প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২৭

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২৭
জান্নাত নুসরাত

আকাশে বিদুৎ চমকাচ্ছে। ঘন কালো মেঘগুলো সময়ের সাথে দানবীয় আকারে পরিণিত হয়েছে। হয়তো ঝুম বৃষ্টি হবে। অঝোর ধারায় গত দু-দিন ধরে আকাশ থেকে মেঘ ঝড়েছে,তাই রাস্তা, ঘাট, মাঠ সবই পিচ্ছিল হয়ে আছে। বৃষ্টির স্যাঁতস্যাঁতে পানিতে রাস্তা ডুবে গিয়েছে। একটানা বৃষ্টি হওয়ায় ড্রেইনে পানি অতিরিক্ত জমাট বেঁধে তা উপরের দিকে ওঠে আসছে। আরশ স্যাতস্যতে মেঠোপথ দিয়ে আসতে গিয়ে কয়েকবার পিচ্ছিল খেল। তাই পায়ের স্লিপার খুলে হাতে নিয়ে হাঁটছে সে। সুঠাম দেহি শরীরটা বাঁকিয়ে কিছুক্ষণ পর পর পিছু ফিরে দেখছে।

বেয়াদবটার সাথে ধস্তাধস্তি করতে গিয়ে মাটিতে লেপ্টে গেছে পুরো শরীর। কী মনে করে ওই বেয়াদব মহিলা! ওকে আরশ চিনবে না! নাক বন্ধ করে কথা বললেই ওই ধান্দাবাজ মহিলা তার কাছে অপরিচিত হয়ে যাবে! ওই বেয়াদব মহিলাকে সে রগরগে চিনে। মাথা ভরা গোবর নিয়ে সবগুলো মিলে গেছে এইগুলো এপ্লাই করতে। বেয়াদবের দল!
আরশ হেঁটে এগিয়ে গেল মন্টু মিয়া যেখানে ছিলেন সেখানে।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

এতক্ষণে অনেকটা ভীর জমেছে ওই জায়গায়। আরশ ভীর ঠেলে এগিয়ে যেতেই জায়িন মুখের কাছে হাতের মুঠো রেখে গলা খাঁকারি দিল। তৎক্ষণাৎ আরশের দৃষ্টি ঘুরে গেল জায়িনের দিকে। জায়িন চোখের ইশারায় কিছু একটা জিজ্ঞেস করতেই আরশ ও মাথা নাড়াল। ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলতেই জায়িন নিজেও মুখ নাড়াল। দু-ভাই নিঃশব্দে কিছু কথা বলে নিল নিজেদের মধ্যে। আরশ চোখ দিয়ে ইশারা করল জায়িনকে কিছু একটা জিজ্ঞেস করার জন্য, জায়িন তাকে আবারো ফিরতি ইশারা করল। দু-জনের ইশারা আশারায় দুয়েক মিনিট কাটল। অতঃপর দু-জনেই একসাথে গুরু গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে বসল,”কারা ছিল দেখেছেন?

মন্টু মিয়া হাহাকার করে ওঠলেন। মাটির সাথে লেপ্টে বসে মাথায় হাত দিয়ে চাপড়ালেন। জায়িন আর আরশ চোখাচোখি করল। জায়িন আরশের কানের কাছে গলা নামিয়ে বলে ওঠল,”এই লোক মহিলাদের মতো আচরণ করছে কেন?
আরশ শ্রাগ করল। ঠোঁট উল্টিয়ে দু-পাশে মাথা নাড়াতে গিয়ে থেমে গেল। জায়িনের কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,”ওইসব মনে হচ্ছে!

জায়িন ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই আরশ বাঁ-হাতের মধ্যমা আঙুল বের করে ডান হাতের তর্জনী-আর মধ্যমা আঙুল দিয়ে কাঁচি আকার করে দেখাল। জায়িন নীরবে কিছুক্ষণ চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল। সতর্ক বাণী দিল,”সিগারেট খেতে দেখলে তোর সাথে এটাই করব আমি। একটা শব্দের এদিক-সেদিক হবে না। সো বি কেয়ারফুল, সন অফ হেলাল আহমেদ।
আরশ জায়িনের এমন হঠাৎ পালটে যাওয়াতে সামান্য ভরকাল। পরপর নিজেকে মনে করিয়ে দিল উনার পাশে দাঁড়ানো লোকটা জায়িন হেলাল। তাই উনার দ্বারা সব সম্ভব। আরশ পকেটে হাত ঢুকিয়ে সামনে চোখ ফিরাতেই জায়িন তীক্ষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”নুসরাতকে ধরতে পেরেছিলি?
আরশ শান্ত কন্ঠে আওড়াল,

“বেয়াদব মহিলা গলায় চাকু চেপে ধরে ভেগে গেছে।
জায়িন তর্জনী আঙুল ঠোঁটের উপর রাখল। হয়তো সামান্য হাসল। আরশ সেদিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকাল। তাকে নিয়ে হাসা হচ্ছে। অতঃপর তীক্ষ্ণ কন্ঠে জায়িন আবারো জিজ্ঞেস করল,” এশার নামাজ পড়েছিলি?
আরশের টনক নড়তেই দু-পাশে মাথা নাড়াল। জায়িন আদেশ দিল,”ফ্রেশ হয়ে গিয়ে নামাজ পড়, আমি এদিকটা সামলে নিচ্ছি।
আরশ যেতে নিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মন্টু মিয়া কিছু একটা বলছেন। মনোযোগ দিতেই কানে ভেসে এলো,”ওরা পাঁচজন ছিল।
অন্যকেউ কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই জায়িন গম্ভীর কন্ঠে শুধাল,”ওদের নাম জানেন?
মন্টু মিয়া বলে ওঠলেন,

“হু!
জায়িন আরশ দু-জন দু-জনের দিকে চেয়ে নিয়ে তৎপরতা নিয়ে শুধাল,”কী নাম?
মন্টু মিয়া এখনো মাটিতে বসা রয়েছেন। এত উপর থেকে পড়ায় কাদা থেকে উঠতে তার হিমশিম খেতে হচ্ছে। কোমড় সামান্য বাঁকাতেই ব্যথায় গুঙিয়ে উঠলেন। সজীব মন্টুর মিয়ার দিকে বিরক্তির নয়নে চেয়ে আছে। তার কাছে মনে হচ্ছে মন্টু মিয়া নাটক করছেন। মন্টু মিয়া গোঙাতে গোঙাতে বলে ওঠলেন,”একটার নাম নাম্বার ওয়ান এটা কম কথা বলেছে। নাম্বার ফাইভ আর ফোর আমাকে কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে রাখা দড়িটা ধরে রেখেছিল। আর নাম্বার থ্রি আর টু এই দুটোই ওদের লিডার মনে হয়েছে আমার। চৌদ্দগুষ্টি তুলে গালি দিয়েছে আমাকে। নাম্বার থ্রি তো আমার বংশের প্রদীপ লাথি মেরে নিভিয়ে দিতে চাইছিল।

মন্টু মিয়া কেঁদে দেওয়ার মতো করে কথাগুলো বললেন। আরশ ঠোঁট চেপে ধরে আলগোছে চলে গেল বাড়ির দিকে। জায়িন বাঁ-পাশে মুখ ঘুরিয়ে কপালে হাত ঘঁষল। মন্টু মিয়া কাঁদছেন, মুখ দিয়ে গোঙ্গাচ্ছেন। হঠাৎ জায়িনের বাঁ-হাত ঝাপটে ধরে বলে ওঠলেন,” আজ তুমি না আসলে ওই পাঁচজন আমায় মেরেই ফেলতো। নাম্বার থ্রি এর কাছে তো চকচকে ধারালো একটা ছুরি ছিল আমাকে কুপানোর জন্য। আমার মনে হইতাছে, ওইগুলা আমাকে পছন্দ করতো তাই হয়তো এমন করেছে!
আরশ ধীরে ধীরে যাচ্ছিল বাড়িএ দিকে আকস্মিক এমন কথা শুনতেই লাফ মেরে চলে আসলো আবার মন্টু মিয়ার সামনে। তিক্ত বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠল,”আপনাকে পছন্দ করবে মানে কী! আমার বউয়ের রুচি দূর্ভিক্ষ হইছে যে আপনাকে পছন্দ করবে?
আরশ বিরক্তি আর রাগক্তিতে কথা বলতে গিয়ে বারবার থেমে গেল। জায়িন একহাতে ধরে না রাখলে হয়তো মন্টু মিয়াকে কয়েক ঘা লাগিয়ে দিত। মন্টু মিয়া না বোঝার মতো করে বলে ওঠলেন,” ওরা পাঁচজন তোমার বউ হতে যাবে কেন ?

আরশের ইচ্ছে করল মন্টুকে ভয়ংকর কয়েকটা গালি দিতে। মুখের পেশি সংকুচিত করে কেউ না বোঝার মতো হিসহিসিয়ে গালি দিল,”ডোন্ট টক বুলসিট। আদার উইস আই উইল কিল ইউ বাস্টার্ড।
জায়িন মেকি হাসার চেষ্টা করল, কিন্তু গম্ভীর মুখ দিয়ে হাসির লেশমাত্র বের হলো না। আরশকে ঠেলে নিয়ে যেতে যেতে মন্টু মিয়ার উদ্দেশ্যে হাত মাথার কাছে ঘুরিয়ে দেখাল স্ক্রু সামান্য ঢিলা। আরশের রাগ দেখে কে! সে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন মন্টু মিয়াকে হাতের কাছে পেলেই থাবা বসিয়ে দিবে,নাহয় আস্তো গিলে নিবে। জায়িন চোয়াল শক্ত করে আরশকে বলে ওঠল,”আরশ এখন তুই বাচ্চামি করছিস! লোকটা বললেই কী নুসরাত উনাকে পছন্দ করবে! আর তুই এমন ভাব করছিস যেন ওকে তুই পছন্দ করিস? বিদেশে থাকতে তো কখনো ওর কথা কানেই নিতি না, এখন কী হয়েছে? এখন এটা বলবি না তুই ওকে পছন্দ করিস? নাহলে উল্টো করে বেঁধে পেটাব।
আরশ জায়িনের একটা কথা কানে ঢোকাল না। তীক্ষ্ণ চোখে শুধু দেখে গেল মন্টু মিয়াকে।

সৈয়দ বাড়ির পাছির টপকে ভেতরে ঢুকতেই টু ওয়ে অডিও থেকে ভেসে এলো নাজমিন বেগমের সতর্ক বাণী,”ওখানেই দাঁড়া..!
নুসরাত পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। বিরক্ত হলো মায়ের উপর, এসময় ও সিসিক্যামেরা অন করে বসে রয়েছেন কেন ভদ্র মহিলা। এই ঘরে জন্ম করে পাপ করে নিয়েছে সে! কোনো প্রাইভেসি নাই তার! স্থির নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে চোখ আশেপাশে ঘোরাতেই দেখল আহান, ইরহাম, ইসরাত আর মমো এক পায়ে ভর দিয়ে, কানে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো শাস্তি দেওয়া হচ্ছে ওদের। নুসরাত নাজমিন বেগম আসার পূর্বেই কান চেপে ধরে দাঁড়িয়ে পড়ল। নাজমিন বেগম ধীরে সুস্থিরে হাতে চ্যালাকাঠ নিয়ে এসে দাঁড়ালেন নুসরাতের সামনে। হাতের মধ্যে চ্যালাকাঠ নাড়াচাড়া করে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে ওঠলেন,”আপনার অপেক্ষাই ছিলাম, এবার কী করেছন সবাই মিলে সুন্দর করে বলে দাও!

নুসরাত চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। সদর্পে ছিনা টানটান করে। চ্যালাকাঠ দেখে বুক ধড়ফড় করে ওঠল তারপরও নিজেকে স্বাভাবিক রাখল। যদি একজন ও মুখ খুলে এই চ্যালাকাঠ, আর জারা লগো বিশিষ্ট নাজমিন বেগমের স্পেশাল চপ্পল তাদের পিঠে পড়বে। সব থেকে বেশি মার খাবে সে আর ইরহাম। তাই কোনোপ্রকার শব্দ না করার জন্য নুসরাত মুখ জিপার টানার মতো আটল। নাজমিন বেগম চ্যালাকাঠ হাতের তালুতে ধীর গতিতে মেরে মেরে জেরা করলেন,”বলবে না তো?

সবসবাই চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। নিঃশব্দে জারী করল পিটিয়ে তক্তা করলেও আজ কোনো বাক্য বের হবে না তাদের মুখ থেকে। প্রথম আঘাতটাই পড়ল নুসরাতের ডান পায়ে। ব্যথায় গা বিষিয়ে ওঠল। নিজের জায়গা থেকে সামান্য হেলে গেল দূরে তবুও চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। এরপরের বারিটা পড়ল ইসরাতের পিঠে। তৃতীয় বারিটা পড়ল ইরহামের পায়ে। চতুর্থ বারিটা পড়ল আহানের হাতের মধ্যে। সকলেই অবস্থ মার খাওয়ার বিষয়ে তাই চুপচাপ গিলে নিল মারের জ্বালা। মমোর সামনে দাঁড়িয়ে নাজমিন বেগম সামান্য ভ্রু উচালেন। আলগোছে মেয়েলি মুখ থেকে উড়ো চুলগুলো সরিয়ে দিলেন আঙুলের স্পর্শে। বলে ওঠলেন,”আমি একটা সুযোগ দিচ্ছি তোকে, কিছু বলার থাকলে বলে ফেল। মার খাওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবি!

মমো চ্যালাকাঠের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে কেঁদে উঠল। নুসরাত বিরক্ত হয়ে শ্বাস ফেলল। ইসরাতের ইচ্ছে করল মমোর কোমড়ে লাত্থি মেরে দূরে ফেলতে। সামান্য এই বিষয় নিয়ে কে কাঁদে! ছাগল কোথাকার! নুসরাত হিসহিসিয়ে গালি দিল,”সুদি*র ভাইটাকে নিয়ে যাওয়াই ভুল হয়েছে, শালী না আবার মুখ খুলে দেয়। এই শালী এত কাঁদে কেমনে! নিব্বি কোথাকার!
মমো দুঃখি চোখে চ্যালাকাঠের দিকে চেয়ে রইল। ইরহাম নিশ্চিত হয়ে গেল ও বলে দিবে। নুসরাত তার দিকে তাকাতেই মুখ চোখা করে ইশারায় বলল,”মামা,আজ যদি এই সু*দির বোন কিছু বলে, একে ধরে আমি কী করব নিজেও জানি! বলেছিলাম, ছাগলটাকে না নিতে, তুই কুত্তার বাচ্চা নিয়ে গেছিস। এবার বোকা*চো*দাটা দেখিস নির্ঘাত মুখ খুলবে।

নুসরাত নিজেও হাজারটা গালি দিল মমোকে। সবাই সিওর থাকল এক্ষুণি মুখ খুলবে খবিশটা। সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে মমো উচ্চ শব্দে কেঁদে ওঠে বলল,”আমি পারব না বলতে, ওরা আমাকে তাহলে ধোঁকাবাজ মনে করবে।
সবাই সবার পানে চেয়ে ঠোঁট উচালো সামান্য বিরক্তিতে। নুসরাত রাগে ফুসফুস করে বলে ওঠল,”এই সাউয়াডার মুখ কেউ বন্ধ করা, ভালো লাগে না এসব বালের প্যানপ্যানানি শুনতে।
নুসরাত দু-হাত উপরে উঠিয়ে দোয়া করল,

“ইয়া আমার রব, আপনি যদি আমায় সামান্য ভালোবেসে থাকেন তাহলে এই বান্দিকে আপনার কাছে ডেকে নেন, আর যদি না ভালোবাস থাকেন তাহলে আরো আগে আপনার কাছে উঠিয়ে নেন।
নুসরাত কথা শেষ করার পূর্বেই ধুপ করে চ্যালাকাঠের বারি পড়ল তার পিঠে। এরপর আরো একটা, আরো একটা করে গণে গণে চারটা পড়ল। নুসরাত ব্যথায় কঁকিয়ে ওঠতেই, নাজমিন বেগম ঠোঁটে হাত রেখে বলে ওঠলেন,” চুপ একদম চুপ! মুখের ভাষা ঠিক না করলে এভাবে পিটিয়ে তক্তা করব। বেয়াদবের বাচ্চা..!
নুসরাত ইসরাতের দিকে চোখ ফিরিয়ে অভিযোগ করল,”এই জল্লাদ মহিলা আমার মা হতেই পারে না? এই মহিলা ওই আরশ ব্যাটা আর জায়িন ব্যাটার মা। ওদের ভেতর আস্তো ঢুকে যাবে এমনভান করে, আর আমাকে যেনো দু-চোখে দেখতে পারে না। শুধু টাকা আয় করতে দাও, এই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়ে বের হয়ে যাব।

নাজমিন বেগম নুসরাতের পায়ে ধুপধাপ দুটো বারি বসালেন। কোমড়ে হাত রেখে ব্যগ্র কন্ঠে বলে ওঠলেন,”ঠ্যাং দেখিয়ে বের হওয়ার আগেই ঠ্যাংই ভেঙে রেখে দেব। একদম বের হয়ে যাবে ঠ্যাং দেখিয়ে বের হওয়া।
নাছির সাহেব চোখে চশমা পরে উঁকি মারলেন নিজের বেডরুমের বারান্দা থেকে। রেলিঙের সামনে দাঁড়িয়ে শুধালেন,”ক্লাস কেমন চলছে আপনাদের?
নুসরাত আর ইসরাত একসাথে চিৎকার করে ওঠল,

“আব্বা..!
নাছির সাহেব গম্ভীর গলায় হু হু করে হেসে ওঠলেন। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন,” নাজমিন ছেড়ে দাও আজকের জন্য, অনেক রাত হয়েছে। আগামীকাল ক্লাস নিবে।
নাজমিন বেগম অত্যাধিক শান্ত সুরে বলে ওঠলেন,
“বাড়ির ভেতর থাকতে আপনার ভালো লাগছে না, আপনারও মনে ইচ্ছে জেগেছে নাকি বাহিরে আসার, ওদের মতো লাইন দিয়ে দাঁড়ানোর, হলে বলুন আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি!
নাজমিন বেগমের কথায় নাছির সাহেব ঠোঁট বাঁকালেন। মেকি হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলে ওঠলেন,” ক্যারি ওন গাইজ, আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। এই বয়সে এসে কান ধরে দাঁড়ানোর কোনো ইচ্ছে আমার নেই।

নাছির সাহেব দো-তলার বারান্দা থেকে হেলে দুলে চলে গেলেন নিজের রুমে। নাজমিন বেগম ও বাগানে পাতা চেয়ার টেনে বসলেন। হাতের চ্যালাকাঠ এখনো স্থায়ীভাবে নাড়াচাড়া করছেন। কারোর পেট থেকে কোনো কথা বের করতে না পেরে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসলেন। অতঃপর বললেন,”যে যার বাড়ি যাও।
ইরহাম মনে করেছিল এবার হয়তো নাজমিন বেগম তাদের প্রতি একটু সদয় হবেন, কিন্তু এই ভদ্র মহিলা আজ মনে হয় কথা পেট থেকে বের করতে না পারলে বাড়িতে ঢুকতে দিবেন না। ইরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মিনমিনিয়ে বলে ওঠল,”গোসলটা করে বাড়ি যাই!

নাজমিন বেগম এক মুহুর্ত দিরুক্তি না করে উত্তর করলেন,”আজ এই বাড়ির ভেতর ঢোকা সবার জন্য নিষিদ্ধ। প্রয়োজন নেই গোসল করার, মাঠে গিয়ে হালচাষ করো। টাকা দিয়ে ধান চাষ করার বদলে তোমাদের পাঠালে ভালো হতো, তাহলে কতগুলো টাকা বেচে যেত।। আগামীকাল থেকে তোমাদের সবাইকে চাষ করার জন্য পাঠাব।অজাতের বংশধর..!
আহান দুঃখি মুখে বলে ওঠল,
“একটা কথা রাখো আমার, আম্মুকে জাস্ট কল দিয়ে বলো গেটটা খুলে দিতে।
নাজমিন বেগম সামান্য সদয় হলেন আহানের কথায়। চেয়ার থেকে উঠে চুপচাপ চলে গেলেন বাড়ির ভেতর। ফোন হাতে বাড়ি থেকে নিয়ে এসে বসলেন আবার নিজ জায়গায়। কললিস্ট ঘেটে ছোট লিখা নাম্বারে কল করলেন। দুটো রিং হতেই কল পিক করলেন রুহিনী। লাউড স্পিকারে থাকা ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসলো রুহিনীর গলার আওয়াজ,” আসসালামু আলাইকুম আপা।
নাজমিন বেগম সালামের জবাব দিলেন,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।
রুহিনী বেগম শুধালেন,
” কোনো সমস্যা হয়েছে কী আপা? এত রাতে কল দিলে?
“কোনো সমস্যা হয়নি, গেট খোল নবাবজাদারা বাড়িতে ঢুকবে।
রুহিনী বেগম বিরক্তি সুরে বললেন,
” পারব না, ওই অজাত গুলোকে আজকের জন্য তোমার কাছে সপে দিলাম। যা ইচ্ছে করো, আমি গেট খুলছি না। নিজেরা নিজেরা ব্যবস্থা করে নিতে বলো।
খট করে ফোন কাটার শব্দ হলো। ইরহাম একপায়ে দাঁড়িয়ে থেকে মুখ সামান্য বাঁকাল। তারপর বলল,”আমার মাম্মিকে কল দাও।

নাজমিন বেগম ঠোঁট চেপে ফোন লাগালেন ঝর্ণা বেগমকে। ঝর্ণা ফোন ধরে কাউমাউ শুরু করলেন। সবার কাছে এমনই মনে হলো। বললেন,”শোহেবের বাচ্চাটাকে আজ শুধু হাতের কাছে পাই মেজ আপা। জুতো দিয়ে পিটিয়ে এর লুচ্চামি আমি ছাড়াব। ওই কুত্তার বাচ্চা যদি তোমার ওখানে থাকে তাহলে তুমি আমার বদলে জুতো পিটা করে দিও। মরেছে কোথায় রামছাগলের বাচ্চাটা? আমি কল দিলে কল পিক করে না, ওর সময় থাকে না। আর হাজারটা মেয়ের সাথে প্রেম করে, ওদের সাথে সারাদিন গরুর মতো প্যানপ্যান করতে পারে তখন সময় থাকে। আসুক আজ বাড়িতে ঝাটা পিটা করে মেয়েদের ভুত ছাড়াব।
নাজমিন বেগম ঠোঁট টিপে হেসে দিলেন। ইরহাম সবার সামনে অপমানিত হয়ে প্রথমে চোখ উল্টাল। মুখ বানাল এমন যেন ঝর্ণা বেগমের কথায় ব্যথিত হয়েছে। এর ঠিক গণে গণে দু-সেকেন্ড পরেই নির্লজ্জের মতো দাঁত কেলিয়ে হাসল। নাজমিন বেগম ফোন রেখে দিয়ে ইরহাম আর আহানের দিকে চেয়ে চেয়ে হাসলেন। ভ্রু উচিয়ে শুধালেন,”আর কিছু?

নাজমিন বেগমকে এরকম তাদের নিয়ে হাসতে দেখে আহান লজ্জা পেল। কান থেকে হাত সরিয়ে এক দৌড় দিল গেটের দিকে। ইরহাম ও আহানের পেছন পেছন দৌড়াল। নাছির মঞ্জিল থেকে বের হয়ে একদম সৈয়দ বাড়ির ফটকের সামনে এসে দাঁড়াল। কোমড়ে দু-হাত চেপে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে চোখাচোখি করল। তারপর দু-জনেই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল পাছির টপকে ভেতরে ঢুকবে। ইরহাম ঝুঁকে বসতেই আহান তার কাঁধের উপর দু-পা দিয়ে আলগোছে দেয়ালের উপর উঠে গেল। পাছিরের উপর থেকে ব্যালেন্স হারিয়ে ওপাশে ধুপ করে আলুথালু হয়ে পড়ল। ব্যলেন্স হারিয়ে পড়ায় পায়ে আর কোমড়ে ব্যথা পেয়ে কঁকিয়ে ওঠল। কিছুক্ষণ ছটফট করতেই ইরহামের সতর্ক গলা ভেসে আসলো,”গেট খোল আমার বাপ!

আহান নিজেকে সামলে নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে এসে গেট খুলে দিল। ইরহাম দু-হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভেঙে আরাম করে ভেতরে প্রবেশ করল। বাড়ির মেইন দরজার নব ধরে ঘোরাল, সেটা ভেতর থেকে লাগানো দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পাইপ বেয়েই উপরে উঠা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখল না দু-জন। বাড়ির উল্টোপাশে চলে গেল অলস ভঙ্গিতে হেঁটে। পাইপ বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে বেগ পোহাতে হলো। পাইপ থেকে পা পিছলে কয়েকবার মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। অনেক প্রচেষ্টা করে উপরে উঠল। অতঃপর দু-জনে দু-জনের পানে চোখ নিবিষ্ট করে প্রশান্তির শ্বাস ফেলল। আহানের বারান্দার দরজা খোলা থাকার ধরুণ দু-জনকে আর কষ্ট করতে হলো না ভেতরে ঢুকতে।

শরীর চিপচিপে হওয়ার জন্য দু-জনেরই মনে হলো গোসল নেওয়া প্রয়োজন। তাই হাতে তোয়ালি নিয়ে আহান দৌড়াল নিজের বাথরুমে। শাওয়ার অন করার আগে মনে হলো ওরেব্বাস দু-দিন আগের ছোটমায়ের পেটানোর ভিডিওটা সে নেটিজেনদের মধ্যে পোস্ট করেনি। সেটা মনে হতে চুপচাপ বাথরুম থেকে বের হয়ে আসলো। ল্যাপটপ হাতে নিয়ে কাজ সম্পাদন করল। সেটা শেষ করে চলে গেল ওয়াশরুমে আবারো। আধঘন্টা লাগিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করার পর বের হলো ওয়াশরুম থেকে। পরণে শর্ট প্যান্ট। তোয়ালি দিয়ে চুলের পানি মুছতে মুছতে এসে বসল বিছানায়৷ কিবোর্ড এ কিছু একটা টাইপিং করতে করতে হঠাৎ তার দৃষ্টি কাড়ল কয়েকটা নোটিফিকেশন। সেখানে ঢুকতেই তার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।

ভিডিও এডিট করে পোস্ট করবে তা বেমালুম ভুলে বসেছে সে। নাজমিন বেগম তাকে পিটাচ্ছেন সেটাও ছেড়ে দিয়েছে। মাথায় হাত পড়ল তার। ইয়া আল্লাহ, একি করল সে! ইচ্ছে করল নিজের মাথায় নিজে দুটো লাথি মেরে দিতে। রেগেমেগে আগুন হয়ে ভিডিও ডিলেট করতে গিয়ে চোখ পড়ল ভিউজে। আর তার চোখ ওখানেই আটকে রইল। দু-ঠোঁট ফাঁকা হয়ে গেল নিমেষে। মাত্র ত্রিশ মিনিটে এত এত শেয়ার, লাইক, কমেন্ট দেখে আহানের ইচ্ছে করল একবার অজ্ঞান হয়ে যেতে। হাতের তোয়ালি কখন হাত ফসকে মাটিতে গড়িয়েছে তার কোনো চিন্তা নেই। হা করে ল্যাপটপের মনিটর এর দিকে চেয়ে রইল। সময় গড়াল, ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ বাড়ল, আহান থম মেরে বসে রইল। অতঃপর মনে হলো দম আটকে এখানেই সে মরে যাবে। ধুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ল, ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে লাগল, যাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিটা সচল হয়। চুপচাপ পড়ে রইল অনেকক্ষণ, ল্যাপটপের মনিটরে দেখা গেল ভিডিও ভিউস ১.৩ এম।

নুসরাতের ঠান্ডা লেগেছে ভয়ংকর। শরীর মোটা কাঁথা জড়িয়ে ঘুরছে। গতকাল রাত দুটোর সময় গোসল করেছিল তারা সবাই মিলে। নাজমিন বেগম বাড়িতে ঢুকতে দেননি ও রাতে। বালিশ আর মাদুর হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সারারাত শাস্তি পাওয়ার সাথে মোবাইল ও হাতে পায়নি কেউ। মোবাইল চেক করার কথা সবাই ভুলে বসেছে। ইসরাত সকাল থেকে চোখে অন্ধকার দেখছে, নাক টেনে টেনে হাঁটছে। চোখদুটো ভীষণ জ্বালা করছে জ্বরের প্রকোপে। হঠাৎ হঠাৎ চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। মমো সারা সকাল ধরে ঘুমাচ্ছে। একবার সোফায় ঘুমাচ্ছে, একবার ডায়নিং টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে, যেদিকে যাচ্ছে ঘুমাচ্ছে। সবার অলস সকাল এমন কাটল৷ ধীরে ধীরে সবাই ঠিক হলেও, নুসরাত হলো না। সে এই সর্দির মধ্যে গলায় ঠান্ডা পানির বোতল নিয়ে ঘুরছে। কথার সাথে হাজারটা হাচ্ছি দিচ্ছে ছাগলের মতো।

নাজমিন বেগম পানির বোতল টেনে নিতে পারেননি, ঘাড়ত্যাড়ামি করে ঠান্ডা আইস যুক্ত পানি খাচ্ছে। তার নাকি প্রচুর গরম লাগছে। গলা শোকাচ্ছে একটু বেশি। সৈয়দ বাড়ির দু-জন নবাবজাদা ও নাকি অসুস্থ হয়ে বিছানায়। তাই সকাল থেকে এই বাড়িতে দেখা নেই তাদের। এত অসুস্থতার মধ্যে নুসরাতের পটর পটর বন্ধ হয়নি। নাকে নাকে কথা বলছে, সাথে চোখের পানি মুছছে। কথা বললেই চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে। নাকে কিছু একটা হচ্ছে তার, সেটা কাউকে বলে বোঝাতে পারছে না। হাতে নিজের পুরোনো ছিঁড়া ফাটা গেঞ্জি নিয়ে ঘুরছে। ইসরাতের পাশে বসে শব্দ করে নাক টেনে সর্দি পরিস্কার করছে। এত অসুস্থতার মধ্যেও মুখ বন্ধ হচ্ছে না নুসরাতের। কথা বলে বলে শুধু চোখ মুছছে। ইসরাত নুসরাতের এই জ্বালা একঘন্টা বসে সহ্য করল।

এত নাক টানার শব্দে আর নাকি সুরে কথা বলা শুনে মাথা ধরে গেল ইসরাতের। তাই নুসরাতকে ঠেলে সরিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়ল। নুসরাত এতিমের মতো মুখ বানিয়ে বাড়িতে ঘুরতে লাগল। মমোটাকে খুঁজে পেল না কোথাও! একটু কথা বলা যেত যদি খুঁজে পেত। কোথায় পড়ে ঘুমাচ্ছে আল্লাহ ভালো জানে। নাজমিন বেগমের আশেপাশে গেল না আজ আর জ্বালাতে। ইরহাম আর আহানটা ও আসেনি আজ তাদের বাড়িতে। তাই নুসরাত নিজে কাঁথা মুড়ি দিয়ে বের হলো বাড়ি থেকে। শিকদার বাড়িতে যাওয়ার জন্য। কপাল পর্যন্ত ঢাকা হুডি পরে কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে কলিং বেল বাজাল। সৌরভি এসে গেট খুলে দিয়ে নিয়ে গেল ভেতরে।

নুসরাত ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখা হলো আরমানের সাথে। ছোট্ট শব্দে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন? এইটুকু জিজ্ঞেস করে আলগোছে চলে গেল ভেতরে। উত্তর জানার প্রয়োজন বোধ করল না৷ আরমান ও এতে কিছু মনে করল না, এই মেয়ে এরকম করে সেটা তার জানা। তাই মনে কোনো ক্লেশ না রেখে সে নিজেও চুপচাপ বেরিয়ে গেল বাড়ির বাহিরে। নুসরাত সৌরভির রুমে ঢুকে চিৎপটাং হয়ে শুয়ে পড়ল। এইটুকু রাস্তা হেঁটে আসায় হাঁপিয়ে উঠেছে। নুসরাতের কপালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করল সৌরভি। অস্বাভাবিক গরম গা টা। তারপর বকে ওঠল,”এই অসুস্থ শরীর নিয়ে আসছিস কেন এখানে? আমাকে বললেই তো আমি চলে যেতাম।

নুসরাত আলুর বস্তার মতো পড়ে রইল বিছানার, ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলল। সৌরভি বুঝল না,তাই কান পাতল গিয়ে নুসরাতের ঠোঁটের কাছে। নুসরাত আবারো বলল,”মোবাইলটা দে শালী!
কথা শেষ করে নাক পরিস্কার করল। নাক পরিস্কারের জিনিসটা দিয়ে চোখ মুছে নিল। সৌরভি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই গিয়ে নিয়ে আসলো নিজের ফোন। আলগোছে বাড়িয়ে দিল নুসরাতের কাছে। কোনোপ্রকার দিরুক্তি না করে শুধায়,”মোবাইল দিয়ে কী করবি?
নুসরাত নাকি সুরে বলে ওঠল,
“জীবনটা পাংসা হয়ে আছে,একটু রশ কষ আনার জন্য আজমল আলীর নাতিকে কল দিচ্ছি।
সৌরভি বিরক্তিতে চ বর্গীয় শব্দ মুখ দিয়ে বের করল। বলল,” তো বেচারাকে জ্বালাবি কেন? বেচারা তোর কোন ভাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে।

নুসরাত নাক ফুলিয়ে চেয়ে শব্দ করে নাক মুছল। কথা বলতে পারছে না এই সর্দি বিশিষ্ট নাকের জন্য। নাকি কন্ঠে বলল,”চুপ বেডি। তোর এত ধরছে কেন? আবার বলিস না, পছন্দ টছন্দ করিস ওই ব্যাটাকে?
নুসরাত তীক্ষ্ণ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। চোখ দুটো সরু করে পরখ করে নিল সৌরভিকে। সৌরভি শব্দ করে শ্বাস ফেলে বলল,”যা ইচ্ছে তোর তাই কর, আমি এতে নাই।

নুসরাত কাঁথার ভেতর থেকে থামজ আপ দেখাল। আরশের নাম্বার ডায়াল করল। প্রথমবার ফোন দেওয়ার পর রিং হতে হতে কেটে গেল। আবার কল দিল আবারো এরকম হলো। আবারো দিল আবারো সেইম কাজ হলো। নুসরাত হেরে না গিয়ে লাগাতার কল দিতে থাকল, আরশ তারপর ও ধরল না। দশমবারের মতো কল দিতেই আরশ ফোন ধরল,নুসরাত খেয়াল করল না সেটা। মনে করল এবারো কাট করে দিবে, তাই আবারো কল দিতে উদ্যেগী সে। নুসরাতের চিন্তায় ভাটা পড়ল শক্ত কন্ঠের চিৎকারে। ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এলো গুরু গম্ভীর সুরে কয়েকটা স্লাং,”জার্ক কোথাকার! কল পিক করছি না তারপরও কেন লাগাতার কল দিচ্ছিস? ডু ইউ ফাকিং ওয়ান্ট টু মেরি মি ওর হোয়াট, যে এভাবে কুত্তার মতো পিছু লেগেছিস?

আরশের ক্রোধানিত সুরে চিৎকারে সৌরভির চোখ মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। নুসরাত চোখ কুঁচকে হেসে দিল সামান্য। তারপর পি পি করে কল কেটে গেল। নুসরাত নতুন উদ্যোগে ফোন দিল আবার। ফোন কানে লাগিয়ে মুখ কুঁচকে ফেলল। সৌরভির দিকে অক্ষিপট ঘুরিয়ে বলে ওঠল,”ব্লক করে দিয়েছে। আর কোনো নাম্বার আছে?
সৌরভি বলার পূর্বেই নুসরাত ফোন ঘেটে অন্যসিম দিয়ে কল লাগাল। প্রথমবার রিং হতেই কল পিক হলো এবার। নুসরাত সামান্য অবাক হলো এতে! তাছাড়া অপাশ থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো টু শব্দ আসেনি। নুসরাত নাক ভালো করে কাপড় দিয়ে মুছে নিয়ে নাকি সুরে ডেকে ওঠল,”হ্যালো,জানেমান..!
আরশের শান্ত আওয়াজ ভেসে এলো,

“হু!
নুসরাত থমকাল সামান্যক্ষণের জন্য। অতঃপর শুধাল,
“প্রেম করবেন?
আরশ পুরু ঠোঁট নাড়িয়ে গম্ভীর গলায় উত্তর দিল,
“আপনি হলে আলহামদুলিল্লাহ বলতে দিরুক্তি করব না, প্রেম কী আর জিনিস!
নুসরাতের চোখগুলো দেখার মতো প্রকট হয়ে গেল। যে কেউ দেখলে বলবে অক্ষিকোটরের ভেতর থেকে বের হয়ে আসবে। মোবাইল মিউটে ফেলে সৌরভির দিকে তাকিয়ে বলল,” ভাই কোনো রিয়েক্ট করতাছে না! ফ্লার্ট চালিয়ে যাব?
সৌরভি এবার নড়েচড়ে বসল। বলে ওঠল,

“স্পিকারে দেয়।
নুসরাত যতক্ষণ পর্যন্ত চুপ ছিল লোকটা ও চুপ ছিল। কল আনমিউট করে গলা খাঁকারি দিল। নাক টেনে বলে ওঠল,”জানেমান খাবার খাইছো?
” আপনাকে ছাড়া কীভাবে খাবার খাব জানেমান? তাই আপনার অপেক্ষায় বসে আছি, আপনি এসে মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিবেন তারপরই খাবার খাবো তার আগে আমার গলা দিয়ে একটা দানা-পানি নামবে না বউ!
নুসরাতের চোখদুটো রসগোল্লার মতো হয়ে গেল। সৌরভির দিকে চোখ উল্টে তাকাল। কল মিউট করে সৌরভির দিকে চেয়ে বলে ওঠল,”এরে পাগলে ধরছে? বউ ডাকছে!
এর মধ্যে আরশের গলা ভেসে আসলো,

“জানেমান কথা বলছেন না কেন?
নুসরাত দাঁতে দাঁত চেপে নাকি সুরে শুধায়,
” প্রেম কয়টা করেছেন আপনি?
আরশ গম্ভীর গলায় বলল,
” প্রেম অনেকগুলো করেছি, সেগুলো নাহয় তোলা থাক। একদিন আপনাকে আদর দিতে দিতে বলব।
নুসরাত শোয়া থেকে উঠে বসল। তার অতিরিক্ত রাগ লাগছে, সাথে গরম লাগছে। সৌরভিকে ইশারা করল, এসির পাওয়ার কমিয়ে দিতে। কাঁথা শরীর থেকে ছুঁড়ে দূরে ফেলল। নুসরাত শুধাল,”জানেমান বিয়ে করবেন আমায়?
আরশ ধারালো চোয়ালে হাত বুলিয়ে নিয়ে অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে ওঠল,”কেন নয়! তার আগে এটা বলুন শিকদার বাড়িতে এসে আপনাকে লাথি মারব, নাকি মোবাইলের ভেতর থেকে লাথি মারব?
সৌরভি বিছানায় মুখ চেপে হেসে ফেলল। নুসরাত বলল,”আপনাকে আগে আমি লাথি মারব, তুই আগে বল কয়টা প্রেম করেছিস?

আরশ কৌতুক করে বলে
“তোকে বলতে বাধ্য নই। কী করবি তুই?
নুসরাত রেগেমেগে বিছানার মধ্যে উঠে দাঁড়াল প্রায় লাফ মেরে। উচ্চ শব্দে চিৎকার করে বলে ওঠল, ” আমি ও তোকে লাথি মারব বদমাশ কোথাকার!
“থাপড়িয়ে গাল ফাটিয়ে ফেলব, বেয়াদব। কিছু বলি না বলে মাথায় চড়ে বসেছ?
“আমি তোর মাথার উপর উঠে ডোল বাজাব, তুই আটকাবি আমায়?
আরশ রাগের দাবানলে পৃষ্ঠ হয়ে গা থেকে ঝড়ে পড়ল সেদ জল। নিমেষেই পুরুষালি সৌষ্ঠব পিঠ ঘেমে জবজবে হয়ে উঠল। গলার নীল রগ গুলো ফুলে ফেপে উঠল রাগের তোপে। শ্বাস চলাচলের গতি দ্বিগুণ হলো। শক্ত হাতের তালু দিয়ে রেলিঙ চেপে ধরে নিজের অস্বাভাবিক রাগ নিয়ন্ত্রণ করার বৃথা প্রয়াস চালাল। দাঁতের মাড়ি চেপে ধরে বলে ওঠল,”শাট ইউ্যের ফাকিং রুড মাউথ এন্ড স্টপ ইয়েলিং লাই আ বাস্টার্ড. ইফ ইউ মেইক ওয়ান মোর সাউন্ড, আই সোয়ার আই উইল স্লেপ ইউ সো হার্ড ইউ্যের টিথ উইল ফ্লাই আউট অফ ইউ্যের মাউথ।

নুসরাত চোখ বড় বড় করে নিল। কত্ত বড় সাহস তার দাঁত নাকি থাপ্পড় মেরে ফেলে দিবে। এটার সাথে সংসার করবে না সে। রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য প্রায় নুসরাত। চিৎকার করে ওঠে বলল,” তোর সাথে আমার এখানেই সব শেষ, তুই কুত্তা, তুই পাঠা, তুই গরু, তুই মেয়বাজ! বউ থাকতে অসংখ্য প্রেম করিস, লজ্জা লাগে না তোর? বদ*মাস, নির্লজ্জ..! তোর সংসার আমি করব না পাঠা।
আরশ নিজেও রেগে গেল। সামনে পেলে বেয়াদবের বাচ্চাটাকে কয়েকটা লাগিয়ে দিত সে। আজকাল মুখ চলছে অনেক বেশি। ফোন কানে লাগিয়েই চোখ মুখ ফ্যাকাশে করে বের হলো রুম থেকে। একহাত প্যান্টের পকেটে পুরে রাবার বল পকেট থেকে বের করে এনে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরল। ফোন কানে চেপে করিডোর পার হতে হতে চূড়ান্ত রাগী কন্ঠে আওড়াল,”Say one more fucking word, Nusrat Nasir… and I swear, I’ll fucking bury you alive. Let that shit sink deep into your head.
নুসরাত নিজেও দ্বিগুণ তালে চিৎকার করে ওঠল,

“এবার তো এটা চূড়ান্ত তোকে আমি ডিভোর্স দিব, দিব, দিব। তোর সাথে সংসার আমি করব না, আটকাতে পারলে আটকে দেখা!
আরশ সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত পায়ে নামল। খেপাটে নয়নে ড্রয়িং রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে সবাইকে না দেখার মতো করে বেরিয়ে আসলো বাড়ি থেকে। রাগের ঘনত্ব এত বাড়ল আরশের, দন্ত কপাটির একটার চাপে অন্যটা প্রায় ভেঙে যাওয়ার মতো হলো। কিড়মিড়িয়ে বলে ওঠল,”এখনো সময় আছে তোর এই ফাকিং মুখ সামলা। আমার রাগ কিন্তু মাথায় চড়ে বসছে। আছাড় মেরে দুনিয়া থেকে তুলে দেব।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২৬

” তোকে আছাড় মেরে তোর মাথা ফাটিয়ে ফেলব। ফোন রাখ শালা, তোর সাথে সংসার এখানেই শেষ। ডিভোর্স পেপার পাঠিয়ে দিব বদ*মাস, লুচ্চা, পাঠা কোথাকার!সাইন করে দিবি। তোকেই ডিভোর্স দিয়েই আমি আরেকটা বিয়ে করব, তুই শুধু বসে বসে দেখবি আর আঙুল চুষবি।

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here