প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১ (২)

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১ (২)
জান্নাত নুসরাত

নাছির মঞ্জিলের ড্রয়িং রুমের দেয়ালে থাকা ঘড়িটি টিকটিক করে চলছে। সেকেন্ডের কাটা এগারোটা ঊনষাট মিনিটে। কাটাটা ষাটের মিনিটে থামতেই পুরো ড্রয়িং রুম কাঁপিয়ে ঘড়িটা বেজে ওঠল।
নাছির মঞ্জিলে অবস্থানরত সবাই আজ অলস সময় কাটাচ্ছে। সবাই বললে ভুল, একমাত্র নুসরাতই অলস সময় কাটাচ্ছে। ড্রয়িংরুম সহ পুরো বাড়ি অন্ধকার করে রেখেছে। ড্রয়িংরুমের সাথে লাগোয়া ডায়নিং ও অন্ধকার করে রাখা। বড় থাই গ্লাস লক থাকার ধরুন বাহিরের আলো ভিতরে ঢুকছে না। আর ভিতরের আলো বাহিরে যাচ্ছে না। এসি পাওয়ার বিশের ঘরে। ঠান্ডা হাওয়া ভেসে আসছে সুরসুর করে এসি থেকে। সবাই যখন নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত তখনই কলিং বেল বেজে উঠল। মমো অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভেঙে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে গিয়ে গেটের লক খুলে দিল। তখনই বাড়িতে প্রবেশ ঘটল ইরহামের। তাড়াহুড়ো করে বাড়িতে প্রবেশ করতে করতে নুসরাতের উদ্দেশ্যে হাক ছুঁড়ল,”এই কুত্তি মরেছিস কোথায়? গতকাল রাতে তুই কী করেছিস?

নুসরাত মুখ বন্ধ করে ঝুলে শুয়ে থাকল সোফায়। ইরহামের কথার উত্তর দেওয়ার তাড়া দেখাল না। ইরহাম ঠাওর করতে পারল না, আদোও কী এই মহিলা তার কথা শুনেছে নাকি শোনেনি। তাই রাগি কন্ঠে, দাঁতের কপাটি পিষে জিজ্ঞেস করল,”আরশ ভাইকে কী বলেছিস?
নুসরাত চোখ তুলে ইরহামের দিকে একবার তাকায়, তারপর হাতের নখের দিকে মনোযোগ সহকারে তাকিয়ে বলে,”কাকে কী বলেছি?
ইরহাম তিক্ত বিরক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কোমরে হাত দিয়ে। হাত নিশপিশ করছে, ধরে নুসরাতকে কয়েকটা লাগানোর জন্য। হাত আলগোছে প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে নিল। খাঁমচে ধরে জিজ্ঞেস করল,”তুই কিছু বলিসনি?
নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়ায়। ইরহাম সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বলে,”ফোন দে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

ইরহামের কথা শুনে চোখ বোলায় আশে-পাশে মোবাইলের খুঁজে। নিজের আশেপাশে কোথাও খুঁজে না পেয়ে তন্নতন্ন করে সব জায়গা খুঁজে। সোফার উপর নিচ খোঁজ করে কোথাও খুঁজে পায় না মোবাইলটা। হঠাৎ মনে হয় ফোন তো তার পকেটে তাই নিজের মথায় একটা গাট্টা মেরে ফোন পকেট থেকে বের করে ইরহামের হাতে দিয়ে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,”তোদের ছোট ভাই কী আমাকে ফোন করেছিল?
ইরহাম কথা বলে না। লক খুলে কল লিস্টে ঢোকতেই নুসরাত তাবা মেরে নিজের মোবাইল নিয়ে নেয়। ভ্রু একপেশে করে বলল,”আমার প্রশ্নের উত্তর দে।
ইরহাম আবার তাবা মেরে মোবাইল নিজের হাতে টেনে নেয়। রাগি কন্ঠে বলে,”কীসের উত্তর দিব?
নুসরাত কর্কশ কন্ঠে শুধায়,

“তুই বলবি না, ছোট ভাইয়ের কী হয়েছে?
ইরহাম দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে,
” জ্বর এসেছে।
নুসরাত গোল গোল চোখে তাকায় ইরহামের দিকে। হতবিহ্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”জ্বর আসলো কীভাবে?
ইরহাম নুসরাতের মাথায় গাট্টা মারে। রাগি কন্ঠে বলে ওঠে,”তুই গতকাল রাতে ভাইয়াকে কী বলেছিস? মাহাদি ভাইয়া বলেছে, তোর উল্টা-পাল্টা কথা শুনে আরশ ভাইয়ের জ্বর চলে আসছে।
নুসরাত মাথা চুলকে মনে করার চেষ্টা করে, আদোও কী কোনো ভাই তাকে ফোন দিয়েছিল। মাথা থেকে বের হয়ে গেছে ঘুমের জন্য তার। মাথায় চাপ দিতেই আকস্মিক গতকাল রাতে নিজের করা ঘুমের ঘোরে সকল কথা এক নিমেষে মনে পড়ে গেল। মনে মনে জিভ কাটল৷ উপরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে মাথা চুলকালো বোকাদের মতো। দাঁত কেলিয়ে হেসে মিথ্যা বলল ইরহামের নিকট,”আসলে ভুলে গেছি।

ইরহাম নুসরাতের মোবাইল টেবিলের উপর রেখে দেয়। নুসরাত গা ঘেঁষে বসতে বসতে এমনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,”তোর এমন-কী কথা শুনে আজ সকালে ভাইয়ার জ্বর চলে এসেছে?
নুসরাত মাথা নাড়াল। ইরহাম চোখের পলক ফেলে নুসরাতের দিকে মাথা ঘোরায়, গাল চেপে ধরে রাগি কন্ঠে বলে ওঠে,”মনে করার চেষ্টা কর কী বলেছিলি?
নুসরাতের মুখ ফসকে, না চাইতেও বের হয়ে আসে,
“বলেছি, জামাই ছোটবেলা মরে গেছে।

কথাটা শেষ করতেই নিজের জিভ কাটে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে নেয় নিজের বোকামির জন্য। কত বড় গাধা সে, ইরহামের কথায় এসে এভাবে ভুলে বলে দিল। চোখ-মুখ কুঁচকে ইরহামের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে কার্টুনের মতো হাসল। ইরহামের দু-হাত নিজের আয়ত্তে নিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল,” থাপ্পড় মেরেছে ওই বেটা তোকে?
ইরহামের মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। নুসরাতের হাত থেকে এক হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলে ওঠে,”সকালে উঠেই ভাই বাঘের মতো আমার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল। আমি বেচারা ব্রাশ রেখে দৌড়ালাম ভাইয়ের রুমের দিকে। রুমে প্রবেশ করার পর দেখি উনার বিটকেল বন্ধু মাহাদি ডিভানে বসে আছে। আড় চোখে ভাইয়ের দিকে তাকাচ্ছে আর হি হি করে দাঁত কেলাচ্ছে। ভাইকে ওই সময় কী-রকম জঘন্য লাগছিল তুই জানিস না? এই গরমের ভিতর বেটা একটা হুডি আর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে বসেছিল। আমি বাচ্চা শিশু প্রথমে ভাইকে এমন দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছিলাম, মনে করেছি কী-না কী প্রয়োজন! বেটার মনে হয় কাপড়ের দরকার আছে। মনবতা দেখিয়ে ভাইয়া বলে ডাক দিতেই ওই বেটা এসে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিল কোনো কথা ছাড়া। আমি যে ওখান থেকে নড়ব তার কোনো পথ ছিল না, এরপরে আরেকটা থাপ্পড়, এরপর আরেকটা, এরকম করে পুরো তিনটা থাপ্পড় মেরে দিল-রে বোন। আমি তো অবাক হই একটা বিষয়ে।

নুসরাত ঠোঁটে ঠোঁট হাসছে। ইরহামের বড় বড় করে তাকানো দেখে হাসি থামানোর চেষ্টা করে। ঢোক গিলে হাসি আটকানোর বৃথা চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করে, “কী বিষয়ে?
ইরহাম গালে হাত দিয়ে ভাবে। ঠোঁট চোখা করে সব বোঝার মতো করে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলে,” ওই বেটার জ্বর, কিন্তু এমন থাপ্পড় মারল মনে হলো আমি দুনিয়া থেকে আজকের জন্য বিদায় হয়ে যাবে। নুসরাত তুই যদি দেখতি, চোখ দুটো এরকম লাল হয়ে আছে। টকটকে লাল, যেন কারোর উপরের রাগ আমাকে মেরে কমাচ্ছে। তুই বুঝতে পারছিস?
নুসরাত সোফায় মুখ চেপে ধরে হাসল অনেকক্ষণ। ইরহামের প্রশ্নে উত্তর দিল,”হু বুঝেছি।
“এত খুশি হইয়ো না সোনা, আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, ওই রাগ তোর উপর। সামনে পেলে ধপাস ধপাস করে তোর এই টসটসে গালে দিবে।

নুসরাতের হাসি থেমে গেল। মুখ পাংশুটে বর্ণের করে ওঠে বসল।
এর মধ্যে নাজমিন বেগম উপস্থিত হলেন ডায়নিং-এ। টেবিলের উপর আপেলের পিস রাখতে রাখতে বললেন,” মমো, ইরহাম আসো,খেয়া নাও!
ইরহাম লাফ দিয়ে আসতে আসতে বলে,
“ওহে সুইটহার্ট, এভাবে বললে নিজের জান তোমার জন্য হাজির করব।
নাজমিন বেগম ঠোঁট এলিয়ে হাসলেন। চেয়ার টেনে দিতে দিতে মমো এসে উপস্থিত হলো। ইসরাত ল্যাপটপ হাতে নিয়ে কিছু একটা করছিল। সবাইকে আসতে দেখে সে নিজেও এগিয়ে আসলো। চেয়ারে বসতে বসতে ইরহামের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করল,” অবস্থা কী তোর?
ইরহাম আবেগে আপ্লুত হয়ে গেল। শার্টের হাতা দিয়ে চোখ মোছার ভাব করে নাক টেনে বলল,”আর বলোনা আপু। আমার গার্ল…

পরের কথা বলার আগেই মমো চিমটি কাটল। চোখ দিয়ে ইশারা করে দেখাল নাজমিন বেগমকে। সতর্কতা দিয়ে বলল কোনো রকম উল্টা-পাল্টা কথা না।
ইরহাম মাথা নাড়াল উপর নিচ বুঝেছে সে। নাজমিন বেগম তখনো অধীর আগ্রেহে দাঁড়িয়ে আছেন ইরহামের কথা শোনার জন্য। ইরহামকে চুপ করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,”কী বলছিলে আব্বু, কথা শেষ করো?
ইরহাম অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল। ঠোঁট টেনে নির্বিকার চিত্তে বলল,”তেমন ইম্পর্ট্যান্ট কিছু না।
নাজমিন বেগম আচ্ছা বলে চলে গেলেন কিচেনে। তখনই মমো ইরহামের মাথায় গাট্টা মারল। ইরহাম রাগি চোখে মমোর দিকে তাকাতেই মমো ভেংচি কাটল। ইরহাম ইসরাতের কাছে নালিশ করল,”আপু দেখছ, এরা আমার ছোট হয়ে কীভাবে আমার উপর পুরুষ নির্যাতন করে?
ইসরাত মাথা নাড়ায় হ্যাঁ ভঙ্গিতে। সে দেখছে এরা কীভাবে নির্যাতন করছে তার উপর।
ইরহাম কিড়মিড় করে বলল,

“দূর তুমি কিছু বলছ না কেন এদের?
ইসরাত অবাক কন্ঠে ইরহামের নিকট জিজ্ঞেস করে,
” কী বলব আমি?
ইরহাম আপেলের পিস সবগুলো একসাথে নিজের মুখের ভিতর ঢুকিয়ে নাছির মঞ্জিলের দরজা দিয়ে বের হতে হতে বলে,”এ-বাড়িতে কেউ আমায় ভালোবাসে না, আর থাকবই না এখানে। চলে যাচ্ছি, আজ বিকালে আর একবার আসব শেষ বারের মতো তারপর আরো সাতশতবার এসে আর আসব না।

নুসরাতের পিঠে ধুপধাপ নাজমিন বেগমের হাতের থাপ্পড় পড়েছে কিছুমুহুর্ত আগে। পিঠে মার পড়ার কারণ ও আছে যুতসই। কোথা থেকে বিড়াল ধরে এনে রেখেছিল নিজের রুমে, সেই বিড়াল পুরো রুমে বমি করে ভাসিয়েছে। নাজমিন বেগম একটু আগে ইসরাতের রুমে যাওয়ার সময় এই রুমের ভিতর থেকে বিড়ালের শব্দ পেয়েছিলেন। দরজা খুলে রুমের অবস্থা করুন দেখতেই তিনশত ষাট ডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেল মেজাজ। রাগি কন্ঠে নুসরাতকে জিজ্ঞাসা বাদ করতেই সদর্পে স্বীকার করল বিড়াল সে নিয়ে এসেছে, তাও গর্বের সাথে। নাজমিন বেগম রাগি কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,” এই বিড়ালের বাচ্চা কেন নিয়ে আসছিস?

নুসরাত নাজমিন বেগমের ভুল শুধরে দিয়ে বলল,”বিড়াল না আম্মা, ওকে বিড়াল-জি না হয় বন্দুক-জি বলো।
নুসরাতের কথা শুনেই নাজমিন বেগমের মেজাজ বিগড়ে গেল। হাত আর থামাতে পারলেন না। হাত তুলে তেড়ে এসে কারোর কিছু বোঝে ওঠার আগেই পিঠের মাঝ বরাবর ধুপধাপ কয়েকটা পড়ল নুসরাতের। আর তখন থেকে মুখ ফুলিয়ে ঘুরছে বাড়িতে। অনেকক্ষণ ঘোরার পর যখন দেখল কেউ পাত্তা দিচ্ছে না তাকে, তখন বাড়ির বাহিরে বের হয়ে আসলো। বাগানের উল্টো পাশে গ্যারেজ। সেখানে চোখ পড়তেই দুটো কালো রঙের মার্সিডিজ রাখা দেখল। সেদিক থেকে চোখ সরাতেই চোখে পড়ল নিজের অতি প্রিয় Gixxer SF 155 Fi ABS বাইক। গ্যারেজের দিকে আলগোছে পা বাড়াল নুসরাত। ইরহামকে ম্যাসেজ করল,”বের হো শালা, আজ আমি আর তুই বাইক রাইডে যাব।
মেসেজ পাঠানোর সাথে সাথে সিন হয়ে গেল। উত্তর আসলো,”আচ্ছা আসছি বস।

গ্যারেজের গেট উপরের দিকে টান দিতেই ক্যাচক্যাচ শব্দ হলো। বোঝাই গেল অনেক দিন পুরোনো হওয়ায় জং ধরেছে তাতে। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ভয়ার্ত চোখে বাড়ির মেইন ডোরের দিকে সতর্ক দৃষ্টি ফেলল। না কেউ নেই! ধীরে সুস্থে গেট খুলে গ্যারেজে ঢুকে টেনে বের করে নিয়ে আসলো নিজের অতি প্রিয় বাইক। বাইক নিয়ে যখন নাছির মঞ্জিলের ফটকের বাহিরে বের হলো তখনো খেয়াল করল না, তীক্ষ্ণ চোখে আরশ তার দিকে চেয়ে আছে এক মনে। নুসরাতের দিকে চোখ রেখে দো-তলার রেলিঙে নিজের বলিষ্ঠ হাত জোড়া চেপে ধরে। সদর্পে টানটান করে রাখা শরীর সামান্য বাকিয়ে নেয়, মাথা কাত করে যতক্ষণ ইরহাম আর নুসরাতকে দেখা যায় ততক্ষণ সেই রাস্তার পানে তাকিয়ে থাকে।

আরশের গতকাল রাতে জ্বর হওয়ার জন্য, নাক-মুখ-চোখ লাল হয়ে আছে। ঠোঁটে অদ্ভুত বলিরেখার হাসি। পুরুষলি ধারালো ক্লিন সেভ থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে আরশ রহস্যময় হাসে। বিড়বিড় করে আওড়ায়,”মিসেস আরশ, নিজেকে কীভাবে বাঁচাবেন আমার হাত থেকে?

অলস দুপুর। অবসন্ন চোখ-মুখ নিয়ে মমো বের হয়েছে নাছির মঞ্জিল থেকে। রোদ গাঢ়ভাবে পড়লেও রাস্তার আশ-পাশ শেষ রাতের বৃষ্টির ধরুন স্যাতস্যাতে হয়ে আছে। তাই একটু বুঝে শুনে পা ফেলতে হচ্ছে বাহিরে। একটু ভালো স্বাস্থ্যের হওয়ার জন্য, বৃষ্টি পড়ে থাকা জায়গা পার হতে বেগ পোহাতে হচ্ছে মেয়েটার। মাথা থেকে ওড়না পড়তেই মাথায় আবার ওড়না টেনে নেয়। অন্যমনস্ক হাঁটার ধরুন পাশ কেটে যাওয়া বাইককে খেয়াল করেনি মমো। আর তখনই ঘটে অঘটন। বাইক ওভার স্পিডে থাকার কারণে রাস্তার গর্তে জমে থাকা বৃষ্টির সকল পানি ছিটকে এসে পড়ে মেয়েটার গায়ে। নোংরা পানির সংস্পর্শে মমোর সারা শরীর ভিজে যায়। কাঁদা পানি শরীরের বিভিন্ন খোলা অংশে লাগতেই রিরি করে ওঠে বস্ত্রবিহীন জায়গা গুলো। রাগে দুঃখে ইচ্ছে করল মমোর হাত পা ছুঁড়ে মাটিতে বসে পড়তে। আর তো দু-পা আগালে সৈয়দ বাড়ি। আর এখনই এই বাইক এসে ভিজিয়ে যেতে হলো।

মমো সেই বাইকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলে ওঠে,”রামছাগলের বাচ্চা তুই কী চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিস যে এরকম বাজপাখির ন্যায় বাইক উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিস। আজ যদি মামনি-রা আমাকে নিয়ে হাসে তোকে আমি জিন্দা পুতে ফেলব।

মমোর ভাবতেই কান্না এলো মামনী-রা সবাই একসাথে মিলে তাকে নিয়ে হাসবে। বলবে কী-রে মমো এইটুকু রাস্তা আসতে তুই এভাবে কাদায় গড়াগড়ি খেয়ে নিলি। রাগে ধুপধাপ পা ফেলে সৈয়দ বাড়ির গেটে পা দিয়ে লাথি দিতে লাগল। নিজের অসহনীয় রাগ গেটের উপর মিটাতে চাইল। দুটো লাথি দিতেই গেট খুলে গেল। উপর-নিচ না চেয়ে চোখের পানি কুর্তির হাতার মধ্যে মুছে নাক টানতে টানতে ভিতরে প্রবেশ করল। একবার ও গেট খুলে দেওয়া ব্যক্তির দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না। মমো কান্না মোছা শেষে নাকে সর্দির উপস্থিতি পেল। তা ও আবার কুর্তির হাতার মধ্যে মুছে নিল। সঠান হয়ে দাঁড়ানো মাহাদি নিশব্দে হেসে ওঠল মমোর কান্ডে। বাড়ির বাহিরে বের হতে হতে বিড়বিড়াল,”স্ট্রেঞ্জ!

মানুষের এলোমেলো পদচরণ। একপাশে চায়ের দোকানে লোক সমাগম কথা বলছে। কথা বলা হচ্ছে রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে। একেক জনের একেক মতামত। কোন সরকার থাকলে কী কী বেনিফিট পাওয়া যায়। সবাই নিজ নিজ পছন্দের সরকারের ভালো গুণ তোলে ধরার চেষ্টা করছে কেউই বসে নেই কারোর অপেক্ষায় কম। সবাই সবার অপছন্দের সরকারের খারাপ কথা বলছে, আর এসব বিষয় নিয়ে কিছুক্ষণ পর পর কথা কাটাকাটি শুরু হচ্ছে সবার মধ্যে। সেই আলোচনায় যোগ দিয়েছেন হেলাল সাহেব। নিজের পাশে বডিগার্ড হিসেবে কারেন্টের খুঁটির মতো সোজা দাড় করিয়ে রেখেছেন জায়িনকে। জায়িনের এইসব বিষয়ে কোনো ইন্টারেস্ট আসছে না। আকস্মিক রাজনৈতিক আলোচনায় এসে যোগ দিলেন নিজাম শিকদার। কথায় কথায় উঠে আসলো তরুণ নেতা নাহিয়ান আবরার পূর্বের কথা। হেলাল সাহেব আগ্রহী কন্ঠে জানতে চাইলেন,”নাহিয়ান আবরার পূর্ব নতুন নাম শুনছি! রাজনৈতিক মাঠে নতুন না-কী?

নিজাম শিকদার মাথা নাড়ালেন। প্রশংসনীয় গলায় বলে উঠলেন,”অত্যন্ত ভদ্র একটা ছেলে। এবার বিরোধী দলের হয়ে লড়বে। আমি হলফ করে বলতে পারি নিঃসন্দেহে ওই ছেলেটা জিতবে। নির্বাচিত হবে মেয়র পদে।
হেলাল সাহেব চায়ে চুমুক দেন। চোখের চশমা নাকের ঢগা থেকে উপরে ঠেলে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,” কী এমন জাদু করল ওই ছেলে যে, আপনি এত প্রশংসা করছেন চাচা?
নিজাম শিকদার হাত দিয়ে মাছি তাড়ালেন। নিজের আধ- পাকা পড়ে যাওয়া মাথার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন,”এমনি এমনি প্রশংসা করছি না, ছেলেটা নিঃসন্দেহে একজন ভালো মেয়র হবে। আমাদের বাড়িতে আসলে তোমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব হেলাল। তখন তুমি নিজে ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকবে ওই ছেলের কথায়।
হঠাৎ নিজাম শিকদার কথা থামিয়ে জায়িনের দিকে এক পলক তাকালেন। তর্জনী আঙুল জায়িনের দিকে তাক করে বললেন,”ওই যে আপনার ছেলে ওর মতোই ভদ্র।

হেলাল সাহেব বিরশ মুখে এক পলক চেয়ে নিলেন জায়িনের দিকে। জায়িনের গম্ভীর করে রাখা মুখ খানার দিকে তাকিয়ে থেকে গলা নিচে নামিয়ে কারোর না শোনার মতো বিড়বিড় করে আওড়ালেন,”ভদ্র না ছাই, দুটোই আমার গুণোধর বাপের মতো মিচকে শয়তান হয়েছে।
নিজাম শিকদার কানে শুনলেন না হেলাল সাহেবের ফিসফিস করে বলা কথা। কান এগিয়ে নিয়ে এসে শুধালেন,”কী বললে হেলাল? পরিস্কার করে বলো, শুনতে পাইনি।
হেলাল সাহেব চোখ মুখ স্বাভাবিক করে জানালেন কিছু বলেননি তিনি। নিজাম শিকদার মাথা নাড়ালেন।
জায়িন হেলাল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে নিরলস কন্ঠে অনুমতি চাইল,”আমার একটু কাজ আছে। আপনারা কথা বলুন, হাফ-এন-হাউয়ার এর ভিতর আমি আসছি।

হেলাল সাহেব অনুমতি দিতেই জায়িন দ্রুত পায়ে চলে গেল রাস্তার ওপাশে৷ কুর্তি আর জিন্স পরা একটা মেয়ের পিছু পিছু দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল। রাশভারী গলায় ডাক দিল,”ইসরাত এই ইসরাত।
মানুষের ভীরে ইসরাতের কানে গেল না জায়িনের সেই ডাক। ইসরাত নিজের পায়ের গতি বাড়িয়ে দিয়ে আরো জোরে হাঁটতে নিবে, খড়খড়ে হাতের নরম স্পর্শ পেল নিজের কব্জিতে। তড়াক করে পিছু ফিরে, থাপ্পড় মারার জন্য হাত উপরে তুলতেই গম্ভীর মুখো জায়িনের হাসি হাসি চেহারা চোখে ভাসল। হাত আলগোছে নিচে নামিয়ে নিল। চোখ-মুখে ফোটে ওঠা ক্রোধ নিভানোর বৃথা প্রয়াস করল।

জায়িনের হাতের তালু থেকে নিজের কব্জি ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই, জায়িন চোখ দিয়ে সতর্ক করল হাত ছাড়ানোর চেষ্টা না করার জন্য। তাই ইসরাত ও কোনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করল না। নিজের ভেতরে একটু আগে জমা হওয়া ক্রোধ মিলিয়ে নিল এক নিমেষে নিজের মাঝে। ঠোঁটে হাসির রেখা এনে কিছু বলতে নিবে জায়িন ইসরাতের হাত টেনে মানুষের ভীর নেই এমন জায়গায় এনে দাড় করালো।

বৃষ্টি ভেজা এই মৌসুমে গলবিলে শুষ্কতা অনুভব করল ইসরাত। ঢোক গিলে নিজের শুষ্ক গলা ভেজালো মেয়েটা। তখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে ধৈর্য নিয়ে জায়িনের রাশভারী সেই কন্ঠস্বর শোনার আশায়। জায়িন নিজের পকেট থেকে একটা আধ শুকিয়ে যাওয়া ঝড়ঝড়ে ফুলের গাজরা বের করে ইসরাতের হাতে যত্ন সহকারে পরিয়ে দেয়। ইসরাত অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে থাকল সেই গাজরার দিকে। পেট ফেটে হাসি আসে শুকনো গাজরা দেখে তবু্ও হাসি পেটে চেপে মোলায়েম কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”এই আধ-শুকনো গাজরা আপনি কোথায় পেলেন?
ইসরাতের কথা শেষ হতেই জায়িন নিজের হাতের তালু দিয়ে ইসরাতের গাল স্পর্শ করে। কন্ঠে মোলায়েম-তা এনে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করে,”পছন্দ হয়েছে আপনার?

ইসরাত উপর নিচ মাথা নাড়ায়। ঠোঁট কামড়ে হ্যাঁ কথাটা বলতে গিয়ে মৃদু শব্দে হেসে ওঠে। জায়িন নিজেও ইসরাতের সাথে হেসে ওঠে। শব্দ হয় না সেই পুরুষালি হাসির। শুধু একটু বলিরেখা দেখা যায় শুভ্র সেই মুখে। ঠোঁটের দু-পাশে হাসির রেখা পড়ে। তা ও আবার নিমেষে উধাও হয়ে যায় চাপ-দাড়ি দ্বারা আবরণকৃত গম্ভীর মুখের আড়ালে। ইসরাতের হাত নিজের হাতের মধ্যে যত্ন সহকারে নিয়ে উল্টো পথে হাঁটতে হাঁটতে বলে ওঠে,”আপনি কী জানেন ইসরাত?

ইসরাত গাজরায় চোখের সামনে ধরে হাত বোলাতে বোলাতে বলে,”কী?
জায়িন ইসরাতের মুখের দিকে তাকায়। শুভ্র বর্ণের মুখ রোদের আলোয় লাল হয়ে আছে। গালগুলো টকটকে লাল। যেন জায়িন একটু টোকা দিলেই রক্ত ঝড়ঝড় হয়ে পড়বে। অপার্থিব আদলে, মুখে গম্ভীরতা এনে নিজের গ্রীবা হালকা বাঁকিয়ে ইসরাতের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে জানায়,”আপনি ফুলের মতো সুন্দর।
ইসরাত হাসে। মুখে কিছুটা আগ্রহীতা নিয়ে জিজ্ঞেস করে,” একটা প্রশ্ন করতে পারি?
জায়িন টান টান হয়ে সোজা দাঁড়ায়। ইসরাতের দিকে আড়-চোখে তাকিয়ে বলে,”একটা কেন, একশত-টা জিজ্ঞেস করুন!

ইসরাত হাসল। জায়িনের সাথে চুপচাপ সামনের দিকে না জানা গন্তব্যের দিকে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করল,”আপনি আমার হাত এমন করে ধরেন যেন, একটু শক্ত করে ধরলে আমি ব্যথা পাব। এর কারণ কী?
ইসরাত নিজের মনে প্রশ্নটা সুন্দর করে সাজালেও জায়িনের নিকট বলতে গিয়ে অগোছালো হয়ে গেল। মনে মনে জিভ কাটল এই ভেবে তার মতো দামড়ি মেয়ে সামান্য একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে এভাবে ঘেটে-গ করে দিয়েছে। কী বিচ্ছিরি একটা অবস্থা! লজ্জা, সংকোচ, বিরম্বনায় চোখ মাটির দিকে পতিত করল। উপরে তোলার সাহস হলো না। জায়িন ইসরাতের নিজের প্রতি এত সংকোচ, লজ্জা, বিরক্তি চুপচাপ দেখল। একমনে অবলোকন করল মেয়েলি সেই নীরবতা। অনেকক্ষণ তাদের মধ্যে নীরবে সময় কাটল।কেউ কোনো কথা বলল না। জায়িন ইসরাতকে সময় দিল যাতে নিজের লজ্জা কাটাতে পারে।

সময় অতিবাহিত হলো কিৎকাল। তারপর ও ইসরাতকে চোখ তুলে তাকাতে না দেখে, নিজ উদ্যোগ জায়িন এক-পা আগাল। যা বুঝল সে, এই মেয়ে এখন আর কোনো কথা বলবে না। নিজেদের ভিতরের অস্বাভাবিক নীরবতা ভাঙা আগে জরুরি জায়িন মনে করল। তাই নীরবতা ভেঙে,ইসরাতের তখনকার করা অগোছালো প্রশ্নের উত্তর করল অত্যন্ত মোলায়েম কন্ঠে,”মেয়েরা হলো ফুলের মতো সুগন্ধিময় কোমল। তাদের স্পর্শ করতে হয় কোমলভাবে। ফুলকে যত ভালোবাসা নিয়ে স্পর্শ করি কিন্তু সেটা যদি আমি শক্ত হাতে স্পর্শ করি সেই স্পর্শে ফুলটা নিঃসন্দেহে ঝড়ে যাবে। আপনি আমার সেই সুগন্ধিময় কোমল ফুল, যাকে আমি যত্ন সহকারে স্পর্শ করি, যাতে আপনি কখনো আমার শক্ত হাতের ছোঁয়ায় মুছড়ে না যান। কখনো যেন আমার এই হাতের স্পর্শে আপনি ঝড়ে না যান। আপনার এই ফুলের মতো কোমল শরীর আমার স্পর্শে নষ্ট না হয়ে যায়। আপনি আমার নিকট নিঃসন্দেহে ফুলের থেকে বেশি সুন্দর ও কোমল ইসরাত।

নিকষ কালো অন্ধকারে ডুবে আছে ধরণী। সন্ধ্যার আগ মুহুর্ত। বাতাসের ঠান্ডব চলছে চারিদিকে। বৃষ্টি প্রবল আকার ধারণ করে ধেয়ে আসছে উত্তর দিক থেকে। কিছুক্ষণ পর কল বৈশাখী ঝড় আসার সম্ভাবনা। পাখিরা সবাই পশ্চিমে আকাশে উড়ে যাচ্ছে। আশ্রয় নিচ্ছে নিজ নিজ বাসায়। ভয়ংকর সেই প্রলয়কারী মেঘের ভয়ে নুসরাত আর ইরহাম নিজেরা ও আশ্রয় নিতে ফিরে আসছে নিজ নিজ নীড়ে। নিজেদের একান্ত বাড়িতে। নুসরাত কলিং বেলে চাপ দিতেই গেট আজ খুলে গেল। বোঝাই গেল অধীর আগ্রহে কেউ বসে ছিল নুসরাতের বাড়ি ফিরে আসার অপেক্ষায়। নিজের থেকে দশমন ভারী বাইকটা টেনে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করাতে নুসরাতের বেগ পোহাতে হলো অনেক। কয়েকবার ব্যগি প্যান্টের সাথে পা বেজে উল্টে পড়ে নিতে নিতে নিজেকে সামলালো। বাইক টেনে ভিতরে প্রবেশ করতেই রাশভারী কন্ঠে আরশ বলে ওঠল,”সৈয়দা নুসরাত নাছির কোথায় ছিলেন?

নুসরাত বাইকের সাথে ধস্তাধস্তি করতে করতে অন্যমনস্ক উত্তর দিল,”ইরহামের সাথে।
আরশ এগিয়ে আসতে আসতে দু-পাশে মাথা নাড়াল। ঠোঁট কামড়ে ধরতেই ঠোঁটের উপরের সেই ছোট্ট সুতো পরিমাণ গর্তের সৃষ্টি হয়। একইভাবে গালের এক পাশে গর্ত হয়। চোখ ছোট ছোট করে সূক্ষ্ম করে অবলোকন করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা বাইকের উপর খ্যাচখ্যাচে হওয়া মেজাজের রমণীকে। নুসরাত বাইকের দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে একটা লাথি মেরে সামনে চোখ ফিরাতেই চোখাচোখি হয় আরশের সাথে।

চোখে মুখে ফুটে ওঠে অস্বাভাবিক ভয়। হঠাৎ এভাবে আরশের সাথে দেখা হবে ভাবেনি হয়তোবা। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে আলগোছে পাশ কাটাতে চায় আরশকে, আরশ কব্জি চেপে ধরে থামিয়ে দেয় নুসরাতকে। নুসরাতের হুডির ক্যাপ অন্য হাত দিয়ে মাথা থেকে নামিয়ে দিতেই মেয়েলি মুখটা বের হয়ে আসে। আরশ ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে নিজের মুখ নুসরাতের কানের কাছে নিল। ফিসফিস করে আওড়াল,”মিসেস আরশ,আবারো দেখা হয়ে ভালো লাগল।
নুসরাত আরশের দিকে কিছুটা মাথা কাত করতেই নাকের সাথে নাকের স্পর্শ লাগল। বাতাসের সাথে সুরসুর করে নাকে এসে লাগে পুরুষালি ব্ল্যাকবেরি-এন্ড-বেই পারফিউমের স্নিগ্ধ সেই ঘ্রাণ।

পারফিউমের মাতাল করা সেই সুবাস নাক চিড়ে প্রবেশ করে ভেতরে। আরশ নিজের বলিষ্ঠ দু-হাত দিয়ে নুসরাতের খোপা করা চুলগুলো খুলে দেয় বাতাসে। মুক্ত বাতাসে পাখির ন্যায় উড়তে শুরু করে চুলগুলো। আরশ এবার নিজের দু-হাত প্যান্টের পকেটে পুরে নেয়। দাঁড়ায় টানটান হয়ে। গতকাল রাতে জ্বর আসার জন্য মুখ থেকে গরম নিঃশ্বাস বের হচ্ছে আরশের, তা আবার সরাসরি এসে নুসরাতের মুখে পড়ছে। সুঠাম দেহি শরীরটা সোজা হতেই শরীরের আড়ালে ঢেকে যায় মেয়েলি দেহটা। আরশ চোখ নামায় নিচের দিকে। নিস্প্রভ চোখে লক্ষ করে মেয়েলি মুখটা। নুসরাতকে উদ্দেশ্য করে গমগমে পুরুষালি গম্ভীর আওয়াজে বলে ওঠে,”তেরোতিম বিবাহ বার্ষিকীর শুভেচ্ছা। তেরোটা উপহার নিবেন না, মিসেস আরশ?

নুসরাত চোখ তুলতেই সুঠাম দেহি আরশকে নজরে পড়ে। আরশ নির্বিঘ্নে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে কোনো কিছু নেই। নিস্প্রভ, অনুভূতিহীন সেই দৃষ্টি। কালো মণির চোখ গুলো রক্তের বলিরেখা জমা হয়ে আছে সাদা অংশে। বোঝাই যাচ্ছে জ্বর ভালো করেই কাবু করেছে লোকটাকে। নুসরাত নিজেও সোজা হয়ে দাঁড়ায়। সুঠাম দেহি পুরুষটার চোখে চোখে রেখে দাঁতে দাঁত পিষে কাঠখোট্টা গলায় প্রশ্নের উত্তর দেয়,”উপহার দেওয়া হয় মানুষকে কিনে নেওয়ার জন্য, আর এমন কারোর জন্ম হয়নি যার সাধ্য বা সাহস আছে এই আমাকে কিনে নিবে।
নুসরাতের ফিরিয়ে দেওয়া উত্তর আরশের মনপুত হয়নি তাই মুখে আরো একটু আধার নেমে আসে।দু-জনের ভিতর নেমে আসে গম্ভীর পরিবেশ। নুসরাতের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে আরশ বলে,”উঁহু, সেটা কীভাবে হয়? আপনাকে তো উপহার নিতেই হবে।
নুসরাত চোখ ছোট ছোট করে নেয়। রাগি কন্ঠে বলে,

“আমি নিতে চাইনা আপনার উপহার।
” তারপর ও আমি দেব। এটা আপনার পাওনা আমার নিকট থেকে।
আরশ জেদি গলায় কথাটা বলা শেষ করে। নুসরাত কিছু বলতে নিবে ঠোঁটে হাত রেখে চুপ দেখায় আরশ। নুসরাত অনিহা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। দেখতে চায় আরশ কী উপহার দেয় তাকে। বৃষ্টি ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে। কিৎকাল কেটে যায়। আরশ তখনো সোজা দাঁড়িয়ে, নড়চড় বিহীন। বৃষ্টির তোড়ে যখন দু-জন ভিজে যেতে শুরু করল, নুসরাত আরশকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে যেতে আওড়ায়,” বৃষ্টিতে ভিজলে আবারো জ্বর আসবে, বাড়ি….
কথা শেষ করার আগেই আরশ নুসরাতের কব্জি চেপে ধরে। ঠোঁটে হাত রেখে নিশ্চুপ থাকতে বলে। নুসরাত হাত ছাড়ানোর আগেই রাশভারী হাস্কি আওয়াজে বলে ওঠে,”উপহার নিয়ে যা!

এক মুহুর্তে আপনি থেকে আরশ তুই এ নেমে আসলো। আরশের এমন রং পাল্টানো দেখে নুসরাত স্তব্ধ বনে গেল। কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ উপরে তুলে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই বাঁ-গালে ঠাস ঠাস করে একসাথে চারটা থাপ্পড় পড়ল। নুসরাত কিছু বুঝে ওঠার আগেই আরো দুটো পড়ল। পরপর আরো চারটা। জীবনে প্রথমবার এক সাথে এত থাপ্পড় খেয়ে নুসরাত জ্ঞান হারানোর জোগাড়। নিজেকে সামলানোর আগেই মাথা ঘুরে উঠল। পুরো পৃথিবী তার নিকট শূন্যে ভাসল। চোখ উল্টে পড়তে নিবে আরশ শক্ত করে ধরল হাত দিয়ে। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ভিতরের সকল রাগ উগড়ে বের করে দিল থাপ্পড়ের উপর।

নুসরাত মনে করল এবার মনে হয় থামবে,কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে দিয়ে পরপর আরো তিনটে দাবাং মার্কা থাপ্পড় পড়ল। থাপ্পড়ের শক্ততা এতো বেশি ছিল যে, নুসরাত চোখ মুখ উল্টে নিল। এতক্ষণ যা হুশ ছিল তা হারিয়ে নিজের জায়গা থেকে টলে গেল। দু-পা পিছনে সরে পড়ে যেতে নিবে আরশ কোমর পেঁচিয়ে ধরল। দু-কদম এগিয়ে এসে নিজেদের ভিতরে নূন্যতম দূরত্ব মিটিয়ে নিয়ে গ্রীবা বাঁকায় সামান্য। অর্ধজ্ঞান হারানো নুসরাতের ছেড়ে দেওয়া শরীর নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে নিজের মুখ নামিয়ে নেয় নুসরাতের কানের কাছে। ফিসফিস করে বলে,”কী বলেছিলাম বেশি উড়বি না। ডানা কেটে ছাটাই করে রাখব।

শ্বাস ফেলল সামান্য। চোখের পলক ফেলে গম্ভীর কন্ঠে আবার বলল,”তেরোবার মিথ্যে বলার শাস্তি তেরোটা থাপ্পড়। এইটুকুতে অর্ধজ্ঞান হয়ে গেলি পরে কী করবি?
নুসরাত নিজেকে যথাসম্ভব সামলানোর চেষ্টা করে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। আরশের হাতের বেষ্টনী থেকে নিজের কোমর ছাড়িয়ে নেয়। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হাপিয়ে যাওয়া কন্ঠে বিড়বিড় করে আওড়ায়,”দেখে নিব আপনাকে আরশ। ছাড়ব না আপনাকে আমি।
আরশ চোয়াল শক্ত করে নেয়। হিসহিসিয়ে বলে ওঠে,”বেড রুমে আসিস, শার্টলেস দেখবি।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১

নুসরাত দু-হাতের নখ আরশের কাঁধে দাবিয়ে দেয়। নিজের বোকামিতে নিজের ওপর বিরক্ত হয় নুসরাত। ঘন ঘন শ্বাস টেনে ফেলে বাহিরে। গলার কাছে শ্বাস আটকে আছে। দাঁতে দাঁত পিষে বলে ওঠে,”এই থাপ্পড়ের উচিত জবাব সময়মতো আমি ফিরিয়ে দিব আপনাকে। আপনার এই উপহার আমি সঃযত্নে তুলে রাখলাম আরশ। এবার আমার নিকট থেকে আপনার জন্য ধামাকাদার উপহার আসবে। wait and see what i do, my beloved husband.
আরশ মাথা কাত করে সামান্য। দু-জন দুজনের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিন্তু বিপরীতমুখী। নিজের গ্রীবা সামান্য বাঁকিয়ে নুসরাতের গালে ফু দিয়ে বলে ওঠে,”I like your attitude baby and,I’ll be waiting to see what you do.

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১১ (৩)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here