প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২২

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২২
মিমি মুসকান

গু’লির একটি শব্দে রাতের পাখিদের কি ডানা ঝাপটানি। ভয়ে সকলে উড়ে চলে যাচ্ছ ডানা ঝাপটে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে চাঁদের এক টুকরো আলো। তবুও ঘন কালো জঙ্গলের ভেতর সেই আলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। প্রিয়তা ছুটছে চোখ বন্ধ করে। হাতের মুঠোয় বুকের উড়না চেপে ছুটছে এক মনে। তার মন বলছে, প্রান্তিক এখানে। গু’লি তার উপরই চলেছে। আবারো সেই চিরচেনা স্বর। সেই ডাক! যে ডাকে নিজেকে বিভোর মনে হয় প্রিয়তার।‌ প্রতিবার আকৃষ্ট হয় সেই ডাকে। প্রাণপণে ছুটে গেল সেই ভালোবাসার মানুষটির কাছে। তার ছুটে চলার পথ দীর্ঘ। বেশ দীর্ঘ। ওপাশ থেকেও কেউ বুঝি ছুটে আসছে। আভাস পাওয়া যাচ্ছে। প্রিয়তা এবার ভয় পেলো না। থেমেও গেলো না। তার মন তাকে বলছে এটা প্রান্তিক। তার বর মশাই। সেই তো ছুটে আসছে তার দিকে।

ঘন জঙ্গলের পথ পেরিয়ে এসে থমকে দাঁড়াল সে। দাঁড়াল অপরপক্ষ ও। হাঁপিয়ে উঠেছে দুজন। অন্ধকারের মাঝে চোখাচোখি করার বৃথা চেষ্টা। তবুও তো আভাস পাচ্ছে। এই অনুভূতি মিথ্যে নয়। অন্ধকারের আবছা আলোয় দেখার চেষ্টা করছে দুজন। চাঁদের আলোয় অবশেষে মুখের আবছা ছায়ার দেখা মিলল। দূরত্ব বেশি নয়। এই তো কয়েক হাত। প্রিয়তা এক মূহুর্ত অপেক্ষা না করে ছুটে গেল তার দিকে। আঁকড়ে ধরল দু হাতে। শক্ত, বিশাল সুদেহে নিজেকে জড়িয়ে নিল ভীষণ অবলীলায়। কান্নার ভঙ্গিমা আরো ভয়া’বহ। ঘন জঙ্গলের মধ্যে এক রূপসী রমণীর কান্নার আওয়াজ ভৌ’তিক ব্যাপার ছাড়া আর কিছুই নয়। তার বুকের মধ্যে নিজেকে চেপে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করছে সে। হচ্ছে না, সম্ভব না। প্রান্তিক জড়িয়ে ধরেছে সেই কখন। অশ্রু রেখা তার নয়ন থেকেও পড়ছে ঝর্ণার পানির মতো। দুজনের কেউই আজ অভিমান করল না, কথা কাটাকাটি করল না, কথা বাড়ালও না। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদল কেবল। অভিমান কি এই অশ্রু কণার সাথেই মূর্ছা যাবে তাহলে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ভালোবাসার মানুষের কাছে ভালোবাসার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা খুব মুশকিল। কেলবই ভয় হয়, কোনো এক সময় ভালোবাসার মানুষ তার অস্তিত্ব ভুলে যাবে। তাকে ভুলে যাবে। দীর্ঘ দিন এক খাবার খেয়ে যে কারো মুখ ফিরে আসে। ভালোবাসা কি অতো সস্তা বাপু। ভালোবাসায় ফিকে শব্দটি তো আসতে দিতে নেই। নিত্য নতুন ভাবে ভালোবাসতে হয়। অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হয়। এই যেমন পৃথিবীতে মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে মানুষ কতো শক্ত কাজই না করে। আর তুমি তো কেবল একটি মানুষের জীবনে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে। এতোই কি শক্ত কাজ? তা কি পারা যায় না? ভালো কি বাসা যায় না। কেন এতো ছলনা, কেন এতো কষ্ট। শান্তিতে কি ভালোবাসা যায় না?

তারা ফিরে এসেছে। দুজনেই ফিরে আসে। হেলিকপ্টারে করে প্রায় ৬ ঘণ্টার জার্নি করে ঢাকায় ফিরেছে দুজন। যখন ফিরেছে তখন ভোর হয়ে গেছে। এতোক্ষণ এতোটুকু কথা হয়নি দুজনের মাঝে। দুজনেই কেবল চুপ থেকেছে। কোনো শব্দ ছাড়াই একজন অপরজনের মনের কথা বুঝতে পেরেছে। প্রান্তিক শক্ত করে তার হাতটা চেপে ধরে আছে। প্রিয়তাও কম না। দু হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে মাথা রেখে চোখ বুজে ছিল। ঘুমিয়েই পড়ল শেষে। যখন চোখ খুলল তখন সে ঢাকায়। হেলিকপ্টার এসে থেমেছে চৌধুরী বাড়ির ছাদে। বিশাল এই ছাদের এক কোণায় খুব সহজেই হেলিকপ্টার নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মান্নাত, রাফি দুজনেই ছিল তাদের সাথে। বাকিরা ফিরছে গাড়ি করে। ফিরতে সময় লাগবে বুঝি আরো।
নামবার সময় তাকে কোলে করে নামাতে গিয়েই প্রিয়তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। নিজেকে প্রান্তিকের কোলে আবিষ্কার করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। পরক্ষনেই মান্নাত আর রাফিকে দেখে নিজেকে খানিকটা গুটিয়ে নিল। একটু লজ্জা যেন পাচ্ছে সে।

প্রান্তিক তাকে নিয়ে সোজা এলো প্রিয়তার ঘরে। হ্যাঁ প্রিয়তার ঘরেই। অভিমানের পাল্লা যেন এখান থেকেই শুরু হলো। বিছানায় তাকে বসিয়ে দিয়ে নরম সুরে বলল, “ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি!”
প্রিয়তা জবাব না দিয়ে হাত পা গুটিয়ে নিল। প্রিয়তার পায়ের জখম খেয়ালে এলো তখন। হাত পা তেও আ’ঘাতের ছড়াছড়ি। এগিয়ে এসে দুই হাতে তার মুখটা আঁকড়ে ধরে কপালে চুমু খেল। চুলগুলো সব কানের কাছে গুঁজে দিয়ে বলল, “প্লিজ ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি আসছি!”

প্রান্তিক বেরিয়ে গেল। মনটা খা খা করছে। কি যেন নেই। কিন্তু প্রান্তিকের কথাও তো ফেলে দেবার নয়। অভিমান ভুলে উঠে দাঁড়াল। আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটল সে।
ভালোই একটা গোসল সেরে বের হলো। প্রান্তিক তখনো এসে পৌঁছায় নি। হাতের তোয়ালে দিয়ে কোনোমতে মাথা মুছে ঘর ছেড়ে বেরুলো প্রিয়তা। মিটিমিটি পায়ে হেঁটে প্রবেশ করল প্রান্তিকের ঘরে। ঘরে ঢুকতে গিয়ে পা থমকে গেল তার। দরজার পর্দা আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে রইল শক্ত পায়ে। নরম, শীতল মুখখানা দ্রুতই কঠোর হতে লাগল। প্রিয়তা হতবাক! বাকরুদ্ধ হয়ে গেল দ্রুত। কেবল স্থির দৃষ্টিতে দেখছে। উদাম শরীরে উল্টো হয়ে বসে আছে প্রান্তিক। পাশেই চশমা পড়া সাদা শার্ট ওয়ালা লোকটা তার জ’খমে চিকিৎসা করছে। প্রিয়তার সামনেই একহাতে ছু’রি দিয়ে অন্যহাতে সরু একটা নলের মতো কিছু একটা দিয়ে প্রান্তিকের বাঁ হাতের বাহু থেকে একটা গু’লি বের করে রাখল পাত্রে। প্রিয়তার মনে হলো তার পায়ের মাটি সরে গেছে। কেমন গোঙানির মতো শব্দ করল সে। প্রান্তিক পিছন ফিরল। প্রিয়তার রক্ত’শূন্য মুখ দেখে চমকে উঠল সে। রাফি আর মান্নাত ও সেই ঘরেই উপস্থিত। সকল লাজ ভেঙে প্রিয়তা ছুটে এলো প্রান্তিকের কাছে। প্রান্তিক নিশ্চুপে তার হাতটা আগলে ধরল। প্রিয়তা দুই হাতের মুঠোয় হাতটা নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ল। প্রান্তিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল কেবল। চোখ দিয়ে আশ্বাস দিচ্ছে সে ঠিক আছে!

ঠিক আছে? বুঝ দিচ্ছে তাকে? সে বুঝি জানে না গু’লির খাওয়ার কষ্ট কি? এতোটাই কি অবুঝ নাকি। তাহলে তখন গু’লি ঠিকই লেগেছিলো। গু’লির শব্দ তো সে পেয়েছিল। কেবল প্রান্তিক কে স্বচক্ষে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিভাবে ভেবে নিল সে একদম ঠিক আছে! কিছু হয়নি তার। গত ৬ ঘণ্টা কিভাবে এই আ’হত শরীর নিয়ে তাকে আঁকড়ে রাখল। কিভাবে বা তাকে কোলে তুলে নিল। কষ্ট হয়নি বুঝি তার। বুঝাচ্ছে তাকে? এতো কষ্ট কিভাবে সইলো প্রান্তিক। একবারও তো উহ্ শব্দ টুকু করল না। প্রিয়তা তো বুঝে নিত তার কষ্ট হচ্ছে। লোকটা কেন এমন? কেন কষ্ট বুঝতে দেয় না। সবসময় দূরে দূরে রাখে। কিসের এতো অভিমান তার?
ডাক্তার ব্যান্ডেজ করিয়ে দিলেন সেখানে। প্রিয়তা ঠোঁট কামড়ে কান্না চেপে রেখেছে। সকলের সামনে পারছে না প্রান্তিকের বুকে লেপ্টে কাঁদতে। তবে বুঝি একটু শান্তি লাগত। ডাক্তার কে দাঁড়াতে দেখে দাঁড়িয়ে গেল সেও। প্রান্তিক তার হাত জড়িয়ে রেখেছে। প্রিয়তা নিজেকে সামলে বলল,
“একটাই গু’লি? দুটো গু’লি যে তবে…”

প্রান্তিক হেসে বলল, “সেটা রাফি করেছিলো লোকটার উপর। রাফি আমায় আবারো ঋণী করে দিল!”
আবারো মানে? গু’লি কি এর আগেও খেয়েছিল সে। প্রিয়তা চোখ মুখ কুঁচকে তাকালো প্রান্তিকের দিকে। প্রান্তিকের দৃষ্টি নেমে যাচ্ছে। চোখের পাতা কাঁপছে। দেখতে দেখতে প্রিয়তার সামনেই মূর্ছা গেলো সে। প্রিয়তা চেঁচিয়ে উঠলো আবারো। মান্নাত ও ঘাবড়ে গেল কিছুটা। রাফি দেখছে ডাক্তারকে। ডাক্তার সাহেব নিরস মুখে বললেন,
“অতিরিক্ত রক্ত’ক্ষরণের কারণে এমনটা হয়েছে। শরীর ও দুর্বল। প্রেসার লো! আমি তো বললাম তাকে হাসপাতালে ভর্তি করান। র’ক্ত দিতে হবে। দু ঘণ্টার মধ্যে র’ক্ত না দিলে এরপর আমার হাতে কিছু থাকবে না।”
অশ্রুসিক্ত নয়নে বিচলিত হয়ে প্রিয়তা তাকাল রাফির দিকে। প্রান্তিক মাথা তখন প্রিয়তার কোলে। লোকটা পুরোপুরি শরীর ছেড়ে দিয়েছে। রাফি শক্ত কণ্ঠে বলল,

“স্যার হাসপাতালে যাবেন না বলে দিয়েছে। আপনি আমার সাথে আসুন। এখানেই র’ক্ত দেবার ব্যবস্থা করছি।”
প্রিয়তার ইচ্ছে করল প্রতিবাদ করবে। এসব কি ধরণের পাগলামি। কেমন জেদ। হাসপাতালে গেলে কি হবে? কিন্তু এসব বলে সময় নষ্ট করল না সে। রাফি ভাই ছোটাছুটি করছে। যত দ্রুত সম্ভব রক্ত দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রিয়তা তার মুখটা আগলে ধরে ফের কান্না করে নিল। এই লোকটা কেন এতো য’ন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। কেন এমন করছে। মান্নাত চাঁপা স্বরে বলল,
“ভাবী কাঁদবেন না। চিন্তা করবেন না, আমরা দেখছি!”

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২১

সত্যি সত্যি চোখের পলকের মধ্যে সবকিছু হয়ে গেল। ডাক্তার নার্স সব এলো একে একে। প্রান্তিকের বড় বেডরুম টা কিছুক্ষণের মধ্যেই হাসপাতালের ছোট একটা কেবিনে রূপ নিল। তাকে র’ক্ত দেওয়া হচ্ছে। কোনো জটিলতা সৃষ্টি হলো না। রাফি যেন আগে থেকেই সমস্ত টা ঠিক করে রেখেছিল। প্রিয়তার প্রান্তিকের পাশে বসে রইল চুপটি করে। এক মূহুর্তের জন্য সরল না। তার হাত ও ছাড়ল না। উদাম শরীরে চাদরের ঢাকা দিয়ে শুয়ে আছে লোকটা। প্রিয়তা তাকে দুচোখ ভরে দেখছে। মুখশ্রী তে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। ঘর খালি পেয়ে চুমু খাচ্ছে তার চোখে মুখে। কখন যে জ্ঞান ফিরবে সেই প্রতিক্ষায় প্রহর গুনছে সে।

প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ২৩