক্টর পলাতক হসপিটালের এমডি তার বি’রুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে,পুলিশ ও তাকে ছাড়বে না।
এরই মধ্যে হঠাৎ করে সোহানার কিছুটা মাথা ঘুরে উঠলো,সাহিল তাকে সাহায্য করার জন্য তার দিকে ঝুঁ’কেছে ফলস্বরূপ তাল সামলাতে না পেরে দুজনই বেডের উপর পড়ে যায়,সে মুহুর্তেই বি”শ্রি ঘটনাটা ঘটায় অন্য একজন ডক্টর,সাহিলের সম্মান পরিচিতি ন’ষ্ট করার জন্য নার্সের সাহায্য পুরো হসপিটালে র’টিয়ে দেয় সাহিল তার পেসে”ন্টের সাথে হসপিটালে বসেই অসা”মাজিক কর্মকান্ড করছে!
বিষয়টা প্রমান করার জন্য সে সেই মুহুর্তের কিছু ছবিও তুলে নেয়।সোহানার সম্মানের কথা চিন্তা করে বিয়ে টা করতে বাধ্য হয়েছিলো সাহিল!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সোহানা অবশ্য সবার সামনে বলেছিলো তাদের মধ্যে এমন কোনো রকম সম্পর্ক নেই,স্যার আমার সাহায্য করতে চাইছিলো শুধু!কিন্তু মানুষের মুখ বন্ধ করা বড় কষ্টের ব্যাপার,তিলকে তাল বানানো তাদের স্বভাব।
যদিও বিয়েটা না করলো সাহিলের তেমন কোনো ক্ষ”তি হতো না।হসপিটালের মালিক পক্ষ খুব সহজেই বিষয় টা ধামা’চাপা দিতে পারতেন,ভালো ডক্টর কে হসপিটাল থেকে তারিয়ে কেউই নিজের লস করতে চাইবে না কখনো।কিন্তু সাহিল একজন সাধারণ মেয়ের ইজ্জ’তের মান র”ক্ষা করতেই বিয়েটা করলো। সে জানে না পরবর্তীতে কি হবে তার সাথে,তার মা যে সহজে মানবে না এসব কিছু মাথায় ছিলো তার!
রোজিনা বেগম বিরক্তি ভরা কন্ঠে বললো–,,কি করে এসেছো সাহিল?তোমার যদি বিয়ে করারই হতো আমাকে বলতে পারতে,এতোদিন যখন বিয়ে করো বিয়ে করো বলে বলে তোমার কান ধরিয়ে ফেলছিলাম তখন তো একবারের জন্য ও রাজি করাতে পারিনি তোমাকে,আর আজ বলা নেই কওয়া নেই বিয়ে করে নিয়ে এসেছো,কিভাবে মুখ দেখাবো এখন আমি সমাজে!

রোজিনা বেগম সোহানার কাছে এসে ওর হাত টেনে ধরে বললো–,,এই মেয়ে কে তুমি?আমার ছেলেকেই পেয়েছিলে শুধু ফাঁসা’নোর জন্য? বাবা মা কোথায় তোমার কেমন শিক্ষা দিয়েছে,তাদের ছাড়াই একটা ছেলের হাত ধরে বিয়ে করতে চলে এসেছো লজ্জা করে না তোমার!
সোহানা শুকনো ঢোক গিললো,অপমান গুলোর জবাব কেনো যেনো চেয়েও দিতে পারছে না! বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে,তার মা থাকলে হয়তো সব কিছু সামলে নিতো,সামলাতো তাকেও।মানুষ কতোটা অসহায় অনুভব করে নিজেকে যখন তার আশেপাশে কেউই তার পরিচিত না হয়,কাউকেই ভরসা করার মতো না পায়,কেউ একজন থাকে না পাশে বলার মতো এইতো আমি তোমার সাথে আছি,ভয় পাচ্ছো কেনো?বাবা মা’রা যাওয়ার পর পৃথিবীটা কতোটা ভয়ান’ক হতে পারে সোহানা জানে,তবে আজ সে অসহায় নিরুপায়,রাগ লাগছে ভীষণ সাহিলের উপর তাকে আর কে চিনতো?সে তো অন্য কোথাও একটা গিয়ে থেকে যেতো সাধারণ মানুষ কে কেই বা মনে রাখে,কে বলেছিলো সাহিল কে এতোটা মহান হতে?তার দিকে তো আর কেউ আঙুল তুলেনি তবে কেনো?সোহানার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো জল।মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলো শুধু!

সাহিল নিজের মায়ের উদ্দেশ্য বললো–,,আম্মু বুঝার চেষ্টা করো পরিস্থিতির স্বীকার আমরা দুজন,না উনার দোষ আছে না আমার!
রোজিনা বেগম বললো–,,দুজন দুজনকে চিনো না পছন্দ করো না,তাহলে বিয়ে করেছো কেনো?সংসার করবে কি করে তোমরা,বিয়ে টা কি ছেলেখেলা? খেলতে মন চাইল, খেললাম না মন চাইলে অন্য খেলা খেলবো!দেখো সাহিল যাকে তাকে ধরে এনে আমার বউমা বলে দিলেই তো আর আমি মেনে নিবো না!তোমাদের এই বিয়ে আমি মানতে পারছি না।এই মেয়েকে নিয়ে তুমি চলে যাও।

রৌফ নিজের মায়ের বিষয়ে অবগত রাগ উঠলে তিনি নিয়’ন্ত্রণ হারান।আবার রাগের সময় কি কি বলেন তা পরে আর মনে থাকে না,নিজেকে কঠোর রাখেন কিন্তু আদোতেও তেমন না।এখন না তার ভাইটা মায়ের উপর রাগ করে চলে যায়,সোহানা মেয়েটা কেমন হবে কে জানে,একদিনে তো আর মানুষ চেনা যায় না!
সাহিলের বাবা সজল শেখ স্ত্রীর বিরো’ধীতা করে বললো–,,থামো রোজিনা!সব সময় তোমার সব সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া হবে ভাবলে ভুল ভাবছো,তোমার ছেলে মেয়েটা কে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে সেখানে মেয়েটাকে কথা শোনাচ্ছো কেনো তুমি?ও কি জোর করে তোমার ছেলের ঘাড়ে চড়ে বসেছে?বিয়ে যখন হয়ে গেছে এই মেয়ে এখন থেকে এই বাড়ির বউ,আমার পুত্র বধু আমার বাড়িতেই থাকবে আর আমার ছেলেও, যাও ওদের ঘরে নিয়ে যাও।
রোজিনা বেগম রাগ দেখিয়ে ভিতরে চলে গেলেন।সজল দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিজের বোনকে বললেন ওদের ভিতরে নিয়ে যেতে।

মেহেরিন পাশেই মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে কেনো যেনো মেয়েটার জন্য মায়া হচ্ছে ওর,এই মেয়েটা তার ভালোবাসার মানুষ কে না চাইতেও পেয়ে গেলো!সে এতো করে চেয়েও পেলো না আর এই মেয়েটি ভুল করে পেয়ে গেলো।
রৌফ মেহেরিন কে বললো–,,মেহেরিন সোহানা ভাবী কে ভাইয়ার রুমে দিয়ে আয় যা!
মেহেরিনের কানে কথাটা কয়েকবার বাজলো!সাহিলের বউ সোহানা,যে ঘরে সে ছোট্ট সংসার সাজানোর কথা ভেবেছিলো সে ঘরে আজ অন্য কাউকে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব কিনা তার উপরই পড়লো,কি নির্মম ভাগ্য তার?না পারা যায় সহ্য করা না পারা যায় চিৎকার করে করে দুঃখ প্রকাশ করা,এই বোবা কষ্ট, বোবা কান্নার দায়ভার তো শুধু মানুষের একার নিজের একান্ত ব্যক্তিগত!

মানুষ এক তরফা ভালোবাসে হয়তো এরকম দুঃখের ভোজার ভাগিদার হতে!
মেহেরিনের শ্বাস আটকে আসতে চাইলো শেষ বারের মতো তাকালো সাহিলের সাজানো গুছানো ঘরটার দিকে যেটা সে প্রায়ই গুছিয়ে দিতো মন মতো, আজ থেকে চিরতরে সে অধিকার হারিয়েছে সে,যদিও অধিকার বোধ কোনো কালেই ছিলো না!

মেহেরিন ফ্যাকাশে মুখে মিলন হাসি হেসে জিজ্ঞেস করলো–,,বাড়িতে কে আছে আপনার?সাহিল কে কি করে চিনেন?যদি বলতে ইচ্ছে হয় বলতে পারেন জোর করবো না!
সোহানা ছলছল চোখে তাকালো মেহেরিনের কাছে মেয়েটার চোখ জোড়া বড় অসহায় ঠেকলো।সোহানা কাঁপা কন্ঠে বললো–,,শুধু মা আছে,সে ছাড়া পৃথিবী তে কেউ নেই আমার!
মেহেরিন নিজেকে অনুভব করলো সোহানার জায়গায়,হুট করেই নিজের মামির কথা ভাবলো, মেহেরিন ও তো এতিম বাবা নেই তাকে কি কখনো মেনে নিতো নিজের ছেলের বউ হিসেবে?সোহানা কেও তো মেনে নিচ্ছে না!সে কি বামুন হয়ে চাঁদ ধরতে চেয়েছিলো?তার তো কৃতজ্ঞ থাকা উচিত যদি মামা মামি না থাকতো তবে মেহেরিনের জীবন ও তো সোহানার মতোই হতো অতি সাধারণ! তখন কি সে সাহিল কে ভালোবাসার মতো দুঃসাহস দেখাতো?হয়তো না!যারা মেহেরিন কে দেখতে আসবে তারাও কি তাকে তার বাবা নেই দেখে অপছন্দ করবে?করতেই পারে স্বাভাবি, মামার ভোজ হয়ে আছে তারা যদিও কখনো সে রকম মনে হয়নি তার পরও নিজের ভিতরেই নিজেকে পরগাছা লাগে আজকাল।কথা বলতে আর ইচ্ছে হলো না মেহেরিনের নিজের ঘরে চলে গেলো সে!

এদিকে নেহা রেগে মে’গে বাড়িতে এসে হাজির কারন একটাই নিখিল তাকে না বলেই নামিরা কে নিয়ে বাড়ি চলে এসেছে,অন্য দিকে মেয়েকে না দেখে নেহার জা”ন যায় যায় অবস্থা!
নেহা এসে দেখলো নামিরা কে নিয়ে বাড়িতে উৎসব লেগে গেছে পুরোপুরি! নেহাকে দেখতে পেয়েই সবাই নেহার দিকে অভিমান নিয়ে তাকালো,নেহা কে দেখেই নামিরা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বললো–,,মাম্মা তুমিও এসেছো?পাপা বলেছে পাপার সাথে আসলে একটু পরে তুমিও চলে আসবে!
নেহা রাগ দেখিয়ে বললো–,,তোমার সাথে মাম্মা রাগ করেছে তুমি তাকে না বলেই চলে এসেছো তাই!
নামিরা কান ধরে বললো–,,আর হবে না মা।পাপা বললো তো তাই!
নেহার নামিরার কথার মাঝেই সেতারা বেগম বলে উঠলো–,,আমার নাতির ঘরে পু’তিরে তুই লুকাইয়া রাখছিলি তোর সাহস তো কম না!

সাহারা বেগম ও অভিমান করে বললো–,,আমাদের কে একবার জানালে কি এমন হতো?বড় আপা ভাইজান ও কিছু বললো না,যদি নিখিল না জানতো তাহলে কি তুই আমাদের কখনো জানাতি না?এতো রাগ আমাদের প্রতি?
জেরিন, নিঝুম এসে বললো–,,কাজ টা কি ঠিক করেছিস নেহা বইন?
নামিরা সবাইকে ধ’মক দিয়ে বললো–,,তু”প!চুপ!আমার মাম্মাকে কেউ বক’বে না বলে দিলাম!
সেতারা বেগম বললো–,,দেখছিস পুঁচকে টা কয় কি?
নামিরা দু হাত কোমরে রেখে বললো–,,তুমি কে?আমার মাম্মা কে কিছু বললে কিন্তু আমরা চলে যাবো!
শুধু দাদু ভাই দিদি ভাই ভালো তোমরা সবাই পঁ”চা,পঁ’চাদের সাথে নামিরা কথা বলে না।
সবাই মিট মিট করে হাসলো,নিখিল নেহা কে দেখে দাঁত কেলিয়ে হেসে বললো–,,আমি ঠিক জানতাম কান টানলে মাথা আসে,এবার দেখবো কি করে দূরে গিয়ে থাকিস তুই!

নেহা বিরক্তি নিয়ে তাকালো, লোকটার হাড়ে হাড়ে শয়”তানি।মেয়েটাকে ঠিক হাত করে ফেলেছে, তার মেয়েটাও হয়েছে একেবারে বাপ বাপ করে করে মাথা খারা’প করে দেয়!
নিখিল ডেকে বললো–,,নামিরা বাবা আসো পাপার কাছে।
নামিরা হাসতে হাসতে চলে গেলো,নেহা সেদিকে তাকিয়ে দেখলো শুধু কিন্তু নিখিল সে তো নেহা কে ভেংচি কে”টে চলে গেলো!
নেহা গাল ফুলিয়ে বসে পড়লো সোফায়,ডেকে বলে উঠলো–,,বড় মা তোমার ছেলেকে বলো আমার মেয়েকে দিয়ে দিতে না হয় বেশি ভালো হবে না কিন্তু!
নিখিল উপর থেকে বলে উঠলো–,,এই এমন ভাব করছিস মেয়ে কি তোর একার?হ্যাঁ হ্যাঁ একা একা কি তোর পেটে চলে এসেছিলো নাকি!

নেহা কানে হাত দিয়ে বললো–,,চুপ করুন অসভ্য লোক!বড় আব্বু তুমি কোথায় তোমার ছেলেকে কিছু বলো বলছি আমার কি রাগ উঠে যাচ্ছে এখন!
বাড়ির সবাই অনেক দিন পর নেহা নিখিল কে ঝগ’ড়া করতে দেখছে তাদের কাছে চক্ষু শীতল কারী ব্যাপার!
নেহা সোফার কুশন হাতে নিয়ে ছুঁড়ে মার’লো নিখিলের দিক, পরে পেছন পেছন দৌড়ে গেলো নিখিল নামিরা কে কোলে নিয়ে রুমের দিক দৌড়ালো।সেতারা বেগম বললো–,,এরা শুরু হয়ে গেলো আবার!

প্রণয়ের সুর ২ পর্ব ১৫

দুপুর হয়েছে রাহা,অথবা নেহা এসেছে ভেবেই দ্রুত দরজা খুললো তাহমিদা বেগম।
দরজায় দাঁড়ানো ব্যক্তিকে দেখে হাতে থাকা প্লেটটা শব্দ করে পড়ে গেলো নিচে।
শহিদুল চৌধুরী এসেছে,কতোদিন পর মানুষটার মুখোমুখি হলো তাহমিদা অভিমান গুলো যেনো এতোবছর পর আবার মাথা চাঁ’ড়া দিয়ে উঠলো!
শহিদুল চৌধুরী ডেকে উঠলো–,,তাহমিদা!
তাহমিদা বেগম কথা বলতে পারলেন না,দরজা ছেড়ে হেঁটে চলে গেলেন ভিতরে।

প্রণয়ের সুর ২ পর্ব ১৭