প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩
রাজিয়া রহমান

সন্ধ্যা বেলায় সাগর অফিস থেকে ফিরে আসে।এসেই নিজের রুমে যায়।আজকে ফেরার পর দেখা গেলো ভিন্ন চিত্র।সাগর আগে ইরার রুমে এলো।অনেক দিন পরে এই রুমে এলো সাগর। রুমের চারদিকে নজর বুলাতে বুলাতে টের পেলো মা বোনের সাথে অনেক দূরত্ব করে ফেলেছে।
এই যে ইরা রুমে এতো টুকিটাকি জিনিস দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে তা কী সাগর খেয়াল করেছে!
কাগজ দিয়ে এতো কিছু বানানো যায়?
শারমিন তসবি হাতে নিয়ে গুনগুন করে কাঁদছে।
সাগরকে দেখে কান্না বন্ধ করে শারমিন কপাল কুঁচকে বললো, “চোখে কী কম দেখস?ভুল করে এই রুমে ঢুকে গেলি যে?”

সাগর হাসে।
মা’কে কিছু না বলে ইরাকে ডাকে সাগর। ইরা রান্নাঘরে ছিলো। ভাইয়ের ডাকে রুমে আসে।অফিসের ব্যাগ থেকে সাগর একটা কাগজের ব্যাগ বের করে ইরার হাতে দিয়ে চলে যায়। ইরা জানে এতে কী আছে কিন্তু আগ্রহ হয় না খুলে দেখার মতো।
শারমিন আবারও কাঁদছে।
ইরা রান্নাঘরে গেলো সাগরের জন্য চা বানাতে।সাগরকে চা দিয়ে নিজের রুমে আসে ইরা।ভীষণ গরম পড়ছে আজকে।ঘামে ইরার গা কুটকুট করে। এরকম গরম পড়লে ইরার ইচ্ছে করে একটা চৌবাচ্চা পানি ভর্তি করে তাতে গা ডুবিয়ে বসে থাকতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

একদিন অনেক টাকা হলে ইরা একটা বাথটাব লাগাবে।সেই বাথটাবে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে শুয়ে থাকবে।চারদিকে সুগন্ধি ক্যান্ডেল জ্বলবে।মৃদু সুরে মিউজিক চলবে।
ওয়াশরুমে গিয়ে ইরা গায়ে দুই মগ পানি ঢেলে নিলো।তারপর রুমে এসে বারান্দার লাইট দিয়ে একটা বই নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে।ঢাকা শহরে সবকিছু থাকলেও প্রাকৃতিক বাতাসের ভীষণ অভাব।একটার গায়ে লেগে গড়ে উঠে আরেকটা দালান।কেউ এক কণা জমি ছাড় দিতে চায় না।
গায়ে পানি দেওয়ায় কিছুটা শান্তি লাগছে ইরার।উঠে গিয়ে একটা হাতপাখা নিয়ে আসে ইরা।হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতে করতে বইতে মনোযোগ দেয়।
বারান্দায় থাকা ফুলের হালকা সুবাস ভেসে আসে বাতাসে।
ইরা বইয়ের দিকে ইরার পূর্ণ মনোযোগ ছিলো। তার মধ্যেই বারান্দার গ্রিলে একটা ঢিল এসে লাগে।ইরা চমকে উঠে।

ঢিল আসছে কোথা থেকে?
উঠে বাহিরের দিকে তাকাতেই দেখে বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে সকালে দেখা ওই ছেলেটা।
ইরাকে তাকাতে দেখে হাত নেড়ে ইশারা করে রাফি।
ইরা বিরক্ত হয়ে রুমে ঢুকে যায়। অযথা ঝামেলা চায় না ইরা।
শারমিন এখনো কান্না করছে।ইরা মা’য়ের হাত ধরে বললো, “কেঁদে কী হবে মা?দোয়া কর। দোয়ায় কাজ হবে।”
শারমিন কথা বাড়ায় না।তার অন্তরে কতো শোক সেটা কেউ বুঝবে না।
রাফি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে থাকে।কিন্তু ইরা আর বারান্দায় যায় না।শালার ফাটা কপাল।যা একটা মেয়েকে মনে ধরলো সে ও কেমন ইগনোর করে।
এক কাপ চা নিয়ে রাফি আবারও আসে ইরার বারান্দার নিচে।

শহরের বুকে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা একটা অত্যাধুনিক বিল্ডিংয়ের ২২ তলায় অ্যাপার্টমেন্টটা।বাহিরে থেকে তাকালে মনে হয় এই ঘরটা ভর্তি সফলতা, স্বপ্ন দিয়ে। অথচ ভেতরে পুরোটা শুভংকরের ফাঁকি।
ঘরে পা রাখার সঙ্গে সঙ্গেই গা ঘিনঘিন করা ধোঁয়ার গন্ধ,হুইস্কির পুরনো গ্লাস, পোড়া ছাই, বৃষ্টিহীন দুপুরের শুকনো বিষণ্নতা।
চারপাশের আসবাব ডিজাইনার।
সবই আছে, তবু কিছুই সাজানো নয়।

এক পাশে ফেলে রাখা Dior এর শার্ট, বিছানার ধারে অর্ধেক খোলা Versace পারফিউম, আর মার্বেল ফ্লোরে গড়িয়ে থাকা সিগারেটের প্যাকেট সব কিছুই যেন বলে, এখানে কেউ থাকে না, শুধু পড়ে থাকে।
রুমের মাঝখানে একটা বিশাল লম্বা গ্লাস টেবিল। টেবিলের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে নানা ব্র‍্যান্ডের সিগারেট। অ্যাশট্রে উপচে টেবিলে পড়ে আছে ছাই।টেবিলের দুই পাশে লেদারের কালো সোফায় চারজন যুবক বসে নেটফ্লিক্স সিরিজ দেখছে আর কথা বলছে।
রুমের বাতাস ভারী হয়ে আছে সিগারেটের ধোঁয়ায়,এ্যারোমা ক্যান্ডেলের ধোঁয়ায়।
এক কোণে একটা আধুনিক ডিজাইনের মিনিবার,মার্বেল স্ল্যাবে সাজানো নানা রকম মদের বোতল। একেকটা বোতল যেনো একেকটা শিল্পকর্ম।

ইশতিয়াক চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। চোখ বন্ধ,ঠোঁটে সিগারেট।উদ্দেশ্যহীন জীবন নৌকার মাঝি। যার জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই,নেই কোনো স্বপ্ন।
একবার টান দিচ্ছে আর ধোঁয়া ছাড়ছে ছাদের দিকে। পরনে সাদা শার্ট যার অর্ধেক বোতাম খোলা।বন্ধুরা সবাই সিরিজ দেখতে দেখতে নানান রকম কথা বলছে মাতাল হয়ে। সবার হাতেই সোনালি তরল।
তাদের অসংলগ্ন কথাবার্তা, হাসাহাসি, খিস্তি কোনোকিছুই ইশতিয়াকের কানে পৌঁছায় না।সে অন্য জগতে হারিয়ে গেছে যেনো।
টেবিলের পাশে থাকা বিলাসবহুল অ্যাম্বিয়েন্ট লাইট প্রতি দশ সেকেন্ড পর পর রঙ বদলাচ্ছে।ইশতিয়াকের ফোন বাজছে।

রুবেল সেন্টার টেবিল থেকে ফোনটা এনে ইশতিয়াকের দিকে ছুঁড়ে মারে। ঘোরলাগা সুরে বললো, “তোর কল এসেছে ইশু।”
“কে?”
“শায়লা নাম দিয়ে সেভ করা।”
“ডিক্লাইন করে ফোনটা অফ করে দে।”
রুবেল সেটাই করে। তারপর চলে যায়।
ইশতিয়াক হাতের সিগারেট শেষ করে আরেকটা সিগারেট নেয়।চারদিকে সিগারেটের ফিল্টার ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।মাথার ভেতর শায়লা নামটা বাজছে ঘন্টার মতো। এই নামটাকে ইশতিয়াক ঘৃণা করে, প্রচন্ড ঘৃণা করে ইশতিয়াক। এতটা ঘৃণা দুনিয়ায় কেউ কাউকে করতে পারে না। ভেঙে টুকরো হয়ে যাওয়া ইশতিয়াককে এখন জুড়তে চেয়ে কী লাভ!

সে যে ধূলায় মিশে গেছে।
শায়লার হাতে একটা মদের গ্লাস।দুই চোখে হতাশা ঠিকরে পড়ছে।হাসিবুল শেখের দিকে তাকিয়ে বললো, “ধরলো না তো।ফোন সুইচ অফ।তুমি নিজে কল দিলেই বেটার হতো।”
হাসিবুল শেখ গম্ভীর হয়ে বললেন, “তোমার কারণে আমি আমার ছেলেটাকে হারিয়ে ফেললাম শায়লা।”
শায়লা মদের গ্লাসে চুমুক দিয়ে হেসে বললো, “ভুল বললে,আমার জন্য না।তোমার লোভ,তোমার উচ্চাকাঙ্ক্ষার জন্য। আমি যা করেছি তোমার অনুমতি নিয়েই, সেটা নিশ্চয় তুমি ভুলে যাও নি।”
হাসিবুল শেখ কথা বলেন না।মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যান হুইলচেয়ারটা নিয়ে।
শায়লার ভীষণ হাসি পায় হাসিবুল শেখের এই সুশীলতা দেখে।
হাসতে হাসতে শায়লার চোখ ভিজে উঠে। ইশতিয়াক তাকে ঘৃণা করছে?
করুক,ব্যাপার না।

তবুও তিনি তো মা।তার চিন্তা হয় ছেলেকে নিয়ে। এই আধপোড়া জীবন ছেলেটা কতো দিন বয়ে বেড়াবে?ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে।তা না হলে ইশতিয়াক হারিয়ে যাবে কোনো অতলে।খুব দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। ইখতিয়ারের বিয়ের পরপরই ইশতিয়াকেও বিয়ে করাতে হবে।
ছন্নছাড়া জীবনে দায়িত্ব কাঁধে আসলে একটু হলেও লাইনে আসবে।
শায়লা লিনাকে কল করে।
লিনা সবেমাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছে। মা’য়ের কল পেয়ে বিরক্ত হয় লিনা।
রিসিভ করতেই শীতল কণ্ঠে শায়লা জিজ্ঞেস করলো, “খুঁজে পেয়েছো কাউকে?”
“হ্যাঁ।”
“গুড।ইখতিয়ারের বিয়ের পর পরই ইশতিয়াকের বিয়ে দিয়ে দিতে হবে যেভাবেই হোক।গলায় দড়ি পরাতে না পারলে সব কিছু শেষ করে ফেলবে ও।”

বাসায় এসেই ধপ করে সোফায় বসে পড়ে রাফি।ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারোটা বাজে।
রিপা এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে রাফিকে বললো, “কী হয়েছে ভাইয়া?এরকম চিন্তিত লাগছে কেনো তোকে?”
“না কিছু না।তুই কি করছিস?পড়া শেষ হয় নি?”
“আমার একজন ফিমেল টিউটর দরকার ভাইয়া,আম্মু বলছে তোকে বলতে টিচার খোঁজার কথা।”
“আমি কী মহিলা না-কি যে আমি ফিমেল টিচার খুঁজে পাবো?আম্মুর আর….”
রাফি থেমে যায়।
“কি হলো?”
রাফির ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠে।

জোর গলায় মা’কে ডাকে রাফি।হাবিবা বেগম শুয়ে পড়েছেন।রাফির ডাক শুনে বিরক্ত হলেন।সারাদিন টোটো করে ঘুরে বেড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ করে না। বাপের ঘাড়ে চেপে বসে খেতে বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ হয় না।
বাপ ছেলের এই নিয়ে খিটিমিটি সারাক্ষণ। মাঝখানে হাবিবার হয়েছে সব যন্ত্রণা।
রাফির বাবা হাবিবাকেই দোষারোপ করে ছেলের এমন বেয়াড়াপনার জন্য।
ওদিকে হাবিনা রাফিকে কিছু বললে সে কানে ও তোলে না।
মা’য়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে রাফি মা’য়ের রুমে যায় হাবিবা রাফিকে দেখে বিরক্ত হয়ে বলেন, “মাঝরাতে এমন ষাঁড়ের মতো চেঁচামেচি করছিস কেনো?”

“রিপার জন্য নাকি টিউটর লাগবে,সে নিয়ে কথা বলতে আসছি।”
“সারাদিন অনেক রাজকার্য করেছো তাই এখন মাঝরাতে এসেছো কথা বলতে? বুড়ো দামড়া ছেলে সারাক্ষণ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় আর বাপের রক্ত চুষে খায়।আর কতো এমন করে ঘুরবি?
না করেছিস পড়াশোনা আর না করছিস কোনো কাজ।”
“উফ মা! তোমার ভাঙা রেডিও বন্ধ করো তো।সারাদিন একই বকর বকর।শোনা পাশের বিল্ডিংয়ের দোতলায় একটা মেয়ে আছে।ইরা নামের।ভার্সিটিতে পড়ে। তুমি সকালে গিয়ে কথা বলে দেখো রিপাকে পড়াতে পারবে কি-না। তাহলে আর বেশি ঝামেলা হবে না।”

“তা ছাড়া আর উপায় কী?মানুষের মেয়েরা ভার্সিটিতে পড়ে আর আমার ছেলে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করতে পারে নাই।”
রাফি বিড়বিড় করে বললো, “তোমার বউমা দেখবে মাস্টার্স পাশ হবে।”
“মানুষের ঠেকা পড়ছে মূর্খ ছেলের কাছে শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে দিতে।”
“দেখা যাক মা।”

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ২

রাফির গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রুমে চলে গেলো। কেমন ঈদ ঈদ লাগছে রাফির।ইরাকে দেখার তো একটা সুযোগ পাবে।দেখা হতে হতে তারপর আস্তে আস্তে কথা হবেই।
বিছানায় শুয়ে রাফি ইরাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করে।

প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৪