প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৪

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৪
রাজিয়া রহমান

জায়নামাজে দাঁড়িয়ে ইশতিয়াকের মনে হলো কতো বছর পর সে এই নামাযে দাঁড়ালো।সারা শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত আনন্দ আলোড়ন তৈরি হলো ইশতিয়াকের।
ইশতিয়াকের পা থেকে মাথা পর্যন্ত সব পাপে ভরে আছে ওর।এমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কেনো আজ?
ইশতিয়াকের মনে পড়ে না কখনো ও নামাজ পড়েছে কিনা এর আগে।
১২ রাকাত নামাজ পড়ে ইশতিয়াক যখন নামাজের জায়নামাজে বসলো ইরা তখন বললো, “দুই হাত তুলে মুনাজাত দিয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চান।উনি পরম ক্ষমাশীল।ওনার কাছে সাহায্য চান উনি যাতে আমাদের সরল পথে পরিচালিত করেন।”

ইশতিয়াক বুক ভরা ভয় নিয়ে দুই হাত তুললো আল্লাহর দরবারে। হাত তুলতেই ইশতিয়াকের মনে হলো জীবন ভরা পাপ তার,কোনটার জন্য ক্ষমা চাইবে সে?
মুহূর্তেই পাষাণ মনে ভীতি জন্মালো।ঝরঝর করে কাঁদতে শুরু করলো ইশতিয়াক।
মনের যত আকুতি, যত পাপ সবকিছু আল্লাহর কাছে বলতে শুরু করলো ইশতিয়াক।
ইরা পাশে বসে দুই হাত তুলে আল্লাহকে বললো, “আল্লাহ, আমি জানি না এই বিয়ে আমার জন্য মঙ্গলজনক কি-না। তুমি সব কিছু জানো আল্লাহ। যদি মঙ্গলজনক হয় তাহলে তুমি আমার অশান্ত মনকে শান্ত করে দাও আল্লাহ। আমাকে শক্তি দাও। যদি অমঙ্গলকর হয় তাহলে তুমি তোমার রহমত দিয়ে তা মঙ্গলকর করে দাও।আমাকে সাহায্য করো আল্লাহ।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ইশতিয়াক মুনাজাত দিয়ে ইরাকে বললো, “ইরা,তোমার কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ।আমার এই জীবনে আমি অনেক কেঁদেছি ইরা।কিন্তু কখনো কান্না করে এরকম মানসিক শান্তি আমি পাই নি।আজকে কান্না করে আমার বুকের ভেতরের সব অস্থিরতা দূর হয়ে গেছে। আমার নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে।”
ইরা মুচকি হাসে।
ইকবালের বিয়ের তারিখ ফিক্সড করা হয়েছে। এক সপ্তাহ পরেই বিয়ে। দুপুরে খাবার সময় হয়েছে। ইশতিয়াক ইরার হাত ধরে বললো, “চলো খেতে যাবো।”
ইরার বিব্রতবোধ দেখে ইশতিয়াক বললো, “ভয় পাবে না।কেউ কিছু বললে প্রতিত্তোরে তুমি ও বলে দিবে।মনে রেখো তুমি এখন এই বাড়ির বউ।তোমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে।তোমার পাশে ছায়া হয়ে আমি আছি।খবরদার চুপ থাকবে না,কারো অন্যায় কথা সহ্য করবে না।যেমন কুকুর তেমন মুগুর না হলে এই দুনিয়ায় বাঁচতে পারবে না।”
ইরা মিনমিন করে বললো, “কি দরকার ঝামেলার!কুকুরের কাজ মানুষকে কামড় দেওয়া। কুকুর মানুষকে কামড় দিলে মানুষ ও কী কুকুরকে কামড় দেয় বলেন?”
ইশতিয়াক এক নজর ইরার দিকে তাকিয়ে বললো, “না, মানুষ তাকে কামড় দেয় না।তবে সেই কুকুরকে বিষ দিয়ে মেরে ফেলতে হয়।”

ইরা হেসে ফেললো এরকম উত্তর শুনে।
ইশতিয়াক ইরাকে নিয়ে নিচে এলো খেতে।সবাই এসে বসেছে।
লিনা বসেছে ইকবালের পাশে।ইকবালের কপালে ব্যান্ডেজ করা। ইশতিয়াককে ওর বউকে নিয়ে আসতে দেখে শায়লার সারা শরীর জ্বলতে শুরু করে। উঠে দাঁড়িয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো, “শেখ পরিবারের একটা মর্যাদা আছে।এই বাড়ির ডাইনিং টেবিলে যাকে তাকে মানায় না।”
ইশতিয়াক ইরার দিকে তাকালো।চোখের চাহনিতে ইরা বুঝতে পারলো ইশতিয়াক চায় ইরা প্রতিবাদ করুক।
ইরা মুচকি হেসে বললো, “আমি আপনার ছেলের বউ তবুও আমাকে এই টেবিলে খুব বেমানান লাগছে শেখ পরিবারের মানুষের সাথে খেতে বসায়?”

শায়লা আগের মতো চিবিয়ে বললো, “বলেছি তো।এই শেখ পরিবারের মানুষের সাথে অন্য কাউকে এক টেবিলে মানায় না।তোমাকে রান্নাঘরের ফ্লোরে মানায়।তুমি এই শেখ পরিবারের কেউ না।”
ইরা আরো মিষ্টি করে হাসে।সেই হাসিতে ইকবালের সবকিছু এলোমেলো লাগে।
এগিয়ে গিয়ে নিজের প্লেট হাতে তুলে নিলো ইরা।তারপর প্লেট নিয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেলো।ইশতিয়াকের মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। এই মেয়েকে এতো রকম বুঝানোর পরেও সে ওনাদের কথা শুনছে?
রাগে ইশতিয়াকের ইচ্ছে করলো নিজের কপাল নিনে ফাটিয়ে ফেলে।কিছুদুর গিয়ে ইরা ফিরে এলো।শায়লার সামনে থেকে খাবার প্লেট নিয়ে বললো, “আপনি ও আসুন তাহলে আন্টি।”
শায়লা হতভম্ব হয়ে যায়।

ইরা গলায় মধু ঢেলে বললো, “আন্টি,আমি ইশতিয়াক শেখের বউ হয়ে ও যদি এই পরিবারের বাহিরের মানুষ হই,তাহলে হিসেব মতো হাসিবুল শেখের বউ হয়ে আপনি ও এই পরিবারের বাহিরের।
তো চলুন,আপনি আর আমি এই পরিবারের মর্যাদা রক্ষা করতে রান্নাঘরে গিয়ে বসি।ওখানে খাই।ফ্লোরে বসে।”
ইশতিয়াক হেসে উঠে হাহাহা করে।
শায়লা রেগে স্বামীর দিকে তাকালো। হাসিবুল শেখ কোনো রিয়েক্ট করলেন না।নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলেন।
ইকবাল বাঁকা চোখে মায়ের দিকে তাকায়। মা এই মেয়েকে বোকা ভেবেছে।এই মেয়েটা বোধহয় অতটাও বোকা নয়।বোকা হলে কী আর ইশতিয়াক বিয়ে করতো!
ইকবাল সেসব নিয়ে ভাবছে না।সে ভাবছে কিভাবে একে নিজের বিছানায় আনতে পারবে।হিংস্র পশুর মতো খুবলে খুবলে খাবে ইকবাল এই মেয়েকে।
ইকবাল ভেবে পায় না।এতো সাদা চামড়ার মেয়েকে সে বিছানায় নিয়েছে সেখানে এই সাধারণ বাঙালি চেহারার একটা মেয়ের জন্য ওর ভেতরের পশুটা কেনো ছটফট করছে?
কেনো?

ইশতিয়াক সবার সামনে ইরার বাম হাতের উল্টো পিঠে আলতো চুমু খেয়ে বললো, “শাবাশ মাই ডিয়ার ওয়াইফ!এভাবেই জোঁকের মুখে নুন দিতে হয়।”
শায়লার হাত পা বরফ হয়ে আসে।ইশতিয়াক কী বললো এটা!
শায়লা হাসিবুল শেখের দিকে ঝুঁকে বললো, “এই মেয়েটা কী বলেছে তুমি শুনেছো?”
“আমি কানে স্পষ্ট শুনতে পাই শায়লা।”
“তার মানে সবটা শুনেছো তুমি?”
“আমি কী কালা নাকি?সবই শুনেছি।”
“শুনেও চুপ করে আছো?”
“চুপ থাকবো না তো কী করবো?হেড়ে গলায় গান গাইবো?”
শায়লার চোখ মুখ শুকিয়ে গেলো। ইশতিয়াকের দিকে তাকিয়ে বললো, “পীপিলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।প্রবাদটা মাথায় রেখো।”
“আমার চাইতে তোমার মাথায় রাখাটা বেশি জরুরি।”
শায়লা গটগট করে চলে গেলো।

উপমা সকাল বেলায় আরাম করে ঘুমাচ্ছিলো।সেই মুহুর্তেই রুমার ডাক শুনতে পেলো। ভীষণ বিরক্ত হয়ে উপমা একটা বালিশ দিয়ে কানে চাপা দিলো।
রুমা এসে দরজা ধাক্কাতে শুরু করে দিলো।যেনো প্রবল ভূমিকম্প হচ্ছে এমন শব্দ শুনে উপমার মাথা ধরে গেলো।
উঠে দরজা খুলতেই রুমা বিরক্ত হয়ে বললো, “কিরে,এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে তোর।সেই কখন থেকে ডাকছি তোকে?”
“কেনো ডাকছো আপা?ঘুমাচ্ছিলাম।”
“এখনো কিসের ঘুম?আয়,আয় আমার সাথে।”
“কোথায় যাবো?”
“রান্নাঘরে আসবি।সকালের নাশতা বানাতে হবে তো।”
উপমা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো, “কি করবো?”
“আরে বাবা,নাশতা বানাবি।আয় তো।একটু পাস্তা করবি আর স্যান্ডউইচ। আর আমার জন্য পরোটা।”
“আমি বানাবো?”

“হ্যাঁ। কেনো,বানালে কি তোর জাত যাবে?বোনের বাসায় এলে কি কেউ এসব করে না নাকি?”
উপমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো।
আপা তাকে রান্নাঘরে পাঠাচ্ছে?
প্রচন্ড ক্ষোভে উপমার ইচ্ছে করলো রুমার মাথা ফাটিয়ে দিতে।কিন্তু দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে উপমা নিজেকে সামলায়।আপাতত ওকে শান্ত থাকতে হবে।এখানে ও যদি ঝামেলা করে উপমা তাহলে এই ঠিকানা ও তার হারিয়ে যাবে।
বাধ্য মেয়ের মতো উপমা রান্নাঘরে গেলো।
নাশতা বানাতে বানাতে উপমার ১ ঘন্টার বেশি লেগে গেলো।
পাস্তা মুখে দিয়ে রবিন ওয়াক থু করে বললো, “ছি মা!কি বানিয়েছো!এতো সস দিয়েছো কেনো?”

“কি বলছিস?”
“খাবো না আমি।”
রুমা এক চামচ মুখে দিয়ে দেখলো সত্যি অনেক বেশি সস দিয়ে ফেলেছে। ভীষণ বিরক্ত লাগলো রুমার।উপমা পাশেই বসে পরোটা খাচ্ছিলো।রুমা বাজখাঁই স্বরে বললো, “কি বানিয়েছিস বল তো!এগুলো কোনো মুখে তোলার যোগ্য!”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৩

উপমার মুখটা তিতকুটে লাগতে শুরু করে।
“খাওয়া শেষ হলে বাবুর জন্য আবারও পাস্তাটা করে দিস।ও কী না খেয়ে স্কুলে যাবে নাকি।ওদের আজ একটু তুই নিজে নিয়ে যাস।”
উপমা চুপ করে তাকিয়ে রইলো।ভেতরে ভেতরে রাগ সব দলা পাকাতে শুরু করে।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২৫