প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২১

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২১
জান্নাত নুসরাত

সাদা সাদা মেঘের থোকা নীল দিগন্তে নিজেদের অধিপত্য বিস্তার করেছে। হিমেল বাতাস বইছে প্রকৃতিতে। বাহিরে মেঘের আনাগোনা চললেও পরিবেশ আগের ন্যায় গরম। ঠান্ডা বাতাসে পরিবেশ একটু শীতল হওয়ার বদলে তা আরো দ্বিগুণ স্থরে গরম হচ্ছে। সেই গরম এসে ভর করেছে নাছির মঞ্জিলের দ্বিতীয় কন্যা সৈয়দা নুসরাত নাছিরের ওপর। বিরক্তিতে মুখ ঠোঁট কুঁচকে বসে আছে সে। সামনে বসা আহান নিজেও বোকার মতো মুখ বানিয়ে চেয়ে আছে বইয়ের পানে। নিজেই বুঝতে পারছে না তার ভুলটা কী! নুসরাতের এমন ক্ষিপ্ত চাহনি বাই বা কেন তার দিকে? কাচুমাচু ভঙ্গিতে যখন বসে ছিল আহান, তখন নুসরাত শক্ত কন্ঠে বলে ওঠে,”পড়, এরকম গাধার মতো এই রসায়ন কেমিস্ট্রি এর দিকে তাকিয়ে আছিস কেন?

আহান নুসরাতের ভুল ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক বলে ওঠল,”রসায়ন কেমিস্ট্রি কী? বললে একটা বলো!
আহান কথা শেষ করতেই তার কানে ভেসে আসলো দাঁত দিয়ে কটমট করা শব্দ। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে ভেবে জিহ্বা কাটল। তারপর চুপচাপ পড়তে মনযোগী হলো। মনে মনে ভাবল, কোন ঠাডা এসে পড়েছে আপির ওপর যে তাকে এই রাক্ষস মহিলার কাছে পড়তে রেখে গিয়েছে। তার বাপকে ও বলিহারি! পড়াশোনার জন্য এদের কাছেই পাঠাতে হলো। ইরহাম ভাইয়ার কাছে পাঠালে কী এমন হতো! নিজেই নিজের জিব কাটল আবার। দু-পাশে মাথা দোলাতে দোলাতে নিজেকে শুধরে মিনমিনে কন্ঠে বলে ওঠে,”ইরহাম ভাই কিছু পারে নাকি!
নুসরাত মোবাইল এক হাতে চাপতে চাপতে আহানকে উদ্দেশ্য করে বলল,”একাদশ অধ্যায় বের কর!
আহান একাদশ অধ্যায় বের করল। নুসরাতের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”তুমি জানো এই অধ্যায়ে কী আছে?
নুসরাত সামান্য চোখ ঘোরাল আহানের দিকে। নিজের মেয়েলি চোখগুলো দিয়ে ইশারা করল পড়া শুরু করতে। আহান মিনমিন করে নুসরাত জানে নাকি জানে না তা জানার জন্য শুধাল,”একাদশ অধ্যায়ের নাম কী?
নুসরাত মোবাইলের দিকে চোখ রেখে উত্তর দিল,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“খনিজ সম্পদ: জীবাশ্ম! হয়েছে? এবার পড়া শুরু কর।
আহানের এতেও হলো না। নুসরাতের পানে গোল গোল চোখে চেয়ে জানতে চাইল,” তোমার এসব মনে আছে কীভাবে আপু?
“তোর মতো মাথামোটা পেয়েছিস? আমি নুসরাত নাছির যা একবার জীবনে দেখি, তা কখনোই ভুলি না।
আহান নুসরাতের কথায় ভেংচি কাটল। অতঃপর বই পড়া মনোযোগী হতে বইয়ের পাতা উল্টালো শুধু। কিছুই পড়ার মতো মনে হলো না তার কাছে। তাই নুসরাতকেই প্রশ্ন করতে তৎপর হয়। কলম মুখে ঢুকিয়ে চোখের গোল চশমা জোড়া নাকের ডগায় নামিয়ে প্রশ্ন করল,”হাইড্রোকার্বন কী?
নুসরাত মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল,
” হাইড্রোজেন ও কার্বনের সমন্বয়ে গঠিত জৈব যৌগকে হাইড্রোকার্বন বলে। এবার তুই পড় আমার বাপ, না হয় আমি লাঠি দিয়ে তোরে পিডামু।

আহান নুসরাতের ওপর বিরক্ত হয়ে বই দেখতে ব্যস্ত হলো। অ্যালকিনের রাসায়নিক ধর্মের পটাশিয়াম পারাম্যাঙ্গানেট দ্বারা জারণ বের করে একটুক্ষণ চোখ বুলালো। সব তার ছোট মাথার দু-হাত উপর দিয়ে চলে গেল। নুসরাতের পানে চেয়ে শুধাল,”এখানে ইথিন এর সাথে পানি কেন যোগ করল? অন্য কিছু তো ব্যবহার করতে পারতো?
নুসরাত মোবাইল হাত থেকে ফেলার মতো ছুঁড়ে ফেলল রিডিং টেবিলে। আহান কেঁপে ওঠল সেই শব্দে। নুসরাতের দিকে তাকাতেই রেগে আগুন হওয়া লাল মুখ তার অক্ষিপটে ভাসল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই নুসরাত একহাতে আহানের ঘাড় চেপে ধরে টেবিলের মধ্যে কয়েকটা লাগিয়ে দিল। রাগে হিসহিস করতে করতে বলে ওঠল,”আইন্সটাইন এর বাচ্চা, এত প্রশ্ন আসে তোর কোথা থেকে? বইয়ে যা দিছে তা পড়বি, তা না করে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করেই যাচ্ছিস! একবার মুখ বন্ধ করার নাম নেই! এই সমস্যা কী তোর? পড়তে আসছিস নাকি আমার ইন্টারভিউ নিতে আসছিস?

নুসরাত আহানকে ছেড়ে দিয়ে ওঠে দাঁড়াল আচ্চা মতো কয়েকটা ধুলাই দেওয়ার জন্য। বিছানা ঝাড়ু খোঁজ করতে লাগল অক্ষিকোটর ঘুরিয়ে। নুসরাতের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে ততক্ষণে রুম থেকে বই নিয়ে পালিয়েছে আহান। নুসরাত পিছু ফিরে আহান আছে কি নেই তা দেখার প্রয়োজন বোধ করল না। অগোছালো হাতে পুরো রুমে জুড়ে ঝাড়ু খুঁজল। কাঙ্ক্ষিত জিনিস নাগালে না পেয়ে ধুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানার ওপর। চোখ বন্ধ করে গালি দিল ঝাড়ুর উদ্দেশ্যে,”বালের ঝাড়ু, প্রয়োজনের সময় হেডার চিপায় ঢুকে যায়।
চোখ খুলে পাশ ফিরতেই আহানকে দরজা দিয়ে উঁকি দিতে দেখল নুসরাত। তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে সাবধান করল,”নিউটনের বাচ্চা হাতের কাছে পেয়ে নেই তোকে, ডেমোক্রিটাস এর অ্যাটম বানাবো।

ইসরাত রুমে প্রবেশ করতেই তার পিছু পিছু এসে রুমে প্রবেশ করল আহান। এতক্ষণ ভয়ে রুমে প্রবেশ করেনি সে। ইসরাতের সমান হওয়া ধরুণ সামনের কিছু না দেখায় উঁকি দেয় পেছন থেকে। চোখে ভাসে বিছানায় ঝুলে শুয়ে থাকা নুসরাতকে। ইসরাত রুমের বেহাল অবস্থা দেখে, তা গুছিয়ে রাখতে রাখতে শুধায়,”আহানকে মেরেছিস কেন?
নুসরাত আড় চোখে তাকায় ইসরাতের পেছনে। আহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই লাফ মেরে ওঠে দাঁড়ায়। ব্যঙের ন্যায় লাফিয়ে এসে আহানকে ধরতে যাবে, ইসরাত দু-হাতে দূরে ঠেলে দিল নুসরাতকে। চোখ দিয়ে শাসাল সামনে পা না বাড়ানোর জন্য। নুসরাত থোড়াই পাত্তা দিল, অনিহা নিয়ে আবার এগিয়ে আসতে নিবে ইসরাত শক্ত কন্ঠে বলল,”নুসরাত, মার খাবি!
নুসরাত নিজেও ইসরাতকে ভেঙিয়ে বলে ওঠল,

“নুসরাত, মার খাবি!
পর মূহুর্তে নুসরাত চিরচির করে ওঠল। ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো গর্জে ওঠে বলল,” কী নুসরাত! জানিস কী জিজ্ঞেস করে আমায়? ইথিনের সাথে পানি যোগ না করে কেন অন্য কিছু যোগ করল না কেন? মানে যাতা বললেই হলো! চাচার একমাত্র ছাও নাহলে আজ এর কাম তামাম করে দিতাম। শালা খবিস!
আহান মুখ কাচুমাচু করে ইসরাতের পেছনে দাঁড়িয়ে রইল। একটা বাক্য বের করল না মুখ দিয়ে। পাছে না নুসরাত ওয়াশরুমের জুতো দিয়ে তার পিটাই করে। তার এসব চিন্তার ভেতর ইসরাতের কন্ঠ ভেসে এলো কানে,”তো করতেই পারে! পড়তে এসেছে প্রশ্ন তো করবেই।

আহান সহমত জারী করে মাথা নাড়াল। নুসরাতএসব দেখে মুখ ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। এই মাত্র বড় সড় একটা গালি বের হচ্ছিল তার মুখ দিয়ে। নিজের মুখের মধ্যে হাত চেপে ধরে কর্কশ কন্ঠে বলে ওঠে,”ও বাল করবে বাল। বালের পড়াশোনা করবে। বালের জাতের প্রশ্ন করবে, আবার তার এই জাতের প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে আমাকেই।। এই আইন্সটাইনের সহকর্মীকে বল নিজেই একটা বিক্রিয়া তৈরি করে নিতে। যেখানে অ্যালকিনে না ব্যবহৃত সকল এসিড ব্যবহার করে নতুন আরেকটা বিক্রিয়কের উৎপন্ন করবে। ইথিনের সাথে সালফিউরিক এসিড, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, নাইট্রিক এসিড মিশিয়ে বানাবে নতুন একটা বিক্রিয়া। তারপর বিক্রিয়ার নাম দিবে বালেস্টাইনের বিক্রিয়া।
ইসরাত রাগী চোখে চেয়ে শক্ত চোয়ালে ডেকে ওঠল,

“নুসরাত!
নুসরাত নিজেও ঝাড়ি মেরে ওঠল। চিৎকার করে জিজ্ঞেস করল,” কী?
ইসরাত আহানকে ইশারা করল রুম থেকে বের হওয়ার জন্য,। আহান রুম থেকে বের হওয়ার সময় কার্টুনের মতো মুখ বানিয়ে নুসরাতকে ভেংচি কেটে দৌড় দিল। নুসরাত পেছন থেকে ষাঁড়ের মতো চিৎকার করছে,”দেখেছিস, ইসরাত দেখেছিস! এই টুকু বাচ্চা আমায় ভেংচি কাটে। এই ঘরে তো আগে বড়দের কাছে ইজ্জত ছিল না, আর আগে যা ছিল এখন তাও নেই। বাচ্চা বাচ্চা পোলাপান আমাকে বেজ্জতি করে ছেড়ে দিচ্ছে।

আহান যেতেই ইসরাত দরজার নব ঘুরিয়ে রুম লক করল। নুসরাতের কথা না শোনার মতো উড়িয়ে দিল। বিছানায় বসতে বসতে অন্য কথা তুলল। মোবাইল হাতে নিয়ে নুসরাতকে হাতের ইশারায় কাছে ডাকল। নুসরাত কাছে গিয়ে বসতেই ইসরাত জুতোর একটা অনলাইন শপে ঢুকে নুসরাতকে শুধাল,”কোনটা নিবি? পছন্দ কর!
নুসরাত নাক কুঁচকাল। যার মানে সে কিনবে না। ইসরাত পেইজ স্ক্রল করতে করতে শুধাল,”তাহল কী করবি?
নুসরাত বিটকেল মার্কা হাসি দিয়ে বলে ওঠল,

“টাকা দিয়ে দে।
ইসরাত মাথা নাড়াল। মোবাইলের স্ক্রিনে আবারো চোখে ফেরাতেই কালো কালার এক জোড়া হাই হিল নজর কাড়ল। কমেন্টে জিজ্ঞেস করল,”প্রাইজ?
নুসরাত পাশ থেকে বসে ইসরাতকে উদ্দেশ্য করে গম্ভীর গলায় বলল,”এক্ষুণি এসে বলবে, চিপায় আসুন ম্যাম।
ইসরাত নুসরাতের কথায় উত্তর করল না। কিৎকাল অতিবাহিত হতেই পেইজের মহিলা লিখল ইনবক্সে আসুন। নুসরাত চুটকি বাজিয়ে, মৃদু চিৎকারের সহিত বলে ওঠল,”দেখেছিস বলছে চিপায় আসুন।

গতকাল রাতে নুসরাতের সাথে ঘুমিয়েছিল ইসরাত। সকাল থেকে নুসরাতের দেখা নেই। নুসরাতের বিড়াল, মানে বন্দুকজি ও নুসরাতের খুঁজে মিউ মিউ করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে। ইসরাত সারাবাড়ি জুড়ে অনেকক্ষণ নুসরাতের খোঁজ করল কোথাও পেল না। তারপর হয়রান হয়ে বসে গেল ধুপ করে সোফার ওপর। বিড়ালটা ও ইসরাতের পাশ ঘেঁষে এসে বসল। পায়ের কাছে কাচুমাচু হয়ে শুয়ে পড়ল আরাম করে। ইসরাত ঝুঁকে বিড়ালটা কোলে তুলে নিতে নিতে আবারো এক পলক কিচেনের দিকে চেয়ে দেখল নুসরাত আছে কি নেই। সেখানে নুসরাতের উপস্থিতি না দেখে বিড়ালটা কোলে তুলে অগ্রসর হলো লনের দিকে। এর মধ্যে বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো আহান। স্বাস্থ্য ভালো হওয়ার ধরুণ তাড়াতাড়ি হেঁটে আসায় ঘেমে গিয়েছে মোটাতাজা শরীর। ইসরাত একহাতে বিড়াল চেপে ধরে নিজের সাথে। অন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে আহানের গাল স্পর্শ করে। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,”কী হয়েছে?
আহান হাঁটুতে হাত চেপে ধরে ঝুঁকে শ্বাস ফেলে। শ্বাস প্রশ্বাস চলাচল স্বাভাবিক হতেই মৃদু শব্দে আওড়ায়,”নুসরাত আপুকে আরশ ভাইয়া কাঁধে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।

ইসরাত ঠোঁট ঠোঁট চেপে হেসে ওঠল। ভ্রুক্ষেপহীন গলায় জানতে চাইল,”তো?
আহান শব্দ করে শ্বাস ফেলল। এখনো হয়রানি দূর হয়নি তার। ইসরাতের হাতে বিড়াল দৃষ্টিপটেই পড়তেই সাবধানে দু-হাত দূরে চলে গেল। এতক্ষণ সে দেখেনি বিড়ালের উপস্থিতি এখানে আছে বলে। বিড়ালের সংস্পর্শে তার নাকে চুলকায় তাই এই সতর্কতা অবলম্বন। দূরত্ব রেখে মিনমিনিয়ে শুধাল,”আপু তোমার চিন্তা হচ্ছে না?
ইসরাত দ্বিধাহীন কন্ঠে, সামান্য ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল,”তা হবে কেন?
আহান ইসরাতকে ভালো করে বোঝানোর জন্য চোখ বড় বড় করে আওড়াল,”আপি, তুমি মনে হয় আমার কথা বুঝতে পারোনি। আরশ ভাইয়া নুসরাত আপিকে কাঁধে তুলে নিয়ে গেছে।

ইসরাত এবার ও নিরর্থক অভিমত পোষণ করল। দু-কাঁধ শ্রাগ করে বলে ওঠল,”নিয়ে যেতেই পারেন, ভাইয়ার মিসেস উনি। এখানে আমার হাত ঢোকানো বেমানান।
আহান ইসরাতের শেষের কথা শুনল না। মুখ ঝামটা মেরে চলে গেল বাড়িতে ফিরে যাওয়ার জন্য। এই আপি ও বুঝে না কিছু! এত করে বলছে আপুকে তুলে নিয়ে গিয়েছে, চিন্তা করবে তা না করে হে হে করে হাসছে।

হাতের মুঠোয় আটালো কিছু অনূভুতি হতেই ঝিমিয়ে ওঠল নুসরাত। হাত নাড়ানোর চেষ্টা করল, কিন্তু এক বিন্দু হাত নড়ল না ওই স্থান থেকে। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই কোনো আলোর রশ্মির দেখা পেল না। মাথা তুলে আশেপাশে চোখ বুলালো। ঘাড়ে অস্বাভাবিক ব্যথায় ঘাড় নাড়ানোর ক্ষমতা প্রায় নেই। অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মুখ দিয়ে বের হয়ে আসলো কিছু ব্যাথাতুর শব্দ। চোখের পাপড়ি ঝাপটালো দুয়েকবার। চোখ অন্ধকার সয়ে আসতেই সবকিছু এবার পরিস্কার হয়ে আসলো। নাকে ভ্যাপসা কিছু একটার গন্ধ ও লাগল। ছোটো ছোটো চুলগুলো ঘামের সাথে আটার মতো লেগে আছে। যার কিছু অংশ নাকে আর কিছু অংশ চোখে উড়াউড়ি করছে।

নুসরাত বেমালুম ভুলে বসে আছে তার হাত বাঁধা।আবারো চুল সরানোর বৃথা প্রচেষ্টা করার জন্য হাত নাড়াতেই মাথায় আটল তার হাত তো বাঁধা। চুল নাকের ভেতর ঢোকায় কিছু একটা হচ্ছে। নুসরাত হাফসাফ করে ওঠল। হাত খোলার চেষ্টা করল, হলো না। এবার পা নাড়াতে যাবে তা ও বাঁধা চেয়ারের সাথে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এক কোন মহাবিপদে পড়েছে সে। সেকেন্ডের মধ্যে রাগ চড়ে বসল মাথায়। কোন গাধা তাকে এভাবে বেঁধে রেখেছে? চিন্তায় হাতের নখ খাওয়ার জন্য হাত নাড়াতেই মনে পড়ল বেঁধে রেখেছে তাকে। অনিশ্চিত কিছুই বুক কাঁপল সামান্য তার। চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে ওঠবে, পুরুষালি গলার শব্দ ভেসে এলো,”তাহলে মিসেসের ঘুম ভেঙেছে।

নুসরাতের সেকেন্ড লাগল না গলার ভয়েজ চিনতে। আরশের গলার ভয়েজ শুনেই কিৎকাল চুপচাপ বসে রইল। হাত ছুটানোর জন্য এতক্ষণের মোচড়া মুচড়ি ও থেমে গেছে অনেক আগেই। দ্বিধা ভরা চোখে যখন নুসরাত সামনে তাকিয়ে তখন গটগট কিছু শব্দ নুসরাতের কানে ভেসে আসলো। নিজের সান্নিধ্যে কারোর উপস্থিতি পেতেই শক্ত হয়ে আসলো পুরো মেয়েলি শরীর। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চাপল নিজেকে স্বাভাবিক রাখার জন্য। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করল আলো জ্বালানো নয় বলে। নুসরাতের শুকরিয়া আদায় শেষ হতেই রুম জুড়ে জ্বলে ওঠল তীব্র আলোর রশ্মির ছটা। চোখ খিঁচে নিল সে। হঠাৎ এত আলো সহ্য করতে পারল না অক্ষিপট। নিজেকে স্থির করে নিয়ে চোখ খুলল যখন, তখন আরশকে নিজের সামনে বসা দেখল। চেয়ার পিছনে কিছুটা সরানোর জন্য গা দিয়ে ধাক্কা দিতেই ব্যালেন্স হারিয়ে পড়ে যেতে নিবে আরশ একহাতে তা টেনে ধরল। ধারালো পুরুষালি চোয়ালে হাত বুলিয়ে নিয়ে হাসল সামান্য। নুসরাতের গায়ের ভরে সামান্য পরিমাণ চেয়ার পেছনে সরাতে, তা টেনে ধরে নিজের একদম সন্নিকটে নিয়ে আসলো। সাবধানী কন্ঠে নিজস্ব ভঙ্গিমায় বলে ওঠল,”নড়চড় বন্ধ কর! নাহলে লাত্তি খাবি।

নুসরাতের চোয়াল ঝুলে গেল। চুপসানো মুখে যখন কিছু বলতে নিবে, আরশ হাত তুলে থামিয়ে দিল। উজ্জ্বল শ্যামলা মুখখানা কালো করে, সোজাসুজি প্রশ্ন ছুঁড়ল,”কারোর সাথে পরকিয়ায় লিপ্ত ছিলি?
নুসরাত চোখ উল্টালো। আরশকে ভেংচি কেটে, ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলতে নিবে আরশ টেপ মেরে দিল নুসরাতের মুখে। অনিহা নিয়ে দু-হাত উপরে তুলে আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে নুসরাতকে ঠাট্টা করে বলে ওঠল,”তোর কথা শুনতে ইচ্ছে করছে না এখন। তুই না হয় চুপ করেই থাক!
নুসরাত চোখ বড় বড় আরশের পানে তাকিয়ে থাকল। আরশ নিজের বলিষ্ঠ এক হাত বাড়িয়ে বুড়ো আঙুল দিয়ে নুসরাতের গাল স্পর্শ করল। ছোটো ছোটো চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে নিজের কথার সুর বদলে ফেলল। ভিন্ন স্বরে বলে ওঠল,”তোর চুলগুলোকে আমি ঘৃণা করি।

নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে চুপচাপ শুধু লক্ষ করল তার সামনে বসা সুঠাম দেহি লোকটাকে। মনের ভেতর কিছু বলার ইচ্ছে জাগলেও তা চাপা দিতে হলো টেপের জন্য। আরশের হাত থেকে নিজের মুখ রক্ষা করার জন্য অন্যপাশে তা ঘুরিয়ে ফেলল। আরশ তা দেখে হেসে ফেলল শব্দ করে। আর তাতেই গালের বাঁ-পাশ দিয়ে গর্তের সৃষ্টি হলো। হাসতে হাসতে যখন টেপ খুলে দিবে নুসরাতের মুখ থেকে, ইরহাম এসে প্রবেশ করল সেখানে। অবাক নয়নে দু-জনের উপর নিচ চোখ বুলালো। তার পিছু পিছু এসে প্রবেশ করল মাহাদি। কপালে এখনো প্লাস্টার স্থায়ী।
দু-জনেই বোকার মতো দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ করল আরশের হাসি। গতকাল এই লোকই তো তাদের দু-জনকে হয়রান করে ফেলেছিল এই মহিলার জন্য। আর আজ এই লোক হে হে করে রুম কাঁপিয়ে হাসছে বউয়ের সামনে বসে। এই দু-জনের সমস্যা কী! সবাইকে টেনশন দিয়ে মারবে কিন্তু ভেতরে ভেতরে সবকিছুই ঠিক দু-জনের মধ্যে। তাদের অবাক হয়ে লক্ষ করার মধ্যে কানে ভেসে আসলো নুসরাতের কর্কশ কন্ঠ, সে বলছে,”হয়েছে আর হাসতে হবে না। একটা মানুষের হাসি এত বাজে কীভাবে হয়, তা আপনাকে না দেখলেই বুঝতেই পারতাম না!

আরশের হাসি আরো দীর্ঘ হলো। নুসরাতের কথায় সে ভ্রক্ষেপই করল না। নিজ মনে হাসল অনেকক্ষণ। অতঃপর নড়েচড়ে বসে, আগের জায়গায় ফিরে গিয়ে শক্ততার সহিত জিজ্ঞেস করল,”তুই পরকীয়া করেছিস?
নুসরাত নির্বিকার চিত্তে আরশের চোখে চোখ রেখে চেয়ে রইল। নিজে প্রশ্ন ছুঁড়ল,”কীসের পরকীয়া?
আরশ ঘন ঘন শ্বাস ফেলে, নুসরাতকে সাবধানী বাণী দিল,”মিথ্যা বলবি না, তুই রিলেশনে ছিলি না?
নুসরাত মাথা নাড়াল বোঝার মতো করে।নির্দ্বিধায় স্বীকারক্তি দিল,”তো আমি অস্বীকার করেছি কখন?
আরশ গর্জে ওঠার মতো করল। রাগী চোখ নুসরাতের ওপর নিচ বুলিয়ে একহাতে নুসরাতের গাল চেপে ধরল। দাঁতের পাটি একটার সাথে অন্যটা চেপে ধরে কড়মড় করে আওড়াল,”বেইমান মহিলা। জামাই থাকতে পরকীয়া করিস? জানে মেরে ফেলব একদম।

নুসরাতের অনুভূত হলো আরশের হাতের চাপে মুখের ভেতরের কোষগুলো মড়মড় করে ভেঙে যাবে। তবুও তার পরোয়া না করে মুখ নাড়াল। চোখ দুটো উল্টে আরশকে ভেঙিয়ে নুসরাত ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে ওঠে,”জানে মেরে ফেলব একদ…!
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই আরো জোরে চাপ পড়ল গালে। ব্যথায় চোখ খিঁচে নিল সে। তবু্ও আরশের বিন্দুমাত্র ভ্রক্ষেপ হলো না। ইরহাম আর মাহাদিকে চোখের ইশারায় বের হতে বলল রুম থেকে। তারা বের হতেই আরশ রাগে হিসহিস করতে করতে বলল,”মরার শখ জেগেছে তোর? একদম জানে মেরে ফেলব নুসরাত। দেখব না তুই আমার সামনে। বেয়াদ্দব মহিলা। জামাই থাকতে পরকীয়া করিস?
নুসরাত অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২০

“কে জামাই?
আরশ শীতল কন্ঠে, নুসরাতকে কিছুটা হুশিয়ারি দিয়ে বলে ওঠল,”আমি।
তখনো হাত স্থায়ী গালে। নুসরাত ব্যথা সহ্য করতে না পেরে নিজের মাথা দিয়ে আরশের মাথায় আঘাত করার চেষ্টা করল। রাগী কন্ঠে চিৎকার করে বলে ওঠল,”তুই আমার সাউয়ার জামাই!

প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here