প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২২

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২২
অনুসা রাত

মেহের বাইরে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো।কাঁদতে কাঁদতে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবতে লাগলো,
-“কি এমন অপরাধ আমি করেছিলাম যে আজ আমায় এদিন দেখতে হচ্ছে? কেন আজ তুমি আমায় এখানে এনে দাঁড় করিয়েছ?কোথায় যাব আমি?আমি চাই না আমার জন্য আমার মা আর বাবার সম্মানহানি হোক।”
মেহেরের ভাবনার মাঝেই দুজন মহিলা এসে উপস্থিত হলো সেখানে।আর মেহেরকে উদ্দেশ্য করে একজন বলতে লাগলো,

-“কে তুমি মেয়ে?এখানে এভাবে কাঁদছ কেন?”
মেহের তৎক্ষনাৎ চোখ মুছে ফেললো।পাশ কাটিয়ে যেতে নিবে এমন সময় একটা মহিলা বলতে লাগলো,
-“এটা তো এদের বাড়ির বউ মনে হয়।”
এটা শুনে আরেকজন বলছে,
-“কি বলছো,এদের বাড়ির ছেলের কি বিয়ে হয়েছে নাকি?”
-“হ্যা হয়েছে গো।আমি শুনেছি।”
-“কি বলো,আমরা তো কিছু শুনলামও না।মেয়েও তো কিছু বলে না।”
-“দাঁড়াও।আমি জিজ্ঞেস করি।কি গো মেয়ে?কে তুমি গো?আজ এদের বাড়ির বউয়ের নাকি সাধের অনুষ্ঠান।”
মেহের জোরপূর্বক হেসে বললো,
-“জ্বী।”
-“তুমি কে?কি লাগো ওদের?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মেহের আমতাআমতা করছে।এমন সময় সেই মহিলাদের পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো,
-“আমার ওয়াইফ ও।মেহের খান আলিশা।”
আরবাজের গলা শুনে মেহের মুখ তুলে তাকালো।আরবাজ দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। সেই দুজন আন্টিও অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো।একজন বললেন,
-“আরবাজ তুমি এখানে?তোমার বউ এটা?”
আরবাজ হেসে এগিয়ে এলো।মেহেরের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-“জ্বী।আমার একমাত্র বউ।”
মেহের নিচের দিকেই তাকিয়ে রইলো। দুজন আন্টি তাদের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একজন বললো,
-“কই তোমার মা তো আমাদের জানায়নি কিছু। দাওয়াতও পেলাম না।লুকিয়ে বউ তুলে আনলে নাকি?”
-“ধরতে পারেন তাই।দেখছেন তো,এত সুন্দর বউ দেখে আমার মা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি।তবে সামনেই আমাদের বিয়ে।অনুষ্ঠান করে জমজমাট ভাবে।”
এটা শুনে মেহের আরবাজের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।চিমটি কেটে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“কিসব বলছেন?”
আরবাজ পাত্তা না দিয়ে বললো,
-“আপনারা ভিতরে যান না।আজই বাবা হয়ত সব এনাউন্সমেন্ট করবে।যান যান।”
সেই দুইটা আন্টি আবারো ফুসুরফাসুর করতে করতে চলে গেলেন।আসলে আন্টিদের কাজই হলো ফুসুরফাসুর করা।আরবাজ মেহেরের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে বললো,
-“আমি জানতাম তুমি এখনো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে।নিশ্চয় ভাবছ যে কোথায় যাবে।”
মেহের অন্যদিকে তাকিয়ে বললো,
-“সেটা জেনে আপনি কি করবেন?”
-“আমিও তো যাব।”
-“বললেই হলো নাকি?”
আরবাজ রাগী গলায় বললো,
-“আসার সময় কি বললে?ডিভোর্স পেপার পাঠাবে?”
-“হ্যা মুক্ত করে দিবো আপনাকে”(মলিন হেসে)
-“আমি মুক্ত হতে চাই না।”
-“মানে?”

-“মানে হলো আমাকে ডিভোর্স দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করবে?এটা আমি হতে দিব না।”
-“আমার ইচ্ছে, আমি কি করব না করব।”
আরবাজ মেহেরের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,
-“আমার সহ্য হবে না।”
মেহের অবাক হয়ে তাকালো।তারপর কিছুসময় আমতা আমতা করলো।আচমকা আরবাজের কলার চেপে ধরে বললো,

-“এতগুলো মিথ্যা কেন বললেন ওনাদের?”
-“তুমি রাস্তার মধ্যে এভাবে আমার কলার চেপে ধরেছ কেন?”
-“বেশ করেছি।আর এটা রাস্তা নয়।বাসার সামনে।”
-“কলার ছাড়ো বলছি।”
-“একশবার ধরবো।আপনি মিথ্যা বললেন কেন?”
-“আমি মিথ্যা বলিনি।”(ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে)
-“আপনি মিথ্যাই বলেছেন।মিথ্যুক একটা।”
-“কলার ছাড়বে কিনা?”
-“ছাড়ব না।”
বলে আরো জোরে চেপে ধরতেই আরবাজ মেহেরের কোমড় জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।এবার মেহের দমে গেল।আস্তে আস্তে হাত ঢিলে হয়ে গেল।মেহের চোখ নামিয়ে বললো,
-“আ..আপনি রাস্তার মধ্যে এ..এভাবে আমাকে ধরতে পারেন না।”
-“আমি সবই করতে পারি।আর এটা তো রাস্তা না।বাসার সামনে।”
বলেই চোখ টিপলো।মেহের গাল ফুলিয়ে বললো,
-“ছাড়ুন বলছি আমায়।চলে যাব আমি।”
-“ছাড়ব না।কি করবে শুনি?”
-“আমি কিন্তু চিৎকার করবো।”
-“করো।”

মেহেরের বেশ রাগ হলো।আরবাজ এমন করছে কেন তার সাথে।আগলা পিরিতি দেখাতে আসছে।মেহের আরবাজকে ছাড়ানোর জন্য মিনমিন গলায় বললো,
-“কে কোথায় আছো…”
-“আমিই তো শুনতে পারছি না।”
-“আপনি মশকরা করতে আসছেন?”
-“মোটেও না।আরো জোরে চিল্লাও।”
-“ছাড়ুন বলছি আমায়।”
-“তুমি চিল্লাও দেখি।তোমার গলা শুনে এখানে লোক জড়ো হবে।যেই বিয়েটা আমাদের ৭ দিন পরে হত সেটা নাহয় আজই হবে।”
-“সাতদিন পর মানে?”(অবাক হয়ে)
আরবাজ আস্তে আস্তে মেহেরকে ছেড়ে দিলো।কিন্তু কোমড় থেকে হাত সরালো না।মুচকি হেসে বললো,
-“তোমার আর আমার বিয়ে।”
-“মানেটা কি?”
-“হ্যা।আমাদের বিয়ে হবে।তোমাকে আমি তুলে আনব আবারো। কিন্তু এবার সেটা আলাদাভাবে। আলাদারকম করে।”

-“বললেই হলো নাকি।আমি বিয়ে করব না আপনাকে।আপনার ওই দজ্জাল মা…”
বলে জিভ কাটলো মেহের।আরবাজ মেহেরের চুল টেনে বললো,
-“আটকে গেলে গেল?”
-“আপনি আমার চুল টানলেন কেন?যান তো এখান থেকে।চলে যাচ্ছি, যেতে দিন।”
-“হ্যা তো যাও। আমি কি আটকেছি নাকি!”
মেহেরের চোখ ভরে এলো।গলা আটকে এলো।খুব অভিমান হলো আরবাজের উপর।
-“আপনি সত্যি আটকাবেন না?”(করুণ গলায়)
-“উহুম।”
মেহের দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। পা বাড়িয়ে যেতে লাগলো কিন্তু মনে হলো পিছনে আরবাজও আসছে।তাকিয়ে দেখলো আসলেও তাই।আরবাজ তার পিছনে পিছনে আসছে আর তার আঁচল ধরে কি যেন করছে।মেহের ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কি করছেন টা কি আপনি?”
-“শুনেছি বরেরা নাকি বউয়ের আঁচলের সাথে বাঁধা পড়ে।”
মেহের অবাক হয়ে আরবাজের মুখ পানে চেয়ে রইলো।আরবাজ মেহেরের দিকে করুণভাবে তাকিয়ে বললো,
-“আমাকে একটা সুযোগ দেবে মেহের? ”
মেহের অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আরবাজের দিকে।আরবাজ মেহেরের হাত ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো,

-“আমায় একটা সুযোগ দাও না মেহের।আমি জানি না তোমার প্রতি আমার ফিলিংস টা কেমন আমি জানি না কিন্তু যখন তুমি চলে যাচ্ছিলে আমার বুকটা কেমন কেপে উঠেছিল।মনে হচ্ছিল আমার বুকে কেউ ভারী পাথর রেখে দিয়েছে। তোমার কান্না আমার এখন আর সহ্য হয় না মেহের।প্রতিদিন তোমার সাথে ঘুমানো অভ্যাস হয়ে গেছে আমার।বিয়েটা যেভাবেই হোক না কেন,ভালোবাসি কি বাসি না জানি না আমি।শুধু এতটুকু জানি যে তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারব না মেহের। আমি কিভাবে থাকব তোমাকে দেখা ছাড়া?তুমি তো আমাকে দূর্বল করে দিয়েছ তোমার প্রতি।
আমাকে ডিপেন্ডেড করে দিয়েছ।”
মেহেরের চোখ ভরে আসছে।কিন্তু কিছু বলছে না।আরবাজ মেহেরের হাত দুইটা নিজের ঠোঁটের উপর চেপে ধরে বললো,

-“আমার শুধু তোমাকে চাই মেহের।বাচ্চা লাগবে না।আমি চাই না কোনো বাচ্চা। তুমি যেমনই হও না কেন,আমার তোমাকেই লাগবে।”
মেহের ঢোক গিললো।আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো মানুষ তাদের দেখে দেখে যাচ্ছে। মেহের নিম্ন স্বরে বললো,
-“রাস্তা দিয়ে মানুষ যাচ্ছে। ”
আরবাজ মেহেরের কথাটা পাত্তা দিলো না।কিছুক্ষণ সময় নিলো।মেহেরের চেহারাটার দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর বলে উঠলো,
-“এসব ফিলিংস তোমার হয় কিনা আমি জানি না।কিন্তু আমি নিরুপায়!যেখানে আমি ১ টা মিনিট ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি সেখানে আমি কি করে তোমাকে ছেড়ে থাকব?কিভাবে সহ্য করব তোমাকে অন্য কারোর সাথে?”
মেহের মুখ তুলে তাকালো আরবাজের দিকে।আরবাজ অসহায় ভাবে তাকিয়ে আছে মেহেরের দিকে।মেহের ঠান্ডা গলায় বললো,

-“এটা কি আপনার আকর্ষণ?অভ্যাস নাকি ভালোবাসা?”
-“আমি জানি না।”
-“হাহ।যেখানে আপনি আমাকে ভালোইবাসেন না সেখানে আমি কিভাবে থাকব আপনার সাথে?”
বলে মেহের পিছনের দিকে ফিরে হাঁটা ধরলো।গেইট টা পার হতেই আরবাজ পিছন থেকে বলে উঠলো,
-“এসব ফিলিংস এর নাম যদি ভালোবাসা হয় তাহলে….তাহলে আই লাভ ইউ।আই লাভ ইউ আ লট মেহের।প্লিজ গিভ মি আ চান্স।”
আরবাজের বলা কথাটা মেহেরের কানে বাজতে লাগলো।মেহের অবাক হয়ে তাকালো আরবাজের দিকে।আরবাজ করুণ চোখে তাকালো মেহেরের দিকে। তারপর বললো,
-“প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না।আমি কখনো চাইনি এসব সংসারে নিজেকে জড়াতে।এজন্যই তোমার থেকে দূরে থাকতাম।চাইতাম তুমি তোমার মত থাকো।কিন্তু দিনশেষে যে তুমিই আমার প্রয়োজন, আমার ভালোবাসা হয়ে উঠবে আমি ভাবতে পারিনি।আমি থাকতে পারব না তোমার সাথে ঝগড়া করা ছাড়া মেহের।”
-“আমি আপনাদের বাসায় আর এক মুহুর্তও থাকতে চাই না।”

-“তুমি আমার সাথে থাকবে মেহের।মা যাই বলুক না কেন!আমি তোমার পাশে আছি সবসময়।”
মেহের আরবাজের মুখপানে তাকিয়ে রইলো।দোটানায় পড়ে গেছে সে।আরবাজ কে ক্ষমা করে দিয়ে কি সে আরবাজের সাথে থাকবে?নাকি এই ভালোবাসা কে উপেক্ষা করে সে ফিরে যাবে।কিন্তু তার মা-বাবা তো…!
এখন তো আরবাজ ছাড়া কেউ নেই তার।আরবাজ হাত বাড়িয়ে বললো,
-“ভালোবাসি মেহের!প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে দিও না।”
মেহের তাকিয়ে রইলো আরবাজের দিকে।কি করবে সে?আরবাজের সাথে নতুন করে জীবন শুরু করবে নাকি ফিরে যাবে?আরবাজ মেহেরের চুপ থাকা মেনে নিতে না পেরে বললো,

-“চুপ করে আছ কেন?”
-“কি বলব বুঝতে পারছি না।”
-“তুমি ভালোবাসো না আমায়।তাই না?আসলেই তো।আমার মত মানুষ কে কি ভালোবাসা যায়।”(মলিন হেসে)
মেহেরের বলতে ইচ্ছে হলো,
-“হ্যা আমিও ভালোবাসি আপনাকে। আপনার সাথে ঝগড়া করা আমারো অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। রোজ রোজ আপনার সাথে ঘুমানোও আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে!”
কিন্তু বলার সাহস হলো না।আরবাজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
-“আচ্ছা বলো না সমস্যা নেই।কিন্তু প্লিজ আমায় ছেড়ে যেও না মেহের।”
মেহের নিজেকে খুব কষ্ট করে সামলে নিলো।আবারো গেইটের দিকে পা বাড়ালো। এমন সময় আরবাজ দৌড়ে এসে মেহেরকে কোলে তুলে নিলো।মেহের ছটফট করতে করতে বললো,

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২১

-“আরে কি করছেন টা কি আপনি।”
-“তোমাকে আমি যেতে দিলে তো যাবে।”(চোখ টিপে)
-“মানেটা কি!নামান আমায়।”
আরবাজ শুনলো না।নিজের মত হাঁটতে লাগলো।মেহের তাকে খামচি দিচ্ছে।তবুও আরবাজের কোনো হেলদোল হচ্ছে না।মেহেরের বেশ রাগ হচ্ছে। আবার কেন যেন ভালোও লাগছে।আরবাজের বুকে এসে শান্তি লাগছে।এই শান্তি ছেড়ে,আরবাজকে ছেড়ে কি মেহের থাকতে পারবে?

প্রথম ভালোবাসার সুর পর্ব ২৩