প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৪
রাজিয়া রহমান
প্রতি দিনের মতো ইরার সকাল শুরু হলো ব্যস্ততা দিয়ে।আজ শুক্রবার। সাগর বাসায় আছে আজকে।উপমা গতকাল রান্নাঘরে এলেও আজকে আর এলো না।উপরন্তু গতরাতে উপমার ভাই সাগরকে কল দিয়ে শাসিয়েছে। বলেছে তার বোনের সাথে ঝামেলা করলে সাগরদের পুরো পরিবারকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াবে।
ইরা দ্রুত নাশতা বানায়।আজকে যদিও তার ক্লাস নেই তবে অনেক কাজ জমে আছে। সাগরের ময়লা কাপড়, উপমার কাপড়, শারমিনের কাপড় সব ধোয়া লাগবে।
উপমার জন্য সিদ্ধ ডিমের খোসা ছিলে ইরা হালকা লবণ আর গোলমরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেয়।
মনে মনে সময় হিসেব করে ইরা।
এখনো প্রায় ৫ মাস লাগবে।
ইরা আনন্দিত হতে চেয়েও হয় না।বিপদ আসতে সময় লাগে না।
টেবিলে নাশতা সাজিয়ে ইরা সবাইকে ডাক দেয়।উপমা এসে খাওয়া শুরু করে। সাগর আসে আরেকটু পরে।
শারমিনের মেজাজ খারাপ হয়ে উঠে। উপমা প্রতিদিনই ডিম খায়।
এতো নাটক করার কী আছে?পেটে বাচ্চা কি আর কারো আসে নাই?
ইরা রুমে যেতেই শারমিন বললো, “উপমার জন্য ডিম সিদ্ধ করার সময় তোর জন্য ও ডিম সিদ্ধ করবি।তুই ও খাবি।একলা ও কেনো সব খাইবো?আমরা কী বানের জলে ভেসে আসছি?সাগরের আনা সবকিছুর উপর তোর আমার ও অধিকার আছে।”
ইরা নরম সুরে বললো, “তোমাকে করে দিবো?তুমি খাবে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“তুই জানস না আমি ডিম খাই না।”
“তাহলে এতো কথার তো দরকার নাই মা।ভাবীর শরীরে এখন পুষ্টি দরকার। আমার দরকার না।কেনো এসব নিয়ে ভাগাভাগি করো মা?”
“ভাগাভাগি কিসের?দুনিয়ায় কী ও একলাই বাচ্চা জন্ম দিবো?যারা বস্তিতে থাকে তারা কি খায়?তাদের পোলাপান হয় না।তাহলে ওর এতো নাটক কিসের?”
“মা,তোমার চিন্তা ভাবনা পরিবর্তন কর।আমাদের ঘরে নতুন অতিথি আসবে।কোথায় তার জন্য তুমি অপেক্ষা করবে উৎফুল্ল হয়ে তা না করে তুমি ভাবীর খাওয়া নিয়ে পড়ে আছো?তুমি জানো তোমার মনটা অনেক ছোট যে!
তা না হলে জেনে-বুঝে তুমি কিভাবে এসব কথা বলতে পারো?তুমি কী সবকিছু ভুলে গেছো?গতকাল না তুমি কান্না করছিলে?”
শারমিন জবাব দেওয়ার আগে কলিং বেলের শব্দ শোনা যায়। শারমিন ভাবে লিনা এসেছে তাই ছুটে গিয়ে দরজা খোলে।দরজা খুলে দেখে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে।
শারমিনকে সালাম দেয় হাবিবা।
শারমিন সালামের উত্তর হাবিবাকে ভেতরে আসতে বলে। সোফায় বসে হাবিবা বলে, “আপা,আমার একটা মেয়ে আছে ক্লাস এইটে পড়ে। ওর একজন টিউটর দরকার। আপনার মেয়ে তো শুনেছি ভার্সিটিতে পড়ে। ওর কী একটু সময় হবে?”
“আমি ইরাকে ডাকছি আপা,আপনি ওর সাথে কথা বলে নেন।”
ইরা নিজের রুমের বিছানার চাদর,বালিশের কাভার খুলে নিচ্ছে পরিষ্কার করার জন্য। শারমিনের আওয়াজ পেয়ে বের হলো।
অচেনা একজন মহিলাকে দেখে সালাম দিলো ইরা।
হাবিবা ইরাকে দেখে একটু থতমত খায়।মেয়েটা তো ভীষণ সুন্দরী।রাফি এই মেয়েকে কিভাবে চেনে?
এই মেয়ের সাথে রাফির কী কোনো চক্কর চলছে?কিন্তু রিপার জন্য টিচার ও লাগবে।
বেশি না ভেবে হাবিবা ইরাকে বললো আবারও পড়ানোর কথা।
ইরা জিজ্ঞেস করলো, “ও ফ্রি থাকে কখন?”
“ও তো স্কুল থেকে ফিরে ৪.৩০ এ।তারপর ধরো বিকেল ৫টা বাজে ওর ফ্রি হতে খাওয়া দাওয়া করে।”
“আচ্ছা আন্টি,আমি তো দিনে পারবো না আমার ও ক্লাস থাকে।আমি সন্ধ্যায় যাবো।৭টা থেকে।”
হাবিবা বললো, “তোমাকে প্রতিমাসে সম্মানী কতো দিতে হবে?”
এই ব্যাপারটা নিয়ে ইরা সরাসরি কথা বলতে লজ্জা পায়।নিজ মুখে কিভাবে বলবে টাকার অ্যামাউন্ট!”
ইরা জবাব দেওয়ার আগে শারমিন দ্রুত বললো, “এসব ইরা বুঝবে না আপা।আমার সাথে কথা বলুন এটা নিয়ে।আপনার মেয়েকে কয় বিষয় পড়াতে হবে?”
শারমিনের কথা শুনে ইরা,হাবিবা দু-জনেই অবাক হলো।ইরার লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। মা এমন এমন কাজ করে বসে!
টাকার গন্ধ পেলে মাথা ঠিক রাখতে পারে না।
হাবিবা বললো, “২ বিষয় পড়াতে হবে।অংক আর ইংরেজি। আর অন্যান্য বিষয়গুলো যদি সময় পায় কোনো সমস্যা হলে একটু দেখিয়ে দিবে মাঝেমাঝে।”
“জি বুঝছি।আপনি এক কাজ করবেন।২৫০০ করে ২ বিষয়ের জন্য ৫০০০ টাকা দিয়েন।”
“৫০০০ টাকা বেশি হয়ে যায় আপা।”
“কি যে বলেন! বেশি কোথায়! এটা কী বাজারের মাছের বাজার যে দর কষাকষি করছেন?ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার জন্য দুই হাত খুলে খরচ করতে হয়।আমার কতো লাখ লাখ টাকা খরচ হয় আপা জানেন!
কি করবো!তবুও পড়াতে হবে। মেয়েরে তো অশিক্ষিত করে ঘরে বসিয়ে রাখতে পারবো না।”
ইরার ইচ্ছে করলো মা’কে জিজ্ঞেস করতে, সেই লাখ লাখ টাকা কোথায় খরচ করছে!
ইরা নিযেই তো টিউশনি করায় অনেক আগে থেকে।উল্টো মায়ের হাতে কিছু কিছু দেয় ইরা।নিজের সব খরচ ইরা নিজেই চালায়।
কি দরকার এসব মিথ্যা কথা বলার!
আর এতো টাকা চাওয়ার ও তো দরকার ছিলো না। অন্য টিউশনিতে ইরা ৩০০০ টাকা সম্মানী পায়।
সেটা মা জানে ও।
হাবিবা আর কথা বাড়ালো না।৫০০০ হাজারেই সম্মত হলো।মেয়ে টিচার পাওয়া কঠিন তাছাড়া বাসায় গিয়ে পড়াবে রাত করে এমন সবসময় পাওয়া যায় না টাকা একটু বেশি গেলেও উপায় নেই। ছেলেটার তো লেখাপড়া হলো না মেয়ের যদি হয় একটু!
কথা ঠিক হলো আজকে সন্ধ্যা থেকে ইরা যাবে।
হাবিবা তাদের বাসা দেখিয়ে দিলো ইরাকে।পাশের বিল্ডিংয়ের ফোর বি তাদের।
হাবিবা চলে যেতেই ইরা কাজে লেগে যায়।একটা মোড়া নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে।তারপর কাপড় ধোয়া শুরু করে। শারমিন কিছুক্ষণ পর গিয়ে বলে, “তুই তো ৩০০০ টাকাই নিতি তুই কথা বললে।বাড়তি ২০০০ হাজার আমাকে দিস।আমার পেটের পোলা তো হইছে একটা জানোয়ার। কখনো মা’য়ের হাতে ২০টাকা ও দিতে ইচ্ছে করে না ওর।একটা নাগিনী আনছি দেখেশুনে, ওই নাগিনীর পেট ভরায়।”
ইরার কেমন গা গুলিয়ে উঠে মা’য়ের এসব ভাষা শুনে। দিনদিন মা কেমন যেনো হয়ে যাচ্ছে!
দুপুরের রান্না ও ইরা করলো।মাছের ঝোল আর কুমড়ো ভাজি সাথে পেঁয়াজ, শুকনো মরিচের ভর্তা।
খেতে বসে উপমা বিরক্ত হয়ে বললো, “কি রান্না করেছো এসব?মুখে দেওয়া যায় না।এতো জঘন্য!”
শারমিন ফোঁস ফোঁস করে বললো, “তোমার ভালা না লাগলে নিজে রানতা।তা তো করো না।দরজায় খিল দিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকো।আমার মেয়েরে দিয়ে কাজ করাই আবার কথা ও শোনাও।”
উপমা সাগরের দিকে তাকায়। সাগরের মনে হচ্ছে গলায় ফাঁসের মতো চেপে বসেছে উপমা।পান থেকে চুন খসলেই ওর ভাইয়ের কাছে খবর চলে যায়।
এখন সে চাইলেও বোনের হয়ে কথা বলতে পারবে না।
তাছাড়া মা-ও ভীষণ ঝগড়াঝাটি করার মুড নিয়ে থাকে সারাক্ষণ।
ইরা বিরক্ত হয় না। উপমার দোষ ও বলে না। ওর শরীরের অবস্থা এখন এমন যেহেতু সেহেতু ওর কাছে খাবার সবসময় ভালো লাগবে না।
ইরা চুপচাপ খেয়ে নিলো। উপমা পেঁয়াজ মরিচের ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে নেয়।
বিকেলে ইরা বসে সাগরের শার্ট প্যান্ট আয়রন করছে সেই মুহূর্তে দেখলো উপমা আর সাগর বের হচ্ছে। উপমার ঘরে ভালো লাগছে না।সাগর জানে এখন আবার একটা অশান্তি হবে।পুরুষ হিসেবে সে যে ব্যর্থ তা সাগর বুঝতে পারছে।
সাগরের ধারণা সত্যি করে দিয়ে শারমিন জিজ্ঞেস করলো, “কোথায় যাচ্ছিস?”
সাগর উত্তর দেওয়ার আগে উপমা বললো, “ঘুরতে যাচ্ছি একটু।কেনো আপনার কোনো সমস্যা?”
“ছেলেটা সারা সপ্তাহ অফিস করে,শুক্রবার একটা ছুটি পায় বাসায় থাকবো,বিশ্রাম করবো।তাও তোমার সহ্য হয় না?এই পেট নিয়ে তোমার ঘুরতে যাইতে হইবো?আল্লাহ খোদার ভয় নাই?লাজ লইজ্জা নাই তোমার?”
“না আমার নাই,আপনার থাকলেই হবে আম্মা।জামাইয়ের সাথে ঘুরতে যেতে কিসের লজ্জা?সারাদিন ঘরে থেকে আমার ভালো লাগে না আমি তাই যাচ্ছি।”
প্রিয় ইরাবতী পর্ব ৩
শারমিনের রাগ হয় ভীষণ। ইরা নিজের কানে ইয়ারফোন গুঁজে নেয়।এসব ঝামেলা ইরার আর ভালো লাগে না।আল্লাহ আল্লাহ করে সামনের মাসে হোস্টেলে বা মেসে উঠে গেলেই শান্তি।যত দিন যায় মা ও যেমন ঝগড়াঝাটি করে ভাবীও তেমন। কেউই কারো থেকে কম যায় না।
শারমিন সাগরকে বললো, “সারাদিন তো ঘরে আমি ও বসে থাকি,আমার ও ভালো লাগে না। একটু দাঁড়া আমি ও তৈরি হয়ে আসি।আমাকে ও নে তোদের সাথে ঘুরতে।”
উপমা হতভম্ব হয়ে যায়। সাগর নির্লিপ্ত থাকে। কোনো রিয়েকশনই আসে না সাগরের।
কানে ইয়ারফোন দেওয়ায় ইরা ও কিছু শুনতে পায় না।