প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৪

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৪
তানিশা সুলতানা

বরাবরই ইফতিয়ার চৌধুরী ভীষণ গোছালো এবং পরিপাটি মানুষ। ময়লা কাপড়ে কখনোই তাকে দেখা যায় নি। পায়ের জুতো থেকে মাথার চুল পর্যন্ত সব সময়ই সুন্দর গোছানো থাকে। মানুষজন এমন ইফতিয়ারকে দেখতেই অভ্যস্ত। তবে আজকের ইফতিয়ারকে দেখে রিতিমতো সকলেই অবাক হচ্ছে। এলোমেলো চুল, ময়লা শার্ট, খালি পা, ফোলা ফোলা মুখটা। বাস থেকে নামার সময় জুতো ছিঁড়ে গিয়েছে। ছিঁড়া জুতো ফেলে ঢাকা থেকে নিজ এলাকা পর্যন্ত এসেছে। শেষ বার খেয়েছিলো পূর্ণতার সাথে। সেটাই বোধহয় ছিলো দুজনের এক সাথে শেষবার খাবার খাওয়া। হয়ত কালকের দেখাটাও ছিলো শেষ দেখা। কথাটা যতবার মস্তিষ্কে আসছে ততবারই চোখে পানি চলে আসছে। টকটকে লাল হয়ে গেছে চোখ দুটো। পাঁপড়ি গুলো এখনো ভেজা।

প্রচন্ড কান্না করার ফলে যে এভাবে চোখ মুখ ফুলে উঠেছে বেশ বোঝা যাচ্ছে। মধুপুর গ্রামে ঢুকতেই কয়েকজন অকপটে প্রশ্ন করে ফেলেছে “কি হয়েছে চৌধুরী?”
ইফতিয়ার মৃদু হেসে এড়িয়ে গিয়েছে। কি জবাব দেবে? ভালোবাসা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরলাম? যার জন্য পরিবার ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। এটা বলবে?
চৌধুরী বাড়ি দেখা যাচ্ছে। সেই সাথে দেখা যাচ্ছে পূর্ণতা নামের বিশাল হাসপাতালটি। ইতোমধ্যেই কার্যক্রম শুরু হয়ে গিয়েছে। কিছু ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শতশত অসুস্থ মানুষ ছুটে আসছে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। দুই চার দশ গ্রামে এই একখানাই হাসপাতাল রয়েছে। তাই রোগীর সংখ্যা স্বাভাবিককে চেয়েও বেশি। দূর দূরান্ত থেকে সকলেই ছুঁটে আসছে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইফতিয়ারের অবর্তমানে ইরিনই হাসপাতালের দেখভাল করছে। নিজের মনের মতো সাজাচ্ছে। ডাক্তারদেরও নিজ দায়িত্বে চড়া বেতনে নিয়োগ দিয়েছে।
ইফতিয়ার খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে বড় বড় অক্ষরে “পূর্ণতা” লেখা স্থানে।
চট করে ভেবেও ফেলে। বিশাল বড় একটা গেইট দেবে হাসপাতালের সামনে। সেথায় লিখে দিবে “পূর্ণতা মেডিকেল হাসপাতাল”
ইফতিয়ারের ফের কান্না পায়। আজকে এতো কান্না কেনো পাচ্ছে? আগে তো কান্না পেতো না? এতো কষ্ট হতো না তো। তবে আজকে বুকটা খালি খালি লাগছে কেনো? কেনো মনে হচ্ছে “একমাত্র মৃ ত্যুই এই কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে পারবে?”

একটা মেয়ের জন্য জীবনটা কেমন ছারখার হয়ে গেলো। স্বপ্ন গুলো কেমন প্রাণহীন হয়ে গেলো। বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে উঠলো। শুধুমাত্র একটা মেয়ের জন্য।
কি অদ্ভুত তাই না?
ইফতিয়ার চৌধুরী।
দেশে বিদেশে যার পরিচিতি রয়েছে। কোটি টাকার মালিক সে। ইচ্ছে করলে গোটা মধুপুর শহর কিনে ফেলতে পারবে। পূর্ণতা নামক রমনিটিকে নিয়ে দূর দেশে চলে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। জোর করলেই ছোট্ট দেহখানা নিজের অধিনে নিয়ে ফেলতে পারবে।
অথচ মনটা?

সেটা পাবে। আর সেটাই দরকার ইফতিয়ার চৌধুরী। টাকার দুনিয়ায় টাকা দিয়ে মন কেনো কেনা যায় না? সুখ কেনো কিনতে পাওয়া যায় না?
তাহলে এই টাকার কি দাম রইলো?
লাগবে না টাকা।
পৃথিবীর এমন কোনো শক্তি বা মানুষ যদি ইফতিয়ারকে বলতো “তোমার সমস্ত টাকা আমাকে দিয়ে দাও। তার বিনিময়ে আমি তোমায় পূর্ণতার মন এনে দিবো”
ইফতিয়ার বীণা ভাবনায় দিয়ে দিবে সব। কিন্তু হায়য়য় এমন শক্তি কারোরই নেই একমাত্র আল্লাহ ছাড়া।
ধীরে ধীরে পা ফেলে চৌধুরী বাড়ির ভেতরে ঢোকে ইফতিয়ার। কালো গোলাপ বাগান অযত্নে অবহেলায় নেতিয়ে পড়েছে। ইফতিয়ার বেশ বুঝতে পারে “বাবা কর্মচারীদের ভাগিয়েছে”

তাচ্ছিল্য হাসে ইফতিয়ার। বিরবির করে বলে
“বাবা আমার ইমোশন কেনো বোঝে না? কেনো বোঝে না তর তাজা কালো গোলাপ বাগান দেখলে আমার কলিজা ঠান্ডা হয়ে যায়। মনে হয় ওই ফুল গুলোর মাঝে পূর্ণতা রয়েছে। হেসে খেলে বেড়াচ্ছে।
আমাকে একটু শান্তি কেনো পেতে দিচ্ছে না বাবা? আমি ম রে গেলে তিনিই তো সব থেকে বেশি কষ্ট পাবে।
ইফতিয়ারের নজর পড়ে মিষ্টির কবরের পানে। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কবর। নিশ্চয় ইরিন পরিষ্কার করেছে।
এগিয়ে যায় ইফতিয়ার। হাঁটু মুরে বসে পড়ে মাথার পাশটায়। ডান হাত এগিয়ে মাটি স্পর্শ করে। মনে হয় স্বয়ং মিষ্টিকেই স্পর্শ করলো।

“কতো শান্তিতে ঘুমিয়ে আছো মিষ্টি। কাউকে পাওয়ার আনন্দ নেই। হারানোর ভয়ও নেই। কঠিন দুনিয়ায় কঠিন কঠিন ঝামেলাও তোমায় স্পর্শ করতে পারছে না। খুব শান্তি বলো?
আমি কবে শান্তি পাবো মিষ্টি? কবে নিশ্চিন্তে ঘুমবো? কবে সুখ পাবো?
আমি না যে ডালটা ধরি সেই ডালটাই ভেঙে যায়। আমি যার মাঝেই সুখ খুঁজে পাই আমার আল্লাহ তাকেই আমার থেকে বহু বহু মাইল দূরে নিয়ে যায়।
আমাকে সবাই ছেড়ে যায় কেনো? বলতে পারবে মিষ্টি? আমার আল্লাহ কি আমাকে কখনোই সুখ দেবে না?
তখনই ইফতিয়ার অনুভব করে কিছু লাইন।

“যার লাগিয়া মন বিবাগী
ঘুরছো দেশ বিদেশে
সে তো দূরে কোথাও নেই
আছে তোমার হৃদয় মাঝারে
আগলে রেখো যত্ন করে
একটু বেশিই বেশো ভালো
সে যে বড্ড অভাগী নামটা রেখো আলো”
চিন্তিত ইফতিয়ার কপালে ভাজ ফেলে লাইন গুলো বারংবার আওড়ায় নিজ মনে। কে আসছে? তার নাম রাখার দায়িত্ব ইফতিয়ারকে দেওয়া হলো কি?
“আলো”
ইফতিয়ার চৌধুরীর অন্ধকার জীবনে আলোর রশ্মি নিয়ে আসছে আলো?

চোখ খুলতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিষ্কার করে অভি৷ মাথার ওপরে ঘূর্ণেয়মান সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকে পলকহীন দৃষ্টিতে। পূর্ণতা পাশেই বসে আছে। সাত আট ঘন্টা হবে একই ভাবে বসে আছে। অপেক্ষা করছে প্রাণ প্রিয় মানুষটির চেতনা ফেরার।
জীবন কি অদ্ভুত।
এই তো গতকাল সকালেও ভেবেছিলো ” অভির নিকট পৌঁছে গেলে সমস্ত দুঃচিন্তার অবসান ঘটবে। দুঃখ গুলো দৌড়ে পালিয়ে যাবে।
পূর্ণতা ভুলেই গিয়েছিলো “তার জন্মই হয়েছে দুঃখ পাওয়ার জন্য”
অভির শিওরে মাথা নুয়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে পূর্ণতা। অভি মাথা ঘুরিয়ে এক পলক দেখে নেয় পূর্ণতার মুখখানা। বুকটা কেঁপে ওঠে অভির।

জীবনে তিনটে নারীকে ভালোবেসে অভি। একজনকেও সুখী করতে পারে নি। কাউকেই দুই দিন শান্তির জীবন উপহার দিতে পারে নি।
যাদের জন্য সব করলো তাদের মধ্য থেকে দুজনকে হারিয়ে ফেলেছে।
আহারে কতো স্বপ্ন দেখেছিলো।
মা থাকবে, মিষ্টি থাকবে, পূর্ণতা থাকবে। দিনশেষে ভীষণ সুন্দর একটা পরিবার হবে তাদের। কিন্তু হলো না। যাদের জন্য জীবনের মায়া ত্যাগ করে অর্থের পাহাড় বানালো দিন শেষে অর্থ এবং চিকিৎসার অভাবে তারাই দুনিয়া ছাড়লো। একজন ব্যর্থ সন্তান, ব্যর্থ ভাই এবং ব্যর্থ স্বামী অভিরাজ।
পূর্ণতার যোগ্য নয় সে। মা এবং বোনকে হারিয়েছে। এবার বুঝি পূর্ণতার পালা? আতঙ্কে ওঠে অভি। এক লাফে বসে পড়ে। হাতের ক্যানেলোতে টান পড়ে। রক্ত উঠে যায়। সদ্য দুচোখের পাতায় ঘুম নেমে আসা পূর্ণতা হকচকিয়ে ওঠে। ভয়ার্তক দৃষ্টিতে তাকায় অভির পানে।

অভি পূর্ণতাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে। নিজের বুকের সাথে পূর্ণতার ছোট্ট মাথাটা চেপে ধরে বিরবির করে বলে
“আমি সব ছেড়ে দিবো। আমি ভালো হয়ে যাবো। আমায় ছেড়ে যেয়ো না পূর্ণতা। আমাকে একা করে দিও না। তুমি ছাড়া আমার কেউ রইলো না। আমি সব হারিয়ে ফেলেছি৷ এবার তোমাকে হারাতে পারবো না। আমি ম রে যাবো। পাগল হয়ে যাবো আমি।
আমাকে ছেড়ে যেয়ো না।
পূর্ণতা অভির পিঠে হাত রাখে। কাঁধে ভেজা অনুভব করে। বুঝতে পারে অভি কাঁদছে। আশ্বাস নিয়ে বলে
” আমি আছি এমপি সাহেব। আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না।
পূর্ণতার কথা বোধহয় শুনলো না অভি। ফের অস্থির হয়ে বলতে থাকে
“আমার জান
আমার বউ
আমাকে ছেড়ে যাসস না। আমি ভালো হয়ে যাবো। আর কোনো পাপ কাজে লিপ্ত হবো না। তুমি যা বলবা তাই শুনবো। বাকিটা জীবন তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকবো। তবুও আমায় ছেড়ে যেয়ো না পূর্ণতা। আমার কেউ নেই তুমি ছাড়া।
সেই মুহুর্তেই একজন নার্স ঢুকে পড়ে কেবিনে। অভিকে অস্থির হতে দেখে বলে

” এ কি আপনি উত্তেজিত হচ্ছেন কেনো? শান্ত হন। নাহলে আবারও
বাকিটা বলতে পারে না নার্স। অভি শান্ত স্বরে বলে ওঠে
“আমি ঠিক আছি।
নার্স মৃদু হাসে। অভি পূর্ণতাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে। হাতের কেনেলো নিজেই খুলে ফেলে।
নার্স স্যালাইন খুলতে খুলতে বলে
” আপনার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। তিন মাস চলছে তার। সে খবর জানেন কি আপনি? নিজে এভাবে বারবার অসুস্থ হয়ে পড়লো বউকে কে দেখবে?
অবাক হয় অভি। এতো এতো খারাপ খবরের মধ্যে এটাই বুঝি ছিলো ভালো খবর। পূর্ণতা মাথা নুয়িয়ে ফেলে। কিন্তু এই ভালো খবরটা অভির মুখে হাসি ফুটাতে পারে না। বরং ভয় বাড়িয়ে দেয়। আরও একজন আসছে। যে অভিকে ভালোবাসবে।
তার জন্য অভিকে ভালো হতে হবে। খুব ভালো হতে হবে। এতোটাই ভালো হতে হবে যে তার সন্তান গর্ব করে বলবে “আমার বাবা বেস্ট”
সব ছেড়ে দিবে অভি। সব।
পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করবে। কুরআন তেলওয়াত শিখে নিবে।
(ডাইরিতে যে লিখা ছিলো সেটার রহস্য পরবর্তী পর্বে ক্লিয়ার করবো)

যে ব্যক্তি একবার মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে সে ব্যক্তি আর কখনোই পাপ কাজে লিপ্ত হতে পারে না। মৃত্যু যন্ত্রণা ভয়ংকর। এমন ভয়ংকর যন্ত্রণা উপভোগ করা মানুষ পাপকে ভয় পায়”
ইব্রাহিম এর বলা কথা গুলো মন দিয়ে শুনে ইমন। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে। পাপীরা কখনোই পাপ ছাড়তে পারে না। মৃ ত্যুর ভয়ংকর যন্ত্রণাও তাদের ভালো করতে পারবে না৷
জমিদার সাহেব ইতোমধ্যেই দুবার মৃ ত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখেছে।
এই তো কিছু বছর পূর্বে ভয়ংকর সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় জমিদার সাহেব। ডাক্তার ঘোষণা করে দেয় “তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়”

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৩

তবে ভাগ্যের ফেরে বেঁচে ওঠে। এক পা অকেজো হয়ে যায়। হাঁটুর ওপরে পায়ে মধ্যে লড ভরে দেয়। যখন ড্রেসিং করানো হতো গলা কাটা মুরগীর ন্যায় ছটফট করতো জমিদার। আহাজারি করে কাঁদতো সারাক্ষণ। তার আহাজারি দেখে সকলের বুক কেঁপে উঠতো।
সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছিলো এক পাপ কাজ করতে গিয়ে। পঁচিশ জন নারী ভর্তি গাড়ি নিয়ে পালাচ্ছিলো শহর ছেড়ে। পেছনে ছিলো পুলিশের গাড়ি।
ড্রাইভার নিজেদের রক্ষা করে খুবই জোরে ড্রাইভ করছিলো। তখনই গাড়িটি উল্টে পড়ে যায় খাঁদে। ব্যসস সকলেই মা রা গেলেও বেঁচে থাকে একমাত্র জমিদার সাহেব।

প্রিয় পূর্ণতা পর্ব ৫৫