প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪২

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪২
তানিশা সুলতানা

মিষ্টির আবদার মেটাতে তাকে কবর দেওয়া হয় চৌধুরী বাড়ির গেইটের পাশে। তার খানিকটা দূরেই রয়েছে বিশাল মসজিদ। ইসমাইল চৌধুরী অবশ্য আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে জোর দিতে পারে নি।
কবর দিয়ে সকলেই বাড়ি ফিরে গেলেও রয়ে গিয়েছে পূর্ণতা। হাঁটু মুরে বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মিষ্টির কবরের পানে। চোখ তার পানি নেই। হয়ত শুকিয়ে গিয়েছে। শরীর ক্ষত এখনো জখম রয়েছে। আঁচল সরলেই বেরিয়ে আসবে কামড়ের দাগ।

বুক ফেঁটে আসছে পূর্ণতার। বারবার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে
“মিষ্টি তুমি ছাড়া ওই পাপের রাজ্যে একা বসবাস করবো কি করে আমি? কে আমায় সাহায্য করবে? কার কাছে মনের কথা বলবো? কিভাবে থাকবো আমি?
পূর্ণতার থেকে খানিকটা দূরে ইফতিয়ার দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি পূর্ণতার পানে।
মিষ্টির বলা একটা কথা মনে পড়ে যায় ইফতিয়ারের।
“ইরিন আপু আকাশ ভাইয়াকে পেলো না।
মিষ্টি ইফতিয়ারকে পেলো না
ইফতিয়ার পূর্ণতাকে পেলো না
পূর্ণতা অভিরাজকে পাবে না।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

আমাদের কি ভাগ্য বলুন চৌধুরী সাহেব। আমরা যেনো এক না-পাওয়ার আন্দোলনে মুখিয়ে আছি। পাল্লা ধরেছি কষ্টে সাগরে ডোবার। আমাদের কষ্টের সমাপ্তি কোথায়?
কোথায় গেলো পাবো সুখের হদিস?
আঁখিভর্তি পানি থাকলেও মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে ওঠে ইফতিয়ারের ঠোঁটের কোণায়।
” দেহ হতে প্রাণ বেরিয়ে গেলেই সুখের রাজ্যের দেখা মিলবে”
একই ভঙ্গিমায় আবার বিরবির করে বলে

” আমার জন্য অপেক্ষা কেনো করলে না পূর্ণতা? একটু অপেক্ষা করলে আমাদেরও সুখের কোনো কমতি থাকতো না৷ মিষ্টিকে আমি চিনতাম না। জড়াতাম না মিথ্যে সম্পর্কে। দ্বিতীয় বার মন ভাঙতো না আমার।
আমার সব আঘাতের মূলে তুমিই কেনো রয়েছে পূর্ণতা?
আসমানের পানে তাকায় ইফতিয়ার। বুক চিঁড়ে দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে।
পূর্ণতা ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় ইফতিয়ারের পানে। উদাস গলায় শুধায়
“আমার এমপি সাহেব কেনো এলো না ইফতিয়ার?

বোনের মৃত্যুও তার মন গলাতে পারলো না? এমন তো ছিলেন না তিনি। এতোটা পাষাণ কি করে হয়ে গেলো?
ইফতিয়ার দু পা এগিয়ে এসে পূর্ণতার মুখোমুখি দাঁড়ায়। অভিমান দেখতে পায় পূর্ণতার চোখে। চিন্তিত বোধহয়?
আবার মনের মধ্যে ভয়ও জেঁকে বসেছে। স্ত্রীরা বোধহয় এমনই হয়? স্বামীর অনুপস্থিতিতে এভাবেই ভেঙে পড়ে?
মিষ্টির সাথে তার বিয়ে হলে মিষ্টিও এভাবে ভেঙে পড়তো?
অবশ্যই পড়তো। পাগলী ছিলো কি না একটা।

” কথা দিচ্ছি পূর্ণতা। তোমার এমপি সাহেবকে তোমার কাছে এনে দিবো আমি। একটু সময় দাও।
“আপনি এনে দিবেন? সে কি আসতে পারে না? তার কি বুক কাঁপছে না?
” হয়ত কোথাও আটকে গিয়েছে। জরুরি কাজ পড়েছে নিশ্চয়। অভি তোমায় ভীষণ ভালোবাসে। তোমাকে ছাড়া থাকতে তার কষ্ট হচ্ছে পূর্ণতা।
পূর্ণতা জবাব দেয় না। ইফতিয়ারের কথা কি তার ভালো লাগলো না?
এবার তাড়া দিয়ে ইফতিয়ার বলে ওঠে
“এবার তুমি বাড়ি যাও। সবাই চিন্তা করবে তোমার জন্য।

মাথা নারিয়ে পূর্ণতা বাড়ির পথে পা বাড়ায়। মনে মনে ভাবতে থাকে আসলেই কি কেউ তার জন্য চিন্তা করবে? চিন্তা করার মানুষ আছে? নেই তো। দুজন ছিলো। একজন শুয়ে আছে সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে। আর একজন চলে গিয়েছে অজানা ঠিকানায়। যেই ঠিকানা পূর্ণতা জানে না। জানলে দৌড়ে চলে যেতো। কারো বারণ শুনতো না।
আর একবার আসুক এমপি সাহেব। দুই হাতে শক্ত করে জাপ্টে জড়িয়ে রাখবো তাকে। একদম ছাড়বো না। কোথাও যেতে দিবো না। ধমক দিলেও শুনবে না পূর্ণতা। একদম শুনবে না।

ইফতিয়ার পূর্ণতার পিছু পিছু হাঁটে। তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে তবেই ইফতিয়ার নিজ বাড়িতে প্রবেশ করবে।
” আল্লাহ অভি কোথায় আছে? তাকে ফিরিয়ে দিন। পূর্ণতার তাকে ভীষণ দরকার। আমাকে সন্ধান দিন আল্লাহ।
পূর্ণতার জন্য বরাদ্দকৃত কষ্ট গুলো আমায় দিয়ে আমার ভাগ্যের সুখ টুকু পূর্ণতাকে দিন।
একবার অভি ফিরুক। আমি তাকে বোঝাবো। চলে যেতে বলবো পাপের রাজ্য ছেড়ে। সুখের রাজ্যে বাসা বানিয়ে দিবো ওদের আমি।

জমিদার বাড়ির উঠোনে এখনো ভিড় জমে আছে। কিছুক্ষণ আগে কান্নায় মুখরিত বাড়ি থেকে এখন ভেসে আসছে চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ। মনোয়ারের গলার স্বর শোনা যাচ্ছে।
পূর্ণতা অবাক হয়৷ এই বাবা একটু আগেই মেয়ের জন্য আহাজারি করছিলো। আর এখন মেজাজ দেখাচ্ছে?
ভিড় ঠেলে এগিয়ে যায় পূর্ণতা। দেখতে পায় কমলা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কমলার স্বামী জামাল মনোয়ারের পা ধরে কান্নাকাটি করছে। কানঘুষায় পূর্ণতা গোটা বিষয়টি বুঝতে পারে।
কমলা মনোয়ারের কক্ষ হতে মোটা অঙ্কের টাকা চুরি করেছেন। এবং মনোয়ারের সাথে অন্তরঙ্গ হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।

তাই শাস্তি সরূপ কমলা এবং তার স্বামী জামিলকে কাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। জমিদার বাড়ির আশেপাশে তাদের আসা বারণ।
পূর্ণতার হাসি পায়।
এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায় মনোয়ারের মুখোমুখি। মনোয়ারের ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছে শিউলি। মুখে তার তৃপ্তির হাসি। যেনো উদ্দেশ্যে সফল হলো। মমতা বেগমকেও দেখা যাচ্ছে।
তবে দেখা যাচ্ছে না জমিদার সাহেবকে এবং ইফাদকে। পাপিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ পাপি এই দুজন। অথচ তারা ভালোবাসতে জানে।
পূর্ণতাকে এগোতে দেখে মমতা খেঁকিয়ে বলে ওঠে

“এই মেয়ে তুমি এখানে আইছো কেন?
” প্রমাণ দিতে এসেছি দাদি শাশুড়ী। ছেলেদের তো বানিয়েছেন নিকৃষ্ট পশু। ভেবেছিলাম বড় ছেলেটার মধ্যে একটু হলেও মনুষ্যত্ব আছে। কিন্তু আজকে বুঝতে পারলাম। ভুল ভেবেছিলাম৷
মনোয়ার চোয়াল শক্ত করে ফেলে। শিউলি গর্জে উঠে বলে
“পূর্ণতা ঠিক করে কথা বলো।
” ঠিক আছে। ঠিক করে কথা বলছি।

আমার এমপি সাহেব আমার সুরক্ষার জন্য গোটা বাড়িতে সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছিলেন। এই ক্যামেরার মাধ্যমে পূর্বে ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা দেখা যায় টিভির সাহায্যে।
নিজের পরিবারকে তিনি বিশ্বাস করেন না। তারা আমার ক্ষতি করতে পারে ভেবে এই কাজটি করেছিলেন।
ডাকা হোক ইফতিয়ার চৌধুরীকে। দেখানো হোক কমলা সত্যিই চুরি করেছে কি না।
মুখটা শুকিয়ে যায় মনোয়ারে। আগত লোকগুলো কানাঘুষা শুরু করে দেয়। শিউলি কাচুমাচু হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে পূর্ণতা খেলার মোর ঘুরিয়ে দিবে কল্পনাও করে নি তিনি।

মনোয়ার মুখ লুকিয়ে চলে যেতে নেয়। পূর্ণতা ফের বলে ওঠে
“কমলা খালা কোথাও যাবে না। সে এখানেই কাজ করবে। তার অসুবিধা হলে আমরা পুলিশের সাহায্য নিবো।
হাসি ফুটে কমলার অধরে। জামাল স্বস্তি নিঃশ্বাস ফেলে। পাড়ার সকলেই পূর্ণতাকে বাহবা দিতে থাকে। এমপি বউ এনেছে মাশাআল্লাহ। যেমন দেখতে তেমন বুদ্ধি। এমন মেয়ে না হলে পশুর রাজ্যে টিকতে পারতো না।

নিজ কক্ষে খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলো পূর্ণতা। বড্ড একা একা লাগছে। কমলা ইমন ইশান ক্ষণে ক্ষণে এসে দেখে যাচ্ছে পূর্ণতাকে। তবে তাদের পর্যাপ্ত সময় না থাকায় বসে দুদন্ড গল্প করতে পারছে না। তবে ইশান বলেছে সন্ধ্যার পরে চায়ের আড্ডা দেবে।

সবেই বই নিয়ে বারান্দায় বসেছে পূর্ণতা। সেই মুহুর্তেই আবারও হইচই এর শব্দ ভেসে আছে পূর্ণতার কানে। এবার বিরক্ত হয় পূর্ণতা। দুই চারকথা শুনিয়ে দিবে ভেবে বই রেখে এগিয়ে যায় বসার ঘরে।
সেখানে হাসিতামাশা করা হচ্ছে। শিউলি সকলকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছে। মনেই হচ্ছে না কিছুক্ষণ আগেই এই বাড়ির সব থেকে আদরের সদস্যের মৃত্যু হয়েছে৷

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪১

কিছু বলার উদ্দেশ্যে এক পা এগোতেই পূর্ণতার কানে আসে
” অভি আর মনা বিয়ে করেছে। আর গ্রামে ফিরবে না। কালকেই সিঙ্গাপুর পাড়ি জমাবে তারা।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৪৩