প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৪ (২)
জান্নাত নুসরাত
কাঠফাটা রোদের দাপটে জনজীবন বিরক্ত। শীতে ও শীত ঠিকভাবে পড়েনি আর এখন শীত শেষ হওয়ার আগেই গরম পড়ে গিয়েছে।
সময় বিবর্তনে জায়িনের সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ টা এখন ডেভেলপমেন্ট করছে। তার ইচ্ছা আছে এটা আরো বড় করার তাই ফ্রান্সে এর একটা ব্রাঞ্চ খোলার চিন্তা মাথায় ঘুরছে। কিন্তু একটা থেকেই যায়! এটার জন্য সরকারের পারমিশনের প্রয়োজন! আর এই পারমিশন পেতে হলে আবেদন করতে হবে। আর তার জন্য ওখানে যেতে হবে। জায়িন চিন্তা ভাবনা এক পাশে ফেলে পাসপোর্ট চেক করলো। পাসপোর্টের ডেইটের এখনো পনেরো দিনের মতো আছে। ইসরাতের পাসপোর্টের ডেইট দেখার জন্য তার রুমে গেল। তন্ন তন্ন করে খোঁজলো পাসপোর্ট ব্যাগ। কিন্তু খুঁজে পেল না। বিরক্ত হয়ে যখন ফিরে যেতে চাইলো তখন হঠাৎ চোখ পড়ল মিররের পাশে রাখা ছোট্ট বারিস্টুলের উপর।
জিহ্বা বের করে ঠোঁট ভিজিয়ে নিল। একবার উঁকি মারল বাহিরে। কাউকে না দেখে বুকের ধক ধক শব্দ নিয়ে এগিয়ে গেল ব্যাগের দিকে। ব্যাগের চেইন খুলে দরজার দিকে তাকালো। না কেউ নেই! নিজেকে শাসাো, এটা তোর নিজের বাড়ি, তুই কেন ভয় পাচ্ছিস? তুই তো আর কিছু চুরি করছিস না জায়িন।
জায়িন ব্যাগ খুলে কাঙ্কিত বস্তুটি পেয়ে ব্যাগের চেইন লাগিয়ে নিজ জায়গায় রেখে দিয়ে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে গেল। তড়িগড়ি করে যেতে গিয়ে ইসরাতের সাথে ধাক্কা খেল।
চোখ ফিরিয়ে জায়িন সামনে ইসরাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছিটকে দূরে সরে গেল। ইসরাত ভ্রু বাঁকাল। জায়িনের দিকে সন্দেহি নজরে তাকিয়ে বলল,”কি হয়েছে? চুরের মতো করছেন কেন?
জায়িন গম্ভীর গলায় বলল,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“কি, কি চুরের মতো করছি?
ইসরাত শীতল চোখে তাকিয়ে বলল,
” এই তো চোরের মতো করছেন? আর আমি আপনাকে নরমাল একটা কুয়েশ্চন করেছি, আর আপনি এমন তোতলাচ্ছেন কেন?
জায়িন রাগী গলায় বলল,
“তো তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?
ইসরাত থতমত খেয়ে বলল,
” আমি সেটা কখন বললাম!
জায়িন ঢোক গিলল। মিছি মিছি রাগ কণ্ঠে আনতে চাইলো।
“তোমার কথা দ্বারা তা প্রকাশ পাচ্ছে।
” কি প্রকাশ পাচ্ছে?
জায়িন ইসরাতের কথার উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। ইসরাত পিছন ফিরে বলল,”কি হয়েছে আপনার? এরকম রাগ করছেন কেন? আমি কি করেছি?
জায়িন নিজের রুমে ঢুকে শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দিল। ইসরাত বিড়বিড় করে বলল,”কি এমন বললাম, যে রাগ করে চলে গেল।
জায়িন রুমে ঢুকে শান্তির শ্বাস ফেলল। ইসরাতের পাসপোর্ট পকেট থেকে বের করে ভিলেনের মতো করে ঠোঁট বাঁকা করে হাসল।
পাসপোর্টের ডেইট চেক করতেই চোখে পড়ল—ইসরাতের পাসপোর্টের ডেইট শেষ হবে মে এর শেষে গিয়ে। জায়িন নখ মুখে দিল। নখ কামড়াতে কামড়াতে ভাবতে লাগলো ইসরাতকে নিজের সাথে কিভাবে নিবে?
মাথায় কিছু আসলো না। ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলো। পায়চারি করতে লাগলো এদিক-সেদিক। আর ভাবতে লাগলো কি করা যায়! কি করলে ইসরাতকে নিয়ে যেতে পারবে!
তার চিন্তার মধ্যে রুমের বাহির থেকে নক করার শব্দ আসলো। জায়িন বিরক্তির চোখে তাকিয়ে বলল,”আসো!
ইসরাত রুমে প্রবেশ করলো ধীর গতিতে। জায়িন একবার তাকালো। এই মেয়ে হাঁটলে একটা পিঁপড়া ও মরবে না তার কাছে মনে হয়। ইসরাত ধীরে হেঁটে এসে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। চিড়নি দিয়ে চুল আঁচড়ে নিয়ে পিঠে ছড়িয়ে দিতেই জায়িন এসে পিছন থেকে ইসরাতের কোমর চেপে ধরলো। হাত পিছন থেকে নিয়ে এসে সামনে রাখলো। নাক ঢুবাল ঘাড়ে! শ্বাস টেনে নিল। নাকে লাগলো বেলি ফুলের সুবাস।
ইসরাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। জায়িন ইসরাতের কাঁধ ধরে নিজের দিকে ফিরাতেই দরজায় নক পড়ল। জায়িন দরজার দিকে তাকিয়ে বকে উঠলো। ইসরাতের কাঁধ ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে গেল। দরজার বাহির থেকে বাচ্চা বাচ্চ কন্ঠে আহান বলল,”ভাইয়া সকালের নাস্তা করার জন্য ডাকা হচ্ছে।
জায়িন গম্ভীর গলায় বলল,
“আসছি তুমি যাও!
আহান গেল না। মিনমিন করে বলল,
” আম্মু বলেছে আপনাকে সাথে নিয়ে আসার জন্য।
জায়িন বিরক্তির শ্বাস ফেলল। ইসরাত জায়িনের অবস্থা দেখে ঠোঁট এলিয়ে হাসল। জায়িন বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে আসলো রুম থেকে। ইসরাত ও পিছন পিছন আসলো।
সিঁড়ির সামনে গিয়ে দেখতে পেল নুসরাত মুখ গম্ভীর করে দাঁড়িয়ে আছে—আর আরশ নুসরাতের সাথে বকবক করছে।
জায়িন বিড়বিড় করলো,
“আজ কি সূর্য উল্টো দিকে উঠেছে, নাকি তার দিক পরিবর্তন করছে
ইসরাত জায়িনের কানে ফিসফিস করে বলল,
” ওটা আপনার না জানলে ও চলবে! ওসবের জন্য নাসা আছে!
জায়িন কথা বাড়ালো না। নুসরাতের পাশ কাটিয়ে চলে গেল।
খাবার টেবিলে সবার শেষে এসে উপস্থিত হলেন মেহেরুন নেছা। আজকাল উনার ফ্যাশন চেঞ্জ হয়েছে। বাড়িতে শাড়ির বদলে মেহেরুন নেছা কুর্তি আর প্যান্ট পরে ঘুরেন। ঠোঁটে লেগে থাকে মিষ্টি হাসি,এখন তিনি চা আর পান খান না,উনার মতামতে ওসব গরীব রা খায়। উনি খান ব্ল্যাক কফি! খেতে তিতা লাগলে ও মেহেরুন নেছা খাওয়ার চেষ্টা করেন। এমন ভাব করেন যেন কিছু হয়নি।
আরো অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। নিজের ফিটনেসের দিকে নজর দিচ্ছেন তিনি। রোজ সকালে এখন শসা, গাজর, ফ্রুটস, আর টমেটো দেওয়া স্যালার্ড খান। এসবে বিরক্ত হেলাল সাহেব। মেহেরুন নেছার এসব কাজে কিছু বলতে পারেন না—মা বলে, শুধু মুখ বুজে সহ্য করতে হচ্ছে।
মেহেরুন নেছা চোখে চশমা নিয়ে এসে বসলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন,”বড় বউ!
“জি আম্মা!
“নাইফ আর কাটাচামচ কই?
লিপি বেগম তড়িগড়ি করে কিচেন থেকে ছোটো খাটো নাইফ এনে দিলেন। মেহেরুন নেছা বিরক্তির স্বরে বললেন,”বড় বউ তোমার খেয়াল কোথায় থাকে?
” দুঃখিত আম্মা, ভুলে গিয়েছিলাম!
মেহেরুন নেছা শাসানো গলায় বললেন,
“এরপর থাইকা যেনো মনে থাকে কডাডা!
মেহেরুন নেছা নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বললেন,
” তুই আমারে ইংলিশ শিখাইবি কবে থাইকা?
নুসরাত গম্ভীর গলায় বলল,
“শিখাবো,আমার কিছু কাজ আছে অফিসের ওগুলোর রিপোর্ট জমা দিয়ে শিখাবো তোমায়।
মেহেরুন নেছা মাথা নাড়ালেন। হেলাল সাহেব বিরক্তির স্বরে বললেন,”আম্মা তুমি এখন ইংলিশ ও শিখবে?
“হো শিখুম! কখন কোনডা দরকার লাগে তা তো আর কওন যায় না। বিপদ আপদ তো বলে কয়ে আসবে না! তাই আমি এইখন থাইক্কা প্রস্তুতি নিচ্ছি।
হেলাল শ্বাস ফেলে খাবার খেতে মন দিলেন। কপালে তৈরি হলো গাঢ় ভাঁজ। মেহেরুন নেছার মাথা থেকে এসব কথা কিভাবে ঝেড়ে ফেলবেন এখন সেটা বড় চিন্তার বিষয়! এসব কি মেনে নেওয়া যায়? এই বয়সে এসে মায়ের কর্মকান্ডে হেলাল সাহেব প্রচুর ব্যথিত।
দুপুরে ইসরাত রুমে আসতেই জায়িন পিছন থেকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। ইসরাত ছাড়াতে চাইলে ছাড়লো না।
“এতো দেরি করে রুমে আসছো কেন?
ইসরাত মিনমিন করে বলল,
“একটু কাজ ছিল।
জায়িন ইসরাতে কে নিজের দিকে ফিরিয়ে নাকের সাথে নাক স্পর্শ করতেই বাহির থেকে নকের শব্দ আসলো। জায়িন তিক্ত নিশ্বাস ফেলল। দরজা খুলে বাহিরে না তাকিয়ে জোর গলায় বলতে নিল কি সমস্যা? বলার আগেই নাজমিন বেগমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুখের কথা মুখের ভিতর আটকে নিল। গম্ভীর মুখ বানিয়ে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে।
নাজমিন বেগম বললেন,
” বাবা, তোমাকে নিচে ডাকছে—আর ইসরাত কোথায়?
“জি রুমে!
” ওকে আসতে বলো কিচেনে তরকারি যে বসিয়ে এসেছিল তা পুরে ছাই হয়ে গেল।
জায়িন নিজের ভিতরের রাগ ভিতরে পুষে নিয়ে বের হয়ে আসলো। শান্ত গলায় বলল,”ইসরাত রুমে আছে। আপনি গিয়ে বলে আসুন চাচি। আমি যাচ্ছি।
জায়িন রাগ চেপে কোনো-রকম নিচে গেল। ড্রয়িং রুমে যেখানে সবাই বসে আছে। নুসরাত পায়ের উপর পা তুলে চোখে চশমা এঁটে হাত নাড়িয়ে কথা বলছে।
কথা বলার স্টাইল টা প্রফেশনালদের মতো। জায়িন গিয়ে বসলো। ইরহাম আর জায়ান ও বসে আছে। মন দিয়ে তারা নুসরাতের কথা শুনছে।
নুসরাত আরশের দিকে তাকালো না। সোহেদের দিকে তাকিয়ে বলল,”সারাদ্ মালহোত্রা আমাকে মেইল করেছেন, এন্ড জানিয়েছেন খুব তাড়াতাড়ি তিনি উনার কাছে থাকা পারফিউম সেম্পল পাঠাবেন।
আরশ নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তোর কাছে থাকা রিপোর্ট গুলো এখনো সাবমিট করিসনি কেন?
নুসরাত আরশের দিকে তাকালো না। মুখ গম্ভীর করে বলল,”আরো দুটো ফাইল চেক করা বাকি রয়েছে!
আরশ ওহ বলল। হেলাল সাহেব নুসরাত কে জিজ্ঞেস করলেন,”কি রকম লাগছে ব্যবসার কাজ করতে?
নুসরাত চোখ তুলে এক পলক চাইলো। চুল গুলো খোপা করতে করতে বলল,”ভালো!
হেলাল সাহেব অনিকার দিকে তাকালেন। অনিকা চোখ নামিয়ে নিল নিচের দিকে।
“তুমি কবে যোগ দিচ্ছ ব্যবসায়?
” জি খুব তাড়াতাড়ি!
লিপি বেগম দুপুরের খাবার খেতে ডাক দিলেন। নুসরাত চোখের চশমা ঠেলে নাকের ডগায় তুলল। তার চোখ জ্বালা করছে। মনে হচ্ছে আবার এলার্জি বেড়েছে।
দুপুরের খাবার সময় শুধু চামচের টু টাং শব্দ ছাড়া দ্বিতীয় শব্দ হলো না।
রাতের বেলা জায়িন বাহির থেকে হাঁটাহাঁটি করে রুমে এসে ইসরাতকে দেখলো বিছনায় শুয়ে আছে। জায়িন লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে ইসরাতকে জড়িয়ে ধরলো।
“আরে এভাবে জড়িয়ে ধরলেন কেন?
” আমার রোমান্স করতে ইচ্ছে করছে,আজ সারাদিন তোমাকে পাই নি,যখনই রোমান্স করতে গিয়েছি কেউ না কেউ চলে এসেছে।এখন আর ছাড়াছাড়ি নেই।
ইসরাত জায়িনের দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকালো।জা য়িন ইসরাতের গালে চুমু দিতে গেল এমন সময় আবার দরজায় নক হলো। জায়িন নাক মুখ কুঁচকে রাগী দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল দরজার দিকে। ইসরাত জায়িনের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে মেতে উঠলো। বিছানার এপাশ থেকে ওপাশে গড়াগড়ি খেল। জায়িন দরজা খুলে জায়ানকে দেখে নাক মুখ আরো কুঁচকে ফেলল।
“কি চাই? আর এখানে কি?
“আরে ভাই অনেক দিন হলো আমরা আড্ডা দেই না। তাই আজ আড্ডা দিতে ইচ্ছে করছে। চল সবাই মিলে আড্ডা দেই।
জায়িন প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে জায়ান কে বলল,
“এটা কি আড্ডা দেওয়া সময়।
“এটাই তো সময় আড্ডা দেওয়ার আর কতদিন হলো ইসরাতের সাথে ভালোভাবে কথা ও বলিনি।
কথাটা বলে জায়ান মাথা উচিয়ে ইসরাতকে হায় দিল। ইসরাত বিনিময়ে হালকা হাসলো—হেসে হায় করলো।
জায়িন নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে না পেরে জায়ান কে মাথা ধরে ঝুঁকিয়ে পিঠের মাঝ বরাবর কিল বসালো।
“আরে ভাই মারছিস কেন?
জায়িন কথা না বলে জায়ানের পিঠে আরো দু একটা কিল বসিয়ে বড় বড় পা ফেলে বের হয়ে গেল। যেতে যেতে ভাবলো,এই বাড়িতে থাকলে জীবনে রোমান্স করতে পারবে না। রোমান্স করতে হলে এই বাড়ি ছাড়তে হবে। রোমান্স না করলে কি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আসবে? উঁহু না! আসবে না! তাই জায়িন নিচে নামতে নামতে প্ল্যান করে ফেলল আর এই দেশে না। পাসপোর্টের ডেইট পিছিয়ে আনতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই কোরবানি তাকে দিতেই হবে।
রাতের খাবার খেয়ে এসে বেডের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে নুসরাত চুপচাপ বসে পড়ল। পায়ের উপর বালিশ রেখে ল্যাপটপের সাটার অন করে পাস দিয়ে কী-বোর্ডে হাত চালাতে লাগলো।
আরশ রুমে এসে দরজা লাগালো শব্দ করে। নুসরাত ফিরে তাকালো না। আরশ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নুসরাতের সুন্দর করে রাখা লোশন গুলো ফেলে দিল। একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখলো নুসরাত তাকাচ্ছে কি না? না নুসরাত তাকাছ্ছে না! কি রকম নির্লিপ্ত হয়ে বসে তার নিজের কাজ করছে।
আরশ হেঁটে নুসরাতের পাশে গিয়ে বসলো। নুসরাত আড়চোখে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। হাসল মনে মনে। আরশ নুসরাতের পাশ ঘেঁষে বসে ল্যাপটপের সাটার বন্ধ করে দিল। নুসরাত সাটার খুলতে নিবে আরশ ল্যাপটপ হাত থেকে টেনে নিয়ে গেল। নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বলল,”কথা বলছিস না কেন?
ঠান্ডা গলায় বলল,
“কি কথা বলবো?
“যা ইচ্ছা তাই!
নুসরাত কথা বলল না। বিছানার মাঝখানে রাখা ফোন হাতে নিতে যাবে আরশ ছুঁ মেরে মোবাইল নিল নিজের হাতে।
নুসরাত ভ্রু বাঁকিয়ে তাকালো। আরশের পানে এক পলক দৃষ্টি দিয়ে বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইলো।
আরশ নুসরাতের মুখ দু-হাতে চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিল। নুসরাত ঠোঁট ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। আরশ নুসরাতের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,”আমি কিছু বলতে চাই।
নুসরাত গম্ভীর দৃষ্টি এবার আরশের দিকে স্থির হলো। মুখ দেখে বোঝা গেল না মনোভাব কি? নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে বলল,”কি বলবেন,বলুন!
নুসরাতের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে রইলল। মিনমিন করে আওড়াল,”আজকাল তোকে দেখলে আমার হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে যাচ্ছে।
নুসরাত অবাক দৃষ্টিতে আরশের দিকে তাকালো। এমনভাব করলল যেন কিছুই বুঝেনি। কুটিল হেসে বলল,”তাই নাকি, মনে হচ্ছে অনেক জটিল সমস্যা।
আরশ উপর নিচ মাথা নাড়াতে গিয়ে, নাড়ালো না। নুসরাতের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো। নুসরাত আরশের হাত মুখ থেকে সরিয়ে দিল। নিজের হাত নিয়ে গালে রাখলো। তর্জনী আঙুল থুতনিতে রেখে ভাবার মতো করে কিছুক্ষণ বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর গাল থেকে হাত নামিয়ে আরশের পানে দুঃখি দুঃখি মুখ বানিয়ে ঠোঁট উল্টিয়ে চাইলো। ডং করে মুখ কাঁদো কাঁদো করে বলল, “মনে হচ্ছে আপনার হৃৎপিন্ডটা পুরনো হয়ে জং ধরে গিয়েছে। এটা চেঞ্জ করে নতুন একটা হৃৎপিন্ড বসাতে হবে। নাহলে পৃথিবী থেকে টা টা গুড বায় হয়ে যাবেন, তাড়াতাড়ি করে ডাক্তারের কাছে যান।
আরশ ক্রোধে চোয়াল শক্ত করে নিল। নুসরাতের দিকে দাঁত কিড়মিড় করে তাকিয়ে বলে,”ডং করবি না! আমি সিরিয়াস নুসরাত।
“তো আমি কি ডং করছি? আমি ও সিরিয়াস,যান না, যান ডাক্তারের কাছে,তাহলে তো জানতে পারবেন গতি বাড়ার কারণ কি? ডাক্তার খুঁজে বের করে দিবে!
আরশ ঢোক গিলল। এটা তাকে ইচ্ছে করে রাগানোর চেষ্টা করছে তা আরশ ভালোই জানে। চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকলো। ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কীভাবে কনফেস করবে নিজের অনুভূতি?
নুসরাতের হাত চেপে ধরে হাঁটু গেড়ে বিছানার পাশে বসলো সুঠাম দেহের ছেলেটা। পুরুষালি ধারালো চোয়ালে কিছুটা নমনীয়তা নেমে আসলো। ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইলো এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ নিজের ব্যক্তিগত নারীর দিকে। ভয় লাগছে নুসরাত কীভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা নিয়ে। নিজের ভয়কে এক পাশে ফেলে দিয়ে আরশ নুসরাতের মেয়েলি নরম দু-হাত নিজের মুঠোয় পুরে নিল। ঢোক গিলে আওড়াল,”আমি আমার হার স্বীকার করে নিচ্ছি, আমি তোর মায়ায় পড়েছি,আমি আমার কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি, আমি যা যা বলেছি তার জন্য আমি মাফ চাচ্ছি,তুই আমার ভুল গুলো ক্ষমা করে দে,আমরা দু-জন মিলে একটা সুন্দর জীবন সাজাই,এতো মারামারি, ঝগড়া ঝাটি চ্যালেঞ্জ দিয়ে কি হবে? জীবন টা ছোট্ট তাহলে ছোট্ট জীবনটা একটু হাসি খুশি ভাবে উপভোগ করি। তোকে আমি সেদিন যা যা বলেছিলাম তার জন্য আমি দুঃখিত। তুই তোর অভিযোগ গুলো আমাকে বলতে পারিস আমি সেগুলো ঠিক করার চেষ্টা করবো। মানুষ তো ভুলের উর্ধ্বে নয়, আমি ও সেরকম একজন। আমি আমার সব কথা ফিরিয়ে নিচ্ছি, যা যা বলেছি তার জন্য আমি ক্ষমা চাচ্ছি, সব ভুলে গিয়ে সুন্দর করে একটা রঙ্গিন জীবন সাজাই আমরা।
“নুসরাত তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। আরশ ধীরে ধীরে নুসরাতের হাতের মধ্যে মাথা রাখলো, চোখ নিচে নামিয়ে নিল। সে একবারও নুসরাতের দিকে চোখ তুলে তাকালো না।
নুসরাত আরশের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কি বলছেন এসব? আমি বুঝতে পারছি না!
“ডং করবি না নুসরাত, তুই সব বুঝতে পারছিস আমি জানি।
নুসরাত শব্দ করে হাসল। ক্যানাইন দাঁত বের করে ঠোঁট বাঁকালো।
নুসরাত নিজের হাত আরশের মুঠো থেকে বের করে নিয়ে এসে বলল,”চ্যালেঞ্জ হেরে গেলেন সৈয়দ আরশ হেলাল। কি বলেছিলেন যেন? নুসরাত চ্যালেঞ্জ ধরতে যাস না গু হারাণ হারবি!
নুসরাত কথা গুলো বোকা চেহারা বানিয়ে বলল। পরমুহূর্তেই গলা কঠিন করে বলল,”হেরে গেলেন তো আপনি?
নুসরাতের গলা প্রচুর শান্ত শোনালো।
” আমি তো বলেছিলাম আজ না হোক কাল আপনি আমার প্রেমে পড়বেন, দেখেছেন আমার কথা মিলে গেল। তাহলে এখানেই এসবের সমাপ্তি টানি। অনেক ডং, অনেক নাটক, অনেক অভিনয় হয়েছে,আমি আপনার সাথে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। এই দেখুন আমার শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে! আমি শ্বাস নিতে পারছি না।
কিছুক্ষণ থামলো মেয়েটা। আরশ ততক্ষণে অক্ষিকোটরে পানি নিয়ে নুসরাতের পানে তাকিয়েছে। চোখে মুখে ফুটে উঠেছে নিদারুণ অবাকতার রেশ। আরশের দিকে এক পলক নুসরাত তাকালো। অতঃপর বজ্র কন্ঠে হিসহিসিয়ে বলল,”তাহলে এবার ডিভোর্স টা হওয়া উচিত। খুব তাড়াতাড়ি ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিব, আমি লয়ারের সাথে কথা বলছি, দু-একদিনের মধ্যে চলে আসবে ডিভোর্স লেটার। আর বাড়ির মানুষদের তো জানাতে হবে সবকিছু তাহলে আগামীকাল সকালে জানিয়ে দেই। কিভাবে আমাদের বিয়ে হলো? কেন হলো? কি জন্য হলো? আগামীকাল সবাইকে জানিয়ে দিব। যান আজ থেকে আপনি মুক্ত, আমার মতো কালো মেয়ে, বেয়াদব, অভদ্র, আত্মসম্মানহীন, বউকে নিয়ে থাকতে হবে না। আপনাকে মুক্ত করে দিলাম। আমাকে ডিভোর্স দিয়ে যাকে ইচ্ছা তাকে নিয়ে সংসার করুন। এবার আমাকে বিদায় জানান। আমি যাচ্ছি আমার নানার বাসায়!
আরশের চোখের ভিতর ধীরে ধীরে লাল রঙ ধারণ করতে শুরু করলো। হাত শক্ত করে নিজের রাগ আয়ত্তে আনার চেষ্টা করলো, কিন্তু নুসরাতের মুখে ডিভোর্সের কথা শুনে নিজের রাগ সামাল দিতে পারল না। দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হাতে নুসরাতের গাল চেপে ধরে হিস্র কন্ঠে আওড়ায়, “ডিভোর্সের কথা মুখে আনবি না, কীসের ডিভোর্স? এসব কথা বললে মুখ ভেঙে দিব!
নুসরাত হাসল। আজ তার হাসির দিন,সে জিতে গিয়েছে।
“শেষ হোক সব এখানেই! ডিভোর্স লেটার ঠিক সময় এসে যাবে।
নুসরাত আরশের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। বিছানা থেকে উঠে রুম থেকে যেতে নিবে আরশ নুসরাতের হাত চেপে ধরলো। চোখের কোণে জমা হলো পানির অস্তিত্ব।
” তুই বললে আমি তোর পা ধরবো,তবুও ডিভোর্সের কথা বলবি না। আমি আমার ভুল মেনে নিচ্ছি! আমার ভুল হয়েছে, আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি মানছি। তবুও ক্ষমা করে দে।
নুসরাত আরশের দিকে ফিরে তাকালো না। হাত ছাড়িয়ে সামনের দিকে চলে যেতে চাইলো। আরশ ডুকড়ে কেঁদে উঠলো। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে থুতনি হয়ে গলার নিচে চলে গেল। নুসরাতের হাতের মধ্যে নিজের চোখ চেপে ধরে আরশ বিড়বিড় করে বলল,”আমার সাথে তোর সুন্দর ব্যবহার করতে হবে না, আমি তুই যেভাবে থাকতে চাইবি ওইভাবে থাকতে দিব,আমি তোর কোনো কাজে বাঁধা দিব না। আমি লজ্জিত তোকে বডি সেম করায়। আমি তোকে আত্মসম্মানহীন বলার জন্য তুই কষ্ট পেয়েছিস। আচ্চা, আচ্ছা আমি সবকিছু ফিরিয়ে নিচ্ছি। তবুও তুই এতো নিষ্ঠুর হোস না আমার প্রতি প্লিজ।
নুসরাত নড়লে না। তার চোখে এখনো ভাসে সেই দিনের কথা। সে আরশের কান্না দেখলো! খারাপ লাগছে তার কিন্তু সেদিন তো নুসরাতের ও খারাপ লেগেছিল নুসরাত কে তো কেউ শান্তনা দেয়নি! নিজেকে নিজে সামলেছে! একদম ঠিক হয়েছে আরশের সাথে সে মাফ করবে না আরশকে।
নুসরাত পাষাণের মতো দাঁড়িয়ে রইলো স্থির। আরশ নুসরাতের হাত ছেড়ে দিয়ে মুখ চেপে ধরলো হাতের তালুতে। আরশ এলোমেলো কথা বলতে লাগলো। এক কথা ঘুরে ফিরে দু-বার, তিন বার বলল। নুসরাতের গালে বার বার হাত দিয়ে চেপে ধরে কপালে কপাল লাগালো। কান্না গলায় বলল,”এতো নিষ্ঠুর হোস না আমার প্রতি, আমি সর্ব সুখ নিয়ে এসে তোর পায়ের তলায় দিয়ে দিব।
নুসরাত গলা শান্ত। শক্ত গলায় কথা বলায় বোঝা গেল না ভিতরের মনোভাব। আরশের দিকে তাকিয়ে হাসল। নুসরাতের এই হাসি আরশের কাছে মনে হলো বড় নিষ্ঠুর! হাসি কি শুধু নিষ্ঠুর? এই রমণী টি পুরো নিষ্ঠুর! এর মতো পাষাণ হৃদয়ের মানুষ আরশ আর দেখেনি।
“বুকে যে ক্ষত তা কীভাবে ভরবেন আরশ?
আরশ নুসরাতের দিকে কান্না চোখে তাকালো। কান্না গলায় বলল,” প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাস না। আমি তোকে ছাড়া বাঁচবো না। আই কান্ট লিভ উইথহাউট ইউ।আই কান্ট সুইটহার্ট ….
নুসরাত হাসল আবার।
❝পৃথিবী তে কেউ কাউকে ছাড়া মরে না। এই দেখুন আমার সবাই থেকে ও কেউ নেই। তবুও আমি মরিনি। আপনার বড় ভাইকে দেখুন। কি বলেছিলেন? ডেলাকে ছাড়া বাঁচবে না। দেখুন, এখন আপনার ভাই ও বেঁচে আছে। ইসরাতের সাথে মানিয়ে নিয়ে ঠিক সংসার ধর্ম পালন করছে। ওসব ভালোবাসা, টালোবাসা, কিছুর এই পৃথিবীতে অস্তিত্ব নেই। মানুষ ভালোবাসে টাকা আর রুপকে। যার টাকা আছে, তার মূল্য আছে। যার রুপ আছে, তার মূল্য আছে। ❞
নুসরাত আরশের হাত মুখ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দরজা দিয়ে বের হতে নিবে আরশ নুসরাতের পা চেপে ধরলো। নুসরাত ছিটকে দূরে সরে গেল। চোখ মুখ উল্টে আরশের দিকে তাকাতেই আরশ মৃদু গলায় শুধায়,”এবার তো মাফ করবি তাই না,আমি পা ধরছি তোর,তুই যা বলবি তাই করবো, আমি তোর সব ক্ষত সারিয়ে তোলার চেষ্টা করবো।
নুসরাত হাসল। আরশের কাছ ঘেঁষে বসলো। হাত ছাড়াতে চাইলো পা থেকে, আরশ ছাড়ল না,দু-হাতের দৃঢ় বন্ধনে আবদ্ধ করলো পা।
“আরশ পা ছাড়ুন! এসব কোন ধরণের আচরণ?
আরশ ছাড়তে চাইলো না পা। নুসরাত জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিল। রাগী চোখে তাকিয়ে উঠতে যাবে আরশ দুই হাত দিয়ে নুসরাতের মাথা দেয়ালে সাথে চেপে ধরলো। নিজের হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ভিজে চুমুতে রাঙিয়ে দিল পুরো মুখ। ঠোঁটের এক পাশে গাঢ় চুমে খেল,যা শ্বাস রোধ করার মতো ছিল। নুসরাত ছটফট করলো, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, সরে যেতে চাইলো এই দহনীয় অনুভূতি থেকে, আরশ ভ্রুক্ষেপ করলো না, বল প্রয়োগ করলো আরেকটু বেশি। নিজের হাতের মধ্যে মেয়েলি মুখটা চেপে ধরে রাখলো। গালে চাপ পড়ায় ঠোঁট একটু ফুলে উঠতেই সূক্ষ্ম একটা চুমু খেল ঠোঁটের মধ্যে। নিজেকে সামলিয়ে নুসরাতকে একপ্রকার ঝাপটে ধরে পাজোকোলে তুলে নিল। বিছানার দিকে অগ্রসর হলো বড় বড় পা ফেলে। চোয়াল শক্ত করে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলার মতো বিছানায় ফেলল মেয়েলি শরীরটা। শক্ত গলায় আওড়াল,”আজ বলেছিস ডিভোর্সের কথা, আরেকদিন যদি বের হয় তোর মুখ দিয়ে ওই কথা—তাহলে তোর ওই মুখ ভেঙে হাত পা বেঁধে রাখবো। তুই না চাইলে ও আমার সাথে থাকতে হবে আর চাইলে ও আমার সাথে থাকতে হবে। তোর ইচ্ছে বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখন সব আমার ইচ্ছায় চলবে। যদি ভালো লাগে থাকবি, না লাগলে ও থাকবি। এটাই তোর শাস্তি আমাকে বিয়ে করার।
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৬৪
আরশ রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে গেল কান্না চোখে। যাওয়ার আগে রুমের বাহিরে মোটা একটা তালা ঝুলিয়ে গেল। নুসরাত শুধু তাকিয়ে রইলো আরশের যাওয়ার পথের দিকে। মাথা ভনভন করছে তার। আশ পাশ নিস্তব্ধ হতেই নুসরাত নিজের চুল টেনে ধরলো। নিজের গালে একের পর এক থাপ্পড় মারতে লাগলো শক্তি খাটিয়ে। সে জিতে গিয়ে ও হেরে গিয়েছে। তারপর বিছানায় মাথা চেপে ধরে ডুকড়ে কেঁদে উঠলো। নিস্তব্ধ এই রজনীতে নুসরাতের কান্না টা বড়ই করূণ শোনালো।