প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫৫
জান্নাত নুসরাত
জায়িন এবং ইসরাতের দু-জন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। নুসরাতকে আজ-কাল ধাক্কিয়ে অফিসে পাঠানো যায় না। জিজ্ঞেস করলেই তার উত্তর বাড়িতে তার অনেক কাজ। হাতে সবসময় ইয়া বড় তালা নিয়ে হাঁটে। সেদিন নাজমিন বেগম কিচেনের সামনে ঘুর ঘুর করতে দেখে চেপে ধরলেন। ধমকালেন অনেক্ষণ। তারপর হাতে তালা দেখে জিজ্ঞেস করলেন,”এটা কীসের জন্য হাতে নিয়ে ঘুরিস?
নুসরাত প্রথমে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসে রইলো। যার মানে সে বলবে না। নাজমিন বেগম মাথায় দুটো থাপ্পড় মেরে আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তুই বলবি নাকি আমি তোকে জুতো পিটা করব?
নুসরাত নাক মুখের হাল বেহাল করে মায়ের দিকে তাকালো। চোখ বাঁকা করে রেখে বলল,”তুমি আমার গায়ে হাত তুলছো। বৌমার গায়ে হাত তুলছো। জঘন্য অপরাধ করছ শাশু-মা। আমাকে আমার শাশুড়ী হাত লাগালেন না এখন পর্যন্ত আর তুমি আমাকে থাপ্পড় মারলে। না আমি বিশ্বাস করি না।
নাজমিন বেগম এক হাত দিয়ে কোমর চেপে ধরে বললেন, “নাটক শেষ! এবার বল হাতে ওইটা কেন?
নুসরাত মায়ের কাছ থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে এসে মিনমিন করে বলল,” সুরক্ষা দিচ্ছি!
নাজমিন বেগম ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কাকে?
” ইসরাতকে!
নুসরাতের পিঠে ধুম ধুম করে দুটো কিল দিলেন নাজমিন বেগম। ওড়না কোমরের কাছে বাঁধতে বাঁধতে এগিয়ে এলেন নুসরাত কে পেটানোর জন্য।
“তুই কে রে ওকে সুরক্ষা দিবি? ওকি এখানে সুরক্ষিত নয়?
নাজমিন বেগমকে তেড়ে আসতে দেখে নুসরাত পালালো। যেতে যেতে চিৎকার করে বলল,” আমি হলাম দ্যা গ্রেট নাছির উদ্দিনের একমাত্র ছেলে দ্যা গ্রেট সৈয়দা ঝন্টু ।
নাজমিন বেগম কিছুক্ষণ নুসরাতের যাওয়ার -দিকে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে নিজের কাজে গেলেন। এই পাগলকে নিয়ে তিনি কি করবেন?
নুসরাত আজ শরীর খারাপ করায় সন্ধ্যার দিকে আরশের রুমে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
জায়িন বাড়িতে ক্লান্ত দেহ নিয়ে ফিরে আসলো মাগরিবের আজানের পর। এই জানুয়ারি মাসে ও ঘেমে নেয়ে জবজবে হয়ে গিয়েছে। আবহাওয়া এই কয়েক বছর ধরে ধোঁকা করছে। শীতকালে শীত না লেগে গরম লাগছে। হায় রে শীত।
জায়িন দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আলগোছে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। সবাই মাগরিবের নামাজ আদায় করার জন্য নিজ নিজ রুমে। আহানের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। নামাজে প্রথম রাকাতের সূরা ফাতিহা পড়ছে গলা ফাটিয়ে। যা আহানের রুম থেকে বের হয়ে সারা বাড়িতে প্রতিধ্বনি হচ্ছে। জায়িন হাসল গাল বাঁকিয়ে। যা বুঝার উপায় নেই কোনোভাবে?
ইসরাতের রুম আজ পর্দা কিছুটা ফাঁক করে রাখা ছিল। জায়িন সেদিকে না তাকিয়ে পা চালিয়ে রুম ক্রস করে চলে গেল। পাঁচ সেকেন্ডের মাথায় তড়িৎ ফিরে আসলো আবার ইসরাতের রুমের সামনে। চারিদিকে একবার তাকিয়ে গলা পরিস্কার করে বড় বড় পা ফেলে প্রবেশ করলো ইসরাতের রুমে।
রুমের ভিতর থেকে মেয়েলি পারফিউম এর সুঘ্রাণ এসে জায়িনের নাকে লাগলো। জায়িন চারিদিকে চোখ ঘুরাল। হঠাৎ চোখ পড়ল স্টাডি টেবিলের উপর যেখানে বইয়ের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে ইসরাত। জায়িন এক হাতে কোট ভাঁজ করে রেখে অন্য হাত পকেটে ঢুকিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেল ইসরাতের দিকে। ইসরাতের দিকে নিশব্দে তাকিয়ে তাকল জায়িন কিৎকাল। সময় গড়াল, কিছুক্ষণ পর জায়িনের টনক নড়তেই হালকা হাসল। নিজের কাজে নিজে কিছুটা অবাক হলো। জায়িন পকেট থেকে হাত বের করে দাড়ির মাঝে হাত বুলালো। টেবিলের উপর এক হাত ভর দিয়ে ঝুঁকল ইসরাতের দিকে।
ইসরাতের মুখের সামনে আসা চুল গুলো আলগোছে কানের পিছনে গুজে দিল। হালকা ফু দিল কানের লতিতে। হঠাৎ জায়িনের ভ্রু কুঁচকে গেল। ইসরাতের কানের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। পিয়ারসিং কানে করা দেখে জায়িন বিড়বিড় করলো,”এটা আবার কবে করল?
ইসরাতের পিয়ারসিং করা জায়গায় হাত বুলিয়ে দিল। গালে আঙুল দিয়ে স্লাইড করতেই গাল লাল হয়ে গেল। জায়িন হালকা হেসে ইসরাতের কানে লতিতে আর গালে সফট চুমু খেল।
রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে ইসরাতের উদ্দেশ্যে বিড়বিড় করলো, “তফাৎ আছে ভালোবাসায় আর মায়ায়,যতটা তফাৎ ধোঁয়া আর কুয়াশায়।
জায়িন নিজের রুমে ঢুকে রুম লক করে নিল। শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ভাবল আজ কাবাবে হাড্ডির দেখা পেল না। গেল কই? সারাদিন তো দেখা যায় হাতে তালা নিয়ে দরজার আশে-পাশে ঘুরা-ঘুরি করছে। আজ এতক্ষণ পার হয়ে গেল কোনো নড়চড় নেই। জায়িন শার্ট খুলে ঢিল মেরে ফেলে দিল বাথরুমের মেঝেতে। পরণে রইলো শুধু ফরমাল প্যান্ট। জায়িন শার্ট খুলতেই ভেসে উঠলো পেটানো পুরুষালি দেহের খাঁজ। হাতে লাইটার আর সিগারেট নিয়ে প্যান্টের বেল্ট কিছুটা লোজ করতে করতে বারান্দায় দিকে এগিয়ে গেল।
জায়িনের রুমের বাহিরে জায়ান নক করলো। জায়িন রুমের ভিতর থেকে রাশভারী গলায় বলল,” কামিং!
জায়ান হেলে-দুলে রুমে প্রবেশ করলো। ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা হেসে বিছানায় লাফ দিয়ে বসে গেল। জায়িন ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে তীব্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো জায়ানের পানে। জায়ান দু-হাত উপরে তুলে স্যরেন্ডার করার মতে করে বলল,”আরে ভাই এরকম লোক দিচ্ছো কেন? মনে হচ্ছে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে!
জায়িন কোনো কথা না বলা জায়ানের পায়ের দিকে তাকালো। জায়ান জায়িনের চোখ অনুসরণ করে নিজের পায়ের দিকে তাকাতেই আসল ঘটনা বুঝতে পারল।বোকার মতো হেসে বলল,”স্লিপার পরা ছিল।
জায়িন তবুও গম্ভীর চোখ নিয়ে ওই-দিকে তাকিয়ে রইলো। জায়ান জায়িনকে বিশ্বাস করতে না দেখে বিছানায় শুয়ে পা জায়িনের মুখের সামনে ধরে বলল,”দেখ ভাই পা পরিস্কার! আমি একশত পার্সেন্ট সিউর তুই আর আরশ দুইটাই শুচিবায়ূ রোগে আক্রান্ত।
জায়িন জায়ানের ফালতু কথায় ধ্যান দিল না। ল্যাপটপে নিজের কাজের দিকে ধ্যান দিল। জায়ান নিজের দিকে জায়িনের কোনো পাত্তা না পেয়ে ব্যথিত গলায় বলল,
” ফ্রান্স যখন ছিলাম আমাদের মধ্যে কত কথা, কত আড্ডা দেওয়া হতো, আর এখন কথা বলা তো দূর দেখাই হয় না।
জায়িন একবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তুলে তাকালো জায়ানের দিকে। জায়িনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির প্রকোপে পড়ে জায়ান কেঁশে উঠল।
“আচ্ছা তুই কথা না বললে কি হতো? আরশ বলতো!
জায়িন এতক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে বলল,
” আরশ কখন তোর সাথে কথা বলতো,আমি তো কোনোদিন দেখলাম না?
জায়ান থতমত খেল। চোখ-মুখ উল্টে বসে রইলো। এতো সত্যি কথা বলতে কে বলেছে?
জায়িন গম্ভীর গলায় বলল,
“ফালতু কথা শোনার টাইম নাই। যা বলতে এসেছিস বল, নাহলে ভাগ এখান থেকে।
জায়ান ঠোঁট কামড়ে জায়িনের দিকে সিরিয়াস হয়ে তাকালো।
“আর দু-দিন পর তো আব্বু আম্মুর এনেভারসেরি। প্রতি বছর তো আমরা পালন করি তাহলে এবার কেন নয়?
” আমি এই বিষয় ভেবে রেখেছি। ভাবছিলাম সারপ্রাইজ দিব তাই আর বলা হয়নি।
“তাহলে কীভাবে কি করবো আই মিন করবি?
“আগামীকাল বলে দিব তোকে। এখন যা, নিজের রুমে!
” কিন্তু, আমি আজ এখানে থাকবো তোর সাথে?
জায়িন তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো। ঠোঁট নেড়ে নেড়ে কিছু বলতেই জায়ান উঠে দাঁড়িয়ে বলল,”ভাই এতো সিরিয়াস হচ্ছেন কেন? আমি তো চলেই যাচ্ছিলাম।
নুসরাত ভার্সিটি যাওয়ার জন্য চুল বেঁধে রেডি হয়ে বসে আছে। আরশ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই পরছিল আড়চোখে বিছানায় নুসরাতের দিকে তাকিয়ে আবার টাই বাঁধায় মন দিল। আরশ টাই পরে নিয়ে কাবার্ডের দিকে এগিয়ে গেল। ব্ল্যাক কালার কোট কাবার্ড থেকে বের করে ভাঁজ করে রাখলো বিছানার পাশে। নুসরাতের দিকে তাকাল আবার। আজ এতো চুপচাপ—কেন তা আরশের মাথায় ধরলো না। মাথায় কি খিচুড়ি পাকাচ্ছে এক আল্লাহ ভালো জানে।
শার্টের উপরের দিকের বোতাম খুলল কোনো কারণ ছাড়া। নুসরাতের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি? বাবু সাহেব হয়ে বসে আছিস কেন? পটর পটর বন্ধ কেন আজ?
নুসরাত উঠে দাঁড়ালো। হেলে দুলে এগিয়ে গেল আরশের দিকে। আরশের শার্টের দু-পাশ হাত দিয়ে চেপে ধরে মুচকি হাসল। আরশ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে নুসরাত কে জিজ্ঞেস করলো,” কি? এতো পিরিত কোথা থেকে আসছে?
নুসরাত গদগদ ভঙ্গিতে হেসে আরশের বুকে মাথা রাখলো। আরশ বুঝলো না নুসরাতের এতো মশলা মাখানোর কারণ। ঠেলে দূরে সরিয়ে দিতে চাইলো,নুসরাত কাঁঠালের আটার মতো আরশের শার্ট ধরে বুকের সাথে লেগে রইলো।
আরশ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল,
“কি চাই? দূরে সর!
নুসরাত দূরে সরা তো দূরের কথা আরেকটু কাছ ঘেঁষে লেপ্টে গেল আরশের বুকের সাথে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট চেপে ধরে দু-হাত নিয়ে আরশের পৃষ্ঠদেশে চেপে ধরলো। আরশ ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহ নিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। অপেক্ষা করলো নুসরাতের বলার অপেক্ষায়।
নুসরাত আরশের ঠোঁটে সূক্ষ্ম চুমে খেয়ে দূরত্ব বাড়াতে চাইলো কিন্তু আরশ এবার দূরত্ব বাড়াতে দিল না। কোমর চেপে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে রাখলো। ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,” কি চাই?
নুসরাত নিজের পা খুটতে লাগলো মেঝেতে। দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে বলল,”বলবো?
আরশ মাথা নাড়ালো। নুসরাত মিনমিন করে বলল,
“একবার আমার সাথে ভার্সিটি যেতে হবে।
আরশের সোজা হয়ে থাকা ভ্রু বেঁকে গেল। নুসরাত মতিগতি চেঞ্জ হতে দেখে গালে ঠোঁট দাবিয়ে চুমু খেল। আরশ কপালে হাজারটা ভাঁজ ফেলে ওইরকম দৃষ্টি রেখে চেয়ে থাকল। নুসরাত আরেকটা চুমু খেয়ে আরশের দিকে তাকাতেই আরশ কপালের সাথে কপাল চেপে ধরে চোখ ছোট ছোট করে নিল। নুসরাত কে শাসানোর স্বরে বলল,
” কি করেছিস তুই?
নুসরাত উচ্ছাসি গলায় বলল,
“তেমন কিছু করিনি!
“তাহলে কেমন কিছু করেছিস?
নুসরাত চোখ ঘুরাল আশে-পাশে। তার ভয় লাগছে একে বলতে। যদি বাড়িতে কাউকে বলে দেয় সে ফেল করেছে তাহলে তো জুতো পিটা করা হবে তাকে। নুসরাত মাথা দু-দিকে ঝাড়া দিয়ে চিন্তা ফেলে দিল বাহিরে।
আরশ নুসরাতের থুতনি চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরালো। নাকে হালকা নাক ছুঁয়ে দিয়ে বলল,”কি হয়েছে বল? আমি আছি তো।
নুসরাতের মনোভাব বোঝা গেল না। ঠোঁট বাঁকা করে আরশের এক হাত নিজের কোমর থেকে টেনে নিয়ে এসে নিজের হাতের উপর রাখলো। সন্দেহি গলায় বলল,”আগে ওয়াদা করুন তারপর বলবো কি হয়েছে?
আরশ ওয়াদা করতে অগ্রাহ্য করলো। নুসরাত আরশের বাহু বন্ধন থেকে বের হয়ে বলল,” তাহলে আর বলবো না।
আরশের সোজা জবাব,
“আমি ও তাহলে যাব না।
” ছোট্ট বিষয়,একটা ওয়াদা করলেই তো হয়ে যায়। তাহলে তো আপনার উপর আমার ভরসা হয়ে যাবে আপনি ফাঁস করবেন না।
আরশ নিজের জিহ্বার সামনা বের করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। তারপর নিজের সাথে কিছু বোঝা পাড়া করে মাথা নাড়িয়ে রাজি হয়ে গেল।
“আগে ওয়াদা করুন তারপর বলবো
আরশ গম্ভীর গলায় বলল,
” ওয়াদা!
ওয়াদা বলতে দেরি হলো কিন্তু নুসরাতের কারণ বলতে দেরি হলো না।
“আসলে না আমি পঞ্চম সেমিস্টারে ডাব্বা খেয়েছি!
আরশ চোয়াল ঝুলিয়ে ফেলল। চোখ মুখ বিকৃতি করে বলল,” কি বললি আবার বল? বুঝতে পারিনি!
“আরে ভাই, বুঝতে পারেন না পঞ্চম সেমিস্টারে ফেল করেছি ফেল।
আরশের চোখ এতো বড় বড় হয়ে গেল যখন শুনলো নুসরাত ফেল করেছে। অবিশ্বাস্য নজরে তাকিয়ে থেকে ঢোক গিলল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
” তুই ফেল করেছিস। আর এটা তুই গলা ফাটিয়ে বলছিস। তোর লজ্জা লাগছে না।
নুসরাত উপরের পাটির দাঁত বের করে হাসল। আরশের ঠোঁট হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে বলল,”চুপ এতো জোরে কথা বলছেন কেন? আমি কাছেই আছি ধীরে বলুন, মানুষ শুনতে পাবে তো।
নুসরাত দরজার বাহিরে চোখ দিয়ে একটু উঁকি ঝুঁকি মারল। নিজের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা অগ্নি মানবকে তার চোখে লাগলো না। কাউকে না দেখে সস্থির নিঃশ্বাস ফেলে আরশের দিকে তাকালল। আরশ ক্ষেপা বাঘের মতো তাকিয়ে আছে নুসরাতের দিকে। নুসরাত আরশের দিকে তাকিয়ে হেসে বাহুতে হালকা চাপড় মেরে বলল,”আপনার কাছে বিশ্বাস যোগ্য বলে এটা মনে হচ্ছে না কিন্তু, এটাই সত্যি।
নুসরাত আরশের রাগী দৃষ্টি দেখে বুঝলো না আরশের এই দৃষ্টি দেওয়ার মানে। মনে করলো অতিরিক্ত অবাক হওয়ার কারণে এভাবে তাকিয়ে আছে। আরশ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে শ্বাস ফেলল, রাগ কন্ট্রোলে আনার জন্য। কিন্তু নুসরাত হেসে আরশের কাঁধে গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ আরশ আড়চোখে অসহায় ভাবে তাকালো। এই পাগল কে নিয়ে সে কি করবে? একে নিয়ে সারাজীবন সে থাকবে কীভাবে? আফসোস হয় আরশের কেন সে বাজি ধরতে গেল। কেন রাগের মাথায় যা মুখে এসেছে তাই বলে দিয়েছে। একবার যদি সেদিন মুখ টা আটকাতো তাহলে আজ এই দিন তাকে দেখতে হতো না। দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে নুসরাতের মাথা এক হাত দিয়ে চেপে ধরে বুকের সাথে নিয়ে শক্ত করে ধরে রাখলল। নুসরাত ছটফট করতে লাগলো নিজের মাথা আরশের হাত থেকে ছাড়ানোর জন্য। আরশ নুসরাতকে নড়াচড়া করতে দেখে আরো শক্ত করে ধরে রাখলো।
জায়িন অফিসে যাওয়ার আগে ইসরাতের রুমে ঢুকল চুপিচুপি। ইসরাতকে কম্ফোটার গায়ে দিয়ে ঘুমাতে দেখে গাল এলিয়ে হাসল। ইসরাতের বিছানার পাশ ঘেঁষে বসল। ইসরাত বিছানার মাঝ-বরাবর ঘুমিয়ে আছে কোণা-কোণি পা রেখে। জায়িন ইসরাতের মাথার নিচে বালিশ দিয়ে নিশ্চুপ চোখে তাকিয়ে রইল। অনেক কথা ইসরাতকে বলতে ইচ্ছে করলো। হয়তো সময়ের ওভাবে নয়তো মনের পীড়নে, বলা হলো না। নিশ্চুপ তাকিয়ে থেকে সময় কাটালো। ইসরাত ঘুমালে দিন-দুনিয়ার খবর ছেড়ে ঘুমায়। জায়িন ইসরাতের গালে টেপ টেপ করে হালকা হাতে থাপ্পড় দিল। যখন দেখলো ইসরাত নড়ছে না, তখন ইসরাতের মাথা টেনে তুলে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। বিড়বিড় করে বলল,”do you know israt? What is wrost feeling? When your heart cries but your eyes don’t…….
জায়িন তাচ্ছিল্য করে হাসল। ইসরাতের মাথা বালিশের উপর ঠিক ভাবে রাখতে রাখতে বলল,”আমি কাকে বলছি, যাকে বলছি সে তো ঘুমিয়ে। হায়রে কপাল!
জায়িন দাঁতে দাঁত চেপে ইসরাতের পাশে কিছুক্ষণ বসে রইলো। ইসরাত নড়ে চড়ে পাশ ফিরল। তারপর আবার ঘুমের ঘুরে আবার তলিয়ে গেল।
নিচ-থেকে সকালের নাস্তা করার জন্য তলব করা হচ্ছে। জায়িন উঠে দাঁড়িয়ে ইন করা শার্ট টেনে ভাঁজ ঠিক করে নিল। শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে রুম থেকে বের হতেই দরজার সাথে ঝুলে দাঁড়িয়ে থাকা নুসরাতকে দেখতে পেল। নুসরাত বোকার মতো হেসে বলল,”ভাইয়া আমি কিচ্ছু শুনিনি। আর শুনে থাকলে ও ভুলে গিয়েছি।
“নুসরাতের বাচ্চা তুই আসবি না কি আমি আসব….
আরশ সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বিরক্তি নিয়ে। এই নুসরাতের জন্য তাকে ও জায়িনের আবেগপূর্ণ পার্সোনাল কথা শুনতে হয়ে গেল। একে নিয়ে সে কি করবে? এর কি হবে? আর তার কি হবে? আল্লাহ এই পাগলকে তুমি একটু ঠিক করে দাও। আমি নফল নামাজ আদায় করবো একে একটু ঠিক করে দিলে।
জায়িন শান্ত চোখে তাকিয়ে গমগমে ভরাট পুরুষালি গলায় বলল,” নুসরাত অন্যের কথা কান পেতে শোনা বেড হেভিট। আরশ ও তোমার সাথে ছিল?
“আমি কিছু শুনিনি ভাইয়া। শুধু দেখেছি আমার এই গুণাগার আখোছে, আপনার আর ইসরাতের মাঝে যা হচ্ছিল। এখানে আমার দোষ বা কোথায়? আপনারা দরজা খুলে রোমান্স করলে আমরা সাধারণ জনগণের একটু আকটু দৃষ্টি সীমানায় পড়বে! দোষ তো সব আপনার।
নুসরাত জায়িনের উপর সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে হেলে দুলে চলে গেল সিঁড়ির দিকে।
ভার্সিটিতে আসার পথে আরশ কোনো কথা বলেনি। ভার্সিটি তে পৌঁছানোর পর নুসরাত প্রফেসর আনোয়ারের রুমের সামনে আরশকে পৌঁছে দিয়ে বলল,” আপনি ভিতরে যান আমি বাহিরে আছি।
আরশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নুসরাতের দিকে ছুঁড়ে রাশভারী গলায় বলল,”আয়!
নুসরাত নিজের জায়গা থেকে এক পা নড়লো না। আরশ হাত চেপে ধরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভরাট গলায় বলল,”মে আই কামিং!
“ইয়েস মিস্টার!
নুসরাত ভুলাভালা মুখ বানিয়ে ভিতরে ঢুকলো। মিষ্টি গলায় এক পেশে হেসে বলল,”আসসালামু আলাইকুম স্যার!
“ওয়ালাইকুম আসসালাম! গার্জিয়ান নিয়ে আসছেন শেষ পর্যন্ত। বসুন মিস্টার ডট ডট!
আরশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রফেসরের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
” আরশ, সৈয়দ আরশ হেলাল।
প্রফেসর আনোয়ার আরশের দিকে না তাকিয়ে নুসরাতের পানে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” কে উনি আপনার?
প্রফেসর আনোয়ার নুসরাতকে হঠাৎ প্রশ্ন করায় সে নড়েচড়ে উঠলো। চোখ বড় বড় করে বলল, “জি. ….
আরশ থামিয়ে দিয়ে বলল,
” এর সাথে কি কথা বলছেন? আমি বসে আছি ওর অভিভাবক, আপনি আমার সাথে কথা বলুন।
“তাহলে মিস্টার আরশ আপনি বলুন, মিস নুসরাতের কি হোন আপনি?
আরশ গলার স্বর যতেষ্ট আয়ত্তে এনে সুন্দর ভাবে বলতে চাইলো আমি নুসরাতের হাজবেন্ড। কিন্তু কথা বের হলো কর্কশ গলায় ক্যাটক্যাট করে।
” আমি ওর হাজবেন্ড! প্লিজ স্টপ কলিং হার মিস! কল হার মিসেস ইন্সতেয়াড( instead)। মিস শুনতে অদ্ভুত লাগছে। বিবাহিত মহিলাকে আবার কীসের মিস? মিসেস বলুন মিসেস।
প্রফেসর আনোয়ার নুসরাতের মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন,”আপনার বিয়ে হয়ে গিয়েছে?
আরশ বলল,
“জি বিয়ে হয়ে গিয়েছে উনার!।এন্ড নাও সি ইজ প্রেগন্যান্ট?
নুসরাত চিৎকার করা বলে উঠলো,
” মানে কি ভাই?
প্রফেসর আনোয়ার কংগ্রেস করলেন। আরশ চোখ ছোট ছোট করে বলল,”জি বলুন কি জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন?
প্রফেসর আনোয়ার নুসরাতের নামে অভিযোগ দিতে শুরু করলেন। নুসরাত এখন পর্যন্ত একটা এ্যাসাইনমেন্ট ঠিকঠাক মতো জমা দেয়নি। এ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার শেষ দিনে এসে জমা দেয় লাস্ট মিনিটে।
আরশ জানালো এবার থেকে ঠিকঠাক এ্যাসাইনমেন্ট জমা দিবে নুসরাত।
” নুসরাত অর্গানিক রসায়নের একটা ল্যাব ক্লাসে উপস্থিত ছিলেন না। এই আড়াই বছর তিন-চার বারের বেশি আমি —উনাকে কখনো ল্যাবে দেখিনি।
“এবার থেকে উপস্থিত থাকবে। এই দায়িত্ব আমি নিলাম।
” উনি ক্লাস ঠিকঠাক এ্যাটেন্ড করেন না। প্রতিবার পাসড হয়ে যান কোনোভাবে, কিন্তু এবার উনি কীভাবে ফেল হলেন একটু জিজ্ঞেস করবেন আপনার স্ত্রীকে?
“পড়াশোনা করেনি ফ্যামেলি প্রবলেম ছিল তাই। আর কিছু…
” উনি ক্লাসে মনোযোগী নন?
“আজকে থেকে মনোযোগী হয়ে যাবে।
“আপনার স্ত্রীকে একটু পড়াশোনায় মন দিতে বলবেন।
“জি বলবো আর কিছু প্রফেসর আনোয়ার!
আনোয়ার সাহেব না ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালেন। আরশ উঠে দাঁড়ালো। প্রফেসর আনোয়ারের থেকে বিদায় নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে আদেশের স্বরে বলল, “চুপচাপ ক্লাসে যাবি নুসরাত।
নুসরাত সালাম দিয়ে বের হয়ে গেল। প্রফেসর আনোয়ার কপালে গুটিয়ে বিড়বিড় করলেন,” জামাই-বউ দু-জন তো এক নৌকার মাঝি। কার কাছে কার কথা বলবো?
শীতের বাতাবরণ প্রায় শেষের দিকে। জায়ান লিপি বেগম আর হেলাল সাহেবকে নিয়ে বাহিরে ঘুরতে গিয়েছে। লিপি বেগম যেতে চাননি কিন্তু জেদী জায়ান টেনে নিয়ে গিয়েছে লিপি বেগমকে। হেলাল সাহেব সাদা রঙের পাঞ্জাবির সাথে গ্যাবাটিনের প্যান্ট পরেছেন। লিপি বেগম হালকা সবুজ রঙের শাড়ির সাথে মাথায় কালো রঙের হিজাব পরেছেন। বাহিরে যাচ্ছেন একটু তো সেজেগুজে যাবেন।
জায়ানের গাড়ি বাড়ির দৃষ্টি সীমানার বাহিরে যেতেই জায়িন ফোন করলো কাউকে।
“জি চলে আসুন!
আধঘন্টার ভিতর এসে হাজির হলো ডেকোরেশন করার লোকেরা। জায়িন দেখিয়ে দিল কোথায় থেকে কোথায় সাজাতে হবে এবং কীভাবে?
সিগারেটে টান দেওয়ার জন্য ছাদের অন্যপাশে চলে গেল জায়িন। আরশ পকেটে এক হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তদারকি করতে লাগলো। আজ তার সময় কাটছে না! তাই সময় কাটানোর জন্য পকেট থেকে সিগারেট বের করে এক টান দিতে চাইলো হঠাৎ জায়িনের কথা মনে হওয়ায় মনের কথা মনের ভিতর রেখে দিল। বড় ভাইয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সে সিগারেট খাবে এটা অসম্মানজনক মনে হলো তার কাছে। তাই সিগারেট আর বের করলো না। পরে রুমে গিয়ে সিগারেট একটা টান দিয়ে আসবে।
সন্ধ্যার দিকে মমো, লুৎফা,মাহমুদা,সরওয়ার,আর আরশদের নানা বাড়ির লোক এসে হাজির হলেন। নানা বাড়ির লোক বলতে আরশদের মামা মামি আর আরশের নানি। আরশের নানি রুমানা খাতুন বাড়ির ভিতর প্রবেশ করার আগেই নাত-বউ দেখার জন্য উৎলা হয়ে গেলেন। নাছির সাহেব বললেন,” মায়োই-মা আগে ভিতরে চলুন পরে নাহয় ধীরে সুস্থে আপনার নাত-বউদের দেখবেন।
রুমানা খাতুন বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেহেরুন নেছার সাথে দেখা হলো। মেহেরুন নেছাকে হালকা খোঁচা দিয়ে বললেন,”আগের মতো মুখ চলে নাকি বেয়াইন? নাকি কিছুটা কমেছে আগের তোলনায়?
দেখা হতেই এমন কথায় মেহেরুন নেছার মুখ কালো হয়ে গেল। এই এক জন ব্যক্তি যার সামনে মেহেরুন নেছার মুখ বন্ধ হয়ে যায়।
“আরে বেয়াইন আপনি তো দেখছি আমাকে ভিতরে ঢুকতেই দিচ্ছেন না। দীর্ঘ কত বছর পর মেয়ের শশুড় বাড়ি আসলাম আর মেয়ের শাশুড়ী দরজা আটকে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড় করিয়ে রেখে আপনার মতো হাঁটুতে ব্যথা বানিয়ে দিতে চাচ্ছেন। এটা কি ঠিক?
মেহেরুন নেছা মুখ লটকে দরজার সামনে থেকে সরে গেলেন। নাজমিন বেগম তাড়াতাড়ি উপরে গেলেন ইসরাত আর নুসরাতকে নিয়ে আসার জন্য। নিচে নিয়ে আসার আগে মাথায় ভালোভাবে ওড়না পেঁচিয়ে নিত্র বললেন। পরে না বড় ভাবির মা তাকেই বেজ্জতি করে দে? ভদ্র মহিলা কাউকে পরোয়া করেন না।
” পা চালিয়ে হাঁট!
নুসরাত ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
“মহিলা কি অতিরিক্ত ডেঞ্জারাস? মেহেরুন নেছার থেকেও বেশি?
“ডেঞ্জারাস বলতে ডেঞ্জারাস, তোর দাদি উনার কাছে ডাল ভাত।
নুসরাত বোঝার মতো করে মাথা নাড়ালো। নাজমিন বেগম নুসরাতের মাথায় গাট্টা মেরে বললেন,”তোর কপালে শনি নাচছে রে নুসরাত। আজকের দিনে এসব পরেছিস কেন?
নুসরাত নাজমিন বেগমের কথা পাত্তা দিল না। ভদ্র মহিলার এক কথা বললে সে দশ কথা শুনিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। নুসরাত সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে উচ্চ শব্দে সালাম দিল রুমানা খাতুনের উদ্দেশ্যে। রুমানা খাতুন তীক্ষ্ণ চোখে দু-জনের উপর থেকে নিচের দিকে তাকালেন। ইসরাত ঝুঁকে পা ধরে সালাম করলো। রুমানা খাতুন হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
নাজমিন বেগম কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিলেন নুসরাতকে পা ধরে সালাম দেওয়ার জন্য, নুসরাত তার জায়গা থেকে এক পা নড়লো না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রুমানা খাতুন মেহেরুন নেছার দিকে জিজ্ঞাসার চোখে তাকাতেই মেহেরুন নেছা কর্কশ গলায় বললেন,”বড়ডার বউ আপনাকে যেইডা পা ধইরা সালাম দিছে,আর ছোডোডার বউ ওই যে ওখানে যেইডা দাঁড়াই আছে।
“আর জায়ানের বউ কোথায়?
“এখনো আয় নাই, জায়ান আনতে গেছে।
রুমানা খাতুন লাঠি ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ইসরাত কে বললেন,” জায়িনের বউ বসো আমার পাশের খালি জায়গায়। আরশের বউকে একটু পরোখ করে দেখে আসি। মেয়ে তো আমার দিকে আসছেই না।
নুসরাতের সামনা-সামনি হতেই দু-জন দুজনের দিকে পরোক্ষ দৃষ্টি তাকালো। নুসরাতের মুখে হাসি নেই ঠোঁট সুক্ষ্ম করে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাতের পাশে দাঁড়াতেই দু-জন সমানে সমায় প্রায় হয়ে গেলেন।
“আরশের বউ দেখছি আমার থেকে ও লম্বা।
নাজমিন বেগম হালকা হাসলেন। নুসরাত ভদ্র মহিলার দিকে তাকালো। মুখ দেখতে কিছুটা পাকিস্তানি মানুষের মতো। মায়ের কাছ থেকে মনে হয় একবার শোনেছিল আরশদের নানি পাকিস্তানি ছিলেন। প্রেম করে বিয়ে ছিল তাদের নানার সাথে। বয়স হওয়ায় মুখে ছাপ পড়েছে কিন্তু চামড়া এখনো সতেজ রয়েছে। মুখের ভাষা ধারালো আর সাথে তীক্ষ্ণ। তা আজ সচক্ষে দেখে নিচ্ছে।রুমানা খাতুন নুসরাত কে অবাক করে দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। নাজমিন বেগম হা করে তাকিয়ে তাকলেন বাজি পালটে যেতে দেখে। বিস্ময়ে চোখ মুখ ঝাপটালেন।
আরশ আর জায়িন ছাদ থেকে নেমে আসলো নানি আসার কথা শোনে। নুসরাতের গালে চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে আরশ আর জায়িনের দিকে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলেন।
আরশের কানে কানে বললেন,
“তোর বউ তো দেখছি আমার থেকে এক ধাপ উপরে। আমার থেকে মুখ বেশি চলে নাকি?
আরশ হালকা হেসে মাথা চুলকালো। নুসরাতের দিকে আড় চোখে একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।
“কীভাবে পটালি?
” রাতে বলি নানি।অনেক কাহিনী এখন বলতে গেলে সময় পার হয়ে যাবে।
জায়িনকে কানে কানে কিছু বলতেই জায়িন কেঁশে উঠলো। নানিকে সামান্য শাসানো গলায় বলল,”নানি লজ্জা বেঁচে দিয়েছো?
রুমানা খাতুন বাহু বন্ধন থেকে ছেড়ে দিলেন নাতিদের। হালকা হেসে জায়িনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ালেন।
“তোদের ছোটবেলা মুদি দোকানে খাওয়াতে নিয়ে সব বেঁচে দিয়েছিলাম।
ইসরাতের কপালে চুমু খেতে খেতে বললেন,
“তোমাকে দেখে আমি এতো মুগ্ধ হয়েছি যে আদর করে দিতে ভুলে গিয়েছি। দুঃখিত….
ইসরাত হালকা হাসল সৌজনতা বজায় রাখতে।মেহেরুন নেছা আর রুমানা খাতুনের গল্প আসর বসলো। মেহেরুন নেছাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমানা খাতুন একের পর এক উস্কানিমূলক বাক্য বলতে শুরু করলেন।
” তা বেয়াইন, এতো ভালোবাসার নাতির বিয়ের অনুষ্ঠানে আসলেন না কেন?
রুমানা খাতুন দাঁত বের করে হাসলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,”আসলে তখন আমি আমার ছোট ছেলের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম, তাই আসতে পারিনি।
রুহিনি জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনার ছোট ছেলে কোথায় থাকে?
নাজমিন বেগম বললেন,
” তুমি জানো না, খালার তো সব ছেলেই আমরিকায় থাকে।
ঝর্ণা মুখ আমরিকার কথা শুনে ইয়া বড় হয়ে গেল।
মেহেরুন নেছা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
“তাইলে চইলা আইলেন কেন?
রুমানা খাতুন কপাল গুটালেন। ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
“আপনার সমস্যা হচ্ছে আমি চলে আসায়?
মেহেরুন নেছা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন,
“আমি কখন কইলাম এডা?
” না আপনার কথা শুনে মনে হলো আপনি খুশি না আমি আসাতে।
নুসরাত ঠোঁটে ঠোঁট চেপে না হাসার প্রয়াস করে গেল। ইসরাত দু-জনের মাঝে নিরপেক্ষ বসে রইলো। ভিতরে ভিতরে হেসে ফেটে যাচ্ছে কিন্তু সামনে হাসির তোড়ে শুধু শরীর নড়ছে। রুমানা খাতুনের সাথে কথায় পেরে উঠলেন না মেহেরুন নেছা। মুখ লটকে বসে রইলেন।
এনিভারসেরি অনুষ্ঠান শুরু হলো সাড়ে সাতটার দিকে। ডি-এস-এল-আর আর ভিডিও করার জন্য লোক বুক করে রেখেছিল জায়ান। একে এক সবাই ছাদে যেতে শুরু করলেন। মেহেরুন নেছার হাঁটুতে ব্যথা হওয়ায় আরশ কোলে করে নিয়ে গেল ছাদে। জায়িন কোলে নিতে চাইলো রুমানা খাতুনকে তিনি লাঠি তুলে শাসালেন জায়িনকে তাকে স্পর্শ না করার জন্য। লাঠিতে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে ছাদে গেলেন রুমানা খাতুন। সবাই যে যার রুমে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য সেজে গুজে রেডি হচ্ছে।
আরশ গ্রে কালার শার্ট, নেভিভ্লু কালার ফরমাল প্যান্ট পড়ল। পায়ে নাইকের লগো বিশিষ্ট ব্ল্যাক কালার শু, চুলে জেল দিয়ে সুন্দর করে এক পেশে করে সেট করে রাখলো।
নুসরাত চুল পনিটেল করলো। গ্রে কালার ফরমাল প্যান্ট আর সাদা রঙের স্কিনি টি-শার্টের উপর সাদা কালার ফরমাল শার্ট পড়ল। পায়ে শর্ট হাই হিল পরে আয়নার সামনে নিজেকে একবার পরখ করে নিল। ঠোঁটে লিপ গ্লোস দিয়ে ঠোঁটের সাথে ঠোঁট ঘষে উপর-নিচ লাগিয়ে নিল। ঠোঁট থেকে লিপ গ্লোস দু-আঙুল দিয়ে ট্যাপ ট্যাপ করে নিয়ে গালে ঘষে নিল।
“শেষ?
” হু!
আরশ এক হাত এগিয়ে দিল। নুসরাত নির্দ্বিধায় আরশের হাত চেপে ধরে এগিয়ে গেল রুমের বাহিরে।
ইসরাত ডার্ক রেড কালার সিল্কের শাড়ি, ঠোঁটে ডার্ক রেড কালার লিপিস্টিক, চুল গুলো মাঝ বরাবর করে পিছনের দিকে অর্ধেক রাখলো আর সামনের দিকে অর্ধেক রাখলো। মুখে লাইট মেকআপ, পায়ে সেন্ট লরেন্টের হাই হিল পড়ল। ইসরাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একবার দেখে নিল। নিজে নিজেকে বলল,”খারাপ লাগছে না, ভালোই লাগছে।
রুম থেকে বের হতেই দেখা হলো জায়িনের সাথে যে কালো রঙের শার্ট আর কালো রঙের প্যান্ট পরে ইসরাতের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। ইসরাতকে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুক্ষণের জন্য জায়িন থমকে গেল। মুগ্ধ চোখে ইসরাতের উপর থেকে নিচে চোখ বুলালো। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে এসে ইসরাতের হাত চেপে ধরলো।
জায়িনের তীব্র দৃষ্টির প্রকোপে ইসরাত নিজের চোখ মাটির দিকে নামিয়ে নিল। জায়িন ইসরাতের কোমরে চেপে ধরতেই ইসরাতের শরীর শিরশির করে উঠলো। ইসরায় ঠোঁট কামড়ে তাকাতেই, জায়িন গম্ভীর গলায় বলল,
“মেডাম!
ইসরাত কেঁপে উঠলো হালকা। মাথা নাড়িয়ে হু বললো।
জায়িন বলল,
” আপনার হাতটা কি ধরতে পারি?
ইসরাত কিছুটা খোঁচা দিয়ে বলল,
“হাত তো ধরেই ফেলেছেন,এখন পারমিশন নিয়ে কি করবেন?
জায়িন ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,
” তাহলে চলুন ম্যাডাম। দেরি হয়ে যাচ্ছে।
ইসরাত মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে গেল। ছাদে গিয়ে দেখলো লিপি বেগম এবং হেলাল সাহেবকে চোখ বেঁধে দাঁড় করিয়ে রেখেছে আরশ আর জায়ান।
জায়িনকে দেখেই জায়ান বলল,
“তোর জন্য অপেক্ষা করছিলাম তাড়াতাড়ি আয়!
জায়িন এগিয়ে আসলো। তিন ছেলে তিন পাশে দাঁড়িয়ে চোখে থেকে কাপড় সরিয়ে দিতেই সবাই বলে উঠলো, “সারপ্রাইজ!
লিপি বেগম হালকা হেসে উঠলেন। রুমানা খাতুন কে উপস্থিত দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করলেন। আলিঙ্গন শেষে খবরা-খবর জিজ্ঞেস করলেন মায়ের।
জায়ান বলল,
” নানুর সাথে পরে কথা হবে আগে কেক কাটো।
হেলাল সাহেব আর লিপি বেগম কেক কাটতে শুরু করলেন। সবাই সমস্বরে বলল, “হ্যাপি থ্রাটি ইয়ার এনিভারসেরি।
কেকে কেটে একে একে লিপি বেগম সবাইকে খাওয়াতে শুরু করলেন। মেহেরুন নেছা এক পাশে নাক ফুলিয়ে বসে রইলেন। হেলাল সাহেব কেক নিয়ে আগে মাকে খাওয়ালেন। পরে সবাইকে খাওয়াতে লাগলেন।
কেক কাটার পর কিছুক্ষণ গল্প-গুজব করে সবাই যে যার রুমে চলে গেল ফ্রেশ হওয়ার জন্য। মাহাদি আসলো অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর। আরশ রাগী চোখে তাকালো, কোনো কথা বলল না।
অনিকা আর ইরহাম গিটার, সসের বোতল আর কয়েকটা ফোল্ড করা কাগজের টুকরো নিয়ে এসে বসলো ছাদের মেঝেতে। সবাইকে আসার জন্য বলা হলো। জায়িন আসতে চাইলো না, জায়ান টেনে নিয়ে আসলো। নুসরাত আরশকে বগলদাবা করে নিয়ে এসে বসল নিজের সাথে। ইরহাম বোতল ঘুরাল। প্রথমবার নুসরাতের দিকে বোতল গিয়ে থামলো।
ইরহাম জিজ্ঞেস করলো,
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৫৪ (২)
” ট্রুথ ওর ডেয়ার?
“ট্রুথ!
“আচ্ছা বল, তোর জীবনের ফাস্ট পিয়োরিটি কি?
নুসরাতের ভারী গলার আওয়াজ,
“আমি নিজে!
ইরহাম,অনিকা, মমো চিৎকার করে বলল,
” কি?