প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৩

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৩
জান্নাত নুসরাত

সকালে সূর্য আকাশে দাপটে ভঙ্গিতে বিরাজ করছিল। নিজের তেজের মহিমায় অতিষ্ঠ করে তুলেছিল সবাইকে। হঠাৎ সূর্য মেঘের আড়ালে ঢেকে গেল,আর তখন থেকে মেঘ ডেকে ওঠছে একটু পর পর। মেঘের বিরাট গর্জনের সাথে বিদুৎ সংযোগ ও ছুটেছে অনেক আগে। তাই বৃষ্টির আগে ঠান্ডা বাতাস নিজের ভেতর সরবারাহের জন্য নুসরাত একটু বাড়ির বাহিরে বেরিয়ে এসেছে। দু-হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে এদিক-সেদিক চোখ বুলাচ্ছিল তখনই মুখের সামনে বিরাট এক ছায়ার উৎপত্তি ঘটল। এত বড় ছায়ার উৎপত্তি কোথা থেকে হলো দেখার জন্য নুসরাত চোখ সামনে ঘোরাতেই সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত সুঠাম দেহের নাহিয়ানের সাথে চোখাচোখি হলো। নাহিয়ানের দিকে নুসরাত চোখ উল্টে তাকাতেই নাহিয়ান নিজস্ব ভঙ্গিমায় ভরাট স্বরে বলে ওঠে,”নাহিয়ান আবরার পূর্ব!

নুসরাত নাহিয়ানকে পাশ কাটাতে কাটাতে বিরক্তির স্বরে বলে ওঠে,”আপনি পূর্ব হোন আর পশ্চিম হোন তাতে আমার কী! সাইডে হাঁটেন।
নাহিয়ান মাথা নাড়ায় দু’পাশে। পুরুষালি আবারো সেই শক্ত, ভরাট কন্ঠে বলে ওঠে,”নট পশ্চিম, অনলি পূর্ব।
নুসরাত তেরছা কন্ঠে বলে,
“ওই তো একই হলো, পশ্চিম পূর্ব!
নাহিয়ানের সাথে আসা তৌফ আর লেভিন সামনের মাথা উঁচু করে থাকা এক দালানের পেছনে দাঁড়িয়ে হিহি করে হেসে উঠল। লেভিন মুখ বন্ধ করার ইশারা করে বলল,”ভাই জানলে একদম হে হে বের হয়ে যাবে!
তৌফ নিজের মুখ বন্ধ করে নিল। অতঃপর আবারো নিজের দন্ত কপাটি বের করে বলে,”ভাইয়ের নামের মাইরি বাপ করে দিচ্ছে এই মাইয়া।
লেভিন শুধরে দিয়ে বলে ওঠল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“মাইয়া নয় ভাবি বল। আরেকবার মাইয়া বললে ভাইরে বলে তোকে উল্টো করে ঝুলায় রাখব।
নাহিয়ান নুসরাতের ত্যাড়া জবাবে ঠোঁট টিপল। নিজের সাদা পাঞ্জাবির ভাঁজ টেনে ঠিক করে জিজ্ঞেস করল,” ভালো আছেন?
নুসরাত ভ্রুযুগল কুঁচকে নিল। অবিলম্বে বলে ওঠল,
“আপনাকে কেন আমি বলতে যাব, আমি ভালো আছি না, খারাপ আছি। আপনি কে ভাই?
নাহিয়ান দু-হাত বুকে আড়াআড়ি বেঁধে নুসরাতের দিকে সরাসরি তাকায়। মোলায়েম কন্ঠে বলার চেষ্টা করে ভাই নয়, কিন্তু নিজের তথাকথিত সেই গম্ভীর আওয়াজে বেরিয়ে আসে,”ভাই নয়,অনলি নাহিয়ান আবরার পূর্ব।
” হ্যাঁ হ্যাঁ জানি! নাহিয়ান আবরার উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিম।

নুসরাত ফরফর করে নাহিয়ানের নামের বিনাশ ঘটিয়ে মুখে জিপার টানে। তারপর এদিক সেদিক উঁকি ঝুঁকি মেরে কিছু একটা দেখতে থাকে। পালোয়ানের মতো লম্বা দেহের নাহিয়ানকে ভেদ করে নুসরাতের দৃষ্টি ওপাশে পৌঁছাল না, তাই বিরক্তির স্বরে বলে,”আপনার বাড়ি নেই, মানুষের বাড়ির সামনে পালোয়ানের মতো এসে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন ভাই? বিদায় হোন! নিজের বাড়িতে হাওলা নিন।
নাহিয়ান থতমত খেয়ে নিজের দিকে আঙুল তুলে ইশারা করে জিজ্ঞেস করে,”আমি?
নুসরাত মুখ বাঁকায়। ব্যঙ্গাত্মক কন্ঠে বলে,
“না আপনার ওই চ্যালাগুলোকে বলছি।
নাহিয়ান গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কোথায় চ্যালা?

নুসরাত হাত তুলে বিপরীত রাস্তার দিকে তাক করে দেখায় নাহিয়ানের চ্যালাদের। বিরক্তিতে মুখের অবস্থা করুন করে বলে ওঠে,”যেইগুলাকে সাথে নিয়ে এসে, মানুষের বাড়ির পেছনে চোরের মতো লুকিয়ে থাকার আদেশ দিয়েছেন ওইগুলাকে বলছি।
লেভিন আর তৌফ নিজেদের দিকে হাতের ইশারা দেখে কাচুমাচু মুখ করে অন্য রাস্তা দিয়ে পালালো। বেঁচে থাকলে আবার লুকিয়ে ভাইয়ের অপমান দেখা যাবে এখন পালানোই শ্রেয় মনে হলো নিজেদের কাছে। আজ ভাই জান ভিক্ষা দিলেই হবে। বেঁচে থাকলে, পরের কথা পরে ভাবা যাবে৷
তৌফ আর লেভিনকে বাচ্চাদের মতো দৌড়ে পালাতে দেখে নাহিয়ান কপালে হাত দিয়ে টিপল। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শব্দ করে। এর মধ্যে হাতে স্পর্শ পেল মেয়েলি হাতের। মেয়েলি লম্বা লম্বা আঙুল দ্বারা নুসরাত নাহিয়ানের বলিষ্ঠ হাতকে হালকা হাতে ধাক্কা দিতে দিতে বাড়ির সামনের গেট থেকে সরিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করল,”নাহিয়ান আবরার পূর্ব, এম আই রাইট?

নাহিয়ান কিছু বলতে নিবে নুসরাত ঠোঁটে তর্জনী আঙুল চেপে চুপ দেখাল। ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলিয়ে বলে ওঠল,”তো পূর্ব, আপনি সোজা পূর্ব দিকে চলে যান।
সামনের রাস্তার দিকে হাত দিয়ে দেখাল নুসরাত, নাহিয়ানকে চলে যাওয়ার জন্য। নাহিয়ান কথা বাড়াল না। নিজের টু-ব্লক করে কাটা চুল চোখের সামনে থেকে হাত দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বলে ওঠে,”আবারো দেখা হওয়ার অপেক্ষা রইলাম।
নুসরাত ভ্রক্ষেপহীন কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আবারো দেখা হবে তার নিশ্চয়তা কোথায়?
নাহিয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল, উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করল না।। ক্লিন সেভ করা থুতনিতে হাত বোলাতে বোলাতে চওড়া কাঁধ ঘুরিয়ে পেছনে অবাক নুসরাতকে ফেলে শক্ত ভঙ্গিমায় হেঁটে চলে যায় সামনের দিকে।

প্রত্যেক বুধবারে নাছির মঞ্জিলের লাইব্রেরি রুমে গোপন বৈঠক বসে। বড় কাঠের তৈরি চেয়ার খানায় সামনে বসে থাকেন নাছির সাহেব। তাদের মাঝে ব্যবধান হিসেবে থাকে একটা কাচের রিডিং টেবিল। টেবিলের ডান-পাশে ইসরাত ও বাঁ-পাশে নুসরাত। এসময় বাপ মেয়েদের কেউ বিরক্ত করলে, তাকে পেতে হয় কঠিন শাস্তি। তাই দো-তলার দিকে একটা কাকপক্ষি গিয়ে পা ফেলে না। নিরিবিলি পরিবেশে বসে বাপ মেয়ে মিলে নিজেদের উল্টাপাল্টা আলোচনার সমাপ্তি দেয়, পরে নাজমিন বেগমকে বলে এটা নাকি তাদের নিজস্ব গোপন বৈঠক।

আজ ও সেই বৈঠক বসেছে। গত আধঘন্টা যাবত চলছে এই আলোচনা। তবুও শেষ হয়নি গোপন বৈঠক, এখনো চলছে, আর চলতেই আছে। সময় গড়ায় তবুও গোপন বৈঠকের শেষ হয় না। ড্রয়িং রুমে বসা নাজমিন বেগম দো-তলার বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। নাজমিন বেগমের পাশে বসে থাকা মমো চুপচাপ তখন থেকে লক্ষ করছে এসব। হঠাৎ তার আগ্রহী কন্ঠ ভেসে আসে নাজমিন বেগমের কানে, সে জিজ্ঞেস করছে,”মামনী কী এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয় প্রত্যেক বুধবারে? প্রত্যেক আলোচনা তো আধঘন্টার ভেতরে শেষ হয়ে যায়, আজ কেন এত সময় লাগছে?

নাজমিন বেগম মমোর চুলে বেনি করে দিতে দিতে বললেন,”যা, নিজে গিয়ে কান লাগিয়ে শুনে আয়, কী এমন বিশেষ গোপন আলোচনা হচ্ছে?
নাজমিন বেগমের ক্ষেপা কন্ঠে মমো ঠোঁট চেপে বন্ধ করে নেয়। কিছুক্ষণ বসে থাকে, আবারো সঠিক সময়ে প্রশ্নটা করার অপেক্ষায়। নাজমিন বেগমের কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে মেজাজ খিঁচে আছে ভয়ংকর রকমভাবে। যার পুরো কৃতিত্ব যায় নুসরাত আর নাছির সাহেবের ওপর। কিৎকাল কাটার পর মমো আবারো মিনতির স্বরে জানতে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,”বলো না মামনী, কী এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হয়?
নাজমিন বেগম তিক্ত বিরক্ত কন্ঠে বলেন,
“আর বলিস না, দুনিয়ার সব আজগুবি কথা বাপ মেয়ে মিলে জোড়া লাগায় ওখানে বসে। গরু আকাশে উড়ানোর মতো গোপন বৈঠক হয়।

” মানে?
মমো বুঝতে না পেরে কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করল। নাজমিন বেগন পাংশুটে বর্ণের মুখ বানিয়ে ক্ষুব্ধ কন্ঠে বলেন,”নামে গোপন বৈঠক, কাজে কিছু নেই। শুনবি? শুনলে আয় কান খাড়া করলেই গোপন বৈঠকের নমুনা দেখবি।
মমো আর নাজমিন বেগম ধীরে ধীরে পা ফেলে দো-তলায় উঠলেন। লাইব্রেরি রুমের সামনে লাগানো কাঠের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে কান খাড়া করতেই কানে ভেসে আসলো নুসরাত আর নাছির সাহেবের তর্ক বির্তক। যা কান দরজা না লাগিয়েই বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে শোনা যাচ্ছে। মমো এতক্ষণে নাজমিন বেগমের কথার মানে বুঝল। ফিসফিস করে বলে,”মামনী সবকিছু তো স্পষ্ট শোনা যায় বাহির থেকে, তাহলে এ আবার কীসের গোপন বৈঠক?
মমোর কথায় নাজমিন বেগম হাসলেন। অতিষ্ঠ কন্ঠে বললেন,”এই হলো ওদের মতো তারছেরাদের গোপন বৈঠক।
নাজমিন বেগম আবারো কষ্টে ভরা কাতর কন্ঠে আওড়ালেন,”আমি বলেই সংসার করছি এই পাগলদের, অন্যকেউ হলে মুখের উপর ঝাটা পেটা করে বিদেয় হতো এতদিনে।
নাজমিন বেগমের দুঃখে ভরা কথা শুনে মমো সান্ত্বনা হাত বাড়িয়ে দেয়। মৃদু কন্ঠে সান্ত্বনা দিয়ে বলে ওঠে,”সব ঠিক হয়ে যাবে।

নাছির মঞ্জিলে যে গোপন বৈঠক হয় তার একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা থাকে। আজ সে সময়সীমার উর্ধ্বে চলে গেলেও গোপন বৈঠক চলমান। নাছির সাহেব নিজের চোখের ছোটো লেন্সের চশমা খুলে রাখেন টেবিলের উপর। দু-হাত কাচের টেবিলে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলেন নুসরাতকে,”জায়িনের হঠাৎ বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার মানে কী? উদ্দেশ্য কী হতে পারে তুমি বুঝতে পারছো আব্বা?

নুসরাত দু-পাশে মাথা নাড়াল সে জানে না বলে। ইসরাতের দিকে চোখ ফিরাতে দেখলেন ইসরাত ঝিমুচ্ছে। তার কোনো মাথা ব্যথা নেই এসবে। মাথা ব্যথা থাকবে কী করে কোনো কথা বলতে গেলেই তার গুণোধর বাপ-বোন মিলে তার মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকতে বলেন। সে না-কী বুঝবে না হেলাল সাহেব আর জায়িন-এর রাজনীতি? ইসরাতের ঝিমুনোর মধ্যে নাছির সাহেব আবারো গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠলেন,”হতে পারে এটা তাদের কোনো চক্র, ইসরাতকে, আমাকে, আর তোমাকে দাবিয়ে রাখার জন্য?

নুসরাত সায় জানাল নাছির সাহেবের কথায়। এটা কোনো চক্র হতে পারে তাদের ফাসানোর জন্য। ইসরাত ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে কিছু বলতে নিবে নাছির সাহেব বললেন,”উঁহু, তুমি ছোটো মানুষ কথা বলো না, চুপ করে বসে থাকো।
ইসরাত আবারো চুপসে গেল। চুপসানো মুখ নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে রইল ভেতরে ভেতরে৷ নুসরাত এক পা তুলে চেয়ারে বসল। থুতনি হাঁটুতে ঠেকিয়ে বলল,”সহমত আব্বা। আপনার বড় ভাইয়ের প্ল্যানের কোনো অংশ হতে পারে ইসরাত, আমাকে, আর আপনাকে ফাসানোর! জায়িনকে হয়তো উনিই ইসরাতের পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন।
ইসরাত এবার নাছির সাহেবের নিষেধজ্ঞার তোয়াক্কা না করে ঝটপট বলে ওঠল,”জায়িন কী কুকুর যে উনাকে লেলিয়ে দিবেন?

নুসরাত আর নাছির সাহেব উপর নিচ মাথা নাড়ালেন। তারপর বাপ-মেয়ের টনক নড়ল ইসরাতের চোখ রাঙানো দেখে। নিজেদের ভুল শুধরে নিয়ে আবারো দু-পাশে মাথা নাড়ালেন, না ভঙ্গিতে। নুসরাত বিশেষজ্ঞের ন্যায় থুতনিতে একহাত রেখে অন্যহাত নাড়িয়ে ভাষণের মতো করে বলল,”ইসরাত তুই অবুঝ, তুই আসলে বুঝতে পারছিস না, আব্বার বড় ভাই আমাদের নিচের দিকে দাবানোর জন্য জায়িন শালা… আইমিন দুলাভাইকে তোর পেছনে লাগিয়ে দিয়েছেন। তুই আসলে তাদের চক্রান্ত বুঝতে পারছিস না! এটা হতে পারে খুবই বড়সড় জান নেওয়া চক্রান্ত।
নাছির সাহেব নুসরাতের কথায় সহমত পোষণ করলেন। নুসরাত একটু শ্বাস ফেলে নিয়ে আবার বলল,”তুই আমাদের বড় মানুষের মধ্যে কথা বলিস না, শুধু বসে বসে শোন, আর বোঝার চেষ্টা কর আমরা তোকে কী বোঝানোর চেষ্টা করছি। এবং কী দিক নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করছি!

নাছির সাহেব নুসরাতের কথা অবিলম্বে সহমত পোষণ করে বললেন,’হ্যাঁ, হ্যাঁ তুমি বাচ্চা রয়েছে তাই চুপ করে বসে থাকো বাচ্চাদের ন্যায় আম্মা।
ইসরাত মাছের মতো দু-ঠোঁট ফাক করে নিল। তার বাপ কী ভুলে গেল সে বড় মেয়ে! তার বিয়ের কথা বলছে আর তাকে কথা বলতে নিষেধাজ্ঞা জারী করছে এই দু-জন মিলে। এ কেমন বিচার?
ইসরাতের অতর্কিত চিন্তার মধ্যে ব্যঘাত ঘটিয়ে নাছির সাহেব বলে ওঠলেন,”হয়তোবা বড় ভাই জায়িন আর ইসরাতের বিয়ের পর ইসরাত আর জায়িনের ডিভোর্সের ভয় দেখাতে পারেন আমাদের। আমার সম্পত্তিতে ও হস্তক্ষেপ করতে পারেন?
নুসরাত বলে ওঠে,

“আব্বা তুমি তো একদম ঠিক জায়গায় ঢিল মেরেছ। আমি ও এরকম কিছু ভাবছিলাম। আমাদের বদনাম করার চেষ্টা করতে পারেন! আবার আমাদের সম্পত্তি ও ছিনিয়ে নিতে চাইবেন না, তার কী কোনো নিশ্চয়তা আছে? একদম নেই। উনি যে-রকম মানুষ সম্পত্তি ছিনিয়ে নিতেই পারেন।
বাপ মেয়ে দু-জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। ইসরাত অতিষ্ঠ হয়ে কিছু বলতে নিবে নাছির সাহেব আর নুসরাত একসাথে বলে ওঠল,” চুপ, একদম চুপ।
নুসরাত ঠোঁটে আঙুল চেপে দেখাল ইসরাতকে চুপ থাকতে। ইসরাত তবুও কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাক করতেই নুসরাত বলে ওঠে,” এখানে তোর জীবন মরণে প্রশ্ন, তাই চুপ থাক। আমি আর আব্বা বুঝে নিব!
নাছির সাহেব মাথা ঝাঁকিয়ে বাচ্চাদের ন্যায় বলে ওঠলেন,”একদম ঠিক।

ইসরাতকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অনেক সময় আলোচনা হলো জায়িনের কথা নিয়ে। দীর্ঘ দুই ঘন্টার আলোচনা শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন নাছির সাহেব আর নুসরাত জায়িন কোনো চক্রান্ত করছে, আর চক্রান্তে কোনোভাবে জায়িনকে বিজয়ী হতে দেওয়া যাবে না। তাই তারা ও এই বিষয়ে একটা দ্রুত পদক্ষেপ নিবে। পদক্ষেপ কী নিবে সেটা ভাবতে লাগলেন। আর তা ভাবতে ভাবতে তাদের মাথা হেং হয়ে গেল।
ইসরাত স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বাপ-আর বোনকে লক্ষ করছে তখন থেকে। মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছে চুপচাপ। দু-ঘন্টা যাবত এক জায়গায় স্থির বসে থাকতে থাকতে ইসরাতের কোমর অসাড় হয়ে গেছে। ঠোঁটে বিতৃষ্ণা হাসি ঝুলিয়ে নিয়ে এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে ওঠে দাঁড়াল। এবং শান্ত গলায় বলল, “আপনাদের আলোচনা শেষ হলে, আমি কী যেতে পারি? শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন তা সম্পর্কে আমাকে জানাইয়েন!

ইসরাত চেয়ার ঠেলে বের হওয়ার আগেই নুসরাত ধমকে ইসরাতকে নিজ জায়গায় বসিয়ে দিল। কটমট কন্ঠে আদেশ দিয়ে বলল,”চুপচাপ বস। এখনো আমরা কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারিনি আর তুই কী-না ডেং ডেং করে নেচে চলে যাচ্ছিস! আর এক পা এখান থেকে নড়লে আব্বা আর আমি তোর বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নিব।
ইসরাত অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে নিজের জায়গায় আবার ধুপ করে বসে যায়। নুসরাত নড়েচড়ে বসে এবার আসল কথায় আসে। গলা খাঁকারি দিয়ে গলা পরিস্কার করে নেয়। ঠোঁটের কোণে মিষ্টতা এনে বলে ওঠে,”আব্বা আপনি চাইলেই জায়িন শালার সাথে ইসরাতের বিয়ে দিতে পারেন। জায়িন ভাই এমনিতে ভালো আছেন, উনার কাছ থেকে কোনো খারাপ ভাইব আমি পাইনি। আর উনার, অনেক গুলো কার্ড ও আছে।

নুসরাতকে ভিন্ন সুরে কথা বলতে দেখে নাছির সাহেব আর ইসরাত তড়াক করে তার দিকে তাকায়। তারা একটু হোঁচট বই-কিছু-নয়। নুসরাত বোকা হাসে, দু-জনকে এমন অস্বাভাবিক ভাবে তাকে চোখ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখা দেখে।
নাছির সাহেব নুসরাতের এমন সুর পাল্টানো দেখে চট করে বুঝে ফেললেন কী হয়েছে! অক্ষিকোটর ছোটো ছোটো করে নুসরাতের উদ্দেশ্যে কঠোর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”সুর পাল্টানোর মানে কী?
ইসরাত ও আগ্রহ নিয়ে হা করে চেয়ে আছে। সে ও জানতে চায় নুসরাতের এই পরিবর্তন কেন! দু-জনের সরু দৃষ্টির তোপে পড়ে নুসরাত থতমত খেয়ে বলে ওঠে,”এভাবে তাকানোর মানে কী? আমি চুরি করে চোর ধরা পড়িনি যে দু-জন এভাবে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছো আমাকে।
নাছির সাহেব চোয়াল শক্ত করে নিলেন। তীক্ষ্ণ কন্ঠে নিরর্থক অভিমত পোষণ করে বলেন,”ঝেড়ে কাশো নুসরাত, কত টাকা পেয়েছ?

নুসরাত ইতস্তত মুখভঙ্গি করে। ক্ষীণ হেস্ব নাছির সাহেবকে ঘষামাজা করতে যাবে, নাছির সাহেব কাঠখোট্টা কন্ঠে বলেন,”একদম অবুঝ সাজার চেষ্টা করো না, স্পষ্ট তোমার মুখে ভাসছে তুমি ঘুষ খেয়েছ।
নুসরাত দাঁত বের করে হাসে। নাছির সাহেবের কথার উত্তর দেয়,”আব্বা আমি ঘোষ খাই না আপনি জানেন, জায়িন ভাই আমাকে ভালোবেসে কিছু দিয়েছেন।
নাছির সাহেব এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে নুসরাতের কথার বিপরীতে ঠাট্টা করে জিজ্ঞেস করলেন,”কত টাকা দিয়েছেন তোমার জায়িন ভাই তোমাকে?
নুসরাত চোখ-মুখ ঝাপ্টে , প্রশস্ত হেসে বলে ওঠে,

” বেশি নয় ওই তো পাঁচহাজার টাকা। আমি আবার কেউ ইচ্ছে করে টাকা দিলে না করতে পারিনা। জায়িন ভাইয়ের কাছ থেকে আমি টাকা নিতে চাইছিলাম না, কিন্তু ভাই খারাপ মনে করতে পারে তাই আর-কী নিয়েছি!
ইসরাত আর নাছির সাহেব, নুসরাতকে কিছুক্ষণ কড়মড় চোখে অবলোকন করলেন। নুসরাত আবারো বোঝানোর স্বরে বলল,”আব্বা আমি বলি, জায়িন ভাইয়ের সাথে ইসরাতের রেজিস্টারি করলে আমাদের শুধু বেনিফিট আর বেনিফিট। জায়িন ভাইয়ের কাছ থেকে আমরা বিনামূল্যে সেবা পাবো। ইসরাতের সাথে বিয়ে হয়ে গেলে আমাকে আরো কিছু টাকা দিবেন জায়িন ভাই এই ওয়াদা করেছেন।।
নাছির সাহেব শুধালেন,

“তাহলে এগুলো কী?
নুসরাত অবিলম্বে উত্তর দিল,
” এগুলো এডভান্স দিয়েছেন,কাজ শেষে বাকিগুলো।
নুসরাতের কথায় ইসরাত আর নাছির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নুসরাত মৃদু স্বরে আওড়ায়,”আপনারা চাইলে একটা শর্তনামা তৈরি করতে পারেন। তাহলে আর আপনার বড় ভাই ইসরাত আর জায়িন ভাইয়ের ডিভোর্স দেওয়াতে পারবে না। আর আমার যতটুকু মনে হয়েছে জায়িন শালা… আই মিন জায়িন ভাই কোনো অবস্থায় ইসরাতকে ডিভোর্স দিবেন না। আব্বা ভেবে দেখতে পারেন প্রচুর বড়লোক্স ওই বেডা জায়িন ভাই।
গোপন বৈঠক আরো কিছুক্ষণ চলল। ততক্ষণে সৈয়দ বাড়িতে এসে হাজির হয়েছে ইরহাম আর আহান। মমো আর নাজমিন বেগমের মতো তারাও এসে কান পাতল দরজার কাছে গোপন বৈঠকের অতি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা শোনার আশায়।

রুম গুছিয়ে রাখছে ইসরাত। নুসরাত বিছানায় বসে বসে লিচু খাচ্ছে। মমো একপাশে বসে বই পড়ছে। নুসরাতের আরাম করে খাওয়ার ভেতর ব্যঘাত ঘটিয়ে ইসরাত জিজ্ঞেস করল,”সেদিন তোর গালে ওরকম রক্তের দাগ পড়েছিল কেন?
নুসরাত লিচু খাওয়া থামিয়ে নিস্প্রভ চোখ তুলে ইসরাতে দিকে তাকায়,আর তখনই চোখাচোখি হয় ইসরাতের সাথে। কথার কোনো উত্তর না দিয়ে নুসরাত লিচু খেতে ব্যস্ত হবে ইসরাত বলে ওঠে,”নুসরাত বলবি তুই?
নুসরাত দ্বিধাহীন কন্ঠে বলে ওঠে,

“আরশ থাপ্পড় মেরেছিল।
ইসরাত আঁতকে উঠল। মমো এতক্ষণ বই পড়লেও ইসরাতের আর নুসরাতের কথায় নিজের মনোযোগ সেদিক থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। মনোযোগী হয় নুসরাত আর ইসরাতের কথায়। ইসরাত নুসরাতের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে মৃদু কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,”বিরক্ত করেছিস তুই ভাইয়াকে, যে এভাবে অমানুষের মতো মারল তোকে?
নুসরাত ভ্রক্ষেপহীন কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমি কেন উনাকে বিরক্ত করতে যাব! আমার কী খেয়ে দেয়ে কাজ নেই?
থাপ্পড়ের কথা মনে করে নুসরাত ভেংচি কাটল আরশকে। ইসরাত তীক্ষ্ণ চোখে এক পলক নুসরাতের দিকে চেয়ে নিয়ে, প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,”তুই আবার প্রতিশোধ নেওয়ার চিন্ত করছিস? উল্টাপাল্টা কিছু করার চিন্তা করলে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল।

ইসরাতের কথা নুসরাত হেসে উড়িয়ে দেয়। আলগোছে কথার উত্তর না দিয়ে কাটিয়ে দেয়। ইসরাত নুসরাতের দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে থাকলে নুসরাত কথা বলে না। সে অন্য কথা বলতে শুরু করে,”শোনলাম, আমি বাহ্মণবাড়িয়া থাকতে না-কী সুফি খাতুন তোর জন্য নিজাম বুড়োর সম্বন্ধ নিয়ে আসছিল?
নুসরাতের কথায় মমো সায় দেয়। কাউচে বই ওইরকম ফেলে রেখে দৌড়ে নেমে এসে নুসরাতের পাশ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে, ইসরাতের কথা শোনার জন্য। ইসরাতের দিকে প্রশ্নাতীত চোখে চাইলে ইসরাত হাসতে হাসতে ঢলে পড়ল বিছানা সেদিনকার কথা মনে করে। নিজের হাসি সেরকম বহাল রেখে বলে ওঠে,” আর বলিস না, নিজাম দাদু না-কী একদম তাগড়া, সুঠাম দেহি যুবক। দাদি এসব বলে নিয়ে গেলেন পাত্র দেখাতে আব্বুকে। আব্বু যখন দেখলেন পাত্র হিসেবে নিজাম দাদুকে, দাদি আমার জন্য পছন্দ করেছেন তখন এমন রেগে মেগে আগুন হলেন, পারতেন যদি তাহলে দাদিকে রিভলবার দিয়ে শুট করতেন।

রিভলবারের কথা শুনতেই নুসরাত থুতনিতে হাত চেপে ধরে হাসল। কুটিল হাসিতে বেঁকে গেল ঠোঁটের একপাশ। বিড়বিড় করে আওড়াল,”রিভলবার!
নুসরাতের এমন হাসি দেখে মমো ইসরাতকে কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিল। ইশারায় দেখাল নুসরাতের ঠোঁট টিপে শয়তানের মতো হাসিটা। দু-জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু বাঁকাল। দু-জনের একজন বুঝতে পারল না হঠাৎ এমন হাসির মানেটা কী! ইসরাত কিছু বলতে নিলে নুসরাত বাঁধা দেয় হাত তুলে। ইসরাত এর নিকট থেকে পরবর্তী কথা শোনার জন্য শুধায়,”তারপর কী হলো?
ইসরাত বলে ওঠে,

“তারপর আর কী! দাদিকে ভালো করে বকে দিয়েছেন। মনে হয়না এই জীবনে আর কোনো সম্বন্ধ নিয়ে এ মুখো হবেন।
নুসরাত ইসরাতের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়,
” সুফি খাতুনের হাবভাব ভালো নয়রে ইসরাত। আমার কেন জানি মনে হয় নিজাম বুড়োর দিকে খারাপ নজর দিয়েছেন এই মহিলা।
মমো নুসরাতের কথায় একমত পোষণ করে। মমোর নিচু গলার আওয়াজ ভেসে এলো,”নানি নিজাম নানার কথা শুনলেই কী-রকম করে ওঠেন। লজ্জা পান মনে হয়!
মমোর কথা শেষ হতেই ইসরাত চিৎকার করে ওঠে। তারপর আবার মুখ চেপে ধরে নিজের কুন্ঠিত হয়ে আসা কন্ঠে হতচকিত গলায় মিয়েই গিয়ে বলে,”আহান বলেছিল নিজাম দাদুর সাথে দাদির একটা সেট-আপ করিয়ে দেওয়ার কথা তখন দাদির মুখ কী লাজ রঙা হয়েছিল তুই দেখলে জাস্ট স্পিচলেস হয়ে যেতি। লজ্জায় একপ্রকার কাচুমাচু হয়ে গিয়েছিলেন।

নুসরাত এক পেশে ভ্রু বাঁকিয়ে বলে ওঠে,
“বুড়ির হাবভাব ভালো না। নিজাম বুড়োর দিকে কু-নজর দিয়েছে মনে হয় তাহলে তো একটু বাজিয়ে দেখা যায় সুফি খাতুনকে কী বলিস তোরা?
ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে তিন মাথা একজায়গা হতে নিবে তা আগেই আরো দু-মাথা ঠেলে সেখানে ঢুকে গেল। মিচকে হাসি দিয়ে ইরহাম নুসরাতের কাছ ঘেঁষে বসল আর আহান মমোর কাছ ঘেঁষে বসল।। পাঁচ মাথা একত্রিত হতেই সবাই হেসে ওঠল। আহান সবার দিকে চেয়ে ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,”আমার কাছে একটা গ্রেট নিউজ আছে।
পাঁচ মাথা একত্রিত থাকল, তাদের গোলাকার হয়ে বসে থাকা বন্ধন ভাঙন ধরল না। আহানের দিকে প্রশ্নাত্মক চোখে তাকাতেই আহান বলল,”নানি নিজাম দাদুর গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে এনে নিজের কানে পিঠে গুজে ছিলেন, আর তা দেখে নিজাম দাদু পুরো আগুন হয়ে উঠেছিলেন। যখন জিজ্ঞেস করলেন ফুলগুলো কোথায় পেয়েছ? নানি নতুন বউয়ের মতো মুখে হাত দিয়ে লজ্জা পেয়ে হেসে ওঠলেন। মৃদু কন্ঠে নিজাম দাদুকে জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগছে, আমায়?

আহানের নাটকীয় ভঙ্গিমায় বলা কথায় সবাই হেসে উঠল। আহান ধীরে ধীরে সব খুলে বলতেই সবাই সবার দিকে চেয়ে ফিসফিস করে এক সাথে বলে ওঠে,”সামথিং ইজ ফিশি, Sufi Khatun might have fallen in love with Nizam Shikder.
কথা শেষ করে সবাই ঠোঁট কামড়ে কুটিল হাসল। তারপর সবাই মিলে পুরো রুম কাঁপিয়ে হেসে উঠল।

বাইরে মৃদু বাতাস বইছে। সেই বাতাসে ভেজা মাটির গন্ধ, প্রথম ফোটা কদম ফুলের সুবাস ভেসে আসছে। দুপুর বারোটা। এই সময় শহরের কোলাহল ঢাকা পড়ে নিস্তব্ধতায়। এই বৃষ্টিময় দুপুরটা কেমন যেন কোলাহলহীন, নিস্তব্ধ, বিষন্ন। নাছির মঞ্জিলে সামনা দিয়ে হঠাৎ হঠাৎ চলে যাচ্ছে ক্রিং ক্রিং শব্দ তুলে রিকশা। নাছির মঞ্জিলের গেটের দু-পাশে ফলেরবাগান করা। ঠিক পাশে সৈয়দ বাড়ি আর সৈয়দ বাড়ির সামনে নিজাম শিকদারের বাড়ি। নাছির মঞ্জিল থেকে সৈয়দ বাড়ির দূরত্ব দু-মিনিটের। নাছির মঞ্জিলের সামনে খোলা জায়গায় কয়েকটা চেয়ার রাখা আছে। হয়তোবা আজ সকালে এখানে বসেই নাছির সাহেব চা খেয়েছিলেন।

নুসরাত পকেটে কালো রঙের কিছু একটা গুজে নেয়। হাঁটু সমান শার্টের হাতা গুটিয়ে নেয়। নিজের থেকে বড় সাইজের জিনিসগুলো পরতে সে একটু বেশি কম্ফোর্ট ফিল করে। তার সবচেয়ে বেশি পছন্দ হলো ইরহামের পরিহিত কাপড়গুলো। ওইগুলো টেনে এনে পরতে সে ভীষণ ভালোবাসে। পায়ে একজোড়া বড় সাইজের স্লিপার। এই জুতো জোড়া ও ইরহামের। নুসরাত চোখে চশমা এঁটে আছে। মুখে গম্ভীরত্ব কিন্তু ঠোঁটের কোণে বিরাজ করছে ক্ষূর হাসি। ক্ষূর হাসি কারণ উদ্মাগাটন করা মুশকিল। নুসরাত হাত পা ছড়িয়ে গিয়ে বসে পড়ল চেয়ারে। চোখ স্থির করে রাখা সৈয়দ বাড়ির গেটের দিকে। কিৎকাল কাটার পর মেরমেরে শব্দে পুরোনো আমলের জং ধরা গেট খুলে গেল সৈয়দ বাড়ির। মাথা নিচু করে বের হয়ে আসলো আরশ।

পায়ে নাইকের লগো বিশিষ্ট স্লিপার। হাঁটু সমান থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট উপরে হুডি পরিহিত। হুডির ক্যাপ মাথায় টানা সবসময়ের ন্যায়। নুসরাত আরশকে দেখতেই ভেতরে ভেতরে হাসল। আরশ নুসরাতকে আরাম করে বসে থাকতে দেখে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে আসলো নুসরাতের দিকে। নুসরাত নড়ল না, চুপচাপ বসে দেখল আরশের উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মুখখানা শক্ত করে এগিয়ে আসা তার দিকে। অধীর আগ্রহ নিয়ে নিস্প্রভ দৃষ্টি স্থির রাখল আরশের দিকে। ঠোঁটে মারাত্মক কুটিল হাসি লেগে আছে। আরশ নুসরাতের পাশে এসে ধুপ করে বসে পড়ল কথাবার্তাহীন। সূক্ষ্ম চোখ বুলালো ওভাল আকৃতির মেয়েলি শ্যাম মুখে।

ডান হাতের বুড়ি আঙুল ও তর্জনী আঙুল দ্বারা নুসরাতের গাল চেপে ধরে বাঁ-পাশে ডান-পাশে ঘোরাল। নাকের কাছের নোজ রিংটা ভালো করে লক্ষ করল। তারপর পুরো মুখে আবারো নিজের কাঠখোট্টা হাত বুলালো। নুসরাত আরশের হাত সরিয়ে দেয় অনিহা নিয়ে নিজের মুখের উপর থেকে। আরশের দিকে সরাসরি তাকিয়ে, চোখে চোখ রেখে নুসরাত বলে ওঠে,”আপনার হাতের তেরোটা থাপ্পড় খেয়ে স্কিনের গ্লো একদম ফিকে গিয়েছে বুঝছেন। মুখে ব্যথা দু-দিন ভরা ছিল, আমি একদম মুখ নাড়াতে পারিনি ঠিক মতো। চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল ও পড়েছে গভীরভাবে। তাই ভাবছি, আবারো আগের মতো স্কিনের গ্লোনেস কীভাবে বাড়ানো যায়?

নুসরাতের কথায় আরশ উত্তর দিল না। গম্ভীর মুখ বানিয়ে চুপচাপ নুসরাতের কথা শ্রবণ করল। নুসরাত নিচের দিকে চোখ রেখে কুটিল হেসে নিল। তারপর এক মুহুর্ত বিলম্ব না করে ব্যঙ্গাত্মক গলায় বলে ওঠল,”আপনি কী জানেন, স্বামীর বুকের বাঁ-পাশের রক্ত দিয়ে ফেইসমাস্ক তৈরি করে ফেইসে ইউজ করলে স্কিন-এর গ্লো বৃদ্ধি পায়। তাই আমিও ভাবলাম, আপনার রক্ত দিয়ে ফেইসমাস্ক তৈরি করে ফেইসে ইউজ করব।

নুসরাতের কথায় আরশ চোখ ছোট ছোট করে নেয়। নড়েচড়ে বসে নুসরাতের সামনে। নুসরাত নিজের পকেট থেকে নাছির সাহেবের লাইসেন্স প্রাপ্ত রিভলবার বের করে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। আরশ ও হাসল নুসরাতের সাথে তাল মিলিয়ে। গম্ভীর মুখখানায় ভয় বা দুশ্চিন্তার কোনো ছাপ নেই। পুরুষালি লম্বা লম্বা পাপড়ি দিয়ে ঘেরা চোখগুলো নুসরাতের মেয়েলি চোখের মধ্যে স্থাপন করল। বলিষ্ঠ হাত দ্বারা নুসরাতের চেয়ার একটানে নিজের সামনে নিয়ে আসলো। চোখে চোখ স্থির রেখে নির্বিকার ভঙ্গিমায় বলে ওঠল,”শুট!
নুসরাত বাকশূন্য মুখে চুপচাপ বসে রয়। আরশ পুরুষালি পুরু ঠোঁট নাড়িয়ে আবারো আদেশ দিয়ে বলে,”শুট মিসেস আরশ!

আরশের কথা শেষ হতেই নুসরাত রিভলবার চেপে ধরে আরশের বুকের বাঁ-পাশে। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখে আরশের চোখে চোখ রেখে নির্বিকার চিত্তে চেয়ে থাকে । আরশের চোখ ও তখনো স্থির নুসরাতের দিকে। তার প্রখর দৃষ্টি সূক্ষ্ম ও ধারালো। আরশ আবার বলে ওঠে,” This is an order, Mrs. Arosh — pull the trigger!
আরশের কথা শেষ হতেই নুসরাত ট্রিগারে চাপ দিল। উচ্চ শব্দে বের হয়ে আসলো গুলি। সেই গুলি আরশের পাজরের হাঢ় ভেদ করতেই ঝরঝর করে রক্ত বের হয়ে আসলো বুকের চামড়া উপর দিয়ে। আরশ ভ্রু দিয়ে ইশারা করে রক্তের দিকে তারপর নিজের ভরাট স্বরে বলে,”নিন আপা রক্ত, আর একটু কষ্ট করে হসপিটালে ভর্তি করে দিয়েন। এসে দেখব, আমার রক্ত দিয়ে ফেইসমাস্ক তৈরি করে, ফেইসে ইউজ করার পর আপনার ফেইসে কতটুকু গ্লো এসেছে।

নুসরাত হেসে উঠল। আরশ ও হেসে উঠল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা দালানের বারান্দায় দাঁড়ানো নিজাম শিকদার স্তব্ধ এরা হাসে কেন? পাগল না-কী! গুলি খেয়ে আবার হাসে কে? এই ছেলের ব্যথা করছে না না-কী! নিজাম শিকদার হা করে তাকিয়ে থাকেন।৷ তখনো তারা স্বামী-স্ত্রী হাসছে একজন আরেকজনের সাথে তাল মিলিয়ে।
আরশ প্রখর গরম নিশ্বাস ফেলে। যে শ্বাসের তোপে পড়ে সামনে বসে থাকা নুসরাত। নুসরাতের চেয়ার ধরে টেনে আরেকটু সামনে নিয়ে আসে আরশ। ধুপ করে নিজের মাথা ফেলে নুসরাতের কাঁধে। শ্বাস ফেলে নাক টেনে মেয়েলি শরীরের ঘ্রাণ নাকে নেয়। নিজের থুতনি ঠেকায় নুসরাতের কাঁধে। ঘনঘন শ্বাস ফেলে অন্তর্ভেদী চাহনি নিক্ষেপ করে। ফিসফিস করে নুসরাতের কানের কাছে আওড়ায়,

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১২

Teri nazar ne ye kya kar diya
Mujh se hi mujhko juda kar diya
Main rehta hoon tere paas kahin
Ab mujhko mera ehsaas nahin
Dil kehta hai kasam se
thoda thoda pyaar hua tumse
Ke thoda ekraar hua tumse

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here