প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৮
রাজিয়া রহমান
উপমা প্রথমে ভাবতে পারে নি ব্যাপারটা এতোদূর পর্যন্ত গড়াবে। যখন জানতে পারলো তার সন্তান আর নেই উপমার হুঁশ হলো তখন।কি করে ফেললো সে!
ক্রোধে অন্ধ হয়ে নিজের সন্তানকেই মেরে ফেললো!
উপমার বুক ভাঙা চিৎকারে সাগরের ভীষণ হাসি পেলো।কেবিনের ভেতর থেকে উপমার কান্না শোনা যাচ্ছে।
শফিকের ও ভালো লাগছে না।বোনকে শফিক সবসময়ই সাপোর্ট করে এসেছে কিন্তু এভাবে নিজের হাতে নিজের বাচ্চাকে শেষ করে দেওয়াটা শফিকের হজম হলো না।
নিজের একটা বাচ্চা আছে বলেই শফিকের এটুকু সুকুমার বোধ আছে যে সন্তানের জন্য মানুষের কতটা ভালোবাসা থাকে।সেখানে যে নিজের হাতে নিজের সন্তানকে শেষ করে দিতে পারে সে আর যাই হোক,মানুষ না।
শফিকের ভাবনার মধ্যেই ফোন বেজে উঠলো।
জান্নাত কল করেছে। শফিক কল রিসিভ করলো।জান্নাত উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কি অবস্থা? বাচ্চা ঠিক আছে তো?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শফিকের পাষাণ বুকটা কেঁপে উঠে। নিজেকে শফিক দয়ামায়াহীন,পাষাণ বলেই জানে।পাষাণ না হলে কি সে টাকার বিনিময়ে অন্যায়ভাবে নিরপরাধ মানুষের ক্ষতি করতে পারতো?
অথচ সেই পাষাণ বুকটা ও এই মুহূর্তে বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে।
“না,বাচ্চাটা নেই।”
জান্নাতের মনটা খারাপ হয়ে যায়। উপমাকে সে পছন্দ না করলেও কখনো চায় নি উপমার বাচ্চাটার ক্ষতি হোক।তবে গতরাতে উপমা যা করেছে এরপর জান্নাত আর উপমাকে এক মুহূর্ত ও নিজের বাসায় টলারেট করবে না।
শফিককে বললো, “তো,তুমি এখনো ওখানে কী করছো?বাসায় চলে আসো।আরেকটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি আমি তোমাকে,তোমার বোনকে তুমি এখানে আনতে পারবে না।আমি শ্বশুর শাশুড়ী নিয়ে সংসার করতে রাজি আছি,অবিবাহিত ননদ নিয়ে সংসার করতে রাজি আছি কিন্তু এরকম নাগিনী মহিলাকে আমার সংসারে আমি জায়গা দিতে পারবো না।নিজের সন্তানের প্রতি যার বিন্দুমাত্র মায়া মমতা নেই সে যে রাগ উঠলে আমার সন্তানকে শেষ করে দিবে না সেই গ্যারান্টি কে দিবে?
তোমার বোনের জন্য আমি আমার সন্তানের জীবন বিপদে ফেলতে পারবো না।আশা করবো তুমি ও বুঝবে নিজের সন্তানের মূল্য। আর যদি এখনো তোমার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে তোমার বোন হয় তো আমাকে বলে দিও।তুমি তোমার সন্তানের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে পারলেও আমি পারবো না আমার সন্তানের জীবন নিয়ে জুয়া খেলতে। ১০ মাস আমি পেটে রেখেছি,সি সেকশন আমার হয়েছে, রাতে জেগে আমি কষ্ট করেছি যেহেতু সন্তানের জীবনের মূল্য তাই তোমার চাইতে বেশি আমাকেই বুঝতে হবে।আমি আমার সন্তান নিয়ে চলে যাবো।”
শফিক জবাব দিলো না। কাউন্টারে গিয়ে হাসপাতালের বিল দিয়ে বের হয়ে এলো। উপমাকে ১২ টার দিকে রিলিজ দিয়ে দেওয়া হবে।শফিক আগেই বের হয়ে এলো। বুকটা কেমন শূন্য শূন্য লাগছে।জান্নাতের সাথে আজ আর অশান্তি করতে ইচ্ছে করে নি।
শফিক আর জান্নাতের বিয়ের ৬ বছর পর শ্রেয়ান জন্মায়।শফিক দেখেছে এই ৬ বছর জান্নাত কতো রাত বিছানায় না ঘুমিয়ে জায়নামাজে ঘুমিয়েছে। আল্লাহর দরবারে কতো চোখের জল ফেলেছে জান্নাত একটা সন্তানের জন্য।শফিক তেমন একটা নামাজ কালাম পড়ে না।সাপ্তাহিক মুসুল্লি সে।শুক্রবার জুমার নামাজ পড়ে শুধু। একসময় শফিক খেয়াল করলো জুমার নামাজ পড়ে নিজের অজান্তে সে ও আল্লাহর কাছে একটা সন্তান চাইতে শুরু করেছে।
মহান আল্লাহ তার মতো গুনাহগারের দোয়া ও কবুল করেছেন। তাকে একটা সন্তান দিয়েছেন।
উপমা যদি কোনো দিন নিজের স্বার্থে আঘাত লাগলে শ্রেয়ানের ও ক্ষতি করে!
নিজের সন্তানকে শেষ করে দিতে যার হাত কাঁপে নি,অন্যের সন্তানের বেলায় কি হাত কাঁপবে?
জান্নাত ভুল কিছু বলে নি।
ছোট পরীটাকে নিজ হাতে দাফন করে এলো সাগর। দাফন করতে গিয়ে সাগরের মনে হলো শুধু নিজের কন্যাকে না সেই সাথে দাফন করেছে নিজের কলিজাটাও।
ইরার ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়ে অনেক দূরে চলে যেতে।পালিয়ে যেতে চায় ইরা সবকিছু থেকে।এতো যন্ত্রণা সহ্য করা যায় না।ভাইয়ের সামনে ইরা আর কখনো মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না।
শারমিন বাসাতেই ছিলো। ইরা আর সাগর যখন বাসায় এলো তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে এসেছে। সাগর বাসায় এসেই নিজের রুমে ঢুকে গেলো।
ইরা গ্লাস টেনে নিয়ে পানি নিলো জগ থেকে।তারপর চেয়ারে বসে পানি পান করলো।
চেহারায় রাজ্যের বিষাদ জমে আছে।
শারমিন বিরক্ত হয়ে বললো, “সকালে বের হইলি,এখন ফিরলি।সারাদিন একটা খবর নিলি না আমি একা মানুষ বাসায়।মইরা গেলেও তো খবর পেতি না।”
“তুমি একটা বার খবর নিয়েছো?একটা বার জানতে চেয়েছো কল দিয়ে ওখানে কী হয়েছে? তোমার কী মনে হয় ওখানে ভাইয়া ফূর্তি করতে গিয়েছে?”
“তা নয়তো কী?যারে তালাক দিছে সে হাসপাতালে যাক আর জাহান্নামে তাতে সাগরের কী?ওর তো যাওয়ার কোনো দরকার ছিলো না।এতো পিরিতি কীসের?ওর সাথে তুই ও নাচতে নাচতে বের হয়ে গেলি,আমি সারাদিন না খেয়ে আছি।রান্না না করে যে চলে গেলি একবার ও মনে হয় নি বাড়িতে আমি খাইছি কি-না!”
ইরার ধৈর্য্য,সংযম আর বাঁধ মানলো না।নিজেকে আর সামলাতে পারলো না ইরা।চিৎকার করে বললো, “তোমার মতো জঘন্য, নিচু মানসিকতার মানুষ আমি আমার জীবনে আর দেখি নি।আমার লজ্জা লাগছে তোমাকে আজকে মা বলে ডাকতে।তুমি আসলে উপমার মতো। একই ক্যাটাগরিতে বিলং করো।যার জন্য সে নিজের পেটের সন্তানকে নিজে শেষ করে দিলো আর তুমি আমাদের তিলে তিলে শেষ করছো।নিজের একটা সন্তানকে তো কবরে পৌঁছিয়ে দিয়েছো,এখন আমাদের দুই ভাইবোনকে শেষ করতে চাও।আল্লাহ তোমার মতো জঘন্য মা আর কাউকে না দিক।
তুমি এতোটা ও অর্থব না যে দুটো ফুটিয়ে নিতে পারো না।তোমার ছেলে আজকে নিজের হাতে নিজের কন্যাকে কবর দিয়ে এসেছে। কোথায় তুমি তাকে নিজের স্নেহ,মমতা দিয়ে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করবে সেটা না করে তুমি কি-না বলছো তোমার খাওয়ার কথা ভাবি নি কেনো?
তোমাকে আমার মা বলে ডাকতে ইচ্ছে করে না। তোমাকে মা বললে মা শব্দের অপমান হবে।”
শারমিন এগিয়ে গিয়ে ইরার চুলের মুঠি চেপে ধরে বললো, “খুব কথা বের হইতেছে! চোপা খুব বাড়ছে মনে হয় তোর?আমি নিচু মানসিকতার মানুষ! তুই ও নিচু চরিত্রের মানুষ। দুনিয়ায় এতো মানুষ থাকতে নয়তো তোর ঘরে পরপুরুষ ঢুকে কেনো?তুই কোথাকার সুফি, দরবেশ!
আমার বাড়িতে থাকস আবার আমাকে গালমন্দ করস!”
ইরা চুল ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, “তোমার মতো মায়ের ঘরে আল্লাহ কখনো কোনো সন্তান না দিক।নিজের সন্তানের ইজ্জতে যে নিজে কালিমা লাগায় সে কখনো মা হতে পারে না।আল্লাহ তোমার মতো মা’য়ের ঘর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যাক।আমার বাবা,বোন,ভাইয়ের মেয়েটার সাথে আমাকে ও নিয়ে যাক।তুমি আমাকে যে অপবাদ দিলে সেটা আমার কলিজা এফোঁড়ওফোঁড় করে দিয়েছে।নোংরা কথা দিয়ে ভেঙে দেওয়া আমার এই কলিজার প্রতিটি টুকরোর হিসেব আল্লাহ তোমার থেকে নিবে।
মনে রেখো,একবার তোমার এই কারাগার থেকে বের হওয়ার পর আমার আপার মতো আমাকেও তুমি আর দেখবে না।অবশ্য তোমাকে এসব বলে লাভ নেই,তোমার ওই নোংরা মন থেকে সন্তানের প্রতি মায়া আল্লাহ তুলে নিয়ে গেছে।এই নেয়ামত আল্লাহ সবাইকে দেয় না।”
শারমিন মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে শুরু করে। সেই সাথে ইরাকে শাপশাপান্ত করতে থাকে।ইরা সেই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয় আজকে থেকে সে আর রান্নাবান্না করবে না।যত শীঘ্রই সম্ভব এখান থেকে বের হয়ে যাবে।ল্যাংড়া হোক,কানা হোক,রিকশাচালক হোক,যেখান থেকেই বিয়ের প্রস্তাব আসবে ইরা বিয়ে করে সেখানেই চলে যাবে।
চাইলেই ইরা হোস্টেলে বা মেসে চলে যেতে পারে কিন্তু নিজের মা-ই ইরার নামে বদনাম রটাবে সুযোগ পেলে।
ইরা সাগরের রুমের দরজা ধাক্কা দিতে লাগলো। সাগর ভেতর থেকে বললো, “আমাকে একা থাকতে দে ইরা।আমার ভালো লাগছে না,মাথা ধরে আছে।মা’কে বল মা’র এসব নখরা বন্ধ করতে।”
“লেবু চা খাবে ভাইয়া?”
“না।কিছু খাবো না আমি। আমাকে ডাকিস না।”
ইরা চেয়ারে একই ভাবে বসে রইলো,কিছুই খেলো না।রান্না ও করলো না।
শারমিন চাল-ডাল মিশিয়ে খিচুড়ি করেছে একটু।সেটুকু খেলো।সন্ধ্যার পর বাসার কলিং বেল বেজে উঠে।
ইরা দরজা খুলে চমকে উঠে। লিনার ভাই,বেবি হাল্কটা এখানে কেনো এসেছে!
“হ্যালো ইরাবতী!”
ইরা সালাম দিয়ে বললো, “আপনি এখানে?”
“তোমার সাথে না,তোমার বাবা মা’র সাথে দেখা করতে এসেছি।”
ইরার মোটেও ইচ্ছে করলো না শারমিনকে ডাকার। শারমিনকে মা বলতে ও ইরার ইচ্ছে করে না। সাগরকে ডেকে ও সাড়া পেলো না ইরা।অগত্যা শারমিনের কাছে গিয়ে বললো, “তোমার কাছে কে যেনো এসেছে।”
শারমিন বাহিরে এসে দেখে ভীষণ লম্বাচওড়া এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে ড্রয়িং রুমে। শারমিনের মনে হলো, ছেলেটা হাত তুললে বোধহয় ছাদ স্পর্শ করতে পারবে। দেখতে নায়কের মতো, চুলগুলো একেবারে ছোট ছোট করে ছাঁটা।
আচ্ছা, কোনো আর্মি না-কি!
ইরা কী তার নামে কোথাও বিচার দিয়েছে যেখান থেকে হয়তো আর্মি পাঠিয়েছে শারমিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য!
শারমিনের গলা শুকিয়ে গেলো।
ইশতিয়াক বললো, “আপনি ইরার মা তো?”
শারমিন আগেই নাক টেনে কেঁদে বললো, “বাবা বিশ্বাস করো,আমার কোনো দোষ নেই।আমি একজন বিধবা মহিলা। আমাকে আমার নিজের মেয়ে ভাত দেয় খেতে।নিজের পেটের মেয়ে আমাকে গালমন্দ করে, গায়ে হাত তোলে।আমি জানি ইরার বিচার পেয়ে তুমি আসছো আমাকে ধরে নিতে।আমি বুড়ো মানুষ। আমারে এরা কতো অত্যাচার করে কাউকে বলি না দেখে কেউ জানে না।আমি…..”
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ১৭
ইরা নিজের রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো।মা’য়ের এসব কথা শুনে ইরা একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো।
ইশতিয়াক হেসে বললো, “আপনি ভুল ভাবছেন।আমি আসলে এসেছি অন্য ব্যাপারে।আমি ইরাবতীকে বিয়ে করতে চাই।”
ইরা চমকে উঠে ইশতিয়াকের কথা শুনে।