প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২১

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২১
রাজিয়া রহমান

প্রচন্ড ক্ষুধা আর মাথা যন্ত্রণা নিয়ে ইরা বিছানায় গেলো।পেটে ভীষণ ক্ষুধা অথচ খাবার খাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই।
বুক ভেঙে কান্না আসছে ইরার।ভীষণ যন্ত্রণায় ছটফট করছে ইরা।কেনো এমন একটা অদ্ভুত জীবন দিলো আল্লাহ!
কেনো নিজের মা এমন হলো তার!
ইশতিয়াক গাড়িতে হেলান দিয়ে বসে আছে। ড্রাইভারকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে বসে আছে গাড়িতে।
কি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে ইশতিয়াকের।
এই যে একটা মেয়েকে সে এতো সংক্ষিপ্ত একটা সময়ের মধ্যে বিয়ে করে ফেললো,সেই মেয়েটার জন্যই হঠাৎ করে ইশতিয়াকের বুকের বাম পাশে এক অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে।
তাকে ভেবে এমন অনুভূতি হওয়ার কারণ কী ইশতিয়াক জানে না।

সে কী ইশতিয়াককে ভাবছে?
মনে হয় না।
কি করছে এখন?
ইশতিয়াকের চোখে ভাসে তার ভীত মুখটা।নিজেকে রক্ষা করার জন্য কেমন মরিয়া হয়ে উঠেছিলো।
ইশতিয়াক তাকে আজীবন রক্ষা করে যাবে।
গাড়িতে বসেই ইশতিয়াক দেখলো একটা ভ্যানে করে সাগর খাবার দাবার সবকিছু নিয়ে বের হয়েছে। ইশতিয়াক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুঝতে পারলো কি হয়েছে।
হঠাৎ করে ইশতিয়াকের মনে হলো ইরাবতী কী তাহলে আমার পাঠানো খাবার খেতে চায় না বলে সবকিছু এমন করে সবাইকে দিয়ে দিতে বলেছে?
গাড়িতে উঠে ইশতিয়াক গাড়ি নিয়ে ইরাদের বাসার সামনে গেলো।এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েকটা ইটের ঢেলা নিয়ে ছুড়ে মারলো ইরার রুমের বারান্দার দিকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইরা চমকে উঠলো
দেয়ার ঘড়িটা ডংডং করে জানান দিলো এখন রাত বারোটা।
ইরা উঠে বারান্দায় যেতেই দেখলো ইশতিয়াক নিচে দাঁড়িয়ে আছে।
ইরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। এই মানুষটাকে সে কিছুক্ষণ আগে বিয়ে করে এসেছে। অথচ ইরার মনেই হচ্ছে না এই মানুষটা তার কেউ হচ্ছে। মনে হয় কোনো অচেনা পথিক বুঝি।
ইরা চলে যেতে উদ্যত হতেই আরেকটা ঢিল এসে লাগলো বারান্দার গ্রীলে।
ইরা ঘুরে তাকালো।ইশতিয়াক গাড়িতে উঠে হর্ণ দিতে শুরু করলো।
ইরাকে কেউ বলে দেয় নি তবুও কেনো জানি ইরার মনে হলো তাকে নিচে ডাকছে।
নিচে নামবে না বলে ইরা মনস্থির করে বসে রইলো খাটের ওপর।
ইশতিয়াক হর্ণ দিতেই থাকলো।

অনেকক্ষণ ধরে হর্ণ শুনতে শুনতে ইরা অধৈর্য্য হয়ে উঠলো। তারপর বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বের হলো।সাগর এখনো ফেরে নি।
ইরা বাহিরে বের হয়ে ইশতিয়াকের গাড়ির কাছে গিয়ে জানালায় নক করে। ইশতিয়াক কোনো কথা না বলে তার পাশের সীটের দরজা খুলে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট দেয়।
ইরা ভীষণ বিরক্ত।ওর সারা শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে।মাথার উপর দিয়ে এতো ঝড় গেলো।ইরার ইচ্ছে করছে কতোগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে একেবারে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে সব চিন্তা মাথা থেকে বের করে দিয়ে।
“সমস্যা কী আপনার?”
ইশতিয়াক তার উত্তর না দিয়ে ইরাকে বললো, “গাড়ির দরজা খুলে রেখেছি কেনো আমি?”
“আপনি কেনো দরজা খুলে রেখেছেন তা আমি কীভাবে জানবো?”
“তুমি জানো না যেহেতু, বুঝো ও না?”
“না বুঝি না।”

ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে রইলো। রাগে ইরার নাকটা ফুলছে।কী ভীষণ মিষ্টি লাগছে!
দরজা খুলে ইশতিয়াক বের হলো। তারপর এক ঝটকায় ইরাকে কোলে তুলে নিয়ে ওপাশ দিয়ে নিয়ে গিয়ে ওর পাশের সীটে বসিয়ে দিলো। তারপর নিজে এসে ড্রাইভিং সীটে বসে গাড়ি নিয়ে বের হয়ে গেলো।
“কোথায় যাচ্ছেন আপনি? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
“জাহান্নামে যাচ্ছি। আমি যেখানে যাবো তুমি ও এখন থেকে সেখানে যেতে বাধ্য কোনো দ্বিধা ছাড়াই।”
“আমি যাবো না আপনার সাথে। আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন।আমার ভালো লাগছে না।”
ইশতিয়াক ঝুঁকে ইরার মুখের উপর গিয়ে বললো, “আজকে সারারাত তুমি আমার সাথে থাকবে।আজ থেকে তুমি আমার।”

ক্লান্ত ইরার কথা বলার শক্তি নেই।
নির্জীব হয়ে বললো, “গাড়ি থামান তা না হলে আমি চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে যাবো।”
ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে গাড়ি থামালো।তারপর মুচকি হেসে বললো, “তুমি আমাকে দিয়ে ফোর্স করাতে চাচ্ছো ইরাবতী? ওকে, ফাইন!”
গাড়ি থামানোতে ইরা খুশি হলো।বাসায় গিয়ে লম্বা একটা ঘুম দিবে ইরা।

ইরাকে চমকে দিয়ে ইশতিয়াক ইরাকে নিজের কোলে বসিয়ে নিলো।তারপর গাড়ির স্পিড বাড়াতে লাগলো। আতঙ্কিত হয়ে ইরা বললো, “আমাকে ছাড়ুন প্লিজ।আমি পাশের সীটে বসে থাকবো।আমি নামবো না।প্রমিজ করছি।”
“এখন আর এসব বলে লাভ নেই ইরা।যদি তুমি পারো তাহলে নামো।তবে মনে রেখো তুমি এখান থেকে নামতে চাইবে তো আমি স্টিয়ারিং ছেড়ে দুই হাতে তোমাকে আঁকড়ে ধরবো। গাড়ি যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে যাক।”
ইরার কেমন অবাক লাগলো। এই লোক তো পাগলের চূড়ান্ত। এর যেই শরীর,এক হাত দিয়ে ইরাকে ধরলেই ইরা এর সাথে পারবে না সেখানে দুই হাতে ধরলে তো ইরা চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।
একটা মানুষ এতো লম্বা,চওড়া কেনো হবে?
ইরা শক্ত হয়ে বসে রইলো দাঁত মুখ খিঁচিয়ে।
ইশতিয়াকের ভীষণ আনন্দ লাগছে।
কি আশ্চর্য!

নিজের একটা বউ থাকলে মানুষের মনে এতো আনন্দ হয়?
ভাগ্যিস বিয়েটা করেছিলো তা না হলে জীবনের এই গোপন আনন্দ ইশতিয়াকের কাছে আজীবন অজানা থেকে যেতো।
ইরাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে ইশতিয়াক বললো, “ধন্যবাদ ইরাবতী। তোমাকে না দেখলে হয়তো আমার বিয়ে করার আগ্রহ কখনোই হতো না।আর বিয়ে না করলে এই মানসিক সুখ আজীবন আমার অজানা থেকে যেতো।”
“আর আমার এই মানসিক যন্ত্রণা।”
ইশতিয়াক হতবাক হয়ে যায়।
ইরা কী খুব আপসেট?
কেনো?

ইশতিয়াকের উপর রেগে আছে ইরা?
ইশতিয়াক কী ভুল কিছু করেছে?
না-কি এভাবে এখানে বসানোতে ইরা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে?
কি আশ্চর্য, ইরার মন খারাপে ইশতিয়াকের কেনো কষ্ট হচ্ছে!
ইশতিয়াক ইরাকে ছেড়ে দিয়ে বললো, “তুমি তোমার জায়গায় বসো।আমার অযাচিত স্পর্শ হয়তো তোমার ভালো লাগছে না।আমি সতর্ক থাকবো ইরাবতী। তবে নিশ্চয়তা দিতে পারবো না তোমাকে টাচ না করার।
তুমি আমার অলকানন্দা, তোমাকে আমি সময় অসময়ে ছুঁয়ে দিবোই।”

ইরা নিজের জায়গায় বসে সীটে হেলান দিয়ে বসলো।অল্প সময়ের মধ্যে ইরা ঘুমিয়ে গেলো।ইরা ঘুমানোর পর ইশতিয়াক ইরাকে সীটবেল্ট লাগিয়ে দিলো।কল করে হোটেলে একটা রুম বুক করলো ইশতিয়াক।
তারপর আস্তে আস্তে ড্রাইভ করে হোটেলের সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করালো।
ইরাকে গাড়িতে থেকে পাঁজাকোলা করে নিজের বুক করা রুমে নিয়ে শুইয়ে দিলো।
হোটেলের রেস্টুরেন্টে খাবার অর্ডার দিয়ে বললো রেডি করে রাখতে যাতে কল দিলেই পাঠিয়ে দিতে পারে।
ঠান্ডা অনুভব হতেই ইরার ঘুম ভেঙে গেলো।যদিও গায়ের ওপর কমফোর্টার দেওয়া আছে।অচেনা জায়গায় ঘুমিয়ে আছে মনে হতেই ইরা লাফিয়ে উঠে বসে।
ভীষণ নরম,আরামদায়ক একটা বিছানায় সে শুয়ে আছে।
আশেপাশে কেউ নেই।

ইরা এদিক ওদিক তাকিয়ে ভয়ার্ত সুরে ইশতিয়াককে ডেকে বললো, “আপনি কোথায়?”
বারান্দা থেকে ইশতিয়াক উঁকি দিয়ে বললো, “ভয় নেই,ঘুমাও তুমি নিশ্চিন্তে ইরাবতী।”
“আমি কোথায়?”
“তোমার হাজব্যান্ডের কাছে।”
ইরা বিরক্ত হয়ে বললো, “এটা কোন জায়গা?”
“এটা বাংলাদেশের রাজধানী,ঢাকা শহর।”
“উফ!এতো কথা প্যাচান কেনো?ঠিক করে বলুন আমি কোথায়? আমি কাউকে না বলে বের হয়ে এসেছি বাসা থেকে।সবাই চিন্তা করবে।”
“তোমার জন্য চিন্তা করার মানুষ এই পৃথিবীতে একমাত্র আমি আছি অলকানন্দা। আর কারো দরকার নেই আমার বউকে নিয়ে ভাবার।তবুও আমি আমার একমাত্র ব্রাদার ইন ল’কে জানিয়েছি।তোমার ভাবনার কোনো কারণ নেই।”
পেটের ভেতর ভীষণ মোচড় দিচ্ছে।ইরা চুপচাপ বসে রইলো।
ইশতিয়াক রুমে এসে কল দিলো কোথাও।ইরা সেদিকে খেয়াল দিলো না।
দুই মিনিটের মাথায় দুজন বয় এলো বিশালাকৃতির একটা ডালা নিয়ে।
ইরা চমকে তাকায়।

বিভিন্ন রকম খাবার আইটেম। রেড ভেলভেট কেক, কোল্ড ড্রিঙ্কস।
ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকিয়ে বললো, “শুরু করো ইরাবতী।”
“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“আমার ইচ্ছে করছে। হয় তুমি নিজে খাও,নয়তো আমি তোমাকে খাইয়ে দিবো নয়তো তুমি আমস্কে খাইয়ে দিবে।যেটাই চুজ করো তুমি। আমার কোনো প্রব্লেম নেই।”
ইরা বুঝতে পারলো পড়েছে মোগলের হাতে,খানা খেতে হবে একসাথে।
ইরা চাইনিজ প্ল্যাটারটা তুলে নিলো।এত মাঝরাতে কে এসব খায় ইরার জানা নেই কিন্তু ইরা সারাদিনের অভুক্ত। অতএব আর লজ্জা না করে ইরা মনোযোগ দিলো খাবারে।
ইশতিয়াক একটা ব্রেড নিলো।
এই যে ইরা তাকে ভয় না পেয়ে পরম নিশ্চিন্তে তার পাশে বসে আছে। অথচ গতকাল রাতে ও ইরা তাকে বিশ্বাস করতো না। একটা স্বাক্ষর করে ইশতিয়াক ইরার বিশ্বাসের জামিনদার হয়ে গেলো।
কী ভীষণ অদ্ভুত না এটা?

ইরার খাওয়া শেষ হতেই ইশতিয়াক বললো, “চলো কেক কাটি ইরা।”
ইরা কথা না বাড়িয়ে রাজি হলো।
সিনেমার মতো কেকে ভেতর থেকে একটা গোলাপ ফুলের বক্স বের হয়ে এলো।
ইরা ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে রইলো। ইশতিয়াক মুচকি হেসে বক্সটা খুলে একটা রিং বের করে ইরাকে পরিয়ে দেয়।নিজের বাম হাতের অনামিকার দিকে তাকিয়ে ইরার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠে।
সবসময় শুনে এসেছে বাসর রাতে হাজব্যান্ড ওয়াইফকে গিফট করে।
এই মানুষটা যে সেটা মনে রেখে ইরাকে গিফট দিলো তাতেই ইরার আনন্দ লাগছে।
ইরার হাতের রিংটাতে একটা আলতো চুমু খায় ইশতিয়াক। তারপর ঝুঁকে ইরার কপালে চুমু খেয়ে বললো, “তুমি বিরক্ত হচ্ছো জানি কিন্তু আমি ভীষণ লোভী বোধহয়। তাই তোমার পারমিশন নেওয়ার ধার ধারছি না।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২০

“আপনাকে ধন্যবাদ।”
“কেনো?”
“আমাকে একটা নরক থেকে উদ্ধার করে আনার জন্য।”
“আমার উল্টো তোমাকে ধন্যবাদ জানানোর কথা।”
“কেনো?”
“তুমি এসে আমার এই শুকনো, খটখটে মরুভূমির মতো জীবনকে স্বর্গ করে তোলার জন্য ইরাবতী।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২২