প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৫
মিমি মুসকান
জীবনে এমন সময় খুব কম আসে যখন সবকিছু ঠিকঠাক চলতে থাকে। দীর্ঘকাল জীবনে তিক্ততা দেখে আসা মানুষগুলো হঠাৎ করেই আনন্দের ছোঁয়া পেলে ভড়কে উঠে। বিস্মিত হয়, ভয় হয় আঁতকে উঠে অচেনা এক ভ”য়েতে। অচেনা এক অনুভুতিতে। এই বুঝি ভাগ্য ঠ*কিয়ে দিল। এই বুঝি সব কিছু শেষ হয়ে গেল। প্রতিনিয়ত এমন সব অদ্ভুত ধরনের ভ*য়ের আচ্ছাদনে বেঁচে থাকতে হয়। এই বেঁচে থাকার নামই তো জীবন!
হানিমুন ছেড়ে তারা ফিরেছে মাস খানেক হলো। প্রিয়তা এখন রোজ নিয়ম করে ভার্সিটিতে যাচ্ছে। রোজ সকালে উঠে বরের জন্য নাস্তা বানানো, তাকে তৈরি করে অফিস পাঠিয়ে এরপর নিজে বেরুনো কম কাজ নয়। নিজের সংসারের ব্যস্ততায় মায়ের সাথে দেখা করার সময় হচ্ছে না। উঁহু কোনোভাবেই হচ্ছে না। দিনের পর দিন এমন অক্লান্ত পরিশ্রমে একটু যেন দুর্বলই হয়ে পড়ছে সে। রাতে একবার ঘুমালে আর কিছু মনে থাকে না। এমন ভাবে ঘুমাতে থাকে, দেখলেই মায়া হয় প্রান্তিকের। ও এতো কেন করছে? বাড়িভর্তি কাজের লোকের কমতি নেই তবু সবটা নিজের হাতে করা চায়। মেয়েদের অদ্ভুত এক মনবাসনা সংসার সামলানো। হাতের সুকৌশলে নিখুঁতভাবে প্রতিটা কাজ তাদের করাই চায়। এসবে বরকে সময় দিতে পারছে কই?
আগে দীর্ঘ রাত বসে তারা গল্প করত এখন আর সম্ভব হচ্ছে না। প্রান্তিক নিজেও যেন কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে। রাত করে বাড়ি ফিরে। মাঝে মাঝে ফিরে দেখে খাবার টেবিলেই প্রিয়তা ঘুমিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলে, খেয়েছে! আদৌও খেয়েছে কি না জানা যায় না। তাদের মাঝে কি তবে দূরত্ব বাড়ছে? এখনই?
প্রান্তিকের ভয় হচ্ছে। দূরত্ব জিনিসটাকে ভীষণ রকমের ভয় পায় সে। তাই আজ শত ব্যস্ততার মাঝেও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার চেষ্টা করল। ভেবেছিল সন্ধ্যে নাগাদ পৌঁছে যাবে। কিন্তু পৌঁছাতে পৌঁছাতে ঠিক আটটা বাজল। প্রিয়তা তখন মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। সামনেই ফাইনাল। এইতো আর একটি বছর। এরপর অর্নাস কমপ্লিট হলে দুধ দিয়ে গোসল করে উঠবে। বয়সটা এমন হয়েছে যে পড়তেই ইচ্ছে করে না। সংসার সামলে তো বই ধরতেই মন চায় না। রাত্রির ৮ টার দিকে কলিং বেল বাজতেই একটু অবাক হলো সে। এই সময় সচরাচর কেউ আসে না।
দাদাজান এখন তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। ভোরে ভোরে উঠে হাঁটতে বের হন বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েন। বসার ঘরে প্রিয়তা একাই সোফার উপর গুটিসুটি মেরে বই নিয়ে বসে ছিল। মনোযোগ দিতে পারছে না কোনোভাবেই। এরই মধ্যে কলিং বেল।
মেয়েটা এসে দরজা খুলতে এগিয়ে যাবার আগেই প্রিয়তা থামিয়ে দিল। বলল, “আমি যাচ্ছি, তুমি যাও আমার জন্য চা বানাও!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
গায়ে উড়না জড়িয়ে নিজেই এগিয়ে গেল। আচমকা দমকা হাওয়ায় বাড়ির সবগুলো জানালার পর্দা উড়তে লাগল। দু একটা জানালা বন্ধ হয়ে খুলেও যাচ্ছে। ঝড় বৃষ্টি আসছে বোধহয়। এখন কি কোনো সময় ঝড় আসার?
প্রয়তা দরজার কাছে এগিয়ে যেতেই আলো সব নিভে গেল। হয়েছে লোডশেডিং। ভালোই বৃষ্টি আসবে। জেনারেটরের কল্যাণে কিছু আলো জ্বলেও উঠল আবার তবে তার আলোও নিভো নিভো। দরজা খুলে অনাকাঙ্ক্ষিত মুখখানি দেখে চমকে উঠল। অবাক হলো একগাদা ফুলের বাহার দেখে। পুরো গোলাপের স্তুপ তুলে দিল প্রিয়তার হাতে। প্রিয়তা চমকে উঠল। এখন এতো ফুলের কি দরকার ছিল? আজ কি বিশেষ কিছু? প্রিয়তার মনে পড়ছে না যেন। বিয়ের এক বছর হতে এখনো কয়েকমাস। তাহলে? তার তো জন্মদিন ও না। প্রান্তিকের জন্মদিন আসতে এখনো দেড়মাস।
“এখন ফুল দেবার মতো কি হলো?”
প্রান্তিক ভিতরে ঢুকে এমন তেতো তেতো কথা শুনে দাঁড়াল। মুখখানি গম্ভীর করে বলল, “এই হচ্ছে বউ! এদের সবকিছুতে কারণ চাই। আরে বাবা এভাবেই দিলাম।”
“আপনি এতো তাড়াতাড়ি কেন এলেন?”
“কেন তুমি খুশি হওনি?”
প্রিয়তা আড়চোখে চেয়ে দেখল মেয়েটার পানির গ্লাস নিয়ে আসছে। চোখ মুখ কুঁচকে ফুলটা সোফার উপর রেখে দিল। প্রান্তিকের মন খচখচ করছে। তার মনে হচ্ছে প্রিয়তাকে সে খুশি করতে পারছে না। মেয়েটার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে প্রিয়তা এগিয়ে এলো। প্রান্তিকের হাতে তুলে দিল পানির গ্লাস। প্রান্তিক ঠকঠক করে পুরো গ্লাস শেষ করে চিন্তিত মুখ নিয়ে বসল। প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে আছে সন্দেহের চোখে। কপালে হাতের উল্টোপিঠ রেখে পরীক্ষা করে বলল, “আপনি ঠিক আছেন তো?”
প্রান্তিক বুঝে উঠতে পারল না, একটা ফুলের তোড়া দিয়ে এমন কি ভুল করল সে। ঠান্ডা মৃদু বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ। বৃষ্টি আসবে। ঝুম বৃষ্টি! প্রান্তিক হঠাৎ প্রিয়তার হাত টেনে বলল, আসো বৃষ্টিতে ভিজি!
“এখন? কি দরকার?
“আমার ইচ্ছে হয়েছে!”
“এই বৃষ্টিতে ভিজলে জ্বর আসবে?”
“হোক জ্বর। তখন তোমার সাথে কাঁথা কম্বল চেপে শুয়ে থাকব। আসো তুমি আমার সাথে। বৃষ্টির চেয়ে মধুর কোনো সময় নেই। বৃষ্টির চেয়ে ভালো প্রেম হয় না। বছরের প্রথম বৃষ্টিতে বউয়ের সাথে না ভিজলে প্রেমটা টিকবে কি করে?”
প্রিয়তা হেঁসে উঠল আকস্মিক। কিসব কথাবার্তা বলছে প্রান্তিক। অতঃপর তার জবাবের অপেক্ষা না করে একপ্রকার তাকে টেনে নিয়েই ছাদে উঠে গেল দুজন। এদিকে মেয়েটা চা বানিয়ে এনে দেখল তারা কেউ নেই। চলে গেছে! ধোঁয়া ওঠা গরম দু কাপ চা টেবিলের উপর রেখে দিল অতি সন্তর্পণে!
ছাদে এসে দুজন দাঁড়াতেই দমকা হাওয়ায় দুজনে উড়ে যেতে নিল। প্রিয়তা নিজেকে সামলে রাখতে পারছে না। একসময় গায়ের উড়না উড়ে চলে গেল হাওয়ার সাথে। দূরে দু হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে প্রান্তিক চৌধুরী হেসে উঠল উচ্চস্বরে। তার হাসিও মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসের সাথে। গায়ের ব্লেজার উড়ছে বাতাসের সঙ্গে। এলোমেলো চুলগুলো কানে গুঁজে প্রিয়তা হেসে উঠল। লোকটা হুটহাট কিসব পাগলামি করে।
টপটপ বৃষ্টি পড়তে পড়তে একসময় ঝুম বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। কিছুক্ষণের মধেই দুজনে কাকভেজা হয়ে গেল। প্রিয়তার চেয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক। প্রিয়তা লাফাচ্ছে বৃষ্টির মধ্যে! এই এতোক্ষণ ভিজতে চাইছিলো না আর এখন নাচছে। মেয়েদের মন ও অদ্ভুত। না, তার বউয়ের মন অদ্ভুত। কখন যে কিসে খুশি হয়ে যায় বোঝা মুশকিল!
গায়ের ব্লেজার খুলে ফেলল প্রান্তিক। পরনে সাদা শার্ট লেপ্টে আছে শরীর জুড়ে। শরীরের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দেখা যাচ্ছে সুক্ষ্মভাবে। চুলগুলো দুই হাতে সব পিছনে ফেলে এগিয়ে এলো তার রমনীর কাছে। মেয়েটি তখন বৃষ্টিতে ভেজায় মশগুল। হুট করে একটা হাত এসে এমন ভাবে তাকে আঁকড়ে ধরবে আশা করেনি।
প্রিয়তা প্রথমে চমকে উঠল। অতঃপর মুখ তুলে তাকাল। প্রান্তিক তার বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল তাকে। জোরে বলে উঠলো, “তোমাকে ভালোবাসি বউ!”
প্রিয়তা হেসে উঠল। মাথা তুলে বলল, “আমি জানি তো!”
প্রান্তিক তার কানের কাছে মুখটা এগিয়ে বলল, “এইজন্যই তো বললাম। মনে করিয়ে দিলাম যাতে ভুলে না যাও!”
প্রিয়তা চোখ বুজে হাসছে। লোকটা পাগল হয়ে গেছে। কপালে চুমু খেল প্রান্তিক। এই ঝুম বৃষ্টির মধ্যে বউকে সাথে নিয়ে না নাচলে পুরো বৃষ্টি বিলাস যেন অসম্পূর্ণ। অতঃপর তাকে কোলে তুলে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। ভয়ে প্রিয়তা আঁকড়ে ধরল শক্ত করে। বারংবার চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “থামুন, থামুন পড়ে যাবো তো!”
কিন্তু প্রান্তিক যে উন্মাদ হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে না থামাবে বলে!
বাসার মধ্যে আমরিশা আর পূরবী। আফরিন গেছে বান্ধবীর জন্মদিনে। আসতে রাত হবে। এখনো রাত কম না। তাদের বাসায় স্মার্টফোন বলতে কেবল দুটো। একটা আমরিশার হাতে আরেকটা মায়ের হাতে। আমরিশার ফোন ধরা বারণ। আফরিন পূরবী কেউই ধরতে পারে না। তারা মায়ের ফোন নিয়ে কাড়াকাড়ি করে সর্বক্ষণ। মেয়েটা জন্মদিনে যাবার পর থেকে মনসূরা বেগম এ অবধি ৭ বার ফোন দিয়ে ফেলেছেন। আফরিনই প্রথমে চালাকি করে আলফি ভাইয়ের ফোন দিয়ে কল করিয়েছে। ফোন নাম্বার নেবার ভালো ধান্দা! আলফি ভাই যদিও বুঝতে পারেনি।
মনসূরা বেগম যতবার ফোন করেন তিনি তুলেন। কথাবার্তা বললেন। ফোনের মধ্যে ছেলেটার সাথে কথাবার্তা বলেই বুঝলেন ছেলেটা ভীষণ ভদ্র। অতঃপর মেয়েটার দায়িত্বের ভার তাকে দিলেন। একটু যেন বাসা অবধি দিয়ে যায়। একা একা মেয়েটা আসবে কি করে?
আলফি একবার ভাবল, বলবে রাতটা না হয় এদিকেই থাকুক। কিন্তু সামলে নিল। কি না কি ভাবে? কি দরকার। কেবল ভদ্র ছেলের মতো বলল, জ্বি আন্টি আমি পৌঁছে দিবো।
মনসূরা বেগম শান্ত হলেন। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। আজকে রাতেই বৃষ্টি হতে হলো। তিনি আমরিশাকে ডাকছেন,জানালা বন্ধ করে দেবার জন্য। বৃষ্টির পানি ঘরে এসে বিছানা ভিজিয়ে ফেলছে। দুবার ফোন করলেন বড় মেয়েটার কাছে। ফোন বাজছে কিন্তু তুলছে না। সিদ্দিকুর সাহেব বিছানায় শুয়ে আছে অসহায় ভঙ্গিতে। ইদানিং তিনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন। মনে হচ্ছে বেশিদিন বাঁচবেন না। বেঁচে থাকতেই মেয়েগুলোর বিয়ে দিয়ে যেতে পারলে ভালো হতো। আমরিশার বিয়ে নিয়ে ভাবছেন তিনি।
পূরবীকে পড়তে বসিয়ে আমরিশা জানালার কাছে আসল জানালা বন্ধ করতে। দূরে রাস্তার পাশে ল্যাম্পপোস্টের আলোয় কাঙ্খিত মুখটা থেকে থমকে গেল সে। তার মুখাবয়ব আঁধার এসে জুটল। এই লোক এখানে কি করছে? উপরেও তো তাকাচ্ছে না। পূরবী থাকার কারণে আমরিশাও ডাকতে পারছে না। কেবল চেয়ে আছে ড্যাব ড্যাব করে। ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছে লোকটা। মা ফের চেঁচাচ্ছেন। “কিরে বন্ধ করলি জানালা?”
আমরিশা ধপ করে জানালা বন্ধ করে দিল। মান্নাত মাথা তুলে চাইল। যাহ, শেষ সুযোগ ও হারালো সে। এদিকে ফোনটাও বন্ধ হয়ে গেছে। তাড়াহুড়ো করে বেরুতে গিয়ে ফোনের চার্জই দেখা হয়নি। আমরিশা কি দেখেছে তাকে? তাহলে তো নিশ্চিত নিচে নামবে। যদি না নামে তখন? দোটনায় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল সে। নিজের বোকামোর উপর এতো রা*গ হচ্ছে। এতো বড় গাধামির পরিচয় দেবার কারণে দু গালে দুটো চ*ড় দিতে ইচ্ছে করছে!
তবুও মনের উপর ভীষণ জোর রেখে সে দাঁড়িয়ে রইল। তার ভালোবাসার উপর তার ভরসা আছে। আমরিশা ঠিক নিচে নামবে। এই ঝড় বৃষ্টির রাতেও তাকে আসতে হবে। বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজতে লাগল সে। ভিজতেই ছিল। অতঃপর সে এলো। তাকে দেখার পরপরই বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড অস্থির হয়ে উঠল। ধিরিম ধিরিম শব্দ করছে যেনো। মৃদু হেসে চেয়ে রইল। সেলোয়ার কামিজ পরা মেয়েটা বৃষ্টির মধ্যে ছাতার তলে দাঁড়িয়ে এদিকেই ফিরে আছে।
মান্নাত গাড়ি ড্রাইভ করছে। মিটিমিটি হাসছে আর পাশে তাকাচ্ছে। আমরিশা ভীষণ বিরক্ত। ধমকে উঠে বলল, “এসি বন্ধ করছেন না কেন? আপনি তো কাঁপছেন? কে বলেছিলো এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে। এতো যে ফোন দিচ্ছিলাম ধরছিলেন না কেন?”
মান্নাত আসলেই কাঁপছে। তার ভীষণ শীত শীত লাগছে। অতঃপর এসি বন্ধ করে মুচকি হেসে বলল, “এতো রাতে তুমি বেরুলে কিভাবে?”
“একদম ভাববেন না আপনার জন্য বেরিয়েছি। আজ আমার বান্ধবীর গায়ে হলুদ আছে। সেখানেই যাবো!”
মান্নাত তাকে উপর থেকে নিচ অবধি দেখল। আমরিশা ভ্রূ নাচিয়ে বলল, “কি দেখছেন এভাবে? আমি সত্যিই গায়ে হলুদে যাবো। নাহলে মা বেরুতে দিত নাকি? ওই যে ( পিছনের সিটে শপিং ব্যাগ দেখিয়ে বলল ) ওখানে গায়ে হলুদের ড্রেস। এই বৃষ্টির মধ্যে তৈরি হয়ে বের হওয়া কি সম্ভব নাকি? ভেবেছি ওখানে গিয়েই তৈরি হবো।”
“বাসা কোথায় বান্ধবীর?”
“এই তো ডানদিকে যান!”
মান্নাত মুচকি হেসে বা দিকে গাড়ি ঘোরাল। আমরিশা চোখ মুখ গরম করে বলল, “এটা কি হলো? ওদিকে বাসা তো। দেখুন আমি আপনার সাথে এখন যেতে পারবো না।”
“স্টপ ইট আমরিশা। এখন কেবল ৮ টা বাজে। এখন কোনো হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হয় না। গত আধঘন্টা দাঁড়িয়ে এই বৃষ্টিতে ভিজেছি একটু তো মায়া দয়া করতে পারো।”
“আহারে কি আবদার। আমি কি বলেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজতে? আপনি কেনো ভিজেছেন? এখন দোষ আমার উপর দিচ্ছেন।”
মান্নাত জবাব দিলো না। ঠোঁট চেপে গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। আমরিশা বোধহয় একটু ভড়কে গেল। মান্নাতকে অবশ্য একটু ভয়ই পায়। মান্নাত তার বয়সে বড়। মাঝে মাঝে তর্ক করার সময় মনে হয় এই বুঝি রেগে গিয়ে চ*ড় মে*রে দেয়। যদিও এখন অবধি এমন কিছু হয়নি। হবার চান্স ও নেই। তবুও আমরিশা একটু ভয় পায়। বিশেষ করে রে*গে গেলে।
নরম স্বরে বলল, “আচ্ছা দেখুন, আমি তৈরি হইনি। ওখানে গিয়ে তো তৈরিও হতে হবে? যেতে দিন আমায়!”
“আমার ওখানে গিয়ে তৈরি হবা। এতো তাড়া কিসের। তৈরিই তো হবা, আমার ওখানে গিয়ে তৈরি হয়ে যেয়ো আমি এসে পৌঁছে দিব। কিন্তু তুমি এখন আমার সাথেই যাচ্ছ।”
বলেই গাড়ির গতি বাড়িয়ে হ্যান্ডেল ঘুরাল। আমরিশা চুপসে গেল। মান্নাত রে*গে গেছে।
তারা এসে গেছে পৌঁছেছে গ্যারেজের উপরের ঘরটাতে। বৃষ্টির তেজ এখন আগের থেকেও আরো বেড়েছে। আমরিশা পড়েছে দোটনায়। মা একবার ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করেছে, পৌঁছে গেছিস কি না।”
সে বলেছে হ্যাঁ। আর এদিকে বান্ধবী ফোন করায় বলেছে ঘণ্টা খানেক লাগবে। সে আসছে! দু জায়গায় দু রকম কথা বলে সে এখন মান্নাতের সাথে। শাড়ি পরা শেষ করেছে আরো আগেই। শাড়ির আঁচল ঠিকঠাক ভাবে পরে এবার মেকাপ করতে বসেছে।
কিন্তু পারছে না। আয়নার সামনে প্রতিবিম্বে মান্নাতকে দেখা যাচ্ছে। তাকে দেখার পর থেকেই তার বুকে দুরুম দুরুম শব্দ হচ্ছে। ঠিক আকাশে বাজ পড়ার মতো।
ড্রেসিন টেবিল থেকে কয়েক পা দূরে, সোফার উপর আরাম করে বসে আছে মান্নাত। একটু আগেই শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। পরনে কেবল একটা কালো ট্রাউজার তাও কোমর ছাড়িয়েছে। গলায় তোয়ালে ঝুলন্ত। একটু বাদে বাদেই ভেজা মাথার চুল মুছছে। অথচ তার ঈগল দৃষ্টি এদিকে। আমরিশার উপর। বেশ পরিপাটি করেই শাড়ি পরেছে। কিন্তু তবুও পেছনের ফাঁক দিয়ে তার চিকন কোমরের ফর্সা অংশ দেখা যাচ্ছে। মান্নাতের নজর সেদিকেই।
আমরিশার সাজ সামান্য। কোনো রকম অতিরঞ্জিত বিষয় না। কেবল কাজল দিলো, ব্লাশ দিয়েই চোখ সাজালো। অথচ ঠোঁটের গাঢ় লাল লিপস্টিক দিতেই মান্নাতের চোখ কপালে। ঠোঁট দু খান ফাঁক করে দেখছে সে। প্রতিবিম্বে আমরিশার সাথে চোখাচোখি হতেই নিজেকে সামলে নিল। শুকনো ঢোক গিলে উঠে দাঁড়াল। তার সুগঠিত উদাম পিঠ, পেশিবহুল বাহু আড়চোখে খুতিয়ে খুতিয়ে দেখছিলো আমরিশা! মান্নাত এদিকে ফিরতেই তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়াল। মান্নাত বলে উঠলো,
“গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে কে কে থাকবে?”
আমরিশা চোখ মুখ কুঁচকে বলল, “কে কে থাকবে মানে? সবাই থাকবে। বাড়ির একমাত্র মেয়ে! কাজিন, ভাই বোন বন্ধু সবাই থাকবে।”
মান্নাত মাথা নেড়ে তোয়ালে রেখে বলল, “ওহ!”
আমরিশা ঠোঁট চেপে হেসে বলল, “তো আপনি জেলাস ফিল করছেন?”
মান্নাত তাকে উপর থেকে নিচ অবধি দেখল। হলুদ শাড়িতে আমরিশাকে হলদে পাখি মনে হচ্ছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো ভঙিতে রাখা। একটা বেলি ফুলের মালা তার হাতে। নিশ্চিত চুলো খোঁপা বেঁধে গেধে নেবে। এরপর, এরপর ওই ঠোঁট জোড়ার দিকে নজর যেতেই চোখ নামিয়ে ফেলল সে। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“না, হচ্ছে না!”
“তাহলে জিজ্ঞেস করলেন কেন? ইনসিকিউরিটি ফিল করছেন?”
মান্নাত চোখ মুখ কুঁচকে তার চোখে চোখ রেখে বলল, “তুমি কি বলতে চাইছো!”
আমরিশা কথা না বাড়িয়ে মৃদু হাসল। ফুলটা রেখে চিরুনি হাতে নিয়ে চুল আঁচড়াতে লাগল। মান্নাত বিভোর হয়ে তাকে দেখছে। আমরিশা একা একাই বলছে,
“শুনুন, আমি তৈরি। এবার আমাকে দিয়ে আসুন। আর আপনি একটা নাপা খেয়ে নিন। নাহলে জ্বর আসবে। বুঝলেন তো?”
বলেই পিছন ফিরল। কিন্তু কেউ নেই। কি আশ্চর্য! এখানেই তো ছিল। তাহলে?
আমরিশার সন্দেহ হলো। বেলকনিতে নেই তো। শাড়ির কুচি সামলে ওদিকেই এগিয়ে গেল।
বেলকনির রেলিং হাতে উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মান্নাত। তার সামনে খোলা আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ছে ঝমঝমিয়ে। অন্ধকারে বৃষ্টি দেখা যায় না তবু বৃষ্টির ছোঁয়া নতুন উদ্যমে এসে তাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে। আমরিশা তার পিছন দাঁড়িয়ে। ডাকতে গিয়ে ইতস্তত বোধ করছে। গায়ে হাত দেবার আগেই থমকে দাঁড়াল। কোথায় রাখবে হাত? ওই উন্মুক্ত পিঠে! বিন্দু বিন্দু পানি যেখানে চকচক করছে। ভাবতে গিয়ে গা শি*উরে উঠল তার। কেঁপে উঠলো খানিকটা। চুড়ির মৃদু আওয়াজ পেয়ে মান্নাত পিছন তাকাল। আকস্মিক ঘটনায় আমরিশা ভয় পেয়ে দেওয়ালে আটকে গেলো সটাং করে। দ্রুত বেগে শ্বাস প্রশ্বাস নিচ্ছে সে।
মান্নাত বিভোর, মুগ্ধ, হতবাক আবার বিস্মিত। তার সামনে আমরিশা দাঁড়িয়ে। হৃৎপিণ্ডে ছুটছে বিন্দুতের গতিতে। অলৌকিক ভাবে তাকে কাছে ডাকছে আমরিশা। ঠিক যেন চুম্বকের মতো। নিজের ভারী, সুবিশাল,সুগঠিত দেহখান নিয়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে।
আমরিশার গলায় এসে কথা আটকে গেল। দেওয়ালের সাথে পারলে মিশে যায় এমন অবস্থা। শশব্যস্ত ভঙ্গিতে এদিক ওদিক ফিরছে। এই পালাবে। তার আগেই মান্নাত তার হাতটা ধরে ফেলে শক্ত করে। নিমিয়ে যায় সে।
হাতের বাঁধন ছেড়ে দিয়ে গালের কাছে হাত রাখে নরম পরশে। ঝিনঝিন করে উঠে আমরিশার পুরো দেহ। মান্নাত কাছে আসছে, আরো কাছে। সে ঠোঁট দুখান ফাঁক করে শ্বাস নিচ্ছে। মান্নাতের ঠোঁট জোড়া গিয়ে পৌঁছায় কানের কাছে। অধরপুটে মৃদু নড়চড়। কানের কাছে সম্মোহিত কণ্ঠস্বর!
“আমরিশা, আমরিশা আমি পারছি না। প্লিজ একটিবার। একটিবার কেবল তোমার এই ঠোঁটজোড়া ছুঁয়ে দেখব। প্লিজ পারমিশন দাও।”
হৃদয়ে তোল*পাড় শুরু করে দিয়েছে। র*ক্তিম হয়ে উঠেছে মুখখানি। কণ্ঠস্বর কাঁপছে যেন। মান্নাত তার ঘাড়টা ধরে মাথা উঁচু করাল। চোখে চোখ পড়ল। গভীর দৃষ্টি জোড়া মন কেড়ে নিল আমরিশার। তার চোখেতে অশ্রু জমছে। মান্নাতের দৃষ্টিতে আকুতি। সে গভীর থেকে গভীরতর স্বরে বলে উঠে, “কেবল একটি চুমু! যাস্ট ওয়ান কিস আমরিশা। নাথিং এলস!”
কম্পিত কণ্ঠস্বর মাথা নেড়ে বলছে, “শুধু একটি চুমু! একবার!”
প্রিয়তে তুমি প্রাণ পর্ব ৩৪
মান্নাত মাথা নেড়ে সায় দিল। আঁখি জোড়া চকচক করছে। দুই হাতে আগলে ধরে পরম আবেগে রক্তিম করা কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ির মতো অধরভাজে ছুঁয়ে দিল। কিন্তু বলে না, নেশায় একবার পড়ে গেলে কে ছাড়ে। উন্মাদ মান্নাত তার সমস্ত আবেগ, সমস্ত অনুভূতি দিয়ে অধরজোড়ার দখল নিল। অন্য হাত ছুঁয়ে দিচ্ছে শাড়ির ভাঁজে কোমরের মসৃণ ত্বক। আমরিশা কেঁপে কেঁপে উঠে খা*মচে ধরছে তার উন্মুক্ত কাঁধ। মূহুর্তের মধ্যেই দাগ ছেড়ে যাচ্ছে নখের আঁ*চড়। অথচ কথা ছিল কেবল একটি চুমুর!