প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৩৪

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৩৪
জান্নাত নুসরাত

ব্যস্ত সকাল ব্যস্ত নগরী। কেউ কারোর দিকে তাকানোর সময় নেই। সবাই নিজ নিজ কাজে যত দ্রুত যাওয়া সম্ভব যাওয়ার চেষ্টা করছে। জায়িন কিছুক্ষণ আগে নিজের অফিসে গিয়েছে। ইসরাত ক্রপ টপ, কার্গো প্যান্ট, উপরে কোট পরে গলায় স্কার্ফ পেচিয়ে জুতো পরে এপার্টমেন্ট থেকে বের হলো। হঠাৎ মনে হলো চাবি আর ব্যাগ ভিতরে রেখে এসেছে। দরজা আটকানোর আগে খুলে আবার ভিতরে গিয়ে ব্যাগ আর চাবি নিয়ে আসলো। ব্যাগ খুলে চেক করলো ইউরো রাখা আছে কিনা? ব্যাগে দুইশত টাকার মতো আছে তা দেখে দৌড়ালো এলিভেটরের দিকে।

এলিভেটর থেকে বের হয়ে দৌড়ে গিয়ে ক্যাবে উঠলো। লকেশন দিয়ে জোরে শ্বাস ফেলল। এতোক্ষণ মনে হচ্ছিল শ্বাস আটকে ছিল। জায়িনের এপার্টমেন্ট শহর থেকে কিছুটা বাহিরে। মেইন টাওনে যেতেই মেইন রোড থেকে আইফেল টাওয়ার দেখা গেল। যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। ইসরাত গাড়ি থেকে বসে যতক্ষণ পর্যন্ত আইফেল টাওয়ার দেখা যায় ততক্ষণ পর্যন্ত আইফেল টাওয়ারের দিকে তাকিয়ে রইলো একমনে।
লকেশনে পৌছে গিয়ে ইসরাত কাঙ্কিত টাকা দিয়ে দিল ড্রাইভারকে। চারিদিকে তাকিয়ে ইসরাত একটা রেস্টুরেন্টের ভিতর ঢুকলো। কাউন্টারে একজন মহিলা বসে আছেন। ইসরাতকে দেখে এগিয়ে আসলেন নিজের জায়গা থেকে।
“হ্যালো ম্যাম! আই এম ইসরাত। আমি আপনার সাথে কথা বলেছিলাম মনে হয়।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

মহিলাটা কিছু মনে করার চেষ্টা করলো। হয়তো মনে হলো! হালকা হেসে তিনি ইসরাতকে জড়িয়ে ধরলেন। ইসরাত ভ্যাবাচেকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো মহিলার দিকে।
” হ্যালো! আমি ক্যামেলিয়া। দুদিন আগে আমার সাথে তোমার কথা হয়েছে। আসো বসে কথা বলি।
ক্যামেলিয়া ইসরাতকে নিয়ে একপাশের সিটে বসলেন। ইসরাত ক্যামেলিয়ার দিকে তাকালো। গলায় খ্রিস্টানদের ক্রুশ পরে আছেন। মহিলা যতেষ্ট মায়াবি ও তার কথা বলার ধরণ অনেক ফ্রেন্ডলি। ইসরাতের চিন্তা ব্যাঘাত ঘটিয়ে ক্যামেলিয়া বলল,”এই রেস্টুরেন্টের ওউনার আমি। হাত তুলে পঁয়ত্রিশ বছরের এক সাদা চামড়ার পুরুষের দিকে ইশারা করে বললেন,আর ওই যে দেখছো উনি আমার স্বামী লিও। আমরা দু-জন মিলে এই রেস্টুরেন্ট চালাই। আজকাল রেস্টুরেন্টে মানুষের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে আগের তোলনায়। আগে আমরা নিজেরা সামলে নিতাম কিন্তু এখন দু-জনে মিলে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। আমাদের সাহায্যের জন্য একজনকে প্রয়োজন তাই আমরা এই বিজ্ঞাপন দিয়েছি। এবং সর্বপ্রথম এই বিষয়ে তুমি আমাদের নক করেছ। এবার বলো তুমি কি এখানে কাজ করতে চাও! আমি তোমাকে কাজে রাখতে চাচ্ছি।

ইসরাত ক্যামেলিয়ার দিকে তাকিয়ে তাকলো। ক্যামেলিয়াকে দেখে নুসরাতের কথা মনে হচ্ছে। একসাথে এতো কথা বলে শুধু মেয়েটা।
ক্যামেলিয়া ইসরাতের হাতে ধাক্কা দিয়ে বলল,
“তুমি কি কাজ করতে রাজি আছো। বেশি কিছু করতে হবে না তোমার শুধু খাবার সার্ভ করতে হবে। আমি মাস শেষে তোমাকে ভালো বেতন দিব। এতে যদি না হয় তাহলে তোমাকে আমি মাস শেষে বোনাস দিব। আমার তোমাকে পছন্দ হয়েছে। যারা চুপচাপ বসে আমার কথা শোনে, আমার কথার মাঝখানে কথা বলে না, তাদের আমি খুব বেশি পছন্দ করি।

” বেতন কত দিবেন?
“বাহ তুমি তো স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড কথা বলো। তুমি আবার আমার পছন্দের লিস্টে যুক্ত হয়ে গিয়েছো। আচ্ছা মূলকথায় আসি, আমি ভাবছিলাম মাস শেষে সাতশত ইউরো দিব কিন্তু এখন তুমি আমার পছন্দের লিস্টে এসে গেছ তাই আমি তোমাকে পনেরোশত ইউরো দিব তোমার পারিশ্রমিক হিসেবে।
ইসরাত ব্যাগ নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাতের ঘড়ি চেক করে দেখল সাড়ে এগারোটা বাজে।
ইসরাত কাঁধে ব্যাগ ঝুলাতে ঝুলাতে গম্ভীর গলায় বলল,
” আশা করি আপনাদের সাথে কাজ করতে এসে আমি খুশি হবো এবং একটি সুন্দর সময় কাটাতে পারবো। আজ তাহলে আসি, দেখা হবে খুব তাড়াতাড়ি।

“কেন? খুব তাড়াতাড়ি কেন? তুমি আগামীকাল থেকে জয়েন করো এখানে। তাহলে আমি খুব খুশি হবো। আগামীকাল চলে এসো আমি অপেক্ষায় থাকবো।
“ঠিক আছে!
ইসরাত গলার স্কার্ফ ঠিক ভাবে পেঁচিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে গেল। ক্যামেলিয়া ইসরাত যেতেই স্বামীর সাথে কথা বলতে গেল আজকে যে মেয়ে এসেছে তার বিষয়ে। মেয়েটাকে তার অনেক পছন্দ হয়েছে। এই মেয়েকে তার রেস্টুরেন্টে কাজে রাখবে।

অন্যদিকে,
বিকাল চারটা গতকাল রাতে ইরহাম ট্রিপ থেকে ফিরে এসেছে। নুসরাত ইরহামকে বলে এসেছে রেডি হওয়ার জন্য তারা কোথাও যাচ্ছে আজ। ইরহাম জিজ্ঞেস করলে ও উত্তর দিল না। বলল গেলে দেখতে পাবি।
নুসরাত পাঁচ মিনিটে লং টপস আর শরীর ঢেকে ওড়না পড়ে রেডি হলো। ইরহামের রুমে দরজায় নক করলো।
” আমার শেষ।
“অপেক্ষা কর আমি ওয়াশরুম হয়ে আসছি।
নুসরাত ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসলো। সোফার উপর পা তুলে বসতেই টপস কিছুটা উপরে উঠে দেখা গেল ব্যগ্গি প্যান্ট।
ইরহাম আরো পাঁচ মিনিট পর নিচে আসলো। নুসরাত ঝটপট উঠে দাঁড়ালো। বাড়ি থেকে বের হয়ে মেইন রোডে গিয়ে উঠলো দু-জ। সিএনজি থামিয়ে নুসরাত জিজ্ঞেস করলো,” মামা মিরাবাজার যাবেন ? রিজার্ভ করে নিব।

“অয় যাইমু! ইলা অইলে বেশি টেখা দিতে অইবো।
” আচ্ছা যতো চান দিয়ে দিব। তাড়াতাড়ি চলেন।
ইরহাম সিএনজি তে উঠে বসলো। নুসরাতের সাথে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে বসলো সিএনজিতে ইরহাম।
“মিরাবাজার কেন যাবি? ওখানে আব্বু, মেজ বাবা আছে।
“একটা প্রয়োজনে যাচ্ছি। আর চাচ্চু আর আব্বা থাকলে কি হবে? আমরা তো কোন ক্রাইম করতে যাচ্ছি না। আমরা গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছি।
” কিসের গোয়েন্দাগিরি?
“আজকাল ব্যবসা কেমন চলছে তার খোঁজ নিতে।
” তুই অফিসে যাবি।
নুসরাত নির্লিপ্ত হয়ে বলল,
“হু!

ইরহাম চোখ বড় বড় করে নুসরাতের দিকে তাকালো। নুসরাত স্বাভাবিক বসে আছে তার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। নুসরাতের মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে এটা তেমন বড় কোনো বিষয় নয়। ইরহাম প্যানিক করে বলল,” তুই ভুলে গিয়েছিস দুই বছর আগের কথা।
“আরে ব্রো চিল! আর দু-বছর আগের কথা এতো তাড়াতাড়ি ভুলে যাব এতো খারাপ ব্রেইন আমার না। সবকিছু চোখের পাতায় ভেসে আছে।
” কিসের চিল করবো? আমি মরছি আমার জ্বালায় আর তুই চিল মারাচ্ছিস। আমাকে আর তোকে গার্ড অফিসের গেট থেকে পিটিয়ে ফিরিয়ে দিবে। আব্বু কি বলেছিল দারোয়ান কে আমাদের অফিসের ব্লিডিং থেকে দু-হাত দূরে দেখলেই সোজা লাঠি দিয়ে পেটাতে।
“ও আমাদের চিনলে না আটকাবে আর পিটাবে।
” মানে!
“ওখানে গেলে বুঝতে পারবি এখন চুপ করে বস।
চিল কর!

ইরহাম চিন্তায় চিল করতেই পারলো না। তার বাপ থাকে অফিসের আশেপাশে দেখলে আজ আর আস্তো রাখবে না। এই মেয়ের জন্য থাকে কি কি দূর্ভোগ পোহাতে হবে এক আল্লাহ ভালো জানে? নুসরাতের দিকে করুন মুখে তাকালো ইরহাম। নুসরাত পাত্তা না দিয়ে ভাঙা গলায় গান ধরলো,
“তোমার কুন কুন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী ললিতা? তোর কুন কুন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী ললিতা
নীরব হইয়া কাঁদিস বইয়া
ঝুলাইয়া মাথা গো, বান্ধবী ললিতা
তোর কোন কোন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী ললিতা
তোর কোন কোন জায়গায় ব্যাথা গো বান্ধবী ললিতা ?
ইরহাম মুখের বিকৃতি করে বলল,

“আল্লাহর ওয়াস্তে কিছুটা সম্মান দেয় আমায়। আমি তোর থেকে তেরো দিনে বড়। একটু সম্মান দিয়ে এই গানটা বন্ধ করলে আমি উপকৃত হতাম। বড় ভাইয়ের সামনে কী সব গান গাচ্ছিস লজ্জা সরম সব বেঁচে খেয়ে ফেলেছিস।
নুসরাত এক হাত দিয়ে ইরহামের গলা পেঁচিয়ে ধরে বলল,
” হ লজ্জা সরম বেঁচে দিয়ে তোদের না চিপস্, চকলেট, আইস্ক্রিম খাওয়ালাম না। তাহলে থাকবে কোথায় থেকে? আর তুই কিসের বড় ভাই তুই তো আমার বান্ধবী ললিতা। এখন মুখ বন্ধ কর আর আমার গান শোন।
ইরহাম দুই হাত নুসরাতের সামনে ধরে বলল,
“প্লিজ বইন মাফ দে আমায়, আমি শুনতে চাইতেছি না।
” আরে একটু শোন!

“প্লিজ বোন গানের বিনাশ টা এইভাবে করিস না সাথে আমার কানের ও বিনাশ করিস না। তোর ভাঙা রেডিও এর গান আমি শোনতে ইচ্ছুক না।
” আরে একটু শোন, বেশি শোনাবো না।
ইরহাম কান দু-হাত দিয়ে চেপে ধরলো। মাথা দু-দিকে নাড়িয়ে বলল সে শোনবে না। নুসরাত দুই-হাত দিয়ে ইরহামের কান থেকে হাত নামিয়ে গান ধরলো,”অহনা তুমি কেন বুঝোনা। দু-চোখের আন্ধারে ঘুম আসে না আমার। এর পরে আর পারি না।আমি তোমায় গান শোনাতে চাইছি? তুমি কেন শোনতে চাইতেছ না?
ইরহাম থতমত খেয়ে গেল। নুসরাতের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “হয়নি তো গান।
” নাহলে ও হবে কারণ এই গানটা আমি গাইছি। এই গান রাইটিং এন্ড লিরিক্স বায় মি।

ইরহাম নুসরাতের দিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেলল। নুসরাত সি-এন-জি থেকে নেমে ইরহামকে ও নামার জন্য বলল। ভাড়া মিটিয়ে প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ান টাইম মাস্ক বের করে ইরহামের কাছে দিল। ইরহাম মাস্ক মুখে লাগিয়ে অফিসের ব্লিডিং এর দিকে তাকালো। ঝড়ঝড় করে দু-বছর আগের কথা চোখের সামনে আবার ভেসে উঠলো।
দু-বছর আগে নুসরাতের কিছুটা জোক ছিল ব্যবসার প্রতি তাই নাছির সাহেব নিয়ে এসেছিলেন তাকে আর নুসরাতকে। নাছির সাহেব তিন তলায় তাদের বসিয়ে রেখে তিনি গিয়েছিলেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজে। যাওয়ার আগে না করে গিয়েছিলেন এটা-সেটা না নাড়ানোর জন্য এবং বার বার না করে গিয়েছিলেন প্রথম তলায় না যাওয়ার জন্য। ইরহাম চুপচাপ এক জায়গায় বসে থাকলে ও নুসরাত বসলো না। এটা সেটা হাত দিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে লাগলো। ইরহাম না করলে তাকে ধমকে উঠলো। গোয়ান্দা গিরি শেষে নুসরাতের হঠাৎ মনে হলো নাছির সাহেব নিচ তলায় যেতে না করেছেন কেন? আগে দ্বিতীয় তলা ব্যবহার করা হতো না বন্ধ ছিল।

এখন আরশ আসায় সেটা খুলে দেওয়া হয়েছে। নুসরাতের ভিতর প্রচন্ড কৌতূল হলো। নুসরাতের গোয়েন্দা মাথা গোলমাল আছে বলে জানান দিল। নিচতলার গোলমাল বের করার জন্য ইরহাম কে বলল নিচে যাওয়ার কথা। ইরহাম না করে দিলে ও নুসরাত ইরহামকে জোর করে ধরে নিয়ে গেল প্রথম তলায়। যা ঘটার ঘটল জিনিস পত্র নাড়াচাড়া করতে গিয়ে নুসরাতের মাথায় আসলো একটার ক্যামিকাল অন্যটার সাথে মিশালে কেমন হবে? নতুন কোন জিনিস উৎপাদন হয়ে যাবে। নিজেকে বাহবা দিল নিজের বুদ্ধি দেখে। ভুল ক্যামিকাল একটার সাথে অন্যটা মিশিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে লাগলো। পারফিউম তৈরি করার জন্য রাখা অ্যালকোহল আর ফ্র্যাগ্রান্ট অয়েল দুটো মিশালো। তারপর আর কি? ধপ করে আগুন ধরে গেল।

ইরহাম আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আগুনের দিকে। নুসরাত আগুন ধরাতে পেরে ইরহামের দিকে তাকিয়ে বলল,”দেখ ভাই, আমি আগুন ধরিয়ে দিয়েছি। আমি নতুন ইনভেনশন করে ফেলেছি। আমাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নোবেল টা এনে দে। বলে নুসরাত হাসল। শোহেব দুজনকে খোঁজতে খোঁজতে প্রথম তলায় আসলেন। এসে নুসরাতকে আগুন ধরিয়ে হাসতে দেখতে পেলেন আর ইরহাম এক পাশে দাঁড়িয়ে বোকার মতো নুসরাতের কর্ম কান্ড দেখছিল। একে মেকআপের জিনিস-পত্র ভুল ক্যামিক্যাল মিশিয়েছে তারপর আবার আগুন ধরিয়ে হাসছে। তাই রাগে দু-জনের গালে দুটো থাপ্পড় মারলেন।

নাছির সাহেব এসে সব দেখে আরো একটা থাপ্পড় মারলেন নুসরাতকে। আর নিষেধ করা হলো জীবনে ও যাতে অফিসের ব্লিডিং এর আশে-পাশে তাদের যেন না দেখা যায়। আর দেখা গেলে জুতো পিটা করে যাতে রাস্তা থেকে ভাগিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন ইরহাম আর নুসরাতকে ঘাড় ধরে শোহেদ বের করে দিয়েছিলেন। ইরহামের মাথা ঝাড়া দিয়ে মাথা থেকে সব ফেলে দিল।

নুসরাতকে আগে পাঠালো গেটের সামনে। নুসরাত গিয়ে গেটে বারি দিল।
“কেউ আছেন এখানে? হ্যালো! খাম্বা টা মরেছে কই?
ছিপছিপে বোকা গড়নের এক ছেলে বসা থেকে উঠে আসলো। নুসরাত একে দেখে হাসি পেল, এটাকে দারোয়ান রেখেছে। এর বাপ কই? নুসরাত ভেবে নিল একে এক ধাক্কা মারলেই তো উড়ে গিয়ে দূরে কোথাও পড়বে?
” জি আপু কীভাবে সাহায্য করতে পারি?
নুসরাত ছেলেটাকে বোকা বানানোর জন্য বলল,
“ভাইয়া……

ভাইয়া বলে মাথায় হাত দিয়ে গেটের সামনে উল্টে পড়ে গেল। বোকা ছেলেটা বুঝলো না নুসরাত ভিতরে ঢুকার জন্য মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করছে।
ইরহাম দূর থেকে হায় হায় করে উঠলো। এটা পাগল নাকি? ভিতরে ঢুকার জন্য মাটিতে পড়ে গেল। কি খাচ্চর এই মহিলা? এই এতো ময়লা আবর্জনা মধ্যে শুয়ে পড়ল। ছি্হ….
ছিপছিপে গড়নের ছেলেটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। গেটের ভিতরে থেকে আপা আপা বলে ডাকলো। নড়চড় না দেখে গেট খুলে ধীরে ধীরে নুসরাতের দিকে আসলো। পাশ থেকে ছোট আকারের বাঁশের কঞ্চি নিয়ে নুসরাতের শরীরে ধাক্কা দিল। নুসরাতকে নড়তে না দেখে মনে করলো অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে।
পা চালিয়ে ভিতরে গেল পানি আনতে ছেলেটা। নুসরাত নিজের আশ-পাশ নড়চড় না দেখে এক চোখ খুলল। ছেলেটাকে না দেখে উঠে দাঁড়িয়ে ভো দৌড় দিল গেটের ভিতর। নুসরাতকে দৌড়াতে দেখে ইরহাম ও দূর থেকে দৌড়ে আসলো। নুসরাতের পিছু পিছু দৌড়ে গিয়ে সিঁড়ির কাছে থামলো। নুসরাত হাফ ছাড়লো, কাপড় থেকে বালু ঝেড়ে নিয়ে ইরহামের গায়ে হাত মুছলো। এটা তার মোছার জায়গা! ইরহাম না করলো গায়ে হাত না মুছার জন্য কিন্তু নুসরাত না করলে আরো বেশি করে মুছবে।

নুসরাত সিঁড়ির ওখানে দাঁড়িয়ে থেকে দেখলো ছেলেটা ওখানে যাচ্ছে। নুসরাতকে ওখানে না পেয়ে হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসলো ছেলেটা।
” জি জি আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।
“আমার আপনাদের উপর ভরসা আছে। এর আগে আপনারা যা সেল দিয়েছিলেন তা অনেক ভালো ছিল। তাই এবার ও আপনাদের কাছে আসলাম।

সোহেদ আর একটা কালো লোক কথা বলতে বলতে নিচে নামলেন। তাদের নিচে নামতে দেখে নুসরাত আর ইরহাম সিঁড়ির পিছনে গিয়ে লুকালো। শোহেব আর কালো লোকটা চলে যেতেই দৌড় দিল দ্বিতীয় তলার দিকে দু-জন। এক দৌড়ে গিয়ে থামলো মেইন দরজার সামনে। নুসরাত আর ইরহাম দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই সবাই তাদের দিকে তাকালো। নুসরাত বোকা হাসল মাস্কের ভিতর থেকে। সবাইকে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাতে দেখে মাস্ক খুলে হাসল। নুসরাতকে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন আলম। তিনি গত দশ বছর ধরে কাজ করছেন এখানে, তাই নুসরাতের করা কর্মকান্ড গুলো উনার জানা। পকেট থেকে মোবাইল বের করলেন আলম। ইরহাম নুসরাতকে এক হাত দিয়ে ধাক্কা দিল। নুসরাত বিরক্ত হয়ে বলল,” কি?
ইরহাম নাক কুঁচকে তাকালো নুসরাতের দিকে। নুসরাতের মাথা চেপে ধরে আলমের দিকে মুখ ঘুরিয়ে দিল।
“ওই দেখ!

নুসরাত চিৎকার করে উঠলো,
” আঙ্কেল উঁহু এটা করার একদম চেষ্টা করবেন না। আব্বা চাচ্চু আর ছোট চাচা এই বিষয়ে জানতে পারলে খুব খারাপ হবে আপনার সাথে।
নুসরাতের কথা তবুও শোনলেন না। তিনি নাছির সাহেবকে কল দেওয়ার জন্য ডায়েলে ঢুকলেন।
“আঙ্কেল আপনার ছেলে তো হাই স্কুলে পড়ে। কি যেন ছিল আপনার ছেলের নাম? নুসরাত মাথা হালকা থাপ্পড় মেরে বলল,” হ্যাঁ হ্যাঁ মনে পড়েছে আদি না কাদি, আপনার ছেলের নাম। আজ মনে হয়, না না, আর এই জীবনে আপনার ছেলের বাসায় ফিরা হবে না। প্রচুর কষ্ট হচ্ছে আপনার ছেলেটার জন্য।
নুসরাত মুখ দিয়ে চুকচুক শব্দ করলো।
আলম হা করে তাকিয়ে রইলেন।
“তুমি কি হুমকি দেওয়ায় চেষ্টা করছো?
নুসরাত হালকা শব্দ করে হাসল।

” হুমকি দেওয়ার চেষ্টা করবো কেন? হুমকি দিচ্ছি আমি আপনাকে। ছেলেকে ভালোয় ভালোয় বাসায় ফিরাতে চাইলে আমার কাজে ঠ্যাং ঢুকাবেন না। আর আপনারা সবাই, যারা নতুন তারা তো আমায় চেনেন না কিন্তু যারা পুরাতন তারা তো আমায় খুব ভালো করে চেনেন। তাই আমার থেকে দূরত্ব বজায় রাখুন এবং আমার কাজে ঠ্যাং ঢুকানো থেকে বিরত থাকুন। আরেকটা কথা এই অফিসের আপনারা ছাড়া আর কারোর কানে যদি যায় আমি এখানে এসেছি তাহলে,. বলতে হবে কেন? বোঝে নিন তাহলে কি হবে?

নুসরাত আর ইরহাম মেকি হাসি দিয়ে ভাবসাব নিয়ে হেঁটে গেল সামনের দিকে। যখন দেখলো সবাই নিজ নিজ ডেস্কে ফিরে যাচ্ছে দু-জন ভো করে দৌড় দিল আরশের কেবিনের দিকে। আরশের কেবিনের সামনে গিয়ে বাহির থেকে উঁকি ঝুঁকি মারলো। বাহির থেকে ভিতরের কোনো কিছু দেখা যায় না বলে নুসরাত মনে মনে আল্লাহের নাম ঝপতে ঝপতে দরজার বাহির থেকে মাথা ভিতরে ঢুকিয়ে এক চোখ বন্ধ করে চারিদিকে তাকালো। যখন দেখলো কেউ নেই নুসরাত ভিতরে ঝটপট ঢুকে গেল। সাথে টেনে নিয়ে গেল তার ক্রাইম পার্টনার কে।
আরশের টেবিলে কিছু ফাইল রাখা ছিল। নুসরাত কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে যখন কিছু বুঝলো না ছুঁড়ে দূরে ফেলল। আবার তুলে এনে জায়গায় রাখলো। ড্রয়ার খুলে কিট কাট, চকলেট আর চুইংগাম পেল, ওগুলো সব নিজের পকেটে ঢুকিয়ে ড্রয়ার লাগিয়ে দিল। চুইংগাম একটা ইরহামের দিকে বাড়িয়ে দিল। নুসরাত চুইংগামের প্যাকেট খুলে মুখে ঢুকিয়ে নিল। চাবাতে চাবাতে খুঁজতে লাগলো ফাইল।

আরশ একটা মেয়ের সাথে কথা বলে এদিকে আসছিল। কেবিনের বাহির থেকে কেবিনের ভিতর কিছু দেখা না গেলেও ভিতর থেকে সব দেখা যায়। আরশকে এদিকে আসতে দেখে নুসরাত আর ইরহাম একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে এদিক-ওদিক লুকালো। নুসরাত সোফার পিছনে লুকাতেই ইরহাম এসে টেনে নিয়ে গেল সেখান থেকে ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের দরজা পুরোপুরি না লাগিয়ে খোলা রাখলো। দু-জন ফাঁক ফোঁকর দিয়ে তাকিয়ে রইলো। আরশ ভিতরে কার সাথে কথা বলে আসছে তা দেখার জন্য,তখন মেয়েটার মুখ খেয়াল করেনি নুসরাত। কেবিনের ভিতর ঢুকে স্লাইডিং দরজা ধরে রাখলো আরশ হাসি-মুখে। নুসরাত আর ইরহাম বিস্ফোরক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে, তারপর নিজেদের দিকে তাকিয়ে চোখা চোখি করে নিল। দ্যা গ্রেইট আরশ হেলাল কোনো একজনের জন্য দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। হাহ…

একটা মেয়ে হালকা হাসি নিয়ে কেবিনে ঢুকলো। মেয়েটাকে নুসরাত চিনতে পারলো। নুসরাত ফিসফিস করে বলল, “এই ইরহাইম্মা মাইয়াডারে আমি দেখছি ইসরাতের বিয়েতে, এরপর ইসরাতের মেহেদিতে। আর কেউ আসেনি অফিসের শুধু এই মেয়ে এসেছিল। ডাল মে জারোর কোচ কালা হ্যায়?
” ভাইয়ার মুখে কি হাসি লেগে আছে দেখ? আমাদের সাথে আসছে থেকে কোনো দিন হেসে কথা বলেনি। আমাদের দেখলেই মুখ…
নুসরাত কথা কেড়ে নিল।

“আমাদের দেখলেই হাগুর মতো মুখ বানিয়ে নে শালা বাই*দ। কোনো দিন একটা স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছিল আমাদের সাথে বসে। উঁহু না!
নিজেদের বাক্য শেষ হলো আরশের সাথে আসা মেয়েটার গলার স্বর শোনে,” স্যার আজ কোনো স্পেশাল কিছু নাকি আপনাকে দেখে খুশি খুশি লাগছে।
আরশ কিছু বলল না। হালকা হাসল ঠোঁট চেপে।
“স্যার এতো জরুরি তলব দিয়ে নিজে গিয়ে নিয়ে আসলেন কি প্রয়োজন? কীভাবে সাহায্য করতে পারি আমি আপনাকে?

আরশ কথা বলল না। নুসরাত আর ইরহাম মুখ কুঁচকে একজন আরেকজনের দিকে তাকাচ্ছে। এদের ন্যাকামি তার ভালো লাগছে না। কি বলবে বলে ফেল না ভাই? এতো দেরি করছিস কেন?
আরশ নিজের পকেট থেকে একটা রিং এর বক্স বের করে এগিয়ে দিল রুবার দিকে। নুসরাতের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল নিশ্চয়ই কিছু হতে চলেছে। তারপর মনে হলো কিছু না হলে কি হবে? নাহলে না হোক, তারপর ও তার ভিডিও ক্যামের অন সবসময় থাকবে। চুপিচুপি বাথরুমের দরজা খুলে কিছুটা ফাঁক করে তার ভিতর দিয়ে মোবাইলের ক্যামেরা বের করলো। আরশ রিং এর বক্স এগিয়ে দিল রুবার দিকে।
রুবা বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলো,
” কি হয়েছে স্যার?

আরশের ইচ্ছা করলো বোকা মেয়েটাকে মাথায় মারতে। তারপর নিজেকে শাসিয়ে রিং এর বক্স খুলে এগিয়ে দিল রুবার দিকে। রুবা এখনো হা করে তাকিয়ে আছে আরশের দিকে। আরশ আর অপেক্ষা করলো না নিজেই বলল , “দেখুন মিস রুবা আমি স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড কথা বলতে পছন্দ করি এবং আমি এখন যা বলবো আপনি পজেটিভলি নিবেন। আর আমি আশা করবো আপনার উত্তর ও আসবে স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। তো যা বলছিলাম, আমার ফ্যামেলি সম্পর্কে অবশ্যই আপনার ধারণা আছে। আর বলতে হবে না। আমার বড় দু-জনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে তাই এবার আমার পালা। তো আমি আমার এজ আ লাইফ পার্টনার হিসেবে আপনাকে পছন্দ করেছি। আপনাকে আমার ভালোলাগে আর আপনার যদি ভালোবাসা চাই আই মিন ভালোবাসা ম্যাটার করে আমার কাছ থেকে তাহলে আপনার সাথে থাকতে থাকতে এমনিতেই ভালোবাসা হয়ে যাব। আপনি বুঝেছেন আমি কি বলেছি?
ইরহাম হা করে তাকিয়ে আছে আরশের দিকে। আরশের মতো একজন ইগোস্টিক ব্যক্তি কাউকে প্রপোজ করছে বিয়ের জন্য। ইরহামের পাশে দাঁড়িয়ে নুসরাত নিজেকে বাহবা দিচ্ছে আজ অফিসে আসার জন্য। নাহলে এতো বড় ক্লাইমেক্স মিস হয়ে যেত। ইরহামকে ধন্যবাদ বলতে বলল,এই সুন্দর সিন দেখানোর জন্য। বাসায় থাকলে আজ সব মিস হতো

রুবা বিমূঢ় নেত্রে আরশের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। নিজের জড়তা একপাশে ফেলে বলল,”স্যার…. কথাটা বলে হেসে দিল রুবা।
“ওয়াট হ্যাপেন্ড মিস রুবা? আপনি হাসছেন কেন?আপনার কি আমাকে পছন্দ হয়নি?
” স্যার সেরকম কিছু না।
“তাহলে কিরকম কিছু।

” স্যার আমি বলছি আপনি প্লিজ উত্তেজিত হবেন না। আমি বিবাহিত স্যার এবং বর্তমানে আমি এক সন্তানের মা।
রুবার কথা শোনে ওয়াশরুমের ভিতর থেকে নুসরাত হেসে উঠলো উচ্চ শব্দ করে। ইরহাম নুসরাতের মুখ চেপে ধরলো। তারপর ও নুসরাত হি হি করে হাসল। বাথরুমের ভিতর থেকে নুসরাতের হাসির শব্দ প্রতিধ্বনি হয়ে বাহিরে আসলো। আরশ আর রুবা ওয়াশরুমের দিকে তাকালো এক সাথে। নুসরাত বলল ইরহামকে, “চল বাহিরে যাই। ভাইয়া শোনে ফেলছে আমার হাসির শব্দ। আসলে আমি হাসতে চাইনি তারপর ও জোরে হাসি বের হয়ে গেল।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৩৩

ইরহাম আসতে চাইলো না ওয়াশরুমের ভিতর থেকে নুসরাত টেনে নিয়ে আসলো। এখন আর লুকিয়ে কি হবে? দু-জন ধরা পড়ে গিয়েছে। নিজে হেসে দিয়ে গন্ডগোল পাকিয়ে দিয়েছি। ওয়াশরুমের ভিতর থেকে ইরহাম আর নুসরাত চুরের মতো মুখ করে বের হয়ে আসলো। আরশের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টেনে বোকার মতো হাসল দু-জন।

প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৩৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here